রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ

ভূমিকা অধ্যায়

হাদীস নং: ৩৮২
আল্লাহর জন্য ভালোবাসার ফযীলত, এর প্রতি উৎসাহদান এবং কেউ কাউকে ভালোবাসলে তাকে সে সম্পর্কে অবহিত করা আর তাকে তা অবহিত করা হলে জবাবে সে যা বলবে।
আল্লাহর ভালোবাসা লাভ করার এক প্রকৃষ্ট উপায়
হাদীছ নং : ৩৮২

আবূ ইদরীস খাওলানী রহ. বলেন, আমি দামেশকের মসজিদে প্রবেশ করলাম। সহসা দেখতে পাই ঝকঝকে দাঁতের এক তরুণ বসে আছেন এবং তাঁর সঙ্গে একদল লোক। যখনই তাদের মধ্যে কোনও বিষয়ে মতভিন্নতা দেখা দেয়, তারা সে বিষয়টি তাঁর সামনে পেশ করে এবং তাঁর অভিমত তারা গ্রহণ করে নেয়। আমি তাঁর সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম। বলা হলো, ইনি মু'আয ইবন জাবাল রাযি.। পরদিন আমি আগে আগে (মসজিদে) আসলাম। দেখলাম, তিনি আমারও আগে উপস্থিত হয়েছেন। আমি তাঁকে নামাযরত পেলাম। সুতরাং আমি তাঁর অপেক্ষা করতে থাকলাম। তাঁর নামায শেষ হলে আমি তাঁর সামনে এসে হাজির হলাম। আমি তাঁকে সালাম দিয়ে বললাম, আল্লাহর কসম! আমি আপনাকে আল্লাহর জন্য ভালোবাসি। তিনি বললেন, আল্লাহর কসম? আমি বললাম, আল্লাহর কসম! তিনি আবার বললেন, আল্লাহর কসম? আমি বললাম, আল্লাহর কসম! তারপর তিনি আমার চাদরের এক কোণ ধরে আমাকে নিজের কাছে টেনে নিলেন। তারপর বললেন, সুসংবাদ নাও। আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি যে, আল্লাহ তা'আলা বলেন, ওই সকল লোকের জন্য আমার ভালোবাসা অবধারিত, যারা আমারই জন্য একে অন্যকে ভালোবাসে; আমারই জন্য পরস্পরে ওঠাবসা করে; আমারই জন্য পরস্পরে দেখা-সাক্ষাত করে এবং আমারই জন্য খরচ করে -মুআত্তা মালিক।
মুআত্তা মালিক, হাদীছ নং ১৬; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ২২০৩০; তহাবী, শারহু মুশকিলিল আছার, হাদীছ নং ৩৮৯০; তাবারানী, আল-মুজামুল কাবীর, হাদীছ নং ১৫০; বায়হাকী, শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ৮৫৭৯; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ, হাদীছ নং ৩৪৬৪
46 - باب فضل الحب في الله والحث عَلَيهِ وإعلام الرجل من يحبه، أنه يحبه، وماذا يقول لَهُ إِذَا أعلمه
382 - وعن أَبي إدريس الخولاني رحمه الله، قَالَ: دخَلْتُ مَسْجِدَ دِمَشْقَ، فَإذَا فَتًى بَرَّاق الثَّنَايَا (1) وَإِذَا النَّاسُ مَعَهُ، فَإِذَا اخْتَلَفُوا في شَيْءٍ، أَسْنَدُوهُ إِلَيْه، وَصَدَرُوا عَنْ رَأيِهِ، [ص:138] فَسَأَلْتُ عَنْهُ، فَقيلَ: هَذَا مُعَاذُ بْنُ جَبَل - رضي الله عنه. فَلَمَّا كَانَ مِنَ الغَدِ، هَجَّرْتُ، فَوَجَدْتُهُ قَدْ سَبَقَنِي بالتَّهْجِيرِ، ووَجَدْتُهُ يُصَلِّي، فانْتَظَرتُهُ حَتَّى قَضَى صَلاتَهُ، ثُمَّ جِئْتُهُ مِنْ قِبَلِ وَجْهِهِ، فَسَلَّمْتُ عَلَيهِ، ثُمَّ قُلْتُ: وَاللهِ إنّي لأَحِبُّكَ لِله، فَقَالَ: آلله؟ فَقُلْتُ: اللهِ، فَقَالَ: آللهِ؟ فَقُلْتُ: اللهِ، فَأَخَذَنِي بِحَبْوَةِ رِدَائِي، فجبذني إِلَيْهِ، فَقَالَ: أَبْشِرْ! فإنِّي سَمِعْتُ رَسُولَ الله - صلى الله عليه وسلم - يقول: «قَالَ الله تَعَالَى: وَجَبَتْ مَحَبَّتي لِلْمُتَحابِّين فِيَّ، وَالمُتَجَالِسينَ فيَّ، وَالمُتَزَاوِرِينَ فيَّ، وَالمُتَبَاذِلِينَ (2) فِيَّ». حديث صحيح رواه مالك في الموطأ بإسناده الصحيح. (3)
قوله: «هَجَّرْتُ» أيْ بَكَّرْتُ، وَهُوَ بتشديد الجيم قوله: «آلله فَقُلْت: الله» الأول بهمزة ممدودة للاستفهام، والثاني بلا مد.

হাদীসের ব্যাখ্যা:

আবু ইদরীস খাওলানী রহ. শামের খাওলান গোত্রীয় একজন প্রবীণ ও বিখ্যাত তাবি‘ঈ। তিনি দামেশকের মসজিদে হযরত মুআয ইবন জাবাল রাযি-এর সঙ্গে সাক্ষাত করে বলেছিলেন 'আমি আপনাকে ভালোবাসি', যেমনটা এ হাদীছের বর্ণনায় আছে। হযরত মু'আয ইবন জাবাল রাযি, ছিলেন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একজন বিশিষ্ট আলেম সাহাবী। তাঁর সম্পর্কে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছিলেন, আমার উম্মতের মধ্যে হালাল-হারাম সম্পর্কে সর্বাপেক্ষা বেশি জানে মু'আয। অতি বড় জ্ঞানীজন হওয়ায় তাঁর কাছে লোকজনের ভিড় লেগে থাকত। কারও কিছু জানার থাকলে তাঁর কাছেই জিজ্ঞেস করত। কোনও বিষয়ে নিজেদের মধ্যে মতভেদ দেখা দিলে তাঁর কাছেই সমাধান চাইত। খুব ইবাদতগুযারও ছিলেন। এসব গুণ ও বিশেষত্ব দেখে আবূ ইদরীস খাওলানী রহ.-এর অন্তরে তাঁর প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধা সৃষ্টি হয়ে যায়। তাতে আপ্লুত হয়েই তিনি এ অভিব্যক্তি প্রকাশ করেছিলেন যে, আমি আপনাকে ভালোবাসি।
ইনি তো হযরত মু'আয ইবন জাবাল রাযি.। উচ্চস্তরের আলেম সাহাবী। পারস্পরিক ভালোবাসার কী মর্যাদা, ভালোভাবেই জানেন। এ উক্তির গভীরতাও যথেষ্ট বোঝেন। তাই তিনি আবূ ইদরীস খাওলানী রহ.-কে কসম দিয়ে তার উক্তির সত্যতা পরিষ্কার করে নেন। তারপর তাকে এ সম্পর্কে সুসংবাদ দান করেন। প্রথমে সুসংবাদটির মূল্য ও মাহাত্ম্যের প্রতি সচেতন করে তোলার জন্য তার চাদর ধরে নিজের দিকে টেনে নেন। অথবা তাকে নিজের দিকে টেনে নিয়েছিলেন ভালোবাসার কারণে তাকে সম্বর্ধিত করার জন্য। তিনি তাকে বললেন, তুমি সুসংবাদ নাও। আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি যে, আল্লাহ তাআলা বলেন-

وَجَبَتْ مَحَبَّتِي لِلْمُتَحَابِّينَ فِيَّ، وَالْمُتَجَالِسِينَ فِيَّ، وَالْمُتَزَاوِرِينَ فِيَّ، وَالْمُتَبَاذِلِينَ فِيَّ.

(ওই সকল লোকের জন্য আমার ভালোবাসা অবধারিত, যারা আমারই জন্য একে অন্যকে ভালোবাসে; আমারই জন্য পরস্পরে ওঠাবসা করে; আমারই জন্য পরস্পরে দেখা-সাক্ষাত করে এবং আমারই জন্য খরচ করে)। অর্থাৎ যাদের পারস্পরিক ভালোবাসা, যাদের পারস্পরিক ওঠাবসা, যাদের পারস্পরিক দেখা-সাক্ষাত এবং যাদের পারস্পরিক অর্থব্যয় হয় কেবল আমারই জন্য, আমারই সন্তুষ্টিলাভের উদ্দেশ্যে, দুনিয়ার নশ্বর কোনও সম্পদের জন্যও নয় এবং নয় অন্য কোনও পার্থিব স্বার্থে, তারা নিশ্চিত থাকুক যে, আমি অবশ্যই তাদের মহব্বত করি, তাদের ভালোবাসি। আল্লাহু আকবার! কী বিশাল পুরস্কার! এটা আল্লাহ তাআলারই মহত্ত্ব ও মহানুভবতা যে, বান্দার তুচ্ছ কাজের বিনিময়েও তিনি নিজের পক্ষ থেকে অনেক বড় পুরস্কার দিয়ে থাকেন। বান্দাই বা কী আর তার ভালোবাসাই বা কী! এক বান্দা আরেক বান্দাকে ভালোবাসলে কতটুকুই বা বাসতে পারে? একজন আরেকজনের জন্য কী পরিমাণই বা খরচ করতে পারে? অথচ এর বিপরীতে তিনি বান্দাকে নিজ ভালোবাসার নিশ্চয়তা দান করেছেন। এ মহা নি'আমতের কারণে আমরা তাঁর কী শোকর আদায় করব?
প্রকাশ থাকে যে, পারস্পরিক মহব্বত, ওঠাবসা, দেখা-সাক্ষাত ও অর্থব্যয় যদি আল্লাহ তাআলার উদ্দেশ্যে হয়, তবে তাতে কোনওরকম সীমালঙ্ঘন হতে পারে না। তা হয় শরীআতের নির্দেশনা মোতাবেক। কাজেই এ বিষয়গুলো যাতে নিখুঁতভাবে কেবল আল্লাহ তাআলার জন্যই নিবেদিত থাকে, সে লক্ষ্যে শরীআতের সীমারেখা রক্ষা করে চলা অবশ্যকর্তব্য। খুব সাবধান থাকতে হবে যাতে এর কোনওটিতেই শরীআতের বরখেলাফ না হয়।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. কাছাকাছি কোথাও কোনও বুযুর্গ ব্যক্তি ও আল্লাহওয়ালার উপস্থিতি জানতে পারলে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাত করতে যাওয়া উচিত। এটা নিজ ঈমান-আমলে উন্নতি লাভের পক্ষে সহায়ক।

খ. নিজেদের মধ্যে কোনও বিষয়ে মতভিন্নতা সৃষ্টি হলে সে ব্যাপারে কর্তব্য বিজ্ঞ আলেমের কাছ থেকে সমাধান নেওয়া।

গ. আল্লাহপ্রেমের এক দাবি হলো আল্লাহওয়ালা ও আল্লাহর প্রেমিক বান্দাদের মহব্বত করা।

ঘ. কারও প্রতি অন্তরে মহব্বত ও ভালোবাসা থাকলে তাকে তা জানানো উচিত।

ঙ. যাকে মহব্বত করা হয় তার উচিত সে মহব্বতের কদর করা এবং যারা মহব্বত করে তাদের মূল্যায়ন করা।

চ. মহব্বত ও ভালোবাসা এবং দেখা-সাক্ষাত করা, ওঠাবসা করা ও টাকাপয়সা খরচ করার কাজগুলো কেবলই আল্লাহ তাআলার জন্য হওয়া উচিত, পার্থিব কোনও স্বার্থে নয়।

ছ. এসব কাজ আল্লাহর জন্য হলে পুরস্কারস্বরূপ আল্লাহ তাআলার মহব্বত লাভ করা যায়। এরচে' বড় কোনও পুরস্কার হতে পারে না।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান
রিয়াযুস সালিহীন - হাদীস নং ৩৮২ | মুসলিম বাংলা