রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ

ভূমিকা অধ্যায়

হাদীস নং: ৩০১
পরিবার-পরিজনকে, সন্তান-সন্ততিদের মধ্যে যারা ভালোমন্দ পার্থক্য করার বয়সে উপনীত হয়েছে তাদেরকে এবং নিজ দায়িত্বভুক্ত সকলকে আল্লাহ তা'আলার আনুগত্যের আদেশ দেওয়া, তাঁর নাফরমানি করতে নিষেধ করা, প্রয়োজনে তাদেরকে শাস্তি দেওয়া এবং নিষিদ্ধ বিষয়সমূহ থেকে তাদেরকে বিরত রাখার আবশ্যকীয়তা।
সাত বছর থেকে দশ বছর বয়সী শিশুদের প্রতি করণীয়
হাদীছ নং : ৩০১

হযরত আমর ইবন শুআইব তাঁর পিতা থেকে এবং তিনি তাঁর পিতা থেকে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, তোমাদের সন্তানদের বয়স সাত বছর হলেই তোমরা তাদেরকে নামাযের আদেশ কর। তাদের বয়স দশ বছর হয়ে গেলে নামাযের জন্য তাদেরকে মার এবং তাদের বিছানা আলাদা করে দাও -আবূ দাউদ।
(সুনানে আবু দাউদ, হাদীছ নং ৪৯৫; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ৬৬৮৯; মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, হাদীছ নং ৩৪৮২: বায়হাকী, আস-সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ৩২৩৩; শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ৮২৮৩; সুনানে দারাকুতনী, হাদীছ নং ৮৮৭; খারাইতী, মাকারিমুল আখলাক, হাদীছ নং ৪৫৭: বাগাবী, শারহুস্ সুন্নাহ, হাদীছ নং ৫০৫)
38 - باب وجوب أمره أهله وأولاده المميزين وسائر من في رعيته بطاعة الله تعالى ونهيهم عن المخالفة وتأديبهم ومنعهم من ارتكاب مَنْهِيٍّ عَنْهُ
301 - وعن عمرو بن شعيب، عن أبيه، عن جدهِ - رضي الله عنه - قَالَ: قَالَ رَسُول الله - صلى الله عليه وسلم: «مُرُوا أَوْلادَكُمْ بِالصَّلاةِ وَهُمْ أبْنَاءُ سَبْعِ سِنينَ، وَاضْرِبُوهُمْ عَلَيْهَا، وَهُمْ أَبْنَاءُ عَشْرٍ، وَفَرِّقُوا بَيْنَهُمْ في المضَاجِعِ». حديث حسن رواه أَبُو داود بإسناد حسن. (1)

হাদীসের ব্যাখ্যা:

হাদীছের বর্ণনাকারী আমরের পিতার নাম শুআইব। তার পিতা মুহাম্মাদ। তার পিতা হযরত আব্দুল্লাহ ইবন আমর ইবনুল আস রাযি.। হযরত আমর ইবনুল ‘আস রাযি. একজন বিখ্যাত সাহাবী। তাঁর পুত্র আব্দুল্লাহ রাযি.-ও প্রসিদ্ধ সাহাবী। তাঁর পুত্র মুহাম্মাদ, পৌত্র শুআইব এবং প্রপৌত্র আমর- এদের সকলেই তাবি'ঈ। হাদীছটি আমর বর্ণনা করেছেন তার পিতা শুআইব থেকে। শুআইব বর্ণনা করেছেন তার দাদা আব্দুল্লাহ ইবন আমর রাযি. থেকে।৪২৪

হাদীছটিতে হুকুম করা হয়েছে, ছেলেমেয়ে যখন সাত বছর বয়সে উপনীত হয়, তখন তাদেরকে নামায পড়ার হুকুম দিতে হবে। বলাবাহুল্য নামায পড়তে হলে ওযূ করা শিখতে হয়, সতর ঢাকা জানতে হয়, পাক-পবিত্রতা বুঝতে হয়, কিবলা চিনতে হয় ইত্যাদি। কাজেই নামায পড়ার হুকুম দিতে হলে এসব বিষয়ও তাদেরকে শেখাতে হবে। নামাযে সূরা ফাতিহাসহ অন্য সূরাও পড়তে হয়, বিভিন্ন দুআ, দুরূদ, আত্তাহিয়্যাতু ইত্যাদিও পড়ার প্রয়োজন হয়। কাজেই তাদেরকে এগুলোও শেখানো জরুরি হবে।

আবার নামায পড়তে হয় আল্লাহ তাআলার উদ্দেশ্যে। না পড়লে আখেরাতে শাস্তি পেতে হবে। পড়লে জান্নাত লাভ হবে। কাজেই শিশুকে দিয়ে নামায পড়াতে হলে তাদেরকে এসব বিশ্বাসের সঙ্গেও পরিচিত করার প্রয়োজন আছে।

নামায আমাদের দীনের সর্বপ্রধান ইবাদত। এর বাইরেও তিনটি মৌলিক ইবাদত আছে। নামাযের কথা বললে 'দীন'-এর বিষয়টি আপনিই এসে যায়। অতএব তাদেরকে দীনেরও পরিচয় দিতে হবে বৈকি। অপরিহার্যভাবেই নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কথাও এসে যায়। এভাবে তিনি যে আমাদের নবী এবং তিনিই সর্বশেষ নবী, তাও তাদের শিক্ষার মধ্যে এসে যাবে।

দেখা যাচ্ছে এক নামায শেখাতে গেলে পর্যায়ক্রমে গোটা দীনের শিক্ষাই শিশুদেরকে দেওয়া হয়ে যায়। শুনতে কথাগুলো খুব ভারী মনে হয়। তা যাতে ভারী মনে না হয়, তাই হিকমতওয়ালা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সংক্ষিপ্ত হুকুম দিয়ে দিয়েছেন যে, ব্যস তাদেরকে নামাযের হুকুম দাও। তাঁর এ হুকুম পালন করা হলে বাকি সব একের পর এক এমনিই শেখানো হয়ে যাবে।

এ নির্দেশ দ্বারা প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রকৃতপক্ষে প্রত্যেক অভিভাবককে তাদের শিশুসন্তানদের দীনের তালীম দেওয়ারই তাগিদ করলেন। বস্তুত শৈশবে দীনের তালীম দেওয়া অতীব গুরুত্বপূর্ণ। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় এটা এক সাধারণ ও তুচ্ছ কাজ। তুচ্ছ নয় মোটেই, প্রকৃতপক্ষে এর কার্যকারিতা সুদূরপ্রসারী। এটা ইমারত নির্মাণের ভিত্তিস্বরূপ। বাহ্যদৃষ্টিতে দেখা যায় মাটির নিচে অহেতুক টাকা ঢালা হচ্ছে। কিন্তু আসলেই কি টাকা নষ্ট করা হয়? ভালো ইমারত নির্মাণের বিষয়টি তো এরই উপর নির্ভরশীল। ভিত্তি যত মজবুত হবে, তার উপর গড়ে তোলা ইমারতও তত সুদৃঢ় হবে। ঠিক এরকমই শৈশবে ভালোভাবে দীনী শিক্ষা দেওয়ার উপরই প্রকৃত ইসলামী জীবন নির্ভর করে। শৈশবের দীনী তা'লীমের উপর ভিত্তি করেই কাউকে আদর্শ মানুষরূপে গড়ে তোলা সম্ভব হয়। প্রত্যেক অভিভাবকের বিষয়টিকে অতি গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া উচিত। এ লক্ষ্যে যত বেশি কুরআনী মক্তব গড়ে তোলা যাবে, উম্মতের কল্যাণ ততই ত্বরান্বিত হবে।

তারপর বলা হয়েছে— وَاضْرِبُوهُمْ عَلَيْهَا, وَهُمْ أَبْنَاءُ عَشْرِ (শিশুদের বয়স দশ বছর হয়ে গেলে নামাযের জন্য তাদেরকে মারবে)। অর্থাৎ হুকুম দেওয়া ও বোঝানো সত্ত্বেও যদি তারা নামায না পড়ে, তবে তাদেরকে লঘু শাস্তিদান করবে। অন্যান্য হাদীছ দ্বারা স্পষ্ট করা হয়েছে যে, এমনভাবে মারতে হবে, যাতে শরীরে দাগ না পড়ে যায়, আর চেহারায় তো মারা যাবেই না।

দশ বছর বয়সে নামাযের জন্য শাস্তিদানের হুকুম দ্বারা বোঝা যায় শিশুদেরকে এ বয়সের ভেতর দীনের জরুরি ও বুনিয়াদী শিক্ষা দিয়ে ফেলা চাই। দীনের জরুরি বিষয়াবলীর মধ্যে নামায অন্যতম। কাজেই এ বয়সের মধ্যে নামাযও পুরোপুরি শিখিয়ে দিতে হবে।

হাদীছটির শেষে আছে— وَفَرِّقُوا بَيْنَهُمْ فِي الْمَضَاجِعِ (শিশুদের বয়স দশ বছর হয়ে গেলে তাদের বিছানাও আলাদা করে দাও)। অর্থাৎ তাদেরকে এক বিছানায় ঘুমাতে দিও না। এর কারণ এ বয়সে শিশুরা মোটামুটি বুঝদার হয়ে যায়। ছেলেমেয়ের মধ্যকার পার্থক্যসমূহ তাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে যায়। আর ঘুমের মধ্যে মানুষের সচেতনতা থাকে না। সতর খুলে গেলেও টের পায় না। বালেগ ছেলে বা মেয়ে কারওই যেমন একে অন্যের সতর দেখা জায়েয নয়, তেমনি এ বয়সেও তাদেরকে সতরের ব্যাপারে সাবধান রাখা উচিত। এক বিছানায় ঘুমালে একে অন্যের সতর দেখে ফেলতে পারে। এটা লজ্জা-শরম নষ্ট হয়ে যাওয়ার পথ খুলে দেয়। লজ্জা-শরম মানুষের আখলাক-চরিত্রের আবরণস্বরূপ। এটা নষ্ট হয়ে গেলে সবরকম বদ্‌আখলাকের বহিঃপ্রকাশ ঘটতে শুরু করে। তাই এ বয়সে বিছানা আলাদা করার নির্দেশ, যাতে লজ্জাশীলতার গুণ সহজে নষ্ট হতে না পারে।

হাদীছ থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. শিশুর বয়স সাত বছর হলে নামাযের প্রশিক্ষণ দেওয়াসহ একটু একটু করে দীনের জরুরি বিষয়সমূহের শিক্ষাদান শুরু করা উচিত।

খ. দশ বছর বয়স হয়ে গেলে নামায ও দীনের অন্যান্য জরুরি বিষয়সমূহ যেন মোটামুটিভাবে শিখে ফেলে, সেরকম করে তার তালীমের ব্যবস্থা নেওয়া চাই।

গ. শিশুর বয়স দশ বছর হলে তাকে দীনদাররূপে গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে লঘু শাস্তিদানের অবকাশ আছে। শাস্তিদানে বাড়াবাড়ি যেমন অন্যায়, তেমনি লঘু শাস্তির প্রয়োজন বোধ হওয়া সত্ত্বেও তা না দেওয়াটাও ক্ষতিকর।

ঘ. দশ বছর বয়সী শিশুদেরকে এক বিছানায় ঘুমাতে দেওয়া ঠিক নয়।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
রিয়াযুস সালিহীন - হাদীস নং ৩০১ | মুসলিম বাংলা