রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ
ভূমিকা অধ্যায়
হাদীস নং: ৩১২
অধ্যায়: ৪০
পিতা-মাতার প্রতি সদ্ব্যবহার ও আত্মীয়তা রক্ষা
পিতা-মাতার আনুগত্য করা, তাদের সেবাযত্ন করা ও তাদেরকে খুশি রাখার প্রচেষ্টাকে بر الوالدين বলা হয়।بر শব্দটির মূল অর্থ সৎকর্মের বিস্তার, প্রাচুর্য ও ব্যাপ্তি। শব্দটি আল্লাহ তাআলার জন্যও ব্যবহৃত হয়, বান্দার জন্যও। বান্দার জন্য ব্যবহার করলে অর্থ হবে আল্লাহ তাআলার পরিপূর্ণ আনুগত্য করা ও সামর্থ্য অনুযায়ী আনুগত্যকে ব্যাপক করে তোলা। আল্লাহ তাআলার ক্ষেত্রে এর অর্থ বান্দার সৎকর্মের পুরোপুরি প্রতিদান দেওয়া। এর থেকে উৎপন্ন আল্লাহ তাআলার এক গুণবাচক নাম হলো البر । যেমন কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে إِنَّهُ هُوَ الْبَرُّ الرَّحِيمُ ‘নিশ্চয়ই তিনি পরিপূর্ণ প্রতিদানদাতা, পরম দয়ালু।
বান্দার ক্ষেত্রে بر শব্দটি আকীদা-বিশ্বাস ও কাজকর্ম সবকিছুতে আল্লাহ তাআলার প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনের অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। যেমন ইরশাদ হয়েছে-
لَيْسَ الْبِرَّ أَنْ تُوَلُّوا وُجُوهَكُمْ قِبَلَ الْمَشْرِقِ وَالْمَغْرِبِ وَلَكِنَّ الْبِرَّ مَنْ آمَنَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ وَالْمَلَائِكَةِ وَالْكِتَابِ وَالنَّبِيِّينَ وَآتَى الْمَالَ عَلَى حُبِّهِ ذَوِي الْقُرْبَى وَالْيَتَامَى وَالْمَسَاكِينَ وَابْنَ السَّبِيلِ وَالسَّائِلِينَ وَفِي الرِّقَابِ وَأَقَامَ الصَّلَاةَ وَآتَى الزَّكَاةَ وَالْمُوفُونَ بِعَهْدِهِمْ إِذَا عَاهَدُوا وَالصَّابِرِينَ فِي الْبَأْسَاءِ وَالضَّرَّاءِ وَحِينَ الْبَأْسِ
‘পুণ্য তো কেবল এটাই নয় যে, তোমরা নিজেদের চেহারা পূর্ব বা পশ্চিম দিকে ফেরাবে; বরং পুণ্য হলো (সেই ব্যক্তির কার্যাবলী), যে ঈমান রাখে আল্লাহর, শেষ দিনের ও ফিরিশতাদের প্রতি এবং (আল্লাহর) কিতাব ও নবীগণের প্রতি। আর আল্লাহর ভালোবাসায় নিজ সম্পদ দান করে আত্মীয়-স্বজন, ইয়াতীম, মিসকীন, মুসাফির ও সওয়ালকারীদেরকে এবং দাসমুক্তিতে এবং সালাত কায়েম করে ও যাকাত দেয় এবং যারা কোনও প্রতিশ্রুতি দিলে তা পূরণে যত্নবান থাকে এবং সংকটে, কষ্টে ও যুদ্ধকালে ধৈর্যধারণ করে। (সূরা বাকারা (২), আয়াত ১১৭)
এ আয়াতে আকীদা-বিশ্বাস এবং নফল ও ফরয সবরকম সৎকর্মকে بر শব্দে ব্যক্ত করা হয়েছে।
পিতা-মাতার আনুগত্য ও সেবাযত্নও আল্লাহ তাআলার প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনের অন্তর্ভুক্ত। তাই এটিকেও بر বলে। বলা হয়ে থাকে- بر اباه (সে তার পিতার আনুগত্য করেছে)। পিতা-মাতার অনুগত সন্তানকে بر ও بار বলা হয়। যেমন কুরআন মাজীদে হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের উক্তি বর্ণিত হয়েছে- وَبَرًّا بِوَالِدَتِي , (এবং আল্লাহ আমাকে বানিয়েছেন আমার মায়ের অনুগত, সূরা মারয়াম (১৯), আয়াত ৩২)
সত্য কথা, কথা রক্ষা করা ও কসম পূর্ণ করার সম্পর্কেও بر ব্যবহৃত হয়। বলা হয় بر في يمينه (সে তার কসম রক্ষা করল)।
আত্মীয়তা রক্ষা করা ও আত্মীয়ের প্রতি সদ্ব্যবহার করাকে صلة الأرحام বলে। صلة অর্থ মেলানো, জোড়ানো। الأرحام শব্দটি رحم এর বহুবচন। رحم এর মূল অর্থ গর্ভাশয়। رحم বা গর্ভাশয় থেকে সন্তানের জন্মকে কেন্দ্র করে যেহেতু আত্মীয়তার সৃষ্টি, তাই আত্মীয়তা অর্থেও শব্দটি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। সুতরাং صلة الأرحام অর্থ যাদের সঙ্গে আত্মীয়তা আছে তাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক রক্ষা করা। এ সম্পর্কটি সর্বপ্রথম স্থাপিত হয় সন্তান-সন্ততি ও পিতা-মাতার মধ্যে। তাই صلة الأرحام ও আত্মীয়তারক্ষা বিষয়ে এদের অবস্থানই সর্বোচ্চে। তাদের পরবর্তী পর্যায়ে রয়েছে জন্মসূত্র সম্পর্কিত অন্যান্য আত্মীয়বর্গ, যেমন দাদা-দাদী, নানা-নানী, ভাইবোন, চাচা-ফুফু, মামা-খালা ও তাদের বংশধরগণ। সুতরাং সাধারণভাবে পিতা-মাতার আনুগত্য করা صلة الأرحام -এর অন্তর্ভুক্ত হলেও এ ক্ষেত্রে পিতা-মাতার স্থান যেহেতু সর্বোচ্চে, তাই ইমাম নববী রহ. এ অধ্যায়ের শিরোনামে তাদের জন্য بر الوالدين শব্দবন্ধকে প্রথমে উল্লেখ করেছেন, তারপর পৃথকভাবে অন্যান্য আত্মীয়বর্গের জন্য صلة الأرحام শব্দযূথ ব্যবহার করেছেন।
ইসলামে পিতা-মাতার আনুগত্য ও সেবাযত্ন করা এবং আত্মীয়তারক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। এর ফযীলতও বিশাল। কুরআন মাজীদ ও নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীছে এ সম্পর্কে বিস্তর আলোচনা আছে। ইমাম নববী রহ. সেরকম কিছু আয়াত ও হাদীছ এ অধ্যায়ে উল্লেখ করেছেন। আমরা নিচে তার বঙ্গানুবাদ ও সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা পেশ করছি। আল্লাহ তাবারাকা ওয়াতাআলাই তাওফীক দাতা।
‘পিতা-মাতার প্রতি সদ্ব্যবহার ও আত্মীয়তারক্ষা' সম্পর্কিত কিছু আয়াত
• এক নং আয়াত
وَاعْبُدُوا اللَّهَ وَلَا تُشْرِكُوا بِهِ شَيْئًا وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا وَبِذِي الْقُرْبَى وَالْيَتَامَى وَالْمَسَاكِينِ وَالْجَارِ ذِي الْقُرْبَى وَالْجَارِ الْجُنُبِ وَالصَّاحِبِ بِالْجَنْبِ وَابْنِ السَّبِيلِ وَمَا مَلَكَتْ أَيْمَانُكُمْ
অর্থ : তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর ও তাঁর সঙ্গে কাউকে শরীক করো না। পিতা- মাতার প্রতি সদ্ব্যবহার কর। আত্মীয়-স্বজন, ইয়াতীম, মিসকীন, নিকট প্রতিবেশী, দূর প্রতিবেশী, সঙ্গে বসা (বা দাঁড়ানো) ব্যক্তি, পথচারী এবং নিজের দাস-দাসীর প্রতিও (সদ্ব্যবহার কর)।৫২
ব্যাখ্যা
এ আয়াতে আল্লাহ তাআলার ইবাদত-বন্দেগীর হুকুম দেওয়ার পর কয়েক শ্রেণীর বান্দার হক আদায় ও তাদের প্রতি সদ্ব্যবহারের আদেশ করা হয়েছে। তাদের মধ্যে সর্বপ্রথম হচ্ছে পিতা-মাতা।
আল্লাহ তাআলার ইবাদত-বন্দেগীর আদেশদানের পরপর পিতা-মাতার প্রতি ভালো ব্যবহার করার আদেশ দেওয়ার কারণ বাহ্যত এই যে, আল্লাহ তাআলা হচ্ছেন মানুষের সৃষ্টিকর্তা । তারপর পিতা-মাতা তাদের দুনিয়ায় আসার মাধ্যম। মানুষের অস্তিত্বলাভে আল্লাহ তাআলার সৃজনক্ষমতাই আসল। তারপর পিতা-মাতার যেহেতু একটা বাহ্যিক ভূমিকা আছে, তাই কৃতজ্ঞতাস্বরূপ আল্লাহ তাআলার আনুগত্য করার পর পিতা-মাতার প্রতি সদ্ব্যবহার করার গুরুত্ব অন্য সবকিছুর চেয়ে বেশিই হওয়ার কথা ।
আয়াতটির বিস্তারিত ব্যাখ্যা এর আগের অধ্যায়ে গত হয়েছে।
• দুই নং আয়াত
وَاتَّقُوا اللَّهَ الَّذِي تَسَاءَلُونَ بِهِ وَالْأَرْحَامَ
অর্থ : আল্লাহকে ভয় কর, যার অছিলা দিয়ে তোমরা একে অন্যের কাছে (নিজেদের হক) চেয়ে থাক ।৫৩
ব্যাখ্যা
দুনিয়ায় মানুষ যখন একে অন্যের কাছে নিজের প্রাপ্য অধিকার দাবি করে, তখন অধিকাংশ সময়ই বলে থাকে, ‘আল্লাহর ওয়াস্তে তুমি আমাকে আমার পাওনা মিটিয়ে দাও,। আল্লাহ তাআলা এ আয়াতে বলছেন যে, তোমরা যখন নিজেদের হক ও প্রাপ্য অধিকারসমূহের ক্ষেত্রে আল্লাহ তাআলাকে অছিলা বানাও, তখন অন্যদের হক আদায়ের ব্যাপারেও আল্লাহ তাআলাকে ভয় কর এবং মানুষের সর্বপ্রকার হক পরিপূর্ণভাবে আদায় করে দাও। (তাওযীহুল কুরআন)
আয়াতটিতে এর আগে আছে-
يَاأَيُّهَا النَّاسُ اتَّقُوا رَبَّكُمُ الَّذِي خَلَقَكُمْ مِنْ نَفْسٍ وَاحِدَةٍ وَخَلَقَ مِنْهَا زَوْجَهَا وَبَثَّ مِنْهُمَا رِجَالًا كَثِيرًا وَنِسَاءً
'হে লোক সকল! নিজ প্রতিপালককে ভয় কর, যিনি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন। এক ব্যক্তি হতে এবং তারই থেকে তার স্ত্রীকে সৃষ্টি করেছেন। আর তাদের উভয় থেকে বহু নর-নারী (পৃথিবীতে) ছড়িয়ে দিয়েছেন।'
পূর্ণ আয়াতটিতে পর্যায়ক্রমে মৌলিক তিনটি বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে-
ক. সৃষ্টিকর্তা হওয়ার কারণে এক আল্লাহকে ভয় করা ও কেবল তাঁরই ইবাদত-আনুগত্য করা।
খ. একই আদম-সন্তান হওয়ার কারণে সমস্ত মানুষের অধিকার সম্পর্কে সচেতন থাকা। কোনও অবস্থায়ই কারও কোনও অধিকার হরণ না করা।
গ. অন্যান্য মানুষ অপেক্ষা আত্মীয়-স্বজনের সাথে ঘনিষ্ঠতা বেশি থাকায় তাদের অধিকারও যেহেতু অন্যদের তুলনায় বেশি, তাই তাদের অধিকারসমূহ আদায়ে অধিকতর যত্নবান থাকা ।
• তিন নং আয়াত
وَالَّذِينَ يَصِلُونَ مَا أَمَرَ اللَّهُ بِهِ أَنْ يُوصَلَ
অর্থ : আল্লাহ যে সম্পর্ক বজায় রাখতে আদেশ করেছেন, তারা তা বজায় রাখে।৫৪
ব্যাখ্যা
এর দ্বারা আত্মীয়তার সম্পর্ক বুঝানো হয়েছে। এ আয়াতটিসহ এর আগের ও পরের কয়েকটি আয়াতে প্রকৃত বুদ্ধিমানের কিছু সদ্গুণ উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন ধৈর্যধারণ করা, নামায পড়া, আল্লাহর পথে প্রকাশ্যে ও গোপনে খরচ করা, মন্দ ব্যবহারের জবাবে ভালো ব্যবহার করা এবং আল্লাহ তাআলা যে সম্পর্ক রক্ষা করার হুকুম দিয়েছেন সেই সম্পর্ক অর্থাৎ আত্মীয়তা রক্ষা করা। এসব গুণ যারা অর্জন করতে সক্ষম হয় তাদের পরিণাম শুভ। অর্থাৎ তারা জান্নাতবাসী হবে।
