রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ

ভূমিকা অধ্যায়

হাদীস নং: ৩৩০
পিতা-মাতার প্রতি সদ্ব্যবহার ও আত্মীয়তা রক্ষা করা
আত্মীয় অমুসলিম হলেও আত্মীয়তার হক সম্পূর্ণ ছিন্ন হয় না
হাদীছ নং : ৩৩০

হযরত আমর ইবনুল আস রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে উচ্চ আওয়াজে বলতে শুনেছি, চুপিসারে নয় - অমুক গোত্রের লোকজন আমার বন্ধু নয়। আমার বন্ধু তো আল্লাহ ও সৎকর্মশীল মুমিনগণ। অবশ্য তাদের সঙ্গে আত্মীয়তা আছে, যার আর্দ্রতা দ্বারা তাদেরকে সিঞ্চিত করব -বুখারী ও মুসলিম।
সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৫৯৯; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ২১৫; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ১৭৮০৪; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ, হাদীছ নং ৩৪৪১
40 - باب بر الوالدين وصلة الأرحام
330 - وعن أَبي عبد الله عمرو بن العاص رضي الله عنهما، قَالَ: سمعت رَسُول الله - صلى الله عليه وسلم - جِهَارًا غَيْرَ سِرٍّ، يَقُولُ: «إنَّ آل بَني فُلاَن لَيْسُوا بِأولِيَائِي، إِنَّمَا وَلِيِّيَ اللهُ وَصَالِحُ المُؤْمِنينَ، وَلَكِنْ لَهُمْ رَحِمٌ أبُلُّهَا بِبلاَلِهَا». مُتَّفَقٌ عَلَيهِ، (1) واللفظ للبخاري.

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোনও এক গোত্র সম্পর্কে বলেছেন যে, তারা আমার বন্ধু নয়। হাদীছটির বর্ণনাকারী সে গোত্রটির নাম উল্লেখ করেননি। উল্লেখ না করার কারণ সম্ভবত এই যে, তিনি চিন্তা করেছেন তারা তা শুনলে কষ্ট পাবে। ইমাম নববী রহ. বলেন, কোনও এক বর্ণনাকারী সে গোত্রটির নাম উল্লেখ না করে যে ইশারা করেছেন, তার কারণ তিনি আশঙ্কা করেছিলেন স্পষ্টভাবে নাম উল্লেখ করলে কোনও অনর্থ ঘটতে পারে। তাতে বর্ণনাকারীর নিজের কোনও বিপদ হতে পারে বা অন্য কারও অনিষ্ট হতে পারে।

কাযী ইয়ায রহ.-এর মতে এর দ্বারা হাকাম ইবন আবুল আসের দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। কেউ কেউ এটিকে বনূ উমাইয়ার প্রতি প্রয়োগ করেছেন।

ইমাম আবূ বকর ইবনুল আরাবী রহ. তার ‘সিরাজুল মুরীদীন' গ্রন্থে বলেন, হযরত আমর ইবনুল আস রাযি. বর্ণিত হাদীছটির মূল কথা ছিল-
ان ال ابي طالب (আবূ তালিবের বংশধরগণ)। আবূ নু'আইম রহ.-এর ‘মুস্তাখরাজ’ গ্রন্থে সুস্পষ্টভাবেই সনদসহকারে আছে- إِنَّ لِبَنِي ابي طالب رَحِمًا أَبُلُّهَا بِبَلَالِهَا (আবূ তালিবের পুত্রদের সঙ্গে আছে আত্মীয়তা, যা আমি তার আর্দ্রতা দ্বারা সিক্ত করব)। যারা এ নাম স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা থেকে বিরত থেকেছেন, তারা সম্ভবত মনে করেছেন তা দ্বারা আবূ তালিবের বংশধরদের অমর্যাদা হয়। কিন্তু বিষয়টি তা নয়।

ইঙ্গিতকৃত গোত্রটি সম্পর্কে বলা হয়েছে- ليسوا باوليائي (তারা আমার বন্ধু নয়)। اولياء শব্দটি ولي -এর বহুবচন। এর উৎপত্তি ولاية থেকে। এর অর্থ নৈকট্য, ঘনিষ্ঠতা, অভিভাবকত্ব, বন্ধুত্ব ইত্যাদি। ইমাম খাত্তাবী রহ. বলেন, এ হাদীছে যে ولاية অস্বীকার করা হয়েছে, তা দ্বারা নৈকট্য ও বিশেষ সম্পর্কের বন্ধুত্ব বোঝানো উদ্দেশ্য, দীনী বন্ধুত্ব নয়। কেননা আবূ তালিবের সন্তানদের মধ্যে আলী রাযি. ও জা'ফর রাযি.-ও রয়েছেন। তাঁরা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অন্যতম বিশিষ্ট ব্যক্তি। তাঁরা শুরুদিকেই ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন এবং ইসলামের সাহায্য-সহযোগিতা করার ক্ষেত্রে তারা ছিলেন অগ্রগামী ।

