রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ

ভূমিকা অধ্যায়

হাদীস নং: ৩২০
পিতা-মাতার প্রতি সদ্ব্যবহার ও আত্মীয়তা রক্ষা করা
নিজের শ্রেষ্ঠ সম্পদ আত্মীয়দের জন্য উৎসর্গ করা
হাদীছ নং : ৩২০

হযরত আনাস রাযি. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, একটি খেজুর বাগানের কারণে হযরত আবূ তালহা রাযি. মদীনায় সর্বাপেক্ষা বেশি সম্পদশালী ছিলেন। তার কাছে তার সর্বাপেক্ষা প্রিয় সম্পদ ছিল বায়রাহা নামক বাগানটি। বাগানটি ছিল মসজিদের সামনেই। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেই বাগানে প্রবেশ করতেন এবং তার (অর্থাৎ বাগানের মধ্যকার একটি কুয়ার) মিষ্টি পানি পান করতেন। হযরত আনাস রাযি. বলেন, যখন এ আয়াত নাযিল হলো-
لَنْ تَنَالُوا الْبِرَّ حَتَّى تُنْفِقُوا مِمَّا تُحِبُّونَ
‘তোমরা কিছুতেই পুণ্যের নাগাল পাবে না, যতক্ষণ না তোমরা তোমাদের প্রিয়বস্তু হতে (আল্লাহর জন্য) ব্যয় করবে', তখন আবূ তালহা রাযি. উঠে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আল্লাহ তাআলা আপনার প্রতি আয়াত নাযিল করেছেন—
لَنْ تَنَالُوا الْبِرَّ حَتَّى تُنْفِقُوا مِمَّا تُحِبُّونَ
আর আমার কাছে আমার সর্বাপেক্ষা প্রিয় সম্পদ হলো বায়রাহা বাগানটি। আমি এটা আল্লাহ তাআলার জন্য সদাকা করে দিলাম। আমি আল্লাহ তাআলার কাছে এর পুণ্য ও প্রতিদান আশা করি। সুতরাং ইয়া রাসূলাল্লাহ! আল্লাহ তাআলার ইচ্ছা অনুযায়ী আপনি এটা যেখানে চান খরচ করুন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, বাহ! এটা তো লাভজনক সম্পদ। এটা তো লাভজনক সম্পদ। তুমি যা বললে আমি তা শুনলাম। আমার মত হচ্ছে, তুমি এটা তোমার নিকটাত্মীয়দের দিয়ে দাও। আবূ তালহা রাযি. বললেন, আমি তাই করব ইয়া রাসূলাল্লাহ। সুতরাং আবূ তালহা রাযি. বাগানটি তার নিকটাত্মীয় ও চাচাতো ভাইদের মধ্যে বণ্টন করে দিলেন - বুখারী ও মুসলিম।
(সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ১৪৬১; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ৯৯৮; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ২৯৯৭; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ১২৪৩৮; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীছ নং ৩৩৪০; নাসাঈ, আস্-সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ১১০০০; বায়হাকী, আস্-সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ১১৯২০ শু‘আবুল ঈমান, হাদীছ নং ৩১৭৬; সুনানে দারিমী, হাদীছ নং ১৬৯৫)
40 - باب بر الوالدين وصلة الأرحام
320 - وعنه، قَالَ: كَانَ أَبُو طَلْحَةَ أكْثَرَ الأنْصَارِ بالمَدينَةِ مَالًا مِنْ نَخل، وَكَانَ أحَبُّ أمْوَاله إِلَيْهِ بَيْرَحاء، وَكَانَتْ مسْتَقْبَلَةَ المَسْجِدِ، وَكَانَ رَسُول الله - صلى الله عليه وسلم - يَدْخُلُهَا، وَيَشْرَبُ مِنْ مَاءٍ فِيهَا طَيِّب، فَلَمَّا نَزَلَتْ هذِهِ الآيةُ: {لَنْ تَنَالُوا الْبِرَّ حَتَّى تُنْفِقُوا مِمَّا تُحِبُّونَ} [آل عمران: 92] قَامَ أَبُو طَلْحَةَ إِلَى رسولِ الله - صلى الله عليه وسلم - فَقَالَ: يَا رَسُول الله، إنَّ الله تبارك وتَعَالَى، يقول: {لَنْ تَنَالُوا الْبِرَّ حَتَّى تُنْفِقُوا مِمَّا تُحِبُّونَ} وَإنَّ أَحَبَّ مَالِي إِلَيَّ بَيْرَحَاءُ، وَإنَّهَا صَدَقَةٌ للهِ تَعَالَى، أرْجُو بِرَّهَا وَذُخْرَهَا عِنْدَ الله تَعَالَى، فَضَعْهَا يَا رَسُول الله، حَيْثُ أرَاكَ الله. فَقَالَ رَسُول الله - صلى الله عليه وسلم: «بَخ! ذلِكَ مَالٌ رَابحٌ، ذلِكَ مَالٌ رَابحٌ! وقَدْ سَمِعْتُ مَا قُلْتَ، وَإنِّي أرَى أَنْ تَجْعَلَهَا في الأقْرَبينَ»، فَقَالَ أَبُو طَلْحَةَ: أفْعَلُ يَا رَسُول الله، فَقَسَّمَهَا أَبُو طَلْحَةَ في أقَارِبِهِ وبَنِي عَمِّهِ. مُتَّفَقٌ عَلَيهِ. (1)
وسبق بيان ألفاظِهِ في باب الإنْفَاقِ مِمَّا يحب.

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীছে মূলত হযরত আবূ তালহা আনসারী রাযি.-এর একটি ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহ তাআলা যখন আয়াত নাযিল করলেন-

لَنْ تَنَالُوا الْبِرَّ حَتَّى تُنْفِقُوا مِمَّا تُحِبُّونَ

“তোমরা কিছুতেই পুণ্যের নাগাল পাবে না, যতক্ষণ না তোমরা তোমাদের প্রিয়বস্তু হতে (আল্লাহর জন্য) ব্যয় করবে', তখন তিনি তাঁর সর্বাপেক্ষা প্রিয় সম্পদ বাইরাহা নামক বাগানটি দান করে দিলেন। আয়াতে বলা হয়েছে প্রিয়বস্তু দান করতে। তিনি সবচে' বেশি প্ৰিয়টা দিয়ে দিলেন। আল্লাহু আকবার! আল্লাহর হুকুম মানার কী উৎকৃষ্টতর নমুনা। এমনই ছিলেন প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাহাবীগণ। এ কেবল তাঁর একার কথা নয়, বহু সাহাবীই এরকম করেছিলেন। হযরত যায়দ ইবন হারিছা রাযি.-এর সবচে' প্রিয় সম্পদ ছিল একটি ঘোড়া। ঘোড়াটির নাম ছিল 'সাবাল'। তিনি ঘোড়াটির কাছে এসে বললেন, হে আল্লাহ! তুমি জান আমার কাছে এ ঘোড়াটির চেয়ে বেশি প্রিয় আর কোনও সম্পদ নেই। এই বলে তিনি ঘোড়াটি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে নিয়ে আসলেন এবং বললেন, এটি আল্লাহর পথে দিয়ে দিলাম। তিনি তাঁর পুত্র উসামা রাযি.-কে বললেন, তুমি এটা নিয়ে নাও। এতে হযরত যায়দ রাযি. যেন কিছুটা মনঃক্ষুণ্ণ হলেন। তা উপলব্ধি করে তিনি তাঁকে এই বলে সান্ত্বনা দিলেন যে, আল্লাহ তাআলা তোমার দান কবুল করেছেন।

হযরত উমর রাযি.-এর খেলাফতকালে যখন পারস্যের রাজধানী মাদাইন বিজিত হল, তখন তিনি হযরত আবূ মূসা আশআরী রাযি.-এর কাছে চিঠি লিখলেন যে, তুমি যুদ্ধবন্দীদের মধ্য থেকে আমার জন্য একটি দাসী ক্রয় কর। তিনি একটি বাঁদী ক্রয় করলেন। খলিফার সেটি খুব পসন্দ হল। পরক্ষণেই তিনি বললেন, আল্লাহ তাআলা বলেছেন- لَنْ تَنَالُوا الْبِرَّ حَتَّى تُنْفِقُوا مِمَّا تُحِبُّونَ সুতরাং আমি একে আযাদ করে দিলাম।

হযরত আব্দুল্লাহ ইবন উমর রাযি.-এর গোলাম নাফে' ছিলেন তাঁর খুবই প্রিয়। একবার হযরত আব্দুল্লাহ ইবন জা'ফর রাযি. তার দাম বলেছিলেন এক হাজার দীনার। তাও তিনি বিক্রি করেননি। পরে তিনি তাকে আযাদ করে দেন। তাঁর স্ত্রী সাফিয়্যা রহ. বলেন, আমার খুব ধারণা তিনি এ আয়াতের দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়েই তা করেছিলেন। পরবর্তীকালে এই নাফে' একজন উচ্চস্তরের মুহাদ্দিছ ও ফকীহ হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন।

এ দানের ক্ষেত্রে হযরত আবূ তালহা আনসারী রাযি. উচ্চমাত্রার আদব ও বিনয়েরও পরিচয় দেন। যেহেতু বাগানটির তিনিই মালিক, তাই চাইলে তিনি নিজ ইচ্ছামত যে-কোনও দীনী খাতে দিয়ে দিতে পারতেন। তা না করে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকেই অনুরোধ করলেন যেন তিনি যেখানে চান তা ব্যয় করেন। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর এ আখলাকের কদর করলেন। তিনি নিজ ক্ষমতা প্রয়োগ না করে বরং তাঁকেই পরামর্শ দিলেন, যেন তাঁর আত্মীয়বর্গের মধ্যে বাগানটি বণ্টন করে দেন। তিনি তাই করলেন।

এ দানের জন্য নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আবূ তালহা রাযি.-কে এই বলে সাধুবাদ জানালেন যে, بخ ، ذلك مال رابح ذلك مال رابح (বাহ! এটা তো লাভজনক সম্পদ। এটা তো লাভজনক সম্পদ)। অর্থাৎ দুনিয়ায়ও এটির অনেক দাম এবং আল্লাহর পথে দান করে তুমি আখেরাতেও অনেক লাভ কুড়ালে। এটি দান না করে নিজের কাছে রেখে দিলে মৃত্যু পর্যন্ত সীমিত কালের লাভ পেতে। কিন্তু আল্লাহর পথে দান করে দিয়ে অনন্ত জীবনের লাভ অর্জন করে নিলে।

অপর এক বর্ণনায় رابح এর স্থলে رايح আছে। সে হিসেবে অর্থ হয় এটির উপকার অর্থাৎ ছাওয়াব তোমারই হাতে ফিরে আসবে। বোঝানো হচ্ছে যে, দান করার দ্বারা প্রকৃতপক্ষে এটি তোমার হাতছাড়া হয়নি। কেননা হাতে থাকলে যেমন তুমি এর ফলফলাদি ভোগ করতে পারতে, তেমনি দান করার দ্বারাও তুমি এর সুফল পেতে থাকবে। আর সেটা তো স্থায়ী সুফল। মান ও পরিমাণে দুনিয়ার উপকার অপেক্ষা তা অনেক অনেক শ্রেষ্ঠ।

উল্লেখ্য, হযরত আবূ তালহা আনসারী রাযি. এ বাগানটি যাদেরকে দিয়েছিলেন, তাদের মধ্যে ছিলেন হযরত কা'ব ইবন উবাঈ রাযি. হযরত হাসসান ইবন ছাবিত রাযি., হযরত শাদ্দাদ ইবন আওস রাযি. হযরত নুবায়ত ইবন জাবির রাযি, প্রমুখ। হযরত হাসান রাযি. তাঁর অংশটি একলক্ষ দিরহামের বিনিময়ে হযরত মুআবিয়া রাযি.-এর কাছে বিক্রি করে দিয়েছিলেন। এর দ্বারা অনুমান করা যায় বাগানটি কত দামী ও কত উন্নত মানের ছিল।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. এর দ্বারা সাহাবায়ে কেরামের অন্তরে আল্লাহর পথে দান-খয়রাত করার কী আগ্রহ উদ্দীপনা ছিল সে সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। আল্লাহ তাআলা আমাদের অন্তরেও তার কিছুটা উত্তাপ লাগিয়ে দিন।

খ. আল্লাহর পথে খরচ করতে নিম্নমানের নয়; বরং উৎকৃষ্ট মানের ও প্রিয় সম্পদটাই বেছে নেওয়া চাই।

গ. আল্লাহর পথে দান করার ক্ষেত্রেও আল্লাহওয়ালাদের পরামর্শ নেওয়া চাই।

ঘ. কেউ কোনও ভালো কাজ করলে গুরুজনদের উচিত তাকে সাধুবাদ জানানো।

ঙ. দান-খয়রাতের ক্ষেত্রে নিকটাত্মীয়দের অগ্রাধিকার দেওয়া শ্রেয়।

চ. মনোরম স্থানে গিয়ে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করা ও শীতল ছায়ায় আরাম গ্রহণ করা দূষণীয় কিছু নয়; বরং কৃতজ্ঞতার সঙ্গে আল্লাহ তাআলার নিআমত ভোগের নিয়ত থাকলে তা ছাওয়াবের কাজ বলেই গণ্য হবে।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:বিশুদ্ধ (পারিভাষিক সহীহ)