রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ

ভূমিকা অধ্যায়

হাদীস নং: ৫১৯
ভূমিকা অধ্যায়
অধ্যায়ঃ ৫৬ অনাহারে থাকা, কৃচ্ছতাপূর্ণ জীবনযাপন করা, অল্প পানাহার, অল্প পোশাক ও অল্প ভোগে পরিতুষ্ট থাকা এবং চাহিদা ত্যাগের ফযীলত।
খন্দকের যুদ্ধকালে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে হযরত জাবির রাযি.-এর মেহমানদারি : খাদ্যের ভেতর মু'জিযার প্রকাশ
হাদীছ নং : ৫১৯

অর্থ : হযরত জাবির রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, খন্দকের যুদ্ধকালে আমরা পরিখা খনন করছিলাম। এ অবস্থায় একটি বিরাট কঠিন পাথর প্রকাশ পেল। সাহাবীগণ নবী সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে বললেন, এই একটি কঠিন পাথর, পরিখার মধ্যে দেখা দিয়েছে। তিনি বললেন, আমি নামছি। এই বলে তিনি উঠলেন। তখন তাঁর পেটে একটি পাথর বাঁধা ছিল। –আমরা তিনদিন এভাবে কাটাচ্ছিলাম যে, কোনও খাদ্য চেখে দেখতে পারিনি– নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোদাল হাতে নিয়ে পাথরটিতে আঘাত করলেন। অমনি সেটি ঝরঝরে বালুরাশিতে পরিণত হয়ে গেল। আমি বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমাকে বাড়িতে যাওয়ার অনুমতি দিন।
আমি (বাড়িতে গিয়ে) স্ত্রীকে বললাম, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এমন অবস্থায় দেখেছি, যা সহ্য করা যায় না। তোমার কাছে কিছু আছে কি? তিনি বললেন, আমার কাছে কিছু যব ও একটি বকরির বাচ্চা আছে। আমি বাচ্চাটি জবাই করলাম এবং যব পিষলাম। তারপর হাঁড়িতে গোশত চড়িয়ে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে চলে আসলাম। ততক্ষণে আটা নরম হয়ে রুটি তৈরির উপযুক্ত হয়ে গেছে আর চুলার উপর হাঁড়ি (-এর গোশত) প্রায় সেদ্ধ হয়ে এসেছে।
আমি বললাম, আমার ঘরে সামান্য কিছু খাবার আছে ইয়া রাসূলাল্লাহ, আপনি উঠুন এবং আপনার সঙ্গে দু'-একজন লোকও। তিনি বললেন, তা কী পরিমাণ? আমি তাঁর কাছে পরিমাণ বললাম। তিনি বললেন, প্রচুর (ও) উত্তম (খাবার)। তুমি তাকে (স্ত্রীকে) বলো, আমি না আসা পর্যন্ত যেন চুলা থেকে হাঁড়ি ও রুটি না নামায়।
তারপর বললেন, তোমরা চলো। অমনি মুহাজির ও আনসারগণ উঠে পড়লেন। আমি স্ত্রীর কাছে এসে বললাম, সর্বনাশ! নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং আনসার- মুহাজির ও তাঁদের সঙ্গের সকলে চলে এসেছেন। তিনি বললেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কি আপনাকে কিছু জিজ্ঞেস করেছিলেন? বললাম, হাঁ।
তারপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমরা প্রবেশ করো কিন্তু ভীড় করো না। তিনি রুটি টুকরো টুকরো করে তার উপর গোশত রাখতে থাকলেন। প্রত্যেকবার তা নেওয়ার পর হাঁড়ি ও চুলা ঢেকে রাখছিলেন আর তা সাহাবীদের দিকে এগিয়ে নিচ্ছিলেন। তারপর আবার তা থেকে বের করছিলেন। এভাবে তিনি রুটি টুকরো টুকরো করতে থাকলেন এবং হাঁড়ি থেকেও গোশত নিতে থাকলেন। এমনকি সকলে পরিতৃপ্ত হয়ে গেলেন। তারপরও কিছু অবশিষ্ট থাকল। তিনি (জাবির রাযি. এর স্ত্রীকে) বললেন, তুমি এটি খাও এবং হাদিয়া দাও। মানুষ বড় ক্ষুধার্ত - বুখারী ও মুসলিম ।
অপর এক বর্ণনায় আছে, হযরত জাবির রাযি. বলেন, যখন পরিখা খনন করা হয়, আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ক্ষুধার্ত দেখতে পেলাম। আমি স্ত্রীর কাছে ফিরে আসলাম। বললাম, তোমার কাছে কিছু আছে কি? আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে প্রচণ্ড ক্ষুধার্ত দেখেছি। সে আমার সামনে এক সা পরিমাণ যবের একটি থলি বের করল। আর আমাদের একটি পালিত ভেড়ার বাচ্চা ছিল। আমি সেটি জবাই করলাম আর স্ত্রী যব পিষল। আমার কাজ শেষ হতে হতে তারও কাজ শেষ হয়ে গেল। আমি গোশত টুকরো টুকরো করে হাঁড়িতে রাখলাম। তারপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে ছুটে চললাম।
স্ত্রী বললেন, দেখুন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সঙ্গীদের কাছে আমাকে যেন বেইজ্জত না করেন।
আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে আসলাম এবং তাঁর কানে কানে বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমরা একটি ভেড়ার বাচ্চা জবাই করেছি আর আমার স্ত্রী এক সা পরিমাণ যব পেষণ করেছে। আপনি কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে আসুন।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উচ্চ আওয়াজে বললেন, ওহে পরিখা খননকারীগণ! জাবির তোমাদের জন্য ভোজের আয়োজন করেছে। তোমরা দ্রুত চলো। তারপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বললেন, আমি না আসা পর্যন্ত তোমরা হাঁড়ি নামিয়ো না এবং খামিরা দিয়ে রুটি বানিয়ো না। আমি বাড়িতে চলে আসলাম। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম লোকদের সামনে সামনে আসতে থাকলেন।
বাড়ি এসে পৌঁছালে স্ত্রী আমাকে মুখঝামটা দিতে থাকলেন। আমি বললাম, তুমি আমাকে যা যা বলতে বলেছিলে তা তো বলেছি। যাহোক, তারপর তিনি খামির বের করলেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাতে নিজ থুতু ছিটিয়ে দিলেন এবং বরকতের দু'আ করলেন। তারপর হাঁড়ির কাছে আসলেন এবং তাতে থুতু ছিটিয়ে দিলেন ও বরকতের দু'আ করলেন। তারপর বললেন, কোনও রাঁধুনীকে ডাকো, সে এসে তোমার সঙ্গে রুটি তৈরি করুক। হাঁড়ি থেকে গোশত বের করো, কিন্তু চুলা থেকে নামিয়ো না ।
