রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ
ভূমিকা অধ্যায়
হাদীস নং: ৩৬০
অধ্যায়ঃ ৪৫
নেককার লোকদের সঙ্গে সাক্ষাত করা, তাদের মজলিসে বসা, তাদের সাহচর্য গ্রহণ করা, তাদেরকে ভালোবাসা,তাদের সাক্ষাত প্রার্থনা করা, তাদের কাছে দু'আ চাওয়া
এবং মর্যাদাপূর্ণ স্থানসমূহ যিয়ারত করা আল্লাহওয়ালা ও বুযুর্গ ব্যক্তিদের সঙ্গে সাক্ষাত করা, তাদের মজলিসে বসা ও তাদের সাহচর্যে থাকার দ্বারা ঈমান ও আমল-আখলাকে উন্নতি লাভ হয়। তাদেরকে দেখার দ্বারা আল্লাহর কথা স্মরণ হয়। তাদের কথা শুনলে দীনের বুঝ-সমঝ হাসিল হয়। তাদের আমল দেখলে নিজেরও আমল করার উৎসাহ জাগে এবং আমলের আদব কায়দা শেখা যায়। তাদের আচার-আচরণ দেখার দ্বারা দীনী শিষ্টাচার সম্পর্কে অবগতি লাভ হয়। তাদের আখলাক-চরিত্র দেখার দ্বারা নিজ আখলাক-চরিত্র সংশোধন করা যায়। মোটকথা তাদের কাছে যাওয়া-আসা করার দ্বারা নিজের জাহের-বাতেন ও ভেতর-বাহির আলোকিত হয়, জীবনে উৎকর্ষ আসে। ইসলাম তো জীবনবদলের জন্যই। কাজেই যা-কিছু জীবনবদলের পক্ষে সহায়ক, তা অবশ্যই অবলম্বন করা উচিত। সে হিসেবে বুযুর্গানে দীন ও আল্লাহওয়ালাদের কাছে যাওয়া-আসা করা ও তাদের সাহচর্য গ্রহণ করা অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ। তাদের দু'আও অত্যন্ত কার্যকর। তাই গুরুত্বের সঙ্গে তাদের কাছে দু'আও চাওয়া দরকার। এমনিভাবে বরকতপূর্ণ স্থানসমূহের স্পর্শও ঈমান তাজা করে, আমলে উদ্দীপনা যোগায়। দেহমনে আলো সঞ্চার ও নূরানী যিন্দেগী গড়ার লক্ষ্যে এরকম স্থানসমূহের যিয়ারতও কাম্য।
এসবই যে কাম্য ও বাঞ্ছনীয়, সে সম্পর্কিত কিছু আয়াত ও হাদীছ ইমাম নববী রহ. এ অধ্যায়ে উল্লেখ করেছেন। আমরা তার বঙ্গানুবাদ ও সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা পেশ করছি। মাল্লাহ তাআলা তাওফীক দান করুন। আমীন।
নেককার লোকদের সঙ্গে সাক্ষাত করা এবং মর্যাদাপূর্ণ স্থানসমূহ যিয়ারত করা -সম্পর্কিত কয়েকটি আয়াত
এক নং আয়াত
وَإِذْ قَالَ مُوسَى لِفَتَاهُ لَا أَبْرَحُ حَتَّى أَبْلُغَ مَجْمَعَ الْبَحْرَيْنِ أَوْ أَمْضِيَ حُقُبًا (60) فَلَمَّا بَلَغَا مَجْمَعَ بَيْنِهِمَا نَسِيَا حُوتَهُمَا فَاتَّخَذَ سَبِيلَهُ فِي الْبَحْرِ سَرَبًا (61) فَلَمَّا جَاوَزَا قَالَ لِفَتَاهُ آتِنَا غَدَاءَنَا لَقَدْ لَقِينَا مِنْ سَفَرِنَا هَذَا نَصَبًا (62) قَالَ أَرَأَيْتَ إِذْ أَوَيْنَا إِلَى الصَّخْرَةِ فَإِنِّي نَسِيتُ الْحُوتَ وَمَا أَنْسَانِيهُ إِلَّا الشَّيْطَانُ أَنْ أَذْكُرَهُ وَاتَّخَذَ سَبِيلَهُ فِي الْبَحْرِ عَجَبًا (63) قَالَ ذَلِكَ مَا كُنَّا نَبْغِ فَارْتَدَّا عَلَى آثَارِهِمَا قَصَصًا (64) فَوَجَدَا عَبْدًا مِنْ عِبَادِنَا آتَيْنَاهُ رَحْمَةً مِنْ عِنْدِنَا وَعَلَّمْنَاهُ مِنْ لَدُنَّا عِلْمًا (65) قَالَ لَهُ مُوسَى هَلْ أَتَّبِعُكَ عَلَى أَنْ تُعَلِّمَنِ مِمَّا عُلِّمْتَ رُشْدًا
অর্থ : (সেই সময়ের বৃত্তান্ত শোন) যখন মূসা তার যুবক (শিষ্য)-কে বলেছিল, আমি দুই সাগরের সঙ্গমস্থলে না পৌঁছা পর্যন্ত চলতেই থাকব অথবা আমি চলতে থাকব বছরের পর বছর। সুতরাং তারা যখন দুই সাগরের সঙ্গমস্থলে পৌঁছল, তখন উভয়েই তাদের মাছের কথা ভুলে গেল। সেটি সাগরের ভেতর সুড়ঙ্গের মত পথ তৈরি করে নিল। তারপর তারা যখন সে স্থান অতিক্রম করে গেল, তখন মূসা তার (সঙ্গী) যুবককে বলল, আমাদের নাশতা লও। সত্যি বলতে কি, এ সফরে আমরা বড় ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। সে বলল, আপনি কি জানেন (কী আজব কাণ্ড ঘটেছে?) আমরা যখন পাথরের চাঁইয়ের উপর বিশ্রাম করছিলাম, তখন মাছটির কথা (আপনাকে বলতে) ভুলে গিয়েছিলাম। সেটির কথা বলতে শয়তানই আমাকে ভুলিয়ে দিয়েছিল। আর সেটি (অর্থাৎ মাছটি) অত্যন্ত আশ্চর্যজনকভাবে সাগরে নিজের পথ করে নিয়েছিল। মূসা বলল, আমরা তো এটাই সন্ধান করছিলাম। অতএব তারা তাদের পদচিহ্ন ধরে ফিরে চলল। অনন্তর তারা আমার বান্দাদের মধ্য হতে এক বান্দার সাক্ষাত পেল, যাকে আমি আমার বিশেষ রহমত দান করেছিলাম এবং আমার পক্ষ হতে শিক্ষা দিয়েছিলাম এক বিশেষ জ্ঞান। মূসা তাকে বলল, আমি কি এই লক্ষ্যে আপনার অনুগমন করতে পারি যে, আপনাকে যে কল্যাণকর জ্ঞান দেওয়া হয়েছে তা থেকে খানিকটা আমাকে শেখাবেন?২২৫
ব্যাখ্যা
এ আয়াতসমূহে হযরত খাযির আলাইহিস সালামের সাথে হযরত মূসা আলাইহিস সালামের সাক্ষাৎকারের ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি দীর্ঘ হাদীছে এ ঘটনাটি বিস্তারিতভাবে বিবৃত করেছেন। বুখারী শরীফে কয়েকটি সনদে তা উদ্ধৃত হয়েছে। হাদীছটির সারসংক্ষেপ এস্থলে উল্লেখ করা হচ্ছে।
হযরত মূসা আলাইহিস সালাম ও হযরত খাযির আলাইহিস সালামের ঘটনা
একবার কেউ হযরত মূসা আলাইহিস সালামকে জিজ্ঞেস করল, বর্তমান বিশ্বে সর্বাপেক্ষা বড় আলেম কে? যেহেতু প্রত্যেক নবী তার সমকালীন বিশ্বে দীনের সর্বাপেক্ষা বড় আলেম হয়ে থাকেন, তাই হযরত মূসা আলাইহিস সালাম জবাব দিলেন, আমিই সবচেয়ে বড় আলেম। এ জবাব আল্লাহ তাআলার পসন্দ হলো না। আল্লাহ তাআলার পক্ষ হতে হযরত মূসা আলাইহিস সালামকে অবহিত করা হলো যে, প্রশ্নের সঠিক উত্তর ছিল- আল্লাহ তাআলাই ভালো জানেন কে সবচেয়ে বড় আলেম।
এতদ্সঙ্গে আল্লাহ তাআলা হযরত মূসা আলাইহিস সালামের সামনে জ্ঞানের এমন এক দিগন্ত উন্মোচিত করতে চাইলেন, যে সম্পর্কে এ যাবৎকাল তার কোনও ধারণা ছিল না। সুতরাং তাঁকে হুকুম দেওয়া হলো, তিনি যেন হযরত খাযির আলাইহিস সালামের সঙ্গে সাক্ষাত করেন। পথ সম্পর্কে দিকনির্দেশনা দেওয়া হলো যে, যেখানে দু'টি সাগর মিলিত হয়েছে, সেটাই হবে তার গন্তব্যস্থল। আয়াতে ইরশাদ হয়েছে-
وَإِذْ قَالَ مُوسَى لِفَتَاهُ لَا أَبْرَحُ حَتَّى أَبْلُغَ مَجْمَعَ الْبَحْرَيْنِ أَوْ أَمْضِيَ حُقُبًا
‘(সেই সময়ের বৃত্তান্ত শোন) যখন মূসা তার যুবক (শিষ্য)-কে বলেছিল, আমি দুই সাগরের সঙ্গমস্থলে না পৌঁছা পর্যন্ত চলতেই থাকব অথবা আমি চলতে থাকব বছরের পর বছর)'। সাগরের সঙ্গমস্থল দ্বারা সুনির্দিষ্টভাবে কোন্ জায়গা বোঝানো হয়েছে সে সম্পর্কে বিভিন্ন মত পাওয়া যায়। অনেকের মতে আকাবা উপসাগর ও লোহিত সাগরের মিলনস্থল। হযরত মূসা আলাইহিস সালাম বনী ইসরাঈলকে নিয়ে যখন মিশর ত্যাগ করে সিনাই মরুভূমিতে এসে পৌঁছান, এবং বিভিন্ন কারণে দীর্ঘকাল যাবৎ তাঁকে এ মরুভূমিতে অবস্থান করতে হয়, হযরত খাযির আলাইহিস সালামের সঙ্গে সাক্ষাতের ঘটনাটি সেই সময়কার হয়ে থাকলে এ স্থানটি তাদের মিলনস্থল হওয়া সম্ভব। কিন্তু কারও কারও মতে এটি ঘটেছিল তাঁর মিশরে অবস্থানকালে। এক ইসরাঈলী বর্ণনা মোতাবেক তিনি মিশর থেকে হাবশার দিকে সুদীর্ঘ একটি সফর করেছিলেন। সে সফরকালেও এ ঘটনা ঘটা সম্ভব। সে ক্ষেত্রে দুই সাগরের সঙ্গমস্থল বলতে সুদানের রাজধানী খুরতুমের কাছাকাছি কোনও এক স্থান হয়ে থাকবে, যেখানে 'নীল আযরাক' ও 'নীল আবয়ায' নামক দুই নদ মিলিত হয়েছে। আবার কেউ কেউ জিব্রাল্টার প্রণালীর কোনও স্থান হতে পারে বলেও অভিমত ব্যক্ত করেছেন। এ প্রণালী দ্বারা আটলান্টিক মহাসাগরের সঙ্গে ভূমধ্য সাগর মিলিত হয়েছে। তবে এর কোনওটিই নিশ্চিত নয়। নিশ্চিতভাবে তা জানা জরুরিও নয়। কুরআন মাজীদে যেসব ঘটনা বর্ণিত হয়েছে, তা দ্বারা উদ্দেশ্য কেবল নসীহত ও শিক্ষাগ্রহণ করা। স্থান-কাল জানা ছাড়াও সে উদ্দেশ্য সাধিত হয়ে যায়।
যাহোক হযরত মূসা আলাইহিস সালামকে বলে দেওয়া হয়েছিল যে, দুই সাগরের সঙ্গমস্থলে এমন একটা জায়গা আসবে, যেখানে তার সঙ্গে নেওয়া মাছ হারিয়ে যাবে। মাছ হারানোর সে জায়গাতেই হযরত খাযির আলাইহিস সালামের সাক্ষাত পাওয়া যাবে। সুতরাং হযরত মূসা আলাইহিস সালাম তাঁর যুবক শিষ্য হযরত ইয়ূশা আলাইহিস সালামকে সঙ্গে নিয়ে, যিনি পরবর্তীকালে নবী হয়েছিলেন, সফর শুরু করে দিলেন।
হযরত মূসা আলাইহিস সালাম এক জায়গায় পৌঁছে একটি পাথরের চাঁইয়ের উপর কিছুক্ষণের জন্য ঘুমিয়ে পড়েছিলেন, এ সময় সঙ্গে আনা মাছটি ঝুড়ির ভেতর থেকে বের হয়ে গেল এবং ঘেঁষড়াতে ঘেঁষড়াতে সাগরে গিয়ে পড়ল। যেখানে সেটি পড়েছিল, সেখানে পানিতে সুড়ঙ্গের মত তৈরি হয়ে গেল এবং তার ভেতর সেটি অদৃশ্য হয়ে গেল।
হযরত ইয়ূশা আলাইহিস সালাম তখন জেগেই ছিলেন। তিনি মাছটির এ বিস্ময়কর কাণ্ড দেখতে পাচ্ছিলেন, কিন্তু হযরত মূসা আলাইহিস সালাম ঘুমিয়ে থাকায় তিনি তাঁকে জাগানো সমীচীন মনে করলেন না। তারপর যখন হযরত মূসা আলাইহিস সালামের ঘুম ভাঙল এবং সামনে এগিয়ে চললেন, তখনও হযরত ইয়ুশা আলাইহিস সালাম তাঁকে সে কথা জানাতে ভুলে গেলেন। তাঁর সে কথা মনে পড়ল যখন হযরত মূসা আলাইহিস সালাম তাঁর কাছে নাশতা চাইলেন ।
হযরত মূসা আলাইহিস সালামকে আলামত বলে দেওয়া হয়েছিল এটাই যে, যেখানে মাছটি হারিয়ে যাবে, সেখানেই হযরত খাযির আলাইহিস সালামের সাথে সাক্ষাত হবে। তাই হযরত ইয়ূশা আলাইহিস সালাম তো ঘটনাটি তাঁকে ভয়ে ভয়ে শুনিয়েছিলেন, কিন্তু হযরত মূসা আলাইহিস সালাম শুনে অত্যন্ত খুশি হলেন। তিনি যে গন্তব্যের সন্ধান পেয়ে গেছেন!
