রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ
ভূমিকা অধ্যায়
হাদীস নং: ২৯৭
অধ্যায়ঃ ৩৭
প্রিয় ও উৎকৃষ্ট বস্তু থেকে দান করা
আল্লাহর পথে যা খরচ করা হয়, প্রকৃতপক্ষে তাই মানুষের আসল সম্পদ; বরং সেটাই তার সম্পদ। দুনিয়ায় যা রেখে যাওয়া হয় তা পরের সম্পদ। মৃত্যুর পর তাতে কারও কোনও ক্ষমতা থাকে না। আল্লাহর পথে যা খরচ করা হয় তা আল্লাহর কাছে সংরক্ষিত থাকে। মৃত্যুর পর তা পাওয়া যাবে। সেই সম্পদই যখন আসল সম্পদ, তখন তার প্রতিই বিশেষভাবে মনোযোগী থাকা যুক্তিসঙ্গত ও বুদ্ধিমত্তার কাজ। সে বুদ্ধিমত্তার দাবি হচ্ছে আল্লাহর পথে নিজ প্রিয়বস্তু দান করা ও উৎকৃষ্ট বস্তু দান করা।
প্রিয় ও উৎকৃষ্ট বস্তু দান করা এ কারণেও প্রয়োজন যে, তা দেওয়া হচ্ছে আল্লাহকে। যে-কোনও বস্তু দান করলে তার প্রথম গ্রহীতা আল্লাহ। কোনও বান্দার হাতে যাওয়ার আগে প্রথমে তা আল্লাহর কাছে পৌঁছে। আল্লাহর পথে দান করা হয় আল্লাহর ভালোবাসায়। এটা এক সাধারণ নিয়ম, ভালোবাসার জনকে কিছু দেওয়া হলে উৎকৃষ্ট ও প্রিয় বস্তুই দেওয়া হয়ে থাকে। এক আল্লাহপ্রেমিকের কাছে আল্লাহর চেয়ে বেশি প্রিয় আর কিছুই হতে পারে না। অতএব আল্লাহর উদ্দেশ্যে যা দান করা হবে, আল্লাহপ্রেমের দাবিতেই তা সর্বোৎকৃষ্ট ও সর্বাপেক্ষা প্রিয় বস্তুই হওয়ার কথা। অনেকে দানের এ মাহাত্ম্য উপলব্ধি করে না। ফলে দায়সারাভাবে কোনও একটা কিছু দিয়ে দেয়। বরং অনেক সময় সবচে' অপসন্দের ও সবচে' কম দামীটাই দেওয়া হয়ে থাকে। বলা যায় এটাই ব্যাপক। বলাবাহুল্য এটা আল্লাহর পক্ষে দানের মহিমা নষ্ট করে।
আবার আল্লাহর পথে যা-কিছু দান করা হয় তা তো আল্লাহ আল্লাহ তাআলারই দেওয়া। তাঁর দেওয়া বস্তু তাঁর পথে ব্যয় করার সময় খুঁজে খুঁজে মন্দটা দেওয়া বা অপ্রিয়টা দেওয়া একরকম নাশুকরীও বটে। এ নাশুকরী থেকে বাঁচার লক্ষ্যেও প্রত্যেক দাতার কর্তব্য আল্লাহর পথে প্রিয়বস্তু দান করা ও ভালোটা দেওয়া।
মানুষ আখেরাতের তুলনায় দুনিয়ার প্রতি বেশি আকৃষ্ট থাকার কারণে দান খয়রাতের ক্ষেত্রে এসকল দিক চিন্তা করে না। ফলে আখেরাতের বিচারে সে অপূরণীয় ক্ষতির শিকার হয়। সে ক্ষতি থেকে মানুষকে বাঁচানোর লক্ষ্যে কুরআন ও হাদীছে তাকে উৎকৃষ্ট ও প্রিয় বস্তু থেকে দান করতে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে।
এ সম্পর্কে কুরআন মাজীদে প্রচুর আয়াত আছে। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদীছও আছে অনেক। ইমাম নববী রহ. এ অধ্যায়ে সেরকম দু'টি আয়াত ও একটি হাদীছ উল্লেখ করেছেন। আমরা তার বঙ্গানুবাদ ও সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা পেশ করছি। আল্লাহ তাআলাই তাওফীকদাতা।
‘প্রিয় ও উৎকৃষ্ট বস্তু থেকে দান করা’ সম্পর্কিত দুটি আয়াত
এক নং আয়াত
لَنْ تَنَالُوا الْبِرَّ حَتَّى تُنْفِقُوا مِمَّا تُحِبُّونَ
অর্থ : ‘তোমরা কিছুতেই পুণ্যের নাগাল পাবে না, যতক্ষণ না তোমরা তোমাদের প্রিয়বস্তু হতে (আল্লাহর জন্য) ব্যয় করবে।৪০৫
ব্যাখ্যা
الْبِرّ শব্দটি বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়। যেমন সদ্ব্যবহার, অনুগ্রহ, সৎকর্ম ইত্যাদি। সাধারণত এর দ্বারা পরিপূর্ণরূপে অন্যের হক আদায় করা বোঝানো হয়, যা দ্বারা নিজ দায়িত্ব পূর্ণাঙ্গরূপে সম্পন্ন হয়ে যায়। এভাবে দায়িত্ব পালনকারীকে بر এবং বহুবচনে ابرار বলা হয়। কুরআন মাজীদে এ শব্দের বহুল ব্যবহার আছে।
এস্থলে الْبِرّ দ্বারা কী বোঝানো উদ্দেশ্য, সে সম্পর্কে মুফাস্সিরগণ বিভিন্ন অভিমত ব্যক্ত করেছেন। কারও মতে এর দ্বারা পূর্ণাঙ্গ ছাওয়াব ও প্রতিদান বোঝানো হয়েছে। কেউ বলেন, রহমত। কেউ বলেন, জান্নাত। এছাড়া যে-কোনও কল্যাণ, আনুগত্য, তাকওয়া, আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি, সত্য ও সততা ইত্যাদি ব্যাখ্যাও করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে এর মধ্যে কোনও বিরোধ নেই। এর সবগুলোই সৎকর্ম বা সৎকর্মের প্রতিদান। মূলত বোঝানো উদ্দেশ্য এই যে, তোমাদের দ্বারা দান-সদাকার ক্ষেত্রে পরিপূর্ণ সৎকর্ম সংঘটিত হবে না, ফলে তার পরিপূর্ণ প্রতিদানও আল্লাহ তাআলার কাছে লাভ করতে পারবে না, যতক্ষণ না তোমাদের প্রিয়বস্তু থেকে দান কর।
‘দান' কথাটি ব্যাপক। এর দ্বারা অর্থ দান করা, শক্তি ব্যয় করা, বিদ্যা-বুদ্ধি খরচ করা, মাখলুকের সেবায় নিজ প্রভাব ও ক্ষমতার বৈধ ব্যবহার করা ইত্যাদি সবই বোঝানো হয়ে থাকে। সুতরাং সর্বপ্রকার ব্যয়ই এ আয়াতের অন্তর্ভুক্ত হবে। আল্লাহ তাআলার পথে যার যা ব্যয় করার সামর্থ্য আছে, তা পরিপূর্ণ আন্তরিকতার সঙ্গে নিজ সাধ্য অনুযায়ী ব্যয় করলে পূর্ণাঙ্গ প্রতিদান পাওয়া যাবে।
প্রকাশ থাকে যে, এ আয়াতে পরিপূর্ণ প্রতিদানের জন্য প্রিয়বস্তু ব্যয়ের শর্ত করা হয়েছে। এর দ্বারা বোঝা যায় যদি প্রিয়বস্তু খরচ করা না হয়, তবুও একরকম প্রতিদান অবশ্যই পাওয়া যাবে। আল্লাহর পথে কোনও খরচই বৃথা যায় না, যদি তা আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টিলাভের উদ্দেশ্যে করা হয়ে থাকে। সুতরাং যার দানের মান ও পরিমাণ যেমন হবে, সে সেই অনুপাতেই প্রতিদান লাভ করবে। তাই তো আয়াতের শেষে আছে—
وَمَا تُنْفِقُوا مِنْ شَيْءٍ فَإِنَّ اللَّهَ بِهِ عَلِيمٌ (92)
(তোমরা যা-কিছুই ব্যয় কর, আল্লাহ সে সম্পর্কে পূর্ণ অবগত)। অর্থাৎ তোমরা আল্লাহর পথে যা ব্যয় কর, তার মান ও পরিমাণ তিনি জানেন এবং সে দানের ক্ষেত্রে তোমাদের আন্তরিকতা কতটুকু, সে সম্পর্কেও তিনি অবগত। তিনি সে অনুসারেই তোমাদেরকে প্রতিদান দেবেন।
অবশ্য আল্লাহ চান তাঁর বান্দা তাঁর কাছে সর্বোৎকৃষ্ট পুরস্কার লাভ করুক। সেজন্যই এ আয়াতে প্রিয়বস্তু দান করতে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে।
এ আয়াত নাযিল হলে সাহাবায়ে কেরাম কী তৎপরতার সঙ্গে এর উপর আমল করেছিলেন, তার একটা দৃষ্টান্ত এ অধ্যায়ে উদ্ধৃত হাদীছ দ্বারা জানা যায়।
দুই নং আয়াত
يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَنْفِقُوا مِنْ طَيِّبَاتِ مَا كَسَبْتُمْ وَمِمَّا أَخْرَجْنَا لَكُمْ مِنَ الْأَرْضِ وَلَا تَيَمَّمُوا الْخَبِيثَ مِنْهُ تُنْفِقُونَ
অর্থ : 'হে মুমিনগণ! তোমরা যা-কিছু উপার্জন করেছ এবং আমি তোমাদের জন্য ভূমি থেকে যা-কিছু উৎপন্ন করেছি, তার উৎকৃষ্ট জিনিসসমূহ থেকে একটি অংশ (আল্লাহর পথে) ব্যয় কর। আর এরূপ মন্দ জিনিস (আল্লাহর নামে) দেওয়ার নিয়ত করো না।৪০৬
ব্যাখ্যা
এ আয়াতে প্রথমত বান্দার উপার্জিত এবং ভূমি হতে আল্লাহর উৎপাদিত বস্তু থেকে যা হালাল ও উৎকৃষ্ট, আল্লাহর পথে তা ব্যয় করতে আদেশ করা হয়েছে। তারপর নিকৃষ্ট বস্ত্র দান করতে নিষেধ করা হয়েছে। এবং তার মন্দত্ব পরিষ্কার করার জন্য দৃষ্টান্তস্বরূপ কাউকে মন্দ বস্তু দেওয়া হলে তার অবস্থা কেমন হয় তা উল্লেখ করা হয়েছে।
বলা হয়েছে যে, তোমাদের উপার্জিত ও ভূমি থেকে উৎপন্ন বস্তুসামগ্রী হতে যা উৎকৃষ্ট তার একটা অংশ আল্লাহর পথে ব্যয় কর। যাকাত ও নফল দান-খয়রাত উভয়টাই এর অন্তর্ভুক্ত। কিছু কিছু লোক যাকাত দেওয়ার সময় নিম্নমানের মাল থেকে তা আদায় করত। এরই পরিপ্রেক্ষিতে আয়াতটি নাযিল হয়। কাজেই সরাসরি এর সম্পর্ক যাকাতের সঙ্গেই হয়। স্বর্ণ-রৌপ্য ছাড়াও নির্দিষ্ট পরিমাণ গবাদি পশুর উপরও যাকাত ফরয হয়ে থাকে। এমনিভাবে ফসলের উপর উশর ফরয হয়। উশর ও একরকম যাকাতই বটে। এসকল সম্পদ সবই সমমানের হয় না। ভালো, মন্দ, মাঝারি বিভিন্নরকম হয়ে থাকে। অনেকে এসব মাল থেকে যাকাত আদায়কালে খুঁজে খুঁজে মন্দটা দেয়। নফল দান-খয়রাতে তো এটা ব্যাপকভাবেই করা হয়ে থাকে।
আল্লাহর পথে খরচ করা মূলত আল্লাহপ্রেমেরই নিদর্শন। নিকৃষ্ট মাল থেকে তাঁর পথে ব্যয় করাটা সে নিদর্শনের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। তাই হুকুম দেওয়া হয়েছে, বেছে বেছে মন্দটা নয়; বরং ভালোটা দিতে চেষ্টা কর। তবেই আল্লাহর কাছে পরিপূর্ণ পুরস্কার লাভ করবে।
প্রকাশ থাকে যে, একদিকে দাতাকে হুকুম দেওয়া হয়েছে উৎকৃষ্ট মাল থেকে দিতে, অন্যদিকে সরকারের পক্ষ থেকে যারা যাকাত উসূল করে তাদের হুকুম দেওয়া হয়েছে যেন বেছে বেছে উৎকৃষ্টটা গ্রহণ না করে; বরং মাঝারি মানেরটা গ্রহণ করে। এর দ্বারা একদিকে যাকাত ব্যয়ের খাত তথা গরীবদেরও স্বার্থ রক্ষা হয় এবং অন্যদিকে যাকাতদাতার উপরও জুলুম হয় না। এটা ইসলামী বিধানাবলীর ভারসাম্য।
তারপর মন্দ জিনিস থেকে দান করতে নিষেধ করা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে-
وَلَا تَيَمَّمُوا الْخَبِيثَ مِنْهُ تُنْفِقُونَ وَلَسْتُمْ بِآخِذِيهِ إِلَّا أَنْ تُغْمِضُوا فِيهِ
‘আর এরূপ মন্দ জিনিস (আল্লাহর নামে) দেওয়ার নিয়ত করো না, যা (অন্য কেউ তোমাদেরকে দিলে ঘৃণার কারণে) তোমরা চক্ষু বন্ধ না করে তা গ্রহণ করবে 'না'।
অর্থাৎ তোমাদেরকে যদি কেউ তোমাদের প্রাপ্য সম্পদ মন্দ বস্তু থেকে দেয় কিংবা কোনও নিম্নমানের বস্তু তোমাদেরকে উপহার দেয়, তবে প্রথমত তোমরা তা গ্রহণই কর না। আর লজ্জাবশত গ্রহণ করলেও এমন অবজ্ঞার সঙ্গে গ্রহণ কর যে, সে বস্তুর দিকে তাকাওই না, চোখ অন্যদিকে ফিরিয়ে রাখ। তুমি আমার এক সাধারণ সৃষ্টি। তুমি নিজের বেলায় যখন এ নীতি অবলম্বন করছ, তখন মহান আল্লাহর সঙ্গে কেন এর বিপরীত আচরণ কর? তাঁকে দেবার বেলায় কেন নিম্নমানের বস্তু খোঁজ? এটা কিছুতেই সমীচীন নয়।
আয়াতের শেষে আল্লাহ তাআলা বলেন-
وَاعْلَمُوا أَنَّ اللَّهَ غَنِيٌّ حَمِيدٌ
