রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ

ভূমিকা অধ্যায়

হাদীস নং: ৪৯৬
ভূমিকা অধ্যায়
অধ্যায়ঃ ৫৬ অনাহারে থাকা, কৃচ্ছতাপূর্ণ জীবনযাপন করা, অল্প পানাহার, অল্প পোশাক ও অল্প ভোগে পরিতুষ্ট থাকা এবং চাহিদা ত্যাগের ফযীলত।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরামের খাদ্যাভাব : একটি হৃদয়স্পর্শী ঘটনা
হাদীছ নং : ৪৯৬

হযরত আবু হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, কোনও একদিন বা রাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বের হলেন। অমনি তিনি আবু বকর ও উমরকে দেখতে পেলেন। জিজ্ঞেস করলেন, এ মুহূর্তে কোন জিনিস তোমাদেরকে ঘর থেকে বের করেছে? তারা বললেন, ক্ষুধা ইয়া রাসূলাল্লাহ। তিনি বললেন, যাঁর হাতে আমার প্রাণ সেই সত্তার কসম! আমাকেও ওই জিনিস বের করেছে, যা তোমাদেরকে বের করেছে। ওঠো। তারা তাঁর সঙ্গে উঠলেন। তিনি জনৈক আনসারীর বাড়িতে আসলেন। দেখা গেল তিনি বাড়িতে নেই। তার স্ত্রী তাঁকে দেখতে পেল। বলে উঠল, মারহাবা ওয়া আহলান! (এই বলে তাঁদেরকে স্বাগত জানাল)। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে জিজ্ঞেস করলেন, অমুক কোথায়? বলল, আমাদের জন্য মিষ্টি পানির সন্ধানে গেছেন। এমনই মুহূর্তে সেই আনসারী এসে পড়লেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সঙ্গীদ্বয়কে দেখেই বলে উঠলেন, আলহামদুলিল্লাহ, আজ আমার চেয়ে সম্মানিত মেহমান আর কেউ পায়নি। এই বলে তিনি চলে গেলেন। পরক্ষণেই একটি খেজুরের থোকা নিয়ে আসলেন। তাতে কাঁচা সেজুর, শুকনো পাকা খেজুর ও তাজা পাকা খেজুর রয়েছে। বললেন, আপনারা খান। তারপর তিনি ছুরি নিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন, সাবধান, দুধের পশু যবাই করো না। তিনি তাঁদের জন্য ছাগল যবাই করলেন। তাঁরা সেই ছাগলের গোশত খেলেন, ওই থোকা থেকে খেজুর খেলেন এবং পানি পান করলেন। তাঁরা যখন পেটভরে খেলেন এবং তৃপ্তিভরে পান করলেন, তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবু বকর ও উমরকে বললেন, যাঁর হাতে আমার প্রাণ সেই সত্তার কসম, কিয়ামতের দিন তোমাদেরকে অবশ্যই এ নি'আমত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে। ক্ষুধা তোমাদেরকে তোমাদের ঘর থেকে বের করেছিল, তারপর তোমরা এখন ফিরে যাচ্ছ এই নি'আমত পেয়ে- মুসলিম।
مقدمة الامام النووي
56 - باب فضل الجوع وخشونة العيش والاقتصار على القليل من المأكول والمشروب والملبوس وغيرها من حظوظ النفس وترك الشهوات
496 - وعن أَبي هريرة - رضي الله عنه - قَالَ: خرجَ رسولُ الله - صلى الله عليه وسلم - ذَاتَ يَوْمٍ أَوْ لَيْلَةٍ، فَإذَا هُوَ بأَبِي بَكْرٍ وَعُمَرَ رضي الله عنهما، فَقَالَ: «مَا أَخْرَجَكُمَا مِنْ بُيُوتِكُما هذِهِ السَّاعَةَ؟» قَالا: الجُوعُ يَا رسول الله. قَالَ: «وَأنَا، وَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ، لأخْرَجَنِي الَّذِي أخْرَجَكُما، قُوما» فقَامَا مَعَهُ، فَأتَى رَجُلًا مِنَ الأَنْصَارِ، فَإذَا هُوَ لَيْسَ في بيْتِهِ، فَلَمَّا رَأَتْهُ المَرْأَةُ، قالت: مَرْحَبًا وَأهلًا. فقال لَهَا رسول الله - صلى الله عليه وسلم: «أيْنَ فُلانُ؟» قالت: ذَهَبَ يَسْتَعْذِبُ لنَا المَاءَ. إِذْ جَاءَ الأَنْصَارِيُّ، فَنَظَرَ إِلَى رسول الله - صلى الله عليه وسلم - وَصَاحِبَيْهِ، ثُمَّ قَالَ: الحَمْدُ للهِ، مَا أَحَدٌ الْيَوْمَ أكْرَمَ أضْيَافًا مِنِّي، فَانْطَلَقَ فَجَاءهُمْ بِعِذْقٍ فِيهِ بُسْرٌ وَتَمْرٌ وَرُطَبٌ، فَقَالَ: كُلُوا، وَأَخَذَ الْمُدْيَةَ، فَقَالَ لَهُ رسول الله - صلى الله عليه وسلم: «إيَّاكَ وَالْحَلُوبَ» فَذَبَحَ لَهُمْ، فَأكَلُوا مِنَ الشَّاةِ وَمِنْ ذَلِكَ العِذْقِ وَشَرِبُوا. فَلَمَّا أَنْ شَبِعُوا وَرَوُوا قَالَ رسول الله - صلى الله عليه وسلم - لأَبي بَكْر وَعُمَرَ رضي الله عنهما: «وَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ، لَتُسْأَلُنَّ عَنْ هَذَا النَّعِيمِ يَوْمَ القِيَامَةِ، أَخْرَجَكُمْ مِنْ بُيُوتِكُمُ الْجُوعُ، ثُمَّ لَمْ تَرْجِعُوا حَتَّى أصَابَكُمْ هَذَا النَّعيمُ». رواه مسلم. (1)
قولُهَا: «يَسْتَعْذِبُ» أيْ: يَطْلُبُ المَاءَ العَذْبَ، وَهُوَ الطَّيِّبُ. وَ «العِذْقُ» بكسر العين وإسكان الذال المعجمة: وَهُوَ الكِباسَةُ، وَهِيَ الغُصْنُ. وَ «المُدْيَةُ» بضم الميم وكسرها: هي السِّكِّينُ. وَ «الْحَلُوبُ»: ذاتُ اللَّبَن.
وَالسُّؤالُ عَنْ هَذَا النَّعِيمِ سُؤَالُ تَعْدِيد النِّعَم لا سُؤَالُ تَوْبيخٍ وتَعْذِيبٍ، والله أعلَمُ.
وَهَذَا الأَنْصَارِيُّ الَّذِي أَتَوْهُ هُوَ، أَبُو الْهَيْثَم بْنُ التَّيِّهَانِ، كَذَا جَاءَ مُبَيَّنًا في رواية الترمذي (2) وغيره.