হযরত মূসা আলাইহিস সালাম যখন পাথরের চাঁইটির কাছে ফিরে আসলেন, তখন হযরত খাযির আলাইহিস সালাম সেখানে চাদর মুড়ি দিয়ে শোয়া ছিলেন। হযরত মূসা আলাইহিস সালাম তাঁকে সালাম দিলেন। তিনি জেগে উঠলেন। উভয়ের মধ্যে পরিচয় হলো। তারপর হযরত মূসা আলাইহিস সালাম তাঁকে লক্ষ্য করে বললেন-
هَلْ أَتَّبِعُكَ عَلَى أَنْ تُعَلِّمَنِ مِمَّا عُلِّمْتَ رُشْدًا
(আমি কি এই লক্ষ্যে আপনার অনুগমন করতে পারি যে, আপনাকে যে কল্যাণকর জ্ঞান দেওয়া হয়েছে তা থেকে খানিকটা আমাকে শেখাবেন?)। এটা ছিল তাঁর পক্ষ থেকে হযরত খাযির আলাইহিস সালামের প্রতি এক বিনীত অনুরোধ। এর দ্বারা শিক্ষা পাওয়া যায়, ছাত্রের কর্তব্য উসতাযের সাথে সর্বদা বিনীতভাবে কথা বলা ও বিনীত আচরণ করা। এক বর্ণনায় আছে,
توَاضَعُوْا لِمَنْ تَعَلَّمُونَ مِنْهُ
‘যার কাছে শিক্ষালাভ কর, তার সাথে বিনয় অবলম্বন করবে।২২৬
হযরত খাযির আলাইহিস সালাম তাঁর এ বিনীত অনুরোধ রক্ষা করলেন। তবে শর্ত দিলেন যে, পথে যা-কিছু নজরে আসবে তাতে হযরত মূসা আলাইহিস সালামকে ধৈর্যধারণ করতে হবে, কোনওরকম আপত্তি করা যাবে না, কোনও প্রশ্নও তোলা যাবে না। তিনি শর্ত মেনে নিয়ে তাঁর সঙ্গে থাকা শুরু করলেন। এ সময়কালে হযরত খাযির আলাইহিস সালাম তিনটি অবাক করা কাজ করলেন। তার কোনওটিই হযরত মূসা আলাইহিস সালামের শরীআতের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ছিল না। যে মাঝি তাদেরকে বিনা ভাড়ায় নদী পার করিয়ে দিয়েছিল, খাযির আলাইহিস সালাম তার নৌকাটি ফুটো করে দিলেন। তিনি শুধু শুধুই একটি বালককে মেরে ফেললেন। এক জনপদের লোকজন তাদের আপ্যায়ন করতে রাজি না হওয়া সত্ত্বেও তিনি বিনামূল্যে তাদের একটি পতনোন্মুখ প্রাচীর সোজা করে দিলেন।
যেহেতু কাজগুলো আপত্তিকর ও প্রশ্নসাপেক্ষ ছিল, তাই কথা না বলার শর্ত থাকা সত্ত্বেও হযরত মূসা আলাইহিস সালাম প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রশ্ন তুললেন। তিন তিনবার শর্ত ভঙ্গ হওয়ায় খাযির আলাইহিস সালাম সফর ও সাহচর্যের সমাপ্তি ঘোষণা করলেন। তারপর তিনি আপাত আপত্তিকর এ কাজ তিনটির ব্যাখ্যা দিলেন। তাতে তিনি স্পষ্ট করে দিলেন যে, তিনি এগুলো আল্লাহর হুকুমেই করেছেন এবং তা করার প্রয়োজন ছিল।
নৌকাটি ফুটো করেছেন এ কারণে যে, সেটি ছিল কয়েকজন গরীব লোকের, যারা সাগরে কাজ করত। তাদের সামনে ছিল এক জালিম রাজা। সে সব ভালো নৌকা কেড়ে নিত। ফুটো করে দেওয়ার কারণে এখন আর সে নৌকাটি নেবে না। ফলে ফুটো করে দেওয়ায় গরীব লোকগুলোর কল্যাণই হয়েছে।
বালকটিকে হত্যা করার কারণ এই যে, তার পিতা-মাতা ছিল মুমিন। আশঙ্কা ছিল সে বড় হয়ে তাদেরকে অবাধ্যতা ও কুফরীতে লিপ্ত করবে। আশা ছিল একে হত্যা করলে তাদেরকে এর পরিবর্তে উৎকৃষ্ট ও নেককার সন্তান দেওয়া হবে।
প্রাচীরটি ছিল শহরে বসবাসকারী দুই ইয়াতীমের। নিচে তাদের গুপ্তধন ছিল। তাদের পিতা ছিল একজন সৎলোক । আল্লাহ তাআলার ইচ্ছা ছিল ছেলে দু'টো বড় হয়ে প্রাচীরের নিচ থেকে নিজেদের গুপ্তধন বের করে নেবে। কিন্তু এখনই যদি প্রাচীরটি পড়ে যায়, তবে সে গুপ্তধন অন্যরা কাড়াকাড়ি করে নিয়ে যাবে এবং তারা বঞ্চিত হবে। সে কারণেই খাযির আলাইহিস সালাম প্রাচীরটি সোজা করে দিয়েছেন।
প্রকাশ থাকে যে, হযরত মুসা আলাইহিস সালামের এ সফরকে সাধারণ কোনও ভ্রমণের সঙ্গে তুলনা করা যাবে না। তার এ সফরের ভেতর আল্লাহ তাআলার বিশেষ উদ্দেশ্য নিহিত ছিল। একটা উদ্দেশ্য তো অতি পরিষ্কার। আল্লাহ তাআলা এর দ্বারা শিক্ষা দিতে চেয়েছেন, নিজেকে নিজে সকলের বড় আলেম বলা কারও পক্ষেই শোভা পায় না। ইলম বা জ্ঞান হচ্ছে কুল-কিনারাহীন এক অথৈ সাগর। এর কোনও দিক সম্পর্কে কে বেশি জানে তা বলা সম্ভব নয়। দ্বিতীয় উদ্দেশ্য ছিল, আল্লাহ তাআলা নিজ জ্ঞান ও হিকমত দ্বারা মহাবিশ্ব কিভাবে চালাচ্ছেন তার একটা ঝলক হযরত মূসা আলাইহিস সালামকে চোখে দেখিয়ে দেওয়া।
মানুষ তার প্রাত্যহিক জীবনে দুনিয়ায় বহু ঘটনা ঘটতে দেখে। অনেক সময় এমন কাণ্ড-কারখানাও তার চোখে পড়ে, যার কোনও ব্যাখ্যা সে খুঁজে পায় না এবং যার উদ্দেশ্য তার বুঝে আসে না। অথচ প্রতিটি ঘটনার ভেতরই আল্লাহ তাআলার কোনও না কোনও হিকমত নিহিত থাকে। মানুষের দৃষ্টি যেহেতু সীমাবদ্ধ, তাই সে অনেক সময় তাঁর রহস্য বুঝতে সক্ষম হয় না। কিন্তু যেই সর্বশক্তিমান মালিকের হাতে বিশ্বজগতের বাগডোর, তিনি জানেন কখন কী ঘটনা ঘটা উচিত।
দুই নং আয়াত
وَاصْبِرْ نَفْسَكَ مَعَ الَّذِينَ يَدْعُونَ رَبَّهُمْ بِالْغَدَاةِ وَالْعَشِيِّ يُرِيدُونَ وَجْهَهُ وَلَا تَعْدُ عَيْنَاكَ عَنْهُمْ
অর্থ : ধৈর্য-স্থৈর্যের সাথে নিজেকে সেই সকল লোকের সংসর্গে রাখ, যারা সকাল ও সন্ধ্যায় নিজেদের প্রতিপালককে এ কারণে ডাকে যে, তারা তাঁর সন্তুষ্টি কামনা করে। তোমার দৃষ্টি যেন তাদের থেকে সরে না যায়।২২৭
ব্যাখ্যা
এ আয়াতে আল্লাহ তাআলা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ওইসব লোকের সঙ্গে ধৈর্য সহকারে থাকার হুকুম দিয়েছেন, যারা আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টিলাভের উদ্দেশ্যে পরিপূর্ণ ইখলাসের সঙ্গে সর্বদা ইবাদত-বন্দেগীতে মশগুল থাকে। সকাল-সন্ধ্যায় আল্লাহ তাআলাকে ডাকে। অর্থাৎ পাঁচ ওয়াক্ত নামায নিয়মিত আদায় করে, আল্লাহ তাআলার যিকর করে, কুরআন তিলাওয়াত করে, হালাল-হারাম বিচার করে চলে, মানুষের সঙ্গে আচার-আচরণে আল্লাহ তাআলাকে স্মরণ রাখে, আল্লাহ তাআলার হক আদায়ের পাশাপাশি মাখলুকের হক আদায়েও যত্নবান থাকে। তারা গরীব কিসিমের লোক হতে পারে, কিন্তু তাদের অন্তর ঐশ্বর্যে ভরা। দুনিয়ার প্রতি তাদের কোনও লোভ-লালসা নেই। দুনিয়াদারদের যা আছে সেজন্য তারা লালায়িতও নয় এবং নয় সে কারণে তাদের প্রতি ঈর্ষান্বিত ।
সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে হযরত আম্মার ইবন ইয়াসির রাযি., হযরত সুহায়ব রাযি.. হযরত বিলাল রাযি., হযরত আবূ হুরায়রা রাযি., হযরত আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ রাযি. প্রমুখ সাহাবী এসকল গুণের অধিকারী ছিলেন। আল্লাহ জাল্লা শানুহু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এসকল গরীব আল্লাহওয়ালাদের সঙ্গে ধৈর্যসহকারে থাকতে বলেছেন।
যাদের সাহচর্য কল্যাণকর
এ আয়াতে বাহ্যত নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তাদের সাহচর্যে থাকার হুকুম দেওয়া হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে বোঝানো উদ্দেশ্য- আপনি ধৈর্যসহকারে তাদেরকে নিজ সাহচর্যে থাকতে দিন। আপনার সাহচর্যে থেকে তারা যাতে নিজেদেরকে আল্লাহর খাঁটি বান্দারূপে গড়ে তুলতে পারে আর এভাবে আখেরাতের সাফল্য অর্জনে সক্ষম হতে পারে, সে সুযোগ তাদেরকে দান করুন।