এ হাদীছ দ্বারা আবূ তালিবের বংশধরদের মধ্যে যারা মুমিন ছিলেন তাদের অমর্যাদা হয় না। কেননা এর দ্বারা সমষ্টির বন্ধুত্ব অস্বীকার করা হয়েছে, বিশেষ বিশেষ ব্যক্তি তার আওতাভুক্ত নাও হতে পারে।

এটাও অসম্ভব নয় যে, আবু তালিবের ال (বংশ) দ্বারা স্বয়ং আবূ তালিবকেই বোঝানো হয়েছে। আরবী ভাষায় এভাবে ال শব্দের বহুল ব্যবহার আছে। যেমন এক হাদীছে হযরত আবূ মূসা আশ'আরী রাযি. সম্পর্কে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-

لَقَدْ أُوتِيَ مِزْمَارًا مِنْ مَزَامِيْرِ آلِ دَاوُدَ عَلَيْهِ السَّلَامُ

‘তাকে দাউদ আলাইহিস সালামের বংশের সুরের মত সুর দেওয়া হয়েছে।১০৫ এর দ্বারা স্বয়ং দাউদ আলাইহিস সালামেরই সুর বোঝানো উদ্দেশ্য ।

কুরায়শ গোত্রের আরও বহু লোক ইসলামগ্রহণ না করা সত্ত্বেও কেবল আবু তালিবকে ‘আমার বন্ধুজন নয়’ বলার কারণ হলো তিনি ছিলেন তাঁর চাচা, পিতার সহোদর, ছিলেন তাঁর অভিভাবক এবং সাহায্য-সহযোগিতাকারী। ফলে তার ব্যাপারে ঈমান আনার আশা স্বাভাবিকভাবেই অন্যদের তুলনায় বেশি থাকার কথা। কিন্তু সে আশাবাদ ব্যর্থ করে দিয়ে তিনি ঈমান আনা হতে বিরত থেকেছেন। নিঃসন্দেহে এটা অত্যন্ত বেদনাদায়ক। তাই তার সঙ্গে বন্ধুত্ব অস্বীকার করা হয়েছে। আর ইসলামে তো বন্ধুত্ব হয়ই দীনের ভিত্তিতে। পুত্রও যদি পিতার দীন কবুল না করে, ত সে পরিবারভুক্ত থাকে না। এ কারণেই দেখা যায় হযরত নূহ আলাইহিস সালামের পুত্র তাঁর প্রতি ঈমান না আনায় আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেছেন- إِنَّهُ لَيْسَ مِنْ أَهْلِكَ (হে নূহ! সে তোমার পরিবারভুক্ত নয়)

তাহলে কারা তাঁর বন্ধুজন? নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন- إنما ولي الله وصالح المؤمنين (আমার বন্ধু তো আল্লাহ ও সৎকর্মশীল মুমিনগণ)। অর্থাৎ আমার বন্ধু সৎকর্মশীল মুমিনগণ, যদিও তারা বংশীয় সম্পর্ক হিসেবে আমার থেকে অনেক দূরের হয়। পক্ষান্তরে বংশসূত্রে যারা আমার অনেক কাছের তারা আমার বন্ধু সাব্যস্ত হবে না, যদি না তারা সৎকর্মশীল ও ঈমানদার হয়। কুরআন মাজীদেও ইরশাদ হয়েছে-
وَإِنْ تَظَاهَرَا عَلَيْهِ فَإِنَّ اللَّهَ هُوَ مَوْلَاهُ وَجِبْرِيلُ وَصَالِحُ الْمُؤْمِنِينَ
কিন্তু তোমরা যদি নবীর বিরুদ্ধে একে অপরকে সাহায্য কর, তবে (জেনে রেখ) তার সঙ্গী আল্লাহ, জিবরাঈল ও সৎকর্মশীল মুমিনগণ'।১০৭ প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাদীছটিতে এ আয়াতের বক্তব্যেরই প্রতিধ্বনি করেছেন। তিনি যেন বলছেন, আমি কেবল আত্মীয়তার সুবাদে কাউকে ভালোবাসি না। আমি ভালোবাসি কেবল আল্লাহ ও নেককার মুমিনদেরকে। আল্লাহ তাআলাকে ভালোবাসি এ কারণে যে, ভালোবাসা তার প্রাপ্য। এটা বান্দাদের উপর তাঁর হক। আর নেককার মুমিনদেরকে ভালোবাসি আল্লাহ তাআলার জন্য, যেহেতু তারা আল্লাহরই জন্য ঈমান এনেছে এবং তারই জন্য নেক আমল করে। মোটকথা মাখলুকের সঙ্গে আমার ভালোবাসার সূত্র কেবলই ঈমান ও আমলে সালিহ, আত্মীয়তা থাকুক বা না-ই থাকুক। এক হাদীছে তিনি ইরশাদ করেন-

وَإِنَّ أَوْلَى النَّاسِ بِي الْمُتَّقُوْنَ، مَنْ كَانُوا حَيْثُ كَانُوا

‘আমার সর্বাপেক্ষা বেশি প্রিয় মানুষ মুত্তাকীগণ, তা যারাই হোক এবং যেখানেই থাকুক।১০৮ বলাবাহুল্য মুত্তাকী তো সৎকর্মশীল মুমিনগণই।

ইমাম কুরতুবী রহ. বলেন, হাদীছটির মর্মকথা হলো মুসলিম ও কাফেরের মধ্যে দীনী বন্ধুত্ব হতে পারে না, যদিও নিকটাত্মীয় হয়।

অবশ্য এক হচ্ছে ভালোবাসা, আরেক হচ্ছে হক ও অধিকার। কারও সঙ্গে যদি আত্মীয়তা থাকে কিন্তু সে মুমিন না হয়, তবে ঈমান না থাকায় সে ভালোবাসা পাবে না বটে, কিন্তু তাই বলে আত্মীয়তার অধিকার থেকে তাকে বঞ্চিত করা যাবে না। সে কথাই নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ হাদীছের শেষাংশে স্পষ্ট করেছেন। তিনি বলেন-
ولكن لهم رَحِمً أَبُلُّهَا بِبَلَالِهَا (অবশ্য তাদের সঙ্গে আত্মীয়তা আছে, যার আর্দ্রতা দ্বারা তাদেরকে সিঞ্চিত করব)। অর্থাৎ আত্মীয় হিসেবে তাদের যে অধিকার আমার উপর রয়েছে আমি তা আদায় করব। আমি তাদের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করব, তাদের বিপদাপদে সাহায্য করব ও তাদের খোঁজখবর রাখব।

ইমাম তীবী রহ. বলেন, হাদীছে আত্মীয়তাকে ওই জমির সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে, যাতে যথাযথভাবে পানির সেচ দেওয়া হলে তা ফল ও ফসলে ভরে ওঠে। আর যদি সেচ দেওয়া না হয় তবে শুকিয়ে যায়, কোনও ফল-ফসল জন্মায় না। আত্মীয়তার বিষয়টাও এরকমই। আত্মীয়তার হক আদায় করলে পরস্পর হৃদ্যতা জন্মায় ও ভালোবাসা সৃষ্টি হয় । আর হক আদায় না করলে জন্মায় বিদ্বেষ ও শত্রুতা।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. প্রকৃত ভালোবাসা কেবল নেককার মুমিনদের সঙ্গেই হতে পারে।

খ. যাদের সঙ্গে আত্মীয়তা আছে তারা নেককার ও ঈমানদার না হলে তাদের ভালোবাসা যাবে না বটে, তবে তাদের আত্মীয়তার হক অবশ্যই আদায় করতে হবে।

১০৫. সুনানে নাসাঈ, হাদীছ নং ১০১৯; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ২৩০৩৩; মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বাহ, হাদীছ নং ২৯৯৩৮; মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক, হাদীছ নং ৪১৭৮; সুনানে দারিমী, হাদীছ নং ২৩০৩৩; বায়হাকী, শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ১৯৬২; তাবারানী, আল মু'জামুল আওসাত, হাদীছ নং ২৬৭৯

১০৬. সূরা হূদ (১১), আয়াত ৪৬

১০৭. সূরা তাহ্রীম (৬৬), আয়াত ৪

১০৮. সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ৬৪৭; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ২২০৫২
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:বিশুদ্ধ (পারিভাষিক সহীহ)