রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ

ভূমিকা অধ্যায়

হাদীস নং: ৩৭৫
অধ্যায়ঃ ৪৬

আল্লাহর জন্য ভালোবাসার ফযীলত, এর প্রতি উৎসাহদান এবং কেউ কাউকে ভালোবাসলে তাকে সে সম্পর্কে অবহিত করা আর তাকে তা অবহতি করা হলে জবাবে সে যা বলবে।

মানবস্বভাবে নিহিত গুণাবলীর মধ্যে একটি বিশেষ গুণ হলো প্রেম-ভালোবাসা। মানুষ মাত্রই কাউকে না কাউকে অবশ্যই ভালোবাসে। ইসলাম মানবস্বভাবের কোনও বিশেষত্বকেই উপেক্ষা করে না; বরং তাকে গুরুত্ব দেয় এবং তার যথাযথ ব্যবহারের নির্দেশনাও দান করে। মহব্বত ও ভালোবাসার বিষয়টিও তার ব্যতিক্রম নয়। এ বিষয়ে ইসলামের মূল কথা হলো, তুমি যে-কাউকেই ভালোবাসবে, সে ভালোবাসা যেন কেবল আল্লাহ তাআলার জন্যই হয়, কোনও পার্থিব উদ্দেশ্যে নয়।
প্রকৃতপক্ষে পার্থিব উদ্দেশ্যে ভালোবাসা তো পরের কথা, মৌলিকভাবে পার্থিব কোনওকিছুকেই ভালোবাসা যায় না। পার্থিব সবকিছুই নশ্বর। সবকিছু ত্রুটিপূর্ণও বটে। দুনিয়ার কোনওকিছুই পুরোপুরি নিখুঁত নয়। কাজেই কাউকে বা কোনও বস্তুকে ভালোবাসলে এক তো তা স্থায়ী হয় না, দ্বিতীয়ত তার ত্রুটি ও বিভিন্ন খুঁত দ্বারা শারীরিক, মানসিক, আর্থিক ও সামাজিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ারও আশঙ্কা থাকে। আল্লাহ তাআলা অবিনশ্বর সত্তা। তিনি সকল দোষত্রুটির ঊর্ধ্বে। বরং তিনি সর্বপ্রকার মহান গুণের আধার। সকল সদ্গুণ তাঁর মধ্যে অসীম ও অফুরন্তরূপে বিদ্যমান। তাই প্রকৃত ভালোবাসা তাঁকেই নিবেদন করা সাজে।
দুনিয়ার সাধারণ রীতি হলো, কেউ কাউকে ভালোবাসলে সে তার সঙ্গে সম্পৃক্ত সবকিছুকেই ভালোবাসতে থাকে। বন্ধুর বন্ধুজনও বন্ধু হয়ে যায়। সুতরাং যে ব্যক্তি আল্লাহ তাআলাকে ভালোবাসবে, আর ভালো তো কেবল তাঁকেই বাসতে হবে, তার কর্তব্য আল্লাহ তাআলার সঙ্গে সম্পৃক্ত সবকিছুকে ভালোবাসা। সে হিসেবে তার ভালোবাসার আওতায় এসে যাবে কুল মাখলুকাত। মহাবিশ্বের সমস্ত সৃষ্টি আল্লাহ তাআলার কুদরতের প্রকাশ। সৃষ্টির বৈচিত্র্য তাঁর অফুরন্ত ক্ষমতার নিদর্শন। প্রতিটি সৃষ্টিতেই আছে সর্বশক্তিমান আল্লাহর অসীম কুদরত ও হিকমতের স্পর্শ। সুতরাং প্রকৃত মুমিন প্রতিটি সৃষ্টিকেই ভালোবাসবে। এমনকি সে কাফের-মুশরিকেরও কল্যাণকামী হয়ে যাবে। সে তাদের দোজাহানের মুক্তি কামনা করবে। সেই লক্ষ্যে তাদেরকে ঈমানের দাওয়াত দেবে। এমনকি শক্তি দিয়ে হলেও তাদেরকে ঈমানের পথে আনতে চাইবে, যাতে তারা আখেরাতের অনন্ত আযাব থেকে বেঁচে যায়।
মোটকথা, মুমিন-মুসলিম মৌলিকভাবে আল্লাহ তাআলাকে ভালোবাসবে, তারপর অন্য যাকে বা যা-কিছুকেই ভালোবাসবে, সে ভালোবাসা হবে কেবল আল্লাহ তাআলার জন্যই। সে ভালোবাসার অনেক ফযীলত। আল্লাহ তাআলার কাছে তার অনেক মর্যাদা।
এরূপ ভালোবাসার ক্ষেত্রে মুমিন-মুসলিম ব্যক্তির কী করণীয়, সে সম্পর্কে কুরআন হাদীছে সুস্পষ্ট নির্দেশনা আছে। ইমাম নববী রহ. এ অধ্যায়ে সে সম্পর্কে আয়াত ও হাদীছ উদ্ধৃত করেছেন। আমরা এবার তার বঙ্গানুবাদ ও সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা পেশ করছি। আল্লাহ তাআলা তাওফীক দান করুন।

আল্লাহর জন্য ভালোবাসার ফযীলত -সম্পর্কিত দু'টি আয়াত

এক নং আয়াত

مُحَمَّدٌ رَسُولُ اللَّهِ وَالَّذِينَ مَعَهُ أَشِدَّاءُ عَلَى الْكُفَّارِ رُحَمَاءُ بَيْنَهُمْ تَرَاهُمْ رُكَّعًا سُجَّدًا يَبْتَغُونَ فَضْلًا مِنَ اللَّهِ وَرِضْوَانًا سِيمَاهُمْ فِي وُجُوهِهِمْ مِنْ أَثَرِ السُّجُودِ ذَلِكَ مَثَلُهُمْ فِي التَّوْرَاةِ وَمَثَلُهُمْ فِي الْإِنْجِيلِ كَزَرْعٍ أَخْرَجَ شَطْأَهُ فَآزَرَهُ فَاسْتَغْلَظَ فَاسْتَوَى عَلَى سُوقِهِ يُعْجِبُ الزُّرَّاعَ لِيَغِيظَ بِهِمُ الْكُفَّارَ وَعَدَ اللَّهُ الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ مِنْهُمْ مَغْفِرَةً وَأَجْرًا عَظِيمًا

অর্থ : মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আল্লাহর রাসূল। তাঁর সঙ্গে যারা আছে, তারা কাফেরদের বিরুদ্ধে কঠোর এবং আপসের মধ্যে একে অন্যের প্রতি দয়ার্দ্র। তুমি তাদেরকে দেখবে (কখনও) রুকুতে, (কখনও) সিজদায়, আল্লাহর অনুগ্রহ ও সন্তুষ্টি সন্ধানে রত। তাদের আলামত তাদের চেহারায় পরিস্ফুট, সিজদার ফলে। এই হলো তাদের সেই গুণাবলী, যা তাওরাতে বর্ণিত আছে। আর ইনজীলে তাদের দৃষ্টান্ত এই, যেন এক শস্যক্ষেত্র, যা তার কুঁড়ি বের করল, তারপর তাকে শক্ত করল। তারপর তা পৃষ্ট হলো। তারপর তা নিজ কাণ্ডের উপর এভাবে সোজা দাঁড়িয়ে গেল যে, তা কৃষকদেরকে মুগ্ধ করে ফেলে। এটা এইজন্য যে, আল্লাহ তাদের (উন্নতি) দ্বারা কাফেরদের অন্তর্দাহ সৃষ্টি করেন। যারা ঈমান এনেছে ও সৎকর্ম করেছে, আল্লাহ তাদেরকে মাগফিরাত ও মহা পুরস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।২৬৭

ব্যাখ্যা

এ আয়াতে মহানবী হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সঙ্গের মুমিন তথা সাহাবায়ে কেরামের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করা হয়েছে। তার মধ্যে প্রথম বৈশিষ্ট্য হলো অমুসলিম কাফেরদের বিরুদ্ধে কঠোর-কঠিন থাকা এবং মুমিন- মুসলিমদের সঙ্গে নম্র-কোমল ও সদয় থাকা।
অমুসলিমদের সঙ্গে আচার-আচরণের নীতি
সাধারণভাবে সমস্ত মানুষের সঙ্গে মানবিক ও সৌজন্যমূলক আচরণ করা চাই। এটাই ইসলামের শিক্ষা। কাজেই মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে দুর্যোগকবলিত সমস্ত মানুষেরই সাহায্য করা উচিত। তৃষ্ণার্ত ব্যক্তি অমুসলিম হলেও তাকে পানি পান করানো একটি পুণ্যের কাজ। অমুসলিম ব্যক্তিও ক্ষুধার্ত হলে তার ক্ষুধা নিবারণের চেষ্টা ছাওয়াবের কাজরূপে গণ্য। শিশু ও বৃদ্ধ যেই হোক না কেন, তার প্রতি মমত্বপূর্ণ আচরণ করাই ইসলামের শিক্ষা। এমনিভাবে ইসলাম মানুষমাত্রের প্রতি ভদ্রতাপূর্ণ আচরণে উৎসাহ দেয়। তবে দীন ও ঈমানসম্পর্কিত বিষয়ে কোনওরূপ আপোষকামিতার সুযোগ নেই। এ ক্ষেত্রে কঠোর নীতি অবলম্বনই কাম্য।
যুদ্ধক্ষেত্র ছাড়াও সাধারণ অবস্থায়ও একজন মুমিনের কর্তব্য অমুসলিমদের বিপরীতে দৃঢ়চেতা কঠোর-কঠিন অবস্থান অবলম্বন করা, যাতে তাদের উপর তার ঈমানী প্রভাব-প্রতিপত্তির বিস্তার ঘটে এবং শিরক ও কুফরের বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণা প্রকাশ পায়। কুরআন মাজীদের বহু আয়াতে মুমিনদেরকে এরূপ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। যেমন এক আয়াতে ইরশাদ-

يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا مَنْ يَرْتَدَّ مِنْكُمْ عَنْ دِينِهِ فَسَوْفَ يَأْتِي اللَّهُ بِقَوْمٍ يُحِبُّهُمْ وَيُحِبُّونَهُ أَذِلَّةٍ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ أَعِزَّةٍ عَلَى الْكَافِرِينَ يُجَاهِدُونَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَلَا يَخَافُونَ لَوْمَةَ لَائِمٍ

‘হে মুমিনগণ! তোমাদের মধ্য হতে কেউ যদি নিজ দীন থেকে ফিরে যায়, তবে আল্লাহ এমন লোক সৃষ্টি করবেন, যাদেরকে তিনি ভালোবাসবেন এবং তারাও তাকে ভালোবাসবে। তারা মুমিনদের প্রতি কোমল এবং কাফেরদের প্রতি কঠোর হবে। তারা আল্লাহর পথে জিহাদ করবে এবং কোনও নিন্দুকের নিন্দাকে ভয় করবে না।২৬৮
অন্যত্র ইরশাদ-

وَلْيَجِدُوا فِيكُمْ غِلْظَةً وَاعْلَمُوا أَنَّ اللَّهَ مَعَ الْمُتَّقِينَ

‘তারা (অর্থাৎ কাফেরগণ) যেন তোমাদের মধ্যে কঠোরতা দেখতে পায়। জেনে রাখ, নিশ্চয়ই আল্লাহ মুত্তাকীদের সঙ্গে আছেন।২৬৯
আরও ইরশাদ-

يَاأَيُّهَا النَّبِيُّ جَاهِدِ الْكُفَّارَ وَالْمُنَافِقِينَ وَاغْلُظْ عَلَيْهِمْ

‘হে নবী! কাফের ও মুনাফিকদের বিরুদ্ধে জিহাদ কর এবং তাদের বিরুদ্ধে কঠোর হয়ে যাও।২৭০
অমুসলিমদের সম্পর্কে কুরআন মাজীদের এ শিক্ষা সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে পরিপূর্ণরূপে প্রতিফলিত হয়েছিল। অপরদিকে কুরআন মাজীদেরই শিক্ষা অনুযায়ী তাঁরা পরস্পরে একে অন্যের প্রতি ছিলেন অত্যন্ত বিনয়ী ও সম্প্রীতিপূর্ণ। তারা পরস্পর ছিলেন ভাই-ভাইয়ের মত। এক মন ও এক দেহতুল্য। নিজ স্বার্থ ত্যাগ করে অন্যের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিতেন।
তারপর তাদের দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য বলা হয়েছে যে, তারা আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি ও অনুগ্রহ কামনায় রুকু-সিজদায় রত থাকে এবং ফরয নামায় ছাড়াও বিভিন্ন নফল নামায বিশেষত তাহাজ্জুদের নামায আদায়ে যত্নবান থাকে। ফলে তাদের ইখলাস ও আল্লাহভীতির আছর ও দীপ্তি অন্তর ছাপিয়ে চেহারা থেকেও বিচ্ছুরিত হয়।
কুরআন ও বাইবেলে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরামের দৃষ্টান্ত
এ আয়াতে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরামের একটি কৌতূহলোদ্দীপক দৃষ্টান্ত বয়ান করা হয়েছে। দৃষ্টান্তটি শস্যক্ষেত্রের। তাতে পর্যায়ক্রমে কুঁড়ি বের হওয়া, সে কুঁড়ি শক্ত ও পুষ্ট হওয়া, তারপর তা নিজ কাণ্ডের উপর সোজা দাঁড়িয়ে যাওয়া ও কৃষকদেরকে মুগ্ধ করে ফেলার যে বিবরণ দেওয়া হয়েছে, তা মূলত ইসলামের সূচনা, ক্রমবিস্তার, শক্তিসঞ্চার ও প্রতিষ্ঠালাভেরই চিত্রাঙ্কন। প্রথমে এ দীনের উপর ছিলেন মাত্র একা এক ব্যক্তি। তারপর দু'জন হলেন। তারপর পর্যায়ক্রমে অনুসারীর সংখ্যা বাড়তে থাকে এবং একপর্যায়ে অমিত শক্তির অধিকারী হয়ে দুর্বার বেগে বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়ে। এভাবে বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়া ফলে-ফুলে পরিপূর্ণ ইসলামের নয়নাভিরাম শস্যক্ষেত্র কাফের-মুশরিকদের কাছে প্রীতিকর বোধ হওয়ার কথা নয় । তাই তো আল্লাহ তাআলা বলেন, এটা এজন্য যে, আল্লাহ তাদের (উন্নতি) দ্বারা কাফেরদের অন্তর্দাহ সৃষ্টি করেন। সেই যে অন্তর্দাহ আজ থেকে চৌদ্দশ' বছর আগে তাদের সৃষ্টি হয়েছিল, তার জ্বালা ও বেদনা থেকে আজও তারা মুক্ত হতে পারেনি। তাই নানা ছলে নানা অজুহাতে একের পর এক সে জ্বালা প্রকাশ করে যাচ্ছে। বলাবাহুল্য, তাদের নিরবচ্ছিন্ন ইসলামবিরোধী প্রয়াস ও বহুবিচিত্র তৎপরতা সে অন্তর্জালারই বহিঃপ্রকাশ।
কুরআন মাজীদে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরামের এই যে দৃষ্টান্ত ও বৈশিষ্ট্যপূর্ণ অবস্থা তুলে ধরা হয়েছে, তাওরাত ও ইনজীল গ্রন্থেও তা বর্ণিত আছে।
তাওরাতে প্রচুর পরিবর্তন-পরিবর্ধন ঘটা সত্ত্বেও তাতে এখনও পর্যন্ত মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরামের এসব গুণের উল্লেখ পাওয়া যায়। বাইবেলের যেসব পুস্তককে ইহুদী ও খ্রীষ্টান উভয় সম্প্রদায় 'তাওরাত' বলে স্বীকার করে, তার মধ্যে একখানি পুস্তকের নাম 'দ্বিতীয় বিবরণ'। এ পুস্তকের (৩৩ : ২-৩) একটি স্তবক সম্পর্কে জোর দিয়েই বলা যায়, কুরআন মাজীদের ইশারা সেদিকেই। তাতে আছে-
‘প্রভু সিনাই থেকে আসলেন সেয়ীর থেকে তাদের উপর আলো দিলেন এবং পারন পাহাড় থেকে তাঁর আলো ছড়িয়ে পড়ল। তিনি দশ হাজার ভক্ত পরিবৃত হয়ে আসলেন। তার ডান হাতে তাদের জন্য রয়েছে আগুন ভরা আইন। তিনি নিঃসন্দেহে জাতিসমূহকে ভালোবাসেন। তার পবিত্র লোকসমূহ তার অধীন এবং তারা সবাই তাঁর পায়ে নত হয়ে আছে। তারই কাছে তারা হুকুম পায়।' (দ্বিতীয় বিবরণ ৩৩ : ২-৩)
প্রকাশ থাকে যে, এটা হযরত মূসা আলাইহিস সালামের শেষ বক্তৃতা। এতে বলা হয়েছে, আল্লাহ তাআলার ওহী সর্বপ্রথম অবতীর্ণ হয়েছে সিনাই পাহাড়ে। এ ওহী দ্বারা তাওরাত বোঝানো হয়েছে। তারপর অবতীর্ণ হবে সেয়ীর পাহাড়ে। এটা ইনজীলের প্রতি ইঙ্গিত। কেননা সেয়ীর ছিল হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের প্রচার কেন্দ্র। বর্তমানে এর নাম 'জাবাল আল-খালীল'। তারপর বলা হয়েছে, তৃতীয় ওহী অবতীর্ণ হবে পারন পর্বতে। এর দ্বারা কুরআন মাজীদ বোঝানো হয়েছে। কেননা পারন বলে হেরা পাহাড়কে। এর গুহায়ই মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর সর্বপ্রথম ওহী নাযিল হয়েছিল। মক্কা বিজয়কালে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবী সংখ্যা ছিল বারো হাজার। সুতরাং 'তিনি দশ হাজার ভক্ত-পরিবৃত্ত হয়ে আসলেন'-এর দ্বারা সাহাবায়ে কেরামের দিকেই ইশারা করা হয়েছে। (উল্লেখ্য, তাওরাতের প্রাচীন মুদ্রণসমূহে সংখ্যা বলা হয়েছে দশ হাজার, কিন্তু বর্তমানে কোনও কোনও মুদ্রণে তা পরিবর্তন করে 'লাখ-লাখ' শব্দ লেখা হয়েছে।)
কুরআন মাজীদে বলা হয়েছে, ‘সাহাবীগণ কাফেরদের বিরুদ্ধে কঠোর'। দ্বিতীয় বিবরণে বলা হয়েছে, 'তার হাতে তাদের জন্য রয়েছে আগুন ভরা আইন'। কুরআন মাজীদে আছে, “তারা নিজেদের মধ্যে একে অন্যের প্রতি দয়ার্দ্র'। আর দ্বিতীয় বিবরণে বলা হয়েছে, 'তিনি নিঃসন্দেহে জাতিসমূহকে ভালোবাসেন। সুতরাং এ ধারণা মোটেই অবান্তর নয় যে, কুরআন মাজীদের ইশারা তাওরাতের উপরিউক্ত স্তবকটিরই দিকে, যা পরিবর্তন হতে হতে 'দ্বিতীয় বিবরণ'-এর বর্তমান রূপে পৌঁছেছে।
মার্কের ইনজীলে এই একই উপমা এভাবে প্রদত্ত হয়েছে যে, প্রভুর রাজত্ব এরকম- একজন লোক জমিতে বীজ বপন করল। তারপর সে রাতে ঘুমিয়ে ও দিনে জেগে থেকে সময় কাটাল। ইতোমধ্যে সেই বীজ হতে চারা গজিয়ে বড় হলো। কিন্তু কিভাবে হলো তা সে জানল না। জমি নিজে নিজেই ফল জন্মাল। প্রথমে চারা, পরে শীষ এবং শীষের মাথায় পরিপূর্ণ শস্যের দানা। দানা পাকলে পর সে কাস্তে লাগাল। কারণ ফসল কাটার সময় হয়েছে (মার্ক ৪ : ২৬-২৯)। অনুরূপ উপমা লুক (১৩-১৮, ১৯) ও মার্ক (১৩-৩১)-এর ইনজীলেও আছে। (তাওযীহুল কুরআন, সংক্ষেপিত)

দুই নং আয়াত

وَالَّذِينَ تَبَوَّءُوا الدَّارَ وَالْإِيمَانَ مِنْ قَبْلِهِمْ يُحِبُّونَ مَنْ هَاجَرَ إِلَيْهِمْ

অর্থ : (এবং ‘ফায়’-এর সম্পদ) তাদেরও প্রাপ্য, যারা পূর্ব থেকেই এ নগরে (অর্থাৎ মদীনায়) ঈমানের সাথে অবস্থানরত আছে। যে-কেউ হিজরত করে তাদের কাছে আসে, তাদেরকে তারা ভালোবাসে।২৭১

ব্যাখ্যা

এ আয়াতটি আনসারদের সম্পর্কে। তারা ছিলেন মদীনার স্থানীয় বাসিন্দা। তারা ঈমান ও ইসলামকেও নিজেদের স্থায়ী ঠিকানা বানিয়ে নিয়েছিলেন। মক্কার যেসকল মুসলিম হিজরত করে তাদের কাছে চলে এসেছিলেন, তারা তাদেরকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসতেন। তাদেরকে নিজেদের জন্য মোটেই বোঝা মনে করতেন না। তাদের প্রতি কোনও কারণে ঈর্ষান্বিতও হতেন না। বরং নিজেদের যা-কিছু ছিল তা অকাতরে তাদের পেছনে ব্যয় করতেন।
এ আয়াতের পরবর্তী অংশে তাদের সে অকৃপণ ব্যয়ের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে এভাবে যে-

وَلَا يَجِدُونَ فِي صُدُورِهِمْ حَاجَةً مِمَّا أُوتُوا وَيُؤْثِرُونَ عَلَى أَنْفُسِهِمْ وَلَوْ كَانَ بِهِمْ خَصَاصَةٌ وَمَنْ يُوقَ شُحَّ نَفْسِهِ فَأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ

‘এবং যা-কিছু তাদেরকে (অর্থাৎ মুহাজিরদেরকে) দেওয়া হয়, তার জন্য নিজেদের অন্তরে কোনও চাহিদা বোধ করে না এবং তাদেরকে তারা নিজেদের উপর প্রাধান্য দেয়, যদিও তাদের অভাব-অনটন থাকে। যারা স্বভাবগত কার্পণ্য হতে মুক্তি লাভ করে, তারাই তো সফলকাম।'
অর্থাৎ মুহাজিরদেরকে আল্লাহ তাআলা যে ইজ্জত-সম্মান দিয়েছেন অথবা 'ফায়’- এর সম্পদ থেকে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে যা দিতেন, তা দেখে তাদের অন্তরে বিন্দুমাত্র ঈর্ষা জাগত না; বরং তাতে তারা খুশি থাকতেন। এমনকি নিজেদের সম্পদেও তারা নিজেদের স্বার্থ দাবিয়ে রেখে মুহাজিরদেরকেই অগ্রাধিকার দিতেন। নিজেরা না খেয়ে তাদেরকে খাওয়াতেন। তাদের সে ত্যাগের এমন এমন বিস্ময়কর ঘটনা আছে, দুনিয়ার অন্য কোনও জাতিতে তার নজির পাওয়া যাবে না।
বস্তুত এরূপ ত্যাগ ও কুরবানী স্বীকার করা কেবল আল্লাহ তাআলার তাওফীকেই সম্ভব। আল্লাহ তাআলা যার অন্তর থেকে লোভ-লালসা, কৃপণতা ও হিংসা-বিদ্বেষ মিটিয়ে দেন, তাদের পক্ষেই ত্যাগের এরূপ দৃষ্টান্ত স্থাপন করা সম্ভব। দোজাহানের মুক্তি ও সফলতা তাদেরই পদচুম্বন করে।

২৬৭. সূরা ফাতহ (৪৮), আয়াত ২৯

২৬৮. সূরা মায়িদা (৫), আয়াত ৫৪

২৬৯. সূরা তাওবা (৯), আয়াত ১২৩

২৭০. সূরা তাহরীম (৬৬), আয়াত ৯

২৭১. সূরা হাশর (৫৯), আয়াত ৯
ঈমানের আস্বাদ পেতে হলে
হাদীছ নং : ৩৭৫

হযরত আনাস রাযি. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, তিনটি বিষয় যার মধ্যে থাকে সে ঈমানের স্বাদ পায়। আল্লাহ ও তাঁর রাসূল বেশি প্রিয় হওয়া তাঁদের ছাড়া আর সবকিছু অপেক্ষা, কোনও ব্যক্তিকে কেবল আল্লাহ তা'আলার জন্যই ভালোবাসা, আল্লাহ তা'আলা কাউকে কুফর থেকে মুক্তিদানের পর তার সেদিকে ফিরে যাওয়াটা এমন অপসন্দ করা যেমনটা আগুনে নিক্ষপ্ত হওয়াকে অপসন্দ করে -বুখারী ও মুসলিম।
সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ১৬; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ৪৩; সুনানে নাসাঈ, হাদীছ নং ৪৯৮৭; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ২৬২৪; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীছ নং ৪০৩৩; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ১২০০২; মুসনাদে আবূ ইয়া'লা, হাদীছ নং ২৮১৩; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীছ নং ২৩৭; তাবারানী, আল-মু'জামুল কাবীর, হাদীছ নং ৮০১৯
46 - باب فضل الحب في الله والحث عَلَيهِ وإعلام الرجل من يحبه، أنه يحبه، وماذا يقول لَهُ إِذَا أعلمه

قَالَ الله تَعَالَى: {مُحَمَّدٌ رَسُولُ اللهِ وَالَّذِينَ مَعَهُ أَشِدَّاءُ عَلَى الْكُفَّارِ رُحَمَاءُ بَيْنَهُمْ} [الفتح: 29] إِلَى آخر السورة، وَقالَ تَعَالَى: {وَالَّذِينَ تَبَوَّأُوا الدَّارَ وَالإِيمَانَ مِنْ قَبْلِهِمْ يُحِبُّونَ مَنْ هَاجَرَ إِلَيْهِمْ} [الحشر: 9].
375 - وعن أنسٍ - رضي الله عنه - عن النَّبيّ - صلى الله عليه وسلم - قَالَ: «ثَلاثٌ مَنْ كُنَّ فِيهِ وَجَدَ بِهِنَّ حَلاوَةَ الإيمانِ: أَنْ يَكُونَ اللهُ وَرَسُولُهُ أحَبَّ إِلَيْهِ مِمَّا سَوَاهُمَا، وَأنْ يُحِبَّ المَرْءَ لاَ يُحِبُّهُ إلاَّ للهِ، وَأَنْ يَكْرَهَ أَنْ يَعُودَ في الكُفْرِ بَعْدَ أَنْ أَنْقَذَهُ الله مِنْهُ، كَمَا يَكْرَهُ أَنْ يُقْذَفَ في النَّارِ». مُتَّفَقٌ عَلَيهِ. (1)

হাদীসের ব্যাখ্যা:

ঈমানের স্বাদ ও মিষ্টতা দ্বারা বোঝানো উদ্দেশ্য ইবাদত-আনুগত্যে মজা পাওয়া, দীনের জন্য কষ্ট-ক্লেশ বরদাশত করতে প্রস্তুত থাকা এবং দুনিয়ার ধন-সম্পদের উপর দীনদারীকে প্রাধান্য দিতে পারা। কারও মধ্যে তিনটি গুণ থাকলে ঈমানের এ স্বাদ ও মিষ্টতা সে অনুভব করতে পারে। অর্থাৎ ঈমানের স্বাদ পেতে চাইলে এ তিনটি গুণের অধিকারী হওয়া শর্ত।

ঈমানের স্বাদ পাওয়ার জন্য অপরিহার্য প্রথম গুণ
তার মধ্যে প্রথম গুণ হলো-

أن يكون الله ورسوله أحب إليه مما سواهما

(আল্লাহ ও তাঁর রাসূল বেশি প্রিয় হওয়া তাঁদের ছাড়া আর সবকিছু অপেক্ষা)। আল্লাহ তাআলাকে প্রিয় জানা ও তাঁকে ভালোবাসার দাবি হলো তাঁর যাবতীয় আদেশ মেনে চলা, তিনি যা-কিছু করতে নিষেধ করেছেন তা থেকে বিরত থাকা, তাঁর নির্ধারিত তাকদীরে সন্তুষ্ট থাকা এবং তাঁর পসন্দ ও অপসন্দকে সর্বাপেক্ষা বেশি গুরুত্ব দেওয়া।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মহব্বত ও ভালোবাসার দাবি হলো দীনের যাবতীয় আদেশ-নিষেধ ও শরীআতের যাবতীয় শিক্ষা তাঁর থেকেই গ্রহণ করা, তিনি যে পথ দেখিয়েছেন কেবল সে পথেই চলা, যাবতীয় কাজে তাঁর সুন্নতের অনুসরণ করা, দান-খয়রাত, ত্যাগ ও কুরবানী, বিনয়, সহনশীলতা, সত্যবাদিতা, সৎসাহস প্রভৃতি সদগুণে তিনি ভূষিত ছিলেন, অনুরূপ গুণাবলী আত্মস্থ করতে সচেষ্ট থাকা।

ইশক ও মহব্বতের এ দাবি পূরণে যে যতবেশি সচেষ্ট থাকবে, তার অন্তরে আল্লাহ তা'আলা ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মহব্বতও ততবেশি বদ্ধমূল হবে। এরূপ ব্যক্তি যে-কোনও ত্যাগ ও যে-কোনও মূল্যের বিনিময়ে আল্লাহ তাআলার ফরমাবরদারি ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নতের সঙ্গে সাংঘর্ষিক সবকিছু খুশিমনে পরিহার করতে প্রস্তুত থাকে। তার সম্পর্কেই বলা যায় যে, সে অন্য সবকিছুর চেয়ে আল্লাহ তাআলা ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকেই বেশি ভালোবাসে।

অনেকে বলেন, এ ভালোবাসা দ্বারা 'আকলী' বা যৌক্তিক ও বৌদ্ধিক ভালোবাসা বোঝানো উদ্দেশ্য। এর অর্থ সুষ্ঠু ও সুস্থ বিবেক-বুদ্ধির দাবিকে প্রাধান্য দেওয়া, যদিও তা নিজ খেয়াল-খুশির বিরোধী হয়। যেমন অসুস্থ ব্যক্তির কাছে ঔষধ খেতে ভালো লাগে না, তা সত্ত্বেও সে বিবেক-বুদ্ধির দাবিতে তা খেয়ে নেয়। ঠিক এরকমই কেউ যখন চিন্তা করবে যে, শরীআতদাতা কেবল এমন কাজেরই আদেশ-নিষেধ করতে পারেন, যাতে মানুষের দুনিয়ার কল্যাণ ও আখেরাতের নাজাত লাভ হয়, আর সুস্থ বিবেক-বুদ্ধি তো তাই কামনা করে, তখন সে নিজের নফস ও খেয়াল-খুশির বিপরীতে শরীআতের আদেশ-নিষেধ মানাকেই প্রাধান্য দেয়। একপর্যায়ে তার নফস ও খেয়াল-খুশি তার বশীভূত হয়ে যায়। তখন সে শরীআতপালনে মানসিক তৃপ্তি ও আনন্দ অনুভব করে। সেই মানসিক তৃপ্তি ও আনন্দের অনুভবকেই 'ঈমানের স্বাদ পাওয়া' শব্দে ব্যক্ত করা হয়েছে। এ ব্যাখ্যা অনুযায়ী শরীআত পালন করাকে সুমিষ্ট ফলের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। তারপর ফল খেলে যে মিষ্টতা অনুভব হয়, তাকে শরীআত পালনজনিত আনন্দ বোঝানোর জন্য ব্যবহার করা হয়েছে।

কিন্তু সুফী-সাধকগণ এ স্বাদ ও মিষ্টতাকে কেবল আকলী ও বৌদ্ধিক নয়; বরং ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যও মনে করে থাকেন। তাদের মতে স্বাদ ও মিষ্টতা দ্বারা স্বাভাবিকভাবে যেহেতু বাহ্যিক ও ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য স্বাদ-মিষ্টতা বোঝানো হয়ে থাকে, তাই হাদীছে শব্দটিকে সে অর্থেই গ্রহণ করা বাঞ্ছনীয়। বিষয়টি আমাদের পক্ষে বোঝা সহজ না হলেও সূফী সাধকগণ তা ঠিকই উপলব্ধি করে থাকেন। সুতরাং জুনায়দ বাগদাদী রহ. বলেন, রাত্রি জাগরণকারীগণ রাত জেগে যে মজা পান তা খেলোয়াড়দের খেলাধুলার মজার চেয়ে অনেক বেশি।

ইবরাহীম ইবন আদহাম রহ. বলেন, আল্লাহর কসম! আমরা যে স্বাদ ও মজার মধ্যে আছি, রাজা-বাদশারা তা জানতে পারলে তরবারির জোরে আমাদের কাছ থেকে তা কেড়ে নিতে চাইত। এ সম্পর্কিত একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হলো এক ঘাঁটিতে পাহারাদারিতে নিযুক্ত দুই সাহাবীর ঘটনা।

দুই সাহাবীর ঈমানোদ্দীপক ঘটনা
যাতুর রিকা যুদ্ধ থেকে ফেরার সময় মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক গিরিপথে যাত্রা বিরতি দেন। এ সময় হযরত আম্মার ইবন ইয়াসির রাযি. ও আব্বাদ ইবন বিশর রাযি.- এ দু'জনকে পাহারায় নিযুক্ত করেন। তাঁরা দু'জন সিদ্ধান্ত নেন যে, রাতের প্রথমার্ধে হযরত আব্বাদ ইবন বিশর রাযি. জেগে থাকবেন এবং শেষার্ধে হযরত আম্মার ইবন ইয়াসির রাযি. হযরত আব্বাদ ইবন বিশর রাযি. তাঁর নিজের পালায় নামাযে রত ছিলেন। এ অবস্থায় এক কাফের তাঁকে লক্ষ্য করে তির ছুঁড়ল এবং তা তাঁর গায়ে বিদ্ধ হলো। তিনি সেটি বের করে ফেলে দিলেন, কিন্তু নামায় ছাড়লেন না। সে আবার তির মারল। এভাবে পরপর তিনটি। কিন্তু তিনি নামাযে অবিচল থাকলেন। নামায শেষ হওয়ার পর তিনি সঙ্গীকে জাগালেন এবং অবস্থা বিবৃত করলেন। ইতোমধ্যে শত্রু পালিয়ে গেল। কোথাও তাকে খুঁজে পাওয়া গেল না। হযরত আম্মার রাযি. সঙ্গীর রক্ত দেখে আঁতকে উঠলেন। বললেন, সুবহানাল্লাহ! আপনি প্রথমবারেই আমাকে জাগালেন না কেন? তিনি বলেন, আমি একটি সূরা পড়ছিলাম, সেটি শেষ না করে ক্ষান্ত হতে আমার মন মানছিল না। আল্লাহর কসম! রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে পাহারাদারিতে নিযুক্ত করেছেন তাতে বিঘ্ন ঘটার আশঙ্কা না থাকলে লোকটা আমার জান নিয়ে নিত, তবুও আমি তিলাওয়াত বন্ধ করতাম না।
এই যে কুরআন তিলাওয়াতের মজার কাছে জখমের কষ্ট তুচ্ছ হয়ে গেল, এটা কি কেবলই বৌদ্ধিক আস্বাদ?

আরেক সাহাবী রাতের বেলা নামাযরত ছিলেন। এ অবস্থায় এক চোর তার ঘোড়াটি নিয়ে যাচ্ছিল। তা দেখে ফেলা সত্ত্বেও তিনি নামায় ছাড়েননি। এ সম্পর্কে তাকে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেছিলেন, আমি যাতে ব্যস্ত ছিলাম তার স্বাদ আরও বেশি ছিল। বলাবাহুল্য এ স্বাদ কেবলই বুদ্ধিগত হলে তিনি ঘোড়া হারানোর উপর তাকে প্রাধান্য দিতে পারতেন না।

ঈমান আনার অপরাধে হযরত বিলাল রাযি.-কে উত্তপ্ত বালুর উপর পাথরচাপা দিয়ে ফেলে রাখা হতো। এ অবস্থায় তিনি 'আহাদ আহাদ' জপতে থাকতেন। তা ঈমানের কী আস্বাদ পেয়েছিলেন, যার সামনে জানের এ কষ্ট তার কাছে তুচ্ছ হয়ে গিয়েছিল?

সাহাবায়ে কেরাম ও আল্লাহওয়ালাদের এরকম হাজারও ঘটনা আছে, যা দ্বারা স্পষ্ট বোঝা যায় ঈমান ও ইবাদতের স্বাদ তারা বাহ্যিক ইন্দ্রিয় দ্বারাই অনুভব করতেন। ফলে এর বিপরীতে কঠিন থেকে কঠিনতর দুঃখ-কষ্ট তারা হাসিমুখে বরণ করে নিতেন। তাদের মত গভীর ঈমানের অধিকারী নই বলে আমরা ঈমানের সে ইন্দ্ৰিয়গত সুখ অনুভব করতে পারি না এবং সে সুখ কী রকম হতে পারে তা বোঝার মত ক্ষমতাও আমরা রাখি না। কিন্তু তাই বলে যে সূফী-সাধকগণ বাস্তবিকভাবেই তা অনুভব করতেন, তাদের অভিজ্ঞতা তো আমরা প্রত্যাখ্যান করতে পারি না। আমি ঈদের চাঁদ দেখতে পারিনি বলে অন্যদের দেখাকে কি অস্বীকার করব?

ঈমানের স্বাদ পাওয়ার জন্য অপরিহার্য দ্বিতীয় গুণ
দ্বিতীয় গুণ হলো وان يحب المرء لا يحبه الا لله (কোনও ব্যক্তিকে কেবল আল্লাহ তা'আলার জন্যই ভালোবাসা)। যারা সত্যিকারের আল্লাহপ্রেমিক, তারা কাউকে ভালোবাসলে সে ভালোবাসা কেবল আল্লাহ তাআলার জন্যই হয়। বরং সে ভালোবাসা আল্লাহপ্রেমেরই ফলস্বরূপ। কেউ কাউকে সত্যিকারভাবে ভালোবাসলে সে তার সঙ্গে সম্পৃক্ত সবকিছুকেই ভালোবাসতে থাকে। বন্ধুর বন্ধুজনও বন্ধু হয়ে যায়। বাকিয়্যাহ ইবনুল ওয়ালীদ রহ. বলেন, কোনও মুমিন যখন অপর মুমিনকে ভালোবেসে ফেলে, তখন সে তার কুকুরটিকেও ভালোবাসে। আশেক-প্রেমিকদের দেখা যায় তারা তাদের প্রিয়জনের মহল্লা, ঘরবাড়ি ও প্রতিবেশীদেরও মহব্বতের দৃষ্টিতে দেখে। বনু আমিরের বিখ্যাত আশেক কায়স ওরফে মজনূর কবিতায় আছে

أمر على الديار ديار ليلى
أقبل ذا الجدار وذا الجدارا
وما حب الديار شغفن قلبي
ولكن حب من سكن الديارا

'আমি লায়লার বাসভূমির উপর দিয়ে যাই
আর এ দেওয়ালে ওই দেওয়ালে চুমু খাই।
ঘরবাড়ির প্রেম আমার হৃদয় কাড়েনি মোটে;
এ কেবল তারই প্রেম করত বসত যে জন তাতে।

আল্লাহপ্রেমও এ রকমই। অন্তরে যখন তা প্রবল হয়ে ওঠে, তখন তার আবেগ উচ্ছ্বাস সমগ্র মাখলূকের উপর ছাপিয়ে যায়। কেননা সমস্ত মাখলূক তাঁর কুদরতেরই প্রকাশ। সবকিছুতেই তাঁর ইলম ও হিকমতের ছাপ। আল্লাহপ্রেমিকের চোখে সে ছাপ ও প্রকাশই ধরা পড়ে। হৃদয়মন দিয়ে তাতে সে তার মাহবূবের স্পর্শ অনুভব করে। অমনি জাগে ইশক ও মহব্বতের কলরোল। হাদীছ দ্বারা জানা যায়, যখনই নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে কোনও নতুন ফল আনা হত, তিনি তা চোখেমুখে লাগাতেন আর বলতেন, আমার রব্বের কাছ থেকে এটি তাজা তাজা এসেছে। বৃষ্টি নামলেই তিনি কাপড় গুটিয়ে পবিত্র দেহে তা লাগাতেন। বলতেন, এ ফোঁটাগুলো সদ্য আমার রব্বের কাছ থেকে আসল। অর্থাৎ কোনও পাপী হাত এ পানি স্পর্শ করেনি। যে মাটিতে গায়রুল্লাহ'র পূজা করা হয়, তার ছোঁয়ায় এখনও এ পানি মলিন হয়নি। এসব ছিল তাঁর গভীর আল্লাহপ্রেমের প্রকাশ। এভাবেই আল্লাহপ্রেম যখন প্রবল হয়ে ওঠে, তখন মাহবুব ও মা'শূকের সঙ্গে যা-কিছুরই সম্পর্ক আছে, সে সবকিছুতেই ওই প্রেমের স্রোত ধাবিত হয়। এমনকি তা ধাবিত হয় অপ্রিয় ও কষ্টদায়ক বস্তুতেও। কিন্তু আল্লাহপ্রেমের উচ্ছ্বাসে তার কষ্ট ও অপ্রিয়তা ম্লান হয়ে যায়। এমনকি কখনও কখনও তা অনুভব পর্যন্ত করা যায় না।

মোটকথা প্রবল আল্লাহপ্রেমের ফলে আল্লাহপ্রেমিক আল্লাহ তাআলার সঙ্গে সম্পৃক্ত সবকিছুকেই ভালোবাসে। সে ভালোবাসে আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগীকারীদের, আল্লাহর দীন প্রচারকদের, উলামা ও মাশায়েখদের। সে ভালোবাসে আল্লাহর পসন্দনীয় আমল আখলাক। সে ওই আমল-আখলাক আত্মস্থ করতে সচেষ্ট হয়।

ঈমানের স্বাদ পাওয়ার জন্য অপরিহার্য তৃতীয় গুণ
আর তৃতীয় গুণ হলো-

وأن يكره ان يعود في الكفر بعد أن أنقذه الله منه ، كما يكره أن يقذف في النار

(আল্লাহ তা'আলা কাউকে কুফর থেকে মুক্তিদানের পর তার সেদিকে ফিরে যাওয়াটা এমন অপসন্দ করা যেমনটা আগুনে নিক্ষিপ্ত হওয়াকে অপসন্দ করে)। 'কুফর থেকে মুক্তিদান' কথাটি ব্যাপক অর্থে বলা হয়েছে। যে ব্যক্তি আগে কাফের ও মুশরিক ছিল, তাকে ঈমান ও ইসলাম গ্রহণের তাওফীক দেওয়া যেমন এর অন্তর্ভুক্ত, তেমনি যে ব্যক্তি আগে কখনও কাফের-মুশরিক ছিল না, তার জন্মই হয়েছে মুসলিম বাবা-মায়ের ঘরে, তারপর সে ঈমান ও ইসলামকে শক্তভাবে ধরে রেখেছে, কখনও তা থেকে বিচ্যুত হয়নি, সেও এর শামিল। কুফরী পরিবেশে জন্ম না দেওয়া ও দীনের উপর অবিচলিত রাখাটাও কুফর থেকে মুক্তিদানই বটে। এরূপ ব্যক্তির ক্ষেত্রে কুফরীর দিকে ফিরে যাওয়া'-এর অর্থ হবে কাফের হয়ে যাওয়া।

তো কুফরীর দিকে ফিরে যাওয়া বা কাফের হয়ে যাওয়াকে যে মুমিন আগুনে নিক্ষিপ্ত হওয়ার মত অপসন্দ করবে, সে ঈমানের স্বাদ অনুভব করতে সক্ষম হবে। ইমাম বদরুদ্দীন আইনী রহ. বলেন, এর দ্বারা বোঝা যায়, যাকে কুফরী বাক্য বলতে বাধ্য করা হয় কিন্তু তা সত্ত্বেও সে তা না বলে, এমনকি অন্তরে ঈমান ধারণ করেও মুখে কৃত্রিমভাবে সে বাক্য উচ্চারণে সম্মত না হয়, ফলে তাকে হত্যা করে ফেলা হয়, সে ব্যক্তি কৃত্রিমভাবে কুফরী বাক্য উচ্চারণকারী অপেক্ষা উৎকৃষ্ট। বলাবাহুল্য, একটু চিন্তা করলেই তার উৎকৃষ্টতা উপলব্ধিও করা যায়। কেননা যে কুফরীর কারণে আখেরাতে জাহান্নামের শাস্তিভোগ অনিবার্য হয়ে যায়, সে কোনওক্রমেই মুখে তা উচ্চারণ করাকেও মেনে নিতে পারছে না। সে দুনিয়ার আগুনে নিক্ষিপ্ত হতে প্রস্তুত থাকে, কিন্তু কুফরী কথার কালিমায় নিজের জবান কলঙ্কিত করতে প্রস্তুত নয়। কত উঁচু তার ঈমান, কী গভীর তার ঈমানী মূল্যবোধ!

এ তিনটি বিষয়কে ঈমানের স্বাদ অনুভব করার জন্য শর্ত সাব্যস্ত করার দ্বারা বোঝা যায়, যে ব্যক্তি এগুলো পূর্ণ করতে সক্ষম হয়, তার ঈমান পরিপূর্ণতা লাভ করে। কেননা কোনও ব্যক্তি যখন চিন্তা করে যে, প্রকৃত অনুগ্রহকর্তা আল্লাহ তাআলাই, তিনিই সকল ইষ্ট-অনিষ্টের মালিক, তিনি ছাড়া অন্য যে-কারও দিক থেকে কোনও উপকার বা ক্ষতির প্রকাশ লক্ষ করা যায় তা আসবাব উপকরণের বেশি কিছু নয়, মূল কর্তা আল্লাহ তাআলাই, তখন প্রকৃত মহব্বত ও ভালোবাসা সে কেবল আল্লাহ তাআলাকেই নিবেদন করতে পারে। আল্লাহ তাআলা যা ভালোবাসেন, সে কেবল তা-ই ভালোবাসে, তাছাড়া অন্যকিছু নয়। আর সে যাকে বা যা-কিছুকেই ভালোবাসে, কেবল আল্লাহর জন্যই ভালোবাসে।

এমনিভাবে যখন চিন্তা করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার কাছে আল্লাহ তাআলার ইচ্ছা-অভিপ্রায় ব্যাখ্যা করেছেন, তাঁর সন্তুষ্টি লাভের উপায় সম্পর্কে তাকে অবগত করেছেন, তাঁর গযব ও আযাব থেকে বাঁচার উপায় বাতলে দিয়েছেন, কুফরের অন্ধকার থেকে মুক্ত হয়ে ঈমানের আলোয় উদ্ভাসিত হওয়ার শিক্ষা দান করেছেন আর এভাবে অন্য সকলের চেয়ে অনেক বড় ও অনেক বেশি উপকার তিনিই করেছেন, তখন সে আল্লাহপ্রেমের দাবিতে তাঁরও প্রেমিক হয়ে ওঠে। এতে করে তার অন্তরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি এমন গভীর আস্থা জন্মায় যে, সে তাঁর প্রতিটি কথা সত্য বলে বিশ্বাস করে, তাঁর প্রতিটি হুকুম মানতে প্রস্তুত হয়ে যায়।

এরূপ ব্যক্তির কাছে আল্লাহ তাআলা ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতিটি ভবিষ্যৎ-ওয়াদা ও প্রতিটি শাস্তির বাণী ঘটমান বাস্তবতা বলে মনে হয়, যেন সে তা নিজ চোখে দেখতে পায়। ইবাদত-বন্দেগী, যিকর ও তিলাওয়াত ইত্যাদিকালে মনে হয় সে জান্নাতের উদ্যানে বিরাজ করছে। এমনিভাবে কুফরীর দিকে ফিরে যাওয়াকে তার কাছে মনে হয় আগামীতে নয়; বরং নগদই জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হওয়া। ফলে কোনওক্রমেই সেদিকে সে ফিরে যেতে পারে না। বরং তার থেকে আত্মরক্ষার উপায় যে ঈমান ও সৎকর্ম, তা আঁকড়ে ধরে রাখে। বড় মজা নিয়ে সে তাতে নিয়োজিত থাকে। জান্নাতের সুখ ও আনন্দের অনুভূতিতে আপ্লুত হয়ে ইবাদত-বন্দেগীতে মগ্ন থাকে।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. এ হাদীছ দ্বারা জানা গেল, সুমিষ্ট ফল বা সুস্বাদু খাবারের মত ঈমানেরও স্বাদ ও মিষ্টতা আছে।

খ. ঈমানের স্বাদ ও মিষ্টতা অনুভব করতে চাইলে আমাদেরকে অবশ্যই আল্লাহ তাআলা ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে অন্য সকলের ও সবকিছুর চেয়ে বেশি ভালোবাসতে হবে।

গ. সে-ই প্রকৃত মুমিন, যে কাউকে ভালোবাসলে আল্লাহরই জন্য ভালোবাসে এবং কাউকে ঘৃণা করলেও আল্লাহ তাআলার জন্যই ঘৃণা করে।

ঘ. প্রকৃত মুমিন কোনও অবস্থায়ই কুফর ও কুফরীকর্মের দিকে ফিরতে প্রস্তুত হয় না, এমনকি তাকে যদি অগ্নিকুণ্ডেও নিক্ষেপ করা হয়।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক নিষ্প্রয়োজন
রিয়াযুস সালিহীন - হাদীস নং ৩৭৫ | মুসলিম বাংলা