এর দ্বারা উদ্দেশ্য সম্ভবত আমাদেরকে সবক দেওয়া যে, আমরা যেন উল্লিখিত গুণসম্পন্ন ব্যক্তিদের সাহচর্যে থাকি। এভাবেও বলা যায় যে, আমাদেরকে আল্লাহওয়ালাদের সাহচর্য অবলম্বনের হুকুম দেওয়া হয়েছে আর কিভাবে চিনব কে সত্যিকারের আল্লাহওয়ালা, সেজন্য তাদের গুণাবলীও উল্লেখ করে দেওয়া হয়েছে। সেইসঙ্গে সতর্ক করা হয়েছে যাতে করে কোনও আল্লাহওয়ালা গরীব হলে সে কারণে তাদের সাহচর্য পরিত্যাগ না করি। কেননা আল্লাহওয়ালা হওয়ার মাপকাঠি ধন-সম্পদ নয়; বরং উল্লিখিত গুণাবলী। যাদের মধ্যে এসব গুণ নেই, পার্থিব দিক থেকে তারা যতই সুপ্রতিষ্ঠিত হোক, প্রকৃতপক্ষে তারা এর উপযুক্ত নয় যে, তাদের সাহচর্য গ্রহণ করা যেতে পারে। তা করতে পারে কেবল এমন লোক, যাদের উদ্দেশ্য পার্থিব ভোগ- উপভোগ। আয়াতের পরের অংশে সেদিকেই দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলা হয়েছে-
وَلَا تَعْدُ عَيْنَاكَ عَنْهُمْ تُرِيدُ زِينَةَ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا
‘পার্থিব জীবনের সৌন্দর্য কামনায় তোমার দৃষ্টি যেন তাদের থেকে সরে না যায়।’
অর্থাৎ মুখলিস গরীবদের ছেড়ে বিত্তবান অহংকারীদের দিকে নজর দিও না। তুমি হয়তো এই উদ্দেশ্যে তাদের দিকে নজর দেবে যে, তারা মুসলিম হয়ে গেলে ইসলাম শক্তিশালী হবে । এ চিন্তা ভুল । ইসলামের প্রকৃত শক্তি ও মর্যাদা অর্থবিত্তের মধ্যে নিহিত নয়; বরং তার উৎস হচ্ছে খাঁটি ঈমান তাকওয়া-পরহেযগারী ও উন্নত আখলাক-চরিত্র। এটাই প্রকৃত সম্পদ, যা ওই গরীব মুমিনদের মধ্যে আছে। অহংকারী বিত্তবানেরা এর থেকে বঞ্চিত।
যাদের সাহচর্য গ্রহণ করতে নেই
এ প্রসঙ্গে আয়াতের পরবর্তী অংশও উল্লেখযোগ্য। বলা হয়েছে-
وَلَا تُطِعْ مَنْ أَغْفَلْنَا قَلْبَهُ عَنْ ذِكْرِنَا وَاتَّبَعَ هَوَاهُ وَكَانَ أَمْرُهُ فُرُطًا
(এমন কোনও ব্যক্তির কথা মানবে না, যার অন্তরকে আমি আমার স্মরণ থেকে গাফেল করে রেখেছি, যে নিজ খেয়াল-খুশির পেছনে পড়ে রয়েছে এবং যার কার্যকলাপ সীমা ছাড়িয়ে গেছে)।
কোনও কোনও বর্ণনা দ্বারা জানা যায়, কুরায়শ গোত্রীয় কোনও কোনও মোড়ল নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে প্রস্তাব পেশ করেছিল, আপনি ওই নিম্নস্তরের লোকগুলোকে সরিয়ে দিন, তাহলে আমরা অভিজাত ও সম্ভ্রান্ত শ্রেণী আপনার কাছে বসতে পারব এবং আপনি কী বলেন তা শুনব। তারা নিম্নস্তরের লোক বলেছিল গরীব মুমিনদেরকে আর অভিজাত বলেছিল বিত্তবান কাফেরদেরকে।
হয়তোবা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চিন্তা করেছিলেন আমার গরীব সাহাবীগণ তো খাঁটি মুমিনই। তাদের ঈমান পরিপক্ক। সাময়িকভাবে তাদেরকে মজলিসে আসতে মানা করলে বিশেষ কোনও ক্ষতি নেই, তারা মনে কষ্ট পাবে না। এ অবকাশে এসব মোড়লকে দীনের কথা শোনানো যাবে। হয়তো তারা ঈমানও আনবে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে আয়াতটি নাযিল হয় এবং নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সতর্ক করে দেওয়া হয় যে, আপনি এ উদ্ধত-অহংকারী শ্রেণীর কথায় কান দেবেন না। এরা শুধু শুধুই এ প্রস্তাব করছে। আসলে তাদের ঈমান আনার ইচ্ছাই নেই। ঈমান আনতে চাইলে তারা এতদিনে এনেই ফেলত। তাদের সামনে সত্যদীন পরিস্ফুট হতে কিছু বাকি নেই। আসলে তাদের অন্তর দুনিয়ার নেশায় মত্ত। তারা আল্লাহর স্মরণ থেকে গাফেল। তারা সর্বক্ষণ মনের খাহেশ পূরণে ব্যস্ত। আল্লাহর আনুগত্য করতে গেলে তারা তাদের মনের অসৎ চাহিদা পূরণ করতে পারবে না। তাই মনের চাহিদাকে অগ্রাধিকার দিয়ে আল্লাহর আনুগত্য পাশ কাটিয়ে চলছে এবং কুফর ও অবাধ্যতায় লিপ্ত থেকে সীমালঙ্ঘন ও বাড়াবাড়ির চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। এহেন নফসের পূজারীদের কথায় বিলকুল কর্ণপাত করবেন না।
মোটকথা তিনটি অসদ্গুণ যাদের মধ্যে আছে, কিছুতেই তাদের আনুগত্য করা যাবে না, এমনকি তাদের সঙ্গ ও সাহচর্যও অবলম্বন করা উচিত হবে না। সে অসৎ গুণগুলো হচ্ছে-
ক. অন্তরের গাফলাত এবং আল্লাহর যিকর ও স্মরণ থেকে বিমুখ থাকা। খ. নফসের আনুগত্য তথা মনের অসৎ চাহিদা পূরণে লিপ্ত থাকা। গ. সত্য ও ন্যায়ের সীমা লঙ্ঘন করা ও বাড়াবাড়িতে লিপ্ত থাকা।
যে-কারও বদদীন হওয়ার জন্য এ তিনটি স্বভাবের যে কোনও একটিই যথেষ্ট। কারও মধ্যে তিনওটি থাকার অর্থ সে চরম পর্যায়ের বেদীন। এরূপ লোকের কথায় চলা। বা তাদের সাহচর্য অবলম্বন করার পরিণাম নিজেরও গোমরাহ হয়ে যাওয়া, যা কোনও মুমিন-মুসলিমের কাম্য হতে পারে না।
এ আয়াতটি সাহাবায়ে কেরামের উচ্চমর্যাদার এক সুস্পষ্ট দলীল। আয়াতটি নাযিল হলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই বলে আল্লাহ তাআলার শোকর আদায় করেন-
الْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِي لَمْ يُمِثْنِي حَتَّى أَمَرَنِي أَنْ أَصْبَرَ نَفْسِي مَعَ قَوْمٍ مِنْ أُمَّتِي، مَعَكُمْ الْمَحْيَا، وَمَعَكُمُ الْمَمَاتُ
‘আল্লাহ তাআলার শোকর, তিনি আমার উম্মতেরই একদল লোকের সঙ্গে আমাকে ধৈর্যসহকারে থাকার আদেশ দান না করা পর্যন্ত আমার মৃত্যু ঘটাননি। (ওহে আমার সাহাবীগণ!) তোমাদেরই সঙ্গে আমার জীবন এবং তোমাদেরই সঙ্গে মরণ।২২৮
২২৫. সূরা কাহফ (১৮), আয়াত ৬০-৬৬
২২৬. এটি হযরত উমর রাযি.-এর বাণী হিসেবে বিশুদ্ধ সূত্রে বর্ণিত। দ্রষ্টব্য : আল আদাবুশ শরইয়্যাহ (ইবনে মুফলিহ) ১/২২৪; তাদরীবুর রাবী, ২/৫৮৯; ফয়যুল কাদীর ৩/২৭৩
২২৭. সূরা কাহফ (১৮), আয়াত নং ২৮
২২৮. শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ১০০১২; তাবারানী, আল-মুজামুস্ সগীর, হাদীছ নং ১০৭৪
নেককার লোকদের সঙ্গে সাক্ষাত করা, তাদের মজলিসে বসা, তাদের সাহচর্য গ্রহণ করা, তাদেরকে ভালোবাসা,তাদের সাক্ষাত প্রার্থনা করা, তাদের কাছে দু'আ চাওয়া
এবং মর্যাদাপূর্ণ স্থানসমূহ যিয়ারত করা আল্লাহওয়ালা ও বুযুর্গ ব্যক্তিদের সঙ্গে সাক্ষাত করা, তাদের মজলিসে বসা ও তাদের সাহচর্যে থাকার দ্বারা ঈমান ও আমল-আখলাকে উন্নতি লাভ হয়। তাদেরকে দেখার দ্বারা আল্লাহর কথা স্মরণ হয়। তাদের কথা শুনলে দীনের বুঝ-সমঝ হাসিল হয়। তাদের আমল দেখলে নিজেরও আমল করার উৎসাহ জাগে এবং আমলের আদব কায়দা শেখা যায়। তাদের আচার-আচরণ দেখার দ্বারা দীনী শিষ্টাচার সম্পর্কে অবগতি লাভ হয়। তাদের আখলাক-চরিত্র দেখার দ্বারা নিজ আখলাক-চরিত্র সংশোধন করা যায়। মোটকথা তাদের কাছে যাওয়া-আসা করার দ্বারা নিজের জাহের-বাতেন ও ভেতর-বাহির আলোকিত হয়, জীবনে উৎকর্ষ আসে। ইসলাম তো জীবনবদলের জন্যই। কাজেই যা-কিছু জীবনবদলের পক্ষে সহায়ক, তা অবশ্যই অবলম্বন করা উচিত। সে হিসেবে বুযুর্গানে দীন ও আল্লাহওয়ালাদের কাছে যাওয়া-আসা করা ও তাদের সাহচর্য গ্রহণ করা অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ। তাদের দু'আও অত্যন্ত কার্যকর। তাই গুরুত্বের সঙ্গে তাদের কাছে দু'আও চাওয়া দরকার। এমনিভাবে বরকতপূর্ণ স্থানসমূহের স্পর্শও ঈমান তাজা করে, আমলে উদ্দীপনা যোগায়। দেহমনে আলো সঞ্চার ও নূরানী যিন্দেগী গড়ার লক্ষ্যে এরকম স্থানসমূহের যিয়ারতও কাম্য।
এসবই যে কাম্য ও বাঞ্ছনীয়, সে সম্পর্কিত কিছু আয়াত ও হাদীছ ইমাম নববী রহ. এ অধ্যায়ে উল্লেখ করেছেন। আমরা তার বঙ্গানুবাদ ও সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা পেশ করছি। মাল্লাহ তাআলা তাওফীক দান করুন। আমীন।