আগত লোকসংখ্যা ছিল এক হাজার। আল্লাহর কসম দিয়ে বলছি, তারা সকলেই (পেট ভরে) খেলেন এবং কিছু অবশিষ্টও রাখলেন। তারপর তারা চলে গেলেন। তখনও আমাদের হাঁড়ি আগের মতই শব্দ করে ফুটছিল এবং আমাদের খামির দ্বারা আগের মতোই রুটি তৈরি করা যাচ্ছিল।
مقدمة الامام النووي
56 - باب فضل الجوع وخشونة العيش والاقتصار على القليل من المأكول والمشروب والملبوس وغيرها من حظوظ النفس وترك الشهوات
519 - وعن جابر - رضي الله عنه - قَالَ: إنَّا كُنَّا يَوْمَ الْخَنْدَقِ نَحْفِرُ، فَعَرَضَتْ كُدْيَةٌ شَدِيدَةٌ، فَجَاؤُوا إِلَى النبي - صلى الله عليه وسلم - فقالوا: هذِهِ كُدْيَةٌ عَرَضَتْ في الخَنْدَقِ. فَقَالَ: «أنَا نَازِلٌ» ثُمَّ قَامَ، وَبَطْنُهُ مَعْصُوبٌ بِحَجَرٍ، وَلَبِثْنَا ثَلاَثَة أيّامٍ لاَ نَذُوقُ ذَوَاقًا، فَأخَذَ النبي - صلى الله عليه وسلم - المِعْوَلَ، فَضَرَبَ فَعَادَ كَثيبًا أهْيَلَ أَو أهْيَمَ، فقلت: يَا رسول الله، ائْذَنْ لي إِلَى البَيْتِ، فقلتُ لامْرَأتِي: رَأيْتُ بالنَّبيِّ - صلى الله عليه وسلم - شَيئًا مَا في ذَلِكَ صَبْرٌ فَعِنْدَكِ شَيْءٌ؟ فقالت: عِنْدي شَعِيرٌ وَعَنَاقٌ (1)، فَذَبَحْتُ العَنَاقَ وَطَحَنْتُ الشَّعِيرَ حَتَّى جَعَلْنَا اللَّحْمَ في البُرْمَةِ، ثُمَّ جِئْتُ النبي - صلى الله عليه وسلم - وَالعَجِينُ قَدِ انْكَسَرَ، وَالبُرْمَةُ بَيْنَ الأثَافِيِّ قَدْ كَادَتْ تَنْضِجُ، فقلتُ: طُعَيْمٌ لي، فَقُمْ أنْتَ يَا رسول اللهِ وَرَجُلٌ أَوْ رَجُلانِ، قَالَ: «كَمْ هُوَ»؟ فَذَكَرْتُ لَهُ، فَقَالَ: «كثيرٌ طَيِّبٌ قُل لَهَا لاَ تَنْزَع البُرْمَةَ، وَلاَ الخبْزَ مِنَ التَّنُّورِحتى آتِي» فَقَالَ: «قُومُوا»، فقام المُهَاجِرُونَ وَالأنْصَارُ، فَدَخَلْتُ عَلَيْهَا فقلتُ: وَيْحَكِ قَدْ جَاءَ النبيُّ - صلى الله عليه وسلم - وَالمُهَاجِرُونَ وَالأنْصَارُ ومن مَعَهُمْ! قالت: هَلْ سَألَكَ؟ قُلْتُ: نَعَمْ، قَالَ: «ادْخُلُوا وَلاَ تَضَاغَطُوا» فَجَعَلَ يَكْسرُ الخُبْزَ، وَيَجْعَلُ عَلَيْهِ اللَّحْمَ، وَيُخَمِّرُ البُرْمَةَ (2) وَالتَّنُّور إِذَا أخَذَ مِنْهُ، وَيُقَرِّبُ إِلَى أصْحَابِهِ ثُمَّ يَنْزعُ، فَلَمْ يَزَلْ يِكْسِرُ وَيَغْرِفُ حَتَّى شَبِعُوا، وَبَقِيَ مِنْهُ، فَقَالَ: «كُلِي هَذَا وَأهِدي، فَإنَّ النَّاسَ أصَابَتْهُمْ مَجَاعَةٌ». متفقٌ عَلَيْهِ. (3)
وفي رواية قَالَ جابر: لَمَّا حُفِرَ الخَنْدَقُ رَأيْتُ بالنبيِّ - صلى الله عليه وسلم - خَمَصًا، فَانْكَفَأْتُ إِلَى امْرَأتِي، فقلت: هَلْ عِنْدَكِ شَيْءٌ؟ فَإنّي رَأيْتُ برسول الله - صلى الله عليه وسلم - خَمَصًا شَديدًا، فَأخْرَجَتْ إلَيَّ جِرَابًا فِيه صَاعٌ مِنْ شَعِيرٍ، وَلَنَا بَهِيمَةٌ دَاجِنٌ فَذَبَحْتُهَا، وَطَحَنتِ الشَّعِيرَ، فَفَرَغَتْ إِلَى فَرَاغي، وَقَطَعْتُهَا في بُرْمَتها، ثُمَّ وَلَّيْتُ إِلَى رسول الله - صلى الله عليه وسلم - فقالت: لاَ تَفْضَحْنِي برسول الله - صلى الله عليه وسلم - وَمَنْ مَعَهُ، فَجئتهُ فَسَارَرْتُهُ، فَقُلْتُ: يَا رسول الله، ذَبَحْنَا بهيمَة لَنَا، وَطَحَنْتُ صَاعًا مِنْ شَعِيرٍ، فَتَعَالَ أنْتَ وَنَفَرٌ مَعَكَ، فَصَاحَ رسول الله - صلى الله عليه وسلم - فَقَالَ: «يَا أهلَ الخَنْدَقِ: إنَّ جَابِرًا قَدْ صَنَعَ سُؤْرًا فَحَيَّهَلا بِكُمْ» فَقَالَ النبي - صلى الله عليه وسلم: «لاَ تُنْزِلُنَّ بُرْمَتَكُمْ وَلاَ تَخْبزنَّ عَجِينَكُمْ حَتَّى أجِيءَ» فَجِئْتُ، وَجَاءَ النبي - صلى الله عليه وسلم - يَقْدُمُ النَّاسَ، حَتَّى جِئْتُ امْرَأتِي،
فقالَتْ: بِكَ وَبِكَ! فقُلْتُ: قَدْ فَعَلْتُ الَّذِي قُلْتِ. فَأخْرَجَتْ عَجِينًا، فَبسَقَ فِيهِ وَبَاركَ، ثُمَّ عَمَدَ إِلَى بُرْمَتِنا فَبصَقَ وَبَارَكَ، ثُمَّ قَالَ: «ادْعِي خَابزَةً فَلْتَخْبِزْ مَعَكِ، وَاقْدَحِي مِنْ بُرْمَتِكُمْ، وَلاَ تُنْزِلُوها» وَهُم ألْفٌ، فَأُقْسِمُ بِالله لأَكَلُوا حَتَّى تَرَكُوهُ وَانْحَرَفُوا، وَإنَّ بُرْمَتَنَا لَتَغِطّ كَمَا هِيَ،
وَإنَّ عَجِينَنَا لَيُخْبَزُ كَمَا هُوَ.
قَوْله: «عَرَضَتْ كُدْيَةٌ» بضم الكاف وإسكان الدال وبالياء المثناة تَحْتَ، وَهِيَ قِطْعَةٌ غَلِيظَةٌ صُلْبَةٌ مِنَ الأرضِ لاَ يَعْمَلُ فِيهَا الفَأسُ، وَ «الكَثيبُ» أصْلُهُ تَلُّ الرَّمْل، وَالمُرَادُ هُنا: صَارَتْ تُرابًا نَاعِمًا، وَهُوَ مَعْنَى «أهْيَلَ». وَ «الأَثَافِيُّ»: الأحجَارُ الَّتي يكُونُ عَلَيْهَا القِدْرُ، وَ «تَضَاغَطُوا»: تَزَاحَمُوا. وَ «المَجَاعَةُ»: الجُوعُ، وَهُوَ بفتح الميم. وَ «الخَمَصُ»: بفتح الخاء المعجمة والميم: الجُوعُ، وَ «انْكَفَأتُ»: انْقَلَبْتُ وَرَجَعْتُ. و «البُهَيْمَةُ» بضم الباء، تصغير بَهْمَة وَهيَ، العَنَاقُ، بفتح العين. وَ «الدَّاجِنُ»: هِيَ الَّتي ألِفَتِ البَيْتَ: وَ «السُّؤْرُ» الطَّعَامُ الَّذِي يُدْعَى النَّاسُ إِلَيْهِ؛ وَهُوَ بالفَارِسيَّة. وَ «حَيَّهَلا» أيْ تَعَالُوا. وَقَوْلُهَا «بك وَبكَ» أيْ خَاصَمَتْهُ وَسَبَّتْهُ، لأَنَّهَا اعْتَقَدَتْ أنَّ الَّذِي عِنْدَهَا لاَ يَكْفِيهمْ، فَاسْتَحْيَتْ وَخَفِيَ عَلَيْهَا مَا أكْرَمَ الله سُبْحَانَهُ وَتَعَالَى بِهِ نَبِيَّهُ - صلى الله عليه وسلم - مِنْ هذِهِ المُعْجِزَةِ الظَّاهِرَةِ وَالآية البَاهِرَةِ. «بَسَقَ» أيْ: بَصَقَ؛ وَيُقَالُ أيْضًا: بَزَقَ، ثَلاث لُغاتٍ. وَ «عَمَدَ» بفتح الميم، أيْ: قَصَدَ. وَ «اقْدَحي» أيْ: اغْرِفِي؛ وَالمِقْدَحَةُ: المِغْرَفَةُ. وَ «تَغِطُّ» أيْ: لِغَلَيَانِهَا صَوْتٌ، والله أعلم.

