রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ
ভূমিকা অধ্যায়
হাদীস নং: ২৬১
ইয়াতীম, কন্যাসন্তান, সর্বপ্রকার দুর্বল, গরীব-মিসকীন ও দুস্থ লোকদের প্রতি সদয় আচরণ, তাদের প্রতি অনুগ্রহ ও মায়া-মমতা প্রদর্শন এবং তাদের সঙ্গে নম্র-কোমল আচরণ প্রসঙ্গ
আবু সুফয়ান রাযি.-কে নিয়ে একটি ঘটনা:
গরীব সাহাবায়ে কেরাম বনাম হযরত আবু বকর সিদ্দীক রাযি.
হাদীছ নং : ২৬১
হযরত ‘আইয ইবন আমর আল-মুযানী রাযি., যিনি বাইআতুর-রিযওয়ানে অংশগ্রহণকারীদের একজন, তিনি বর্ণনা করেন যে, একদিন আবু সুফয়ান কয়েকজন লোকের সঙ্গে সালমান, সুহায়ব ও বিলালের কাছে আসলেন। (তাদেরকে দেখে) তারা বললেন, আল্লাহর তরবারিসমূহ কি আল্লাহর দুশমনকে পুরোপুরি বুঝে নেয়নি? (তাদের এ মন্তব্য শুনে) আবু বকর রাযি. বললেন, তোমরা কি কুরাইশের এ মুরব্বি ও তাদের নেতাকে এরকম কথা বলছ? এই বলে তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে আসলেন এবং এ বৃত্তান্ত তাঁকে জানালেন। তিনি বললেন, হে আবু বকর! তুমি সম্ভবত তাদেরকে নাখোশ করেছ। যদি তুমি তাদেরকে নাখোশ করে থাক, তবে তুমি তোমার প্রতিপালককেই নাখোশ করলে। অমনি তিনি তাদের কাছে চলে আসলেন এবং বললেন, ওহে আমার ভাইয়েরা! আমি কি তোমাদের নারাজ করে ফেলেছি? তারা বললেন, না, আল্লাহ আপনাকে ক্ষমা করুন হে আমাদের প্রিয় ভাই- মুসলিম।
সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ২৫০৪; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ২০৬৪০; নাসাঈ, আস্ সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ৮২১৯; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর, হাদীছ নং ২৮
গরীব সাহাবায়ে কেরাম বনাম হযরত আবু বকর সিদ্দীক রাযি.
হাদীছ নং : ২৬১
হযরত ‘আইয ইবন আমর আল-মুযানী রাযি., যিনি বাইআতুর-রিযওয়ানে অংশগ্রহণকারীদের একজন, তিনি বর্ণনা করেন যে, একদিন আবু সুফয়ান কয়েকজন লোকের সঙ্গে সালমান, সুহায়ব ও বিলালের কাছে আসলেন। (তাদেরকে দেখে) তারা বললেন, আল্লাহর তরবারিসমূহ কি আল্লাহর দুশমনকে পুরোপুরি বুঝে নেয়নি? (তাদের এ মন্তব্য শুনে) আবু বকর রাযি. বললেন, তোমরা কি কুরাইশের এ মুরব্বি ও তাদের নেতাকে এরকম কথা বলছ? এই বলে তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে আসলেন এবং এ বৃত্তান্ত তাঁকে জানালেন। তিনি বললেন, হে আবু বকর! তুমি সম্ভবত তাদেরকে নাখোশ করেছ। যদি তুমি তাদেরকে নাখোশ করে থাক, তবে তুমি তোমার প্রতিপালককেই নাখোশ করলে। অমনি তিনি তাদের কাছে চলে আসলেন এবং বললেন, ওহে আমার ভাইয়েরা! আমি কি তোমাদের নারাজ করে ফেলেছি? তারা বললেন, না, আল্লাহ আপনাকে ক্ষমা করুন হে আমাদের প্রিয় ভাই- মুসলিম।
সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ২৫০৪; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ২০৬৪০; নাসাঈ, আস্ সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ৮২১৯; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর, হাদীছ নং ২৮
33 - باب ملاطفة اليتيم والبنات وسائر الضعفة والمساكين والمنكسرين والإحسان إليهم والشفقة عليهم والتواضع معهم وخفض الجناح لهم
261 - وعن أَبي هُبَيرَة عائِذ بن عمرو المزنِي وَهُوَ مِنْ أهْل بيعة الرضوان - رضي الله عنه: أنَّ أبا سُفْيَانَ أتَى (1) عَلَى سَلْمَانَ وَصُهَيْبٍ وَبلاَلٍ في نَفَرٍ، فقالوا: مَا أخَذَتْ سُيُوفُ اللهِ مِنْ عَدُوِّ الله [ص:107] مَأْخَذَهَا، فَقَالَ أَبُو بَكْرٍ - رضي الله عنه: أتَقُولُون هَذَا لِشَيْخِ قُرَيْشٍ وَسَيدِهِمْ؟ فَأتَى النَّبيَّ - صلى الله عليه وسلم - فَأخْبَرهُ، فَقَالَ: «يَا أَبَا بَكْرٍ، لَعلَّكَ أغْضَبتَهُمْ؟ لَئِنْ كُنْتَ أغْضَبْتَهُمْ لَقَدْ أغْضَبتَ رَبَّكَ» فَأَتَاهُمْ فَقَالَ: يَا إخْوَتَاهُ، أغْضَبْتُكُمْ؟ قالوا: لاَ، يَغْفِرُ اللهُ لَكَ يَا أُخَيَّ. رواه مسلم. (2)
قولُهُ: «مَأْخَذَهَا» أيْ: لَمْ تَسْتَوفِ حقها مِنْهُ. وقوله: «يَا أُخَيَّ»: رُوِي بفتحِ الهمزةِ وكسرِ الخاءِ وتخفيف الياءِ، وَرُوِيَ بضم الهمزة وفتح الخاء وتشديد الياءِ.
قولُهُ: «مَأْخَذَهَا» أيْ: لَمْ تَسْتَوفِ حقها مِنْهُ. وقوله: «يَا أُخَيَّ»: رُوِي بفتحِ الهمزةِ وكسرِ الخاءِ وتخفيف الياءِ، وَرُوِيَ بضم الهمزة وفتح الخاء وتشديد الياءِ.
হাদীসের ব্যাখ্যা:
এ হাদীছের বর্ণনায় হযরত আইয ইবন আমর রাযি.-এর পরিচয় দিতে গিয়ে বলা হয়েছে, তিনি বাইআতুর রিযওয়ানে অংশগ্রহণ করেছিলেন। বাইআত মানে অঙ্গীকার ও প্রতিশ্রুতি। রিযওয়ান অর্থ সন্তুষ্টি। হুদায়বিয়ার সফরে একপর্যায়ে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবায়ে কেরামের নিকট থেকে বাইআত বা প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করেছেন। সে বাইআতে আল্লাহ তাআলা নিজ সন্তুষ্টির ঘোষণা দান করেন। তাই এর নাম বাইআতুর রিযওয়ান। আমরা সংক্ষেপে বাইআতুর রিযওয়ানের ঘটনা উল্লেখ করছি।
বাইআতুর রিযওয়ান
হুদায়বিয়ার ঘটনা ঘটেছিল হিজরী ৬ষ্ঠ সনের যিলকদ মাসে। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদীনা হতে রমযান মাসে বের হন। তাঁর সঙ্গে ছিল প্রায় দেড় হাজার সাহাবী।
মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্বপ্ন দেখেছিলেন, তিনি সাহাবীগণসহ হজ্জ করেছেন এবং কাবাগৃহের চাবি নিজ হাতে নিয়ে নিয়েছেন। তারপর হজ্জ শেষে কতক সাহাবী মাথা কামিয়ে ফেলেন এবং কতকে চুল ছাঁটেন।
তিনি এ স্বপ্নের কথা সাহাবায়ে কেরামকে জানালেন এবং উমরা আদায়ের প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করে দিলেন। অবশেষে মুহাজির ও আনসারগণকে নিয়ে উমরার উদ্দেশ্যে বের হয়ে পড়লেন। তীর ও তরবারি ছাড়া অন্য কোনও অস্ত্র সংগে নিলেন না। তাঁর ও সফর যে কেবলই উমরা আদায়ের উদ্দেশ্যে, যুদ্ধের জন্য নয়, এটা ভালভাবে স্পষ্ট করে দেওয়া হল।
যাদের সামর্থ্য ছিল, তারা নিজেদের সাথে কুরবানীর পশু নিল। মহানবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের সংগে কুরবানীর পশু ছিল ৭০টি। তার মধ্যে একটি ছিল আবূ জাহলের উট, যার নাকে রুপার বলয় ছিল। এটি বদর যুদ্ধে তাঁর হস্তগত হয়েছিল।
তিনি খুযাআ গোত্রের বিশর নামক এক ব্যক্তিকে কুরায়শের মনোভাব জানার জন্য মক্কায় পাঠিয়ে দিলেন। তিনি যখন উসফান নামক স্থানে পৌঁছলেন, তখন সেই ব্যক্তি ফিরে আসল। সে জানাল, আমি বনূ কা'ব ইবন লুআঈ থেকে যখন চলে আসি, তখন তারা যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। তারা সৈন্য সংগ্রহ করেছে এবং বিভিন্ন গোত্রের লোকজনকেও নিজেদের সাথে এক্কাট্টা করেছে। তারা কিছুতেই আপনাকে বায়তুল্লাহ শরীফে প্রবেশ করতে দেবে না।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবায়ে কেরামের সাথে পরামর্শে বসলেন। বললেন, আমরা কি তাদের সাথে যোগদানকারীদের ঘর-বাড়িতে হামলা করব, যাতে তারা বিক্ষিপ্ত হয়ে যায়, নাকি সোজা বায়তুল্লাহ শরীফের দিকে অগ্রসর হতে থাকব আর কেউ বাধা দিতে আসলে তার সংগে যুদ্ধ করব?
হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি. বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমরা কারও সংগে যুদ্ধ করতে আসিনি। তবে কেউ যদি আমাদের বায়তুল্লাহ শরীফে যাওয়ার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়, তার সংগে অবশ্যই লড়ব।
মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সামনে এগিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন। কুরাউল-গামীমে খালিদ ইবনুল ওয়ালীদ কুরায়শের অগ্রবর্তী বাহিনী প্রস্তুত থাকায় তিনি সে পথ পরিহার করে অন্য পথ ধরলেন। সে পথ খুবই উঁচু-নিচু ও দুর্গম ছিল। তথাপি তাঁরা সেই পথ ধরেই এগিয়ে চললেন।
‘ছানিয়াতুল মিরার’ পৌঁছলে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উটনী ‘আল- কাসওয়া' বসে পড়ল। সেটিকে উঠানোর অনেক চেষ্টা করা হল, কিন্তু উঠল না। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, যেই মহান সত্তা হস্তিবাহিনীকে মক্কায় ঢুকতে দেননি, তিনিই এ উটনীকে আটকে দিয়েছেন, নচেৎ এই উটনী এ রকমের নয়। তারপর তিনি বললেন, আল্লাহর কসম! এমন যে-কোনও প্রস্তাব আমি গ্রহণ করে নেব, যা দ্বারা বায়তুল্লাহর মর্যাদা রক্ষা হয়। এ কথা বলার পর যখন আল- কাসওয়াকে উঠানোর চেষ্টা করা হল, সেটি উঠল এবং চলতে শুরু করল। এভাবে তিনি হুদায়বিয়ার শেষ সীমানায় পৌঁছে শিবির ফেললেন।
সেখানে একটা পুরানো কুয়া ছিল। তাতে সামান্য পরিমাণ পানি ছিল। খুব শীঘ্রই সে পানি শেষ হয়ে গেল। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে আসায় সকলেই পিপাসায় কাতর ছিল। তারা পানি পানি বলে হাহাকার করতে লাগল। মহানবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার তূণ থেকে একটা তীর বের করে বললেন, এটা কুয়ায় ফেলে দাও। তাই করা হল। সংগে সংগে কুয়া পানিতে ভরে গেল এবং তাতে সকলের প্রয়োজন মিটল।
তারপর মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কাউকে কুরায়শের কাছে পাঠাতে চাইলেন। পরামর্শক্রমে তিনি হযরত উছমান রাযি.-কে পাঠালেন। তাঁকে বললেন, তুমি তাদেরকে বলো- আমরা কেবল উমরার নিয়তে এসেছি, যুদ্ধ করা আমাদের অভিপ্রায় নয়। তাদেরকে ইসলামের দাওয়াতও দিও। আর যে সকল মুসলিম নর-নারী মক্কায় আছে তাদেরকে সুসংবাদ দিও যে, শীঘ্রই আল্লাহ তাআলা মক্কায় ইসলামকে জয়যুক্ত করবেন।
হযরত উছমান রাযি. রওয়ানা হয়ে গেলে সাঈদ ইবনুল আসের পুত্র আবান তাঁকে নিজ ঘোড়ায় বসালেন এবং নিজ আশ্রয়ে তাঁকে মক্কায় নিয়ে গেলেন।
মক্কায় গিয়ে হযরত উছমান রাযি. আপন দায়িত্ব পালনে রত হলেন। কিন্তু কুরায়শ নেতৃবর্গ তাঁর কোনও কথায় কর্ণপাত করতে চাইল না। তারা হযরত উছমান রাযি.-কে প্রস্তাব দিল- আপনি চাইলে উমরা করতে পারেন। কিন্তু তিনি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও অন্যান্য সাহাবায়ে কেরামকে ছাড়া একা উমরা করতে সম্মত হলেন না। একপর্যায়ে তারা তাঁকে গৃহবন্দী করে ফেলল। কিন্তু সংবাদ ছড়িয়ে পড়ল যে, কাফেররা হযরত উছমান রাযি.-কে হত্যা করেছে। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছেও হত্যার সংবাদ পৌঁছে গেল। তিনি তখন একটি গাছের নিচে বসে ছিলেন। সাহাবীগণ তাঁর কাছে সমবেত হল।
এরই পরিপ্রেক্ষিতে তিনি সকল সাহাবী থেকে এই মর্মে শপথ নিতে শুরু করলেন যে, যুদ্ধ শুরু হলে কেউ পলায়ন করবে না। সর্বপ্রথম হযরত আবূ সিনান আসাদী রাযি. শপথ গ্রহণ করলেন। তারপর উপস্থিত সকল মুসলিমই শপথ করলেন।
হযরত উছমান রাযি, তো উপস্থিত ছিলেন না। মহানবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর এক হাত তুলে বললেন, এটা উছমানের হাত। তারপর সে হাত অপর হাতের উপর রেখে হযরত উছমান রাযি.-এর পক্ষ হতে শপথ গ্রহণ করলেন [আসাহহুস্-সিয়ার থেকে সংক্ষেপিত]।
এ সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা আয়াত নাযিল করেন-
لَقَدْ رَضِيَ اللَّهُ عَنِ الْمُؤْمِنِينَ إِذْ يُبَايِعُونَكَ تَحْتَ الشَّجَرَةِ فَعَلِمَ مَا فِي قُلُوبِهِمْ فَأَنْزَلَ السَّكِينَةَ عَلَيْهِمْ وَأَثَابَهُمْ فَتْحًا قَرِيبًا
‘নিশ্চয়ই আল্লাহ মুমিনদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন, যখন তারা গাছের নিচে তোমার কাছে বাইআত গ্রহণ করছিল। তাদের অন্তরে যা-কিছু ছিল সে সম্পর্কেও তিনি অবগত ছিলেন। তাই তিনি তাদের উপর অবতীর্ণ করলেন প্রশান্তি এবং পুরস্কারস্বরূপ তাদেরকে দান করলেন আসন্ন বিজয়।২৮০
আয়াতের এ ঘোষণার ফলে বাইআতটির নাম হয়ে যায় বাইআতুর রিযওয়ান । অর্থাৎ যে বাইআতের কারণে আল্লাহ তাআলা মুমিনদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন।
সংক্ষেপে কিছু হযরত আবূ সুফয়ান রাযি. সম্পর্কে
এ হাদীছে হযরত আবূ সুফয়ান রাযি.-কে লক্ষ্য করে কয়েকজন গরীব সাহাবী যে মন্তব্য করেছিলেন, তা মক্কাবিজয়ের পরের কথা। হযরত আবূ সুফয়ান রাযি. প্রথম জীবনে ইসলাম ও নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ঘোর শত্রু ছিলেন। ইসলামের বিরুদ্ধে মক্কাবিজয়ের পূর্ববর্তী সবগুলো যুদ্ধে তাঁর ছিল প্রত্যক্ষ নেতৃত্ব ও মুখ্য ভূমিকা। এ কারণে তাঁর প্রতি সাহাবায়ে কেরামের অন্তরে ছিল প্রচণ্ড বিদ্বেষ। সে বিদ্বেষ আল্লাহরই জন্য। তাঁর ইসলাম গ্রহণও ছিল মূলত পরিস্থিতির মুখে অনেকটা বাধ্য হয়ে। তাঁর অন্তরে যাতে ঈমান পরিপক্ক হয়ে ওঠে, সেজন্য নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর প্রতি মনোরঞ্জনমূলক বিভিন্ন সদাচরণ করেন। ক্রমে তাঁর অন্তরে ইসলাম বদ্ধমূল হতে থাকে। অচিরেই তিনি ইসলামের সেবায় আত্মনিবেদন করেন এবং বিভিন্ন যুদ্ধে প্রশংসনীয় ভূমিকা রাখেন। তায়েফের যুদ্ধে তিনি একটি চোখ হারান। ইয়ারমুকের যুদ্ধে বিপুল বিক্রমে লড়াই করেন। তিনি এ যুদ্ধে দ্বিতীয় চোখটিও হারিয়ে ফেলেন। ফলে সম্পূর্ণ অন্ধ হয়ে যান। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁকে নাজরানের শাসনকর্তা নিযুক্ত করেছিলেন। তাঁর এ পদে থাকা অবস্থায়ই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইন্তিকাল হয়ে যায়।
হযরত আবূ সুফয়ান রাযি.-কে লক্ষ্য করে কয়েকজন সাহাবীর মন্তব্য ও হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি.-এর জবাব
যাহোক মক্কাবিজয়ের আগে দীর্ঘকাল ইসলামের শত্রুতায় নিয়োজিত থাকার কারণে যেহেতু সাহাবায়ে কেরামের অন্তরে তাঁর প্রতি প্রচণ্ড বিদ্বেষ জমাট বেঁধেছিল,তাই মক্কাবিজয়কালে তিনি ইসলাম গ্রহণ করলেও সে বিদ্বেষ দূর হতে খানিকটা সময় লাগে। ফলে মক্কাবিজয়ের পরপর তিনি তাদের সামনে উপস্থিত হলে তারা বলে ওঠেন- ما أخذت سيوف الله من عدو الله مأخذها (আল্লাহর তরবারিসমূহ কি আল্লাহর দশমনকে পুরোপুরি বুঝে নেয়নি?)। 'আল্লাহর তরবারি' বলে মুসলিমদেরকে বোঝানো হয়েছে। বোঝানো হচ্ছে, মুসলিমগণ এখনও পর্যন্ত তাদের তরবারি দ্বারা আল্লাহর এ দুশমনের মুক্তপাত করেনি? অর্থাৎ তার দ্বারা এ যাবতকাল ইসলামের যা ক্ষতি হয়েছে, তাতে তো ইতোমধ্যে একে সাবাড় করে ফেলার কথা ছিল।
আবূ বকর সিদ্দীক রাযি. তাদের এ মন্তব্য পসন্দ করেননি। তিনি চাচ্ছিলেন আবৃ সুফয়ান রাযি. পরিস্থিতির চাপে হলেও যেহেতু ইসলাম গ্রহণ করে নিয়েছে, তাই এখন করণীয় হচ্ছে তাঁর প্রতি মনোরঞ্জনমূলক আচরণ করা। এতে করে ইসলাম তাঁর অন্তরে বদ্ধমূল হবে এবং সে মুমিনদের প্রতি আকৃষ্ট হবে আর তাঁর অন্তরে তাদের প্রতি ভালোবাসা সঞ্চার হবে। তাই তিনি তাদের লক্ষ্য করে বললেন-
أَتَقُوْلُوْنَ هَذَا لِشَيْخِ قُرَيْشٍ وَسَيدِهِمْ؟
(তোমরা কি কুরাইশের এ মুরব্বী ও তাদের নেতাকে এরকম কথা বলছ?)।
অর্থাৎ তোমাদের এখন আর তাঁকে এমন কথা বলা উচিত নয়। কারণ এক তো তিনি ইসলাম গ্রহণ করে নিয়েছেন, সেইসঙ্গে বর্তমানে তিনি কুরায়শদের সবচে' বড় মুরব্বী ও তাদের নেতা। নিজ কওমের একজন নেতা হিসেবে তাঁকে সম্মান দেখানো চাই। এটাও ইসলামেরই শিক্ষা।
হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি.-কে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সতর্কীকরণ ও তাঁর বিনয়ী আচরণ
হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি, তারপর রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে গিয়ে সবকথা খুলে বললেন। সব শুনে তিনি বললেন, হে আবূ বকর! তুমি হয়তো তাদেরকে রাগিয়ে দিয়েছ। অর্থাৎ তুমি তাদেরকে যা বলেছ তাতে হয়তো তারা মনে কষ্ট পেয়েছে এবং তোমার কথা তাদের রাগের কারণ হয়েছে। তারপর তিনি হযরত আবূ বকর রাযি.-কে এই বলে সতর্ক করলেন-
لَئِنْ كُنْتَ أَغْضَبْتَهُمْ لَقَدْ أَغْضَبْتَ رَبَّكَ
(যদি তুমি তাদেরকে নাখোশ করে থাক, তবে তুমি তোমার প্রতিপালককেই নাখোশ করলে) । কেননা তারা আল্লাহর ওলী। ঈমান ও তাকওয়ার উচ্চতর স্তরে তারা অধিষ্ঠিত। কাজেই তারা উচ্চস্তরের আওলিয়াই বটে। কেউ আল্লাহর ওলীকে কষ্ট দিলে তাতে আল্লাহ নাখোশ হন। হাদীছে কুদসীতে আছে-
مَنْ عَادَى لِيْ وَلِيًّا فَقَدْ آذَنْتُهُ بِالْحَرْبِ
‘যে কেউ আমার ওলীকে কষ্ট দেয়, তার সঙ্গে আমি যুদ্ধ ঘোষণা করলাম।
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এখানে আল্লাহ তাআলার গুণবাচক নাম 'রব্ব' উল্লেখ করেছেন। রব্ব বলা হয় এমন সত্তাকে, যিনি বান্দার প্রয়োজনীয় সব সামগ্রীর যোগান দিয়ে ক্রমান্বয়ে তাকে পরিপূর্ণতায় পৌঁছান। তো তুমি তোমার রব্বকে নারাজ করলে' বলে ইঙ্গিত করা হচ্ছে যে, আল্লাহ তাআলা নিজ অনুগ্রহে তোমাকে ঈমান ও তাকওয়ার এক অসাধারণ স্তরে পৌঁছিয়েছেন। সে হিসেবে তোমার ভেতর আল্লাহপ্রেমও থাকার কথা অসামান্য। কেননা কারও প্রতি যার অনুগ্রহ যত বেশি হয়, তার প্রতি তার প্রেম ও মহব্বতও তত বেশিই হয়ে থাকে। এ আল্লাহপ্রেমের দাবি হচ্ছে তাঁর সকল প্রিয়জনকে ভালোবাসা। ওই গরীব সাহাবীগণ যখন আল্লাহর ওলী ও প্রিয়জন, তখন আল্লাহর ভালোবাসায় তাদেরও ভালোবাসা উচিত। তাদেরকে ভালো না বাসলে সে যেন আল্লাহপ্রেমের দাবি সম্পর্কে খানিকটা উদাসীন হয়ে গেল আর এভাবে সে তাঁকে একপর্যায়ে নারাজও করে ফেলল। সুতরাং তুমি তাদেরকে নারাজ করে থাকলে যেন আল্লাহ তাআলাকেই নারাজ করেছ।
ইনি তো সিদ্দীকে আকবার। উম্মতের শ্রেষ্ঠতম ব্যক্তি। শ্রেষ্ঠতম আল্লাহপ্রেমিক ও শ্রেষ্ঠতম আশেকে রাসূল। কাজেই আল্লাহ তাআলা ও তাঁর রাসূলের বিন্দুমাত্র নারাজিও তিনি বরদাশত করতে পারেন কি? সঙ্গে সঙ্গে তিনি সেই মজলিসে চলে গেলেন, যেখানে হযরত সালমান রাযি. বিলাল রাযি. ও সুহায়ব রাযি. প্রমুখ বসা ছিলেন। তিনি তাদেরকে পরম বিনয় ও ভালোবাসার সঙ্গে সম্বোধন করে বললেন-يا إخوتاه ২৮২ أغضبتكم؟ (ওহে আমার ভাইয়েরা! আমি কি তোমাদের নারাজ করে ফেলেছি?)। অর্থাৎ আবূ সুফয়ানের পক্ষ হয়ে আমি তোমাদের যা বলেছি, তোমরা কি তাতে মনে কষ্ট পেয়েছ? এই বলে তিনি তাদের কাছে পরোক্ষভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করলেন কিংবা বলা যায় তাদের মনোরঞ্জনের চেষ্টা করলেন। তারা বললেন- ‘لا يغفر الله لك يا اخي (না, আল্লাহ আপনাকে ক্ষমা করুন হে আমাদের প্রিয় ভাই)। অর্থাৎ আপনার সে কথায় আমরা মনে কষ্ট পাইনি। বাস্তবিকপক্ষে মনে কষ্ট পাওয়ার কথাও নয়। হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি.-এর সমুচ্চ আখলাক ও মহানুভবতার সাথে তারা পরিচিত ছিলেন। তারা জানতেন তিনি তাদেরকে তুচ্ছ গণ্য করেন না এবং তিনি তাদেরকে কষ্ট দিতেও চাননি। তিনি কেবল আবূ সুফয়ান রাযি.-কে খুশি করতে চেয়েছিলেন, যাতে তাঁর ঈমানে পরিপক্কতা আসে এবং তাঁর ও তাঁর অনুসারীদের দ্বারা উম্মতের সংখ্যাবৃদ্ধি ঘটে।
তারা তাঁর জন্য মাগফিরাতের দুআও করলেন। এ দুআ দ্বারা ইঙ্গিত হয় না যে, আবূ সুফয়ান রাযি.-এর পক্ষে কথা বলে তিনি কিছু অপরাধ করেছিলেন। কারও জন্য মাগফিরাতের দুআ করতে অপরাধের প্রতি দৃষ্টিপাতের প্রয়োজন হয় না। আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে মাগফিরাতলাভ বান্দার জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি। কাজেই কারও জন্য এ দুআ করাও তার জন্য দুআকারীর পক্ষ থেকে শ্রেষ্ঠতম উপহার। তারা খুশি হয়ে এ দুআর মাধ্যমে তাঁকে সে উপহারই দান করেছেন।
উল্লেখ্য, তারা যে বলেছেন- لا‘ يغفر الله لك (না, আল্লাহ আপনাকে ক্ষমা করুন), এখানে لا -এর পর ওয়াক্ফ করা জরুরি। অন্যথায় অর্থ হয়ে যাবে- আল্লাহ যেন আপনাকে ক্ষমা না করেন। একবার এমন হল যে, হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি. একজনের হাতে কিছু পণ্য দেখে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি এটা বিক্রি করবে? সে ওয়াক্ফ ছাড়াই বলল- لا يرحمك الله (না আল্লাহ আপনার প্রতি রহমত করুন)। তিনি বললেন, এরকম নয়; বরং বল- لا‘ يرحمك الله (না, আল্লাহ আপনার প্রতি রহমত করুন)।
হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি. থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি এরকম বাক্য ব্যবহার করতেই নিষেধ করতেন। অর্থাৎ তিনি দুআর আগে لا ব্যবহার করতে নিষেধ করতেন। কেননা لا ব্যবহার করলে দুআর পরিবর্তে বদ্দুআ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।
সবশেষে তারা يا اخي (হে আমাদের প্রিয় ভাই) বলে ইঙ্গিত করছেন যে, তাঁর কথায় তাদের মনে কষ্ট আসবে কি করে, যখন তাদের মধ্যে সম্পর্কটা ভ্রাতৃত্বের এবং সে ভ্রাতৃত্বও অনেক গভীর! এক ভাই অন্য ভাইকে তিরস্কার করলে তা তার কল্যাণার্থেই করে থাকে। সেজন্য মনে কষ্ট নেওয়া উচিত নয়। আবার তাও যদি হয় মহান আবূ বকর সিদ্দীক রাযি.-এর মত কোনও ভাই, যিনি মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ছায়াস্বরূপ, উম্মতের সকলের প্রতি যাঁর অসাধারণ স্নেহ-মমতা!
হাদীছটির শিক্ষা
ক. কারও প্রতি বিদ্বেষ যদি হয় আল্লাহর জন্য, তবে সে বিদ্বেষ দোষের নয়। অবশ্য কোন্ বিদ্বেষ আল্লাহর জন্য এবং কোন্টা আল্লাহর জন্য নয়, আল্লাহওয়ালা উলামার কাছ থেকে তা শিখে নেওয়া চাই ।
খ. এ হাদীছ দ্বারা হযরত সালমান রাযি., হযরত সুহায়ব রাযি., হযরত বিলাল রাযি প্রমুখ গরীব সাহাবীদের মর্যাদা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। বলাবাহুল্য তাদের সে মর্যাদা লাভ হয়েছিল ঈমান ও তাকওয়ার কারণে। সুতরাং মুত্তাকী ও পরহেযগার গরীবদের মর্যাদার দৃষ্টিতে দেখা চাই।
গ. বড়র সামনে ছোটদের কোনও কথা আপত্তিকর মনে হলে তার উচিত তা সংশোধন করে দেওয়া।
ঘ. নিজের কোনও কথা সঠিক হল কি না এ ব্যাপারে সন্দেহ হলে বিজ্ঞজনের কাছে গিয়ে সে সন্দেহের নিরসন করে নেওয়া উচিত।
ঙ. যারা মুত্তাকী-পরহেযগার, তারা আল্লাহর ওলী। কোনও অবস্থায়ই তাদেরকে কষ্ট দেওয়া উচিত নয়। তাতে আল্লাহ নারাজ হন।
চ. কাউকে কষ্ট দিয়ে ফেললে যথাশীঘ্র ক্ষমা চেয়ে নেওয়া উচিত। ক্ষমা চাইতে লজ্জাবোধ করা উচিত নয়।
ছ. বড়র তিরস্কারে ছোটদের মনে কষ্ট নেওয়া উচিত নয়। মনে করতে হবে তার সে তিরস্কার তাদের কল্যাণার্থেই ।
জ. কেউ ক্ষমা চাইলে সঙ্গে সঙ্গেই ক্ষমা করে দেওয়া উচিত। সেইসঙ্গে তার জন্য আল্লাহর কাছে মাগফিরাতের দুআ করাও বাঞ্ছনীয়।
২৮০. সূরা ফাত্হ (৪৮), আয়াত ১৮
২৮১. সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৬৫০২; সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ৩৪৭; সুনানে ইবন মাজাহ, হাদীছ নং ৩৯৮৯; বায়হাকী, আস্ সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ৬৩৯৫; বাগাবী, শারহুস্ সুন্নাহ, হাদীছ নং ১২৪৭
২৮২. يا হরফটি ইস্তিগাছা (বিপদে ফরিয়াদ জানানো ও সাহায্য প্রার্থনা করা)-এর অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। ইস্তিগাছার জন্য যাকে আহ্বান করা হয়, সেই 'মুনাদা'-এর ইসমে যদি يا لزيد -এর মত لام الجر দাখিল না হয়, তবে সাধারণত শেষে আলিফ যুক্ত হয়ে থাকে। তখন যদি ওয়াক্ফ করা হয়, তবে শেষে هاء السكت ব্যবহার করা যায়। সম্ভবত হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি. اخوتاه -এর উপর ওয়াক্ফ করেছিলেন। সে কারণেই هاء السكت ব্যবহার করেছেন। অথবা এটা ব্যবহার করেছেন যারা المندوب ছাড়াও هاء السكت ব্যবহার করে থাকে তাদের ভাষারীতি অনুযায়ী। তবে এরকম ব্যবহার বিরল।
বাইআতুর রিযওয়ান
হুদায়বিয়ার ঘটনা ঘটেছিল হিজরী ৬ষ্ঠ সনের যিলকদ মাসে। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদীনা হতে রমযান মাসে বের হন। তাঁর সঙ্গে ছিল প্রায় দেড় হাজার সাহাবী।
মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্বপ্ন দেখেছিলেন, তিনি সাহাবীগণসহ হজ্জ করেছেন এবং কাবাগৃহের চাবি নিজ হাতে নিয়ে নিয়েছেন। তারপর হজ্জ শেষে কতক সাহাবী মাথা কামিয়ে ফেলেন এবং কতকে চুল ছাঁটেন।
তিনি এ স্বপ্নের কথা সাহাবায়ে কেরামকে জানালেন এবং উমরা আদায়ের প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করে দিলেন। অবশেষে মুহাজির ও আনসারগণকে নিয়ে উমরার উদ্দেশ্যে বের হয়ে পড়লেন। তীর ও তরবারি ছাড়া অন্য কোনও অস্ত্র সংগে নিলেন না। তাঁর ও সফর যে কেবলই উমরা আদায়ের উদ্দেশ্যে, যুদ্ধের জন্য নয়, এটা ভালভাবে স্পষ্ট করে দেওয়া হল।
যাদের সামর্থ্য ছিল, তারা নিজেদের সাথে কুরবানীর পশু নিল। মহানবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের সংগে কুরবানীর পশু ছিল ৭০টি। তার মধ্যে একটি ছিল আবূ জাহলের উট, যার নাকে রুপার বলয় ছিল। এটি বদর যুদ্ধে তাঁর হস্তগত হয়েছিল।
তিনি খুযাআ গোত্রের বিশর নামক এক ব্যক্তিকে কুরায়শের মনোভাব জানার জন্য মক্কায় পাঠিয়ে দিলেন। তিনি যখন উসফান নামক স্থানে পৌঁছলেন, তখন সেই ব্যক্তি ফিরে আসল। সে জানাল, আমি বনূ কা'ব ইবন লুআঈ থেকে যখন চলে আসি, তখন তারা যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। তারা সৈন্য সংগ্রহ করেছে এবং বিভিন্ন গোত্রের লোকজনকেও নিজেদের সাথে এক্কাট্টা করেছে। তারা কিছুতেই আপনাকে বায়তুল্লাহ শরীফে প্রবেশ করতে দেবে না।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবায়ে কেরামের সাথে পরামর্শে বসলেন। বললেন, আমরা কি তাদের সাথে যোগদানকারীদের ঘর-বাড়িতে হামলা করব, যাতে তারা বিক্ষিপ্ত হয়ে যায়, নাকি সোজা বায়তুল্লাহ শরীফের দিকে অগ্রসর হতে থাকব আর কেউ বাধা দিতে আসলে তার সংগে যুদ্ধ করব?
হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি. বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমরা কারও সংগে যুদ্ধ করতে আসিনি। তবে কেউ যদি আমাদের বায়তুল্লাহ শরীফে যাওয়ার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়, তার সংগে অবশ্যই লড়ব।
মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সামনে এগিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন। কুরাউল-গামীমে খালিদ ইবনুল ওয়ালীদ কুরায়শের অগ্রবর্তী বাহিনী প্রস্তুত থাকায় তিনি সে পথ পরিহার করে অন্য পথ ধরলেন। সে পথ খুবই উঁচু-নিচু ও দুর্গম ছিল। তথাপি তাঁরা সেই পথ ধরেই এগিয়ে চললেন।
‘ছানিয়াতুল মিরার’ পৌঁছলে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উটনী ‘আল- কাসওয়া' বসে পড়ল। সেটিকে উঠানোর অনেক চেষ্টা করা হল, কিন্তু উঠল না। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, যেই মহান সত্তা হস্তিবাহিনীকে মক্কায় ঢুকতে দেননি, তিনিই এ উটনীকে আটকে দিয়েছেন, নচেৎ এই উটনী এ রকমের নয়। তারপর তিনি বললেন, আল্লাহর কসম! এমন যে-কোনও প্রস্তাব আমি গ্রহণ করে নেব, যা দ্বারা বায়তুল্লাহর মর্যাদা রক্ষা হয়। এ কথা বলার পর যখন আল- কাসওয়াকে উঠানোর চেষ্টা করা হল, সেটি উঠল এবং চলতে শুরু করল। এভাবে তিনি হুদায়বিয়ার শেষ সীমানায় পৌঁছে শিবির ফেললেন।
সেখানে একটা পুরানো কুয়া ছিল। তাতে সামান্য পরিমাণ পানি ছিল। খুব শীঘ্রই সে পানি শেষ হয়ে গেল। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে আসায় সকলেই পিপাসায় কাতর ছিল। তারা পানি পানি বলে হাহাকার করতে লাগল। মহানবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার তূণ থেকে একটা তীর বের করে বললেন, এটা কুয়ায় ফেলে দাও। তাই করা হল। সংগে সংগে কুয়া পানিতে ভরে গেল এবং তাতে সকলের প্রয়োজন মিটল।
তারপর মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কাউকে কুরায়শের কাছে পাঠাতে চাইলেন। পরামর্শক্রমে তিনি হযরত উছমান রাযি.-কে পাঠালেন। তাঁকে বললেন, তুমি তাদেরকে বলো- আমরা কেবল উমরার নিয়তে এসেছি, যুদ্ধ করা আমাদের অভিপ্রায় নয়। তাদেরকে ইসলামের দাওয়াতও দিও। আর যে সকল মুসলিম নর-নারী মক্কায় আছে তাদেরকে সুসংবাদ দিও যে, শীঘ্রই আল্লাহ তাআলা মক্কায় ইসলামকে জয়যুক্ত করবেন।
হযরত উছমান রাযি. রওয়ানা হয়ে গেলে সাঈদ ইবনুল আসের পুত্র আবান তাঁকে নিজ ঘোড়ায় বসালেন এবং নিজ আশ্রয়ে তাঁকে মক্কায় নিয়ে গেলেন।
মক্কায় গিয়ে হযরত উছমান রাযি. আপন দায়িত্ব পালনে রত হলেন। কিন্তু কুরায়শ নেতৃবর্গ তাঁর কোনও কথায় কর্ণপাত করতে চাইল না। তারা হযরত উছমান রাযি.-কে প্রস্তাব দিল- আপনি চাইলে উমরা করতে পারেন। কিন্তু তিনি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও অন্যান্য সাহাবায়ে কেরামকে ছাড়া একা উমরা করতে সম্মত হলেন না। একপর্যায়ে তারা তাঁকে গৃহবন্দী করে ফেলল। কিন্তু সংবাদ ছড়িয়ে পড়ল যে, কাফেররা হযরত উছমান রাযি.-কে হত্যা করেছে। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছেও হত্যার সংবাদ পৌঁছে গেল। তিনি তখন একটি গাছের নিচে বসে ছিলেন। সাহাবীগণ তাঁর কাছে সমবেত হল।
এরই পরিপ্রেক্ষিতে তিনি সকল সাহাবী থেকে এই মর্মে শপথ নিতে শুরু করলেন যে, যুদ্ধ শুরু হলে কেউ পলায়ন করবে না। সর্বপ্রথম হযরত আবূ সিনান আসাদী রাযি. শপথ গ্রহণ করলেন। তারপর উপস্থিত সকল মুসলিমই শপথ করলেন।
হযরত উছমান রাযি, তো উপস্থিত ছিলেন না। মহানবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর এক হাত তুলে বললেন, এটা উছমানের হাত। তারপর সে হাত অপর হাতের উপর রেখে হযরত উছমান রাযি.-এর পক্ষ হতে শপথ গ্রহণ করলেন [আসাহহুস্-সিয়ার থেকে সংক্ষেপিত]।
এ সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা আয়াত নাযিল করেন-
لَقَدْ رَضِيَ اللَّهُ عَنِ الْمُؤْمِنِينَ إِذْ يُبَايِعُونَكَ تَحْتَ الشَّجَرَةِ فَعَلِمَ مَا فِي قُلُوبِهِمْ فَأَنْزَلَ السَّكِينَةَ عَلَيْهِمْ وَأَثَابَهُمْ فَتْحًا قَرِيبًا
‘নিশ্চয়ই আল্লাহ মুমিনদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন, যখন তারা গাছের নিচে তোমার কাছে বাইআত গ্রহণ করছিল। তাদের অন্তরে যা-কিছু ছিল সে সম্পর্কেও তিনি অবগত ছিলেন। তাই তিনি তাদের উপর অবতীর্ণ করলেন প্রশান্তি এবং পুরস্কারস্বরূপ তাদেরকে দান করলেন আসন্ন বিজয়।২৮০
আয়াতের এ ঘোষণার ফলে বাইআতটির নাম হয়ে যায় বাইআতুর রিযওয়ান । অর্থাৎ যে বাইআতের কারণে আল্লাহ তাআলা মুমিনদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন।
সংক্ষেপে কিছু হযরত আবূ সুফয়ান রাযি. সম্পর্কে
এ হাদীছে হযরত আবূ সুফয়ান রাযি.-কে লক্ষ্য করে কয়েকজন গরীব সাহাবী যে মন্তব্য করেছিলেন, তা মক্কাবিজয়ের পরের কথা। হযরত আবূ সুফয়ান রাযি. প্রথম জীবনে ইসলাম ও নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ঘোর শত্রু ছিলেন। ইসলামের বিরুদ্ধে মক্কাবিজয়ের পূর্ববর্তী সবগুলো যুদ্ধে তাঁর ছিল প্রত্যক্ষ নেতৃত্ব ও মুখ্য ভূমিকা। এ কারণে তাঁর প্রতি সাহাবায়ে কেরামের অন্তরে ছিল প্রচণ্ড বিদ্বেষ। সে বিদ্বেষ আল্লাহরই জন্য। তাঁর ইসলাম গ্রহণও ছিল মূলত পরিস্থিতির মুখে অনেকটা বাধ্য হয়ে। তাঁর অন্তরে যাতে ঈমান পরিপক্ক হয়ে ওঠে, সেজন্য নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর প্রতি মনোরঞ্জনমূলক বিভিন্ন সদাচরণ করেন। ক্রমে তাঁর অন্তরে ইসলাম বদ্ধমূল হতে থাকে। অচিরেই তিনি ইসলামের সেবায় আত্মনিবেদন করেন এবং বিভিন্ন যুদ্ধে প্রশংসনীয় ভূমিকা রাখেন। তায়েফের যুদ্ধে তিনি একটি চোখ হারান। ইয়ারমুকের যুদ্ধে বিপুল বিক্রমে লড়াই করেন। তিনি এ যুদ্ধে দ্বিতীয় চোখটিও হারিয়ে ফেলেন। ফলে সম্পূর্ণ অন্ধ হয়ে যান। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁকে নাজরানের শাসনকর্তা নিযুক্ত করেছিলেন। তাঁর এ পদে থাকা অবস্থায়ই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইন্তিকাল হয়ে যায়।
হযরত আবূ সুফয়ান রাযি.-কে লক্ষ্য করে কয়েকজন সাহাবীর মন্তব্য ও হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি.-এর জবাব
যাহোক মক্কাবিজয়ের আগে দীর্ঘকাল ইসলামের শত্রুতায় নিয়োজিত থাকার কারণে যেহেতু সাহাবায়ে কেরামের অন্তরে তাঁর প্রতি প্রচণ্ড বিদ্বেষ জমাট বেঁধেছিল,তাই মক্কাবিজয়কালে তিনি ইসলাম গ্রহণ করলেও সে বিদ্বেষ দূর হতে খানিকটা সময় লাগে। ফলে মক্কাবিজয়ের পরপর তিনি তাদের সামনে উপস্থিত হলে তারা বলে ওঠেন- ما أخذت سيوف الله من عدو الله مأخذها (আল্লাহর তরবারিসমূহ কি আল্লাহর দশমনকে পুরোপুরি বুঝে নেয়নি?)। 'আল্লাহর তরবারি' বলে মুসলিমদেরকে বোঝানো হয়েছে। বোঝানো হচ্ছে, মুসলিমগণ এখনও পর্যন্ত তাদের তরবারি দ্বারা আল্লাহর এ দুশমনের মুক্তপাত করেনি? অর্থাৎ তার দ্বারা এ যাবতকাল ইসলামের যা ক্ষতি হয়েছে, তাতে তো ইতোমধ্যে একে সাবাড় করে ফেলার কথা ছিল।
আবূ বকর সিদ্দীক রাযি. তাদের এ মন্তব্য পসন্দ করেননি। তিনি চাচ্ছিলেন আবৃ সুফয়ান রাযি. পরিস্থিতির চাপে হলেও যেহেতু ইসলাম গ্রহণ করে নিয়েছে, তাই এখন করণীয় হচ্ছে তাঁর প্রতি মনোরঞ্জনমূলক আচরণ করা। এতে করে ইসলাম তাঁর অন্তরে বদ্ধমূল হবে এবং সে মুমিনদের প্রতি আকৃষ্ট হবে আর তাঁর অন্তরে তাদের প্রতি ভালোবাসা সঞ্চার হবে। তাই তিনি তাদের লক্ষ্য করে বললেন-
أَتَقُوْلُوْنَ هَذَا لِشَيْخِ قُرَيْشٍ وَسَيدِهِمْ؟
(তোমরা কি কুরাইশের এ মুরব্বী ও তাদের নেতাকে এরকম কথা বলছ?)।
অর্থাৎ তোমাদের এখন আর তাঁকে এমন কথা বলা উচিত নয়। কারণ এক তো তিনি ইসলাম গ্রহণ করে নিয়েছেন, সেইসঙ্গে বর্তমানে তিনি কুরায়শদের সবচে' বড় মুরব্বী ও তাদের নেতা। নিজ কওমের একজন নেতা হিসেবে তাঁকে সম্মান দেখানো চাই। এটাও ইসলামেরই শিক্ষা।
হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি.-কে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সতর্কীকরণ ও তাঁর বিনয়ী আচরণ
হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি, তারপর রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে গিয়ে সবকথা খুলে বললেন। সব শুনে তিনি বললেন, হে আবূ বকর! তুমি হয়তো তাদেরকে রাগিয়ে দিয়েছ। অর্থাৎ তুমি তাদেরকে যা বলেছ তাতে হয়তো তারা মনে কষ্ট পেয়েছে এবং তোমার কথা তাদের রাগের কারণ হয়েছে। তারপর তিনি হযরত আবূ বকর রাযি.-কে এই বলে সতর্ক করলেন-
لَئِنْ كُنْتَ أَغْضَبْتَهُمْ لَقَدْ أَغْضَبْتَ رَبَّكَ
(যদি তুমি তাদেরকে নাখোশ করে থাক, তবে তুমি তোমার প্রতিপালককেই নাখোশ করলে) । কেননা তারা আল্লাহর ওলী। ঈমান ও তাকওয়ার উচ্চতর স্তরে তারা অধিষ্ঠিত। কাজেই তারা উচ্চস্তরের আওলিয়াই বটে। কেউ আল্লাহর ওলীকে কষ্ট দিলে তাতে আল্লাহ নাখোশ হন। হাদীছে কুদসীতে আছে-
مَنْ عَادَى لِيْ وَلِيًّا فَقَدْ آذَنْتُهُ بِالْحَرْبِ
‘যে কেউ আমার ওলীকে কষ্ট দেয়, তার সঙ্গে আমি যুদ্ধ ঘোষণা করলাম।
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এখানে আল্লাহ তাআলার গুণবাচক নাম 'রব্ব' উল্লেখ করেছেন। রব্ব বলা হয় এমন সত্তাকে, যিনি বান্দার প্রয়োজনীয় সব সামগ্রীর যোগান দিয়ে ক্রমান্বয়ে তাকে পরিপূর্ণতায় পৌঁছান। তো তুমি তোমার রব্বকে নারাজ করলে' বলে ইঙ্গিত করা হচ্ছে যে, আল্লাহ তাআলা নিজ অনুগ্রহে তোমাকে ঈমান ও তাকওয়ার এক অসাধারণ স্তরে পৌঁছিয়েছেন। সে হিসেবে তোমার ভেতর আল্লাহপ্রেমও থাকার কথা অসামান্য। কেননা কারও প্রতি যার অনুগ্রহ যত বেশি হয়, তার প্রতি তার প্রেম ও মহব্বতও তত বেশিই হয়ে থাকে। এ আল্লাহপ্রেমের দাবি হচ্ছে তাঁর সকল প্রিয়জনকে ভালোবাসা। ওই গরীব সাহাবীগণ যখন আল্লাহর ওলী ও প্রিয়জন, তখন আল্লাহর ভালোবাসায় তাদেরও ভালোবাসা উচিত। তাদেরকে ভালো না বাসলে সে যেন আল্লাহপ্রেমের দাবি সম্পর্কে খানিকটা উদাসীন হয়ে গেল আর এভাবে সে তাঁকে একপর্যায়ে নারাজও করে ফেলল। সুতরাং তুমি তাদেরকে নারাজ করে থাকলে যেন আল্লাহ তাআলাকেই নারাজ করেছ।
ইনি তো সিদ্দীকে আকবার। উম্মতের শ্রেষ্ঠতম ব্যক্তি। শ্রেষ্ঠতম আল্লাহপ্রেমিক ও শ্রেষ্ঠতম আশেকে রাসূল। কাজেই আল্লাহ তাআলা ও তাঁর রাসূলের বিন্দুমাত্র নারাজিও তিনি বরদাশত করতে পারেন কি? সঙ্গে সঙ্গে তিনি সেই মজলিসে চলে গেলেন, যেখানে হযরত সালমান রাযি. বিলাল রাযি. ও সুহায়ব রাযি. প্রমুখ বসা ছিলেন। তিনি তাদেরকে পরম বিনয় ও ভালোবাসার সঙ্গে সম্বোধন করে বললেন-يا إخوتاه ২৮২ أغضبتكم؟ (ওহে আমার ভাইয়েরা! আমি কি তোমাদের নারাজ করে ফেলেছি?)। অর্থাৎ আবূ সুফয়ানের পক্ষ হয়ে আমি তোমাদের যা বলেছি, তোমরা কি তাতে মনে কষ্ট পেয়েছ? এই বলে তিনি তাদের কাছে পরোক্ষভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করলেন কিংবা বলা যায় তাদের মনোরঞ্জনের চেষ্টা করলেন। তারা বললেন- ‘لا يغفر الله لك يا اخي (না, আল্লাহ আপনাকে ক্ষমা করুন হে আমাদের প্রিয় ভাই)। অর্থাৎ আপনার সে কথায় আমরা মনে কষ্ট পাইনি। বাস্তবিকপক্ষে মনে কষ্ট পাওয়ার কথাও নয়। হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি.-এর সমুচ্চ আখলাক ও মহানুভবতার সাথে তারা পরিচিত ছিলেন। তারা জানতেন তিনি তাদেরকে তুচ্ছ গণ্য করেন না এবং তিনি তাদেরকে কষ্ট দিতেও চাননি। তিনি কেবল আবূ সুফয়ান রাযি.-কে খুশি করতে চেয়েছিলেন, যাতে তাঁর ঈমানে পরিপক্কতা আসে এবং তাঁর ও তাঁর অনুসারীদের দ্বারা উম্মতের সংখ্যাবৃদ্ধি ঘটে।
তারা তাঁর জন্য মাগফিরাতের দুআও করলেন। এ দুআ দ্বারা ইঙ্গিত হয় না যে, আবূ সুফয়ান রাযি.-এর পক্ষে কথা বলে তিনি কিছু অপরাধ করেছিলেন। কারও জন্য মাগফিরাতের দুআ করতে অপরাধের প্রতি দৃষ্টিপাতের প্রয়োজন হয় না। আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে মাগফিরাতলাভ বান্দার জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি। কাজেই কারও জন্য এ দুআ করাও তার জন্য দুআকারীর পক্ষ থেকে শ্রেষ্ঠতম উপহার। তারা খুশি হয়ে এ দুআর মাধ্যমে তাঁকে সে উপহারই দান করেছেন।
উল্লেখ্য, তারা যে বলেছেন- لا‘ يغفر الله لك (না, আল্লাহ আপনাকে ক্ষমা করুন), এখানে لا -এর পর ওয়াক্ফ করা জরুরি। অন্যথায় অর্থ হয়ে যাবে- আল্লাহ যেন আপনাকে ক্ষমা না করেন। একবার এমন হল যে, হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি. একজনের হাতে কিছু পণ্য দেখে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি এটা বিক্রি করবে? সে ওয়াক্ফ ছাড়াই বলল- لا يرحمك الله (না আল্লাহ আপনার প্রতি রহমত করুন)। তিনি বললেন, এরকম নয়; বরং বল- لا‘ يرحمك الله (না, আল্লাহ আপনার প্রতি রহমত করুন)।
হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি. থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি এরকম বাক্য ব্যবহার করতেই নিষেধ করতেন। অর্থাৎ তিনি দুআর আগে لا ব্যবহার করতে নিষেধ করতেন। কেননা لا ব্যবহার করলে দুআর পরিবর্তে বদ্দুআ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।
সবশেষে তারা يا اخي (হে আমাদের প্রিয় ভাই) বলে ইঙ্গিত করছেন যে, তাঁর কথায় তাদের মনে কষ্ট আসবে কি করে, যখন তাদের মধ্যে সম্পর্কটা ভ্রাতৃত্বের এবং সে ভ্রাতৃত্বও অনেক গভীর! এক ভাই অন্য ভাইকে তিরস্কার করলে তা তার কল্যাণার্থেই করে থাকে। সেজন্য মনে কষ্ট নেওয়া উচিত নয়। আবার তাও যদি হয় মহান আবূ বকর সিদ্দীক রাযি.-এর মত কোনও ভাই, যিনি মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ছায়াস্বরূপ, উম্মতের সকলের প্রতি যাঁর অসাধারণ স্নেহ-মমতা!
হাদীছটির শিক্ষা
ক. কারও প্রতি বিদ্বেষ যদি হয় আল্লাহর জন্য, তবে সে বিদ্বেষ দোষের নয়। অবশ্য কোন্ বিদ্বেষ আল্লাহর জন্য এবং কোন্টা আল্লাহর জন্য নয়, আল্লাহওয়ালা উলামার কাছ থেকে তা শিখে নেওয়া চাই ।
খ. এ হাদীছ দ্বারা হযরত সালমান রাযি., হযরত সুহায়ব রাযি., হযরত বিলাল রাযি প্রমুখ গরীব সাহাবীদের মর্যাদা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। বলাবাহুল্য তাদের সে মর্যাদা লাভ হয়েছিল ঈমান ও তাকওয়ার কারণে। সুতরাং মুত্তাকী ও পরহেযগার গরীবদের মর্যাদার দৃষ্টিতে দেখা চাই।
গ. বড়র সামনে ছোটদের কোনও কথা আপত্তিকর মনে হলে তার উচিত তা সংশোধন করে দেওয়া।
ঘ. নিজের কোনও কথা সঠিক হল কি না এ ব্যাপারে সন্দেহ হলে বিজ্ঞজনের কাছে গিয়ে সে সন্দেহের নিরসন করে নেওয়া উচিত।
ঙ. যারা মুত্তাকী-পরহেযগার, তারা আল্লাহর ওলী। কোনও অবস্থায়ই তাদেরকে কষ্ট দেওয়া উচিত নয়। তাতে আল্লাহ নারাজ হন।
চ. কাউকে কষ্ট দিয়ে ফেললে যথাশীঘ্র ক্ষমা চেয়ে নেওয়া উচিত। ক্ষমা চাইতে লজ্জাবোধ করা উচিত নয়।
ছ. বড়র তিরস্কারে ছোটদের মনে কষ্ট নেওয়া উচিত নয়। মনে করতে হবে তার সে তিরস্কার তাদের কল্যাণার্থেই ।
জ. কেউ ক্ষমা চাইলে সঙ্গে সঙ্গেই ক্ষমা করে দেওয়া উচিত। সেইসঙ্গে তার জন্য আল্লাহর কাছে মাগফিরাতের দুআ করাও বাঞ্ছনীয়।
২৮০. সূরা ফাত্হ (৪৮), আয়াত ১৮
২৮১. সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৬৫০২; সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ৩৪৭; সুনানে ইবন মাজাহ, হাদীছ নং ৩৯৮৯; বায়হাকী, আস্ সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ৬৩৯৫; বাগাবী, শারহুস্ সুন্নাহ, হাদীছ নং ১২৪৭
২৮২. يا হরফটি ইস্তিগাছা (বিপদে ফরিয়াদ জানানো ও সাহায্য প্রার্থনা করা)-এর অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। ইস্তিগাছার জন্য যাকে আহ্বান করা হয়, সেই 'মুনাদা'-এর ইসমে যদি يا لزيد -এর মত لام الجر দাখিল না হয়, তবে সাধারণত শেষে আলিফ যুক্ত হয়ে থাকে। তখন যদি ওয়াক্ফ করা হয়, তবে শেষে هاء السكت ব্যবহার করা যায়। সম্ভবত হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি. اخوتاه -এর উপর ওয়াক্ফ করেছিলেন। সে কারণেই هاء السكت ব্যবহার করেছেন। অথবা এটা ব্যবহার করেছেন যারা المندوب ছাড়াও هاء السكت ব্যবহার করে থাকে তাদের ভাষারীতি অনুযায়ী। তবে এরকম ব্যবহার বিরল।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)


বর্ণনাকারী: