রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ

ভূমিকা অধ্যায়

হাদীস নং: ৩৯৬
অধ্যায়ঃ ৫০

আল্লাহর ভয়

خوف এর আভিধানিক অর্থ ভয়-ভীতি। অনাকাঙ্ক্ষিত কোনওকিছু ঘটে যাওয়ার আশঙ্কায় অন্তরে যে পীড়া বোধ হয়, তাকেই خوف বলে। শরীআতে যে خوف ও ভীতির গুণ অর্জনের উৎসাহ দেওয়া হয়েছে, সে ভীতির সারকথা হলো আযাবভোগের আশঙ্কা। অর্থাৎ নিজের সম্পর্কে এই আশঙ্কা বোধ করা যে, আমার শাস্তি হতে পারে। আখেরাতের শাস্তি সম্পর্কে অন্তরে এ ভয় পোষণ করা অতি জরুরি। এটা ঈমানের অঙ্গ। ভীতির এ গুণ চেষ্টা করলেই অর্জন করা যায়। এটা মানুষের সাধ্যভুক্ত। কাজেই চেষ্টা-সাধনা দ্বারা এ গুণ অবশ্যই অর্জন করা উচিত।
অন্তরে আখেরাতের ভয় থাকলে শরীর ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দ্বারা তা প্রকাশ পায়। এর ফলে অন্তর পরিশুদ্ধ হয় এবং কাজকর্ম পরিশীলিত হয়। আখেরাতের ভয়ে ভীত ব্যক্তি সহজেই দুনিয়ার লোভ-লালসা পরিত্যাগ করতে পারে। তার অন্তরে অহংকার, হিংসা বিদ্বেষ প্রভৃতি রিপু শেকড় ছড়াতে পারে না। সে সহজেই পাপকর্ম হতে বিরত থাকতে পারে। প্রকৃতপক্ষে ভয় অতীব কল্যাণকর একটি গুণ। আল্লাহওয়ালা বুযুর্গগণ এ গুণটির খুব কদর করতেন। অন্যকেও তারা উৎসাহ দিতেন, যাতে এ গুণ অর্জনে সচেষ্ট হয়।
ইয়াহইয়া ইবন মু'আয রায়ী রহ. বলেন, মানুষ দারিদ্র্যকে যেমনটা ভয় করে, সেরকম ভয় যদি জাহান্নামকে করত, তবে অবশ্যই তারা জান্নাতী হয়ে যেত।
আবূ সুলায়মান দারানী রহ. বলেন, যে অন্তরে আল্লাহর ভয় নেই তা উজাড় হয়ে গেছে।
হাসান বসরী রহ. বলেন, যে ব্যক্তি বেশি বেশি ভয়ের কথা বলে, তার সাহচর্যে থাক। দুনিয়ায় এরূপ ব্যক্তিদের সাহচর্যে থাকলে আখেরাতে নির্ভয় থাকতে পারবে। যেসব লোক তোমাকে এ জগতে নির্ভয় করে রাখে, তাদের সাহচর্য এড়িয়ে চল।
আবূ হাফস রহ. বলেন, خوف হলো আল্লাহর চাবুক। যারা তার দরজা থেকে পালায়, এ চাবুক দ্বারা তিনি তাদের ফিরিয়ে আনেন। তিনি আরও বলেন, খওফ হলো অন্তরের প্রদীপ। এর দ্বারা ঈমানদার ব্যক্তি কোন্‌টা ভালো কোন্‌টা মন্দ দেখতে পায়। দুনিয়ায় তুমি যাকেই ভয় করে থাক, তুমি তার থেকে পালিয়ে যাও। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভয় করে, সে অন্য সকলের থেকে পালিয়ে আল্লাহর কাছেই ফিরে আসে। সুতরাং আল্লাহর ভয়ে ভীত ব্যক্তি তাঁর (আযাব) থেকে পালিয়ে তাঁর কাছে আশ্রয় নেয়।
জুন্নুন মিসরী রহ. বলেন, অন্তরে যতক্ষণ খওফ থাকে, ততক্ষণ মানুষ সঠিক পথে থাকে। যেই না খওফ দূর হয়ে যায়, অমনি পথভ্রষ্ট হয়ে যায়।
মানুষ যাতে আখেরাত ভুলে দুনিয়ার আনন্দ-ফুর্তিতে মত্ত হয়ে না পড়ে, সেজন্য অন্তরে আখেরাতের ভয় জাগানো দরকার। এ লক্ষ্যে কুরআন ও হাদীছে বিভিন্নভাবে আখেরাতের কঠিন পরিস্থিতিসমূহ তুলে ধরা হয়েছে। ইমাম নববী রহ. এ অধ্যায়ে সেরকম কিছু আয়াত ও হাদীছ উল্লেখ করেছেন। এবার আমরা তার বঙ্গানুবাদ ও সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা পেশ করছি। আল্লাহ তাআলা তাওফীক দান করুন।

‘আল্লাহর ভয়' সম্পর্কিত কিছু আয়াত

এক নং আয়াত

وَإِيَّايَ فَارْهَبُونِ

অর্থ : আর তোমরা (অন্য কাউকে নয়) কেবল আমাকেই ভয় কর।৩৩৭

ব্যাখ্যা

এ আয়াতে বনী ইসরাঈলকে হুকুম দেওয়া হয়েছে যে, তারা যেন এক আল্লাহ তাআলাকেই ভয় করে। আয়াতের শুরুতে তাদেরকে ওই সকল নিআমত স্মরণ করতে বলা হয়েছে, যা বিশেষভাবে তাদেরকে দেওয়া হয়েছিল। এবং তাদেরকে ওই অঙ্গীকার পূরণের আদেশ করা হয়েছে, যা তাওরাতের অনুসরণ এবং সর্বশেষ নবীর প্রতি ঈমান আনা সম্পর্কে তাদের থেকে গ্রহণ করা হয়েছিল। আল্লাহর সঙ্গে কৃত অঙ্গীকার ও আল্লাহ তাআলার বিধান পালনের ক্ষেত্রে অনেক সময় বিভিন্ন রকম ভয়ভীতি প্রতিবন্ধক হয়ে থাকে, যেমন সমাজের নিন্দা-সমালোচনার ভয়, ক্ষমতাসীন ও প্রভাবশালীদের জুলুম- অত্যাচারের ভয় ইত্যাদি। প্রকৃতপক্ষে মাখলূককে ভয় করে খালেক ও সৃষ্টিকর্তার হুকুম অমান্য করা কোনও বুদ্ধির কথা নয়। আল্লাহ তাআলা যার সাহায্য করেন, তার ক্ষতি করতে পারে এমন কেউ নেই। আবার আল্লাহ তাআলা কারও ক্ষতি করতে চাইলে তাকে রক্ষা করার মত ক্ষমতাও কারও নেই। অপরদিকে কোনও মাখলুকের দ্বারা কোনও ক্ষতি হলেও তা সীমিত দিনের সীমিত ক্ষতি। সে ক্ষতি স্বীকার করে কেউ যদি আল্লাহর হুকুম পালন করতে প্রস্তুত হয়ে যায়, তবে এর বদলে আখেরাতে অনন্ত দিনের অসীম উপকার সে লাভ করবে। আবার মাখলুকের ভয়ে আল্লাহর হুকুম অমান্য করলে যদি তাতে পার্থিব কোনও উপকার হয়ও, সে উপকারও হয় সীমিত পরিমাণে সীমিত দিনের জন্য। অথচ আল্লাহ তাআলার হুকুম অমান্য করার কারণে যে ক্ষতি হয়ে যায় তা অনন্তকালের অপরিসীম ক্ষতি। তা হচ্ছে আল্লাহ তাআলার অসন্তুষ্টি ও জাহান্নামের চির শাস্তি। তাই আল্লাহ তাআলা বলছেন, তোমরা অন্য কাউকে নয়; বরং আমাকেই ভয় কর।
প্রকাশ থাকে যে, আয়াতটির হুকুম বনী ইসরাঈলকে লক্ষ্য করে দেওয়া হলেও আমাদের জন্যও এটি সমান প্রযোজ্য। কুরআন মাজীদে বিভিন্ন জাতিকে লক্ষ্য করে যে আদেশ করা হয়েছে তার উদ্দেশ্য এ নয় যে, কেবল তারাই তা পালন করবে। বস্তুত তারা কেবলই উপলক্ষ্য। সে আদেশ প্রযোজ্য সকলের জন্যই।

দুই নং আয়াত

إِنَّ بَطْشَ رَبِّكَ لَشَدِيدٌ

অর্থ : প্রকৃতপক্ষে তোমার প্রতিপালকের ধরা বড়ই কঠিন।৩৩৮

ব্যাখ্যা

এটি সূরা বুরূজের ১২ নং আয়াত। এর আগে ১০ নং আয়াতে জানানো হয়েছে- যারা মুমিন নর-নারীকে উৎপীড়ন করে সত্যপথ থেকে বিচ্যুত করতে চায় আর এ অবস্থায় তাদের মৃত্যু ঘটে, তাদের জন্য জাহান্নামের কঠিন আযাবের ব্যবস্থা রয়েছে। ১১ নং আয়াতে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সান্ত্বনাদানের জন্য সুসংবাদ শোনানো হয়েছে যে, আখেরাতে সৎকর্মশীল মুমিনগণ জান্নাতের অধিকারী হবে আর জান্নাত পেয়ে যাওয়াই মহাসাফল্য। তারপর এ আয়াতে তাঁকে এই বলে সান্ত্বনা দেওয়া হয়েছে যে, আপনি কাফের-মুশরিকদের জুলুম-অত্যাচারে বিচলিত হবেন না; বরং আপন কর্তব্য পালন করতে থাকুন। প্রকৃত সাফল্য আপনার ও আপনার অনুসারীদের জন্যই নির্ধারিত। যারা আপনার বিরুদ্ধাচরণ করছে, তাওবা না করলে তাদেরকে অবশ্যই একদিন ধরা হবে। আপনার প্রতিপালকের ধরা বড়ই কঠিন। তিনি জালিম-অত্যাচারীদেরকে কঠিনভাবেই ধরে থাকেন, যা থেকে নিস্তার পাওয়ার কোনও সুযোগ থাকে না।
যদিও সতর্কবাণীটি কাফের-মুশরিকদের জন্য, কিন্তু সকলের জন্যই এর মধ্যে কঠিন বার্তা রয়েছে। নাফরমানির কারণে আল্লাহ তাআলা যে-কাউকেই শাস্তি দিতে পারেন। তিনি যেমন ক্ষমাশীল, তেমনি কঠোর শাস্তিদাতাও বটে। কুরআন মাজীদে একেকটি পাপকর্মের উল্লেখের সঙ্গে সে পাপ সম্পর্কে কঠিন শাস্তির সতর্কবাণী উচ্চারিত হয়েছে। কাজেই প্রত্যেকের উচিত আল্লাহ তাআলাকে ভয় করা এবং যাতে তাঁর সুকঠিন ধরার মধ্যে পড়ে যেতে না হয়, তাই প্রত্যেকের কর্তব্য সর্বপ্রকার পাপ থেকে বিরত থাকার সর্বোচ্চ চেষ্টা করা।

তিন নং আয়াত

وَكَذَلِكَ أَخْذُ رَبِّكَ إِذَا أَخَذَ الْقُرَى وَهِيَ ظَالِمَةٌ إِنَّ أَخْذَهُ أَلِيمٌ شَدِيدٌ (102) إِنَّ فِي ذَلِكَ لَآيَةً لِمَنْ خَافَ عَذَابَ الْآخِرَةِ ذَلِكَ يَوْمٌ مَجْمُوعٌ لَهُ النَّاسُ وَذَلِكَ يَوْمٌ مَشْهُودٌ (103) وَمَا نُؤَخِّرُهُ إِلَّا لِأَجَلٍ مَعْدُودٍ (104) يَوْمَ يَأْتِ لَا تَكَلَّمُ نَفْسٌ إِلَّا بِإِذْنِهِ فَمِنْهُمْ شَقِيٌّ وَسَعِيدٌ (105) فَأَمَّا الَّذِينَ شَقُوا فَفِي النَّارِ لَهُمْ فِيهَا زَفِيرٌ وَشَهِيقٌ (106)

অর্থ : যেসকল জনপদ জুলুমে লিপ্ত হয়, তোমার প্রতিপালক যখন তাদের ধরেন, তখন তাঁর ধরা এমনই হয়ে থাকে। বাস্তবিকই তাঁর ধরা অতি মর্মন্তুদ, অতি কঠিন। যে ব্যক্তি আখেরাতের শান্তিকে ভয় করে, তার জন্য এসব বিষয়ের মধ্যে বিরাট শিক্ষা রয়েছে। তা এমন দিন, যার জন্য সমস্ত মানুষকে একত্র করা হবে এবং তা এমন দিন, যা হবে (সকলের কাছে) দৃশ্যমান। আমি তা স্থগিত রেখেছি গণা-গুণতি কিছু কালের জন্য। যখন সে দিন আসবে, তখন আল্লাহর অনুমতি ছাড়া কেউ কথা বলতে পারবে না। অতঃপর তাদের মধ্যে কেউ হবে দুর্গতিগ্রস্ত এবং কেউ হবে সদ্‌গতিসম্পন্ন। সুতরাং যারা দুর্গতিগ্রস্ত হবে, তারা থাকবে জাহান্নামে, যেখানে তাদের চিৎকার ও আর্তনাদ শোনা যাবে।৩৩৯

ব্যাখ্যা

এ আয়াতসমূহের আগে এক এক করে হযরত নূহ আলাইহিস সালামের কওম, 'আদ জাতি, ছামূদ জাতি, লূত আলাইহিস সালামের সম্প্রদায়, শু‘আয়ব আলাইহিস সালামের সম্প্রদায় এবং ফিরআউন ও তার জাতির দৃষ্টান্ত উল্লেখ করা হয়েছে। এসকল সম্প্রদায়কে আপন আপন নবীর বিরুদ্ধাচরণ করার পরিণামে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছিল। তারপর এ আয়াতসমূহে আল্লাহ তাআলা জানাচ্ছেন যে, কোনও জনপদের বাসিন্দাগণ জুলুম-অত্যাচার ও অন্যায়-অপরাধ চালিয়ে যেতে থাকলে আল্লাহ তাআলা তাদেরকে এভাবেই কঠিন শাস্তি দিয়ে থাকেন। তাদেরকে যে শাস্তি দেওয়া হয়েছিল তা ছিল দুনিয়াবী শাস্তি। সে শাস্তিই যখন এত কঠিন ছিল, তখন আখেরাতের শাস্তি কেমন কঠিন হবে তা কিছুটা হলেও অনুমান করা যায়। সুতরাং আখেরাতকে ভয় করে এমন প্রত্যেক ব্যক্তির উচিত এসব সম্প্রদায়ের পরিণাম থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা। আর আখেরাতকে তো ভয় করতেই হবে। আখেরাতের সত্যতায় কোনও সন্দেহ নেই। সেদিন আগের-পরের সমস্ত মানুষকে আল্লাহর সামনে উপস্থিত করা হবে। সকলের থেকে সমস্ত কাজের হিসাব নেওয়া হবে। সেটা ন্যায়বিচারের দিন। অত্যন্ত ভয়াবহ দিন। আল্লাহ তাআলার অনুমতি ছাড়া সেদিন কেউ কথা বলতে পারবে না। মানুষের মুখে বাকশক্তি বন্ধ করে দিয়ে তাদের হাত-পা ও অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে কথা বলার শক্তি দেওয়া হবে এবং তাদের থেকে সাক্ষ্য নেওয়া হবে। আমলনামা খুলে দেওয়া হবে। নেকী-বদী বিচার করা হবে। যার নেকীর ওজন বেশি হবে সে হবে ভাগ্যবান, আর যার বদীর ওজন বেশি হবে সে হবে হত্যভাগ্য। হতভাগ্যের ঠিকানা হবে জাহান্নাম। ভাগ্যবানের ঠিকানা জান্নাত। উভয় দল উভয় ঠিকানায় চিরদিন থাকবে। এমন এক দিনকে ভয় না করে পারা যায় কি? সুতরাং সেদিনের ভয়ে ভীত থেকে প্রত্যেক মুমিনের কর্তব্য সকল পাপকর্ম থেকে দূরে থাকা এবং যতবেশি সম্ভব কর্ম অব্যাহত রাখা।

চার নং আয়াত

وَيُحَذِّرُكُمُ اللَّهُ نَفْسَهُ

অর্থ : আল্লাহ তোমাদেরকে নিজ (শাস্তি) সম্পর্কে সাবধান করছেন ।৩৪০

ব্যাখ্যা

এটি সূরা আলে ইমরানের ২৮ নং আয়াতের অংশবিশেষ। পূর্ণ আয়াতটি এরকম-

لَا يَتَّخِذِ الْمُؤْمِنُونَ الْكَافِرِينَ أَوْلِيَاءَ مِنْ دُونِ الْمُؤْمِنِينَ وَمَنْ يَفْعَلْ ذَلِكَ فَلَيْسَ مِنَ اللَّهِ فِي شَيْءٍ إِلَّا أَنْ تَتَّقُوا مِنْهُمْ تُقَاةً وَيُحَذِّرُكُمُ اللَّهُ نَفْسَهُ وَإِلَى اللَّهِ الْمَصِيرُ

‘মুমিনগণ যেন মুমিনদেরকে ছেড়ে কাফেরদেরকে (নিজেদের) মিত্র না বানায়। যে এরূপ করবে আল্লাহর সঙ্গে তার কোনও সম্পর্ক নেই। তবে তাদের (জুলুম) থেকে বাঁচার জন্য যদি আত্মরক্ষামূলক কোনও পন্থা অবলম্বন কর, সেটা ভিন্ন কথা। আল্লাহ তোমাদেরকে নিজ (শাস্তি) সম্পর্কে সাবধান করছেন আর তাঁরই দিকে (সকলকে) ফিরে যেতে হবে।
এ আয়াতে মুমিনদেরকে কাফেরদের সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপন করতে নিষেধ করা হয়েছে। অর্থাৎ এমন বন্ধুত্ব ও আন্তরিক সম্পর্ক, যার ফলে দু'জন লোকের জীবনের লক্ষ্য ও লাভ-লোকসান অভিন্ন হয়ে যায়। মুসলিমদের এ জাতীয় সম্পর্ক কেবল মুসলিমদের সঙ্গেই হতে পারে। অমুসলিমদের সঙ্গে এরূপ সম্পর্ক স্থাপন কঠিন পাপ।
অবশ্য যে অমুসলিম যুদ্ধরত নয়, তার সাথে সদাচরণ, সৌজন্যমূলক ব্যবহার ও তার কল্যাণ কামনা করা কেবল জায়েযই নয়, বরং তাই কাম্য। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরূপ লোকদের সঙ্গে সর্বদা সদয় আচরণই করেছেন।
এমনিভাবে অমুসলিমদের সঙ্গে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সহযোগিতামূলক চুক্তি বা ব্যবসায়িক কারবারও করা যেতে পারে। শর্ত হচ্ছে এরূপ চুক্তি ইসলাম ও মুসলিমদের স্বার্থবিরোধী হতে পারবে না এবং তাতে শরীআতের পরিপন্থী কোনও কর্মপন্থাও অবলম্বন করা যাবে না। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং তাঁর পরে সাহাবায়ে কেরাম এরূপ কারবার ও চুক্তি সম্পাদন করেছেন।
এ আয়াতে অমুসলিমদের সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপনকে নিষেধ করে দেওয়ার পর যে ইরশাদ হয়েছে— ‘তবে তাদের (জুলুম) থেকে বাঁচার জন্য আত্মরক্ষামূলক কোনও পন্থা অবলম্বন করলে সেটা ভিন্ন কথা', এর অর্থ কাফেরদের জুলুম ও নিপীড়ন থেকে আত্মরক্ষার উদ্দেশ্যে যদি এমন কোনও পন্থা অবলম্বন করতে হয়, যা দ্বারা বাহ্যত মনে হয় তাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপন করা হয়েছে, তবে তা করার অবকাশ আছে।
এরপর আল্লাহ তাআলা সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন যে, وَيُحَذِّرُكُمُ اللَّهُ نَفْسَهُ আল্লাহ তোমাদেরকে নিজ (শাস্তি) সম্পর্কে সাবধান করছেন' । অর্থাৎ মুমিনদের কর্তব্য কেবল আল্লাহ তাআলাকেই ভয় করা। তিনি অসন্তুষ্ট হন এমন কোনও কাজে কিছুতেই লিপ্ত হওয়া উচিত নয়। তিনি যখন কাফেরদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে নিষেধ করেছেন, তখন বোঝাই যাচ্ছে এটা করা তাঁর পসন্দ নয়; করলে তিনি অসন্তুষ্ট হবেন। তাই তাদের সঙ্গে বাহ্যিক বা আন্তরিক বন্ধুত্ব স্থাপন থেকে বেঁচে থাকতে হবে। কখনও যদি বিশেষ কোনও কারণে তাদের সঙ্গে মৈত্রীস্থাপনের প্রয়োজন পড়ে, তখনও লক্ষ রাখতে হবে যাতে শরীআতের সীমানা অতিক্রম না হয়ে যায়। মনে রাখতে হবে, একদিন সকলকেই আল্লাহ তাআলার সামনে হাজির হতে হবে। তাঁর কাছে প্রতিটি কাজকর্মের কৈফিয়ত দিতে হবে। বন্ধুত্ব সম্পর্কেও তিনি জিজ্ঞেস করবেন তা তাঁর দেওয়া শরীআত মোতাবেক করা হয়েছিল কি না। তখন কোনও মিথ্যা অজুহাত দেখিয়ে বাঁচা যাবে না। সুতরাং তাঁর ভয়ে এবং আখেরাতের শাস্তি হতে বাঁচার উদ্দেশ্যে বন্ধুত্ব করার কাজটিও শরীআতের সীমারেখার মধ্যে রাখতে হবে।

পাঁচ নং আয়াত

يَوْمَ يَفِرُّ الْمَرْءُ مِنْ أَخِيهِ (34) وَأُمِّهِ وَأَبِيهِ (35) وَصَاحِبَتِهِ وَبَنِيهِ (36) لِكُلِّ امْرِئٍ مِنْهُمْ يَوْمَئِذٍ شَأْنٌ يُغْنِيهِ (37)

অর্থ : (তা ঘটবে সেইদিন), যেদিন মানুষ তার ভাই থেকেও পালাবে এবং নিজ পিতা-মাতা থেকেও এবং নিজ স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততি থেকেও। (কেননা) সেদিন তাদের প্রত্যেকের এমন দুশ্চিন্তা দেখা দেবে, যা তাকে অন্যের থেকে ব্যস্ত করে রাখবে।৩৪১

ব্যাখ্যা

সূরা আবাসা'র এ আয়াতসমূহে কিয়ামতের ভয়াবহতা তুলে ধরা হয়েছে। এর সারকথা হচ্ছে, সেদিন প্রত্যেকে আপন চিন্তায় ব্যস্ত থাকবে। আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধব কেউ কারও দিকে ফিরে তাকানোর অবকাশ পাবে না। বরং প্রত্যেকে একে অন্যের থেকে এই ভয়ে পালাবে যে, না-জানি তার কাছে কোনও নেকী চেয়ে বসে কিংবা দুনিয়ায় যে হক ও অধিকার খর্ব করা হয়েছিল তা দাবি করে বসে, না-জানি ভাই বলে বসে আমি অর্থকষ্টে ভুগছিলাম, তুমি তোমার সম্পদ দিয়ে আমাকে সাহায্য করনি, পিতা-মাতা বলে বসে- তুমি আমাদের সেবাযত্ন করনি ও আমাদের হক আদায় করনি, স্ত্রী বলে বসে- তুমি আমার ভরণপোষণ ঠিকমত দাওনি বা আমাকে তা দিয়েছিলে হারাম উপার্জন থেকে এবং ছেলে-মেয়ে বলে বসে- আমাদেরকে দীন শেখাওনি এবং দীনের পথে চালাওনি। কাজেই আখেরাতের এ ভয়াবহ পরিস্থিতিতে যাতে আল্লাহ তাআলার রহমতের ছায়া পাওয়া যায়, সে উদ্দেশ্যে এখনই সতর্ক হয়ে যাওয়া উচিত এবং আল্লাহ ও বান্দার কোনও হক যাতে নষ্ট করা না হয়, সেদিকে লক্ষ রেখে শরীআত মোতাবেক জীবনযাপন করা উচিত।

ছয় নং আয়াত

يَاأَيُّهَا النَّاسُ اتَّقُوا رَبَّكُمْ إِنَّ زَلْزَلَةَ السَّاعَةِ شَيْءٌ عَظِيمٌ (1) يَوْمَ تَرَوْنَهَا تَذْهَلُ كُلُّ مُرْضِعَةٍ عَمَّا أَرْضَعَتْ وَتَضَعُ كُلُّ ذَاتِ حَمْلٍ حَمْلَهَا وَتَرَى النَّاسَ سُكَارَى وَمَا هُمْ بِسُكَارَى وَلَكِنَّ عَذَابَ اللَّهِ شَدِيدٌ (2)

অর্থ : হে মানুষ! নিজ প্রতিপালকের (ক্রোধকে ভয় কর। জেনে রেখ, কিয়ামতের প্রকম্পন এক সাংঘাতিক জিনিস। যেদিন তোমরা তা দেখতে পাবে, সেদিন প্রত্যেক স্তন্যদাত্রী সেই শিশুকে (পর্যন্ত) ভুলে যাবে, যাকে সে দুধ পান করিয়েছে এবং প্রত্যেক গর্ভবতী তার গর্ভপাত ঘটিয়ে ফেলবে আর মানুষকে তুমি এমন দেখবে, যেন তারা নেশাগ্রস্ত, অথচ তারা নেশাগ্রস্ত নয়; বরং (সেদিন) আল্লাহর শাস্তি হবে অতি কঠোর।৩৪২

ব্যাখ্যা

এ আয়াতদু'টিতে হযরত ইসরাফীল আলাইহিস সালাম পুনরুত্থান দিবসে শিঙ্গায় ফুঁ দেওয়ার পর সকল কবরবাসী যখন কবর থেকে উঠে হাশরের ময়দানে ছুটে যাবে, তখনকার ভয়াবহ পরিস্থিতির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এতে যে বলা হয়েছে স্তন্যদাত্রী তার শিশু থেকে গাফেল হয়ে যাবে এবং গর্ভবর্তী মহিলার গর্ভপাত হয়ে যাবে, তা বলা হয়েছে রূপকার্থে। বাস্তবেই যে এমন ঘটবে তা নয়। বোঝানো হচ্ছে যে, সেদিনের পরিস্থিতি এমনই বিভীষিকাময় হবে যে, তখন কোনও গর্ভবর্তী মহিলা থাকলে তার গর্ভপাত হয়ে যেত, কোনও স্তন্যদাত্রী থাকলে সে তার শিশুর কথা ভুলে যেত।
আল্লাহ তাআলা বিভীষিকাময় সে দিনের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে আমাদের সাবধান করছেন, যাতে সে কঠিন দিনে তাঁর রহমতের ছায়ায় আশ্রয় পাওয়ার উদ্দেশ্যে ইহজীবনে তাঁর দেওয়া শরীআত মোতাবেক জীবনযাপন করি।

সাত নং আয়াত

وَلِمَنْ خَافَ مَقَامَ رَبِّهِ جَنَّتَانِ

অর্থ : (দুনিয়ায়) যে ব্যক্তি নিজ প্রতিপালকের সামনে দাঁড়ানোর ভয় রাখত, তার জন্য থাকবে দু'টি উদ্যান। ৩৪৩

ব্যাখ্যা

এটি সূরা আর-রহমানের ৪৬ নং আয়াত। এখান থেকে সূরাটির শেষ পর্যন্ত আয়াতসমূহে জান্নাতের বিভিন্ন নিআমতের বিবরণ দেওয়া হয়েছে। এ আয়াত বলছে, জান্নাতের সে স্থায়ী অফুরন্ত নিআমতরাজি পাবে এমন লোক, যে তার অন্তরে এই ভয় রাখে যে, একদিন তাকে তার প্রতিপালকের সামনে দাঁড়াতে হবে। সেদিন তাঁর কাছে সবকিছুর পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাব দিতে হবে। এ ভয়ের দাবি হলো কোনও অবস্থায়ই আল্লাহ তাআলার নাফরমানি না করা, সকল ক্ষেত্রে শরীআতের অনুশাসন মেনে চলা এবং তাকওয়া-পরহেযগারীর সঙ্গে জীবনযাপন করা।

আট নং আয়াত

وَأَقْبَلَ بَعْضُهُمْ عَلَى بَعْضٍ يَتَسَاءَلُونَ (25) قَالُوا إِنَّا كُنَّا قَبْلُ فِي أَهْلِنَا مُشْفِقِينَ (26) فَمَنَّ اللَّهُ عَلَيْنَا وَوَقَانَا عَذَابَ السَّمُومِ (27) إِنَّا كُنَّا مِنْ قَبْلُ نَدْعُوهُ إِنَّهُ هُوَ الْبَرُّ الرَّحِيمُ (28)

অর্থ : তারা একে অন্যের দিকে ফিরে অবস্থাদি জিজ্ঞেস করবে। বলবে, আমরা পূর্বে আমাদের পরিবারবর্গের মধ্যে (অর্থাৎ দুনিয়ায়) বড় ভয়ের ভেতর ছিলাম। অবশেষে আল্লাহ আমাদের প্রতি অনুগ্রহ করেছেন এবং আমাদেরকে রক্ষা করেছেন উত্তপ্ত বায়ুর শাস্তি থেকে। আমরা এর আগে তার কাছে দু'আ করতাম। বস্তুত তিনি অতি অনুগ্রহশীল, পরম দয়ালু।

ব্যাখ্যা

এ আয়াতসমূহে জান্নাতে প্রবেশের পর জান্নাতবাসীদের পরস্পরের মধ্যে যে কথাবার্তা হবে তার একটা অংশ উল্লেখ করা হয়েছে। তখন তারা একে অন্যকে আনন্দ ও কৃতজ্ঞতায় আপ্লুত হয়ে বলবে, আমরা দুনিয়ায় পরিবার-পরিজনের মধ্যে জীবন কাটাচ্ছিলাম এই ভীতির সঙ্গে যে, না-জানি মৃত্যুর পর আমাদের কী পরিণাম হয়। অর্থাৎ পার্থিব সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে মাতোয়ারা হয়ে আমরা আখেরাতকে ভুলে যাইনি। আল্লাহ তাআলার মেহেরবানীতে তাঁর হুকুমমত চলার চেষ্টা করেছি। ফলে আল্লাহ তাআলা আজ আমাদের প্রতি দয়া করেছেন। তিনি আমাদেরকে এমনই নিরাপত্তা দিয়েছেন যে, জাহান্নামের উত্তপ্ত বাতাস পর্যন্ত আমাদের স্পর্শ করে না। দুনিয়ায় আমরা তাঁর ভয়ে ভীত হয়ে তাঁকেই ডাকতাম, তাঁরই ইবাদত করতাম। তিনি আমাদের ডাক শুনেছেন। আমাদের ইবাদত কবুল করেছেন। তাই আজ তিনি আমাদের প্রতি অনুগ্রহ করেছেন। তিনি আমাদের সঙ্গে রহমতের আচরণ করছেন।
আল্লাহ তাআলা জান্নাতবাসীদের এ কথোপকথন উল্লেখ করে আমাদেরকে সচেতন করছেন যে, আমরা যেন সর্বাবস্থায় তাঁকে ভয় করে চলি, যেন তাকওয়া ও পরহেযগারীর সঙ্গে জীবনযাপন করি। আমরা যদি অন্তরে তাকওয়া ও আল্লাহভীতি জাগরূক রেখে আল্লাহর দেওয়া দীন অনুসরণ করে চলতে পারি, তবে আখেরাতে আমরাও জান্নাতের অনন্ত অফুরন্ত সুখ-শান্তি লাভ করতে পারব। তখন আমরাও এরূপ কৃতজ্ঞতার ভাষায় পরস্পরের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করতে পারব। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে তাওফীক দান করুন।

৩৩৭. সূরা বাকারা (২), আয়াত ৪০

৩৩৮. সূরা বুরূজ (৮৫), আয়াত ১২

৩৩৯. সূরা হুদ (১১), আয়াত ১০২-১০৬

৩৪০. সূরা আলে ইমরান (৩), আয়াত ২৮

৩৪১. সূরা আবাসা (৮০), আয়াত ৩৪-৩৭

৩৪২. সূরা হজ্জ (২২), আয়াত ১-২

৩৪৩, সূরা আর-রহমান (৫৫), আয়াত ৪৬
মানবশিশুর সৃজন পরিক্রমা ও তাকদীরের লিখন
হাদীছ নং : ৩৯৬

হযরত আব্দুল্লাহ ইবন মাস'ঊদ রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, মহা সত্যবাদী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের কাছে বর্ণনা করেছেন যে, প্রত্যেক ব্যক্তির সৃজন তার মায়ের গর্ভে চল্লিশ দিন জমা করে রাখা হয় শুক্রাকারে। তারপর তা জমাট বাঁধা রক্ত অবস্থায় থাকে সমান কাল। তারপর তা মাংসপিণ্ড অবস্থায় থাকে সমান কাল। তারপর ফিরিশতা পাঠানো হয়। সে ফিরিশতা তার মধ্যে রূহ ফুঁকে দেয়। আর তাকে চারটি বিষয় লিখতে আদেশ করা হয়- তার রিযিক, তার আয়ু, তার আমল এবং সে হতভাগ্য হবে না ভাগ্যবান। সেই সত্তার কসম, যিনি ব্যতীত কোনও মা'বূদ নেই, তোমাদের একেকজন সারা জীবন জান্নাতবাসীদের আমলের মত আমল করতে থাকে, এমনকি তার ও জান্নাতের মধ্যে মাত্র এক হাতের দূরত্ব থাকে। ঠিক এ অবস্থায় (তাকদীরের) লিখন তার অগ্রবর্তী হয়। তখন সে জাহান্নামবাসীদের আমলের মত আমল করতে শুরু করে। ফলে সে জাহান্নামে প্রবেশ করে। অপরদিকে তোমাদের একেকজন জাহান্নামবাসীদের আমলের মত আমল করতে থাকে, এমনকি তার ও জাহান্নামের মধ্যে মাত্র এক হাতের দূরত্ব থাকে। এ অবস্থায় (তাকদীরের) লিখন তার অগ্রবর্তী হয়ে যায়। তখন সে জান্নাতবাসীদের আমলের মত আমল করতে শুরু করে। ফলে সে তাতে প্রবেশ করে -বুখারী ও মুসলিম।
সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৬৫৯৪, ৭৪৫৪; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ২৬৪৩; সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ৪৭০৮; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ৩১৩৭; সুনানে ইবন মাজাহ, হাদীছ নং ৭৬: মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ৩৯৩৪; সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ৬১৭৪ তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর, হাদীছ নং ১০৪৪০
50 - باب الخوف
قَالَ الله تَعَالَى: {وَإِيَّايَ فَارْهَبُونِ} [البقرة: 40]، وَقالَ تَعَالَى: {إِنَّ بَطْشَ رَبِّكَ لَشَدِيدٌ} [البروج: 12]، وَقالَ تَعَالَى: {وَكَذَلِكَ أَخْذُ رَبِّكَ إِذَا أَخَذَ الْقُرَى وَهِيَ ظَالِمَةٌ إِنَّ أَخْذَهُ أَلِيمٌ شَدِيدٌ إِنَّ فِي ذَلِكَ لآيَةً لِمَنْ خَافَ عَذَابَ الآخِرَةِ ذَلِكَ يَوْمٌ مَجْمُوعٌ لَهُ النَّاسُ وَذَلِكَ يَوْمٌ [ص:143] مَشْهُودٌ وَمَا نُؤَخِّرُهُ إِلاَّ لأَجَلٍ مَعْدُودٍ يَوْمَ يَأْتِ لا تَكَلَّمُ نَفْسٌ إِلاَّ بِإِذْنِهِ فَمِنْهُمْ شَقِيٌّ وَسَعِيدٌ فَأَمَّا الَّذِينَ شَقُوا فَفِي النَّارِ لَهُمْ فِيهَا زَفِيرٌ وَشَهِيقٌ} [هود: 102 - 106]، وَقالَ تَعَالَى: {وَيُحَذِّرُكُمُ اللهُ نَفْسَهُ} [آل عمران: 28]، وَقالَ تَعَالَى: {يَوْمَ يَفِرُّ الْمَرْءُ مِنْ أَخِيهِ وَأُمِّهِ وَأَبِيهِ وَصَاحِبَتِهِ وَبَنِيهِ لِكُلِّ امْرِئٍ مِنْهُمْ يَوْمَئِذٍ شَأْنٌ يُغْنِيهِ} [عبس: 34 - 37]، وَقالَ تَعَالَى: {يَا أَيُّهَا النَّاسُ اتَّقُوا رَبَّكُمْ إِنَّ زَلْزَلَةَ السَّاعَةِ شَيْءٌ عَظِيمٌ يَوْمَ تَرَوْنَهَا تَذْهَلُ كُلُّ مُرْضِعَةٍ عَمَّا أَرْضَعَتْ وَتَضَعُ كُلُّ ذَاتِ حَمْلٍ حَمْلَهَا وَتَرَى النَّاسَ سُكَارَى وَمَا هُمْ بِسُكَارَى وَلَكِنَّ عَذَابَ اللهِ شَدِيدٌ} [الحج: 1 - 2]، وَقالَ تَعَالَى: {وَلِمَنْ خَافَ مَقَامَ رَبِّهِ جَنَّتَانِ} [الرحمان: 46]، وَقالَ تَعَالَى: {وَأَقْبَلَ بَعْضُهُمْ عَلَى بَعْضٍ يَتَسَاءلُونَ قَالُوا إِنَّا كُنَّا قَبْلُ فِي أَهْلِنَا مُشْفِقِينَ، فَمَنَّ اللهُ عَلَيْنَا وَوَقَانَا عَذَابَ السَّمُومِ إِنَّا كُنَّا مِنْ قَبْلُ نَدْعُوهُ إِنَّهُ هُوَ الْبَرُّ الرَّحِيمُ} [الطور: 25 - 28]
وَالآيات في الباب كثيرة جدًا معلومات، والغرض الإشارة إِلَى بعضها وقد حصل:
وأما الأحاديث فكثيرة جدًا فنذكر مِنْهَا طرفًا وبالله التوفيق:
396 - عن ابن مسعود - رضي الله عنه - قَالَ: حدثنا رَسُول الله - صلى الله عليه وسلم - وَهُوَ الصادق المصدوق: «إنَّ أحَدَكُمْ يُجْمَعُ خَلْقُهُ في بَطْنِ أُمِّهِ أربَعِينَ يَومًا نُطْفَةً، ثُمَّ يَكُونُ عَلَقَةً مِثْلَ ذلِكَ، ثُمَّ يَكُونُ مُضْغَةً مِثْلَ ذلِكَ، ثُمَّ يُرْسَلُ المَلَكُ، فَيَنْفُخُ فِيهِ الرُّوحَ، وَيُؤْمَرُ بِأرْبَعِ كَلِمَاتٍ: بِكَتْبِ رِزْقِهِ وَأجَلِهِ وَعَمَلِهِ وَشَقِيٌّ أَوْ سَعِيدٌ. فَوَالَّذِي لاَ إلهَ غَيْرُهُ إنَّ أحَدَكُمْ لَيَعْمَلُ بِعَمَلِ أهْلِ الجَنَّةِ حَتَّى مَا يَكُونُ بَيْنَهُ وبيْنَهَا إلاَّ ذِرَاعٌ فَيَسْبِقُ عَلَيهِ الكِتَابُ، فَيَعْمَلُ بِعَمَلِ أهْلِ النَّارِ فَيدْخُلُهَا، وَإنَّ أَحَدَكُمْ لَيَعْمَلُ بِعَمَلِ أهْلِ النَّارِ حَتَّى مَا يَكُونُ بَيْنَهُ وَبَيْنَهَا إلاَّ ذراعٌ، فَيَسْبِقُ عَلَيهِ الكِتَابُ فَيعْمَلُ بِعَمَلِ أهْلِ الجَنَّةِ فَيَدْخُلُهَا». مُتَّفَقٌ عَلَيهِ. (1)

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীছটি বর্ণনা করতে গিয়ে হযরত আব্দুল্লাহ ইবন মাস'উদ রাযি, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে الصادق المصدوق (মহা সত্যবাদী) বিশেষণের সঙ্গে উল্লেখ করেছেন।

الصادق অর্থ সত্যবাদী, যিনি সত্য কথা বলেন, সত্য সংবাদ দেন, সত্য সাক্ষ্য দেন, সকল ক্ষেত্রে সত্যনিষ্ঠ থাকেন।

المصدوق অর্থ সত্যে সম্ভাষিত, যাকে লক্ষ্য করে সত্য বলা হয়েছে, যাকে সত্য ওয়াদা দেওয়া হয়েছে। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে সত্যবাদী ছিলেন এবং আল্লাহ তাআলা তাঁকে যা কিছু বলেছেন সত্য বলেছেন। তাঁর উপর সত্যবাণী নাযিল করেছেন এবং তাঁর সঙ্গে যা-কিছু ওয়াদা করেছেন তা সত্যে পরিণত করেছেন।

হযরত আব্দুল্লাহ ইবন মাস'উদ রাযি. ছাড়াও আরও অনেক সাহাবী الصادق المصدوق (মহা সত্যবাদী) বিশেষণের সঙ্গে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নাম নিয়েছিলেন বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। যেমন হযরত মুগীরা ইবন শু'বা রাযি. হযরত আবূ হুরায়রা রাযি. প্রমুখ।

এ হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাতৃগর্ভে মানবশিশুর বেড়ে উঠার যে পর্যায়ক্রম বর্ণনা করেছেন, তা আল্লাহ তাআলার কুদরত ও সৃষ্টিকৌশলের এক সুস্পষ্ট নিদর্শন। কুরআন মাজীদে আল্লাহ তাআলা বলেন-

وَلَقَدْ خَلَقْنَا الْإِنْسَانَ مِنْ سُلَالَةٍ مِنْ طِينٍ ثُمَّ جَعَلْنَاهُ نُطْفَةً فِي قَرَارٍ مَكِينٍ ثُمَّ خَلَقْنَا النُّطْفَةَ عَلَقَةً فَخَلَقْنَا الْعَلَقَةَ مُضْغَةً فَخَلَقْنَا الْمُضْغَةَ عِظَامًا فَكَسَوْنَا الْعِظَامَ لَحْمًا ثُمَّ أَنْشَأْنَاهُ خَلْقًا آخَرَ فَتَبَارَكَ اللَّهُ أَحْسَنُ الْخَالِقِينَ

'আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি মাটির সারাংশ দ্বারা। তারপর তাকে স্খলিত বিন্দুরূপে এক সংরক্ষিত স্থানে রাখি। তারপর আমি সেই বিন্দুকে জমাট রক্তে পরিণত করি। তারপর সেই জমাট রক্তকে গোশতপিণ্ড বানিয়ে দিই। তারপর সেই গোশতপিণ্ডকে অস্থিতে রূপান্তরিত করি। তারপর অস্থিরাজিতে গোশতের আচ্ছাদন লাগিয়ে দিই। তারপর তাকে অন্য এক সৃষ্টিরূপে গড়ে তুলি। বস্তুত সকল কারিগরের শ্রেষ্ঠ কারিগর আল্লাহ কত মহান!

আল্লাহ তাআলা চাইলে মুহূর্তের মধ্যেই পূর্ণাঙ্গ মানবশিশুর রূপ দান করতে পারতেন। কিন্তু মায়ের প্রতি আসানীসহ আরও বহুবিধ কল্যাণার্থে এ পর্যায়ক্রমিক ধারা চালু করেছেন। যে ব্যক্তি তার সৃষ্টির উপর দৃষ্টিপাত করবে আর চিন্তা করবে কিভাবে সে এক তুচ্ছ শুক্রবিন্দু হতে ধাপে ধাপে এক সুন্দর সুদৃশ্য আকৃতির পূর্ণাঙ্গ মানুষে পরিণত হলো, সেইসঙ্গে আকল-বুদ্ধি ও বাকশক্তিসহ বহুবিচিত্র শক্তি-ক্ষমতার সমাহারে এক বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত মাখলূকের মর্যাদা লাভ করল, সে স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ সৃষ্টিকর্তার অস্তিতৃস্বীকারে বাধ্য হবে এবং তাঁর কৃতজ্ঞতায় অবনমিত হয়ে কেবল তাঁরই ইবাদত বন্দেগী ও তাঁরই আনুগত্য করাকে নিজের জন্য অবধারিত করে নেবে।

সকলের জানা, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিরক্ষর ছিলেন। বিশেষ কোনও বিদ্যা শেখেননি। বিশেষ কোনও শাস্ত্রীয় বই-পুস্তক কখনও পড়েননি। পড়তেই জানতেন না। কোনও শিক্ষকের সামনে জানু পেতে বসারই সুযোগ তাঁর কখনও হয়নি। তা সত্ত্বেও ভ্রূণ সম্পর্কিত জ্ঞান তিনি কোথায় পেলেন? সন্দেহ নেই এটা আল্লাহ তাআলার নিকট থেকেই পাওয়া। সুতরাং তিনি যে একজন সত্যনবী ছিলেন এবং আল্লাহ তাআলার নিকট থেকে ওহী মারফত তিনি জ্ঞান লাভ করতেন, এ হাদীছটি তার এক উজ্জ্বল প্রমাণ।

তাকদীর লেখা সম্পর্কে কিছু কথা
এ হাদীছে বলা হয়েছে, ফিরিশতা মাতৃগর্ভে শিশুর চারটি বিষয় লিখে থাকে। বাহ্যত বোঝা যায় লেখার কোনও পাত্রেই তা লেখা হয়। মুসলিম শরীফের এক বর্ণনায় স্পষ্টই আছে ثم تطوى الصحف، فلا يزاد فيها ولا ينقص ‘তারপর সহীফা (রেজিস্ট্রার) ভাঁজ করে ফেলা হয়। তাতে আর কিছু বাড়ানো ও কমানো হয় না।৩৪৭

কিন্তু হযরত আবূ যার রাযি. বর্ণিত এক হাদীছে আছে ثم يكتب بين عينيه ما هو لاق ‘তারপর তার দুই চোখের মাঝখানে (কপালে) লিখে দেয় সে যা-কিছুর সম্মুখীন হবে তা সব।৩৪৮

বাস্তবিকপক্ষে উভয় বর্ণনার মধ্যে কোনও বিরোধ নেই। হাদীছে বর্ণিত বিষয়গুলো যেমন কোনও রেজিস্ট্রারে লেখা হয়, তেমনি শিশুর ললাটেও লিখে দেওয়া হয়।

প্রশ্ন হতে পারে, কোনও কোনও হাদীছ দ্বারা তো জানা যায় তাকদীর লেখা হয়েছে মানবসৃষ্টির অনেক আগে, যেমন হযরত আব্দুল্লাহ ইবন উমর রাযি. বর্ণিত এক হাদীছে আছে كتب الله مقادير الخلائق قبل أن يخلق السماوات والأرض بخمسين ألف سنة “আল্লাহ মাখলুকাতের তাকদীর লিখেছেন আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টির পঞ্চাশ হাজার বছর আগে।৩৪৯

উভয় বর্ণনা কি পরস্পরবিরোধী নয়?
উত্তর হলো, না, পরস্পরবিরোধী নয়। কেননা মুসলিম শরীফের এ হাদীছে যে তাকদীর লিখনের কথা বলা হয়েছে তা হচ্ছে লাওহে মাহফূযের লেখা, যাকে ‘উম্মুল কিতাব'ও বলা হয়। সর্বপ্রথম আল্লাহ তাআলা তাতে সমস্ত মাখলূক সম্পর্কিত যাবতীয় বিষয় লিপিবদ্ধ করেছেন। হযরত উবাদা ইবনুস সামিত রাযি. থেকে বর্ণিত এক হাদীছে আছে أول ما خلق الله : القلم، ثم قال له: أكتب قال: وما أكتب؟ قال: القدر، قال فكتب ما يكون وما هو كائن إلى أن تقوم الساعة “আল্লাহ তাআলা সর্বপ্রথম যে জিনিস সৃষ্টি করেছেন তা হলো কলম। তাকে বললেন, লেখ। সে বলল, কী লিখব? বললেন, তাকদীর। তখন কলম কিয়ামত সংঘটিত হওয়া পর্যন্ত যা-কিছু ঘটবে সব লিখল।৩৫০
অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা নিজ 'ইলম ও কুদরতে যা-কিছু সৃষ্টি করবেন বলে স্থির করেছেন এবং প্রত্যেক সৃষ্টির আনুষাঙ্গিক যা-কিছু নির্ধারণ করেছেন তা সব সে আদি কলম দ্বারা লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। সে লেখার কোনও পরিবর্তন নেই। এটি অপরিবর্তনীয় তাকদীর। তারপর ফিরিশতাদের দ্বারা মাতৃগর্ভে যে তাকদীর লেখানো হয় বলে আমাদের আলোচ্য এ হাদীছে বর্ণিত হয়েছে, এটা স্বতন্ত্র লিখন, যা প্রত্যেক মানবশিশুর জন্য পৃথক পৃথকভাবে লেখা হয়ে থাকে। এ লেখায় পরিবর্তনেরও সুযোগ থাকে। বিভিন্ন হাদীছে যে বিভিন্ন আমলের দ্বারা আয়ু বাড়া-কমার উল্লেখ পাওয়া যায়, তার সম্পর্কও এ লেখার সঙ্গেই। কুরআন মাজীদেও এর প্রতি ইশারা পাওয়া যায়। ইরশাদ হয়েছে يَمْحُو اللَّهُ مَا يَشَاءُ وَيُثْبِتُ وَعِنْدَهُ أُمُّ الْكِتَابِ 'আল্লাহ যা চান (অর্থাৎ যে বিধানকে ইচ্ছা করেন) রহিত করে দেন এবং যা চান বলবৎ রাখেন। সমস্ত কিতাবের যা মূল, তা তাঁরই কাছে।৩৫১

মাতৃগর্ভে যে চারটি বিষয় লেখা হয়
এ হাদীছে যে চারটি জিনিস লেখা হয় বলে জানানো হয়েছে, তার মধ্যে একটি হলো রিযিক। এর দ্বারা আমাদেরকে পরিতুষ্টির গুণ অর্জনে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ তোমাদের প্রত্যেকের রিযিক যখন নির্ধারিত আছে, তখন অহেতুক লোভ করো না। বাড়তি উপার্জনের জন্য উন্মত্ত হয়ে যেও না। চেষ্টা অবশ্যই করবে, তবে তাতে বাড়াবাড়ি করবে না। যখন যা অর্জিত হয় তাতে সন্তুষ্ট থাকবে। আরও কেন অর্জিত হলো না সে আক্ষেপ করবে না।

দুনিয়ায় কে কতদিন বাঁচবে তাও লিখে দেওয়া হয়। কাজেই যার যতদিন আয়ু সে ততদিনই বাঁচবে, তার বেশিও নয় কমও নয়। কুরআন মাজীদে ইরশাদ فَإِذَا جَاءَ أَجَلُهُمْ لَا يَسْتَأْخِرُونَ سَاعَةً وَلَا يَسْتَقْدِمُونَ "যখন তাদের সেই নির্দিষ্ট সময় এসে পড়ে, তখন তারা এক মুহূর্তও বিলম্ব করতে পারে না এবং ত্বরাও করতে পারে না।৩৫২

সুতরাং যার যখন মৃত্যু হয়, তা তার নির্দিষ্ট সময়ই হয়। তার প্রিয়জনদের উচিত আল্লাহ তাআলার ফয়সালা হিসেবে তা মেনে নেওয়া। এমন কোনও কথা বলা উচিত নয়, যা তাকদীর বা আল্লাহ তাআলার ফয়সালার বিরুদ্ধে অভিযোগ বলে মনে হয়।

বস্তুত তাকদীরের উপর বিশ্বাস রাখা ঈমানের অপরিহার্য অঙ্গ। এ বিশ্বাস ছাড়া কেউ মুমিনই হতে পারে না। মৃত্যু তো বটেই, ছোটখাটো কোনও আঘাতও তাকদীরের লিখন ছাড়া হয় না। যে-কোনও অর্জন বা যে-কোনও ক্ষয় ও বিয়োগ তাকদীর অনুযায়ীই হয়ে থাকে। এতে বিশ্বাস রাখাতেই দুনিয়ার প্রশান্তি ও আখেরাতের মুক্তি।

এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

ما بلغ عبد حقيقة الإيمان، حتى يعلم أن ما أصابه لم يكن ليخطئه، وما أخطأه لم يكن ليصيبه

“কোনও বান্দা ঈমানের প্রকৃত স্তরে পৌঁছতে পারে না, যতক্ষণ না সে মনেপ্রাণে জেনে নেয় যে, যা সে লাভ করেছে তা তার হারানোর ছিল না, আর যা সে হারিয়েছে তা তার পাওয়ার ছিল না।৩৫৩

প্রকাশ থাকে যে, তাকদীরের বিষয়টি আল্লাহ তাআলার এক গুপ্ত রহস্য। এর প্রকৃত স্বরূপ আল্লাহ তাআলাই জানেন। এ নিয়ে বেশি ঘাঁটাঘাঁটি করা উচিত নয়। ঘাঁটাঘাটি করলে এর কুলকিনারা পাওয়ার কোনও নিশ্চয়তা নেই। বরং তাতে অস্থিরতাই বাড়ে। এমনকি পদস্খলিত হওয়ারও যথেষ্ট আশঙ্কা থাকে। উলামায়ে কেরাম বলেন, আল্লাহ তাআলা নিজ হিকমতে তাকদীরের জ্ঞান মানুষের থেকে আড়াল করে রেখেছেন। কারও আকল-বুদ্ধি তা আয়ত্ত করতে সক্ষম নয়। হযরত আব্দুল্লাহ ইবন মাস'উদ রাযি. থেকে বর্ণিত আছে যে, যখন তাকদীরের আলোচনা আসে, তখন তোমরা ক্ষান্ত হয়ে যেও। বলা হয়ে থাকে, জান্নাতবাসীগণ যখন জান্নাতে প্রবেশ করবে, তখনই তাদের কাছে তাকদীরের রহস্য উন্মোচিত হবে, তার আগে নয়।

এমনিভাবে লেখা হয়—–কে ভাগ্যবান আর কে হতভাগা তাও। এর মানে আমলও লেখা হয়। কেননা যার আমল ভালো সে জান্নাত লাভ করবে। আর যে জান্নাত লাভ করবে সেই ভাগ্যবান। যার আমল মন্দ সে জাহান্নামে যাবে। আর যে জাহান্নামে যাবে সেই হতভাগা।

জান্নাতলাভে আমলের ভূমিকা প্রসঙ্গ
বোঝা গেল জান্নাত ও জাহান্নামে প্রবেশের সঙ্গে আমলের সম্পর্ক আছে। যে ব্যক্তি জান্নাতে যাওয়ার আশা রাখে, তাকে অবশ্যই সৎকর্ম করতে হবে। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-

إِنَّ الَّذِينَ قَالُوا رَبُّنَا اللَّهُ ثُمَّ اسْتَقَامُوا فَلَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُونَ أُولَئِكَ أَصْحَابُ الْجَنَّةِ خَالِدِينَ فِيهَا جَزَاءً بِمَا كَانُوا يَعْمَلُونَ

“নিশ্চয়ই যারা বলেছে, আমাদের প্রতিপালক আল্লাহ, তারপর এতে অবিচল থেকেছে, তাদের কোনও ভয় নেই এবং তারা দুঃখিতও হবে না। তারা হবে জান্নাতবাসী। সেখানে তারা থাকবে সর্বদা। তারা যা করত তার প্রতিদানস্বরূপ।৩৫৪

অপর এক আয়াতে ইরশাদ سَلَامٌ عَلَيْكُمُ ادْخُلُوا الْجَنَّةَ بِمَا كُنْتُمْ تَعْمَلُونَ 'তোমাদের প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক। তোমরা যে আমল করতে, তার ফলে জান্নাতে প্রবেশ কর।৩৫৫
এরকম আরও বহু আয়াত আছে, যা দ্বারা স্পষ্টই বোঝা যায়, জান্নাত দেওয়া হবে বান্দার আমলের প্রতিদানে। এ কথা ঠিক যে, কোনও কোনও হাদীছে এরকমও আছে যে, কেউ নিজ আমল দ্বারা মুক্তি পাবে না। যেমন এক হাদীছে ইরশাদ হয়েছে-

«ما من أحد يدخله عمله الجنة»، فقيل: ولا أنت يا رسول الله؟ قال: «ولا أنا، إلا أن يتغمدني ربي برحمة»

“তোমাদের কাউকে তার আমল জান্নাতে প্রবেশ করাতে পারবে না। জিজ্ঞেস করা হলো, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনাকেও নয়? তিনি বললেন, আমাকেও নয়, যদি না আমার প্রতিপালক নিজ রহমত দ্বারা আমাকে আচ্ছন্ন করে নেন।৩৫৬

প্রকৃতপক্ষে আয়াতের সঙ্গে এ হাদীছের কোনও বিরোধ নেই। কেননা আয়াতে যে আমল দ্বারা জান্নাত পাওয়া যাবে বলে জানানো হয়েছে, সে আমল তো আল্লাহ তাআলার তাওফীক হলেই করা সম্ভব। আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে তাওফীক লাভ হয় একান্তই তাঁর রহমত ও দয়ায়। তাছাড়া সৎকর্ম আল্লাহ তাআলার রহমত পাওয়ার অছিলাও বটে।

হাদীছটিতে বান্দার আমল প্রসঙ্গে বলা হয়েছে- فيسبق عليه الكتاب (তাকদীরের) লিখন তার অগ্রবর্তী হয়ে যায়। তোমাদের একেকজন সারা জীবন জান্নাতবাসীদের আমলের মত আমল করতে থাকে, এমনকি তার ও জান্নাতের মধ্যে মাত্র এক হাতের দূরত্ব থাকে। ঠিক এ অবস্থায় (তাকদীরের) লিখন তার অগ্রবর্তী হয়। তখন সে জাহান্নামবাসীদের আমলের মত আমল করতে শুরু করে। ফলে সে জাহান্নামে প্রবেশ করে। একই কথা বলা হয়েছে জাহান্নামীদের সম্পর্কেও।

এর অর্থ হলো, বান্দার চালিয়ে যাওয়া আমল এবং তার সৌভাগ্য ও দুর্ভাগ্য সম্পর্কিত লিখনের মধ্যে বিরোধ দেখা দেয়। তাতে লিখন জয়ী হয়ে যায়। তারপর বান্দা সে লিখন অনুযায়ীই আমল করতে থাকে। এটিকেই فيسبق عليه الكتاب (তাকদীরের) লিখন তার অগ্রবর্তী হয়ে যায়' বাক্যে ব্যক্ত করা হয়েছে। কেননা প্রতিযোগিতায় যে অগ্রগামী হয়, সেই তার উদ্দেশ্যে সফল হয়। যে পেছনে পড়ে যায় সে সফল হতে পারে না। বিষয়টি এভাবে বোঝা যেতে পারে যে, আমল ও লিখনকে যদি পৃথক দুই ব্যক্তি কল্পনা করা হয় আর তারা দু'জন দৌড় প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়, তবে সেই দৌড়ে ‘লিখন' নামক ব্যক্তি আগে চলে যাবে এবং 'আমল' নামক ব্যক্তি পেছনে পড়ে থাকবে।

মৃত্যু নেক আমলের অবস্থায় হওয়াটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ
এর দ্বারা বোঝা গেল শেষ সময়ের আমলই গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমদিকে যত ভালো আমলই করুক, যদি নেক আমলের অবস্থায় মৃত্যু না হয়, তবে তার পরিণাম অত্যন্ত আশঙ্কাজনক। তাই মনে খুব ভয় রাখা দরকার। বর্তমান ভালো অবস্থার কারণে গর্বিত হওয়া বা আত্মমুগ্ধতায় ভোগার কোনও সুযোগ নেই। তাই তো এক হাদীছে ইরশাদ হয়েছে-

لا عليكم أن لا تعجبوا بأحد، حتى تنظروا بم يختم له، فإن العامل يعمل زمانا من عمره، أو برهة من دهره، بعمل صالح، لو مات عليه دخل الجنة، ثم يتحول فيعمل عملا سيئا، وإن العبد ليعمل البرهة من دهره بعمل سيئ، لو مات عليه دخل النار، ثم يتحول فيعمل عملا صالحا، وإذا أراد الله بعبد خيرا استعمله قبل موته»، قالوا: يا رسول الله، وكيف يستعمله؟ قال: «يوفقه لعمل صالح، ثم يقبضه عليه.

“তোমরা কারও আমল দেখে আশ্চর্যবোধ করো না, যতক্ষণ না দেখতে পাও তার মৃত্যু কোন আমলের উপর হয়। কেননা কোনও কোনও আমলকারী জীবনভর বা জীবনের দীর্ঘ একটা কাল সৎকর্মে রত থাকে। যদি ওই অবস্থায় সে মারা যেত, অবশ্যই জান্নাতে প্রবেশ করত। কিন্তু পরে তার অবস্থার পরিবর্তন হয় এবং সে অসৎকর্মে লিপ্ত হয়ে পড়ে। এমনিভাবে কোনও কোনও বান্দা জীবনের একটা দীর্ঘকাল অসৎকর্মে লিপ্ত থাকে। সেই অবস্থায় মারা গেলে অবশ্যই জাহান্নামে যেত। পরে তার পরিবর্তন ঘটে। সে সৎকর্মে লিপ্ত হয়। আল্লাহ তাআলা তার যে বান্দার কল্যাণ চান, তাকে তার মৃত্যুর আগে আমলে লাগিয়ে দেন। সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! কিভাবে আমলে লাগান? তিনি বললেন, তাকে সৎকর্মের তাওফীক দেন। তারপর সে অবস্থায় তাকে মৃত্যু দেন।৩৫৭

মৃত্যুর আগে যেহেতু অবস্থা পরিবর্তনের সম্ভাবনা থাকে, তাই যাদেরই নেক আমলের তাওফীক লাভ হয়, তাদের আল্লাহ তাআলার কাছে এ দুআ করাও জরুরি যেন তিনি মৃত্যু পর্যন্ত সে তাওফীক জারি রাখেন এবং সর্বাবস্থায় সৎকর্মে অবিচল থাকতে সাহায্য করেন। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুআ শিক্ষা দিয়েছেন يا مقلب القلوب ثبت قلبي على دينك “হে অন্তরসমূহের পরিবর্তনকারী! আপনি আমার অন্তর আপনার দীনের উপর প্রতিষ্ঠিত রাখুন।'রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেও এ দুআ খুব বেশি পড়তেন।৩৫৮

উল্লেখ্য, এ হাদীছটি মৃত্যুর পর পুনরুত্থানের সত্যতার পক্ষে এক শক্তিশালী দলীল। কেননা যে মহান আল্লাহ মাতৃগর্ভে তুচ্ছ শুক্রবিন্দুকে জমাট রক্তে, তারপর মাংসপিণ্ডে, তারপর সুবিন্যস্ত অস্থিকাঠামোয় পূর্ণাঙ্গ মানবরূপ দিয়ে তার ভেতর রূহ ফুঁকে দিতে পারেন, তারপর তার মধ্যে বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ বহুবিচিত্র গুণের সমাহার ঘটিয়ে এ নশ্বর জগতে নিয়ে আসতে পারেন, তিনি তাকে তার মৃত্যুর পর বিচূর্ণ বিক্ষিপ্ত অংশসমূহ একত্র করে পুনর্জীবিত করতে পারবেন না কেন? নিশ্চয়ই পারবেন। মহান সর্বশক্তিমান আল্লাহ তাআলার পক্ষে কোনওকিছুই অসম্ভব নয়।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. তাকদীরের লিখন সত্য। মানুষের রিযিক, আয়ু সবই লেখা আছে।

খ. রিযিক ও অর্থ-সম্পদের জন্য লোভ-লালসা না করে আপন অবস্থায় পরিতুষ্ট থাকা ও পরিমিত চেষ্টা করাই কাম্য।

গ. প্রিয়জনের মৃত্যুতে তাকদীর-বিরোধী অনুচিত মন্তব্য করা হতে বিরত থেকে আল্লাহর ফয়সালায় রাজি থাকাই ঈমানের দাবি।

ঘ. আল্লাহ তাআলার রহমত ও জান্নাতলাভের জন্য আমল সহায়ক। তাই আমলে অবহেলা উচিত নয়।

ঙ. নিজের বা অন্যের আপাতকালীন আমল দেখে ধোঁকায় পড়া উচিত নয়। যে-কারও ভালো আমল শেষটায় মন্দ আমলে পরিবর্তিত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। আবার যে-কোনও মন্দ আমলকারীও শেষটায় ভালো আমলে মনোযোগী হতে পারে বলে আশা থাকে।

চ. নিরক্ষর হওয়া সত্ত্বেও মাতৃগর্ভে ভ্রূণের পর্যায়ক্রমিক বৃদ্ধি সম্পর্কে সংবাদ দেওয়াটা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নবুওয়াতের সত্যতার পক্ষে একটি মজবুত দলীল।

ছ. এ হাদীছ দ্বারা মৃত্যুর পর পুনরুত্থান সম্পর্কেও ধারণা মেলে।

৩৪৬. সূরা মু'মিনূন (২৩), আয়াত ১২-১৪

৩৪৭. সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ২৬৪৪; মুসনাদুল হুমাইদী, হাদীছ নং ৮৪৮; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ১৬১৪২; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর, হাদীছ নং ৩০৩৮, তহাবী, শারহু মুশকিলিল আছার, হাদীছ নং ২৬৬৩

৩৪৮. সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ৬১৭৮; মুসনাদে আবূ ইয়া'লা, হাদীছ নং ৫৭৭৫

৩৪৯. সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ২৬৫৩; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ২১৫৬; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ, হাদীছ নং ৬৭; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ৬৫৭৯; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীছ নং ৬১৩৮: তাবারানী, আল মুজামুল কাবীর, হাদীছ নং ৮০

৩৫০. জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ৩৩১৯; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ২২৭০৭; সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ৪৭০০; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর, হাদীছ নং ১২২২৭; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ১৭৭০৩

৩৫১. সূরা রা'দ (১৩), আয়াত ৩৯

৩৫২. সূরা আ'রাফ (৭), আয়াত ৩৪

৩৫৩. তাবারানী, আল মুজামুল কাবীর, হাদীছ নং ৬০৬০; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ২৭৪৯; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ২১৪৪; বায়হাকী, শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ২১০

৩৫৪. সূরা আহকাফ (৪৬), আয়াত ১৩-১৪

৩৫৫. সূরা নাহল (১৬), আয়াত ৩২

৩৫৬. সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৬৪৬৩; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ২৮১৬; তাবারানী, আল মুজামুল কাবীর, হাদীছ নং ৭২১৮

৩৫৭. মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ১২২১৪; মুসনাদে আবূ ইয়া'লা, হাদীছ নং ৩৭৫৬

৩৫৮. জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ২১৪০; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীছ নং ৩৮৩৪; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ১২১০৭; মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, হাদীছ নং ২৯১৯৬; আল-আদাবুল মুফরাদ, হাদীছ নং ৬৮৩; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর, হাদীছ নং ৭৫৯; বায়হাকী, শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ৭৪২; মুসনাদে আবূ ইয়া'লা, হাদীছ নং ২৩১৮
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:বিশুদ্ধ (পারিভাষিক সহীহ)