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীছটির ঘটনা খন্দকের যুদ্ধকালীন। খন্দকের যুদ্ধের অপর নাম আহযাবের যুদ্ধ। এর বিবরণ ৭৪ নং হাদীসে গত হয়েছে।

হযরত জাবির ইবন আব্দুল্লাহ রাযি. এ বর্ণনায় খন্দকের যুদ্ধকালীন একদিনের ঘটনা বর্ণনা করেছেন যে, পরিখা খননকালে একটি বিশাল কঠিন পাথর প্রকাশ পেয়েছিল। সাহাবায়ে কেরামের পক্ষে সেটি ভেঙ্গে খননের কাজ চালানো সম্ভব হচ্ছিল না। শেষে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেই নেমে তার উপর কুড়াল চালালেন। অমনি সেটি ঝরঝরে বালুরাশিতে পরিণত হয়ে গেল।

যখন তিনি পাথরটির উপর কুঠার চালাচ্ছিলেন, তখন তিনি অত্যন্ত ক্ষুধার্ত ছিলেন। ক্ষুধার কষ্ট লাঘবের উদ্দেশ্যে তাঁর পেটে পাথর বাঁধা ছিল। যেখানে যুবক ও শক্তিশালী সাহাবীদের পক্ষে পাথরটি ভাঙ্গা সম্ভব হচ্ছিল না, সেখানে ক্ষুধার্ত অবস্থায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কুঠারের আঘাতে সেটি কীভাবে ভেঙ্গে গেল, বিশেষত যখন তাঁর পেটে পাথরও বাঁধা? নিশ্চয়ই এটা ছিল তাঁর একটি মু'জিযা। এর বিস্তারিত বিবরণ হযরত বারা' ইবন আযিব রাযি.-এর একটি বর্ণনায় আছে। তাতে বলা হয়েছে-
فقال: «بسم الله» فضرب ضربة، فكسر ثلث الحجر، وقال: «الله أكبر أعطيت مفاتيح الشام، والله إني لأبصر قصورها الحمر من مكاني هذا». ثم قال: «بسم الله» وضرب أخرى، فكسر ثلث الحجر، فقال: «الله أكبر، أعطيت مفاتيح فارس، والله إني لأبصر المدائن، وأبصر قصرها الأبيض من مكاني هذا»، ثم قال: «بسم الله وضرب ضربة أخرى فقلع بقية الحجر، فقال: «الله أكبر أعطيت مفاتيح اليمن، والله إني لأبصر أبواب صنعاء من مكاني هذا
‘তিনি বিসমিল্লাহ বলে পাথরে একটি আঘাত করলেন। পাথরটির তিন ভাগের একভাগ কেটে গেল। তিনি বললেন, আল্লাহু আকবার, আমাকে শামের চাবিগুলো দিয়ে দেওয়া হয়েছে। আল্লাহর কসম, আমি এই মুহূর্তে তথাকার লাল প্রাসাদগুলো দেখতে পাচ্ছি। তারপর দ্বিতীয় আঘাত করলেন। তাতে তিন ভাগের আরও একভাগ কেটে গেল। তিনি বলে উঠলেন, আল্লাহু আকবার, আমাকে পারস্যের চাবিসমূহ দিয়ে দেওয়া হয়েছে। আল্লাহর কসম, আমি এই মুহূর্তে (পারস্যের রাজধানী) মাদাইনের শ্বেত প্রাসাদ দেখতে পাচ্ছি। তারপর তৃতীয় আঘাত করলেন এবং বললেন, বিসমিল্লাহ। এবার পাথরটির অবশিষ্টাংশ কেটে গেল। তিনি বলে উঠলেন, আল্লাহু আকবার, আমাকে ইয়ামানের চাবিসমূহ দিয়ে দেওয়া হয়েছে। আল্লাহর কসম, আমি এই মুহূর্তে এ জায়গা থেকে (রাজধানী) সান'আর দরজাগুলো দেখতে পাচ্ছি।

অপর এক বর্ণনায় আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রত্যেক আঘাতে পাথরটি থেকে আগুনের ফুলকি বের হয়েছিল এবং তার আলোয় সমগ্র মদীনা আলোকিত হয়ে উঠেছিল। প্রত্যেকবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহু আকবার বলে উঠেন এবং তাঁর সঙ্গে সাহাবীগণও। শেষে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জানান যে, সে আগুনের আলোয় তিনি একেকটি দেশের অট্টালিকাসমূহ দেখতে পেয়েছিলেন আর হযরত জিবরাঈল আলাইহিস সালাম তাঁকে সুসংবাদ শুনিয়েছিলেন যে, তাঁর উম্মত এসব দেশ জয় করবে।

এ যুদ্ধকালে সবাই ছিলেন ক্ষুধার্ত। তিনদিন পর্যন্ত কারও কিছু খাওয়া হয়নি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পেটে পাথর বেঁধে রেখেছিলেন। আরও অনেক সাহাবীর পেটে পাথর বাঁধা ছিল। হযরত জাবির রাযি. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ক্ষুধার্ত অবস্থা সইতে পারছিলেন না। একটা কিছু ব্যবস্থা করার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠলেন। অনুমতি নিয়ে বাড়িতে গেলেন। বাড়িতে কিছু যব ও একটি বকরির বাচ্চা ছিল। তা দ্বারা খাওয়ার ব্যবস্থা করে তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে চলে আসলেন। হযরত জাবির রাযি. বলেন-
فقلت : طعيم لي ، فقم أنت يا رسول الله ورجل او رجلان (আমি বললাম, আমার সামান্য কিছু খাবার আছে। ইয়া রাসূলাল্লাহ, আপনি উঠুন এবং আপনার সঙ্গে দু-একজন লোকও)। এক বর্ণনায় আছে, খাবার খুব কম থাকায় তিনি চাচ্ছিলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একাই যান। তাঁর স্ত্রীও সতর্ক করে দিয়েছিলেন যাতে বেশি লোক নিয়ে না আসেন। যেমন পরের রেওয়ায়েতে আছে-
لا تفضحني برسول الله ﷺ ومن معه (দেখুন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সঙ্গীদের কাছে আমাকে যেন বেইজ্জত না করেন)। অর্থাৎ আমাদের খাবার তো খুব কম। যদি বেশি লোক নিয়ে আসেন, আমরা তাদের তৃপ্তিভরে খাওয়াতে পারব না। সেটা আমাদের জন্য বড় লজ্জার কারণ হবে। তাই বুঝেশুনে মেহমান আনবেন।

এ কারণেই হযরত জাবির রাযি. শুরুতে বলে নিয়েছেন আমার সামান্য কিছু খাবার আছে। পরের বর্ণনায় আছে যে, তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কানে কানে খাদ্যের পরিমাণ উল্লেখ করেছিলেন যে, তা একটি ছাগল এবং এক সা' পরিমাণ যব। কিন্তু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেই সামান্য খাবার সবাই মিলে খেতে চাইলেন। তাই আনসার ও মুহাজির যারাই খন্দক খননের কাজে নিয়োজিত ছিলেন, সবাইকেই সঙ্গে যাওয়ার জন্য বললেন। যেমন পরের রেওয়ায়েতে আছে, তিনি ডেকে বললেন-
يا أهل الخندق : إن جابرا قد صنع سورا فحيهلا بكم (হে পরিখা খননকারীগণ। জাবির তোমাদের জন্য ভোজের আয়োজন করেছে। তোমরা দ্রুত চলো)। তিনি তো সম্পূর্ণরূপে তাওয়াক্কুল করে অভ্যস্ত। বিশ্বাস ছিল আল্লাহ তা'আলার উপর যথাযথ ভরসা করে খেলে এই সামান্য খাবারই সকলের জন্য যথেষ্ট হয়ে যাবে। সেইসঙ্গে তিনি হযরত জাবির রাযি.-কেও এই বলে আশ্বস্ত করলেন যে, (তুমি যাকে অল্প বলছ, প্রকৃতপক্ষে তা) প্রচুর (ও) উত্তম (খাবার)।