(মনে রেখ, আল্লাহ বেনিয়ায, সর্বপ্রকার প্রশংসা তাঁরই দিকে ফেরে)। অর্থাৎ আল্লাহর পথে দান- খয়রাত করার সময় তোমাদের যেন এ কথা স্মরণ থাকে যে, আল্লাহ গনী ও বেনিয়ায। কারও কাছে তাঁর কোনও ঠ্যাকা নেই, তাঁর কোনও অভাব নেই। তিনি তোমাদেরকে দান করতে হুকুম দিয়েছেন তোমাদেরই স্বার্থে। কাজেই তোমরা যদি তাঁর মর্জি মোতাবেক দান না কর, তবে তিনি তা কবুল করবেন না। তোমরা তাঁর কাছে কোনও প্রতিদানও পাবে না। আবার তিনি হামীদ ও গুণগ্রাহীও বটে। তাঁর পথে উৎকৃষ্ট বস্তু খরচ করলে তিনি তা প্রশংসার দৃষ্টিতে দেখেন। তিনি তার উত্তম বদলা দেন। সুতরাং তাঁর সন্তুষ্টি ও উত্তম প্রতিদান পাওয়ার আশায় তাঁর পথে তোমরা উৎকৃষ্ট বস্তুই দান করতে সচেষ্ট থেক।
৪০৫. সূরা আলে ইমরান (৩), আয়াত ৯২
৪০৬. সূরা বাকারা (২), আয়াত ২৬৭
প্রিয় ও উৎকৃষ্ট বস্তু থেকে দান করা
আল্লাহর পথে যা খরচ করা হয়, প্রকৃতপক্ষে তাই মানুষের আসল সম্পদ; বরং সেটাই তার সম্পদ। দুনিয়ায় যা রেখে যাওয়া হয় তা পরের সম্পদ। মৃত্যুর পর তাতে কারও কোনও ক্ষমতা থাকে না। আল্লাহর পথে যা খরচ করা হয় তা আল্লাহর কাছে সংরক্ষিত থাকে। মৃত্যুর পর তা পাওয়া যাবে। সেই সম্পদই যখন আসল সম্পদ, তখন তার প্রতিই বিশেষভাবে মনোযোগী থাকা যুক্তিসঙ্গত ও বুদ্ধিমত্তার কাজ। সে বুদ্ধিমত্তার দাবি হচ্ছে আল্লাহর পথে নিজ প্রিয়বস্তু দান করা ও উৎকৃষ্ট বস্তু দান করা।
প্রিয় ও উৎকৃষ্ট বস্তু দান করা এ কারণেও প্রয়োজন যে, তা দেওয়া হচ্ছে আল্লাহকে। যে-কোনও বস্তু দান করলে তার প্রথম গ্রহীতা আল্লাহ। কোনও বান্দার হাতে যাওয়ার আগে প্রথমে তা আল্লাহর কাছে পৌঁছে। আল্লাহর পথে দান করা হয় আল্লাহর ভালোবাসায়। এটা এক সাধারণ নিয়ম, ভালোবাসার জনকে কিছু দেওয়া হলে উৎকৃষ্ট ও প্রিয় বস্তুই দেওয়া হয়ে থাকে। এক আল্লাহপ্রেমিকের কাছে আল্লাহর চেয়ে বেশি প্রিয় আর কিছুই হতে পারে না। অতএব আল্লাহর উদ্দেশ্যে যা দান করা হবে, আল্লাহপ্রেমের দাবিতেই তা সর্বোৎকৃষ্ট ও সর্বাপেক্ষা প্রিয় বস্তুই হওয়ার কথা। অনেকে দানের এ মাহাত্ম্য উপলব্ধি করে না। ফলে দায়সারাভাবে কোনও একটা কিছু দিয়ে দেয়। বরং অনেক সময় সবচে' অপসন্দের ও সবচে' কম দামীটাই দেওয়া হয়ে থাকে। বলা যায় এটাই ব্যাপক। বলাবাহুল্য এটা আল্লাহর পক্ষে দানের মহিমা নষ্ট করে।
আবার আল্লাহর পথে যা-কিছু দান করা হয় তা তো আল্লাহ আল্লাহ তাআলারই দেওয়া। তাঁর দেওয়া বস্তু তাঁর পথে ব্যয় করার সময় খুঁজে খুঁজে মন্দটা দেওয়া বা অপ্রিয়টা দেওয়া একরকম নাশুকরীও বটে। এ নাশুকরী থেকে বাঁচার লক্ষ্যেও প্রত্যেক দাতার কর্তব্য আল্লাহর পথে প্রিয়বস্তু দান করা ও ভালোটা দেওয়া।
মানুষ আখেরাতের তুলনায় দুনিয়ার প্রতি বেশি আকৃষ্ট থাকার কারণে দান খয়রাতের ক্ষেত্রে এসকল দিক চিন্তা করে না। ফলে আখেরাতের বিচারে সে অপূরণীয় ক্ষতির শিকার হয়। সে ক্ষতি থেকে মানুষকে বাঁচানোর লক্ষ্যে কুরআন ও হাদীছে তাকে উৎকৃষ্ট ও প্রিয় বস্তু থেকে দান করতে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে।
এ সম্পর্কে কুরআন মাজীদে প্রচুর আয়াত আছে। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদীছও আছে অনেক। ইমাম নববী রহ. এ অধ্যায়ে সেরকম দু'টি আয়াত ও একটি হাদীছ উল্লেখ করেছেন। আমরা তার বঙ্গানুবাদ ও সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা পেশ করছি। আল্লাহ তাআলাই তাওফীকদাতা।
‘প্রিয় ও উৎকৃষ্ট বস্তু থেকে দান করা’ সম্পর্কিত দুটি আয়াত
এক নং আয়াত
لَنْ تَنَالُوا الْبِرَّ حَتَّى تُنْفِقُوا مِمَّا تُحِبُّونَ
অর্থ : ‘তোমরা কিছুতেই পুণ্যের নাগাল পাবে না, যতক্ষণ না তোমরা তোমাদের প্রিয়বস্তু হতে (আল্লাহর জন্য) ব্যয় করবে।৪০৫
ব্যাখ্যা
الْبِرّ শব্দটি বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়। যেমন সদ্ব্যবহার, অনুগ্রহ, সৎকর্ম ইত্যাদি। সাধারণত এর দ্বারা পরিপূর্ণরূপে অন্যের হক আদায় করা বোঝানো হয়, যা দ্বারা নিজ দায়িত্ব পূর্ণাঙ্গরূপে সম্পন্ন হয়ে যায়। এভাবে দায়িত্ব পালনকারীকে بر এবং বহুবচনে ابرار বলা হয়। কুরআন মাজীদে এ শব্দের বহুল ব্যবহার আছে।
এস্থলে الْبِرّ দ্বারা কী বোঝানো উদ্দেশ্য, সে সম্পর্কে মুফাস্সিরগণ বিভিন্ন অভিমত ব্যক্ত করেছেন। কারও মতে এর দ্বারা পূর্ণাঙ্গ ছাওয়াব ও প্রতিদান বোঝানো হয়েছে। কেউ বলেন, রহমত। কেউ বলেন, জান্নাত। এছাড়া যে-কোনও কল্যাণ, আনুগত্য, তাকওয়া, আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি, সত্য ও সততা ইত্যাদি ব্যাখ্যাও করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে এর মধ্যে কোনও বিরোধ নেই। এর সবগুলোই সৎকর্ম বা সৎকর্মের প্রতিদান। মূলত বোঝানো উদ্দেশ্য এই যে, তোমাদের দ্বারা দান-সদাকার ক্ষেত্রে পরিপূর্ণ সৎকর্ম সংঘটিত হবে না, ফলে তার পরিপূর্ণ প্রতিদানও আল্লাহ তাআলার কাছে লাভ করতে পারবে না, যতক্ষণ না তোমাদের প্রিয়বস্তু থেকে দান কর।
