রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ

ভূমিকা অধ্যায়

হাদীস নং: ৩৯০
অধ্যায়ঃ ৪৯

মানুষের উপর তাদের বাহ্যিক অবস্থা অনুযায়ী শরীআতের বিধান জারী করা এবং তাদের অভ্যন্তরীণ অবস্থা আল্লাহর উপর ছেড়ে দেওয়া

ইসলাম দ্বারা দুনিয়ায়ও মানুষের জান-মালের নিরাপত্তা লাভ হয়। ইসলাম হলো আল্লাহ ছাড়া কোনও মা'বূদ নেই এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহ তাআলার নবী ও রাসূল বলে সাক্ষ্য দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে যে দীন ও শরীআত নিয়ে এসেছেন তা গ্রহণ করে নেওয়া। যে ব্যক্তি মুখে এটা স্বীকার করে নেয় সে-ই মুসলিম। যদি অন্তরে এর প্রতি বিশ্বাস না থাকে, সে মুনাফিক। তবে কার মনে বিশ্বাস আছে আর কার মনে বিশ্বাস নেই তা আল্লাহ তাআলা ছাড়া কারও পক্ষে বলা সম্ভব নয়। এ হিসেবে কাউকে মুনাফিক সাব্যস্ত করা সম্ভবও নয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জমানায় কিছু সংখ্যক লোক মুনাফিক ছিল। তাঁকে ওহীর মাধ্যমে তা জানিয়েও দেওয়া হয়েছিল। তাই ইতিহাসে তারা মুনাফিকরূপে চিহ্নিত হয়ে আছে। কিন্তু এখন যেহেতু ওহী নাযিলের ধারা বন্ধ, তাই এখন বাস্তবিকপক্ষে কেউ মুনাফিক হলেও কারও পক্ষে তা জানা সম্ভব নয়। দুনিয়ার বিচারে এখন মানুষ কেবল দু'প্রকার হয় মুসলিম নয়তো কাফের। সুতরাং বাহ্যিকভাবে যাকে মুসলিম মনে হবে, তাকে মুসলিমই গণ্য করতে হবে। আর বাহ্যিকভাবে যাকে কাফের মনে হবে, তাকে কাফেরই গণ্য করা হবে।
এমনিভাবে মুসলিম ব্যক্তির বাহ্যিক আমল ভালো হলে তাকে নেককার গণ্য করা হবে। তার নিয়ত সম্পর্কে সন্দেহ করা যাবে না। আবার বাহ্যিকভাবে পাপাচারে লিপ্ত থাকলে তাকে ফাসেক বলা হবে। মন ভালোর দোহাই দিয়ে তার পাপাচারকে উপেক্ষা করা হবে না। কুরআন ও হাদীছ আমাদেরকে এ শিক্ষাই দেয়। রিয়াযুস সালিহীনের এ অধ্যায়ে সে সম্পর্কিত একটি আয়াত ও কয়েকটি হাদীছ পেশ করা হয়েছে। নিচে তার বঙ্গানুবাদ ও সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা পেশ করা যাচ্ছে । আল্লাহ তাআলাই তাওফীকদাতা।

‘মানুষের উপর তাদের বাহ্যিক অবস্থা অনুযায়ী শরীআতের বিধান জারী করা এবং তাদের অভ্যন্তরীন অবস্থা আল্লাহর উপর ছেড়ে দেওয়া সম্পর্কিত একটি আয়াত

فَإِنْ تَابُوا وَأَقَامُوا الصَّلَاةَ وَآتَوُا الزَّكَاةَ فَخَلُّوا سَبِيلَهُمْ إِنَّ اللَّهَ غَفُورٌ رَحِيمٌ

অর্থ : অবশ্য তারা যদি তাওবা করে, নামায কায়েম করে ও যাকাত দেয়, তবে তাদের পথ ছেড়ে দেবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।৩২৩

ব্যাখ্যা

এটি সূরা তাওবার ৫ম আয়াত। সূরাটি নাযিল হয়েছিল মক্কাবিজয়ের পর। আরবের বহু গোত্র, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে কুরাইশ কাফেরদের যুদ্ধ কোন পরিণতিতে পৌছায়——তার অপেক্ষায় ছিল। হিজরী ৬ সনে কুরাইশ গোত্রের সঙ্গে 'হুদায়বিয়া' নামক স্থানে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একটি শান্তিচুক্তি সম্পাদিত হয়েছিল। হিজরী ৮ সনে তারা সে চুক্তি বাতিল ঘোষণা করে। ফলে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কা মুকাররামায় হামলা চালান এবং বিশেষ রক্তপাত ছাড়াই জয়লাভ করেন। এটাই ছিল তাদের সঙ্গে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সর্বশেষ যুদ্ধ। এতে তাদের পরাজয়ের পর আরবের যেসকল গোত্র কুরাইশের কারণে ইসলাম গ্রহণ করতে ভয় পাচ্ছিল কিংবা যারা যুদ্ধের শেষ পরিণতি দেখার অপেক্ষায় ছিল, তাদের অন্তর থেকে ইসলাম গ্রহণের প্রতিবন্ধকতা দূর হয়ে যায়। ফলে তারা দলে দলে মদীনা মুনাউওয়ারায় এসে ইসলাম গ্রহণ করতে থাকে। এভাবে জাযিরাতুল আরবের অধিকাংশ এলাকায় ইসলামী পতাকা উড়তে শুরু করে।
মক্কাবিজয়ের পর আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে জাযিরাতুল আরবকে ইসলামের কেন্দ্রভূমি ঘোষণা করা হলো। মূল উদ্দেশ্য ছিল এই যে, আরব উপদ্বীপে কোনও অমুসলিম সাধারণ নাগরিক হিসেবে বসবাস করতে পারবে না। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক হাদীছে এ আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করেই ইরশাদ করেন-

لَا يَجْتَمِعُ فِي جَزِيرَةِ الْعَرَبِ دِيْنَانِ

(আরব উপদ্বীপে দু'টি দীন একত্রে অবস্থান করতে পারে না)।’৩২৪

এ লক্ষ্য বাস্তবায়ন করা হয় পর্যায়ক্রমে। সর্বপ্রথম লক্ষ্য স্থির করা হয় মূর্তিপূজার মলোচ্ছেদ, যাতে জাযিরাতুল আরবের কোথাও মূর্তিপূজার চিহ্নমাত্র না থাকে। সুতরাং আরবের যেসকল মূর্তিপূজক অবশিষ্ট ছিল এবং যারা বিশ বছরেরও বেশি কাল যাবৎ মুসলিমদের প্রতি বর্বরোচিত জুলুম-নির্যাতন চালিয়েছিল, তাদেরকে বিভিন্ন মেয়াদে অবকাশ দেওয়া হলো। এ সূরার শুরুতে সেসব মেয়াদের উল্লেখপূর্বক জানিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, তাদের সঙ্গে মুসলমানদের আর কোনও সম্পর্ক থাকল না। তাদেরকে এ সময়ের ভেতর ইসলাম গ্রহণ করতে হবে। আর তা না করলে তাদেরকে জাযিরাতুল আরব ছাড়তে হবে । যদি ইসলাম গ্রহণ না করে এবং জাযিরাতুল আরব ছেড়েও না যায়, তবে তাদের সঙ্গে যুদ্ধ হবে। এতদ্‌সঙ্গে মসজিদুল হারামকে মূর্তিপূজার সকল চিহ্ন থেকে পবিত্র করারও ঘোষণা দিয়ে দেওয়া হলো। এ ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল হিজরী ৯ সনের হজ্জের সময়।
জাযিরাতুল আরবে যেসকল মুশরিক বাস করত, তাদের মধ্যে একদল ছিল এরকম, যাদের সঙ্গে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যুদ্ধবিরোধী চুক্তি সম্পন্ন করেছিলেন বটে, কিন্তু তারা সে চুক্তির মর্যাদা রক্ষা না করে বিশ্বাসঘাতকতার পরিচয় দিয়েছিল। তাদেরকে বাড়তি কোনও সময় দেওয়া হয়নি, তবে তাদের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদের ঘোষণা যেহেতু হজ্জের সময় দেওয়া হয়েছিল, যা এমনিতেই সম্মানিত মাস, যখন যুদ্ধ-বিগ্রহ জায়েয নয় এবং এর পরের মুহাররামও এরকমই একটি মাস, তাই স্বাভাবিকভাবেই মুহাররাম মাসের শেষ পর্যন্ত তারা সময় পেয়ে গিয়েছিল। তাদেরই সম্পর্কে আলোচ্য আয়াতের শুরুতে বলা হয়েছে-

فَإِذَا انْسَلَخَ الْأَشْهُرُ الْحُرُمُ فَاقْتُلُوا الْمُشْرِكِينَ حَيْثُ وَجَدْتُمُوهُمْ وَخُذُوهُمْ وَاحْصُرُوهُمْ وَاقْعُدُوا لَهُمْ كُلَّ مَرْصَدٍ

‘অতঃপর সম্মানিত মাসসমূহ অতিবাহিত হলে মুশরিকদেরকে (যারা তোমাদের চুক্তি ভঙ্গ করেছিল) যেখানেই পাবে হত্যা করবে। তাদেরকে গ্রেফতার করবে, অবরোধ করবে এবং তাদেরকে ধরার জন্য প্রত্যেক ঘাঁটিতে ওঁৎ পেতে বসে থাকবে।'
অর্থাৎ সম্মানিত মাসসমূহ গত হওয়ার পরও যদি তারা ঈমান না আনে এবং জাযিরাতুল আরব ত্যাগও না করে, তবে তাদেরকে কতল করা হবে। তারপর এ আয়াতের পরবর্তী অংশে ইরশাদ হয়েছে-

فَإِنْ تَابُوا وَأَقَامُوا الصَّلَاةَ وَآتَوُا الزَّكَاةَ فَخَلُّوا سَبِيلَهُمْ إِنَّ اللَّهَ غَفُورٌ رَحِيمٌ

‘অবশ্য তারা যদি তাওবা করে, নামায কায়েম করে ও যাকাত দেয়, তবে তাদের পথ ছেড়ে দেবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।'
অর্থাৎ তারা যদি প্রকাশ্যে কুফর ও শিরক থেকে তাওবা করে মুসলিম সমাজের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়, যার বড় আলামত হলো নামায পড়া ও যাকাত দেওয়া, তবে তাদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা গ্রহণ করার অনুমতি নেই। ইসলাম গ্রহণের কারণে তারা তাদের জান ও মালের নিরাপত্তা পেয়ে যাবে। সুতরাং তোমরা তাদেরকে মুক্ত ও নিরাপদ জীবন যাপন করতে দেবে। তাদের মনে কী আছে বা নেই, তার পেছনে পড়বে না। মনের অবস্থা আল্লাহর উপরই ন্যস্ত থাকবে। তোমরা কেবল তাদের বাহ্যিক অবস্থাই দেখবে। সে হিসেবে তাদের সঙ্গে মুসলিমসুলভ আচরণই করবে।
আয়াতে তাদের মুক্ত ও স্বাধীন জীবনযাপনের জন্য ইসলামগ্রহণের ঘোষণা দেওয়ার পাশাপাশি নামায পড়া ও যাকাত দেওয়ার শর্তও যুক্ত করা হয়েছে। বোঝা গেল নিরাপত্তালাভের জন্য কেবল ইসলামগ্রহণের ঘোষণা দেওয়াই যথেষ্ট নয়; নামায পড়া ও যাকাত দেওয়াও জরুরি। বরং ইসলামের জরুরি সমস্ত বিধান মানা জরুরি। যদি কোনও একটি জরুরি বিধান মানতে না চায়, তবে ইসলামী সরকার তাদেরকে তা মানতে বাধ্য করবে। প্রয়োজনে তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করবে। হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি.-এর জমানায় একদল লোক যাকাত দিতে অস্বীকার করলে তিনি তাদের সঙ্গে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন।

৩২৩. সূরা তাওবা (৯), আয়াত ৫

৩২৪. বায়হাকী, আস্ সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ১১৬২৯; তহাবী, শারহু মুশকিলিল আছার, হাদীছ নং ২৭৬৩; মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, হাদীছ নং ৩২৯৯২; মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক, হাদীছ নং ৭২০৮
যা দ্বারা জান-মালের নিরাপত্তা লাভ হয়
হাদীছ নং : ৩৯০

হযরত আব্দুল্লাহ ইবন উমর রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, আমাকে মানুষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে আদেশ করা হয়েছে, যতক্ষণ না তারা সাক্ষ্য দেয় যে, আল্লাহ ছাড়া কোনও মাবুদ নেই এবং মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল, আর নামায কায়েম করে ও যাকাত দেয়। যখন তারা তা করবে তখন আমার পক্ষ হতে তারা নিজেদের জান-মালের নিরাপত্তা পাবে। তবে ইসলামের হক (এর বিষয়টি) ব্যতিক্রম। আর তাদের হিসাব আল্লাহ তা'আলার উপর ন্যস্ত - বুখারী ও মুসলিম।
সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ২৫; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ২০; সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ১৫৫৬; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ২৬০৬; সুনানে নাসাঈ, হাদীছ নং ২৪৪৩; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীছ নং ৭১; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ৬৭; বায়হাকী, আসসুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ২১৯৯; তবারানী, আল-মু'জামুল কাবীর, হাদীছ নং ৫৯২
49 - باب إجراء أحكام الناس عَلَى الظاهر وسرائرهم إِلَى الله تَعَالَى

قَالَ الله تَعَالَى: {فَإِنْ تَابُوا وَأَقَامُوا الصَّلاةَ وَآتَوُا الزَّكَاةَ فَخَلُّوا سَبِيلَهُم} [التوبة: 5].
390 - وعن ابن عمر رضي الله عنهما: أنَّ رَسُول الله - صلى الله عليه وسلم - قَالَ: «أُمِرْتُ أَنْ أُقَاتِلَ النَّاسَ حَتَّى يَشْهَدُوا أَنْ لاَ إلهَ إلاَّ الله، وَأنَّ مُحَمَّدًا رَسُول الله، وَيُقيمُوا الصَّلاةَ، وَيُؤتُوا الزَّكَاةَ، فَإِذَا فَعَلُوا ذلِكَ عَصَمُوا مِنِّي دِمَاءهُمْ وَأَمْوَالَهُمْ إلاَّ بحَقِّ الإسْلاَمِ، وَحِسَابُهُمْ عَلَى الله تَعَالَى». مُتَّفَقٌ عَلَيهِ. (1)

হাদীসের ব্যাখ্যা:

অন্য বর্ণনায় আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলেছেন, যে ব্যক্তি বলে আল্লাহ ছাড়া কোনও মাবূদ নেই, মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল এবং আল্লাহ ছাড়া যা–কিছুর উপাসনা করা হয় তা প্রত্যাখ্যান করে, তার জান–মাল (এর উপর অন্যের হস্তক্ষেপ) হারাম হয়ে যায়। আর তার হিসাব আল্লাহর উপর ন্যস্ত।

এ হাদীছদু'টিতে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কাদের সঙ্গে যুদ্ধ করা হবে, কারা জান-মালের নিরাপত্তা পাবে এবং ইসলাম গ্রহণের পর কোনও কারণে কাউকে হত্যা করা যাবে কি না, সে সম্পর্কে মৌলিক নির্দেশনা দান করেছেন। প্রথমে ইরশাদ করেন- أمرْتُ أن أقاتل الناس حَتَّى يَشْهَدُوا أن لا إله إلا الله، وَأَنَّ مُحَمَّدًا رَسُولُ الله মানুষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে আদেশ করা হয়েছে, যতক্ষণ না তারা সাক্ষ্য দেয় যে, আল্লাহ ছাড়া কোনও মাবুদ নেই এবং মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল)। অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা আমাকে আদেশ করেছেন, যারা ইসলাম গ্রহণ করবে না আবার জিযিয়াও দেবে না, তাদের সঙ্গে যেন আমি যুদ্ধ করি।

“আল্লাহ ছাড়া কোনও মাবূদ নেই ও মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল' কথাটি ইসলামগ্রহণের বাণী। আন্তরিক বিশ্বাসের সঙ্গে এ কথাটি ঘোষণা করার দ্বারা অমুসলিম ব্যক্তি ইসলামের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। সে মুসলিম বলে গণ্য হয়। এ কথা ঘোষণা করার অপরিহার্য দাবি হলো মহানবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর পক্ষ থেকে যা-কিছু নিয়ে এসেছেন তা সব সত্য বলে বিশ্বাস করা এবং তিনি যে শরীআত পেশ করেছেন তা পালন করা। এ কারণেই কেবল এ ঘোষণার দ্বারাই জান-মালের নিরাপত্তা লাভ হয় না; বরং এর সঙ্গে নামায পড়া ও যাকাত দেওয়াও শর্ত। যেমন হাদীছের পরের অংশে আছে-
وَيُقيمُوا الصَّلاةَ، وَيُؤتُوا الزَّكَاةَ (আর নামায কায়েম করে ও যাকাত দেয়)। সুতরাং যে ব্যক্তি নামায ও যাকাতের বিধান মানবে না, সরকার তাকে তা মানতে বাধ্য করবে। যদি অবিশ্বাস করে তবে তো মুরতাদই হয়ে যাবে। ফলে মুরতাদের শাস্তি হিসেবে তার উপর মৃত্যুদণ্ড জারি করা হবে। আর যদি নামায ও যাকাত ফরয বলে বিশ্বাস করে কিন্তু পালন না করে, তবে মুরতাদ হবে না বটে, কিন্তু সরকার এ কারণে তার বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে। যদি সংঘবদ্ধ কোনও দল নামায, যাকাত ইত্যাদি ফরয বিধান পালন করতে না চায়, তবে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা হবে, যেমন হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি. যাকাত দিতে অস্বীকারকারী একটি দলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন।

শরীআতের জরুরি বিধানসমূহ মেনে নেওয়া সহকারে ইসলামের ঘোষণা দিলে জান-মালের নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়ে যায়। সুতরাং হাদীছের পরবর্তী অংশে বলা হয়েছে-
فَإِذَا فَعَلُوا ذلِكَ عَصَمُوا مِنِّي دِمَاءهُمْ وَأَمْوَالَهُمْ (যখন তারা তা করবে তখন আমার পক্ষ হতে তারা নিজেদের জান-মালের নিরাপত্তা পাবে)। অর্থাৎ তারা যদি কালেমায়ে শাহাদাত পড়ে এবং শরীআত মেনে নেয়, তবে তারা তাদের জান-মাল নিরাপত্তা পেয়ে যাবে। এ অবস্থায় তাদের রক্তপাত করা ও তাদের সম্পদে হস্তক্ষেপ করা বৈধ নয়।

যেসকল কারণে মুসলিম ব্যক্তি মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হয়
এমন কিছু অপরাধ আছে, কোনও মুসলিম ব্যক্তিও তাতে লিপ্ত হলে ইসলামের বিধান অনুযায়ী তার নিরাপত্তা বাতিল হয়ে যায়। সে ক্ষেত্রে তার উপর মৃত্যুদন্ড আরোপিত হবে। সুতরাং নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন- إلاَّ بحَقِّ الإسْلاَمِ তবে ইসলামের হক (এর বিষয়টি) ব্যতিক্রম'। কোনও কোনও বর্ণনায় আছে—إلاَّ بحَقِّها অর্থাৎ কালেমায়ে শাহাদাতের 'হক'-এর বিষয়টি ব্যতিক্রম উভয় বর্ণনার মর্ম একই। অর্থাৎ কেউ যদি কালেমায়ে শাহাদাত তথা ইসলামের হক নষ্ট করে, তবে তার জান ও মালের নিরাপত্তা থাকবে না। কালেমায়ে শাহাদাতের সে হক হলো তিনটি— ক. অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা না করা; খ. ব্যভিচার না করা। এবং গ. মুরতাদ না হওয়া। ইসলাম গ্রহণের পরে মুরতাদ হয়ে গেলে অথবা অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করলে কিংবা কোনও বিবাহিত মুসলিম ব্যভিচারে লিপ্ত হলে তার উপর মৃত্যুদণ্ড জারি করা হবে। যেমন এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

أمرْتُ أنْ أُقَاتِلَ النَّاسَ حَتَّى يَقُولُوا: لا إله إلا الله، فإذا قَالُوْهَا عَصَمُوا مِن دِمَاءَهُمْ وَأَمْوَالَهُمْ إِلَّا بِحَقَّهَا قِبْلَ: وَمَا حَقَّهَا؟ قَالَ: زنى بَعْدَ إِحْصَانِ، أَوْ كُفْرٌ بَعْدَ إِسلام أَوْ قَتْلُ نَفْسٍ فَيُقْتَلُ بِهِ

'আমাকে মানুষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে আদেশ করা হয়েছে, যতক্ষণ না তারা বলে, আল্লাহ ছাড়া কোনও মাবুদ নেই। যখন তারা এটা বলবে, আমার পক্ষ হতে তাদের জান-মালের নিরাপত্তা পেয়ে যাবে। তবে এ কালেমার হক-এর বিষয়টি ব্যতিক্রম। জিজ্ঞেস করা হলো, এর হক কী? তিনি বললেন, বিবাহের পর ব্যভিচার, ইসলাম গ্রহণের পর কুফর এবং কোনও ব্যক্তিকে হত্যা করা। এ অপরাধের কারণে কতলের শাস্তি দেওয়া হবে।৩২৭

অপর এক হাদীছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

لا يَحِلُّ دَمُ امْرِي مُسْلِمٍ يَشْهَدُ أَنْ لا إلهَ إِلَّا اللهُ وَأَنِّي رَسُولُ اللهِ، إِلَّا بِإِحْدَى ثَلاثِ النفس بالنفس، وَالتَّيْبُ الزَّانِي، وَالْمَارِقُ مِنَ الدِّينِ التارِكُ لِلْجَمَاعَةِ

'যে ব্যক্তি সাক্ষ্য দেয় আল্লাহ ছাড়া কোনও মাবূদ নেই এবং আমি আল্লাহর রাসূল, এমন মুসলিম ব্যক্তিকে তিনটি কারণের কোনও একটি ছাড়া হত্যা করা বৈধ নয়- বিবাহিত ব্যভিচারকারী (-কে ব্যভিচারের কারণে), প্রাণের বদলে প্রাণ, দীন পরিত্যাগকারী এমন ব্যক্তি, যে মুসলমানদের জামাত পরিত্যাগ করেছে।৩২৮

এই যা বলা হলো, এর সম্পর্ক দুনিয়ার সঙ্গে। অর্থাৎ কেউ কালেমায়ে শাহাদাত পাঠ করলে এবং ইসলামী শরীআত মেনে নিলে সে তার জান-মালের নিরাপত্তা পেয়ে যাবে। উপর তাদের বাহ্যিক উপরে বর্ণিত কারণসমূহ ছাড়া অন্য কোনও কারণে তাকে হত্যা করা যাবে না। সে কালেমা পড়েছে খাঁটি মনে না কপট মনে, তা দেখার প্রয়োজন নেই। তা দেখা বান্দার কাজ নয়। সে হিসাব নেবেন আল্লাহ। যেমন হাদীছটির শেষে বলা হয়েছে—وَحِسَابُهُمْ عَلَى الله تَعَالَى (আর তাদের হিসাব আল্লাহ তাআলার উপর ন্যস্ত)। অর্থাৎ দুনিয়ায় তার বাহ্যিক অবস্থা অনুযায়ীই আচরণ করা হবে। তবে আখেরাতের বিষয়টা আলাদা। সে আখেরাতে মুক্তি পাবে কি পাবে না, তা নির্ভর করে তার ইখলাসের উপর। অর্থাৎ সে যদি খাঁটি মনে ইসলাম গ্রহণ করে থাকে, তবে আল্লাহ তাআলার কাছে তার ইসলাম গৃহীত হবে। ফলে আল্লাহ তাআলা তাকে জান্নাত দান করবেন। আর যদি তার অন্তরে মুনাফিকী থাকে, তবে আল্লাহ তাআলার কাছে তার বাহ্যিক ইসলাম গৃহীত হবে না। ফলে সে মুক্তিও পাবে না। মোটকথা আখেরাতের হিসাব হবে অন্তরের অবস্থা অনুযায়ী। সে হিসাব নেওয়া আল্লাহরই কাজ।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. মানুষের জান-মালের নিরাপত্তা নিশ্চিত হয় কালেমা পাঠের সঙ্গে শরীআতের বিধানাবলী মেনে নেওয়ার দ্বারা।

খ. বাহ্যিক অবস্থা দ্বারা কাউকে মুমিন-মুসলিম বলে মনে হলেই সে নিরাপত্তা পেয়ে যাবে। অন্তরে ঈমান আছে কি নেই তা দেখা বান্দার কাজ নয়। বান্দার পক্ষে তা নির্ণয় করা সম্ভবও নয়।

গ. এমন কিছু অপরাধও আছে, কোনও মুসলিম ব্যক্তি যাতে লিপ্ত হলে তার প্রাণের নিরাপত্তা বাতিল হয়ে যায়। সে অপরাধের শরীআতী শাস্তি হলো হত্যা করা।

৩২৭. আল মু'জামুল আওসাত, হাদীছ নং ৩২২১

৩২৮. সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৬৮৭৮; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ১৬৭৬; সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ৪৩৫৩; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ১৪০২; সুনানে নাসাঈ, হাদীছ নং ৪০৪৮; সুনানে ইবন মাজাহ, হাদীছ নং ২৫৩৩; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ৪৫২; মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, হাদীছ নং ৩৬৪৯২; বায়হাকী, আস সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ১৫৮৪৩
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:বিশুদ্ধ (পারিভাষিক সহীহ)
রিয়াযুস সালিহীন - হাদীস নং ৩৯০ | মুসলিম বাংলা