তারপর তিনি খাদ্যে বরকত হওয়ার লক্ষ্যে হযরত জাবির রাযি.-কে বললেন, তুমি তাকে (স্ত্রীকে) বলো আমি না আসা পর্যন্ত যেন চুলা থেকে হাঁড়ি ও রুটি না নামায়। তারপর তিনি আনসার ও মুহাজিরদের নিয়ে হযরত জাবির রাযি.-এর বাড়িতে গিয়ে পৌঁছলেন। এত লোক দেখে তাঁর স্ত্রী ভড়কে গেলেন। প্রথমে তো স্বামীকে নানা কথা বলে তিরস্কার করলেন।

এক বর্ণনায় আছে, হযরত জাবির রাযি. নিজেও খুব পেরেশান হয়ে পড়েছিলেন। তিনি বলেন, এতসংখ্যক লোক আসায় আমি যে কী পরিমাণ লজ্জাবোধ করছিলাম তা আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না। মনে মনে বললাম, মাত্র এক সা' যব ও একটি ছাগলছানা, অথচ মেহমান এত লোক! এখন কী হবে?

তাঁর স্ত্রী ছিলেন খুবই বুদ্ধিমতী। তিনি যখন জানতে পারলেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সবই জানানো হয়েছে, তখন তিনি আশ্বস্ত হয়ে গেলেন যে, তিনি জেনেশুনেই যখন এত লোক নিয়ে এসেছেন, তখন নিশ্চয়ই এর মধ্যে কোনও হেকমত আছে। পেরেশানির কোনও কারণ নেই। হয়তো তাঁর উপস্থিতির বরকতে এ সামান্য খাবারেই সকলের প্রয়োজন মিটে যাবে।

বাড়িতে পৌঁছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রথমে আটার খামিরায় ও গোশতের হাঁড়িতে খানিকটা থুতু দিলেন। সঙ্গে বরকতের জন্য দুআ করলেন। সেইসঙ্গে রুটি তৈরি করতে পারে এমন কোনও প্রতিবেশী মহিলাকে ডেকে আনার হুকুম করলেন।

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মুখের থুতু অন্যদের মত নয়। তাঁর শরীরের ঘামেও তো ছিল মিশকের চেয়েও বেশি সুরভি। সুতরাং পবিত্র মুখের থুতুতে অমৃতের আস্বাদ ও প্রাণকাড়া সুরভি তো থাকবেই। তাই খাবারে তা দেওয়াতে খাবারের অমর্যাদা হয়নি; বরং তা স্বতন্ত্র মহিমা লাভ করেছে। পবিত্র মুখের সে থুতুর সঙ্গে ছিল দু'আর মিলন। নূরুন ‘আলা নূর। বরকত তখনই শুরু হয়ে গিয়েছিল। আটার খামিরা যদিও সামান্য, কিন্তু সে বরকতের কারণে রুটি তৈরিতে সাহায্যকারীর প্রয়োজন পড়েছিল।

সুতরাং রুটি তৈরি হতে থাকল। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে তা বিতরণের দায়িত্ব নিলেন। তিনি রুটি টুকরো টুকরো করে তার উপর গোশত রাখতে থাকলেন। প্রত্যেকবার তা নেওয়ার পর হাঁড়ি ও চুলা ঢেকে রাখছিলেন আর তা সাহাবীদের দিকে এগিয়ে দিচ্ছিলেন। এভাবে সে খাবার খেয়ে সকলে পরিতৃপ্ত হয়ে গেলেন। তারপরও কিছু অবশিষ্ট থাকল। বরং দ্বিতীয় বর্ণনা দ্বারা জানা যায়, আটার খামিরা ও হাঁড়ির গোশত আগে যেমন ছিল তেমনিই রয়ে গেল।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (হযরত জাবির রাযি. এর স্ত্রীকে) বললেন- كلي هذا وأهدي ، فإن الناس اصابتهم مجاعة (তুমি এটি খাও এবং হাদিয়া দাও। মানুষ বড় ক্ষুধার্ত)। এক বর্ণনায় আছে, হযরত জাবির রাযি. বলেন, আমরা সারাটা দিন সেই খাবার নিজেরাও খেয়েছিলাম এবং মানুষের মধ্যেও বিতরণ করছিলাম। আল্লাহু আকবার! মাত্র এক সা খাবার ও ছোট্ট একটি ছাগলছানা। এক হাজার মানুষ তৃপ্তির সঙ্গে তা খেল। তারপর দিনভর তা সেই পরিবারটির খাদ্যের প্রয়োজন মেটানোর পর লোকজনের মধ্যে অবারিতভাবে বিতরণও করা হল।

এটা আল্লাহ তা'আলার কুদরতের মহিমা। তিনি তাঁর প্রিয় বান্দাদের সবকিছুতে এভাবেই বরকত দিয়ে থাকেন, বিশেষত বান্দাগণ যদি সবরের সঙ্গে তাঁর হুকুম পালনে রত থাকে। আনসার ও মুহাজিরগণ তিন দিনের না খাওয়া ছিলেন। ক্ষুধার কষ্ট লাঘবের উদ্দেশ্যে তাঁদেরকে পেটে পাথর পর্যন্ত বাধতে হয়েছিল। তা সত্ত্বেও প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হুকুম পালনে তাঁরা বিন্দুমাত্র ত্রুটি করেননি। সেই ক্ষুধার্ত শরীর নিয়ে মাটি কেটে পরিখা খননের মত কঠিন কাজও তাঁরা খুশিমনে করে যাচ্ছিলেন। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁদের প্রতি বেহদ্দ খুশি ছিলেন। এই সবর ও আনুগত্যের যে পুরস্কার পরকালের জন্য বরাদ্দ আছে, তা তো আছেই। দুনিয়ায়ও আল্লাহ তা'আলা তার খানিকটা প্রকাশ দেখিয়ে দিলেন।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. ক্ষুধার অশেষ কষ্টের মধ্যেও আল্লাহর হুকুম পালনে যত্নবান থাকা চাই ।

খ. নবীদের মু'জিযা সত্য। তাতে অবিশ্বাস করা ঈমানের পরিপন্থী।

গ. যুদ্ধজয়ে আল্লাহ তা'আলার উপর নির্ভরতার পাশাপাশি সম্ভাব্য সকল ব্যবস্থাও গ্রহণ করা চাই। এটাই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শিক্ষা।

ঘ. নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী ক্ষুধার্তদের ক্ষুধা নিবারণের চেষ্টা করা উচিত।

ঙ. ক্ষুধার্ত ব্যক্তি নিজ মুরুব্বি ও মাননীয় কেউ হলে সে ক্ষেত্রে অধিকতর গুরুত্বের সঙ্গে তার সেবা করা চাই।

চ. অতিথি আপ্যায়নের ক্ষেত্রে স্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শ করা উচিত।

ছ. স্ত্রীর কর্তব্য অতিথি আপ্যায়নে স্বামীর সহযোগিতা করা।

জ. আপ্যায়নকারীর উপর আস্থা থাকলে নিমন্ত্রিত ব্যক্তি সঙ্গে অতিরিক্ত লোক নিয়ে আসতে পারে।

ঝ. আপ্যায়নকারী ও তার পরিবারবর্গের বাড়তি কষ্ট না হয়, অতিথির সেদিকে লক্ষ রাখা জরুরি।

ঞ. অতিথির কর্তব্য পরিবেশিত খাবারে বরকতের জন্য দুআ করা।

ট. অতিথির উচিত আপ্যায়নের কাজে প্রয়োজনে গৃহকর্তার সহযোগিতা করা।

ঠ. খাদ্য ঢেকে রাখা বরকত পাওয়ার পক্ষে সহায়ক।

ড. আপ্যায়ন শেষে খাবার বেঁচে থাকলে যতটুকু সম্ভব প্রতিবেশীদের মধ্যে তা বিতরণ করা চাই।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:বিশুদ্ধ (পারিভাষিক সহীহ)
রিয়াযুস সালিহীন - হাদীস নং ৫১৯ | মুসলিম বাংলা