‘দান' কথাটি ব্যাপক। এর দ্বারা অর্থ দান করা, শক্তি ব্যয় করা, বিদ্যা-বুদ্ধি খরচ করা, মাখলুকের সেবায় নিজ প্রভাব ও ক্ষমতার বৈধ ব্যবহার করা ইত্যাদি সবই বোঝানো হয়ে থাকে। সুতরাং সর্বপ্রকার ব্যয়ই এ আয়াতের অন্তর্ভুক্ত হবে। আল্লাহ তাআলার পথে যার যা ব্যয় করার সামর্থ্য আছে, তা পরিপূর্ণ আন্তরিকতার সঙ্গে নিজ সাধ্য অনুযায়ী ব্যয় করলে পূর্ণাঙ্গ প্রতিদান পাওয়া যাবে।
প্রকাশ থাকে যে, এ আয়াতে পরিপূর্ণ প্রতিদানের জন্য প্রিয়বস্তু ব্যয়ের শর্ত করা হয়েছে। এর দ্বারা বোঝা যায় যদি প্রিয়বস্তু খরচ করা না হয়, তবুও একরকম প্রতিদান অবশ্যই পাওয়া যাবে। আল্লাহর পথে কোনও খরচই বৃথা যায় না, যদি তা আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টিলাভের উদ্দেশ্যে করা হয়ে থাকে। সুতরাং যার দানের মান ও পরিমাণ যেমন হবে, সে সেই অনুপাতেই প্রতিদান লাভ করবে। তাই তো আয়াতের শেষে আছে—
وَمَا تُنْفِقُوا مِنْ شَيْءٍ فَإِنَّ اللَّهَ بِهِ عَلِيمٌ (92)
(তোমরা যা-কিছুই ব্যয় কর, আল্লাহ সে সম্পর্কে পূর্ণ অবগত)। অর্থাৎ তোমরা আল্লাহর পথে যা ব্যয় কর, তার মান ও পরিমাণ তিনি জানেন এবং সে দানের ক্ষেত্রে তোমাদের আন্তরিকতা কতটুকু, সে সম্পর্কেও তিনি অবগত। তিনি সে অনুসারেই তোমাদেরকে প্রতিদান দেবেন।
অবশ্য আল্লাহ চান তাঁর বান্দা তাঁর কাছে সর্বোৎকৃষ্ট পুরস্কার লাভ করুক। সেজন্যই এ আয়াতে প্রিয়বস্তু দান করতে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে।
এ আয়াত নাযিল হলে সাহাবায়ে কেরাম কী তৎপরতার সঙ্গে এর উপর আমল করেছিলেন, তার একটা দৃষ্টান্ত এ অধ্যায়ে উদ্ধৃত হাদীছ দ্বারা জানা যায়।
দুই নং আয়াত
يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَنْفِقُوا مِنْ طَيِّبَاتِ مَا كَسَبْتُمْ وَمِمَّا أَخْرَجْنَا لَكُمْ مِنَ الْأَرْضِ وَلَا تَيَمَّمُوا الْخَبِيثَ مِنْهُ تُنْفِقُونَ
অর্থ : 'হে মুমিনগণ! তোমরা যা-কিছু উপার্জন করেছ এবং আমি তোমাদের জন্য ভূমি থেকে যা-কিছু উৎপন্ন করেছি, তার উৎকৃষ্ট জিনিসসমূহ থেকে একটি অংশ (আল্লাহর পথে) ব্যয় কর। আর এরূপ মন্দ জিনিস (আল্লাহর নামে) দেওয়ার নিয়ত করো না।৪০৬
ব্যাখ্যা
এ আয়াতে প্রথমত বান্দার উপার্জিত এবং ভূমি হতে আল্লাহর উৎপাদিত বস্তু থেকে যা হালাল ও উৎকৃষ্ট, আল্লাহর পথে তা ব্যয় করতে আদেশ করা হয়েছে। তারপর নিকৃষ্ট বস্ত্র দান করতে নিষেধ করা হয়েছে। এবং তার মন্দত্ব পরিষ্কার করার জন্য দৃষ্টান্তস্বরূপ কাউকে মন্দ বস্তু দেওয়া হলে তার অবস্থা কেমন হয় তা উল্লেখ করা হয়েছে।
বলা হয়েছে যে, তোমাদের উপার্জিত ও ভূমি থেকে উৎপন্ন বস্তুসামগ্রী হতে যা উৎকৃষ্ট তার একটা অংশ আল্লাহর পথে ব্যয় কর। যাকাত ও নফল দান-খয়রাত উভয়টাই এর অন্তর্ভুক্ত। কিছু কিছু লোক যাকাত দেওয়ার সময় নিম্নমানের মাল থেকে তা আদায় করত। এরই পরিপ্রেক্ষিতে আয়াতটি নাযিল হয়। কাজেই সরাসরি এর সম্পর্ক যাকাতের সঙ্গেই হয়। স্বর্ণ-রৌপ্য ছাড়াও নির্দিষ্ট পরিমাণ গবাদি পশুর উপরও যাকাত ফরয হয়ে থাকে। এমনিভাবে ফসলের উপর উশর ফরয হয়। উশর ও একরকম যাকাতই বটে। এসকল সম্পদ সবই সমমানের হয় না। ভালো, মন্দ, মাঝারি বিভিন্নরকম হয়ে থাকে। অনেকে এসব মাল থেকে যাকাত আদায়কালে খুঁজে খুঁজে মন্দটা দেয়। নফল দান-খয়রাতে তো এটা ব্যাপকভাবেই করা হয়ে থাকে।
আল্লাহর পথে খরচ করা মূলত আল্লাহপ্রেমেরই নিদর্শন। নিকৃষ্ট মাল থেকে তাঁর পথে ব্যয় করাটা সে নিদর্শনের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। তাই হুকুম দেওয়া হয়েছে, বেছে বেছে মন্দটা নয়; বরং ভালোটা দিতে চেষ্টা কর। তবেই আল্লাহর কাছে পরিপূর্ণ পুরস্কার লাভ করবে।
প্রকাশ থাকে যে, একদিকে দাতাকে হুকুম দেওয়া হয়েছে উৎকৃষ্ট মাল থেকে দিতে, অন্যদিকে সরকারের পক্ষ থেকে যারা যাকাত উসূল করে তাদের হুকুম দেওয়া হয়েছে যেন বেছে বেছে উৎকৃষ্টটা গ্রহণ না করে; বরং মাঝারি মানেরটা গ্রহণ করে। এর দ্বারা একদিকে যাকাত ব্যয়ের খাত তথা গরীবদেরও স্বার্থ রক্ষা হয় এবং অন্যদিকে যাকাতদাতার উপরও জুলুম হয় না। এটা ইসলামী বিধানাবলীর ভারসাম্য।
তারপর মন্দ জিনিস থেকে দান করতে নিষেধ করা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে-
وَلَا تَيَمَّمُوا الْخَبِيثَ مِنْهُ تُنْفِقُونَ وَلَسْتُمْ بِآخِذِيهِ إِلَّا أَنْ تُغْمِضُوا فِيهِ
‘আর এরূপ মন্দ জিনিস (আল্লাহর নামে) দেওয়ার নিয়ত করো না, যা (অন্য কেউ তোমাদেরকে দিলে ঘৃণার কারণে) তোমরা চক্ষু বন্ধ না করে তা গ্রহণ করবে 'না'।
অর্থাৎ তোমাদেরকে যদি কেউ তোমাদের প্রাপ্য সম্পদ মন্দ বস্তু থেকে দেয় কিংবা কোনও নিম্নমানের বস্তু তোমাদেরকে উপহার দেয়, তবে প্রথমত তোমরা তা গ্রহণই কর না। আর লজ্জাবশত গ্রহণ করলেও এমন অবজ্ঞার সঙ্গে গ্রহণ কর যে, সে বস্তুর দিকে তাকাওই না, চোখ অন্যদিকে ফিরিয়ে রাখ। তুমি আমার এক সাধারণ সৃষ্টি। তুমি নিজের বেলায় যখন এ নীতি অবলম্বন করছ, তখন মহান আল্লাহর সঙ্গে কেন এর বিপরীত আচরণ কর? তাঁকে দেবার বেলায় কেন নিম্নমানের বস্তু খোঁজ? এটা কিছুতেই সমীচীন নয়।
আয়াতের শেষে আল্লাহ তাআলা বলেন-
وَاعْلَمُوا أَنَّ اللَّهَ غَنِيٌّ حَمِيدٌ
(মনে রেখ, আল্লাহ বেনিয়ায, সর্বপ্রকার প্রশংসা তাঁরই দিকে ফেরে)। অর্থাৎ আল্লাহর পথে দান- খয়রাত করার সময় তোমাদের যেন এ কথা স্মরণ থাকে যে, আল্লাহ গনী ও বেনিয়ায। কারও কাছে তাঁর কোনও ঠ্যাকা নেই, তাঁর কোনও অভাব নেই। তিনি তোমাদেরকে দান করতে হুকুম দিয়েছেন তোমাদেরই স্বার্থে। কাজেই তোমরা যদি তাঁর মর্জি মোতাবেক দান না কর, তবে তিনি তা কবুল করবেন না। তোমরা তাঁর কাছে কোনও প্রতিদানও পাবে না। আবার তিনি হামীদ ও গুণগ্রাহীও বটে। তাঁর পথে উৎকৃষ্ট বস্তু খরচ করলে তিনি তা প্রশংসার দৃষ্টিতে দেখেন। তিনি তার উত্তম বদলা দেন। সুতরাং তাঁর সন্তুষ্টি ও উত্তম প্রতিদান পাওয়ার আশায় তাঁর পথে তোমরা উৎকৃষ্ট বস্তুই দান করতে সচেষ্ট থেক।
৪০৫. সূরা আলে ইমরান (৩), আয়াত ৯২
৪০৬. সূরা বাকারা (২), আয়াত ২৬৭
আল্লাহর পথে হযরত আবূ তালহা রাযি.-এর সর্বোৎকৃষ্ট সম্পদ দান করে দেওয়ার ঘটনা
হাদীছ নং : ২৯৭
হযরত আনাস রাযি. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, হযরত আবূ তালহা রাযি. মদীনায় সর্বাপেক্ষা বেশি সম্পদশালী ছিলেন একটি খেজুর বাগানের কারণে। তার কাছে তার সর্বাপেক্ষা প্রিয় সম্পদ ছিল বাইরাহা নামক বাগানটি। বাগানটি ছিল মসজিদের সামনেই। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেই বাগানে প্রবেশ করতেন এবং তার (অর্থাৎ বাগানের মধ্যকার একটি কুয়ার) মিষ্টি পানি পান করতেন।
হযরত আনাস রাযি.বলেন, যখন এ আয়াত নাযিল হল لَنْ تَنَالُوا الْبِرَّ حَتَّى تُنْفِقُوا مِمَّا تُحِبُّونَ তোমরা কিছুতেই পুণ্যের নাগাল পাবে না, যতক্ষণ না তোমরা তোমাদের প্রিয়বস্তু হতে (আল্লাহর জন্য) ব্যয় করবে, তখন আবূ তালহা রাযি. উঠে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আল্লাহ তাআলা আপনার প্রতি আয়াত নাযিল করেছেন- لَنْ تَنَالُوا الْبِرَّ حَتَّى تُنْفِقُوا مِمَّا تُحِبُّونَ, আর আমার কাছে আমার সর্বাপেক্ষা প্রিয় সম্পদ হল বাইরাহা বাগানটি। আমি এটা আল্লাহ তাআলার জন্য সদাকা করে দিলাম। আমি আল্লাহ তাআলার কাছে এর পুণ্য ও প্রতিদান আশা করি। সুতরাং ইয়া রাসূলাল্লাহ! আল্লাহ তাআলার ইচ্ছা অনুযায়ী আপনি এটা যেখানে চান খরচ করুন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, বাহ! এটা তো লাভজনক সম্পদ। এটা তো লাভজনক সম্পদ। তুমি যা বললে আমি তা শুনলাম। আমার মত হচ্ছে, তুমি এটা তোমার নিকটাত্মীয়দের দিয়ে দাও। আবূ তালহা রাযি. বলেন, আমি তাই করব ইয়া রাসূলাল্লাহ। সুতরাং আবূ তালহা রাযি. বাগানটি তার নিকটাত্মীয় ও চাচাতো ভাইদের মধ্যে বণ্টন করে দিলেন -বুখারী ও মুসলিম।৪০৭
ইমাম নববী রহ. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে বলেছেন مال رابح, বুখারী ও মুসলিম শরীফে এর رابح শব্দটি যেমন ب হরফের সঙ্গে আছে, তেমনি ي দ্বারা رايح-ও বর্ণিত আছে। সে হিসেবে অর্থ হবে, এটা এমন সম্পদ যার উপকার তোমার কাছেই ফিরে আসবে। বাইরাহা হচ্ছে একটি খেজুর বাগানের নাম।
(সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ১৪৬১; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ৯৯৮; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ২৯৯৭; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ১২৪৩৮; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীছ নং ৩৩৪০ নাসাঈ, আস্-সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ১১০০০; বায়হাকী, আস্-সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ১১৯২০; শু'আবুল ঈমান, হাদীছ নং ৩১৭৬; সুনানে দারিমী, হাদীছ নং ১৬৯৫)
হাদীছ নং : ২৯৭
হযরত আনাস রাযি. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, হযরত আবূ তালহা রাযি. মদীনায় সর্বাপেক্ষা বেশি সম্পদশালী ছিলেন একটি খেজুর বাগানের কারণে। তার কাছে তার সর্বাপেক্ষা প্রিয় সম্পদ ছিল বাইরাহা নামক বাগানটি। বাগানটি ছিল মসজিদের সামনেই। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেই বাগানে প্রবেশ করতেন এবং তার (অর্থাৎ বাগানের মধ্যকার একটি কুয়ার) মিষ্টি পানি পান করতেন।
হযরত আনাস রাযি.বলেন, যখন এ আয়াত নাযিল হল لَنْ تَنَالُوا الْبِرَّ حَتَّى تُنْفِقُوا مِمَّا تُحِبُّونَ তোমরা কিছুতেই পুণ্যের নাগাল পাবে না, যতক্ষণ না তোমরা তোমাদের প্রিয়বস্তু হতে (আল্লাহর জন্য) ব্যয় করবে, তখন আবূ তালহা রাযি. উঠে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আল্লাহ তাআলা আপনার প্রতি আয়াত নাযিল করেছেন- لَنْ تَنَالُوا الْبِرَّ حَتَّى تُنْفِقُوا مِمَّا تُحِبُّونَ, আর আমার কাছে আমার সর্বাপেক্ষা প্রিয় সম্পদ হল বাইরাহা বাগানটি। আমি এটা আল্লাহ তাআলার জন্য সদাকা করে দিলাম। আমি আল্লাহ তাআলার কাছে এর পুণ্য ও প্রতিদান আশা করি। সুতরাং ইয়া রাসূলাল্লাহ! আল্লাহ তাআলার ইচ্ছা অনুযায়ী আপনি এটা যেখানে চান খরচ করুন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, বাহ! এটা তো লাভজনক সম্পদ। এটা তো লাভজনক সম্পদ। তুমি যা বললে আমি তা শুনলাম। আমার মত হচ্ছে, তুমি এটা তোমার নিকটাত্মীয়দের দিয়ে দাও। আবূ তালহা রাযি. বলেন, আমি তাই করব ইয়া রাসূলাল্লাহ। সুতরাং আবূ তালহা রাযি. বাগানটি তার নিকটাত্মীয় ও চাচাতো ভাইদের মধ্যে বণ্টন করে দিলেন -বুখারী ও মুসলিম।৪০৭
ইমাম নববী রহ. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে বলেছেন مال رابح, বুখারী ও মুসলিম শরীফে এর رابح শব্দটি যেমন ب হরফের সঙ্গে আছে, তেমনি ي দ্বারা رايح-ও বর্ণিত আছে। সে হিসেবে অর্থ হবে, এটা এমন সম্পদ যার উপকার তোমার কাছেই ফিরে আসবে। বাইরাহা হচ্ছে একটি খেজুর বাগানের নাম।
(সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ১৪৬১; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ৯৯৮; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ২৯৯৭; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ১২৪৩৮; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীছ নং ৩৩৪০ নাসাঈ, আস্-সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ১১০০০; বায়হাকী, আস্-সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ১১৯২০; শু'আবুল ঈমান, হাদীছ নং ৩১৭৬; সুনানে দারিমী, হাদীছ নং ১৬৯৫)
37 - باب الإنفاق مِمَّا يحبُّ ومن الجيِّد
قَالَ الله تَعَالَى: {لَنْ تَنَالُوا الْبِرَّ حَتَّى تُنْفِقُوا مِمَّا تُحِبُّونَ} [آل عمران: 92] وَقالَ تَعَالَى: {يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَنْفِقُوا مِنْ طَيِّبَاتِ مَا كَسَبْتُمْ وَمِمَّا أَخْرَجْنَا لَكُمْ مِنَ الأَرْضِ وَلا تَيَمَّمُوا الْخَبِيثَ مِنْهُ تُنْفِقُونَ} [البقرة: 267].
قَالَ الله تَعَالَى: {لَنْ تَنَالُوا الْبِرَّ حَتَّى تُنْفِقُوا مِمَّا تُحِبُّونَ} [آل عمران: 92] وَقالَ تَعَالَى: {يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَنْفِقُوا مِنْ طَيِّبَاتِ مَا كَسَبْتُمْ وَمِمَّا أَخْرَجْنَا لَكُمْ مِنَ الأَرْضِ وَلا تَيَمَّمُوا الْخَبِيثَ مِنْهُ تُنْفِقُونَ} [البقرة: 267].
297 - عن أنس - رضي الله عنه - قَالَ: كَانَ أَبُو طَلْحَةَ - رضي الله عنه - أكْثَرَ الأنْصَار بالمَدِينَةِ مَالًا مِنْ نَخْل، وَكَانَ أَحَبُّ أمْوالِهِ إِلَيْه بَيْرَحَاء، وَكَانتْ مُسْتَقْبلَةَ المَسْجِدِ وَكَانَ رَسُول الله - صلى الله عليه وسلم [ص:115] يَدْخُلُهَا وَيَشْرَبُ مِنْ مَاءٍ فِيهَا طَيِّب. قَالَ أنَسٌ: فَلَمَّا نَزَلَتْ هذِهِ الآيةُ: {لَنْ تَنَالُوا الْبِرَّ حَتَّى تُنْفِقُوا مِمَّا تُحِبُّونَ} قام أَبُو طَلْحَةَ إِلَى رسولِ الله - صلى الله عليه وسلم - فَقَالَ: يَا رَسُول الله، إنَّ الله تَعَالَى أنْزَلَ عَلَيْكَ: {لَنْ تَنَالُوا الْبِرَّ حَتَّى تُنْفِقُوا مِمَّا تُحِبُّونَ} وَإنَّ أَحَبَّ مَالِي إِلَيَّ بَيْرَحَاءُ، وَإنَّهَا صَدَقَةٌ للهِ تَعَالَى، أرْجُو بِرَّهَا، وَذُخْرَهَا عِنْدَ الله تَعَالَى، فَضَعْهَا يَا رَسُول الله حَيْثُ أرَاكَ الله، فَقَالَ رَسُول الله - صلى الله عليه وسلم: «بَخ (1)! ذلِكَ مَالٌ رَابحٌ، ذلِكَ مَالٌ رَابحٌ، وقَدْ سَمِعْتُ مَا قُلْتَ، وَإنِّي أرَى أَنْ تَجْعَلَهَا في الأقْرَبينَ»، فَقَالَ أَبُو طَلْحَةَ: أفْعَلُ يَا رَسُول الله، فَقَسَّمَهَا أَبُو طَلْحَةَ في أقَارِبِهِ، وبَنِي عَمِّهِ. مُتَّفَقٌ عَلَيهِ. (2)
قوله - صلى الله عليه وسلم: «مالٌ رابحٌ»، رُوِيَ في الصحيحين «رابحٌ» و «رايحٌ» بالباء الموحدة وبالياءِ المثناةِ، أي: رايح عَلَيْكَ نفعه، وَ «بَيرَحَاءُ»: حديقة نخلٍ، وروي بكسرِ الباءِ وَفتحِها.
قوله - صلى الله عليه وسلم: «مالٌ رابحٌ»، رُوِيَ في الصحيحين «رابحٌ» و «رايحٌ» بالباء الموحدة وبالياءِ المثناةِ، أي: رايح عَلَيْكَ نفعه، وَ «بَيرَحَاءُ»: حديقة نخلٍ، وروي بكسرِ الباءِ وَفتحِها.
হাদীসের ব্যাখ্যা:
এ হাদীছে মূলত হযরত আবূ তালহা আনসারী রাযি.-এর একটি ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহ তাআলা যখন আয়াত নাযিল করলেন-لَنْ تَنَالُوا الْبِرَّ حَتَّى تُنْفِقُوا مِمَّا تُحِبُّونَ “তোমরা কিছুতেই পুণ্যের নাগাল পাবে না, যতক্ষণ না তোমরা তোমাদের প্রিয়বস্তু হতে (আল্লাহর জন্য) ব্যয় করবে', তখন তিনি তাঁর সর্বাপেক্ষা প্রিয় সম্পদ বাইরাহা নামক বাগানটি দান করে দিলেন। আয়াতে বলা হয়েছে প্রিয়বস্তু দান করতে। তিনি সবচে' বেশি প্ৰিয়টা দিয়ে দিলেন। আল্লাহু আকবার! আল্লাহর হুকুম মানার কী উৎকৃষ্টতর নমুনা। এমনই ছিলেন প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাহাবীগণ। এ কেবল তাঁর একার কথা নয়, বহু সাহাবীই এরকম করেছিলেন। হযরত যায়দ ইবন হারিছা রাযি.-এর সবচে' প্রিয় সম্পদ ছিল একটি ঘোড়া। ঘোড়াটির নাম ছিল 'সাবাল'। তিনি ঘোড়াটির কাছে এসে বললেন, হে আল্লাহ! তুমি জান আমার কাছে এ ঘোড়াটির চেয়ে বেশি প্রিয় আর কোনও সম্পদ নেই। এই বলে তিনি ঘোড়াটি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে নিয়ে আসলেন এবং বললেন, এটি আল্লাহর পথে দিয়ে দিলাম। তিনি তাঁর পুত্র উসামা রাযি.-কে বললেন, তুমি এটা নিয়ে নাও। এতে হযরত যায়দ রাযি. যেন কিছুটা মনঃক্ষুণ্ণ হলেন। তা উপলব্ধি করে তিনি তাঁকে এই বলে সান্ত্বনা দিলেন যে, আল্লাহ তাআলা তোমার দান কবুল করেছেন।
হযরত উমর রাযি.-এর খেলাফতকালে যখন পারস্যের রাজধানী মাদাইন বিজিত হল, তখন তিনি হযরত আবূ মূসা আশআরী রাযি.-এর কাছে চিঠি লিখলেন যে, তুমি যুদ্ধবন্দীদের মধ্য থেকে আমার জন্য একটি দাসী ক্রয় কর। তিনি একটি বাঁদী ক্রয় করলেন। খলিফার সেটি খুব পসন্দ হল। পরক্ষণেই তিনি বললেন, আল্লাহ তাআলা বলেছেন- لَنْ تَنَالُوا الْبِرَّ حَتَّى تُنْفِقُوا مِمَّا تُحِبُّونَ। সুতরাং আমি একে আযাদ করে দিলাম।
হযরত আব্দুল্লাহ ইবন উমর রাযি.-এর গোলাম নাফে' ছিলেন তাঁর খুবই প্রিয়। একবার হযরত আব্দুল্লাহ ইবন জা'ফর রাযি. তার দাম বলেছিলেন এক হাজার দীনার। তাও তিনি বিক্রি করেননি। পরে তিনি তাকে আযাদ করে দেন। তাঁর স্ত্রী সাফিয়্যা রহ. বলেন, আমার খুব ধারণা তিনি এ আয়াতের দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়েই তা করেছিলেন। পরবর্তীকালে এই নাফে' একজন উচ্চস্তরের মুহাদ্দিছ ও ফকীহ হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন।
এ দানের ক্ষেত্রে হযরত আবূ তালহা আনসারী রাযি. উচ্চমাত্রার আদব ও বিনয়েরও পরিচয় দেন। যেহেতু বাগানটির তিনিই মালিক, তাই চাইলে তিনি নিজ ইচ্ছামত যে-কোনও দীনী খাতে দিয়ে দিতে পারতেন। তা না করে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকেই অনুরোধ করলেন যেন তিনি যেখানে চান তা ব্যয় করেন। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর এ আখলাকের কদর করলেন। তিনি নিজ ক্ষমতা প্রয়োগ না করে বরং তাঁকেই পরামর্শ দিলেন, যেন তাঁর আত্মীয়বর্গের মধ্যে বাগানটি বণ্টন করে দেন। তিনি তাই করলেন।
এ দানের জন্য নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আবূ তালহা রাযি.-কে এই বলে সাধুবাদ জানালেন যে, بخ ، ذلك مال رابح ذلك مال رابح (বাহ! এটা তো লাভজনক সম্পদ। এটা তো লাভজনক সম্পদ)। অর্থাৎ দুনিয়ায়ও এটির অনেক দাম এবং আল্লাহর পথে দান করে তুমি আখেরাতেও অনেক লাভ কুড়ালে। এটি দান না করে নিজের কাছে রেখে দিলে মৃত্যু পর্যন্ত সীমিত কালের লাভ পেতে। কিন্তু আল্লাহর পথে দান করে দিয়ে অনন্ত জীবনের লাভ অর্জন করে নিলে।
অপর এক বর্ণনায় رابح এর স্থলে رايح আছে। সে হিসেবে অর্থ হয় এটির উপকার অর্থাৎ ছাওয়াব তোমারই হাতে ফিরে আসবে। বোঝানো হচ্ছে যে, দান করার দ্বারা প্রকৃতপক্ষে এটি তোমার হাতছাড়া হয়নি। কেননা হাতে থাকলে যেমন তুমি এর ফলফলাদি ভোগ করতে পারতে, তেমনি দান করার দ্বারাও তুমি এর সুফল পেতে থাকবে। আর সেটা তো স্থায়ী সুফল। মান ও পরিমাণে দুনিয়ার উপকার অপেক্ষা তা অনেক অনেক শ্রেষ্ঠ।
উল্লেখ্য, হযরত আবূ তালহা আনসারী রাযি. এ বাগানটি যাদেরকে দিয়েছিলেন, তাদের মধ্যে ছিলেন হযরত কা'ব ইবন উবাঈ রাযি. হযরত হাসসান ইবন ছাবিত রাযি., হযরত শাদ্দাদ ইবন আওস রাযি. হযরত নুবায়ত ইবন জাবির রাযি, প্রমুখ। হযরত হাসান রাযি. তাঁর অংশটি একলক্ষ দিরহামের বিনিময়ে হযরত মুআবিয়া রাযি.-এর কাছে বিক্রি করে দিয়েছিলেন। এর দ্বারা অনুমান করা যায় বাগানটি কত দামী ও কত উন্নত মানের ছিল।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. এর দ্বারা সাহাবায়ে কেরামের অন্তরে আল্লাহর পথে দান-খয়রাত করার কী আগ্রহ উদ্দীপনা ছিল সে সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। আল্লাহ তাআলা আমাদের অন্তরেও তার কিছুটা উত্তাপ লাগিয়ে দিন।
খ. আল্লাহর পথে খরচ করতে নিম্নমানের নয়; বরং উৎকৃষ্ট মানের ও প্রিয় সম্পদটাই বেছে নেওয়া চাই।
গ. আল্লাহর পথে দান করার ক্ষেত্রেও আল্লাহওয়ালাদের পরামর্শ নেওয়া চাই।
ঘ. কেউ কোনও ভালো কাজ করলে গুরুজনদের উচিত তাকে সাধুবাদ জানানো।
ঙ. দান-খয়রাতের ক্ষেত্রে নিকটাত্মীয়দের অগ্রাধিকার দেওয়া শ্রেয়।
চ. মনোরম স্থানে গিয়ে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করা ও শীতল ছায়ায় আরাম গ্রহণ করা দূষণীয় কিছু নয়; বরং কৃতজ্ঞতার সঙ্গে আল্লাহ তাআলার নিআমত ভোগের নিয়ত থাকলে তা ছাওয়াবের কাজ বলেই গণ্য হবে।
৪০৮. সূরা তাওবা (৯), আয়াত ৪১
হযরত উমর রাযি.-এর খেলাফতকালে যখন পারস্যের রাজধানী মাদাইন বিজিত হল, তখন তিনি হযরত আবূ মূসা আশআরী রাযি.-এর কাছে চিঠি লিখলেন যে, তুমি যুদ্ধবন্দীদের মধ্য থেকে আমার জন্য একটি দাসী ক্রয় কর। তিনি একটি বাঁদী ক্রয় করলেন। খলিফার সেটি খুব পসন্দ হল। পরক্ষণেই তিনি বললেন, আল্লাহ তাআলা বলেছেন- لَنْ تَنَالُوا الْبِرَّ حَتَّى تُنْفِقُوا مِمَّا تُحِبُّونَ। সুতরাং আমি একে আযাদ করে দিলাম।
হযরত আব্দুল্লাহ ইবন উমর রাযি.-এর গোলাম নাফে' ছিলেন তাঁর খুবই প্রিয়। একবার হযরত আব্দুল্লাহ ইবন জা'ফর রাযি. তার দাম বলেছিলেন এক হাজার দীনার। তাও তিনি বিক্রি করেননি। পরে তিনি তাকে আযাদ করে দেন। তাঁর স্ত্রী সাফিয়্যা রহ. বলেন, আমার খুব ধারণা তিনি এ আয়াতের দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়েই তা করেছিলেন। পরবর্তীকালে এই নাফে' একজন উচ্চস্তরের মুহাদ্দিছ ও ফকীহ হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন।
এ দানের ক্ষেত্রে হযরত আবূ তালহা আনসারী রাযি. উচ্চমাত্রার আদব ও বিনয়েরও পরিচয় দেন। যেহেতু বাগানটির তিনিই মালিক, তাই চাইলে তিনি নিজ ইচ্ছামত যে-কোনও দীনী খাতে দিয়ে দিতে পারতেন। তা না করে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকেই অনুরোধ করলেন যেন তিনি যেখানে চান তা ব্যয় করেন। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর এ আখলাকের কদর করলেন। তিনি নিজ ক্ষমতা প্রয়োগ না করে বরং তাঁকেই পরামর্শ দিলেন, যেন তাঁর আত্মীয়বর্গের মধ্যে বাগানটি বণ্টন করে দেন। তিনি তাই করলেন।
এ দানের জন্য নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আবূ তালহা রাযি.-কে এই বলে সাধুবাদ জানালেন যে, بخ ، ذلك مال رابح ذلك مال رابح (বাহ! এটা তো লাভজনক সম্পদ। এটা তো লাভজনক সম্পদ)। অর্থাৎ দুনিয়ায়ও এটির অনেক দাম এবং আল্লাহর পথে দান করে তুমি আখেরাতেও অনেক লাভ কুড়ালে। এটি দান না করে নিজের কাছে রেখে দিলে মৃত্যু পর্যন্ত সীমিত কালের লাভ পেতে। কিন্তু আল্লাহর পথে দান করে দিয়ে অনন্ত জীবনের লাভ অর্জন করে নিলে।
অপর এক বর্ণনায় رابح এর স্থলে رايح আছে। সে হিসেবে অর্থ হয় এটির উপকার অর্থাৎ ছাওয়াব তোমারই হাতে ফিরে আসবে। বোঝানো হচ্ছে যে, দান করার দ্বারা প্রকৃতপক্ষে এটি তোমার হাতছাড়া হয়নি। কেননা হাতে থাকলে যেমন তুমি এর ফলফলাদি ভোগ করতে পারতে, তেমনি দান করার দ্বারাও তুমি এর সুফল পেতে থাকবে। আর সেটা তো স্থায়ী সুফল। মান ও পরিমাণে দুনিয়ার উপকার অপেক্ষা তা অনেক অনেক শ্রেষ্ঠ।
উল্লেখ্য, হযরত আবূ তালহা আনসারী রাযি. এ বাগানটি যাদেরকে দিয়েছিলেন, তাদের মধ্যে ছিলেন হযরত কা'ব ইবন উবাঈ রাযি. হযরত হাসসান ইবন ছাবিত রাযি., হযরত শাদ্দাদ ইবন আওস রাযি. হযরত নুবায়ত ইবন জাবির রাযি, প্রমুখ। হযরত হাসান রাযি. তাঁর অংশটি একলক্ষ দিরহামের বিনিময়ে হযরত মুআবিয়া রাযি.-এর কাছে বিক্রি করে দিয়েছিলেন। এর দ্বারা অনুমান করা যায় বাগানটি কত দামী ও কত উন্নত মানের ছিল।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. এর দ্বারা সাহাবায়ে কেরামের অন্তরে আল্লাহর পথে দান-খয়রাত করার কী আগ্রহ উদ্দীপনা ছিল সে সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। আল্লাহ তাআলা আমাদের অন্তরেও তার কিছুটা উত্তাপ লাগিয়ে দিন।
খ. আল্লাহর পথে খরচ করতে নিম্নমানের নয়; বরং উৎকৃষ্ট মানের ও প্রিয় সম্পদটাই বেছে নেওয়া চাই।
গ. আল্লাহর পথে দান করার ক্ষেত্রেও আল্লাহওয়ালাদের পরামর্শ নেওয়া চাই।
ঘ. কেউ কোনও ভালো কাজ করলে গুরুজনদের উচিত তাকে সাধুবাদ জানানো।
ঙ. দান-খয়রাতের ক্ষেত্রে নিকটাত্মীয়দের অগ্রাধিকার দেওয়া শ্রেয়।
চ. মনোরম স্থানে গিয়ে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করা ও শীতল ছায়ায় আরাম গ্রহণ করা দূষণীয় কিছু নয়; বরং কৃতজ্ঞতার সঙ্গে আল্লাহ তাআলার নিআমত ভোগের নিয়ত থাকলে তা ছাওয়াবের কাজ বলেই গণ্য হবে।
৪০৮. সূরা তাওবা (৯), আয়াত ৪১
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