আত্মীয়তা রক্ষা করা মানে আত্মীয়দের খোঁজখবর রাখা, সামর্থ্য অনুযায়ী তাদের সাহায্য-সহযোগিতা করা ও তাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করা। ভালো ব্যবহার করার মানে তারা দুর্ব্যবহার করলেও তার জবাবে দুর্ব্যবহার না করা; বরং ক্ষমা করা এবং সর্বদা সুসম্পর্ক রক্ষায় সচেষ্ট থাকা। যেমন এক হাদীছে ইরশাদ হয়েছে-
لَيْسَ الْوَاصِلُ بِالْمُكَافِي، وَلَكِنَّ الْوَاصِلَ : الَّذِي إِذَا قُطِعَتْ رَحِمُهُ وَصَلَهَا
‘ওই ব্যক্তি আত্মীয়তা রক্ষাকারী নয়, যে কেবল (সদ্ব্যবহারের) প্রতিদান দেয়। বরং আত্মীয়তা রক্ষাকারী সে-ই, যার সঙ্গে আত্মীয়তা ছিন্ন করা হলে সে তা পুনঃস্থাপন করে।,৫৫
• চার নং আয়াত
وَوَصَّيْنَا الْإِنْسَانَ بِوَالِدَيْهِ حُسْنًا
অর্থ : আমি মানুষকে আদেশ করেছি তারা যেন পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার করে ।৫৬
ব্যাখ্যা
পিতা-মাতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার সম্পর্কে এ আয়াতটি একটি মূলনীতির মর্যাদা রাখে। পরিপূর্ণ আয়াতটি এরকম-
وَوَصَّيْنَا الْإِنْسَانَ بِوَالِدَيْهِ حُسْنًا وَإِنْ جَاهَدَاكَ لِتُشْرِكَ بِي مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ فَلَا تُطِعْهُمَا إِلَيَّ مَرْجِعُكُمْ فَأُنَبِّئُكُمْ بِمَا كُنْتُمْ تَعْمَلُونَ
‘আমি মানুষকে আদেশ করেছি তারা যেন পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার করে। তারা যদি আমার সাথে এমন কিছুকে শরীক করার জন্য তোমার উপর বলপ্রয়োগ করে, যার সম্পর্কে তোমার কাছে কোনও প্রমাণ নেই, তবে সে ব্যাপারে তাদের কথা মানবে না। আমারই কাছে তোমাদেরকে ফিরে আসতে হবে। তখন আমি তোমাদেরকে অবহিত করব তোমরা কী করতে।'
আয়াতটি নাযিল হয়েছে হযরত সা'দ ইবন আবী ওয়াক্কাস রাযি. ও তাঁর মা হামনা বিনত আবূ সুফয়ানকে কেন্দ্র করে। আশারায়ে মুবাশশারার অন্তর্ভুক্ত বিখ্যাত সাহাবী হযরত সা'দ ইবন আবী ওয়াক্কাস রাযি. ইসলামের প্রথম যুগেই ঈমান এনেছিলেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত মাতৃভক্ত। কিন্তু ইসলাম গ্রহণ করলে তাঁর মা তাঁর প্রতি অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হন। তিরস্কার করে বললেন, তুমি বাপ-দাদার ধর্ম ছেড়ে নতুন এক ধর্ম গ্রহণ করেছ! আল্লাহর কসম, তুমি যতক্ষণ না এ নতুন ধর্ম ত্যাগ করে বাপ-দাদার ধর্মে ফিরে আসবে, ততক্ষণ আমি কিছু খাব না, কিছু পানও করব না। এভাবেই মরে যাব। ফলে চিরকাল মানুষ এই বলে তোমার নিন্দা করবে যে, তুমি তোমার মাকে হত্যা করেছ। এতে হযরত সা'দ ইবন আবী ওয়াক্কাস রাযি. খুব পেরেশান হয়ে যান। এরই পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহ তাআলা আলোচ্য আয়াত নাযিল করেন।
এতে প্রথমত পিতা-মাতার প্রতি সদ্ব্যবহার করতে হুকুম দেওয়া হয়েছে। তারপর বলা হয়েছে, পিতা-মাতা আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরীক করার হুকুম দিলে তা মানা যাবে না। আল্লাহর সঙ্গে শরীক করাকে একটি অজ্ঞতাপ্রসূত কাজ সাব্যস্ত করা হয়েছে। নিখুঁত ও পূর্ণাঙ্গ জ্ঞান কেবল আল্লাহ তাআলারই আছে। মানুষের জ্ঞান ত্রুটিপূর্ণ ও অপূর্ণ। কাজেই আল্লাহ তাআলার হুকুমের বিপরীত কেউ কোনও হুকুম দিলে তা অজ্ঞতাপ্রসূতই বটে। যাবতীয় ভ্রান্ত বিশ্বাস অজ্ঞতাপ্রসূত বিশ্বাস এবং যাবতীয় পাপাচার ও নাফরমানির কাজ অজ্ঞতারই পরিচায়ক, তা বাহ্যদৃষ্টিতে মানুষের কাছে যতই জ্ঞান-যুক্তিভিত্তিক সাব্যস্ত হোক না কেন।
এর দ্বারা বুঝা গেল, আল্লাহর নাফরমানি হয় এমন কোনও কাজে মানুষের আনুগত্য করা জায়েয নয়। এক হাদীছে ইরশাদ হয়েছে-
لَا طَاعَةَ فِي مَعْصِيَةِ اللهِ، إِنَّمَا الطَاعَةُ فِي الْمَعْرُوفِ
‘আল্লাহর নাফরমানির কাজে বান্দার কোনও আনুগত্য নেই। বান্দার আনুগত্য করা যায় কেবল সৎকাজে।,৫৭
যাহোক আয়াতটি নাযিল হলে হযরত সা'দ রাযি.-এর পেরেশানি দূর হয়। তিনি নিজ করণীয় সম্পর্কে নির্দেশনা পেয়ে যান। ইমাম বাগাবী রহ.-এর বর্ণনায় আছে, এ আয়াত নাযিল হওয়ার পর হযরত সা'দ ইবন আবী ওয়াক্কাস রাযি.-এর মা একদিন একরাত অনাহারে কাটান, কিন্তু তবুও হযরত সা'দ রাযি. সত্যদীনের উপর অবিচল থাকেন। তিনি মায়ের কাছে এসে বললেন, আম্মা, আপনার যদি একশ'টিও প্রাণ থাকত এবং একটি একটি করে তার সবগুলো বের হয়ে যেত, তবুও আমি আমার এ দীন পরিত্যাগ করতাম না। এবার আপনার ইচ্ছা হলে পানাহার গ্রহণ করুন আর না হয় অনাহারেই থাকুন। তার মা বুঝে ফেললেন যে, পুত্রকে তার নতুন ধর্ম থেকে টলানো যাবে না। নিরাশ হয়ে পানাহার শুরু করে দিলেন।
• পাঁচ নং আয়াত
وَقَضَى رَبُّكَ أَلَّا تَعْبُدُوا إِلَّا إِيَّاهُ وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا إِمَّا يَبْلُغَنَّ عِنْدَكَ الْكِبَرَ أَحَدُهُمَا أَوْ كِلَاهُمَا فَلَا تَقُلْ لَهُمَا أُفٍّ وَلَا تَنْهَرْهُمَا وَقُلْ لَهُمَا قَوْلًا كَرِيمًا (23) وَاخْفِضْ لَهُمَا جَنَاحَ الذُّلِّ مِنَ الرَّحْمَةِ وَقُلْ رَبِّ ارْحَمْهُمَا كَمَا رَبَّيَانِي صَغِيرًا
অর্থ : তোমার প্রতিপালক নির্দেশ দিয়েছেন যে, তাকে ছাড়া অন্য কারও ইবাদত করো না, পিতা-মাতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করো, পিতা-মাতার কোনও একজন কিংবা উভয়ে যদি তোমার কাছে বার্ধক্যে উপনীত হয়, তবে তাদেরকে উফ্ পর্যন্ত বলো না এবং তাদেরকে ধমক দিও না; বরং তাদের সঙ্গে সম্মানজনক কথা বলো। এবং তাদের প্রতি মমতাপূর্ণ আচরণের সঙ্গে তাদের সামনে নিজেকে বিনয়াবনত করো আর দু'আ করো, হে আমার প্রতিপালক! তারা যেভাবে আমার শৈশবে আমাকে লালন-পালন করেছে, তেমনি আপনিও তাদের প্রতি রহমতের আচরণ করুন।৫৮
ব্যাখ্যা
এ দুই আয়াতে আল্লাহ তাআলা পিতা-মাতার প্রতি সদ্ব্যবহার সম্পর্কে কয়েকটি নির্দেশনা দিয়েছেন। শুরুতে কেবল আল্লাহ তাআলারই ইবাদত করার হুকুম দেওয়া হয়েছে। তারপর ইরশাদ হয়েছে- وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا (পিতা-মাতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করো)। এটা তাদের প্রতি সাধারণভাবে সদ্ব্যবহারের হুকুম। এরপর এ হুকুমের খানিকটা ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে, যা দ্বারা সদ্ব্যবহারের বিশেষ কয়েকটি দিক পরিস্ফুট হয়েছে।
সুতরাং ইরশাদ হয়েছে—
إِمَّا يَبْلُغَنَّ عِنْدَكَ الْكِبَرَ أَحَدُهُمَا أَوْ كِلَاهُمَا فَلَا تَقُلْ لَهُمَا أُفٍّ
(পিতা-মাতার কোনও একজন কিংবা উভয়ে যদি তোমার কাছে বার্ধক্যে উপনীত হয়, তবে তাদেরকে উফ্ পর্যন্ত বলো না)। ‘উফ্’ শব্দটি বিরক্তি প্রকাশক ও অপ্রীতিব্যাঞ্জক। উফ্ পর্যন্ত বলো না- এর অর্থ, তাদের প্রতি বিরক্তি প্রকাশ করো না এবং তাদেরকে বিরক্তিসূচক কোনও কথা বলো না, যেমন তারা যদি কোনও কথা বার বার বলে বা অপ্রয়োজনীয় কোনও কথা বলে, যেমনটা বৃদ্ধ ও শিশুরা করে থাকে, তখন বিরক্তির সাথে তার জবাব দিও না।
আয়াতে পিতা-মাতার সঙ্গে উফ্ বা বিরক্তিসূচক কোনও শব্দ ব্যবহার নিষেধ করার দ্বারা বুঝা গেল এটা জায়েয নয়। পিতা-মাতার সঙ্গে যখন এরূপ শব্দ ও ভাষা ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ, তখন তাদেরকে সরাসরি কষ্ট দেওয়া যে আরও কতটা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ হবে তা বলাই বাহুল্য। কিন্তু অনেক সময় সেদিকে লক্ষ রাখা হয় না। কেউ তো পিতা- মাতাকে খাওয়ায় কষ্ট দেয়। কেউ বা পোশাক-আশাকে। অনেকে তাদের স্বাস্থ্যের দিকেও লক্ষ রাখে না। অসুস্থ হলে চিকিৎসার যথাযথ ব্যবস্থা নেয় না। এদিকেও লক্ষ করা হয় না যে, পিতা-মাতা যে ঘরে বা যে কামরায় থাকে তা তাদের পক্ষে কষ্টদায়ক নয় তো! মোটকথা তাদের শারীরিক বা মানসিক কষ্ট নানাভাবেই দেওয়া হয়ে থাকে। তা সবই এ আয়াতের হুকুমের পরিপন্থী। এ ব্যাপারে প্রত্যেক সন্তানের সচেতন থাকা উচিত। আবার অনেকে তো পিতা-মাতাকে তীব্র ভাষায় আক্রমণও করে। আয়াতে পরের বাক্যে এ ব্যাপারে সতর্ক করা হয়েছে।
ইরশাদ হয়েছে- وَلَا تَنْهَرْهُمَا (এবং তাদেরকে ধমক দিও না)। অনেক সময় পিতা-মাতার কোনও কথা বা কোনও কাজ পসন্দ না হলে সন্তান তাদেরকে ধমক দিয়ে বসে। পসন্দ-অপসন্দের বিষয়টি কখনও রুচি-প্রকৃতির প্রভেদের কারণেও হয় এবং কখনও হয় সময়ের ব্যবধানের কারণে। সন্তানকে এটা বুঝতে হবে। বৃদ্ধ পিতা-মাতার রুচি-অভিরুচি কেন আমার মত নয় কিংবা পিতা-মাতা কেন আমার সময়কালের রুচি-অভিরুচি বুঝতে পারে না, কেন লোকজনের সামনে সময়োপযোগী কথা বলে না—এসব বিবেচনায় তাদের প্রতি বিরক্ত না হয়ে বরং সন্তানের কর্তব্য হবে পিতা-মাতার দীর্ঘদিনের অভ্যাসকে সম্মান জানানো ও তাদের লালিত রুচি-প্রকৃতির মূল্য দেওয়া। এভাবে চিন্তা করা হয় না বলেই অনেক সন্তান পিতা-মাতার আচরণে যন্ত্রণাবোধ করে। ফলে বিরক্ত হয়ে অনেক সময় ধমক দিয়ে বসে। কোনও কোনও দুর্ভাগা তো রীতিমত গালাগালিই করে। এটা অত্যন্ত ধ্বংসকর আচরণ। এরূপ অবাধ্য সন্তান নিজ আখেরাত তো বরবাদ করেই, দুনিয়ায়ও তাকে কঠিন দুর্ভোগের সম্মুখীন হতে হয়। এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
كُلُّ الذُّنُوبِ يَغْفِرُ اللهُ مِنْهَا مَا شَاءَ إِلَّا عُقُوْقَ الْوَالِدَيْنِ، فَإِنَّهُ يُعَجِّلُ لِصَاحِبِهِ فِي الْحَيَاةِ قَبْلَ الْمَمَاتِ
‘সমস্ত পাপের ক্ষেত্রেই নিয়ম এই যে, আল্লাহ তাআলা তা থেকে যা ইচ্ছা মাফ করে দেবেন। কিন্তু পিতা-মাতার অবাধ্যতা এর ব্যতিক্রম। কেননা আল্লাহ এই অপরাধের অপরাধীকে মৃত্যুর আগে এ দুনিয়ায়ই নগদ শাস্তি দিয়ে দেন।,৫৯
সুতরাং প্রত্যেক সন্তানের এরূপ আচরণ থেকে বিরত হওয়া একান্ত কর্তব্য। সর্বাবস্থায়ই সন্তানদেরকে পিতা-মাতার সঙ্গে শান্তিদায়ী আচরণ করতে হবে। কথা বলতে হবে সম্মানজনক। সুতরাং এর পরবর্তী বাক্যে ইরশাদ হয়েছে-
وَقُلْ لَّهُمَا قَوْلًا كَرِيمًا
(বরং তাদের সঙ্গে সম্মানজনক কথা বলো)। অর্থাৎ যখনই তাদের সঙ্গে কথা বলবে, তখন মাথায় এই চিন্তা-চেতনা জাগ্রত রেখে কথা বলবে যে, তারা আমার পিতা-মাতা, সর্বাপেক্ষা শ্রদ্ধাভক্তির পাত্র। কেউ কেউ বলেন, একজন কঠোর স্বভাবের মানবের সঙ্গে তার অনুগত ও বাধ্যগত গোলাম যেমন নম্র ও বিনীত ভঙ্গিতে কথা বলে, প্রত্যেক সন্তানকে তার পিতা-মাতার সঙ্গে ঠিক সেইভাবে কথা বলতে হবে। পরবর্তী আয়াতে ইরশাদ হয়েছে-
وَاخْفِضْ لَهُمَا جَنَاحَ الذُّلِّ مِنَ الرَّحْمَةِ
(এবং তাদের প্রতি মমতাপূর্ণ আচরণের সঙ্গে তাদের সামনে নিজেকে বিনয়াবনত করো)। অর্থাৎ তাদের জন্য তোমার দু'হাত নম্র-কোমল রাখ। এর দ্বারা তাদের প্রতি বিনীত ও উদার থাকতে হুকুম করা হয়েছে। কাজেই তাদের সঙ্গে আচার-আচরণ করতে হবে অত্যন্ত আদবের সঙ্গে। খুব সতর্ক থাকতে হবে যাতে কোনও অবস্থায়ই তাদের সঙ্গে বেআদবী না হয়ে যায়। এমনিভাবে নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী তাদের প্রয়োজন পূরণেও সচেষ্ট থাকতে হবে। তাদের যা-কিছু পসন্দ তা পূরণে অকাতরে টাকাপয়সা খরচ করবে।
বলা হয়েছে বৃদ্ধ পিতা-মাতার প্রতি আচরণ করতে হবে মমতাপূর্ণ। কেননা আজ তারা বার্ধক্যের কারণে তোমার উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। স্মরণ কর, আজ তারা যেমন তোমার উপর নির্ভরশীল, তেমনি তুমিও একদিন তাদের উপর এরকম নির্ভরশীল ছিলে। তখন তারা পরম মমতায় নিজেদের সুখ ও আরাম ভুলে তোমার সুখ ও আরামের প্রতি লক্ষ রাখতেন। কাজেই আজ তাদের এই দুর্বল অবস্থায় তোমারও উচিত সর্বোচ্চ ধৈর্যের সঙ্গে তাদের প্রতি মমত্বপূর্ণ আচরণ করে যাওয়া।
এ তো গেল পিতা-মাতার সেবাযত্নে নিজ শক্তি-সামর্থ্য ব্যয় করার ব্যাপার। প্রকৃত সুখ-শান্তিদাতা তো আল্লাহ তাআলাই । আল্লাহ তাআলা না চাইলে কোনও বান্দা হাজার চেষ্টা করেও কাউকে সুখ দিতে পারে না। বিশেষত আখেরাতের মুক্তি ও নাজাতের ব্যাপারে কেউ তো বাহ্যিকভাবেও কিছু করতে পারে না। তা সম্পূর্ণই আল্লাহ তাআলার এখতিয়ারে। তাই সন্তানের কর্তব্য পিতা-মাতার প্রতি যত্ন নেওয়ার পাশাপাশি তাদের দোজাহানের শান্তি ও মুক্তির জন্য আল্লাহ তাআলার কাছে দুআ করাও। আয়াতের পরবর্তী অংশে সে দুআই শিক্ষা দেওয়া হয়েছে—
وَقُلْ رَبِّ ارْحَمْهُمَا كَمَا رَبَّيَانِي صَغِيرًا
(আর দু'আ করো, হে আমার প্রতিপালক! তারা যেভাবে আমার শৈশবে আমাকে লালন-পালন করেছে, তেমনি আপনিও তাদের প্রতি রহমতের আচরণ করুন)। অর্থাৎ আমি যখন নিতান্তই দুর্বল ছিলাম, তখন তারা আমার লালন-পালনের জন্য নিজের সমস্ত সুখ ও আরাম বিসর্জন দিয়েছিলেন। নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী তারা আমার আরাম ও কল্যাণের সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিলেন। কোনও বিপদ-আপদ যাতে আমাকে স্পর্শ করতে না পারে, সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রেখেছিলেন। এমনকি আমার বর্তমান ও ভবিষ্যৎ কল্যাণের জন্য তারা প্রয়োজনে জীবনের ঝুঁকি নিতেও প্রস্তুত থাকতেন। আজ তারা বয়সের ভারে ক্লান্ত-শ্রান্ত। হে আল্লাহ! আপনার তাওফীকে আমি তো আমার সামর্থ্য অনুযায়ী তাদের খেদমত করে যাচ্ছি। কিন্তু সন্তান হিসেবে যা কর্তব্য তা ঠিক পালন করা হচ্ছে না। সুতরাং হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে নিবেদন করছি, আপনি আজ তাদের প্রতি নিজ রহমত জারি রাখুন এবং মৃত্যুর পরও তাদের প্রতি আপন দয়ামায়ার আচরণ করুন।
• ছয় নং আয়াত
وَوَصَّيْنَا الْإِنْسَانَ بِوَالِدَيْهِ حَمَلَتْهُ أُمُّهُ وَهْنًا عَلَى وَهْنٍ وَفِصَالُهُ فِي عَامَيْنِ أَنِ اشْكُرْ لِي وَلِوَالِدَيْكَ إِلَيَّ الْمَصِيرُ
অর্থ : আমি মানুষকে তার পিতা-মাতা সম্পর্কে নির্দেশ দিয়েছি- (কেননা) তার মা কষ্টের পর কষ্ট সয়ে তাকে গর্ভে ধারণ করেছে আর তার দুধ ছাড়ানো হয় দু' বছরে- তুমি শোকর আদায় কর আমার এবং তোমার পিতা-মাতার। আমারই কাছে (তোমাদেরকে) ফিরে আসতে হবে।৬০
ব্যাখ্যা
এটি সূরা লুকমানের ১৪ নং আয়াত। এর পরের আয়াতটি এরকম-
وَإِنْ جَاهَدَاكَ عَلَى أَنْ تُشْرِكَ بِي مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ فَلَا تُطِعْهُمَا وَصَاحِبْهُمَا فِي الدُّنْيَا مَعْرُوفًا وَاتَّبِعْ سَبِيلَ مَنْ أَنَابَ إِلَيَّ ثُمَّ إِلَيَّ مَرْجِعُكُمْ فَأُنَبِّئُكُمْ بِمَا كُنْتُمْ تَعْمَلُونَ
‘তারা যদি এমন কাউকে (প্রভুত্বে) আমার সমকক্ষ সাব্যস্ত করার জন্য তোমাকে চাপ দেয়, যে সম্পর্কে তোমার কোনও জ্ঞান নেই, তবে তাদের কথা মানবে না। অবশ্য দুনিয়ায় তাদের সাথে সদ্ভাবে থাকবে। এমন ব্যক্তির পথ অবলম্বন করো, যে একান্তভাবে আমার অভিমুখী হয়েছে। অতঃপর তোমাদের সকলকে আমারই কাছে ফিরে আসতে হবে। তখন আমি তোমাদেরকে অবহিত করব তোমরা যা-কিছু করতে।৬১
এ আয়াতদু'টির আগে ও পরে হযরত লুকমান আলাইহিস সালামের উপদেশ বর্ণিত হয়েছে। সে উপদেশ তিনি করেছিলেন নিজ পুত্রকে লক্ষ্য করে। তাতে পুত্রকে সাবধান করেছিলেন যেন কিছুতেই আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরীক না করে। তাঁর উপদেশের মাঝখানে এ দুই আয়াতে আল্লাহ তাআলার পক্ষ হতে বিশেষভাবে পিতা-মাতার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
শিরক পরিহারের নির্দেশের সাথে এর সম্পর্ক এই যে, হযরত লুকমান তো নিজ পুত্রকে শিরক থেকে বেঁচে থাকার ও তাওহীদকে আঁকড়ে ধরার উপদেশ দিচ্ছিলেন, অপর দিকে মক্কা মুকাররমার মুশরিকগণ হযরত লুকমানকে একজন মহাজ্ঞানী লোক হিসেবে স্বীকার করা সত্ত্বেও, যখন তাদের সন্তানগণ তাওহীদী আকীদা অবলম্বন করল, তখন তারা তাদেরকে তা থেকে ফেরানোর এবং পুনরায় শিরকে লিপ্ত করার জন্য জোরদার চেষ্টা করছিল। তাদের মুমিন সন্তানগণ এক্ষেত্রে পিতা-মাতার সঙ্গে কীরূপ আচরণ করবে তা নিয়ে বেজায় পেরেশান ছিল। তাই আল্লাহ তাআলা এ আয়াত দ্বারা তাদেরকে পথনির্দেশ করছেন যে, আমিই মানুষকে আদেশ করেছি, তারা যেন আল্লাহ তাআলার সাথে তাদের পিতা-মাতারও শোকর আদায় করে। কেননা যদিও তাদের সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তাআলা, কিন্তু বাহ্যিক কারণ হিসেবে তাদের দুনিয়ায় আগমনের পেছনে পিতা-মাতার ভূমিকাই প্রধান।
পিতা-মাতার মধ্যেও আবার বিশেষভাবে মায়ের কষ্ট-মেহনতের কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে-
حَمَلَتْهُ أُمُّهُ وَهْنًا عَلَى وَهْنٍ وَفِصَالُهُ فِي عَامَيْنِ
(তার মা কষ্টের পর কষ্ট সয়ে তাকে গর্ভে ধারণ করেছে আর তার দুধ ছাড়ানো হয় দু' বছরে)। মা কতইনা কষ্টের সাথে তাকে নিজ গর্ভে ধারণ করে রাখেন। তারপর একটানা দু'বছর তাকে দুধ পান করায়। বলাবাহুল্য শিশুর লালন-পালনের সুদীর্ঘ সময়ের ভেতর দুধ পানের সময়টাই মায়ের জন্য বেশি কষ্ট-ক্লেশের হয়ে থাকে। এসব কারণে মা'ই সন্তানের পক্ষ হতে সদ্ব্যবহারের বেশি হকদার। কিন্তু এই সদ্ব্যবহারের অর্থ এ নয় যে, মানুষ তার দীন ও ঈমানের প্রশ্নে আল্লাহ তাআলার হুকুমকে পাশ কাটিয়ে পিতা-মাতার হুকুম মানতে শুরু করে দেবে।
এ বিষয়টা স্মরণে রাখার জন্যই আয়াতে পিতা-মাতার শোকর আদায়ের নির্দেশ দেওয়ার আগে আল্লাহ তাআলার শোকর আদায়ের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে- أَنِ اشْكُرْ لِي وَلِوَالِدَيْكَ (তুমি শোকর আদায় কর আমার এবং তোমার পিতা-মাতার)। কেননা পিতা-মাতা তো এক বাহ্যিক 'কারণ' ও মাধ্যম মাত্র। মানুষের প্রতিপালনের ব্যবস্থা হিসেবে এ কারণ আল্লাহ তাআলাই সৃষ্টি করেছেন। প্রকৃত স্রষ্টা ও প্রতিপালক আল্লাহ তাআলাই। কাজেই এই বাহ্যিক কারণ ও মাধ্যমের গুরুত্ব কখনওই প্রকৃত স্রষ্টা ও আসল প্রতিপালকের গুরুত্ব অপেক্ষা বেশি হতে পারে না। তাই বলে তাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহারও করা যাবে না। ইরশাদ হয়েছে- وَصَاحِبْهُمَا فِي الدُّنْيَا مَعْرُوفًا (অবশ্য দুনিয়ায় তাদের সাথে সদ্ভাবে থাকবে)।
অর্থাৎ দীনের ব্যাপারে পিতা-মাতা কোনও অন্যায় কথা বললে তা মানা তো জায়ে হবে না, কিন্তু তাদের কথা এমন পন্থায় রদ করা যাবে না, যা তাদের জন্য কষ্টদায়ক হয় বা যাতে তারা নিজেদেরকে অপমানিত বোধ করে। বরং তাদেরকে নম্র ভাষায় বুঝিয়ে দেওয়া উচিত যে, আমি আপনাদের কথা মানতে অপারগ।
কেবল এতটুকুই নয়, বরং সাধারণভাবে অন্যান্য সকল ক্ষেত্রেই তাদের সাথে সদাচরণ করতে হবে। তাদের খেদমত করতে হবে, আর্থিকভাবে তাদের সাহায্য করতে হবে এবং তারা অসুস্থ হয়ে পড়লে তাদের সেবা-যত্ন করতে হবে ইত্যাদি। মূলত এ নসীহতের সম্পর্ক পিতা-মাতার খেদমতের সঙ্গে। তাদের আনুগত্য করা যাবে কেবল এমন বিষয়েই, যা শরীআতসম্মত হয়। সুতরাং আয়াতের পরের অংশে ইরশাদ হয়েছে-
وَاتَّبِعْ سَبِيلَ مَنْ أَنَابَ إِلَيَّ ثُمَّ إِلَيَّ مَرْجِعُكُمْ فَأُنَبِّئُكُمْ بِمَا كُنْتُمْ تَعْمَلُونَ
(এমন ব্যক্তির পথ অবলম্বন করো, যে একান্তভাবে আমার অভিমুখী হয়েছে। অতঃপর তোমাদের সকলকে আমারই কাছে ফিরে আসতে হবে। তখন আমি তোমাদেরকে অবহিত করব তোমরা যা-কিছু করতে)। অর্থাৎ মাতা-পিতা ভ্রান্ত পথে থাকলে তাদের পথ অবলম্বন করা যাবে না কিছুতেই; বরং পথ অবলম্বন করতে হবে কেবল তাদেরই, যারা আল্লাহ তাআলার সঙ্গে সুদৃঢ় সম্পর্ক রক্ষা করে চলে। অর্থাৎ কেবল তাঁরই ইবাদত ও আনুগত্য করে।
এর ভেতর এই ইঙ্গিতও রয়েছে যে, দীনের অনুসরণও কেবল নিজ বুদ্ধি-বিবেচনার ভিত্তিতে করা ঠিক নয়; বরং যারা আল্লাহ তাআলার আশেক ও তাঁর পরিপূর্ণ অনুগত বলে পরিষ্কারভাবে জানা আছে, দেখতে হবে তারা দীনের অনুসরণ করে কিভাবে এবং তাদের আমলের ধরন কী? তারা যে কাজ যেভাবে করেন ঠিক সেভাবেই তা সম্পাদন করা চাই। সমস্ত আমলে তাদেরই পথ অনুসরণ করা চাই। এ কারণেই বলা হয়ে থাকে এবং যথার্থই বলা হয়ে থাকে যে, ব্যক্তিগত পড়াশোনার ভিত্তিতে কুরআন ও হাদীছের এমন কোনও ব্যাখ্যা করা ও তা থেকে এমন কোনও সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া কিছুতেই সমীচীন নয়, যা উম্মতের উলামায়ে কেরাম ও বুযুর্গানে দীন থেকে প্রাপ্ত ব্যাখ্যার পরিপন্থী। (তাওযীহুল কুরআন)
৫২. সূরা নিসা (৪), আয়াত ৩৬
৫৩. সূরা নিসা (৪), আয়াত ১
৫৪. সূরা রা'দ (১৩), আয়াত ২১
৫৫. সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৫৯৯১; সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ১৬৯৭; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ১৯০৮; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ৬৭৮৫; আল-আদাবুল মুফরাদ, হাদীছ নং ৬৮; বায়হাকী, আস্সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ১৩২১৯; তবারানী, আল-মু'জামুল আওসাত, হাদীছ নং ৫৬২৬; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ, হাদীছ নং ৩৪৪২
৫৬. সূরা আনকাবূত (২৯), আয়াত ৮
৫৭. সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ১৮৪০; সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ২৬২৫; সুনানে নাসাঈ, হাদীছ নং ৪২০৫; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ৭২৪; সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ৪৫৬৭; বায়হাকী, আস্ সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ১৬৬০৯
৫৮. সূরা বনী ইসরাঈল (১৭), আয়াত ২৩,২৪
৫৯. বায়হাকী, শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ৭৫০৬; খারাইতী, মাসাবিউল আখলাক, হাদীছ নং ২৩৬
৬০. সূরা লুকমান (৩১), আয়াত ১৪
৬১. সূরা লুকমান (৩১), আয়াত ১৫
পিতা-মাতার প্রতি সদ্ব্যবহার ও আত্মীয়তা রক্ষা
পিতা-মাতার আনুগত্য করা, তাদের সেবাযত্ন করা ও তাদেরকে খুশি রাখার প্রচেষ্টাকে بر الوالدين বলা হয়।بر শব্দটির মূল অর্থ সৎকর্মের বিস্তার, প্রাচুর্য ও ব্যাপ্তি। শব্দটি আল্লাহ তাআলার জন্যও ব্যবহৃত হয়, বান্দার জন্যও। বান্দার জন্য ব্যবহার করলে অর্থ হবে আল্লাহ তাআলার পরিপূর্ণ আনুগত্য করা ও সামর্থ্য অনুযায়ী আনুগত্যকে ব্যাপক করে তোলা। আল্লাহ তাআলার ক্ষেত্রে এর অর্থ বান্দার সৎকর্মের পুরোপুরি প্রতিদান দেওয়া। এর থেকে উৎপন্ন আল্লাহ তাআলার এক গুণবাচক নাম হলো البر । যেমন কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে إِنَّهُ هُوَ الْبَرُّ الرَّحِيمُ ‘নিশ্চয়ই তিনি পরিপূর্ণ প্রতিদানদাতা, পরম দয়ালু।
বান্দার ক্ষেত্রে بر শব্দটি আকীদা-বিশ্বাস ও কাজকর্ম সবকিছুতে আল্লাহ তাআলার প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনের অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। যেমন ইরশাদ হয়েছে-
لَيْسَ الْبِرَّ أَنْ تُوَلُّوا وُجُوهَكُمْ قِبَلَ الْمَشْرِقِ وَالْمَغْرِبِ وَلَكِنَّ الْبِرَّ مَنْ آمَنَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ وَالْمَلَائِكَةِ وَالْكِتَابِ وَالنَّبِيِّينَ وَآتَى الْمَالَ عَلَى حُبِّهِ ذَوِي الْقُرْبَى وَالْيَتَامَى وَالْمَسَاكِينَ وَابْنَ السَّبِيلِ وَالسَّائِلِينَ وَفِي الرِّقَابِ وَأَقَامَ الصَّلَاةَ وَآتَى الزَّكَاةَ وَالْمُوفُونَ بِعَهْدِهِمْ إِذَا عَاهَدُوا وَالصَّابِرِينَ فِي الْبَأْسَاءِ وَالضَّرَّاءِ وَحِينَ الْبَأْسِ
‘পুণ্য তো কেবল এটাই নয় যে, তোমরা নিজেদের চেহারা পূর্ব বা পশ্চিম দিকে ফেরাবে; বরং পুণ্য হলো (সেই ব্যক্তির কার্যাবলী), যে ঈমান রাখে আল্লাহর, শেষ দিনের ও ফিরিশতাদের প্রতি এবং (আল্লাহর) কিতাব ও নবীগণের প্রতি। আর আল্লাহর ভালোবাসায় নিজ সম্পদ দান করে আত্মীয়-স্বজন, ইয়াতীম, মিসকীন, মুসাফির ও সওয়ালকারীদেরকে এবং দাসমুক্তিতে এবং সালাত কায়েম করে ও যাকাত দেয় এবং যারা কোনও প্রতিশ্রুতি দিলে তা পূরণে যত্নবান থাকে এবং সংকটে, কষ্টে ও যুদ্ধকালে ধৈর্যধারণ করে। (সূরা বাকারা (২), আয়াত ১১৭)
এ আয়াতে আকীদা-বিশ্বাস এবং নফল ও ফরয সবরকম সৎকর্মকে بر শব্দে ব্যক্ত করা হয়েছে।
পিতা-মাতার আনুগত্য ও সেবাযত্নও আল্লাহ তাআলার প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনের অন্তর্ভুক্ত। তাই এটিকেও بر বলে। বলা হয়ে থাকে- بر اباه (সে তার পিতার আনুগত্য করেছে)। পিতা-মাতার অনুগত সন্তানকে بر ও بار বলা হয়। যেমন কুরআন মাজীদে হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের উক্তি বর্ণিত হয়েছে- وَبَرًّا بِوَالِدَتِي , (এবং আল্লাহ আমাকে বানিয়েছেন আমার মায়ের অনুগত, সূরা মারয়াম (১৯), আয়াত ৩২)
সত্য কথা, কথা রক্ষা করা ও কসম পূর্ণ করার সম্পর্কেও بر ব্যবহৃত হয়। বলা হয় بر في يمينه (সে তার কসম রক্ষা করল)।
আত্মীয়তা রক্ষা করা ও আত্মীয়ের প্রতি সদ্ব্যবহার করাকে صلة الأرحام বলে। صلة অর্থ মেলানো, জোড়ানো। الأرحام শব্দটি رحم এর বহুবচন। رحم এর মূল অর্থ গর্ভাশয়। رحم বা গর্ভাশয় থেকে সন্তানের জন্মকে কেন্দ্র করে যেহেতু আত্মীয়তার সৃষ্টি, তাই আত্মীয়তা অর্থেও শব্দটি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। সুতরাং صلة الأرحام অর্থ যাদের সঙ্গে আত্মীয়তা আছে তাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক রক্ষা করা। এ সম্পর্কটি সর্বপ্রথম স্থাপিত হয় সন্তান-সন্ততি ও পিতা-মাতার মধ্যে। তাই صلة الأرحام ও আত্মীয়তারক্ষা বিষয়ে এদের অবস্থানই সর্বোচ্চে। তাদের পরবর্তী পর্যায়ে রয়েছে জন্মসূত্র সম্পর্কিত অন্যান্য আত্মীয়বর্গ, যেমন দাদা-দাদী, নানা-নানী, ভাইবোন, চাচা-ফুফু, মামা-খালা ও তাদের বংশধরগণ। সুতরাং সাধারণভাবে পিতা-মাতার আনুগত্য করা صلة الأرحام -এর অন্তর্ভুক্ত হলেও এ ক্ষেত্রে পিতা-মাতার স্থান যেহেতু সর্বোচ্চে, তাই ইমাম নববী রহ. এ অধ্যায়ের শিরোনামে তাদের জন্য بر الوالدين শব্দবন্ধকে প্রথমে উল্লেখ করেছেন, তারপর পৃথকভাবে অন্যান্য আত্মীয়বর্গের জন্য صلة الأرحام শব্দযূথ ব্যবহার করেছেন।
ইসলামে পিতা-মাতার আনুগত্য ও সেবাযত্ন করা এবং আত্মীয়তারক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। এর ফযীলতও বিশাল। কুরআন মাজীদ ও নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীছে এ সম্পর্কে বিস্তর আলোচনা আছে। ইমাম নববী রহ. সেরকম কিছু আয়াত ও হাদীছ এ অধ্যায়ে উল্লেখ করেছেন। আমরা নিচে তার বঙ্গানুবাদ ও সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা পেশ করছি। আল্লাহ তাবারাকা ওয়াতাআলাই তাওফীক দাতা।
‘পিতা-মাতার প্রতি সদ্ব্যবহার ও আত্মীয়তারক্ষা' সম্পর্কিত কিছু আয়াত
• এক নং আয়াত
وَاعْبُدُوا اللَّهَ وَلَا تُشْرِكُوا بِهِ شَيْئًا وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا وَبِذِي الْقُرْبَى وَالْيَتَامَى وَالْمَسَاكِينِ وَالْجَارِ ذِي الْقُرْبَى وَالْجَارِ الْجُنُبِ وَالصَّاحِبِ بِالْجَنْبِ وَابْنِ السَّبِيلِ وَمَا مَلَكَتْ أَيْمَانُكُمْ
অর্থ : তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর ও তাঁর সঙ্গে কাউকে শরীক করো না। পিতা- মাতার প্রতি সদ্ব্যবহার কর। আত্মীয়-স্বজন, ইয়াতীম, মিসকীন, নিকট প্রতিবেশী, দূর প্রতিবেশী, সঙ্গে বসা (বা দাঁড়ানো) ব্যক্তি, পথচারী এবং নিজের দাস-দাসীর প্রতিও (সদ্ব্যবহার কর)।৫২
ব্যাখ্যা
এ আয়াতে আল্লাহ তাআলার ইবাদত-বন্দেগীর হুকুম দেওয়ার পর কয়েক শ্রেণীর বান্দার হক আদায় ও তাদের প্রতি সদ্ব্যবহারের আদেশ করা হয়েছে। তাদের মধ্যে সর্বপ্রথম হচ্ছে পিতা-মাতা।
আল্লাহ তাআলার ইবাদত-বন্দেগীর আদেশদানের পরপর পিতা-মাতার প্রতি ভালো ব্যবহার করার আদেশ দেওয়ার কারণ বাহ্যত এই যে, আল্লাহ তাআলা হচ্ছেন মানুষের সৃষ্টিকর্তা । তারপর পিতা-মাতা তাদের দুনিয়ায় আসার মাধ্যম। মানুষের অস্তিত্বলাভে আল্লাহ তাআলার সৃজনক্ষমতাই আসল। তারপর পিতা-মাতার যেহেতু একটা বাহ্যিক ভূমিকা আছে, তাই কৃতজ্ঞতাস্বরূপ আল্লাহ তাআলার আনুগত্য করার পর পিতা-মাতার প্রতি সদ্ব্যবহার করার গুরুত্ব অন্য সবকিছুর চেয়ে বেশিই হওয়ার কথা ।
আয়াতটির বিস্তারিত ব্যাখ্যা এর আগের অধ্যায়ে গত হয়েছে।
• দুই নং আয়াত
وَاتَّقُوا اللَّهَ الَّذِي تَسَاءَلُونَ بِهِ وَالْأَرْحَامَ
অর্থ : আল্লাহকে ভয় কর, যার অছিলা দিয়ে তোমরা একে অন্যের কাছে (নিজেদের হক) চেয়ে থাক ।৫৩
ব্যাখ্যা
দুনিয়ায় মানুষ যখন একে অন্যের কাছে নিজের প্রাপ্য অধিকার দাবি করে, তখন অধিকাংশ সময়ই বলে থাকে, ‘আল্লাহর ওয়াস্তে তুমি আমাকে আমার পাওনা মিটিয়ে দাও,। আল্লাহ তাআলা এ আয়াতে বলছেন যে, তোমরা যখন নিজেদের হক ও প্রাপ্য অধিকারসমূহের ক্ষেত্রে আল্লাহ তাআলাকে অছিলা বানাও, তখন অন্যদের হক আদায়ের ব্যাপারেও আল্লাহ তাআলাকে ভয় কর এবং মানুষের সর্বপ্রকার হক পরিপূর্ণভাবে আদায় করে দাও। (তাওযীহুল কুরআন)
আয়াতটিতে এর আগে আছে-
يَاأَيُّهَا النَّاسُ اتَّقُوا رَبَّكُمُ الَّذِي خَلَقَكُمْ مِنْ نَفْسٍ وَاحِدَةٍ وَخَلَقَ مِنْهَا زَوْجَهَا وَبَثَّ مِنْهُمَا رِجَالًا كَثِيرًا وَنِسَاءً
'হে লোক সকল! নিজ প্রতিপালককে ভয় কর, যিনি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন। এক ব্যক্তি হতে এবং তারই থেকে তার স্ত্রীকে সৃষ্টি করেছেন। আর তাদের উভয় থেকে বহু নর-নারী (পৃথিবীতে) ছড়িয়ে দিয়েছেন।'
পূর্ণ আয়াতটিতে পর্যায়ক্রমে মৌলিক তিনটি বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে-
ক. সৃষ্টিকর্তা হওয়ার কারণে এক আল্লাহকে ভয় করা ও কেবল তাঁরই ইবাদত-আনুগত্য করা।
খ. একই আদম-সন্তান হওয়ার কারণে সমস্ত মানুষের অধিকার সম্পর্কে সচেতন থাকা। কোনও অবস্থায়ই কারও কোনও অধিকার হরণ না করা।
গ. অন্যান্য মানুষ অপেক্ষা আত্মীয়-স্বজনের সাথে ঘনিষ্ঠতা বেশি থাকায় তাদের অধিকারও যেহেতু অন্যদের তুলনায় বেশি, তাই তাদের অধিকারসমূহ আদায়ে অধিকতর যত্নবান থাকা ।
• তিন নং আয়াত
وَالَّذِينَ يَصِلُونَ مَا أَمَرَ اللَّهُ بِهِ أَنْ يُوصَلَ
অর্থ : আল্লাহ যে সম্পর্ক বজায় রাখতে আদেশ করেছেন, তারা তা বজায় রাখে।৫৪
ব্যাখ্যা
এর দ্বারা আত্মীয়তার সম্পর্ক বুঝানো হয়েছে। এ আয়াতটিসহ এর আগের ও পরের কয়েকটি আয়াতে প্রকৃত বুদ্ধিমানের কিছু সদ্গুণ উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন ধৈর্যধারণ করা, নামায পড়া, আল্লাহর পথে প্রকাশ্যে ও গোপনে খরচ করা, মন্দ ব্যবহারের জবাবে ভালো ব্যবহার করা এবং আল্লাহ তাআলা যে সম্পর্ক রক্ষা করার হুকুম দিয়েছেন সেই সম্পর্ক অর্থাৎ আত্মীয়তা রক্ষা করা। এসব গুণ যারা অর্জন করতে সক্ষম হয় তাদের পরিণাম শুভ। অর্থাৎ তারা জান্নাতবাসী হবে।
আত্মীয়তা রক্ষা করা মানে আত্মীয়দের খোঁজখবর রাখা, সামর্থ্য অনুযায়ী তাদের সাহায্য-সহযোগিতা করা ও তাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করা। ভালো ব্যবহার করার মানে তারা দুর্ব্যবহার করলেও তার জবাবে দুর্ব্যবহার না করা; বরং ক্ষমা করা এবং সর্বদা সুসম্পর্ক রক্ষায় সচেষ্ট থাকা। যেমন এক হাদীছে ইরশাদ হয়েছে-
لَيْسَ الْوَاصِلُ بِالْمُكَافِي، وَلَكِنَّ الْوَاصِلَ : الَّذِي إِذَا قُطِعَتْ رَحِمُهُ وَصَلَهَا
‘ওই ব্যক্তি আত্মীয়তা রক্ষাকারী নয়, যে কেবল (সদ্ব্যবহারের) প্রতিদান দেয়। বরং আত্মীয়তা রক্ষাকারী সে-ই, যার সঙ্গে আত্মীয়তা ছিন্ন করা হলে সে তা পুনঃস্থাপন করে।,৫৫
• চার নং আয়াত
وَوَصَّيْنَا الْإِنْسَانَ بِوَالِدَيْهِ حُسْنًا
অর্থ : আমি মানুষকে আদেশ করেছি তারা যেন পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার করে ।৫৬
ব্যাখ্যা
পিতা-মাতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার সম্পর্কে এ আয়াতটি একটি মূলনীতির মর্যাদা রাখে। পরিপূর্ণ আয়াতটি এরকম-
وَوَصَّيْنَا الْإِنْسَانَ بِوَالِدَيْهِ حُسْنًا وَإِنْ جَاهَدَاكَ لِتُشْرِكَ بِي مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ فَلَا تُطِعْهُمَا إِلَيَّ مَرْجِعُكُمْ فَأُنَبِّئُكُمْ بِمَا كُنْتُمْ تَعْمَلُونَ
‘আমি মানুষকে আদেশ করেছি তারা যেন পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার করে। তারা যদি আমার সাথে এমন কিছুকে শরীক করার জন্য তোমার উপর বলপ্রয়োগ করে, যার সম্পর্কে তোমার কাছে কোনও প্রমাণ নেই, তবে সে ব্যাপারে তাদের কথা মানবে না। আমারই কাছে তোমাদেরকে ফিরে আসতে হবে। তখন আমি তোমাদেরকে অবহিত করব তোমরা কী করতে।'
আয়াতটি নাযিল হয়েছে হযরত সা'দ ইবন আবী ওয়াক্কাস রাযি. ও তাঁর মা হামনা বিনত আবূ সুফয়ানকে কেন্দ্র করে। আশারায়ে মুবাশশারার অন্তর্ভুক্ত বিখ্যাত সাহাবী হযরত সা'দ ইবন আবী ওয়াক্কাস রাযি. ইসলামের প্রথম যুগেই ঈমান এনেছিলেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত মাতৃভক্ত। কিন্তু ইসলাম গ্রহণ করলে তাঁর মা তাঁর প্রতি অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হন। তিরস্কার করে বললেন, তুমি বাপ-দাদার ধর্ম ছেড়ে নতুন এক ধর্ম গ্রহণ করেছ! আল্লাহর কসম, তুমি যতক্ষণ না এ নতুন ধর্ম ত্যাগ করে বাপ-দাদার ধর্মে ফিরে আসবে, ততক্ষণ আমি কিছু খাব না, কিছু পানও করব না। এভাবেই মরে যাব। ফলে চিরকাল মানুষ এই বলে তোমার নিন্দা করবে যে, তুমি তোমার মাকে হত্যা করেছ। এতে হযরত সা'দ ইবন আবী ওয়াক্কাস রাযি. খুব পেরেশান হয়ে যান। এরই পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহ তাআলা আলোচ্য আয়াত নাযিল করেন।
এতে প্রথমত পিতা-মাতার প্রতি সদ্ব্যবহার করতে হুকুম দেওয়া হয়েছে। তারপর বলা হয়েছে, পিতা-মাতা আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরীক করার হুকুম দিলে তা মানা যাবে না। আল্লাহর সঙ্গে শরীক করাকে একটি অজ্ঞতাপ্রসূত কাজ সাব্যস্ত করা হয়েছে। নিখুঁত ও পূর্ণাঙ্গ জ্ঞান কেবল আল্লাহ তাআলারই আছে। মানুষের জ্ঞান ত্রুটিপূর্ণ ও অপূর্ণ। কাজেই আল্লাহ তাআলার হুকুমের বিপরীত কেউ কোনও হুকুম দিলে তা অজ্ঞতাপ্রসূতই বটে। যাবতীয় ভ্রান্ত বিশ্বাস অজ্ঞতাপ্রসূত বিশ্বাস এবং যাবতীয় পাপাচার ও নাফরমানির কাজ অজ্ঞতারই পরিচায়ক, তা বাহ্যদৃষ্টিতে মানুষের কাছে যতই জ্ঞান-যুক্তিভিত্তিক সাব্যস্ত হোক না কেন।
এর দ্বারা বুঝা গেল, আল্লাহর নাফরমানি হয় এমন কোনও কাজে মানুষের আনুগত্য করা জায়েয নয়। এক হাদীছে ইরশাদ হয়েছে-
لَا طَاعَةَ فِي مَعْصِيَةِ اللهِ، إِنَّمَا الطَاعَةُ فِي الْمَعْرُوفِ
‘আল্লাহর নাফরমানির কাজে বান্দার কোনও আনুগত্য নেই। বান্দার আনুগত্য করা যায় কেবল সৎকাজে।,৫৭
যাহোক আয়াতটি নাযিল হলে হযরত সা'দ রাযি.-এর পেরেশানি দূর হয়। তিনি নিজ করণীয় সম্পর্কে নির্দেশনা পেয়ে যান। ইমাম বাগাবী রহ.-এর বর্ণনায় আছে, এ আয়াত নাযিল হওয়ার পর হযরত সা'দ ইবন আবী ওয়াক্কাস রাযি.-এর মা একদিন একরাত অনাহারে কাটান, কিন্তু তবুও হযরত সা'দ রাযি. সত্যদীনের উপর অবিচল থাকেন। তিনি মায়ের কাছে এসে বললেন, আম্মা, আপনার যদি একশ'টিও প্রাণ থাকত এবং একটি একটি করে তার সবগুলো বের হয়ে যেত, তবুও আমি আমার এ দীন পরিত্যাগ করতাম না। এবার আপনার ইচ্ছা হলে পানাহার গ্রহণ করুন আর না হয় অনাহারেই থাকুন। তার মা বুঝে ফেললেন যে, পুত্রকে তার নতুন ধর্ম থেকে টলানো যাবে না। নিরাশ হয়ে পানাহার শুরু করে দিলেন।
• পাঁচ নং আয়াত
وَقَضَى رَبُّكَ أَلَّا تَعْبُدُوا إِلَّا إِيَّاهُ وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا إِمَّا يَبْلُغَنَّ عِنْدَكَ الْكِبَرَ أَحَدُهُمَا أَوْ كِلَاهُمَا فَلَا تَقُلْ لَهُمَا أُفٍّ وَلَا تَنْهَرْهُمَا وَقُلْ لَهُمَا قَوْلًا كَرِيمًا (23) وَاخْفِضْ لَهُمَا جَنَاحَ الذُّلِّ مِنَ الرَّحْمَةِ وَقُلْ رَبِّ ارْحَمْهُمَا كَمَا رَبَّيَانِي صَغِيرًا
অর্থ : তোমার প্রতিপালক নির্দেশ দিয়েছেন যে, তাকে ছাড়া অন্য কারও ইবাদত করো না, পিতা-মাতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করো, পিতা-মাতার কোনও একজন কিংবা উভয়ে যদি তোমার কাছে বার্ধক্যে উপনীত হয়, তবে তাদেরকে উফ্ পর্যন্ত বলো না এবং তাদেরকে ধমক দিও না; বরং তাদের সঙ্গে সম্মানজনক কথা বলো। এবং তাদের প্রতি মমতাপূর্ণ আচরণের সঙ্গে তাদের সামনে নিজেকে বিনয়াবনত করো আর দু'আ করো, হে আমার প্রতিপালক! তারা যেভাবে আমার শৈশবে আমাকে লালন-পালন করেছে, তেমনি আপনিও তাদের প্রতি রহমতের আচরণ করুন।৫৮
ব্যাখ্যা
এ দুই আয়াতে আল্লাহ তাআলা পিতা-মাতার প্রতি সদ্ব্যবহার সম্পর্কে কয়েকটি নির্দেশনা দিয়েছেন। শুরুতে কেবল আল্লাহ তাআলারই ইবাদত করার হুকুম দেওয়া হয়েছে। তারপর ইরশাদ হয়েছে- وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا (পিতা-মাতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করো)। এটা তাদের প্রতি সাধারণভাবে সদ্ব্যবহারের হুকুম। এরপর এ হুকুমের খানিকটা ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে, যা দ্বারা সদ্ব্যবহারের বিশেষ কয়েকটি দিক পরিস্ফুট হয়েছে।
সুতরাং ইরশাদ হয়েছে—
إِمَّا يَبْلُغَنَّ عِنْدَكَ الْكِبَرَ أَحَدُهُمَا أَوْ كِلَاهُمَا فَلَا تَقُلْ لَهُمَا أُفٍّ
(পিতা-মাতার কোনও একজন কিংবা উভয়ে যদি তোমার কাছে বার্ধক্যে উপনীত হয়, তবে তাদেরকে উফ্ পর্যন্ত বলো না)। ‘উফ্’ শব্দটি বিরক্তি প্রকাশক ও অপ্রীতিব্যাঞ্জক। উফ্ পর্যন্ত বলো না- এর অর্থ, তাদের প্রতি বিরক্তি প্রকাশ করো না এবং তাদেরকে বিরক্তিসূচক কোনও কথা বলো না, যেমন তারা যদি কোনও কথা বার বার বলে বা অপ্রয়োজনীয় কোনও কথা বলে, যেমনটা বৃদ্ধ ও শিশুরা করে থাকে, তখন বিরক্তির সাথে তার জবাব দিও না।
আয়াতে পিতা-মাতার সঙ্গে উফ্ বা বিরক্তিসূচক কোনও শব্দ ব্যবহার নিষেধ করার দ্বারা বুঝা গেল এটা জায়েয নয়। পিতা-মাতার সঙ্গে যখন এরূপ শব্দ ও ভাষা ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ, তখন তাদেরকে সরাসরি কষ্ট দেওয়া যে আরও কতটা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ হবে তা বলাই বাহুল্য। কিন্তু অনেক সময় সেদিকে লক্ষ রাখা হয় না। কেউ তো পিতা- মাতাকে খাওয়ায় কষ্ট দেয়। কেউ বা পোশাক-আশাকে। অনেকে তাদের স্বাস্থ্যের দিকেও লক্ষ রাখে না। অসুস্থ হলে চিকিৎসার যথাযথ ব্যবস্থা নেয় না। এদিকেও লক্ষ করা হয় না যে, পিতা-মাতা যে ঘরে বা যে কামরায় থাকে তা তাদের পক্ষে কষ্টদায়ক নয় তো! মোটকথা তাদের শারীরিক বা মানসিক কষ্ট নানাভাবেই দেওয়া হয়ে থাকে। তা সবই এ আয়াতের হুকুমের পরিপন্থী। এ ব্যাপারে প্রত্যেক সন্তানের সচেতন থাকা উচিত। আবার অনেকে তো পিতা-মাতাকে তীব্র ভাষায় আক্রমণও করে। আয়াতে পরের বাক্যে এ ব্যাপারে সতর্ক করা হয়েছে।
ইরশাদ হয়েছে- وَلَا تَنْهَرْهُمَا (এবং তাদেরকে ধমক দিও না)। অনেক সময় পিতা-মাতার কোনও কথা বা কোনও কাজ পসন্দ না হলে সন্তান তাদেরকে ধমক দিয়ে বসে। পসন্দ-অপসন্দের বিষয়টি কখনও রুচি-প্রকৃতির প্রভেদের কারণেও হয় এবং কখনও হয় সময়ের ব্যবধানের কারণে। সন্তানকে এটা বুঝতে হবে। বৃদ্ধ পিতা-মাতার রুচি-অভিরুচি কেন আমার মত নয় কিংবা পিতা-মাতা কেন আমার সময়কালের রুচি-অভিরুচি বুঝতে পারে না, কেন লোকজনের সামনে সময়োপযোগী কথা বলে না—এসব বিবেচনায় তাদের প্রতি বিরক্ত না হয়ে বরং সন্তানের কর্তব্য হবে পিতা-মাতার দীর্ঘদিনের অভ্যাসকে সম্মান জানানো ও তাদের লালিত রুচি-প্রকৃতির মূল্য দেওয়া। এভাবে চিন্তা করা হয় না বলেই অনেক সন্তান পিতা-মাতার আচরণে যন্ত্রণাবোধ করে। ফলে বিরক্ত হয়ে অনেক সময় ধমক দিয়ে বসে। কোনও কোনও দুর্ভাগা তো রীতিমত গালাগালিই করে। এটা অত্যন্ত ধ্বংসকর আচরণ। এরূপ অবাধ্য সন্তান নিজ আখেরাত তো বরবাদ করেই, দুনিয়ায়ও তাকে কঠিন দুর্ভোগের সম্মুখীন হতে হয়। এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
كُلُّ الذُّنُوبِ يَغْفِرُ اللهُ مِنْهَا مَا شَاءَ إِلَّا عُقُوْقَ الْوَالِدَيْنِ، فَإِنَّهُ يُعَجِّلُ لِصَاحِبِهِ فِي الْحَيَاةِ قَبْلَ الْمَمَاتِ
‘সমস্ত পাপের ক্ষেত্রেই নিয়ম এই যে, আল্লাহ তাআলা তা থেকে যা ইচ্ছা মাফ করে দেবেন। কিন্তু পিতা-মাতার অবাধ্যতা এর ব্যতিক্রম। কেননা আল্লাহ এই অপরাধের অপরাধীকে মৃত্যুর আগে এ দুনিয়ায়ই নগদ শাস্তি দিয়ে দেন।,৫৯
সুতরাং প্রত্যেক সন্তানের এরূপ আচরণ থেকে বিরত হওয়া একান্ত কর্তব্য। সর্বাবস্থায়ই সন্তানদেরকে পিতা-মাতার সঙ্গে শান্তিদায়ী আচরণ করতে হবে। কথা বলতে হবে সম্মানজনক। সুতরাং এর পরবর্তী বাক্যে ইরশাদ হয়েছে-
وَقُلْ لَّهُمَا قَوْلًا كَرِيمًا
(বরং তাদের সঙ্গে সম্মানজনক কথা বলো)। অর্থাৎ যখনই তাদের সঙ্গে কথা বলবে, তখন মাথায় এই চিন্তা-চেতনা জাগ্রত রেখে কথা বলবে যে, তারা আমার পিতা-মাতা, সর্বাপেক্ষা শ্রদ্ধাভক্তির পাত্র। কেউ কেউ বলেন, একজন কঠোর স্বভাবের মানবের সঙ্গে তার অনুগত ও বাধ্যগত গোলাম যেমন নম্র ও বিনীত ভঙ্গিতে কথা বলে, প্রত্যেক সন্তানকে তার পিতা-মাতার সঙ্গে ঠিক সেইভাবে কথা বলতে হবে। পরবর্তী আয়াতে ইরশাদ হয়েছে-
وَاخْفِضْ لَهُمَا جَنَاحَ الذُّلِّ مِنَ الرَّحْمَةِ
(এবং তাদের প্রতি মমতাপূর্ণ আচরণের সঙ্গে তাদের সামনে নিজেকে বিনয়াবনত করো)। অর্থাৎ তাদের জন্য তোমার দু'হাত নম্র-কোমল রাখ। এর দ্বারা তাদের প্রতি বিনীত ও উদার থাকতে হুকুম করা হয়েছে। কাজেই তাদের সঙ্গে আচার-আচরণ করতে হবে অত্যন্ত আদবের সঙ্গে। খুব সতর্ক থাকতে হবে যাতে কোনও অবস্থায়ই তাদের সঙ্গে বেআদবী না হয়ে যায়। এমনিভাবে নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী তাদের প্রয়োজন পূরণেও সচেষ্ট থাকতে হবে। তাদের যা-কিছু পসন্দ তা পূরণে অকাতরে টাকাপয়সা খরচ করবে।
বলা হয়েছে বৃদ্ধ পিতা-মাতার প্রতি আচরণ করতে হবে মমতাপূর্ণ। কেননা আজ তারা বার্ধক্যের কারণে তোমার উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। স্মরণ কর, আজ তারা যেমন তোমার উপর নির্ভরশীল, তেমনি তুমিও একদিন তাদের উপর এরকম নির্ভরশীল ছিলে। তখন তারা পরম মমতায় নিজেদের সুখ ও আরাম ভুলে তোমার সুখ ও আরামের প্রতি লক্ষ রাখতেন। কাজেই আজ তাদের এই দুর্বল অবস্থায় তোমারও উচিত সর্বোচ্চ ধৈর্যের সঙ্গে তাদের প্রতি মমত্বপূর্ণ আচরণ করে যাওয়া।
এ তো গেল পিতা-মাতার সেবাযত্নে নিজ শক্তি-সামর্থ্য ব্যয় করার ব্যাপার। প্রকৃত সুখ-শান্তিদাতা তো আল্লাহ তাআলাই । আল্লাহ তাআলা না চাইলে কোনও বান্দা হাজার চেষ্টা করেও কাউকে সুখ দিতে পারে না। বিশেষত আখেরাতের মুক্তি ও নাজাতের ব্যাপারে কেউ তো বাহ্যিকভাবেও কিছু করতে পারে না। তা সম্পূর্ণই আল্লাহ তাআলার এখতিয়ারে। তাই সন্তানের কর্তব্য পিতা-মাতার প্রতি যত্ন নেওয়ার পাশাপাশি তাদের দোজাহানের শান্তি ও মুক্তির জন্য আল্লাহ তাআলার কাছে দুআ করাও। আয়াতের পরবর্তী অংশে সে দুআই শিক্ষা দেওয়া হয়েছে—
وَقُلْ رَبِّ ارْحَمْهُمَا كَمَا رَبَّيَانِي صَغِيرًا
(আর দু'আ করো, হে আমার প্রতিপালক! তারা যেভাবে আমার শৈশবে আমাকে লালন-পালন করেছে, তেমনি আপনিও তাদের প্রতি রহমতের আচরণ করুন)। অর্থাৎ আমি যখন নিতান্তই দুর্বল ছিলাম, তখন তারা আমার লালন-পালনের জন্য নিজের সমস্ত সুখ ও আরাম বিসর্জন দিয়েছিলেন। নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী তারা আমার আরাম ও কল্যাণের সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিলেন। কোনও বিপদ-আপদ যাতে আমাকে স্পর্শ করতে না পারে, সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রেখেছিলেন। এমনকি আমার বর্তমান ও ভবিষ্যৎ কল্যাণের জন্য তারা প্রয়োজনে জীবনের ঝুঁকি নিতেও প্রস্তুত থাকতেন। আজ তারা বয়সের ভারে ক্লান্ত-শ্রান্ত। হে আল্লাহ! আপনার তাওফীকে আমি তো আমার সামর্থ্য অনুযায়ী তাদের খেদমত করে যাচ্ছি। কিন্তু সন্তান হিসেবে যা কর্তব্য তা ঠিক পালন করা হচ্ছে না। সুতরাং হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে নিবেদন করছি, আপনি আজ তাদের প্রতি নিজ রহমত জারি রাখুন এবং মৃত্যুর পরও তাদের প্রতি আপন দয়ামায়ার আচরণ করুন।
• ছয় নং আয়াত
وَوَصَّيْنَا الْإِنْسَانَ بِوَالِدَيْهِ حَمَلَتْهُ أُمُّهُ وَهْنًا عَلَى وَهْنٍ وَفِصَالُهُ فِي عَامَيْنِ أَنِ اشْكُرْ لِي وَلِوَالِدَيْكَ إِلَيَّ الْمَصِيرُ
অর্থ : আমি মানুষকে তার পিতা-মাতা সম্পর্কে নির্দেশ দিয়েছি- (কেননা) তার মা কষ্টের পর কষ্ট সয়ে তাকে গর্ভে ধারণ করেছে আর তার দুধ ছাড়ানো হয় দু' বছরে- তুমি শোকর আদায় কর আমার এবং তোমার পিতা-মাতার। আমারই কাছে (তোমাদেরকে) ফিরে আসতে হবে।৬০
ব্যাখ্যা
এটি সূরা লুকমানের ১৪ নং আয়াত। এর পরের আয়াতটি এরকম-
وَإِنْ جَاهَدَاكَ عَلَى أَنْ تُشْرِكَ بِي مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ فَلَا تُطِعْهُمَا وَصَاحِبْهُمَا فِي الدُّنْيَا مَعْرُوفًا وَاتَّبِعْ سَبِيلَ مَنْ أَنَابَ إِلَيَّ ثُمَّ إِلَيَّ مَرْجِعُكُمْ فَأُنَبِّئُكُمْ بِمَا كُنْتُمْ تَعْمَلُونَ
‘তারা যদি এমন কাউকে (প্রভুত্বে) আমার সমকক্ষ সাব্যস্ত করার জন্য তোমাকে চাপ দেয়, যে সম্পর্কে তোমার কোনও জ্ঞান নেই, তবে তাদের কথা মানবে না। অবশ্য দুনিয়ায় তাদের সাথে সদ্ভাবে থাকবে। এমন ব্যক্তির পথ অবলম্বন করো, যে একান্তভাবে আমার অভিমুখী হয়েছে। অতঃপর তোমাদের সকলকে আমারই কাছে ফিরে আসতে হবে। তখন আমি তোমাদেরকে অবহিত করব তোমরা যা-কিছু করতে।৬১
এ আয়াতদু'টির আগে ও পরে হযরত লুকমান আলাইহিস সালামের উপদেশ বর্ণিত হয়েছে। সে উপদেশ তিনি করেছিলেন নিজ পুত্রকে লক্ষ্য করে। তাতে পুত্রকে সাবধান করেছিলেন যেন কিছুতেই আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরীক না করে। তাঁর উপদেশের মাঝখানে এ দুই আয়াতে আল্লাহ তাআলার পক্ষ হতে বিশেষভাবে পিতা-মাতার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
শিরক পরিহারের নির্দেশের সাথে এর সম্পর্ক এই যে, হযরত লুকমান তো নিজ পুত্রকে শিরক থেকে বেঁচে থাকার ও তাওহীদকে আঁকড়ে ধরার উপদেশ দিচ্ছিলেন, অপর দিকে মক্কা মুকাররমার মুশরিকগণ হযরত লুকমানকে একজন মহাজ্ঞানী লোক হিসেবে স্বীকার করা সত্ত্বেও, যখন তাদের সন্তানগণ তাওহীদী আকীদা অবলম্বন করল, তখন তারা তাদেরকে তা থেকে ফেরানোর এবং পুনরায় শিরকে লিপ্ত করার জন্য জোরদার চেষ্টা করছিল। তাদের মুমিন সন্তানগণ এক্ষেত্রে পিতা-মাতার সঙ্গে কীরূপ আচরণ করবে তা নিয়ে বেজায় পেরেশান ছিল। তাই আল্লাহ তাআলা এ আয়াত দ্বারা তাদেরকে পথনির্দেশ করছেন যে, আমিই মানুষকে আদেশ করেছি, তারা যেন আল্লাহ তাআলার সাথে তাদের পিতা-মাতারও শোকর আদায় করে। কেননা যদিও তাদের সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তাআলা, কিন্তু বাহ্যিক কারণ হিসেবে তাদের দুনিয়ায় আগমনের পেছনে পিতা-মাতার ভূমিকাই প্রধান।
পিতা-মাতার মধ্যেও আবার বিশেষভাবে মায়ের কষ্ট-মেহনতের কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে-
حَمَلَتْهُ أُمُّهُ وَهْنًا عَلَى وَهْنٍ وَفِصَالُهُ فِي عَامَيْنِ
(তার মা কষ্টের পর কষ্ট সয়ে তাকে গর্ভে ধারণ করেছে আর তার দুধ ছাড়ানো হয় দু' বছরে)। মা কতইনা কষ্টের সাথে তাকে নিজ গর্ভে ধারণ করে রাখেন। তারপর একটানা দু'বছর তাকে দুধ পান করায়। বলাবাহুল্য শিশুর লালন-পালনের সুদীর্ঘ সময়ের ভেতর দুধ পানের সময়টাই মায়ের জন্য বেশি কষ্ট-ক্লেশের হয়ে থাকে। এসব কারণে মা'ই সন্তানের পক্ষ হতে সদ্ব্যবহারের বেশি হকদার। কিন্তু এই সদ্ব্যবহারের অর্থ এ নয় যে, মানুষ তার দীন ও ঈমানের প্রশ্নে আল্লাহ তাআলার হুকুমকে পাশ কাটিয়ে পিতা-মাতার হুকুম মানতে শুরু করে দেবে।
এ বিষয়টা স্মরণে রাখার জন্যই আয়াতে পিতা-মাতার শোকর আদায়ের নির্দেশ দেওয়ার আগে আল্লাহ তাআলার শোকর আদায়ের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে- أَنِ اشْكُرْ لِي وَلِوَالِدَيْكَ (তুমি শোকর আদায় কর আমার এবং তোমার পিতা-মাতার)। কেননা পিতা-মাতা তো এক বাহ্যিক 'কারণ' ও মাধ্যম মাত্র। মানুষের প্রতিপালনের ব্যবস্থা হিসেবে এ কারণ আল্লাহ তাআলাই সৃষ্টি করেছেন। প্রকৃত স্রষ্টা ও প্রতিপালক আল্লাহ তাআলাই। কাজেই এই বাহ্যিক কারণ ও মাধ্যমের গুরুত্ব কখনওই প্রকৃত স্রষ্টা ও আসল প্রতিপালকের গুরুত্ব অপেক্ষা বেশি হতে পারে না। তাই বলে তাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহারও করা যাবে না। ইরশাদ হয়েছে- وَصَاحِبْهُمَا فِي الدُّنْيَا مَعْرُوفًا (অবশ্য দুনিয়ায় তাদের সাথে সদ্ভাবে থাকবে)।
অর্থাৎ দীনের ব্যাপারে পিতা-মাতা কোনও অন্যায় কথা বললে তা মানা তো জায়ে হবে না, কিন্তু তাদের কথা এমন পন্থায় রদ করা যাবে না, যা তাদের জন্য কষ্টদায়ক হয় বা যাতে তারা নিজেদেরকে অপমানিত বোধ করে। বরং তাদেরকে নম্র ভাষায় বুঝিয়ে দেওয়া উচিত যে, আমি আপনাদের কথা মানতে অপারগ।
কেবল এতটুকুই নয়, বরং সাধারণভাবে অন্যান্য সকল ক্ষেত্রেই তাদের সাথে সদাচরণ করতে হবে। তাদের খেদমত করতে হবে, আর্থিকভাবে তাদের সাহায্য করতে হবে এবং তারা অসুস্থ হয়ে পড়লে তাদের সেবা-যত্ন করতে হবে ইত্যাদি। মূলত এ নসীহতের সম্পর্ক পিতা-মাতার খেদমতের সঙ্গে। তাদের আনুগত্য করা যাবে কেবল এমন বিষয়েই, যা শরীআতসম্মত হয়। সুতরাং আয়াতের পরের অংশে ইরশাদ হয়েছে-
وَاتَّبِعْ سَبِيلَ مَنْ أَنَابَ إِلَيَّ ثُمَّ إِلَيَّ مَرْجِعُكُمْ فَأُنَبِّئُكُمْ بِمَا كُنْتُمْ تَعْمَلُونَ
(এমন ব্যক্তির পথ অবলম্বন করো, যে একান্তভাবে আমার অভিমুখী হয়েছে। অতঃপর তোমাদের সকলকে আমারই কাছে ফিরে আসতে হবে। তখন আমি তোমাদেরকে অবহিত করব তোমরা যা-কিছু করতে)। অর্থাৎ মাতা-পিতা ভ্রান্ত পথে থাকলে তাদের পথ অবলম্বন করা যাবে না কিছুতেই; বরং পথ অবলম্বন করতে হবে কেবল তাদেরই, যারা আল্লাহ তাআলার সঙ্গে সুদৃঢ় সম্পর্ক রক্ষা করে চলে। অর্থাৎ কেবল তাঁরই ইবাদত ও আনুগত্য করে।
এর ভেতর এই ইঙ্গিতও রয়েছে যে, দীনের অনুসরণও কেবল নিজ বুদ্ধি-বিবেচনার ভিত্তিতে করা ঠিক নয়; বরং যারা আল্লাহ তাআলার আশেক ও তাঁর পরিপূর্ণ অনুগত বলে পরিষ্কারভাবে জানা আছে, দেখতে হবে তারা দীনের অনুসরণ করে কিভাবে এবং তাদের আমলের ধরন কী? তারা যে কাজ যেভাবে করেন ঠিক সেভাবেই তা সম্পাদন করা চাই। সমস্ত আমলে তাদেরই পথ অনুসরণ করা চাই। এ কারণেই বলা হয়ে থাকে এবং যথার্থই বলা হয়ে থাকে যে, ব্যক্তিগত পড়াশোনার ভিত্তিতে কুরআন ও হাদীছের এমন কোনও ব্যাখ্যা করা ও তা থেকে এমন কোনও সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া কিছুতেই সমীচীন নয়, যা উম্মতের উলামায়ে কেরাম ও বুযুর্গানে দীন থেকে প্রাপ্ত ব্যাখ্যার পরিপন্থী। (তাওযীহুল কুরআন)
৫২. সূরা নিসা (৪), আয়াত ৩৬
৫৩. সূরা নিসা (৪), আয়াত ১
৫৪. সূরা রা'দ (১৩), আয়াত ২১
৫৫. সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৫৯৯১; সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ১৬৯৭; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ১৯০৮; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ৬৭৮৫; আল-আদাবুল মুফরাদ, হাদীছ নং ৬৮; বায়হাকী, আস্সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ১৩২১৯; তবারানী, আল-মু'জামুল আওসাত, হাদীছ নং ৫৬২৬; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ, হাদীছ নং ৩৪৪২
৫৬. সূরা আনকাবূত (২৯), আয়াত ৮
৫৭. সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ১৮৪০; সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ২৬২৫; সুনানে নাসাঈ, হাদীছ নং ৪২০৫; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ৭২৪; সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ৪৫৬৭; বায়হাকী, আস্ সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ১৬৬০৯
৫৮. সূরা বনী ইসরাঈল (১৭), আয়াত ২৩,২৪
৫৯. বায়হাকী, শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ৭৫০৬; খারাইতী, মাসাবিউল আখলাক, হাদীছ নং ২৩৬
৬০. সূরা লুকমান (৩১), আয়াত ১৪
৬১. সূরা লুকমান (৩১), আয়াত ১৫
কোন্ আমল আল্লাহর কাছে সর্বাপেক্ষা বেশি প্রিয়
হাদীছ নং : ৩১২
হযরত আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করলাম, আল্লাহর কাছে কোন্ আমল সর্বাপেক্ষা বেশি প্রিয়? তিনি বললেন, ‘ওয়াক্তমত নামায পড়া,। জিজ্ঞেস করলাম, তারপর কোনটি? তিনি বললেন, ‘পিতা-মাতার সঙ্গে সদ্বব্যবহার করা,। ফের জিজ্ঞেস করলাম, তারপর কোনটি? তিনি বললেন, ‘আল্লাহর পথে জিহাদ করা,-বুখারী ও মুসলিম।
সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ২৭৮২; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ৮২; সুনানে নাসাঈ, হাদীছ নং ৬১০; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ১৮৯৮; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ৩৮৯০; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীছ নং ১৪৭৬; মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বাহ, হাদীছ নং ১৯৩০৮; তবারানী, আল-মু'জামুল কাবীর, হাদীছ নং ৯৮০২
হাদীছ নং : ৩১২
হযরত আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করলাম, আল্লাহর কাছে কোন্ আমল সর্বাপেক্ষা বেশি প্রিয়? তিনি বললেন, ‘ওয়াক্তমত নামায পড়া,। জিজ্ঞেস করলাম, তারপর কোনটি? তিনি বললেন, ‘পিতা-মাতার সঙ্গে সদ্বব্যবহার করা,। ফের জিজ্ঞেস করলাম, তারপর কোনটি? তিনি বললেন, ‘আল্লাহর পথে জিহাদ করা,-বুখারী ও মুসলিম।
সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ২৭৮২; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ৮২; সুনানে নাসাঈ, হাদীছ নং ৬১০; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ১৮৯৮; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ৩৮৯০; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীছ নং ১৪৭৬; মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বাহ, হাদীছ নং ১৯৩০৮; তবারানী, আল-মু'জামুল কাবীর, হাদীছ নং ৯৮০২
40 - باب بر الوالدين وصلة الأرحام
قَالَ الله تَعَالَى: {وَاعْبُدُوا اللهَ وَلا تُشْرِكُوا بِهِ شَيْئًا وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا وَبِذِي الْقُرْبَى وَالْيَتَامَى وَالْمَسَاكِينِ وَالْجَارِ ذِي الْقُرْبَى وَالْجَارِ الْجُنُبِ وَالصَّاحِبِ بِالْجَنْبِ (1) وَابْنِ السَّبِيلِ وَمَا مَلَكَتْ أَيْمَانُكُمْ} [النساء: 36]، وَقالَ تَعَالَى: {وَاتَّقُوا اللهَ الَّذِي تَسَاءلُونَ بِهِ وَالأَرْحَام} [النساء: 1]، وَقالَ تَعَالَى: {وَالَّذِينَ يَصِلُونَ مَا أَمَرَ اللهُ بِهِ أَنْ يُوصَلَ} [الرعد: 21]، وَقالَ تَعَالَى: {وَوَصَّيْنَا الأِنْسَانَ بِوَالِدَيْهِ حُسْنًا} [العنكبوت: 8]، وَقالَ تَعَالَى: {وَقَضَى رَبُّكَ أَلاَّ تَعْبُدُوا إِلاَّ إِيَّاهُ وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا إِمَّا يَبْلُغَنَّ عِنْدَكَ الْكِبَرَ أَحَدُهُمَا أَوْ كِلاهُمَا فَلا تَقُلْ لَهُمَا أُفٍّ وَلا تَنْهَرْهُمَا وَقُلْ لَهُمَا قَوْلًا كَرِيمًا وَاخْفِضْ لَهُمَا جَنَاحَ الذُّلِّ مِنَ الرَّحْمَةِ وَقُلْ رَبِّ ارْحَمْهُمَا كَمَا رَبَّيَانِي صَغِيرًا} [الإسراء: 23 - 24]، وَقالَ تَعَالَى: {وَوَصَّيْنَا الأِنْسَانَ بِوَالِدَيْهِ حَمَلَتْهُ أُمُّهُ وَهْنًا عَلَى وَهْنٍ وَفِصَالُهُ فِي عَامَيْنِ أَنِ اشْكُرْ لِي وَلِوَالِدَيْك} [لقمان: 14].
قَالَ الله تَعَالَى: {وَاعْبُدُوا اللهَ وَلا تُشْرِكُوا بِهِ شَيْئًا وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا وَبِذِي الْقُرْبَى وَالْيَتَامَى وَالْمَسَاكِينِ وَالْجَارِ ذِي الْقُرْبَى وَالْجَارِ الْجُنُبِ وَالصَّاحِبِ بِالْجَنْبِ (1) وَابْنِ السَّبِيلِ وَمَا مَلَكَتْ أَيْمَانُكُمْ} [النساء: 36]، وَقالَ تَعَالَى: {وَاتَّقُوا اللهَ الَّذِي تَسَاءلُونَ بِهِ وَالأَرْحَام} [النساء: 1]، وَقالَ تَعَالَى: {وَالَّذِينَ يَصِلُونَ مَا أَمَرَ اللهُ بِهِ أَنْ يُوصَلَ} [الرعد: 21]، وَقالَ تَعَالَى: {وَوَصَّيْنَا الأِنْسَانَ بِوَالِدَيْهِ حُسْنًا} [العنكبوت: 8]، وَقالَ تَعَالَى: {وَقَضَى رَبُّكَ أَلاَّ تَعْبُدُوا إِلاَّ إِيَّاهُ وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا إِمَّا يَبْلُغَنَّ عِنْدَكَ الْكِبَرَ أَحَدُهُمَا أَوْ كِلاهُمَا فَلا تَقُلْ لَهُمَا أُفٍّ وَلا تَنْهَرْهُمَا وَقُلْ لَهُمَا قَوْلًا كَرِيمًا وَاخْفِضْ لَهُمَا جَنَاحَ الذُّلِّ مِنَ الرَّحْمَةِ وَقُلْ رَبِّ ارْحَمْهُمَا كَمَا رَبَّيَانِي صَغِيرًا} [الإسراء: 23 - 24]، وَقالَ تَعَالَى: {وَوَصَّيْنَا الأِنْسَانَ بِوَالِدَيْهِ حَمَلَتْهُ أُمُّهُ وَهْنًا عَلَى وَهْنٍ وَفِصَالُهُ فِي عَامَيْنِ أَنِ اشْكُرْ لِي وَلِوَالِدَيْك} [لقمان: 14].
312 - وعن أَبي عبد الرحمان عبد الله بن مسعود - رضي الله عنه - قَالَ: سألت النبي - صلى الله عليه وسلم: أيُّ العَمَلِ أحَبُّ إِلَى اللهِ تَعَالَى؟ قَالَ: «الصَّلاةُ عَلَى وَقْتِهَا»، قُلْتُ: ثُمَّ أي؟ قَالَ: «بِرُّ الوَالِدَيْنِ»، قُلْتُ: ثُمَّ أيٌّ؟ قَالَ: «الجِهَادُ في سبيلِ الله». مُتَّفَقٌ عَلَيهِ. (1)
হাদীসের ব্যাখ্যা:
এ হাদীছ দ্বারা নেক আমলের প্রতি সাহাবায়ে কেরামের আগ্রহ-উদ্দীপনার পরিচয় পাওয়া যায়। জানতে চাচ্ছেন, আল্লাহ তাআলার কাছে কোন আমল সবচে' বেশি প্রিয়। অর্থাৎ কোন আমল করলে আল্লাহ তাআলার বেশি নৈকট্য লাভ হবে। এ জিজ্ঞেস করার উদ্দেশ্য আল্লাহর কাছে যে আমল বেশি প্রিয় এবং যা দ্বারা তাঁর নৈকট্য বেশি লাভ হবে তাতে বেশি যত্নবান থাকা। দুনিয়াদারীতেও মানুষ সবচে' বেশি লাভজনক কাজ খোঁজে। সাহাবায়ে কেরামের অভ্যাস ছিল যে কাজ আখেরাতের পক্ষে বেশি লাভজনক তা জেনে নিয়ে তাতে বেশি বেশি মশগুল থাকা। এটা তাঁদের আখেরাতমুখী মানসিকতার পরিচায়ক।
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উত্তরে জানালেন, ওয়াক্তমত নামায পড়া। অর্থাৎ ঈমানের পর ওয়াক্তমত নামায পড়া শ্রেষ্ঠতম আমল। এটাই আল্লাহ তাআলার কাছে সবচে' বেশি পসন্দ এবং এর দ্বারাই আল্লাহ তাআলার বেশি নৈকট্য লাভ করা যায়। অপর এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন الصلاة خير موضوع، فمن استطاع أن يستكثر فليستكثر 'নামায আল্লাহপ্রদত্ত শ্রেষ্ঠতম কাজ। যার পক্ষে সম্ভব সে যেন তা বেশি বেশি করে। ৬৩
ওয়াক্তমত নামায পড়া যখন শ্রেষ্ঠ আমল, তখন প্রত্যেকের উচিত পাঁচ ওয়াক্ত নামায ওয়াক্তমত আদায়ে সচেষ্ট থাকা। সতর্ক থাকা উচিত যাতে ইচ্ছাকৃতভাবে কোনও নামায কাযা না হয়ে যায়। ইচ্ছাকৃত নামায কাযা করা কবীরা গুনাহ। হাঁ, অসুস্থতা, ঘুম, শত্রুর হামলা বা অন্য কোনও গ্রহণযোগ্য ওযরের কারণে ওয়াক্তমত আদায় করতে না পারলে ভিন্ন কথা, তাতে গুনাহ নেই।
হযরত আব্দুল্লাহ ইবন মাসঊদ রাযি. জানতে চাইলেন, তারপর অর্থাৎ নামাযের পর কোন আমল আল্লাহর কাছে সর্বাপেক্ষা বেশি প্রিয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, পিতা-মাতার আনুগত্য।
এর দ্বারা বোঝা গেল বান্দার হক আদায় করাও আল্লাহ তাআলার কাছে প্রিয় আমল। এর দ্বারাও আল্লাহ তাআলার নৈকট্য লাভ হয়। আরও বোঝা গেল বান্দার হকসমূহের মধ্যে পিতা-মাতার আনুগত্য করার স্থান সবার উপরে। সুতরাং যদি কেউ আল্লাহ তাআলার কোনও প্রিয় আমলের মাধ্যমে তাঁর নৈকট্য অর্জন করতে চায়, তবে তার উচিত পিতা-মাতার আনুগত্য করা, তাদের বেশি বেশি খেদমত করা এবং তাদেরকে খুশি রাখতে সচেষ্ট থাকা।
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ হাদীছে তৃতীয় পর্যায়ে আল্লাহ তাআলার বেশি প্রিয় আমল হিসেবে জিহাদের কথা উল্লেখ করেছেন। অর্থাৎ আল্লাহ তাআলার কালেমা ও তাঁর দেওয়া দীন প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে সসস্ত্র সংগ্রাম করা। কুরআন মাজীদের বিভিন্ন আয়াতে জিহাদের উচ্চ ফযীলত বর্ণিত হয়েছে। এ সম্পর্কে হাদীছও আছে প্রচুর। বস্তুত এটি ইসলামের এক স্থায়ী বিধান। এ বিধান কিয়ামত পর্যন্ত বলবৎ থাকবে। এর জন্য প্রত্যেক মুমিনের সর্বদা প্রস্তুত থাকা উচিত। অন্তরে দৃঢ় সংকল্প রাখা উচিত যে, যখনই আল্লাহর পথে জিহাদের অবকাশ আসবে, নিজ জান-মাল নিয়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাতে অংশগ্রহণ করবে।
এ হাদীছে লক্ষণীয় যে, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পিতা-মাতার আনুগত্য করাকে জিহাদের মাঝখানে স্থান দিয়েছেন। নামাযকে হাদীছে দীনের স্তম্ভ বলা হয়েছে। আর জিহাদ সম্পর্কে আছে, এটি ইসলামের শীর্ষচূড়া। পিতা-মাতার আনুগত্যকে এ উভয় বিধানের মাঝখানে উল্লেখ করার দ্বারা স্পষ্ট হয়ে ওঠে এর গুরুত্ব কত বেশি এবং এটা কত উচ্চস্তরের আমল।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. ঈমানের পর নামাযই আল্লাহর কাছে সর্বাপেক্ষা বেশি প্রিয়। সুতরাং আমাদেরকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে এ আমলে মনোযোগী থাকতে হবে।
খ. পিতা-মাতার আনুগত্য করাও আল্লাহ খুব পসন্দ করেন। কোনও সন্তানের এ বিষয়ে গাফলাতি করা উচিত নয়।
গ. আল্লাহর পথে জিহাদও একটি শ্রেষ্ঠতম আমল। এর জন্যও প্রত্যেকের প্রস্তুত থাকা চাই।
ঘ. জিজ্ঞাসা করা দীনী ইলম হাসিলের একটি উত্তম পন্থা। কাজেই যার যা জানা নেই, নির্ভরযোগ্য কোনও আলেমের কাছে জিজ্ঞেস করে তা জেনে নেওয়া উচিত।
৬৩. তাবারানী, আল মু'জামুল আওসাত, হাদীছ নং ২৪৩; সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ৩৬১; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ২১৫৪৬
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উত্তরে জানালেন, ওয়াক্তমত নামায পড়া। অর্থাৎ ঈমানের পর ওয়াক্তমত নামায পড়া শ্রেষ্ঠতম আমল। এটাই আল্লাহ তাআলার কাছে সবচে' বেশি পসন্দ এবং এর দ্বারাই আল্লাহ তাআলার বেশি নৈকট্য লাভ করা যায়। অপর এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন الصلاة خير موضوع، فمن استطاع أن يستكثر فليستكثر 'নামায আল্লাহপ্রদত্ত শ্রেষ্ঠতম কাজ। যার পক্ষে সম্ভব সে যেন তা বেশি বেশি করে। ৬৩
ওয়াক্তমত নামায পড়া যখন শ্রেষ্ঠ আমল, তখন প্রত্যেকের উচিত পাঁচ ওয়াক্ত নামায ওয়াক্তমত আদায়ে সচেষ্ট থাকা। সতর্ক থাকা উচিত যাতে ইচ্ছাকৃতভাবে কোনও নামায কাযা না হয়ে যায়। ইচ্ছাকৃত নামায কাযা করা কবীরা গুনাহ। হাঁ, অসুস্থতা, ঘুম, শত্রুর হামলা বা অন্য কোনও গ্রহণযোগ্য ওযরের কারণে ওয়াক্তমত আদায় করতে না পারলে ভিন্ন কথা, তাতে গুনাহ নেই।
হযরত আব্দুল্লাহ ইবন মাসঊদ রাযি. জানতে চাইলেন, তারপর অর্থাৎ নামাযের পর কোন আমল আল্লাহর কাছে সর্বাপেক্ষা বেশি প্রিয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, পিতা-মাতার আনুগত্য।
এর দ্বারা বোঝা গেল বান্দার হক আদায় করাও আল্লাহ তাআলার কাছে প্রিয় আমল। এর দ্বারাও আল্লাহ তাআলার নৈকট্য লাভ হয়। আরও বোঝা গেল বান্দার হকসমূহের মধ্যে পিতা-মাতার আনুগত্য করার স্থান সবার উপরে। সুতরাং যদি কেউ আল্লাহ তাআলার কোনও প্রিয় আমলের মাধ্যমে তাঁর নৈকট্য অর্জন করতে চায়, তবে তার উচিত পিতা-মাতার আনুগত্য করা, তাদের বেশি বেশি খেদমত করা এবং তাদেরকে খুশি রাখতে সচেষ্ট থাকা।
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ হাদীছে তৃতীয় পর্যায়ে আল্লাহ তাআলার বেশি প্রিয় আমল হিসেবে জিহাদের কথা উল্লেখ করেছেন। অর্থাৎ আল্লাহ তাআলার কালেমা ও তাঁর দেওয়া দীন প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে সসস্ত্র সংগ্রাম করা। কুরআন মাজীদের বিভিন্ন আয়াতে জিহাদের উচ্চ ফযীলত বর্ণিত হয়েছে। এ সম্পর্কে হাদীছও আছে প্রচুর। বস্তুত এটি ইসলামের এক স্থায়ী বিধান। এ বিধান কিয়ামত পর্যন্ত বলবৎ থাকবে। এর জন্য প্রত্যেক মুমিনের সর্বদা প্রস্তুত থাকা উচিত। অন্তরে দৃঢ় সংকল্প রাখা উচিত যে, যখনই আল্লাহর পথে জিহাদের অবকাশ আসবে, নিজ জান-মাল নিয়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাতে অংশগ্রহণ করবে।
এ হাদীছে লক্ষণীয় যে, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পিতা-মাতার আনুগত্য করাকে জিহাদের মাঝখানে স্থান দিয়েছেন। নামাযকে হাদীছে দীনের স্তম্ভ বলা হয়েছে। আর জিহাদ সম্পর্কে আছে, এটি ইসলামের শীর্ষচূড়া। পিতা-মাতার আনুগত্যকে এ উভয় বিধানের মাঝখানে উল্লেখ করার দ্বারা স্পষ্ট হয়ে ওঠে এর গুরুত্ব কত বেশি এবং এটা কত উচ্চস্তরের আমল।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. ঈমানের পর নামাযই আল্লাহর কাছে সর্বাপেক্ষা বেশি প্রিয়। সুতরাং আমাদেরকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে এ আমলে মনোযোগী থাকতে হবে।
খ. পিতা-মাতার আনুগত্য করাও আল্লাহ খুব পসন্দ করেন। কোনও সন্তানের এ বিষয়ে গাফলাতি করা উচিত নয়।
গ. আল্লাহর পথে জিহাদও একটি শ্রেষ্ঠতম আমল। এর জন্যও প্রত্যেকের প্রস্তুত থাকা চাই।
ঘ. জিজ্ঞাসা করা দীনী ইলম হাসিলের একটি উত্তম পন্থা। কাজেই যার যা জানা নেই, নির্ভরযোগ্য কোনও আলেমের কাছে জিজ্ঞেস করে তা জেনে নেওয়া উচিত।
৬৩. তাবারানী, আল মু'জামুল আওসাত, হাদীছ নং ২৪৩; সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ৩৬১; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ২১৫৪৬
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
