রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ

ভূমিকা অধ্যায়

হাদীস নং: ৩২১
পিতা-মাতার প্রতি সদ্ব্যবহার ও আত্মীয়তা রক্ষা করা
হিজরত ও জিহাদের বায়আতপ্রত্যাশীকে পিতা-মাতার সেবায় নিয়োজিত থাকার পরামর্শ দান
হাদীছ নং : ৩২১

হযরত আব্দুল্লাহ ইবন আমর ইবনুল আস রাযি. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, এক ব্যক্তি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে বলল, আমি আল্লাহ তা'আলার কাছে প্রতিদানের আশায় হিজরত ও জিহাদের বায়আত গ্রহণ করতে চাই। তিনি বললেন, তোমার পিতা-মাতার মধ্যে কেউ জীবিত আছে কী? সে বলল, হাঁ, বরং উভয়ই জীবিত। তিনি বললেন, তুমি আল্লাহ তা'আলার কাছে প্রতিদানের আশা কর তো? সে বলল, হাঁ। তিনি বললেন, তবে তুমি তোমার পিতা-মাতার কাছে ফিরে যাও এবং তাদের প্রতি সদাচরণ কর -বুখারী ও মুসলিম।৮০
এটা মুসলিমের বর্ণনা। বুখারী ও মুসলিমের অপর এক বর্ণনায় আছে, জনৈক ব্যক্তি এসে তাঁর কাছে জিহাদে যাওয়ার অনুমতি চাইল। তিনি বললেন, তোমার পিতা-মাতা কি জীবিত? সে বলল, হাঁ। তিনি বললেন, তবে তাদের মধ্যেই (সদাচরণ বজায় রাখার) জিহাদ কর।৮১
৮০. সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ২৫৪৯; তবারানী, আল-মু'জামুল কাবীর, হাদীছ নং ১৫৩; বায়হাকী, আস্-সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ১৭৮২৯; শু'আবুল ঈমান, হাদীছ নং ৭৪৪৩

৮১. সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৩০০৪; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ২৫৪৯; সুনানে নাসাঈ, হাদীছ নং ৩১০৩; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ৬৫৪৪; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীছ নং ৩১৮; বায়হাকী, আস্-সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ১৭৮২৭; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ, হাদীছ নং ২৬৩৮; তবারানী, আল-মু'জামুল আওসাত, হাদীছ নং ৮৯৯৮;
40 - باب بر الوالدين وصلة الأرحام
321 - وعن عبد الله بن عمرو بن العاص رضي الله عنهما، قَالَ: أقبلَ رَجُلٌ إِلَى نَبيِّ الله - صلى الله عليه وسلم - فَقَالَ: أُبَايِعُكَ عَلَى الهِجْرَةِ وَالجِهَادِ أَبْتَغي الأجْرَ مِنَ الله تَعَالَى. قَالَ: «فَهَلْ لَكَ مِنْ [ص:121] وَالِدَيْكَ أحَدٌ حَيٌّ؟» قَالَ: نَعَمْ، بَلْ كِلاهُمَا. قَالَ: «فَتَبْتَغي الأجْرَ مِنَ الله تَعَالَى؟» قَالَ: نَعَمْ. قَالَ: «فارْجِعْ إِلَى وَالِدَيْكَ، فَأحْسِنْ صُحْبَتَهُمَا». مُتَّفَقٌ عَلَيهِ، وهذا لَفْظُ مسلِم. (1)
وفي رواية لَهُمَا: جَاءَ رَجُلٌ فَاسْتَأذَنَهُ في الجِهَادِ، فقَالَ: «أحَيٌّ وَالِداكَ؟»
قَالَ: نَعَمْ، قَالَ: «فَفيهِمَا فَجَاهِدْ».

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীছে হিজরত ও বায়আতের উদ্দেশ্যে আগমনকারী ব্যক্তির নাম উল্লেখ করা হয়নি। কোনও কোনও বর্ণনা দ্বারা জানা যায়, তার নাম জাহিমা ইবন আব্বাস ইবন মিরদাস রাযি. অথবা মুআবিয়া ইবন জাহিমা রাযি.। নাসাঈ ও আহমাদের বর্ণনায় আছে জাহিমা রাযি. নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে আরয করেছিলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি জিহাদে যাওয়ার ইচ্ছা করেছি এবং সেজন্য আপনার পরামর্শ গ্রহণের জন্য এসেছি। এ উভয় বর্ণনা যদি একই ব্যক্তি সম্পর্কে হয়ে থাকে, তবে তার নাম জাহিমা প্রমাণিত হয়। যাহোক নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রথমে জিহাদ ও হিজরত দ্বারা তার উদ্দেশ্য কী তা জানতে চাইলেন। তিনি জানালেন যে, উদ্দেশ্য আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি। তারপর জানতে চাইলেন তার পিতা-মাতা জীবিত কি না। যখন জানালেন যে তার পিতা-মাতা জীবিত, তখন তাকে ফিরিয়ে দিলেন এবং পিতা-মাতার সেবাই নিয়োজিত থাকতে বললেন। কেননা জিহাদ হয়তো তখন তার উপর ওয়াজিব ছিল না, অন্যদিকে পিতা-মাতার হক আদায় করা ওয়াজিব। তাই জিহাদ অপেক্ষা পিতা-মাতার সেবাই নিয়োজিত থাকাই তার কর্তব্য ছিল। আর যদি জিহাদ তখন তার উপর ওয়াজিব হয়েও থাকে, তবুও পিতা-মাতার হক যেহেতু তারচে'ও বেশি গুরুত্বপূর্ণ, তাই নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনের জন্য জিহাদে অংশগ্রহণ থেকে ছুটি দিয়ে দেন।

লক্ষণীয়, ইসলামের প্রতিষ্ঠাকালীন সে সময়ে জিহাদ কতইনা গুরুত্বপূর্ণ ছিল! তখন প্রতিটি যুদ্ধে শত্রুবাহিনী অপেক্ষা মুসলিম মুজাহিদদের অস্ত্র ও জনবল ছিল নিতান্তই নগণ্য। স্বাভাবিকভাবেই তখন মুসলিম বাহিনীর পক্ষে একজন সৈন্যেরও অনেক মূল্য। কিন্তু তা সত্ত্বেও নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই সাহাবীর জন্য জিহাদে যোগদান অপেক্ষা পিতা-মাতার খেদমতে নিয়োজিত থাকাকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। তাঁর দৃষ্টি ও বিবেচনাবোধ ছিল কতইনা প্রশস্ত, নিরপেক্ষ ও নিঃস্বার্থ!

এমনিভাবে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পিতা-মাতার খেদমতে নিয়োজিত থাকার জন্য এ সাহাবীর হিজরতকেও অনুমোদন করেননি। অবশ্য অন্যান্য ঈমান রক্ষা করা কঠিন হয়ে যায়, তবে দীন ও ঈমান রক্ষার স্বার্থে প্রয়োজনে পিতা-মাতা, দলীল-প্রমাণ দ্বারা বোঝা যায়, পিতা-মাতার কাছে থাকা অবস্থায় যদি নিজের দীন ও ছেলে-মেয়ে ও আত্মীয়-স্বজন সকলকে পরিত্যাগ করে হিজরত করাই অবশ্যকর্তব্য হয়ে যায়। মক্কা ত্যাগ করে মদীনায় গমনকারী মুহাজিরগণ তাই করেছিলেন।

দ্বিতীয় বর্ণনায় পিতা-মাতার সেবাই নিয়োজিত থাকাকে 'জিহাদ' শব্দ দ্বারা ব্যক্ত করা হয়েছে। বলা হয়েছে- ففيهما فجاهد ‘তবে তাদের মধ্যেই (সদাচরণ বজায় রাখার) জিহাদ কর'। অর্থাৎ জিহাদ দ্বারা যদি আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি লাভ করাই তোমার উদ্দেশ্য হয়ে থাকে, তবে পিতা-মাতার সেবাই নিয়োজিত থাকার জিহাদ অবলম্বন কর। এটাও জিহাদ ও মুজাহাদাই বটে। এতে নফসের বিরুদ্ধে জিহাদ করা হয়। তাদের প্রয়োজন পূরণে যত্নবান থাকা, তাদের আদেশ-নিষেধ মান্য করা ও তাদের মনোতুষ্টি বজায় রেখে চলা খুব সহজ কাজ নয়। অনেক সময়ই মন এর বিরুদ্ধে উস্কানি দেয়। কখনও মন বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। সে উস্কানি উপেক্ষা করা ও মনের বিদ্রোহ দমন করার জন্য কঠিন সংগ্রামের প্রয়োজন হয়। এমনিতেও মনের বিরুদ্ধে জিহাদ করা অনেক কঠিন কাজ। তাই তো এ জিহাদকে 'জিহাদে আকবার' বলা হয়েছে। কাজেই সসস্ত্র সংগ্রাম দ্বারা যার উদ্দেশ্য কেবলই আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি লাভ করা, তার কিছুতেই পিতা-মাতাকে অসহায় ও অরক্ষিত অবস্থায় রেখে যাওয়া উচিত নয়। তাদের খেদমতের কোনও ব্যবস্থা করা না গেলে জিহাদে না গিয়ে বরং নিজেই সে দায়িত্ব আঞ্জাম দেওয়া চাই। এ দায়িত্ব পালন তার পক্ষে জিহাদরূপে গণ্য হবে এবং এর মাধ্যমে সে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে সক্ষম হবে।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. এ হাদীছ দ্বারা জানা যায় যে, পিতা-মাতার সেবাযত্নে নিয়োজিত থাকা জিহাদে যাওয়ার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

খ. আরও শিক্ষা পাওয়া যায়, নিজ আগ্রহ-উদ্দীপনা ও আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণের নাম দীন নয়; বরং দীন হলো আল্লাহ তাআলা ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদেশ-নিষেধ পালনের নাম।

গ. এ হাদীছের আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হচ্ছে দীনী কাজসমূহেও গুরুত্বের পর্যায়ক্রম বিবেচনায় রাখা চাই। একইসঙ্গে দু'টি গুরুত্বপূর্ণ কাজ সামনে এসে গেলে তখন যেটি বেশি গুরুত্বপূর্ণ, সেটিকেই অগ্রাধিকার দিতে হবে।

ঘ. নেতার কর্তব্য নিজ স্বার্থ-সুবিধার দিকে না তাকিয়ে কর্মী ও সঙ্গীর ব্যক্তিগত ও আনুষাঙ্গিক অবস্থাদি বিবেচনায় রাখা।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:বিশুদ্ধ (পারিভাষিক সহীহ)