নেককার লোকদের সঙ্গে সাক্ষাত করা এবং মর্যাদাপূর্ণ স্থানসমূহ যিয়ারত করা -সম্পর্কিত কয়েকটি আয়াত
এক নং আয়াত
وَإِذْ قَالَ مُوسَى لِفَتَاهُ لَا أَبْرَحُ حَتَّى أَبْلُغَ مَجْمَعَ الْبَحْرَيْنِ أَوْ أَمْضِيَ حُقُبًا (60) فَلَمَّا بَلَغَا مَجْمَعَ بَيْنِهِمَا نَسِيَا حُوتَهُمَا فَاتَّخَذَ سَبِيلَهُ فِي الْبَحْرِ سَرَبًا (61) فَلَمَّا جَاوَزَا قَالَ لِفَتَاهُ آتِنَا غَدَاءَنَا لَقَدْ لَقِينَا مِنْ سَفَرِنَا هَذَا نَصَبًا (62) قَالَ أَرَأَيْتَ إِذْ أَوَيْنَا إِلَى الصَّخْرَةِ فَإِنِّي نَسِيتُ الْحُوتَ وَمَا أَنْسَانِيهُ إِلَّا الشَّيْطَانُ أَنْ أَذْكُرَهُ وَاتَّخَذَ سَبِيلَهُ فِي الْبَحْرِ عَجَبًا (63) قَالَ ذَلِكَ مَا كُنَّا نَبْغِ فَارْتَدَّا عَلَى آثَارِهِمَا قَصَصًا (64) فَوَجَدَا عَبْدًا مِنْ عِبَادِنَا آتَيْنَاهُ رَحْمَةً مِنْ عِنْدِنَا وَعَلَّمْنَاهُ مِنْ لَدُنَّا عِلْمًا (65) قَالَ لَهُ مُوسَى هَلْ أَتَّبِعُكَ عَلَى أَنْ تُعَلِّمَنِ مِمَّا عُلِّمْتَ رُشْدًا
অর্থ : (সেই সময়ের বৃত্তান্ত শোন) যখন মূসা তার যুবক (শিষ্য)-কে বলেছিল, আমি দুই সাগরের সঙ্গমস্থলে না পৌঁছা পর্যন্ত চলতেই থাকব অথবা আমি চলতে থাকব বছরের পর বছর। সুতরাং তারা যখন দুই সাগরের সঙ্গমস্থলে পৌঁছল, তখন উভয়েই তাদের মাছের কথা ভুলে গেল। সেটি সাগরের ভেতর সুড়ঙ্গের মত পথ তৈরি করে নিল। তারপর তারা যখন সে স্থান অতিক্রম করে গেল, তখন মূসা তার (সঙ্গী) যুবককে বলল, আমাদের নাশতা লও। সত্যি বলতে কি, এ সফরে আমরা বড় ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। সে বলল, আপনি কি জানেন (কী আজব কাণ্ড ঘটেছে?) আমরা যখন পাথরের চাঁইয়ের উপর বিশ্রাম করছিলাম, তখন মাছটির কথা (আপনাকে বলতে) ভুলে গিয়েছিলাম। সেটির কথা বলতে শয়তানই আমাকে ভুলিয়ে দিয়েছিল। আর সেটি (অর্থাৎ মাছটি) অত্যন্ত আশ্চর্যজনকভাবে সাগরে নিজের পথ করে নিয়েছিল। মূসা বলল, আমরা তো এটাই সন্ধান করছিলাম। অতএব তারা তাদের পদচিহ্ন ধরে ফিরে চলল। অনন্তর তারা আমার বান্দাদের মধ্য হতে এক বান্দার সাক্ষাত পেল, যাকে আমি আমার বিশেষ রহমত দান করেছিলাম এবং আমার পক্ষ হতে শিক্ষা দিয়েছিলাম এক বিশেষ জ্ঞান। মূসা তাকে বলল, আমি কি এই লক্ষ্যে আপনার অনুগমন করতে পারি যে, আপনাকে যে কল্যাণকর জ্ঞান দেওয়া হয়েছে তা থেকে খানিকটা আমাকে শেখাবেন?২২৫
ব্যাখ্যা
এ আয়াতসমূহে হযরত খাযির আলাইহিস সালামের সাথে হযরত মূসা আলাইহিস সালামের সাক্ষাৎকারের ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি দীর্ঘ হাদীছে এ ঘটনাটি বিস্তারিতভাবে বিবৃত করেছেন। বুখারী শরীফে কয়েকটি সনদে তা উদ্ধৃত হয়েছে। হাদীছটির সারসংক্ষেপ এস্থলে উল্লেখ করা হচ্ছে।
হযরত মূসা আলাইহিস সালাম ও হযরত খাযির আলাইহিস সালামের ঘটনা
একবার কেউ হযরত মূসা আলাইহিস সালামকে জিজ্ঞেস করল, বর্তমান বিশ্বে সর্বাপেক্ষা বড় আলেম কে? যেহেতু প্রত্যেক নবী তার সমকালীন বিশ্বে দীনের সর্বাপেক্ষা বড় আলেম হয়ে থাকেন, তাই হযরত মূসা আলাইহিস সালাম জবাব দিলেন, আমিই সবচেয়ে বড় আলেম। এ জবাব আল্লাহ তাআলার পসন্দ হলো না। আল্লাহ তাআলার পক্ষ হতে হযরত মূসা আলাইহিস সালামকে অবহিত করা হলো যে, প্রশ্নের সঠিক উত্তর ছিল- আল্লাহ তাআলাই ভালো জানেন কে সবচেয়ে বড় আলেম।
এতদ্সঙ্গে আল্লাহ তাআলা হযরত মূসা আলাইহিস সালামের সামনে জ্ঞানের এমন এক দিগন্ত উন্মোচিত করতে চাইলেন, যে সম্পর্কে এ যাবৎকাল তার কোনও ধারণা ছিল না। সুতরাং তাঁকে হুকুম দেওয়া হলো, তিনি যেন হযরত খাযির আলাইহিস সালামের সঙ্গে সাক্ষাত করেন। পথ সম্পর্কে দিকনির্দেশনা দেওয়া হলো যে, যেখানে দু'টি সাগর মিলিত হয়েছে, সেটাই হবে তার গন্তব্যস্থল। আয়াতে ইরশাদ হয়েছে-
وَإِذْ قَالَ مُوسَى لِفَتَاهُ لَا أَبْرَحُ حَتَّى أَبْلُغَ مَجْمَعَ الْبَحْرَيْنِ أَوْ أَمْضِيَ حُقُبًا
‘(সেই সময়ের বৃত্তান্ত শোন) যখন মূসা তার যুবক (শিষ্য)-কে বলেছিল, আমি দুই সাগরের সঙ্গমস্থলে না পৌঁছা পর্যন্ত চলতেই থাকব অথবা আমি চলতে থাকব বছরের পর বছর)'। সাগরের সঙ্গমস্থল দ্বারা সুনির্দিষ্টভাবে কোন্ জায়গা বোঝানো হয়েছে সে সম্পর্কে বিভিন্ন মত পাওয়া যায়। অনেকের মতে আকাবা উপসাগর ও লোহিত সাগরের মিলনস্থল। হযরত মূসা আলাইহিস সালাম বনী ইসরাঈলকে নিয়ে যখন মিশর ত্যাগ করে সিনাই মরুভূমিতে এসে পৌঁছান, এবং বিভিন্ন কারণে দীর্ঘকাল যাবৎ তাঁকে এ মরুভূমিতে অবস্থান করতে হয়, হযরত খাযির আলাইহিস সালামের সঙ্গে সাক্ষাতের ঘটনাটি সেই সময়কার হয়ে থাকলে এ স্থানটি তাদের মিলনস্থল হওয়া সম্ভব। কিন্তু কারও কারও মতে এটি ঘটেছিল তাঁর মিশরে অবস্থানকালে। এক ইসরাঈলী বর্ণনা মোতাবেক তিনি মিশর থেকে হাবশার দিকে সুদীর্ঘ একটি সফর করেছিলেন। সে সফরকালেও এ ঘটনা ঘটা সম্ভব। সে ক্ষেত্রে দুই সাগরের সঙ্গমস্থল বলতে সুদানের রাজধানী খুরতুমের কাছাকাছি কোনও এক স্থান হয়ে থাকবে, যেখানে 'নীল আযরাক' ও 'নীল আবয়ায' নামক দুই নদ মিলিত হয়েছে। আবার কেউ কেউ জিব্রাল্টার প্রণালীর কোনও স্থান হতে পারে বলেও অভিমত ব্যক্ত করেছেন। এ প্রণালী দ্বারা আটলান্টিক মহাসাগরের সঙ্গে ভূমধ্য সাগর মিলিত হয়েছে। তবে এর কোনওটিই নিশ্চিত নয়। নিশ্চিতভাবে তা জানা জরুরিও নয়। কুরআন মাজীদে যেসব ঘটনা বর্ণিত হয়েছে, তা দ্বারা উদ্দেশ্য কেবল নসীহত ও শিক্ষাগ্রহণ করা। স্থান-কাল জানা ছাড়াও সে উদ্দেশ্য সাধিত হয়ে যায়।
যাহোক হযরত মূসা আলাইহিস সালামকে বলে দেওয়া হয়েছিল যে, দুই সাগরের সঙ্গমস্থলে এমন একটা জায়গা আসবে, যেখানে তার সঙ্গে নেওয়া মাছ হারিয়ে যাবে। মাছ হারানোর সে জায়গাতেই হযরত খাযির আলাইহিস সালামের সাক্ষাত পাওয়া যাবে। সুতরাং হযরত মূসা আলাইহিস সালাম তাঁর যুবক শিষ্য হযরত ইয়ূশা আলাইহিস সালামকে সঙ্গে নিয়ে, যিনি পরবর্তীকালে নবী হয়েছিলেন, সফর শুরু করে দিলেন।
হযরত মূসা আলাইহিস সালাম এক জায়গায় পৌঁছে একটি পাথরের চাঁইয়ের উপর কিছুক্ষণের জন্য ঘুমিয়ে পড়েছিলেন, এ সময় সঙ্গে আনা মাছটি ঝুড়ির ভেতর থেকে বের হয়ে গেল এবং ঘেঁষড়াতে ঘেঁষড়াতে সাগরে গিয়ে পড়ল। যেখানে সেটি পড়েছিল, সেখানে পানিতে সুড়ঙ্গের মত তৈরি হয়ে গেল এবং তার ভেতর সেটি অদৃশ্য হয়ে গেল।
হযরত ইয়ূশা আলাইহিস সালাম তখন জেগেই ছিলেন। তিনি মাছটির এ বিস্ময়কর কাণ্ড দেখতে পাচ্ছিলেন, কিন্তু হযরত মূসা আলাইহিস সালাম ঘুমিয়ে থাকায় তিনি তাঁকে জাগানো সমীচীন মনে করলেন না। তারপর যখন হযরত মূসা আলাইহিস সালামের ঘুম ভাঙল এবং সামনে এগিয়ে চললেন, তখনও হযরত ইয়ুশা আলাইহিস সালাম তাঁকে সে কথা জানাতে ভুলে গেলেন। তাঁর সে কথা মনে পড়ল যখন হযরত মূসা আলাইহিস সালাম তাঁর কাছে নাশতা চাইলেন ।
হযরত মূসা আলাইহিস সালামকে আলামত বলে দেওয়া হয়েছিল এটাই যে, যেখানে মাছটি হারিয়ে যাবে, সেখানেই হযরত খাযির আলাইহিস সালামের সাথে সাক্ষাত হবে। তাই হযরত ইয়ূশা আলাইহিস সালাম তো ঘটনাটি তাঁকে ভয়ে ভয়ে শুনিয়েছিলেন, কিন্তু হযরত মূসা আলাইহিস সালাম শুনে অত্যন্ত খুশি হলেন। তিনি যে গন্তব্যের সন্ধান পেয়ে গেছেন!
হযরত মূসা আলাইহিস সালাম যখন পাথরের চাঁইটির কাছে ফিরে আসলেন, তখন হযরত খাযির আলাইহিস সালাম সেখানে চাদর মুড়ি দিয়ে শোয়া ছিলেন। হযরত মূসা আলাইহিস সালাম তাঁকে সালাম দিলেন। তিনি জেগে উঠলেন। উভয়ের মধ্যে পরিচয় হলো। তারপর হযরত মূসা আলাইহিস সালাম তাঁকে লক্ষ্য করে বললেন-
هَلْ أَتَّبِعُكَ عَلَى أَنْ تُعَلِّمَنِ مِمَّا عُلِّمْتَ رُشْدًا
(আমি কি এই লক্ষ্যে আপনার অনুগমন করতে পারি যে, আপনাকে যে কল্যাণকর জ্ঞান দেওয়া হয়েছে তা থেকে খানিকটা আমাকে শেখাবেন?)। এটা ছিল তাঁর পক্ষ থেকে হযরত খাযির আলাইহিস সালামের প্রতি এক বিনীত অনুরোধ। এর দ্বারা শিক্ষা পাওয়া যায়, ছাত্রের কর্তব্য উসতাযের সাথে সর্বদা বিনীতভাবে কথা বলা ও বিনীত আচরণ করা। এক বর্ণনায় আছে,
توَاضَعُوْا لِمَنْ تَعَلَّمُونَ مِنْهُ
‘যার কাছে শিক্ষালাভ কর, তার সাথে বিনয় অবলম্বন করবে।২২৬
হযরত খাযির আলাইহিস সালাম তাঁর এ বিনীত অনুরোধ রক্ষা করলেন। তবে শর্ত দিলেন যে, পথে যা-কিছু নজরে আসবে তাতে হযরত মূসা আলাইহিস সালামকে ধৈর্যধারণ করতে হবে, কোনওরকম আপত্তি করা যাবে না, কোনও প্রশ্নও তোলা যাবে না। তিনি শর্ত মেনে নিয়ে তাঁর সঙ্গে থাকা শুরু করলেন। এ সময়কালে হযরত খাযির আলাইহিস সালাম তিনটি অবাক করা কাজ করলেন। তার কোনওটিই হযরত মূসা আলাইহিস সালামের শরীআতের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ছিল না। যে মাঝি তাদেরকে বিনা ভাড়ায় নদী পার করিয়ে দিয়েছিল, খাযির আলাইহিস সালাম তার নৌকাটি ফুটো করে দিলেন। তিনি শুধু শুধুই একটি বালককে মেরে ফেললেন। এক জনপদের লোকজন তাদের আপ্যায়ন করতে রাজি না হওয়া সত্ত্বেও তিনি বিনামূল্যে তাদের একটি পতনোন্মুখ প্রাচীর সোজা করে দিলেন।
যেহেতু কাজগুলো আপত্তিকর ও প্রশ্নসাপেক্ষ ছিল, তাই কথা না বলার শর্ত থাকা সত্ত্বেও হযরত মূসা আলাইহিস সালাম প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রশ্ন তুললেন। তিন তিনবার শর্ত ভঙ্গ হওয়ায় খাযির আলাইহিস সালাম সফর ও সাহচর্যের সমাপ্তি ঘোষণা করলেন। তারপর তিনি আপাত আপত্তিকর এ কাজ তিনটির ব্যাখ্যা দিলেন। তাতে তিনি স্পষ্ট করে দিলেন যে, তিনি এগুলো আল্লাহর হুকুমেই করেছেন এবং তা করার প্রয়োজন ছিল।
নৌকাটি ফুটো করেছেন এ কারণে যে, সেটি ছিল কয়েকজন গরীব লোকের, যারা সাগরে কাজ করত। তাদের সামনে ছিল এক জালিম রাজা। সে সব ভালো নৌকা কেড়ে নিত। ফুটো করে দেওয়ার কারণে এখন আর সে নৌকাটি নেবে না। ফলে ফুটো করে দেওয়ায় গরীব লোকগুলোর কল্যাণই হয়েছে।
বালকটিকে হত্যা করার কারণ এই যে, তার পিতা-মাতা ছিল মুমিন। আশঙ্কা ছিল সে বড় হয়ে তাদেরকে অবাধ্যতা ও কুফরীতে লিপ্ত করবে। আশা ছিল একে হত্যা করলে তাদেরকে এর পরিবর্তে উৎকৃষ্ট ও নেককার সন্তান দেওয়া হবে।
প্রাচীরটি ছিল শহরে বসবাসকারী দুই ইয়াতীমের। নিচে তাদের গুপ্তধন ছিল। তাদের পিতা ছিল একজন সৎলোক । আল্লাহ তাআলার ইচ্ছা ছিল ছেলে দু'টো বড় হয়ে প্রাচীরের নিচ থেকে নিজেদের গুপ্তধন বের করে নেবে। কিন্তু এখনই যদি প্রাচীরটি পড়ে যায়, তবে সে গুপ্তধন অন্যরা কাড়াকাড়ি করে নিয়ে যাবে এবং তারা বঞ্চিত হবে। সে কারণেই খাযির আলাইহিস সালাম প্রাচীরটি সোজা করে দিয়েছেন।
প্রকাশ থাকে যে, হযরত মুসা আলাইহিস সালামের এ সফরকে সাধারণ কোনও ভ্রমণের সঙ্গে তুলনা করা যাবে না। তার এ সফরের ভেতর আল্লাহ তাআলার বিশেষ উদ্দেশ্য নিহিত ছিল। একটা উদ্দেশ্য তো অতি পরিষ্কার। আল্লাহ তাআলা এর দ্বারা শিক্ষা দিতে চেয়েছেন, নিজেকে নিজে সকলের বড় আলেম বলা কারও পক্ষেই শোভা পায় না। ইলম বা জ্ঞান হচ্ছে কুল-কিনারাহীন এক অথৈ সাগর। এর কোনও দিক সম্পর্কে কে বেশি জানে তা বলা সম্ভব নয়। দ্বিতীয় উদ্দেশ্য ছিল, আল্লাহ তাআলা নিজ জ্ঞান ও হিকমত দ্বারা মহাবিশ্ব কিভাবে চালাচ্ছেন তার একটা ঝলক হযরত মূসা আলাইহিস সালামকে চোখে দেখিয়ে দেওয়া।
মানুষ তার প্রাত্যহিক জীবনে দুনিয়ায় বহু ঘটনা ঘটতে দেখে। অনেক সময় এমন কাণ্ড-কারখানাও তার চোখে পড়ে, যার কোনও ব্যাখ্যা সে খুঁজে পায় না এবং যার উদ্দেশ্য তার বুঝে আসে না। অথচ প্রতিটি ঘটনার ভেতরই আল্লাহ তাআলার কোনও না কোনও হিকমত নিহিত থাকে। মানুষের দৃষ্টি যেহেতু সীমাবদ্ধ, তাই সে অনেক সময় তাঁর রহস্য বুঝতে সক্ষম হয় না। কিন্তু যেই সর্বশক্তিমান মালিকের হাতে বিশ্বজগতের বাগডোর, তিনি জানেন কখন কী ঘটনা ঘটা উচিত।
দুই নং আয়াত
وَاصْبِرْ نَفْسَكَ مَعَ الَّذِينَ يَدْعُونَ رَبَّهُمْ بِالْغَدَاةِ وَالْعَشِيِّ يُرِيدُونَ وَجْهَهُ وَلَا تَعْدُ عَيْنَاكَ عَنْهُمْ
অর্থ : ধৈর্য-স্থৈর্যের সাথে নিজেকে সেই সকল লোকের সংসর্গে রাখ, যারা সকাল ও সন্ধ্যায় নিজেদের প্রতিপালককে এ কারণে ডাকে যে, তারা তাঁর সন্তুষ্টি কামনা করে। তোমার দৃষ্টি যেন তাদের থেকে সরে না যায়।২২৭
ব্যাখ্যা
এ আয়াতে আল্লাহ তাআলা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ওইসব লোকের সঙ্গে ধৈর্য সহকারে থাকার হুকুম দিয়েছেন, যারা আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টিলাভের উদ্দেশ্যে পরিপূর্ণ ইখলাসের সঙ্গে সর্বদা ইবাদত-বন্দেগীতে মশগুল থাকে। সকাল-সন্ধ্যায় আল্লাহ তাআলাকে ডাকে। অর্থাৎ পাঁচ ওয়াক্ত নামায নিয়মিত আদায় করে, আল্লাহ তাআলার যিকর করে, কুরআন তিলাওয়াত করে, হালাল-হারাম বিচার করে চলে, মানুষের সঙ্গে আচার-আচরণে আল্লাহ তাআলাকে স্মরণ রাখে, আল্লাহ তাআলার হক আদায়ের পাশাপাশি মাখলুকের হক আদায়েও যত্নবান থাকে। তারা গরীব কিসিমের লোক হতে পারে, কিন্তু তাদের অন্তর ঐশ্বর্যে ভরা। দুনিয়ার প্রতি তাদের কোনও লোভ-লালসা নেই। দুনিয়াদারদের যা আছে সেজন্য তারা লালায়িতও নয় এবং নয় সে কারণে তাদের প্রতি ঈর্ষান্বিত ।
সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে হযরত আম্মার ইবন ইয়াসির রাযি., হযরত সুহায়ব রাযি.. হযরত বিলাল রাযি., হযরত আবূ হুরায়রা রাযি., হযরত আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ রাযি. প্রমুখ সাহাবী এসকল গুণের অধিকারী ছিলেন। আল্লাহ জাল্লা শানুহু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এসকল গরীব আল্লাহওয়ালাদের সঙ্গে ধৈর্যসহকারে থাকতে বলেছেন।
যাদের সাহচর্য কল্যাণকর
এ আয়াতে বাহ্যত নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তাদের সাহচর্যে থাকার হুকুম দেওয়া হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে বোঝানো উদ্দেশ্য- আপনি ধৈর্যসহকারে তাদেরকে নিজ সাহচর্যে থাকতে দিন। আপনার সাহচর্যে থেকে তারা যাতে নিজেদেরকে আল্লাহর খাঁটি বান্দারূপে গড়ে তুলতে পারে আর এভাবে আখেরাতের সাফল্য অর্জনে সক্ষম হতে পারে, সে সুযোগ তাদেরকে দান করুন।
এর দ্বারা উদ্দেশ্য সম্ভবত আমাদেরকে সবক দেওয়া যে, আমরা যেন উল্লিখিত গুণসম্পন্ন ব্যক্তিদের সাহচর্যে থাকি। এভাবেও বলা যায় যে, আমাদেরকে আল্লাহওয়ালাদের সাহচর্য অবলম্বনের হুকুম দেওয়া হয়েছে আর কিভাবে চিনব কে সত্যিকারের আল্লাহওয়ালা, সেজন্য তাদের গুণাবলীও উল্লেখ করে দেওয়া হয়েছে। সেইসঙ্গে সতর্ক করা হয়েছে যাতে করে কোনও আল্লাহওয়ালা গরীব হলে সে কারণে তাদের সাহচর্য পরিত্যাগ না করি। কেননা আল্লাহওয়ালা হওয়ার মাপকাঠি ধন-সম্পদ নয়; বরং উল্লিখিত গুণাবলী। যাদের মধ্যে এসব গুণ নেই, পার্থিব দিক থেকে তারা যতই সুপ্রতিষ্ঠিত হোক, প্রকৃতপক্ষে তারা এর উপযুক্ত নয় যে, তাদের সাহচর্য গ্রহণ করা যেতে পারে। তা করতে পারে কেবল এমন লোক, যাদের উদ্দেশ্য পার্থিব ভোগ- উপভোগ। আয়াতের পরের অংশে সেদিকেই দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলা হয়েছে-
وَلَا تَعْدُ عَيْنَاكَ عَنْهُمْ تُرِيدُ زِينَةَ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا
‘পার্থিব জীবনের সৌন্দর্য কামনায় তোমার দৃষ্টি যেন তাদের থেকে সরে না যায়।’
অর্থাৎ মুখলিস গরীবদের ছেড়ে বিত্তবান অহংকারীদের দিকে নজর দিও না। তুমি হয়তো এই উদ্দেশ্যে তাদের দিকে নজর দেবে যে, তারা মুসলিম হয়ে গেলে ইসলাম শক্তিশালী হবে । এ চিন্তা ভুল । ইসলামের প্রকৃত শক্তি ও মর্যাদা অর্থবিত্তের মধ্যে নিহিত নয়; বরং তার উৎস হচ্ছে খাঁটি ঈমান তাকওয়া-পরহেযগারী ও উন্নত আখলাক-চরিত্র। এটাই প্রকৃত সম্পদ, যা ওই গরীব মুমিনদের মধ্যে আছে। অহংকারী বিত্তবানেরা এর থেকে বঞ্চিত।
যাদের সাহচর্য গ্রহণ করতে নেই
এ প্রসঙ্গে আয়াতের পরবর্তী অংশও উল্লেখযোগ্য। বলা হয়েছে-
وَلَا تُطِعْ مَنْ أَغْفَلْنَا قَلْبَهُ عَنْ ذِكْرِنَا وَاتَّبَعَ هَوَاهُ وَكَانَ أَمْرُهُ فُرُطًا
(এমন কোনও ব্যক্তির কথা মানবে না, যার অন্তরকে আমি আমার স্মরণ থেকে গাফেল করে রেখেছি, যে নিজ খেয়াল-খুশির পেছনে পড়ে রয়েছে এবং যার কার্যকলাপ সীমা ছাড়িয়ে গেছে)।
কোনও কোনও বর্ণনা দ্বারা জানা যায়, কুরায়শ গোত্রীয় কোনও কোনও মোড়ল নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে প্রস্তাব পেশ করেছিল, আপনি ওই নিম্নস্তরের লোকগুলোকে সরিয়ে দিন, তাহলে আমরা অভিজাত ও সম্ভ্রান্ত শ্রেণী আপনার কাছে বসতে পারব এবং আপনি কী বলেন তা শুনব। তারা নিম্নস্তরের লোক বলেছিল গরীব মুমিনদেরকে আর অভিজাত বলেছিল বিত্তবান কাফেরদেরকে।
হয়তোবা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চিন্তা করেছিলেন আমার গরীব সাহাবীগণ তো খাঁটি মুমিনই। তাদের ঈমান পরিপক্ক। সাময়িকভাবে তাদেরকে মজলিসে আসতে মানা করলে বিশেষ কোনও ক্ষতি নেই, তারা মনে কষ্ট পাবে না। এ অবকাশে এসব মোড়লকে দীনের কথা শোনানো যাবে। হয়তো তারা ঈমানও আনবে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে আয়াতটি নাযিল হয় এবং নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সতর্ক করে দেওয়া হয় যে, আপনি এ উদ্ধত-অহংকারী শ্রেণীর কথায় কান দেবেন না। এরা শুধু শুধুই এ প্রস্তাব করছে। আসলে তাদের ঈমান আনার ইচ্ছাই নেই। ঈমান আনতে চাইলে তারা এতদিনে এনেই ফেলত। তাদের সামনে সত্যদীন পরিস্ফুট হতে কিছু বাকি নেই। আসলে তাদের অন্তর দুনিয়ার নেশায় মত্ত। তারা আল্লাহর স্মরণ থেকে গাফেল। তারা সর্বক্ষণ মনের খাহেশ পূরণে ব্যস্ত। আল্লাহর আনুগত্য করতে গেলে তারা তাদের মনের অসৎ চাহিদা পূরণ করতে পারবে না। তাই মনের চাহিদাকে অগ্রাধিকার দিয়ে আল্লাহর আনুগত্য পাশ কাটিয়ে চলছে এবং কুফর ও অবাধ্যতায় লিপ্ত থেকে সীমালঙ্ঘন ও বাড়াবাড়ির চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। এহেন নফসের পূজারীদের কথায় বিলকুল কর্ণপাত করবেন না।
মোটকথা তিনটি অসদ্গুণ যাদের মধ্যে আছে, কিছুতেই তাদের আনুগত্য করা যাবে না, এমনকি তাদের সঙ্গ ও সাহচর্যও অবলম্বন করা উচিত হবে না। সে অসৎ গুণগুলো হচ্ছে-
ক. অন্তরের গাফলাত এবং আল্লাহর যিকর ও স্মরণ থেকে বিমুখ থাকা। খ. নফসের আনুগত্য তথা মনের অসৎ চাহিদা পূরণে লিপ্ত থাকা। গ. সত্য ও ন্যায়ের সীমা লঙ্ঘন করা ও বাড়াবাড়িতে লিপ্ত থাকা।
যে-কারও বদদীন হওয়ার জন্য এ তিনটি স্বভাবের যে কোনও একটিই যথেষ্ট। কারও মধ্যে তিনওটি থাকার অর্থ সে চরম পর্যায়ের বেদীন। এরূপ লোকের কথায় চলা। বা তাদের সাহচর্য অবলম্বন করার পরিণাম নিজেরও গোমরাহ হয়ে যাওয়া, যা কোনও মুমিন-মুসলিমের কাম্য হতে পারে না।
এ আয়াতটি সাহাবায়ে কেরামের উচ্চমর্যাদার এক সুস্পষ্ট দলীল। আয়াতটি নাযিল হলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই বলে আল্লাহ তাআলার শোকর আদায় করেন-
الْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِي لَمْ يُمِثْنِي حَتَّى أَمَرَنِي أَنْ أَصْبَرَ نَفْسِي مَعَ قَوْمٍ مِنْ أُمَّتِي، مَعَكُمْ الْمَحْيَا، وَمَعَكُمُ الْمَمَاتُ
‘আল্লাহ তাআলার শোকর, তিনি আমার উম্মতেরই একদল লোকের সঙ্গে আমাকে ধৈর্যসহকারে থাকার আদেশ দান না করা পর্যন্ত আমার মৃত্যু ঘটাননি। (ওহে আমার সাহাবীগণ!) তোমাদেরই সঙ্গে আমার জীবন এবং তোমাদেরই সঙ্গে মরণ।২২৮
২২৫. সূরা কাহফ (১৮), আয়াত ৬০-৬৬
২২৬. এটি হযরত উমর রাযি.-এর বাণী হিসেবে বিশুদ্ধ সূত্রে বর্ণিত। দ্রষ্টব্য : আল আদাবুশ শরইয়্যাহ (ইবনে মুফলিহ) ১/২২৪; তাদরীবুর রাবী, ২/৫৮৯; ফয়যুল কাদীর ৩/২৭৩
২২৭. সূরা কাহফ (১৮), আয়াত নং ২৮
২২৮. শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ১০০১২; তাবারানী, আল-মুজামুস্ সগীর, হাদীছ নং ১০৭৪
হযরত উম্মু আয়মান রাযি.-এর সঙ্গে হযরত আবূ বকর রাযি. ও উমর রাযি.-এর সাক্ষাত করতে যাওয়া
হাদীছ নং : ৩৬০
হযরত আনাস রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওফাতের পর হযরত আবূ বকর রাযি. উমর রাযি.কে বললেন, চলুন আমরা উম্মু আয়মানের সঙ্গে সাক্ষাত করতে যাই, যেমন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সঙ্গে সাক্ষাত করতেন। যখন তাঁরা তাঁর কাছে পৌঁছলেন, তিনি কেঁদে দিলেন। তাঁরা তাঁকে বললেন, আপনি কাঁদছেন কেন? আপনি জানেন না, আল্লাহর কাছে যা আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্য তাই শ্রেয়? তিনি বললেন, আমি এজন্য কাঁদছি না যে, আল্লাহর কাছে যা আছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্য যে তাই শ্রেয়—তা আমার জানা নেই। বরং আমি কাঁদছি এজন্য যে, আসমান থেকে ওহী নাযিলের ধারা ছিন্ন হয়ে গেল। তিনি এ কথা বলে তাঁদেরও কান্না উথলে দিলেন। সুতরাং তাঁরাও তাঁর সঙ্গে কাঁদতে লাগলেন -মুসলিম।
সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ২৪৫৪; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীছ নং ১৬৩৫; মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, হাদীছ নং ৩৭০২৭; মুসনাদে আবূ ইয়ালা, হাদীছ নং ৬৯, বায়হাকী, আস্ সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ১৩৫৩৬
হাদীছ নং : ৩৬০
হযরত আনাস রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওফাতের পর হযরত আবূ বকর রাযি. উমর রাযি.কে বললেন, চলুন আমরা উম্মু আয়মানের সঙ্গে সাক্ষাত করতে যাই, যেমন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সঙ্গে সাক্ষাত করতেন। যখন তাঁরা তাঁর কাছে পৌঁছলেন, তিনি কেঁদে দিলেন। তাঁরা তাঁকে বললেন, আপনি কাঁদছেন কেন? আপনি জানেন না, আল্লাহর কাছে যা আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্য তাই শ্রেয়? তিনি বললেন, আমি এজন্য কাঁদছি না যে, আল্লাহর কাছে যা আছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্য যে তাই শ্রেয়—তা আমার জানা নেই। বরং আমি কাঁদছি এজন্য যে, আসমান থেকে ওহী নাযিলের ধারা ছিন্ন হয়ে গেল। তিনি এ কথা বলে তাঁদেরও কান্না উথলে দিলেন। সুতরাং তাঁরাও তাঁর সঙ্গে কাঁদতে লাগলেন -মুসলিম।
সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ২৪৫৪; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীছ নং ১৬৩৫; মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, হাদীছ নং ৩৭০২৭; মুসনাদে আবূ ইয়ালা, হাদীছ নং ৬৯, বায়হাকী, আস্ সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ১৩৫৩৬
45 - باب زيارة أهل الخير ومجالستهم وصحبتهم ومحبتهم وطلب زيارتهم والدعاء منهم وزيارة المواضع الفاضلة
قَالَ الله تَعَالَى: {وَإِذْ قَالَ مُوسَى لِفَتَاهُ لا أَبْرَحُ حَتَّى أَبْلُغَ مَجْمَعَ الْبَحْرَيْنِ أَوْ أَمْضِيَ حُقُبًا} إِلَى قوله تَعَالَى: {قَالَ لَهُ مُوسَى هَلْ أَتَّبِعُكَ عَلَى أَنْ تُعَلِّمَنِ مِمَّا عُلِّمْتَ رُشْدًا} [الكهف: 60 - 66]، وَقالَ تَعَالَى: {وَاصْبِرْ نَفْسَكَ مَعَ الَّذِينَ يَدْعُونَ رَبَّهُمْ بِالْغَدَاةِ وَالْعَشِيِّ يُرِيدُونَ وَجْهَهُ} [الكهف: 28].
قَالَ الله تَعَالَى: {وَإِذْ قَالَ مُوسَى لِفَتَاهُ لا أَبْرَحُ حَتَّى أَبْلُغَ مَجْمَعَ الْبَحْرَيْنِ أَوْ أَمْضِيَ حُقُبًا} إِلَى قوله تَعَالَى: {قَالَ لَهُ مُوسَى هَلْ أَتَّبِعُكَ عَلَى أَنْ تُعَلِّمَنِ مِمَّا عُلِّمْتَ رُشْدًا} [الكهف: 60 - 66]، وَقالَ تَعَالَى: {وَاصْبِرْ نَفْسَكَ مَعَ الَّذِينَ يَدْعُونَ رَبَّهُمْ بِالْغَدَاةِ وَالْعَشِيِّ يُرِيدُونَ وَجْهَهُ} [الكهف: 28].
360 - وعن أنس - رضي الله عنه - قَالَ: قَالَ أَبُو بكر لِعُمَرَ رضي الله عنهما بَعْدَ وَفَاةِ رسولِ الله - صلى الله عليه وسلم: انْطَلِقْ بِنَا إِلَى أُمِّ أَيْمَنَ - رضي الله عنها - نَزُورُهَا كَمَا كَانَ رَسُول الله - صلى الله عليه وسلم - يَزُورُهَا، فَلَمَّا انْتَهَيَا إِلَيْهَا، بَكَتْ، فَقَالاَ لَهَا: مَا يُبْكِيكِ؟ أمَا تَعْلَمِينَ أَنَّ مَا عِنْدَ اللهِ خَيْرٌ لرَسُولِ الله - صلى الله عليه وسلم؟ فَقَالَتْ: مَا أبْكِي أَنْ لاَ أَكُونَ أَعْلَم أنَّ مَا عِنْدَ الله تَعَالَى خَيْرٌ لرسول الله - صلى الله عليه وسلم - ولَكِنْ أَبكي أَنَّ الوَحْيَ قدِ انْقَطَعَ مِنَ السَّماءِ، فَهَيَّجَتْهُمَا عَلَى البُكَاءِ، فَجَعَلاَ يَبْكِيَانِ مَعَهَا. رواه مسلم. (1)
হাদীসের ব্যাখ্যা:
দীনদার ও বুযুর্গ ব্যক্তিদের যিয়ারত-সাক্ষাতে যাওয়ার গুরুত্ব সম্পর্কে এটি অত্যন্ত শিক্ষণীয় এক হাদীছ। যিয়ারত ও সাক্ষাতের কতটা গুরুত্ব থাকলে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইন্তিকালের পর হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি. ও হযরত উমর ফারূক রাযি.-এর মত এ উম্মতের শ্রেষ্ঠতম দুই ব্যক্তি হযরত উম্মু আয়মান রাযি.-এর সঙ্গে সাক্ষাত করতে যেতে পারেন তা সহজেই বোধগম্য। তাঁদেরকে দেখেই হযরত উম্মু আয়মান রাযি. কেঁদে উঠলেন। তাঁদের ধারণা ছিল এ কান্নার কারণ মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মহাপ্রয়াণ ও তাঁর বিরহবেদনা। তাই তাঁরা এই বলে তাঁকে সান্ত্বনা দিতে চাইলেন যে- (আপনি জানেন না, আল্লাহর কাছে যা আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্য তাই শ্রেয়?)। নিঃসন্দেহে যে-কোনও মুমিনের জন্যই দুনিয়ার চেয়ে আখেরাত শ্রেষ্ঠ। দুনিয়ার বিভিন্ন আকর্ষণীয় বস্তুসামগ্রীর উল্লেখ করার পর কুরআন মাজীদে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
قُلْ أَؤُنَبِّئُكُمْ بِخَيْرٍ مِنْ ذَلِكُمْ لِلَّذِينَ اتَّقَوْا عِنْدَ رَبِّهِمْ جَنَّاتٌ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا وَأَزْوَاجٌ مُطَهَّرَةٌ وَرِضْوَانٌ مِنَ اللَّهِ وَاللَّهُ بَصِيرٌ بِالْعِبَادِ
‘বল, আমি কি তোমাদেরকে এসব অপেক্ষা উৎকৃষ্ট জিনিসের সংবাদ দেব? যারা তাকওয়া অবলম্বন করে, তাদের জন্য তাদের প্রতিপালকের কাছে আছে এমন বাগ-বাগিচা, যার তলদেশে নহর প্রবাহিত, যেখানে তারা সর্বদা থাকবে এবং (তাদের জন্য আছে) পবিত্র স্ত্রী ও আল্লাহর পক্ষ হতে সন্তুষ্টি। আল্লাহ সকল বান্দাকে ভালোভাবে দেখছেন ।২৩০
জান্নাতের স্থায়ী, অফুরন্ত, অতুলনীয় নিআমতরাজির সামনে দুনিয়ার বস্তুসামগ্রী নিতান্তই তুচ্ছ। কাজেই প্রত্যেক মুমিনের জন্য আল্লাহর কাছে রক্ষিত সেই নিআমতসমূহ ইহজীবনের সবকিছু অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ বৈকি। তাহলে নবী-রাসূলদের জন্য আখেরাতে কেমন ব্যবস্থা রাখা হয়েছে? তাদের মধ্যে আবার সায়্যিদুল আম্বিয়া ওয়াল মুরসালীন হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মহামর্যাদা অনুপাতে যে মহা আয়োজনের সমারোহ থাকবে, সে হিসেবে এ দুনিয়া তাঁর পক্ষে সিন্ধুর মধ্যে বিন্দু অপেক্ষাও তুচ্ছ নয় কি? তাই তো ওফাতের আগে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দুনিয়া ও আখেরাতের মধ্যে কোনও একটা বেছে নেওয়ার এখতিয়ার দেওয়া হলে তিনি সানন্দে আখেরাতকে বেছে নেন। ওফাতকালে বার বার এই বলে মহান বন্ধু মহাপ্রভুর সন্নিধানে যাত্রার ব্যকুলতা ব্যক্ত করছিলেন যে, 'হে আল্লাহ! হে মহান বন্ধু!" ।
হযরত উম্মু আয়মান রাযি.-এর চিন্তার গভীরতা
হযরত উম্মু আয়মান রাযি.-এরও ঢের জানা ছিল যে, আল্লাহ তাআলার কাছে তাঁর প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্য যা সংরক্ষিত আছে তা ইহজীবনের সবকিছু অপেক্ষা অনেক অনেক শ্রেয়। তাই তিনি কান্নার যে কারণ তারা উল্লেখ করেছেন তা নাকচ করে দেন। তাহলে কেন তিনি কাঁদছিলেন? তিনি তার কারণ ব্যাখ্যা করেন-
ولكِنِّي أَبْكِي أَنَّ الوَحْيَ قَدِ انْقَطَعَ مِنَ السَّماءِ
(বরং আমি কাঁদছি এজন্য যে, আসমান থেকে ওহী নাযিলের ধারা ছিন্ন হয়ে গেল)। এ সংক্ষিপ্ত কথাটি দ্বারা ওহীর মর্ম ও ঐশ্বর্য, তার কল্যাণ ও বরকত, তার আলোকময়তা ও শক্তি-ক্ষমতা এবং তার প্রভাব ও মাধুর্য সম্পর্কে হযরত উম্মু আয়মান রাযি.-এর গভীর উপলব্ধির পরিচয় মেলে। তাঁর এ অভিব্যক্তি মহান সিদ্দীক ও ফারূকের অন্তর্দেশে ভাবাবেগের কলরোল তুলল। ভূবন উদ্ভাসী ওহীর ধারাবিচ্ছেদ-বেদনার যে শোক তাঁরা এতদিন পাথরচাপা দিয়ে রেখেছিলেন, সহসাই তা উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল। তাঁরাও তাঁর সঙ্গে কাঁদতে থাকলেন।
প্রকাশ থাকে যে, যদিও দীনের পরিপূর্ণতার জন্য যে পরিমাণ ওহী নাযিলের প্রয়োজন ছিল তা নাযিল করা হয়ে গেছে, দীনের পরিপূর্ণতা ঘোষণা করে দেওয়া হয়েছে, ফলে দীনের চাহিদা ও জরুরত পূরণের জন্য আর কোনও ওহী নাযিলের প্রয়োজন নেই, তবুও এতে তো কোনও সন্দেহ নেই যে, ওহী শুধু কল্যাণই কল্যাণ, জ্ঞানই জ্ঞান ও বরকতই বরকত। এর মাধুর্য ও স্নিগ্ধতা প্রকৃত মুমিনের প্রাণের খোরাক। মুমিনদের এ খোরাকের চাহিদা অফুরন্ত। ঠিক ধনাসক্ত ব্যক্তির ধনসম্পদের চাহিদার মত। এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
منهُوْمَانِ لا يَشْبعَانِ : مَنْهُومٌ فِي الْعِلْم لا يَشبَعُ مِنْهُ، وَمَنْهُومٌ فِي الدُّنْيَا لَا يَشْبَعُ مِنْهَا
‘দুই ক্ষুধার্ত কখনও পরিতৃপ্ত হয় না। এক হলো ইলমের ক্ষুধার্ত, (যতই ইলম অর্জন হোক) তাতে তার পরিতৃপ্তি আসে না। আরেক হলো দুনিয়ার অর্থ-সম্পদে আসত ব্যক্তি, তারও তাতে কখনও পরিতৃপ্তি লাভ হয় না।’২৩১
তবে সংক্ষিপ্ত ও সীমিত ইহজগতের সবকিছুই সীমিত ও পরিমিত। এ জগতে জাহিরী ও বাতিনী, প্রকাশ্য ও গুপ্ত, মূর্ত ও বিমূর্ত এবং ব্যবহারিক ও তাত্ত্বিক সবকিছুই সীমিত। আকারে দেওয়া হয়েছে। সবকিছু সীমিত রাখাই এ জগতের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। এ জগতে তাতেই কল্যাণ। সে নিয়মের অধীনেই ওহী নাযিলের ধারাও সীমিতই রাখা হয়েছে। একপর্যায়ে সে ধারা তার শেষ সীমায় পৌঁছে গেছে। আর অমনি সর্বশেষ যাঁর প্রতি ওহী নাযিল হচ্ছিল, সেই মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকেও দুনিয়া থেকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে । আর কোনও নবীও আসবে না, নতুন কোনও ওহীও নাযিল হবে না।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
এ হাদীছে অনেক মূল্যবান শিক্ষা আছে। তার মধ্যে কয়েকটি এখানে উল্লেখ করা গেল-
ক. দীনদার ও নেককার ব্যক্তিদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাত করতে যাওয়া চাই।
খ. নিজ মুরুব্বী ও শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি জীবিতকালে যাদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাত করত, তার মৃত্যুর পর তাদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাত অব্যাহত রাখা বাঞ্ছনীয়।
গ. কোনও বুযুর্গ ব্যক্তির সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার সময় কোনও প্রিয়জনকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়া ভালো।
ঘ. প্রিয় ব্যক্তি ও প্রিয় বস্তুর বিরহ-বিচ্ছেদে শোকার্ত হওয়া ও কান্না করা দোষের নয়; বরং এটা ব্যক্তির গুণগ্রাহিতা ও সংবেদনশীলতার পরিচায়ক।
ঙ. খাঁটি মানুষেরা সামাজিক অবস্থা ও অবস্থানগত দিক থেকে নিজেদের তুলনায় নিম্নস্তরের লোকের সঙ্গেও সাক্ষাত করতে কুণ্ঠাবোধ করে না।
২৩০, সূরা আলে ইমরান (৩), আয়াত ১৫
২৩১. শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ৯৭৯৮; মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, হাদীছ নং ২৬১১৮; সুনানে দারিমী, হাদীছ নং ৩৪৩; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর, হাদীছ নং ১০৩৮৮
قُلْ أَؤُنَبِّئُكُمْ بِخَيْرٍ مِنْ ذَلِكُمْ لِلَّذِينَ اتَّقَوْا عِنْدَ رَبِّهِمْ جَنَّاتٌ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا وَأَزْوَاجٌ مُطَهَّرَةٌ وَرِضْوَانٌ مِنَ اللَّهِ وَاللَّهُ بَصِيرٌ بِالْعِبَادِ
‘বল, আমি কি তোমাদেরকে এসব অপেক্ষা উৎকৃষ্ট জিনিসের সংবাদ দেব? যারা তাকওয়া অবলম্বন করে, তাদের জন্য তাদের প্রতিপালকের কাছে আছে এমন বাগ-বাগিচা, যার তলদেশে নহর প্রবাহিত, যেখানে তারা সর্বদা থাকবে এবং (তাদের জন্য আছে) পবিত্র স্ত্রী ও আল্লাহর পক্ষ হতে সন্তুষ্টি। আল্লাহ সকল বান্দাকে ভালোভাবে দেখছেন ।২৩০
জান্নাতের স্থায়ী, অফুরন্ত, অতুলনীয় নিআমতরাজির সামনে দুনিয়ার বস্তুসামগ্রী নিতান্তই তুচ্ছ। কাজেই প্রত্যেক মুমিনের জন্য আল্লাহর কাছে রক্ষিত সেই নিআমতসমূহ ইহজীবনের সবকিছু অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ বৈকি। তাহলে নবী-রাসূলদের জন্য আখেরাতে কেমন ব্যবস্থা রাখা হয়েছে? তাদের মধ্যে আবার সায়্যিদুল আম্বিয়া ওয়াল মুরসালীন হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মহামর্যাদা অনুপাতে যে মহা আয়োজনের সমারোহ থাকবে, সে হিসেবে এ দুনিয়া তাঁর পক্ষে সিন্ধুর মধ্যে বিন্দু অপেক্ষাও তুচ্ছ নয় কি? তাই তো ওফাতের আগে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দুনিয়া ও আখেরাতের মধ্যে কোনও একটা বেছে নেওয়ার এখতিয়ার দেওয়া হলে তিনি সানন্দে আখেরাতকে বেছে নেন। ওফাতকালে বার বার এই বলে মহান বন্ধু মহাপ্রভুর সন্নিধানে যাত্রার ব্যকুলতা ব্যক্ত করছিলেন যে, 'হে আল্লাহ! হে মহান বন্ধু!" ।
হযরত উম্মু আয়মান রাযি.-এর চিন্তার গভীরতা
হযরত উম্মু আয়মান রাযি.-এরও ঢের জানা ছিল যে, আল্লাহ তাআলার কাছে তাঁর প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্য যা সংরক্ষিত আছে তা ইহজীবনের সবকিছু অপেক্ষা অনেক অনেক শ্রেয়। তাই তিনি কান্নার যে কারণ তারা উল্লেখ করেছেন তা নাকচ করে দেন। তাহলে কেন তিনি কাঁদছিলেন? তিনি তার কারণ ব্যাখ্যা করেন-
ولكِنِّي أَبْكِي أَنَّ الوَحْيَ قَدِ انْقَطَعَ مِنَ السَّماءِ
(বরং আমি কাঁদছি এজন্য যে, আসমান থেকে ওহী নাযিলের ধারা ছিন্ন হয়ে গেল)। এ সংক্ষিপ্ত কথাটি দ্বারা ওহীর মর্ম ও ঐশ্বর্য, তার কল্যাণ ও বরকত, তার আলোকময়তা ও শক্তি-ক্ষমতা এবং তার প্রভাব ও মাধুর্য সম্পর্কে হযরত উম্মু আয়মান রাযি.-এর গভীর উপলব্ধির পরিচয় মেলে। তাঁর এ অভিব্যক্তি মহান সিদ্দীক ও ফারূকের অন্তর্দেশে ভাবাবেগের কলরোল তুলল। ভূবন উদ্ভাসী ওহীর ধারাবিচ্ছেদ-বেদনার যে শোক তাঁরা এতদিন পাথরচাপা দিয়ে রেখেছিলেন, সহসাই তা উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল। তাঁরাও তাঁর সঙ্গে কাঁদতে থাকলেন।
প্রকাশ থাকে যে, যদিও দীনের পরিপূর্ণতার জন্য যে পরিমাণ ওহী নাযিলের প্রয়োজন ছিল তা নাযিল করা হয়ে গেছে, দীনের পরিপূর্ণতা ঘোষণা করে দেওয়া হয়েছে, ফলে দীনের চাহিদা ও জরুরত পূরণের জন্য আর কোনও ওহী নাযিলের প্রয়োজন নেই, তবুও এতে তো কোনও সন্দেহ নেই যে, ওহী শুধু কল্যাণই কল্যাণ, জ্ঞানই জ্ঞান ও বরকতই বরকত। এর মাধুর্য ও স্নিগ্ধতা প্রকৃত মুমিনের প্রাণের খোরাক। মুমিনদের এ খোরাকের চাহিদা অফুরন্ত। ঠিক ধনাসক্ত ব্যক্তির ধনসম্পদের চাহিদার মত। এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
منهُوْمَانِ لا يَشْبعَانِ : مَنْهُومٌ فِي الْعِلْم لا يَشبَعُ مِنْهُ، وَمَنْهُومٌ فِي الدُّنْيَا لَا يَشْبَعُ مِنْهَا
‘দুই ক্ষুধার্ত কখনও পরিতৃপ্ত হয় না। এক হলো ইলমের ক্ষুধার্ত, (যতই ইলম অর্জন হোক) তাতে তার পরিতৃপ্তি আসে না। আরেক হলো দুনিয়ার অর্থ-সম্পদে আসত ব্যক্তি, তারও তাতে কখনও পরিতৃপ্তি লাভ হয় না।’২৩১
তবে সংক্ষিপ্ত ও সীমিত ইহজগতের সবকিছুই সীমিত ও পরিমিত। এ জগতে জাহিরী ও বাতিনী, প্রকাশ্য ও গুপ্ত, মূর্ত ও বিমূর্ত এবং ব্যবহারিক ও তাত্ত্বিক সবকিছুই সীমিত। আকারে দেওয়া হয়েছে। সবকিছু সীমিত রাখাই এ জগতের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। এ জগতে তাতেই কল্যাণ। সে নিয়মের অধীনেই ওহী নাযিলের ধারাও সীমিতই রাখা হয়েছে। একপর্যায়ে সে ধারা তার শেষ সীমায় পৌঁছে গেছে। আর অমনি সর্বশেষ যাঁর প্রতি ওহী নাযিল হচ্ছিল, সেই মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকেও দুনিয়া থেকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে । আর কোনও নবীও আসবে না, নতুন কোনও ওহীও নাযিল হবে না।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
এ হাদীছে অনেক মূল্যবান শিক্ষা আছে। তার মধ্যে কয়েকটি এখানে উল্লেখ করা গেল-
ক. দীনদার ও নেককার ব্যক্তিদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাত করতে যাওয়া চাই।
খ. নিজ মুরুব্বী ও শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি জীবিতকালে যাদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাত করত, তার মৃত্যুর পর তাদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাত অব্যাহত রাখা বাঞ্ছনীয়।
গ. কোনও বুযুর্গ ব্যক্তির সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার সময় কোনও প্রিয়জনকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়া ভালো।
ঘ. প্রিয় ব্যক্তি ও প্রিয় বস্তুর বিরহ-বিচ্ছেদে শোকার্ত হওয়া ও কান্না করা দোষের নয়; বরং এটা ব্যক্তির গুণগ্রাহিতা ও সংবেদনশীলতার পরিচায়ক।
ঙ. খাঁটি মানুষেরা সামাজিক অবস্থা ও অবস্থানগত দিক থেকে নিজেদের তুলনায় নিম্নস্তরের লোকের সঙ্গেও সাক্ষাত করতে কুণ্ঠাবোধ করে না।
২৩০, সূরা আলে ইমরান (৩), আয়াত ১৫
২৩১. শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ৯৭৯৮; মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, হাদীছ নং ২৬১১৮; সুনানে দারিমী, হাদীছ নং ৩৪৩; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর, হাদীছ নং ১০৩৮৮
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)


বর্ণনাকারী: