রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ

ভূমিকা অধ্যায়

হাদীস নং: ২৬০
ভূমিকা অধ্যায়
অধ্যায়ঃ ৩৩

ইয়াতীম, কন্যাসন্তান, সর্বপ্রকার দুর্বল, গরীব-মিসকীন ও দুস্থ লোকদের প্রতি সদয় আচরণ,
তাদের প্রতি অনুগ্রহ ও মায়া-মমতা প্রদর্শন এবং তাদের সঙ্গে নম্র-কোমল আচরণ প্রসঙ্গ

ইয়াতীম, মিসকীন, দুস্থ ও দুর্বল শ্রেণীর লোক সমাজেরই অংশ। একটি পূর্ণাঙ্গ ও সুষ্ঠু সমাজ গঠনের লক্ষ্যে তাদেরকে বৃহত্তর সমাজের করে রাখা এবং সমাজনির্মাণে তাদেরকেও ভূমিকা রাখার সুযোগ দান করা জরুরি। এটা জরুরি কেবল দুনিয়াবী শান্তি-শৃঙ্খলার জন্যই নয়, তারচে'ও বেশি আখেরাতের নাজাত ও মুক্তির জন্য।
বলাবাহুল্য, এ দায়িত্ব বর্তায় সমাজের সচ্ছল ও সামর্থ্যবান অংশের উপর। তাদেরই কর্তব্য এদের মৌলিক অধিকারসমূহ সংরক্ষণের পাশাপাশি তাদের জীবনরক্ষা ও মানবিক বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছুর সুবন্দোবস্ত করে দেওয়া। এ কর্তব্য পালনের উদ্যোগ কেবল তখনই গ্রহণ করা যায়, যখন অন্তরে তাদের প্রতি দয়ামায়া, সহমর্মিতা, সহানুভূতি ও শ্রদ্ধাবোধ থাকবে। তাই ইসলাম বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে মানুষের অন্তরে এসব গুণ সঞ্চারের চেষ্টা করেছে। ইসলামী শিক্ষায় এর এতবেশি গুরুত্ব যে, পরিপূর্ণ মুমিন ও মুসলিম হওয়ার জন্য এসব গুণ অর্জনকে অপরিহার্য করা হয়েছে এবং একে অতি বড় ছাওয়াবের বিষয় বানিয়ে দেওয়া হয়েছে। এমনকি ইয়াতীম ও বিধবা প্রভৃতির সাহায্য-সহযোগিতা করাকে জান্নাত লাভেরও একটি উপায় বলা হয়েছে। মোটকথা এরকম অসহায় শ্রেণীর প্রতি সহানুভূতিশীল থাকা ও তাদের সাহায্য-সহযোগিতা করা আমাদের মহান দীনের অতীব গুরুত্বপূর্ণ এক আমল। যেমন কুরআন মাজীদ, তেমনি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদীছসমগ্র এ সম্পর্কিত শিক্ষায় ভরপুর।
ইমাম নববী রহ. এ অধ্যায়ে সেরকম কিছু আয়াত ও হাদীছ উল্লেখ করেছেন। নিচে তার বঙ্গানুবাদ ও সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা পেশ করা যাচ্ছে।
প্রকাশ থাকে যে, ইমাম নববী রহ. এ অধ্যায়ের শিরোনামে ‘কন্যাসন্তান’-এর কথাও উল্লেখ করেছেন। তাদেরকে ইয়াতীম, বিধবা প্রমুখের সারিতে উল্লেখ করা কারণ একশ্রেণীর মানুষ কন্যাসন্তানকে যথার্থ মর্যাদা দেয় না। তাদেরকে অবজ্ঞা ও উপেক্ষা করে। তাদের লালন-পালনে পুত্রসন্তানের মত গুরুত্ব দেয় না। জাহিলী যুগে তো তাদেরকে মানুষরূপেই গণ্য করা হত না । সে জাহিলিয়াত এখনও পুরোপুরি নির্মূল হয়নি। তাই আজও বহুলাংশে তাদেরকে অবহেলা করা হয়ে থাকে। সে হিসেবেই তাদেরকে দুর্বল শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। না হয় ইসলামী শিক্ষায় তারা দুর্বল ও অবহেলিত শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত নয়। মাতৃজাতির অংশ হিসেবে ইসলামে তাদের অনেক গুরুত্ব। গুরুত্ব দিয়েই তাদের প্রতিপালন করা উচিত। তাই এ অধ্যায়ে তাদের প্রতিপালনের ফযীলত সম্পর্কেও হাদীছ উদ্ধৃত হয়েছে।

ইয়াতীম, কন্যাসন্তান..এর প্রতি নম্র-কোমল আচরণ সম্পর্কিত কিছু আয়াত

এক নং আয়াত

وَاخْفِضْ جَنَاحَكَ لِلْمُؤْمِنِينَ

অর্থ : ‘আর যারা ঈমান এনেছে, তাদের জন্য তোমার (বাৎসল্যের) ডানা নামিয়ে দাও ।২৭১

ব্যাখ্যা

অর্থাৎ আপনি অহংকারী দুনিয়াদারদের জন্য অতবেশি চিন্তা করবেন না। তাদের কাছে সত্যদীন পৌঁছানোর দায়িত্ব আপনি পালন করেছেন। এখন আপনার কর্তব্য যারা আপনার ডাকে সাড়া দিয়ে ঈমান এনেছে এবং কাফের-মুশরিকদের পক্ষ থেকে নানারকম জুলুম-নির্যাতন ভোগ করেছে, তাদের দিকে লক্ষ করা। তারাই আপনার স্নেহ-মমতা লাভের বেশি হকদার। সুতরাং তাদের প্রতি নম্র-কোমল আচরণ করতে থাকুন।
جَنَاح অর্থ ডানা অর্থাৎ পাখির ডানা। পাখিরা যখন তাদের ছানাদের আদর-সোহাগ করে বা শত্রু থেকে রক্ষার চেষ্টা করে, তখন প্রথমে ডানা ছড়িয়ে দেয়, তারপর ছানারা তাদের ডানার নিচে চলে আসলে তাদের উপর ডানা নামিয়ে দেয়। তাই রূপক অর্থে ডানা নামানো দ্বারা আশ্রয়দান ও আদর-সোহাগ করা বোঝানো হয়ে থাকে। এ আয়াতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সাহাবায়ে কেরামের প্রতি সে আচরণেরই হুকুম করা হচ্ছে। পূর্ণ আয়াতটি এরূপ-

لَا تَمُدَّنَّ عَيْنَيْكَ إِلَى مَا مَتَّعْنَا بِهِ أَزْوَاجًا مِنْهُمْ وَلَا تَحْزَنْ عَلَيْهِمْ وَاخْفِضْ جَنَاحَكَ لِلْمُؤْمِنِينَ (88)

‘আমি তাদের (অর্থাৎ কাফেরদের) বিভিন্ন লোককে মজা লোটার যে উপকরণ দিয়েছি, তুমি তার দিকে চোখ তুলে তাকিও না এবং তাদের প্রতি মনোক্ষুণ্ণ হয়ো না। আর যারা ঈমান এনেছে তাদের জন্য তোমার (বাৎসল্যের) ডানা নামিয়ে দাও।'
এ আয়াতে প্রথমে কাফের-মুশরিকদেরকে ক্ষণস্থায়ী দুনিয়ার যে ধন-দৌলত ও শান-শওকত দেওয়া হয়েছে, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সেদিকে তাকাতে নিষেধ করা হয়েছে। তা নিষেধ করা হয়েছে এ কারণে যে, তাকে এরচে আরও বড় ঐশ্বর্য দান করা হয়েছে, আর তা হচ্ছে মহান কুরআন ও সূরা ফাতিহা। যেমন এর পূর্বের আয়াতে বর্ণিত হয়েছে-

وَلَقَدْ آتَيْنَاكَ سَبْعًا مِنَ الْمَثَانِي وَالْقُرْآنَ الْعَظِيمَ (87)

‘আমি তোমাকে এমন সাতটি আয়াত দিয়েছি, যা বারবার পড়া হয় এবং দিয়েছি মর্যাদাপূর্ণ কুরআন।২৭২
অধিকাংশ মুফাস্সিরের মতে সাত আয়াত দ্বারা সূরা ফাতিহা বোঝানো উদ্দেশ্য । মর্যাদাপূর্ণ কুরআনও সূরা ফাতিহাকেই বলা হয়েছে। সূরা ফাতিহাকে ‘মর্যাদাপূর্ণ কুরআন' নামে অভিহিত করার কারণ এ সূরাটি সমগ্র কুরআনের সারসংক্ষেপ। সূরা বাকারা থেকে সূরা নাস পর্যন্ত গোটা কুরআন যেন এ সূরারই ব্যাখ্যা। তো বলা হচ্ছে- আপনাকে যখন সূরা ফাতিহার মত মহা মর্যাদাপূর্ণ সম্পদ দান করা হয়েছে, তখন আর অন্যকিছুর দিকে ফিরে তাকানো আপনার জন্য শোভনীয় নয়। কাফের-মুশরিকদেরকে যে সম্পদ দেওয়া হয়েছে তা কেবল ক্ষণস্থায়ীই নয়; ফিতনাও বটে। তাদেরকে এসব দেওয়া হয়েছে পার্থিব জীবনে তাদেরকে শাস্তি দেওয়ার জন্য। দীন ও ঈমানের সম্পদ যাদের নেই, ধন-দৌলত তাদের জন্য শাস্তিই বটে। এটা যেমন জীবনের আরাম হারাম করে দেয়, তেমনি আখলাক-চরিত্রও ধ্বংস করে। সুতরাং ওদিকে না তাকিয়ে এবং যারা সত্য বোঝা সত্ত্বেও তা পরিহার করে ওই ক্ষণস্থায়ী সম্পদের মোহে মত্ত হয়ে আছে, তাদের জন্য অতবেশি দুঃখ না করে ওইসকল মুমিনদের প্রতি নম্র-কোমল মনোযোগ ধরে রাখুন, যারা সকল জুলুম-নির্যাতন উপেক্ষা করে আপনার ও কুরআনের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছে। এটাই আপনার মহান দায়িত্বের সঙ্গে বেশি সঙ্গতিপূর্ণ।
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মূলত এ নীতির উপরই প্রতিষ্ঠিত ছিলেন। তারপরও তাঁকে এ আদেশ করা হয়েছে বাড়তি তাকিদস্বরূপ। মূলত এর মধ্যে তাঁর উম্মত ও অনুসারীদের জন্য এই হিদায়াত রয়েছে যে, তারা যেন সম্পদশালীদের অর্থবিত্তের দিকে নজর না দেয়। তাদেরও কর্তব্য নিজেদেরকে দীনের খেদমতের জন্য নিবেদিত রাখা এবং দীনের নিসবতে (সূত্রে) আপন আপন সম্পৃক্তজনদের প্রতি মমত্বপূর্ণ আচরণ করা।
হযরত আব্দুল্লাহ ইবন আমর ইবনুল আস রাযি. বলেন, যে ব্যক্তি কুরআন পাওয়ার পর কোনও সম্পদশালীর অর্থবিত্তকে তারচে' উত্তম মনে করে, প্রকৃতপক্ষে সে মহামূল্যবান সম্পদকে তুচ্ছ এবং তুচ্ছ সম্পদকে মহামূল্যবান সাব্যস্ত করল।

এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-

لا تَغْبَطَنَّ فَاجِرًا بِنِعْمَةٍ، إِنَّ لَهُ عِنْدَ اللهِ قَائِلًا لَا يَمُوتُ

‘কোনও পাপিষ্ঠের ঐশ্বর্য দেখে ঈর্ষা করো না। কেননা আল্লাহ তাআলার কাছে তার এমন ঘাতক আছে, যার মৃত্যু নেই।২৭৩
ওয়াহাব ইবন মুনাব্বিহ রহ. এ হাদীছটি শোনার পর আবু দাউদ আল আ'ওয়ার রহ.-কে হাদীছটির বর্ণনাকারী ইবন আবী মারয়াম রহ.-এর কাছে পাঠালেন এবং তাকে জিজ্ঞেস করলেন, কে সেই ঘাতক, যার মৃত্যু নেই? তিনি বললেন, জাহান্নামের আগুন।
উল্লেখ্য, সাহাবায়ে কেরামের অধিকাংশই ছিলেন গরীব। কাজেই তাদের প্রতি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে মমত্বপূর্ণ আচরণের নির্দেশদান দ্বারা পরোক্ষভাবে উম্মতকে হুকুম করা হচ্ছে তারা যেন গরীব ও অসহায় শ্রেণীর প্রতি সদয় আচরণ করে।

দুই নং আয়াত

وَاصْبِرْ نَفْسَكَ مَعَ الَّذِينَ يَدْعُونَ رَبَّهُمْ بِالْغَدَاةِ وَالْعَشِيِّ يُرِيدُونَ وَجْهَهُ وَلَا تَعْدُ عَيْنَاكَ عَنْهُمْ تُرِيدُ زِينَةَ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا

অর্থ : ‘ধৈর্য-স্থৈর্যের সাথে নিজেকে সেইসকল লোকের সংসর্গে রাখ, যারা সকাল ও সন্ধ্যায় নিজেদের প্রতিপালককে এ কারণে ডাকে যে, তারা তাঁর সন্তুষ্টি কামনা করে। পার্থিব জীবনের সৌন্দর্য কামনায় তোমার দৃষ্টি যেন তাদের থেকে সরে না যায়।২৭৪

ব্যাখ্যা

এ আয়াতে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ধৈর্যসহকারে তাঁর গরীব ও দুস্থ সাহাবীদের সঙ্গে থাকতে বলা হয়েছে। আয়াতে তাদের বৈশিষ্ট্য বলা হয়েছে যে, তারা সকাল-সন্ধ্যায় তাদের প্রতিপালককে ডাকে। সকাল ও সন্ধ্যা দিবারাত্রের মূল অংশ। এ মূল অংশ বলে গোটা দিন-রাত বোঝানো হয়েছে। কাজেই এর অর্থ হচ্ছে, তারা সর্বদাই আল্লাহ তাআলাকে ডাকে। তাদের অন্তরে আল্লাহ তাআলার স্মরণ সর্বদা জাগ্রত থাকে। ফলে যখন যেই কাজ করে, আল্লাহ তাআলার হুকুম মোতাবেক করে এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দুনিয়াবী কাজকর্মে ব্যস্ত থাকলেও অন্তর থাকে আল্লাহর অভিমুখী।
অথবা আয়াতে সুনির্দিষ্টভাবে সকাল ও সন্ধ্যাই বোঝানো হয়েছে। এই দুই সময় মানুষের কাজের ব্যস্ততা থাকে বেশি। তো এই ব্যস্ততাকালেই যখন তারা আল্লাহ তাআলাকে ডাকে এবং তাঁর থেকে গাফেল হয় না, তখন অন্যান্য সময় যে তাঁকে আরও বেশি ডাকবে এটাই স্বাভাবিক।
সেইসঙ্গে আয়াতে জানানো হয়েছে যে, সাহাবায়ে কেরাম আল্লাহ তাআলাকে ডাকতেন ও তাঁর ইবাদত-বন্দেগী করতেন পূর্ণ ইখলাসের সঙ্গে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল কেবলই আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টিলাভ, পার্থিব কোনও স্বার্থ নয়।
তারপর নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে হুকুম করা হয়েছে তিনি যেন এই গরীব সাহাবীদের থেকে চোখ সরিয়ে অবস্থাসম্পন্ন কুরায়শ নেতৃবর্গের দিকে নজর না দেন। কেননা তাদের সামনে সত্য পরিষ্কার হয়ে গেছে। তা সত্ত্বেও তারা তা মানছে না; হঠকারিতাপূর্ণ আচরণ করছে। কাজেই তাদের ঈমানের কোনও আশা নেই। এ অবস্থায় তাদের দিকে বেশি তাকানোর অর্থ হবে অর্থবিত্ত ও দুনিয়াবী শান- শওকতের কারণে তাদেরকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া, যা কিছুতেই বাঞ্ছনীয় নয়। সুতরাং তাদের দিকে না তাকিয়ে এই গরীব সাহাবীদের প্রতি মনোনিবেশ করুন ও তাদের ব্যক্তিগঠনের কাজে লেগে থাকুন।
উল্লেখ্য, এর আগের অধ্যায়ে হুবহু এ আয়াতটি গত হয়েছে। সেখানে এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। আগ্রহী পাঠক তা দেখে নিতে পারেন।

তিন নং আয়াত

فَأَمَّا الْيَتِيمَ فَلَا تَقْهَرْ (9) وَأَمَّا السَّائِلَ فَلَا تَنْهَرْ (10)

অর্থ : ‘সুতরাং যে ইয়াতীম, তুমি তার প্রতি কঠোরতা প্রদর্শন করো না। এবং যে সওয়াল করে, তাকে দাবড়ি দিও না। ১২৭৫

ব্যাখ্যা

এ সূরার ৬ নং আয়াতে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে স্মরণ করানো হয়েছে যে, তিনি একসময় ইয়াতীম ছিলেন। আমরা সবাই জানি তাঁর জন্মের আগেই তার পিতা আব্দুল্লাহর ইন্তিকাল হয়ে গিয়েছিল। সুতরাং ইয়াতীম অবস্থা দাদা আব্দুল মুত্তালিবের তত্ত্বাবধানে তার লালন-পালন হয়েছিল। মাকেও হারিয়েছিলেন শৈশবেই। তখন তাঁর বয়স ছিল ৬ বছর। দাদা আব্দুল মুত্তালিবও তাঁর ৮ বছর বয়সকালে ইন্তিকাল করেন। তারপর তাঁর লালন-পালনের ভার পড়ে চাচা আবূ তালিবের উপর। আবূ তালিবও তেমন সচ্ছল ছিলেন না। কাজেই নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইয়াতীম অবস্থাটাও ছিল উপর্যুপরি কঠিন থেকে কঠিনতর। আবার ছিলেন গরীবও, যেমনটা এ সূরার ৮ম আয়াতে বলা হয়েছে। তো এক সময়কার ইয়াতীম পরবর্তীকালে নবুওয়াত লাভ করলেন। বরিত হলেন শ্রেষ্ঠতম নবীরূপে। নবুওয়াতী জীবনের শুরুটা কেটেছে মক্কার কাফেরদের ঘোর শত্রুতার মুখে। পরে ইয়াছরিবের আওস ও খাযরাজ গোত্র তাঁকে আমন্ত্রণ জানায়। তিনি তাদের কাছে চলে যান। সেখানকার সমস্ত মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে তাঁর আনুগত্য স্বীকার করে। ইয়াছরিব পরিণত হয় সমগ্র পৃথিবীর দীন ও ঈমানের রাজধানীতে। অভিহিত হয় মদীনা মুনাউওয়ারা নামে। পবিত্র মদীনার আনসারগণ তাঁর আত্মনিবেদিত সেবক। মক্কার ইয়াতীম ও গরীব বালককে আল্লাহ তাআলা এভাবেই পবিত্র মদীনায় এনে এমন ঠাঁই-ই দান করলেন যে, এখানকার জনগণ নিজেরাও তাঁর জন্য উৎসর্গিত এবং উৎসর্গিত তাদের যা-কিছু আছে সব। এভাবে আল্লাহ তা'আলা ইয়াতীম অবস্থা দূর করে তাঁকে দান করেন সুপ্রতিষ্ঠা এবং অর্থাভাব দূর করে দান করেন ঐশ্বর্য, যদিও আমৃত্যু তিনি যুহদ ও কৃচ্ছ্রতার জীবনই যাপন করেছেন।
যেহেতু এক সময় তিনি ইয়াতীম ছিলেন এবং ছিলেন অভাবগ্রস্তও, তাই তার শোকর আদায়ার্থে তাঁকে আদেশ করা হয়েছে যেন ইয়াতীম ও গরীবদের প্রতি দুর্ব্যবহার না করে মমত্বপূর্ণ আচরণ করেন।
প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন রহমাতুল-লিল-আলামীন। তিনি স্বভাবতই গরীব-দুঃখী ও বিধবা-ইয়াতীমের প্রতি সদয় আচরণ করতেন। তা সত্ত্বেও তাঁকে এ আদেশ করা হয়েছে বিষয়টার প্রতি অধিকতর গুরুত্ব আরোপের জন্য, যাতে তাঁর উম্মত এ ব্যাপারে বিন্দুমাত্র অবহেলা না করে।
যারা কোনওকালে ইয়াতীম ও গরীব ছিল, তাদের কর্তব্য অতীতদিনের কথা স্মরণ করে কৃতজ্ঞতাবোধে উজ্জীবিত হওয়া এবং সে কৃতজ্ঞতার প্রকাশস্বরূপ ইয়াতীম ও গরীবদের প্রতি সহমর্মী থাকা। যারা অতীতে ইয়াতীম ও গরীব ছিল না, তাদেরও পিতা-মাতার আশ্রয়ে প্রতিপালিত হওয়া ও অভাবমুক্ত অবস্থায় বেড়ে ওঠার জন্য আল্লাহর শোকর আদায় করা কর্তব্য। সে শোকরের একটা অংশ এইও যে, তারা ইয়াতীম ও গরীবদের প্রতি সদা সহানুভূতিশীল থাকবে।
বস্তুত ইয়াতীম ও গরীবদের প্রতি সদয় আচরণ করা ঈমানেরও দাবি। যারা আখেরাত ও কর্মফল দিবসের উপর ঈমান রাখে না, তারাই এ শ্রেণীর দুর্বলদের প্রতি দুর্ব্যবহার করতে পারে, ঈমানদারগণ কিছুতেই নয়, যেমনটা পরবর্তী আয়াতসমূহ দ্বারা বোঝা যায়।

চার নং আয়াত

أَرَأَيْتَ الَّذِي يُكَذِّبُ بِالدِّينِ (1) فَذَلِكَ الَّذِي يَدُعُّ الْيَتِيمَ (2) وَلَا يَحُضُّ عَلَى طَعَامِ الْمِسْكِينِ (3)

অর্থ : 'তুমি কি দেখেছ তাকে, যে দীন অস্বীকার করে? সে তো সে-ই, যে ইয়াতীমকে ধাক্কা দেয় এবং মিসকীনকে খাদ্য দানে উৎসাহ দেয় না।২৭৬

ব্যাখ্যা

এ আয়াতগুলো সূরা মা'উনের। এতে 'দীন' দ্বারা হয়তো কর্মফল বোঝানো হয়েছে, অথবা দীনে ইসলাম। বোঝানো হচ্ছে— এমন লোকও আছে, যে কর্মফল দিবস বিশ্বাস করে না। সে মনে করে বিচারদিবস বলতে কিছু নেই এবং আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে ভালোমন্দ কর্মের প্রতিফলও দেওয়া হবে না। পরের আয়াতদু'টিতে যে ইয়াতীমকে ধাক্কা দেওয়া ও মিসকীনকে খাদ্যদানে উৎসাহিত না করার কথা বলা হয়েছে তা তার সে অবিশ্বাসেরই ফল। কর্মফল ও বিচারদিবসে যার বিশ্বাস নেই সে যা ইচ্ছা তাই করতে পারে। এ স্বেচ্ছাচারিতারই পরিণাম যে, সে অসহায় ইয়াতীম বাচ্চাকে গলাধাক্কা দিতে দ্বিধাবোধ করে না। আর মিসকীনকে নিজে খাদ্য দেবে কি, অন্য কেউ দিক তাও সে কামনা করে না। এ নির্মমতা ও নিষ্ঠুরতা এমনসব লোকের অন্তরেই থাকতে পারে, যারা আখেরাতে বিশ্বাস করে না। সুতরাং যারা মুমিন এবং যারা আখেরাত আছে বলে বিশ্বাস করে, তাদের কিছুতেই এরকম চরিত্র থাকা উচিত নয়। তারা হবে ইয়াতীমের প্রতি সদয়। তারা মিসকীনকে নিজেও খাদ্যদান করবে, অন্যকেও খাদ্যদানে উৎসাহ দেবে।
দীন অর্থ যদি ইসলাম হয়ে থাকে, তবে আয়াতে বোঝানো হচ্ছে যে, এমন লোকও আছে, যে দীন-ধর্ম মানে না। সত্যধর্ম ইসলামের উপর তার বিশ্বাস নেই। জানা কথা যে, সব যুগেরই মূল ধর্ম ছিল ইসলামই। সে হিসেবে সব ধর্মেই উন্নত আখলাক- চরিত্রের শিক্ষা ছিল। এখনও পুরোনো আসমানী ধর্মসমূহের ধর্মীয় গ্রন্থে সচ্চরিত্রের শিক্ষা পাওয়া যায়। তা সত্ত্বেও এমন লোকও আছে, যারা আসমানী ধর্মের অনুসারী বলে দাবি করা সত্ত্বেও মানুষের প্রতি উন্নত আখলাক-চরিত্রের পরিচয় দেয় না। না ইয়াতীমের প্রতি সদ্ব্যবহার করে, আর না ক্ষুধার্তকে খাদ্য দান করে। কাজেই এরা যে ধর্মেরই দাবিদার হোক না কেন, প্রকৃতপক্ষে তারা কোনও ধর্মই মানে না। এ অবস্থার যারা ইসলাম ধর্মের সত্যতা স্বীকার করে না, তাদের মধ্যে উন্নত আখলাক-চরিত্রের অস্তিত্ব থাকবে বলে কিভাবে আশা করা যায়? যারা ইসলামের প্রকৃত অনুসারী, তাদের মধ্যে আগেও উন্নত চরিত্র ছিল, এখনও আছে। যাদের মধ্যে এর ঘাটতি আছে, মূলত তারা পূর্ণাঙ্গ মুসলিম নয়। সুতরাং যারা মুসলিম হওয়া সত্ত্বেও ইয়াতীমের প্রতি দুর্ব্যবহার করে বা গরীব-মিসকীনকে খাদ্যদানে কুণ্ঠিত থাকে, তাদের আত্মসমালোচনা করা উচিত। তাদের কর্তব্য পরিপূর্ণ মুসলিম হয়ে ওঠার জন্য এ জাতীয় আচরণ পরিহার করা এবং সমাজের দুর্বল শ্রেণীর প্রতি সহমর্মী হয়ে থাকা।

২৭১. সূরা হিজর (১৫), আয়াত ৮৮

২৭২. সূরা হিজর (১৫), আয়াত ৮৭

২৭৩. বায়হাকী, শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ৪২২২; বাগাবী, শারহুস্ সুন্নাহ, হাদীছ নং ৪১০৩; তাবারানী, আল মু'জামুল আওসাত, হাদীছ নং ৪০৬৭

২৭৪. সূরা কাহফ (১৮), আয়াত ২৮

২৭৫. সূরা দুহা (৯৩), আয়াত ৯-১০

২৭৬, সূরা মা'উন (১০৭), আয়াত ১-৩
মুশরিকদের পক্ষ থেকে দুর্বল মুসলিমদের তাড়িয়ে দেওয়ার প্রস্তাব ও সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান
হাদীছ নং : ২৬০

হযরত সা'দ ইবন আবী ওয়াক্কাস রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে আমরা ছয়জন লোক ছিলাম। মুশরিকগণ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলল, আপনি এদেরকে তাড়িয়ে দিন, যাতে তারা আমাদের উপর স্পর্ধা না দেখাতে পারে। (তাঁর সঙ্গে) ছিলাম আমি, ইবনে মাসউদ, হুযাইল গোত্রের এক ব্যক্তি, বিলাল এবং অপর দুই ব্যক্তি যাদের নাম আমি বলতে পারছি না। (তাদের প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অন্তরে আল্লাহ তাআলার ইচ্ছায় যা উদয় হওয়ার তা উদয় হল । তিনি আপন মনে (তা নিয়ে) ভাবলেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহ তাআলা নাযিল করলেন-
وَلَا تَطْرُدِ الَّذِينَ يَدْعُونَ رَبَّهُمْ بِالْغَدَاةِ وَالْعَشِيِّ يُرِيدُونَ وَجْهَهُ
(যারা তাদের প্রতিপালকের সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে সকাল ও সন্ধ্যায় তাকে ডাকে, তাদেরকে তুমি তাড়িয়ে দিও না -সূরা আনআম : ৫২) - মুসলিম।
সহীহ মুসিলম, হাদীছ নং ২৪১৩; সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ৬৫৭৩; নাসাঈ, আস্ সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ৮১৮০
مقدمة الامام النووي
33 - باب ملاطفة اليتيم والبنات وسائر الضعفة والمساكين والمنكسرين والإحسان إليهم والشفقة عليهم والتواضع معهم وخفض الجناح لهم

قَالَ الله تَعَالَى: {وَاخْفِضْ جَنَاحَكَ لِلْمُؤْمِنِينَ} [الحجر: 88]، وَقالَ تَعَالَى: {وَاصْبِرْ نَفْسَكَ مَعَ الَّذِينَ يَدْعُونَ رَبَّهُمْ بِالْغَدَاةِ وَالْعَشِيِّ يُرِيدُونَ وَجْهَهُ وَلا تَعْدُ عَيْنَاكَ عَنْهُمْ تُرِيدُ زِينَةَ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا} [الكهف: 28]، وَقالَ تَعَالَى: {فَأَمَّا الْيَتِيمَ فَلا تَقْهَرْ وَأَمَّا السَّائِلَ فَلا تَنْهَرْ} [الضحى: 9 - 10]، وَقالَ تَعَالَى: {أَرَأَيْتَ الَّذِي يُكَذِّبُ بِالدِّينِ فَذَلِكَ الَّذِي يَدُعُّ الْيَتِيمَ وَلا يَحُضُّ عَلَى طَعَامِ الْمِسْكِينِ} [الماعون: 6].
260 - وعن سعد بن أَبي وَقَّاص - رضي الله عنه - قَالَ: كُنَّا مَعَ النَّبيِّ - صلى الله عليه وسلم - سِتَّةَ نَفَرٍ، فَقَالَ المُشْرِكُونَ للنَّبيِّ - صلى الله عليه وسلم: اطْرُدْ هؤلاء لا يَجْتَرِئُونَ عَلَيْنَا، وَكُنْتُ أنَا وَابْنُ مَسْعُودٍ. وَرَجُلٌ مِنْ هُذَيْلٍ وَبِلالٌ وَرَجُلاَنِ لَسْتُ أُسَمِّيهِمَا، فَوَقَعَ في نفس رَسُول الله - صلى الله عليه وسلم - مَا شَاءَ اللهُ أَنْ يَقَعَ فَحَدَّثَ نَفسَهُ، فَأنْزَلَ اللهُ تعالى: {وَلا تَطْرُدِ الَّذِينَ يَدْعُونَ رَبَّهُمْ بِالْغَدَاةِ وَالْعَشِيِّ يُرِيدُونَ وَجْهَهُ} [الأنعام: 52] رواه مسلم. (1)

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীছটি ইসলামের একদম সূচনাকালীন, যখন নগণ্য সংখ্যক লোক ইসলাম গ্রহণ করেছে। তাদেরও অধিকাংশ অতি সাধারণ স্তরের লোক। এটা সব যুগেরই এক সাধারণ অবস্থা যে, নবী-রাসূলগণের ডাকে বেশিরভাগ সাধারণ স্তরের লোকই সাড়া দিত। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সময়ও তাই হয়েছে।
সমাজের অভিজাত ও মোড়ল শ্রেণীর লোক অহমিকাবশত সবসময়ই সত্যের ডাকে সাড়া দিতে হয় অস্বীকার করেছে, নয়তো সবশেষে পরিস্থিতির কারণে সাড়া দিতে বাধ্য হয়েছে। মক্কার যারা অভিজাত ও মোড়ল ছিল, যেমন আবূ জাহল, উমাইয়া, উকবা প্রমুখ, তারা বরাবরই ইসলামের আহ্বান প্রত্যাখ্যান করেছে। গরীব ও সাধারণ স্তরের লোকদের ইসলামগ্রহণ এবং নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাহচর্যে তাদের অবস্থানকে মোড়লগণ নিজেদের ইসলাম অজুহাত হিসেবে দাঁড় করাত। একপর্যায়ে তারা প্রস্তাবই করে বসে, এই লোক তাড়িয়ে দিন, তাহলে আমরা আপনার কথা শুনব, যেমনটা আলোচ্য হাদীছে বর্ণিত হয়েছে। কোনও কোনও বর্ণনা দ্বারা জানা যায় এ প্রস্তাবটি করেছিল উমাইয়া ইবন খাল্‌ফ।
আসলে তারা কখনওই শুনবার ছিল না। তাদের এ প্রস্তাব ছিল ভাওতামাত্র। কিন্তু নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের ইসলাম গ্রহণের বড় আকাঙ্ক্ষী ছিলেন। তাই তাদের প্রস্তাব সম্পর্কে তিনি চিন্তা-ভাবনা করছিলেন।

এ হাদীছে বলা হয়েছে—

فَوَقَعَ فِي نَفْسِ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَا شَاءَ اللهُ أَنْ يَقَعَ فَحَدَّثَ نَفْسَهُ

(তাদের প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অন্তরে আল্লাহ তাআলার ইচ্ছায় যা উদয় হওয়ার তা উদয় হল। তিনি আপন মনে (তা নিয়ে) ভাবলেন'। অর্থাৎ যে গরীব মুমিনদেরকে তাড়ানোর প্রস্তাব তারা দিয়েছিল, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জানা ছিল যে, তারা সবাই পরিপক্ক মুমিন। ঈমান তাদের অন্তরের পরতে পরতে মিশে গিয়েছে। শত নির্যাতনেও তারা ঈমান ছাড়েনি। ভবিষ্যতেও কোনও পরিস্থিতিতেই তারা তা ছাড়বার নয়। ঈমানের আলোয় তাদের গোটা অস্তিত্ব উদ্ভাসিত। এখন আর তাদের কোনওরকম মনোরঞ্জনেরও প্রয়োজন নেই। কাজেই ঈমানের আশায় ধনী মোড়লদের মনোরঞ্জনার্থে যদি সাময়িক কালের জন্য এ সাহাবীদেরকে দূরে থাকতে বলা হয়, তাতে তাদের কোনও ক্ষতিও নেই এবং তাতে তাদের মর্যাদাও কোনও অংশে কমবে না। পক্ষান্তরে এর দ্বারা যদি মক্কার নেতৃবর্গের মন জয় করা যায় আর খুশি হয়ে তারা ঈমান আনে, তবে তাদের নাজাতের ব্যবস্থা হয়ে যাবে এবং তা ইসলামের প্রচার-প্রসারেও সহায়ক হবে।
কোনও কোনও বর্ণনায় আছে, তারা বলেছিল, আপনি অন্ততপক্ষে দিন ভাগ করে দিন। একদিন তাদের জন্য রাখুন, একদিন আমাদের জন্য। আর এটা লিখিত আকারে চূড়ান্ত করুন। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বৃহত্তর স্বার্থে এটা করবেন বলে ভাবছিলেন। এমনকি এটা লেখার জন্য হযরত আলী রাযি.-কে ডেকেওছিলেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহ তাআলা আয়াত নাযিল করেন-

وَلَا تَطْرُدِ الَّذِينَ يَدْعُونَ رَبَّهُمْ بِالْغَدَاةِ وَالْعَشِيِّ يُرِيدُونَ وَجْهَهُ

(যারা তাদের প্রতিপালকের সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে সকাল ও সন্ধ্যায় তাকে ডাকে, তাদেরকে তুমি তাড়িয়ে দিও না)। এর মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা তাঁর ভাবনাটি নাকচ করে দেন। অর্থাৎ তিনি যে তাদেরকে সাময়িক কালের জন্য দূরে থাকতে বলবেন বলে মনস্থির করেছিলেন তা নিষেধ করে দেন। উল্টো হুকুম দেন যেন তিনি ধৈর্যসহকারে তাদেরকে সঙ্গদান করেন এবং তাদেরকেও তাঁর সঙ্গগ্রহণের সুযোগ দেন। ইরশাদ হয়েছে-

وَاصْبِرْ نَفْسَكَ مَعَ الَّذِينَ يَدْعُونَ رَبَّهُمْ بِالْغَدَاةِ وَالْعَشِيِّ يُرِيدُونَ وَجْهَهُ وَلَا تَعْدُ عَيْنَاكَ عَنْهُمْ تُرِيدُ زِينَةَ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا

‘ধৈর্য-স্থৈর্যের সাথে নিজেকে সেইসকল লোকের সংসর্গে রাখ, যারা সকাল ও সন্ধ্যায় নিজেদের প্রতিপালককে এ কারণে ডাকে যে, তারা তাঁর সন্তুষ্টি কামনা করে। পার্থিব জীবনের সৌন্দর্য কামনায় তোমার দৃষ্টি যেন তাদের থেকে সরে না যায়।২৭৮
সুতরাং মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যা মনস্থ করেছিলেন তাতে নিবৃত্ত হন। অতঃপর তিনি যখনই এ গরীব সাহাবীদেরকে দেখতেন, বলে উঠতেন, মুবারকবাদ ওইসব লোকদের, যাদের সন্তুষ্টির লক্ষ্যে আল্লাহ তাআলা আমাকে তিরস্কার করেছেন। এরপর থেকে তিনি তাদেরকে সঙ্গদান আরও বৃদ্ধি করে দেন। তাদের সঙ্গে যখন বসতেন, তখন যতক্ষণ না তারা মজলিস থেকে উঠা শুরু করত, ততক্ষণ তিনি উঠতেন না, তাদের সঙ্গেই বসে থাকতেন।

হাদীছটির শিক্ষা

ক. ধনীদের খাতিরে কখনও গরীবদের প্রতি মনোযোগ কমানো উচিত নয়। অবহেলার তো প্রশ্নই আসে না।

খ. ধন-সম্পদ ও আভিজাত্যের অহমিকা অত্যন্ত নিন্দনীয়। এ অহমিকা ঈমান ও সত্যগ্রহণের পক্ষে অনেক বড় বাধা।

গ. ইসলামের শুরুকালটা ছিল গরীব ও সাধারণ স্তরের লোকদের। কাজেই নিজের আশপাশে বেশিরভাগ এ শ্রেণীর লোক দেখলে কোনও হকপন্থীর দমে যাওয়া ঠিক নয়; বরং এটাকে তার হকপন্থী হওয়ার এক নিদর্শন গণ্য করা উচিত।

২৭৮. সূরা কাহফ (১৮), আয়াত ২৮
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:বিশুদ্ধ (পারিভাষিক সহীহ)