হাদীসের ব্যাখ্যা:

নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত আবু বকর রাযি. ও উমর রাযি.- কে জিজ্ঞেস করলেন, এ মুহূর্তে কোন জিনিস তোমাদেরকে ঘর থেকে বের করেছে?
বোঝা যাচ্ছে তখন নামাযের ওয়াক্ত ছিল না। কিংবা এমন কোনও সময়ও ছিল না, যখন বিশেষ উদ্দেশ্যে লোকজন ঘর থেকে বের হয়ে থাকে। এ কারণেই তিনি জানতে চেয়েছিলেন এ অসময়ে তাদের বের হওয়ার কারণ কী? তারা উত্তরে বললেন-
(ক্ষুধা ইয়া রাসূলাল্লাহ)। অর্থাৎ ক্ষুধা মেটানোর মত আমাদের ঘরে কিছু নেই। তাই বের হয়ে পড়েছি কোথাও ক্ষুধা নিবারণের মত কিছু পাওয়া যায় কি না সে উদ্দেশ্যে। এ বর্ণনায় হযরত আবু বকর সিদ্দীক রাযি. ও উমর ফারূক রাযি.- এর উভয়ের একই উত্তর উল্লেখ করা হয়েছে।

অন্য বর্ণনায় আছে যে, হযরত আবু বকর সিদ্দীক রাযি. বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে সাক্ষাত করা ও তাঁর (মুবারক) চেহারা দেখা এবং তাঁকে সালাম দেওয়ার উদ্দেশ্যে বের হয়েছিলাম।

একটু পরেই উমর রাযি. আসলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞেস করলেন, উমর, কী জন্যে এসেছ? তিনি বললেন, ক্ষুধা ইয়া রাসূলাল্লাহ।

উভয় বর্ণনার মধ্যে কোনও দ্বন্দ্ব নেই। কেননা ক্ষুধার বিষয়টি মূলত হযরত আবু বকর রাযি.-এরও ছিল। হযরত উমর রাযি.-কে আসার কারণ জিজ্ঞেস করা হলে তিনি যখন ক্ষুধার কথা বললেন, তখন তা যেন হযরত আবু বকর সিদ্দীক রাযি.-এরও মনের কথা ছিল। তাই বর্ণনাকারী ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে সে কথাটিকে উভয়ের উত্তর হিসেবে উল্লেখ করে দিয়েছেন।

এমনও হতে পারে যে, প্রথমে হযরত আবু বকর রাযি.-কেও নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ প্রশ্ন করেছিলেন এবং তিনিও এ উত্তর দিয়েছিলেন। যাহোক, তাঁরা যখন তাঁদের ক্ষুধার কথা জানালেন, তখন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন-
(যাঁর হাতে আমার প্রাণ সেই সত্তার কসম! আমাকেও ওই জিনিস বের করেছে, যা তোমাদেরকে বের করেছে)। এ বলে তিনি তাদের মনে সান্ত্বনা জুগিয়েছেন এবং তাদের ক্ষুধার কষ্ট কিছুটা লাঘবের চেষ্টা করেছেন। কেননা তাঁরা যখন জানতে পারবেন যে, তাদের মতোই ক্ষুধার কষ্টে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘর থেকে বের হয়ে এসেছেন, তখন স্বাভাবিকভাবেই তাঁরা নিজেদের কষ্ট ভুলে গিয়ে তাঁর কষ্টের কথাই ভাববেন। তাঁরা তো তাঁকে প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসতেন। তাছাড়া এটা নবী কারীম সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লামের মহানুভবতাও বটে যে, তিনি তাদের প্রতি সমবেদনা প্রকাশের জন্য নিজেকেও ক্ষুধার কষ্টের দিক থেকে তাদের কাতারভুক্ত করে দিলেন।

এবার নিজের সঙ্গীদু'জনের ক্ষুধা নিবারণের চিন্তা। তিনি তাঁদের দু'জনকে নিয়ে জনৈক আনসারী সাহাবীর বাড়িতে চলে গেলেন। এ বর্ণনায় সে সাহাবীর নাম উল্লেখ করা হয়নি। অপর বর্ণনায় আছে, তাঁর নাম আবুল হায়ছাম ইবনুত তায়িহান রাযি.। তিনি আর্থিকভাবে সচ্ছল ছিলেন। তাঁর প্রচুর খেজুর গাছ ও ছাগলের পাল ছিল। তিনি তখন বাড়িতে ছিলেন না। তাঁর আলাদা কাজের লোক ছিল না। তাই নিজেই কোনও কুয়া থেকে মিষ্টি পানি আনার জন্য গিয়েছিলেন।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর দরজায় গিয়ে সালাম দিলেন। কিন্তু উত্তর পেলেন না। ভেতর থেকে তাঁর স্ত্রী তাদের দেখতে পেলেন। তিনি তাঁদের স্বাগত জানালেন। এর দ্বারা বোঝা গেল স্বামীর অনুপস্থিতিতে মেহমানদের ঘরে আসার অনুমতি দেওয়া স্ত্রীর জন্য জায়েয, যদি জানা থাকে স্বামী তাতে মনঃক্ষুণ্ণ হবে না।

কিছুক্ষণের মধ্যেই আবুল হায়ছাম রাযি. ফিরে আসলেন। তিনি তো মহা খুশি। একসঙ্গে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর প্রধান দুই সঙ্গীকে মেহমানরূপে পেয়ে গেছেন! তিনি বলে উঠলেন-
(আলহামদুলিল্লাহ, আজ আমার চেয়ে সম্মানিত মেহমান আর কেউ পায়নি)। কেই বা কখন পেয়েছে? স্বয়ং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, সঙ্গে রয়েছেন সর্বপ্রধান সাহাবী আবু বকর সিদ্দীক রাযি., আরও আছেন উম্মতের দ্বিতীয় ব্যক্তি উমর ফারুক রাযি.। এ বিষয়টি নিয়ে বিশিষ্ট কবি সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবন রাওয়াহা রাযি. চমৎকার একটি কবিতা রচনা করেছেন। তিনি তাতে আবুল হায়ছাম ইবনুত তায়্যিহান রাযি.-এর প্রশংসা করতে গিয়ে বলেন-
“ইসলাম কোনও জাতিকে যে মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করে,
এমনটি আর দেখা যায়নি।
আবুল হায়ছামের অতিথিদলের মতো
এমন অতিথিও আর দেখা যায়নি।
তাঁদের মধ্যে রয়েছেন নবী, সিদ্দীক ও উমর ফারুক।
হাওয়ার বংশধরদের মধ্যে তাঁরা সবার শ্রেষ্ঠজন।"

এর দ্বারা বাড়িতে অতিথি আসলে আনন্দ প্রকাশ করা ও তাদের মনোরঞ্জনমূলক কথা বলার শিক্ষা পাওয়া যায়। বিশেষত আল্লাহ তা'আলার শোকর আদায় করা চাই যে, তিনি মেহমানের সেবাযত্ন করার সুযোগ করে দিয়েছেন। কোনও কোনও বর্ণনায় আছে, হযরত আবুল হায়ছাম রাযি. রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জড়িয়ে ধরলেন আর বললেন, আপনার প্রতি আমার পিতা মাতা উৎসর্গিত হোক। তারপর তাদেরকে নিয়ে ছায়ায় চলে গেলেন এবং একটি বিছানা বিছিয়ে তার উপর তাঁদেরকে বসালেন। তারপর দ্রুত নিজ বাগানে চলে গেলেন এবং এক ছড়া খেজুর এনে তাদের সামনে পরিবেশন করলেন। তাতে ছিল বুসর (যে খেজুর পাকার আগে হলদে রং ধারণ করে), তামার (পাকা শুকনো খেজুর) ও রুতাব (পাকা তাজা খেজুর)।

শামায়িলুত-তিরমিযী গ্রন্থে আছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছড়াটি দেখে বললেন, তুমি এর থেকে বেছে বেছে রুতাব আনলে না কেন? তিনি বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমার ইচ্ছা হল আপনারা এখান থেকে পসন্দমতো বুসর, রুতাব যা ইচ্ছা হয় খাবেন।

এক বর্ণনায় আছে, আবুল হায়ছাম রাযি. যে মিষ্টি পানি এনেছিলেন, তার একটি মশকও তাঁদের সামনে রাখলেন। তাঁরা সে খেজুর খেলেন ও পানি পান করলেন।

এটা ছিল উপস্থিত মেহমানদারী। এটাই নিয়ম। অতিথি আসলে ঘরে উপস্থিত যা থাকে, প্রথমে তাই খেতে দেওয়া চাই, যাতে আয়োজন করে তৈরি করা খাবারের অপেক্ষায় তাদের কষ্ট না হয়। উপস্থিত পরিবেশিত খাবার ফল জাতীয় কিছু হলে আরও ভালো। ভারী খাবারের আগে ফল খাওয়া স্বাস্থ্যের পক্ষে ভালো।

তারপর আবুল হায়ছাম রাযি. পরবর্তী আপ্যায়নের প্রস্তুতি নিলেন। অতিথিদের জন্য সাধ্যমতো উত্তম খাবারের ব্যবস্থা করা সুন্নত। বাড়াবাড়ি করা সমীচীন নয়। হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম অতিধিদের সামনে ভুনা বাছুর পেশ করেছিলেন। সাহাবায়ে কেরামের একাধিক ঘটনা পাওয়া যায়, যাতে তাঁরা মেহমানদের জন্য ছাগল জবাই করেছিলেন। একদিন সাধ্যমতো ভালো খাবার খাওয়ানোর নির্দেশনা হাদীছেও পাওয়া যায়।

হযরত আবুল হায়ছাম রাযি. ছুরি নিয়ে ছাগল যবাই করতে চললেন। তা দেখে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন-
(দুধের পশু যবাই করো না)। এটা ছিল তাঁদের প্রতি তাঁর স্নেহ-মমতার প্রকাশ। আপ্যায়নের জন্য দুধের বকরি যবাহের প্রয়োজন নেই। আবার সেটি থাকলে তার দুধ দ্বারা পরিবারটি উপকৃত হতে পারবে।

আবুল হায়ছাম রাযি. ছাগল জবাই করলেন। তা রান্না হল। মহান অতিথিগণ তা খেলেন। তাদের সকলে পানাহার করে পরিতৃপ্ত হয়ে গেলেন। তারপর নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সঙ্গীদ্বয়কে লক্ষ্য করে বললেন-
(যাঁর হাতে আমার প্রাণ সেই সত্ত্বার কসম, কিয়ামতের দিন তোমাদেরকে অবশ্যই এ নি'আমত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে)। অর্থাৎ কিয়ামতের দিন আল্লাহ তা'আলা তোমাদেরকে নি'আমতের কথা স্মরণ করিয়ে দেবেন এবং জিজ্ঞেস করবেন তোমরা এর কতটুকু শোকর আদায় করেছিলে। পরবর্তী বাক্যে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ নি'আমতটির খানিকটা ব্যাখ্যাও দান করেন। তিনি বলেন-
اخرجَكُمْ مِنْ بُيُوتِكُمُ الْجُوع، ثُمَّ لَمْ تَرْجِعُوا حَتَّى أَصَابَكُمْ هَذَا النعِيمُ তোমাদেরকে তোমাদের ঘর থেকে ক্ষুধা বের করেছিল, তারপর তোমরা এখন ফিরে যাচ্ছে এই নি'আমত পেয়ে)। প্রকৃতপক্ষে তাঁদেরকে বের তো করেছেন আল্লাহ তা'আলাই। তবে এটা ভাষার সৌন্দর্য ও এক রকম আদব যে, কষ্ট-ক্লেশ ও বাহ্যদৃষ্টিতে যা মন্দ ও অপ্রীতিকর, তাকে আল্লাহ তা'আলার সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত করা হয় না। তাই বলা হয়েছে- ক্ষুধা তোমাদেরকে বের করেছিল। তারপর তোমাদেরকে সে ক্ষুধা নিয়েই ঘরে ফিরতে হয়নি; বরং আল্লাহ তা'আলা তোমাদের সে ক্ষুধা নিবারণ করিয়ে দিয়েছেন এবং তোমাদেরকে পানাহারে পরিতৃপ্ত করে ফেরার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন।

অন্যান্য বর্ণনায় আছে, সবশেষে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবুল হাইছাম রাযি.-কে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার কি কোনও খাদেম নেই? বললেন, না। তিনি বললেন, আমাদের কাছে যখন কোনও বন্দী আসবে, তখন তুমি এসো।

কিছুদিন পর দু'জন বন্দী আসল। আবুল হায়ছাম রাযি. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে সাক্ষাত করলে তিনি বললেন, তুমি এ দু'জন থেকে একজন বেছে নাও। তিনি বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনিই বেছে দিন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, যার কাছে মাশওয়ারা চাওয়া হয় সে আমানতপ্রাপ্ত। কাজেই তুমি এই বন্দীকে নিয়ে যাও। আমি একে নামায পড়তে দেখেছি। তুমি এর সঙ্গে ভালো ব্যবহার করো।

তিনি সে বন্দীকে নিয়ে বাড়িতে চলে গেলেন। স্ত্রীর কাছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা কিছু বলেছেন তাও বললেন। স্ত্রী বললেন, আপনি যতক্ষণ একে মুক্তি না দিয়ে দেন ততক্ষণ পর্যন্ত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপদেশ যথাযথভাবে মানা হবে না। তিনি তাকে মুক্তি দিয়ে দিলেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খুব খুশি হলেন এবং তিনি তাঁর স্ত্রীর প্রশংসা করলেন।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. এ হাদীছ দ্বারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরামের অভাব-অনটন সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। এর দ্বারা অভাবী ব্যক্তি সান্ত্বনা লাভ করতে পারে।

খ. যারা মুসলিমসাধারণের দীনী নেতা, তাদের কর্তব্য ক্ষুধার্তদের সমবাদী হওয়া এবং নিজ ক্ষুধা মেটানোর পাশাপাশি তাদের ক্ষুধা নিবারণেরও চেষ্টা করা।

গ. প্রিয়জনের বাড়িতে কেউ মেহমান হয়ে গেলে সঙ্গে অতিরিক্ত লোক নেওয়ারও অবকাশ আছে, যদি জানা থাকে তাতে মেজবান নাখোশ হবে না।

ঘ. গৃহকর্তা বাড়ি না থাকলে তার স্ত্রী মেহমানদেরকে ঘরে ঢোকার অনুমতি দিতে পারে, যদি তাতে তার স্বামী নাখোশ হবে না বলে নিশ্চিত থাকে।

ঙ. অতিথি আসলে গৃহকর্তার কর্তব্য হাসিমুখে তাকে গ্রহণ করা, তার সঙ্গে মনোরঞ্জনমূলক কথাবার্তা বলা এবং আল্লাহ তা' আলার শোকর আদায় করা।

চ. অতিথি আসলে ঘরে উপস্থিত যা আছে তাই পেশ করা উচিত। কখন রান্নাবান্না হবে। সে অপেক্ষায় রেখে তাদের কষ্ট দেওয়া উচিত নয়।

ছ. অতিথির জন্য সাধ্যমতো ভালো খাবারের বন্দোবস্ত করা উত্তম। তবে বাড়াবাড়ি করা সমীচীন নয়।

জ, আতিথেয়তা আল্লাহ তা'আলার নি'আমত। এর জন্য অতিথিদের শোকর আদায় করা উচিত।

ঝ. গৃহকর্তার দরকারি কোনও বিষয় অতিথির নজরে আসলে তার যদি সামর্থ্য থাকে, তবে তা সমাধা করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা চাই। এটা উপকারকারীর উপকার করার নববী শিক্ষার অন্তর্ভুক্ত।

ঞ. সেই শ্রেষ্ঠ স্ত্রী, যে দীনী কাজে স্বামীর সহযোগিতা করে এবং অধিকতর ভালো কাজের প্রেরণা যোগায়।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:বিশুদ্ধ (পারিভাষিক সহীহ)
রিয়াযুস সালিহীন - হাদীস নং ৪৯৬ | মুসলিম বাংলা