রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ
ভূমিকা অধ্যায়
হাদীস নং: ১৯২
সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ প্রসঙ্গ।
শাসককে সদুপদেশদান এবং সাহাবায়ে কিরামের মর্যাদা
হাদীছ নং: ১৯২
হাসান বসরী রহ. বলেন, হযরত আইয ইবন আমর রাযি. উবায়দুল্লাহ ইবন যিয়াদের নিকট উপস্থিত হয়ে বললেন, ওহে বাছা! আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি সর্বাপেক্ষা নিকৃষ্ট রাখাল সেই ব্যক্তি, যে রক্ষণাবেক্ষণের ব্যাপারে কঠোরতা অবলম্বন করে। সুতরাং তুমি তাদের একজন হয়ো না। যিয়াদ তাঁকে বলল, বস। তুমি তো মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাহাবীদের মধ্যে ভুসিতুল্য। তিনি বললেন, তাদের মধ্যে আবার কেউ ভুসিতুল্য ছিল নাকি? ভুসি তো হয়েছে তাদের পরবর্তীকালে এবং তাদের ছাড়া অন্যদের মধ্যে.- মুসলিম।
(সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ১৮৩০; সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ৪৫১১; মুস্তাখরাজ আবু "আওয়ানা, হাদীছ নং ৭০৪৯; মুসনাদ ইবনুল জা'দ, হাদীছ নং ১৩৪৯)
হাদীছ নং: ১৯২
হাসান বসরী রহ. বলেন, হযরত আইয ইবন আমর রাযি. উবায়দুল্লাহ ইবন যিয়াদের নিকট উপস্থিত হয়ে বললেন, ওহে বাছা! আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি সর্বাপেক্ষা নিকৃষ্ট রাখাল সেই ব্যক্তি, যে রক্ষণাবেক্ষণের ব্যাপারে কঠোরতা অবলম্বন করে। সুতরাং তুমি তাদের একজন হয়ো না। যিয়াদ তাঁকে বলল, বস। তুমি তো মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাহাবীদের মধ্যে ভুসিতুল্য। তিনি বললেন, তাদের মধ্যে আবার কেউ ভুসিতুল্য ছিল নাকি? ভুসি তো হয়েছে তাদের পরবর্তীকালে এবং তাদের ছাড়া অন্যদের মধ্যে.- মুসলিম।
(সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ১৮৩০; সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ৪৫১১; মুস্তাখরাজ আবু "আওয়ানা, হাদীছ নং ৭০৪৯; মুসনাদ ইবনুল জা'দ, হাদীছ নং ১৩৪৯)
23 - باب في الأمر بالمعروف والنهي عن المنكر
192 - التاسع: عن أَبي سعيد الحسن البصري: أن عائِذَ بن عمرو - رضي الله عنه - دخل عَلَى عُبَيْدِ اللهِ بنِ زياد، فَقَالَ: أي بُنَيَّ، إني سمعت رَسُول الله - صلى الله عليه وسلم - يقول: «إنَّ شَرَّ الرِّعَاءِ الحُطَمَةُ (1)» فَإِيَّاكَ أَنْ تَكُونَ مِنْهُمْ، فَقَالَ لَهُ: اجلِسْ فَإِنَّمَا أنْتَ مِنْ نُخَالَةِ أصْحَابِ مُحَمَّد - صلى الله عليه وسلم - فَقَالَ: وهل كَانَتْ لَهُم نُخَالَةٌ إِنَّمَا كَانَتِ النُّخَالَةُ بَعْدَهُمْ وَفي غَيْرِهِمْ. رواه مسلم. (2)
হাদীসের ব্যাখ্যা:
এ হাদীছ দ্বারা শাসককে উপদেশদান এবং তাকে সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করার শিক্ষা পাওয়া যায়। হযরত আইয ইবন আমর রাযি, যাকে নসীহত করছিলেন তিনি ছিলেন বসরার এক দোর্দণ্ড প্রতাপশালী গভর্নর উবায়দুল্লাহ ইবন যিয়াদ। তার কঠোর শাসন এবং জনগণের প্রতি তার নিষ্ঠুরতা ইতিহাসখ্যাত। তাঁর সে কঠোরতা দেখে হযরত আইয রাযি, তাকে উপদেশ দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করলেন। সুতরাং তিনি তার সঙ্গে দেখা করে অত্যন্ত কোমল ভাষায় নসীহত করছিলেন। তিনি তাকে 'ওহে বাছা' বলে সম্বোধন করেছিলেন। নসীহত ও উপদেশদানে নম্র-কোমল কথা বলা কর্তব্য। শাসকদের ক্ষেত্রে তা আরও বেশি জরুরি। আল্লাহ তা'আলা যখন হযরত মূসা ও হারুন আলাইহিস সালামকে ফির'আউনের কাছে পাঠান তখন আদেশ করেছিলেন-
فَقُولَا لَهُ قَوْلًا لَيِّنًا لَعَلَّهُ يَتَذَكَّرُ أَوْ يَخْشَى (44)
তোমরা গিয়ে তার সাথে নম্র কথা বলবে। হয়ত সে উপদেশ গ্রহণ করবে অথবা (আল্লাহকে) ভয় করবে। সূরা তোয়াহা (২০), আয়াত ৪৪
হযরত আইয রাযি, উবায়দুল্লাহ ইবন যিয়াদকে নসীহত করতে গিয়ে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের একটি হাদীছ শোনান। হাদীছটিতে শাসককে রাখালের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। একজন ভালো রাখাল গবাদি পশুর প্রতি সদয় আচরণ করে থাকে। সে তাদের খাদ্য ও পানির ব্যাপারে খুব সতর্ক থাকে। কোন্ মাঠে তাদের চরালে ভালো ঘাস পাবে, কোথায় নিলে সহজে পানি পান করানো যাবে তার অনুসন্ধানে থাকে। পশুরা এদিক-সেদিক ছোটাছুটি করলে যত্নের সাথে তাদের ফিরিয়ে আনে এবং সর্বতোপ্রযত্নে তাদের আগলে রাখে। পশুদের প্রতি যে রাখাল নির্দয় ও নিষ্ঠুর, তার আচরণ এর সম্পূর্ণ বিপরীত। হাদীছটিতে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম শাসককে রাখালের সাথে তুলনা করে বোঝাচ্ছেন যে, তারও উচিত জনগণের প্রতি একজন দরদী রাখালের মত আচরণ করা। সে যদি তাদের প্রতি নিষ্ঠুরতা দেখায়, তবে সে একজন নিকৃষ্ট শাসকরূপে গণ্য হবে।
শাসককে রাখালের সাথে তুলনা করার তাৎপর্য
শাসককে রাখালের সাথে তুলনা করার একটা তাৎপর্য এই যে, গবাদি পশু বোধ-বুদ্ধিহীন হয়ে থাকে। তারা কোনও যুক্তিতর্ক বোঝে না। কল্যাণ-অকল্যাণেরও পার্থক্য করতে পারে না। কাজেই তাদের সঙ্গে রাগারাগি করার বা তাদেরকে মারামারি করার কোনও যুক্তি নেই এবং তার কোনও ফায়দাও নেই। সর্বাবস্থায় ধৈর্যের পরিচয় দিতে হবে। কোনও পশু হয়তো চারণভূমি ছেড়ে কারও শস্যক্ষেত্রে ঢুকে পড়ে, কোনওটি পালিয়ে যেতে চায় এবং আরও নানারকম বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করে। সব ক্ষেত্রেই রাখালকে ধৈর্য রক্ষা করতে হয় এবং হিকমত ও কৌশলের সাথে রক্ষণাবেক্ষণের কাজ আঞ্জাম দিতে হয়।
ঠিক তেমনি জনগণের মধ্যেও নানারকমের লোক থাকে। অধিকাংশেরই ভালোমন্দ জ্ঞান পরিপক্ক থাকে না। ফলে নানারকম অশান্তিকর ও বিশৃঙ্খলাপূর্ণ কর্মকাণ্ড তাদের দ্বারা হয়ে যায়। এ অবস্থায় তাদের প্রতি নিষ্ঠুর ও নির্দয় আচরণ কখনও কল্যাণ বয়ে আনে না। সাময়িকভাবে হয়তো তাদেরকে দমন করা যায়, কিন্তু কঠোরতার ফলে তাদের অন্তরে যে ঘৃণা-বিদ্বেষ দানা বাঁধতে থাকে, একপর্যায়ে তার বিস্ফোরণ ঘটে। তাই একজন ভালো শাসকের কর্তব্য আইনের যথাযথ প্রয়োগের পাশাপাশি আচার-আচরণে কোমলতা রক্ষা করা এবং সর্বাবস্থায় জনগণের প্রতি কল্যাণকামিতার পরিচয় দেওয়া।
হযরত আইয রাযি. যখন এ হাদীছটি শোনালেন, তখন উবায়দুল্লাহর কর্তব্য ছিল একজন সাহাবী হিসেবে তাঁর প্রতি সম্মানজনক আচরণ করা এবং সর্বোপরি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদীছকে ভক্তি-শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে দেখা আর সে অনুযায়ী আমলের চেষ্টা করা। কিন্তু 'চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনী'। নিষ্ঠুরতা ও রূঢ়তাই যার স্বভাব, সে সাহাবীর মত মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তিত্বকেও কটুকথা শোনাতে ছাড়ে না। কেমন শিষ্টতাবর্জিত উক্তি তাঁর উদ্দেশ্যে করে বসল যে, তুমি তো সাহাবীদের মধ্যে একজন তুচ্ছ লোক!
نخالة অর্থ আটার ভুসি, ধানের চিটা, শস্যের শাঁসবিহীন খোসা, অপুষ্ট অবস্থায় শুকিয়ে যাওয়া খেজুর ইত্যাদি। এককথায় রদ্দিমাল। একজন সাহাবী সম্পর্কে এ জাতীয় শব্দ ব্যবহার কী গুরুতর অসভ্যতা! আল্লাহ তা'আলা আমাদের হেফাজত করুন।
সাহাবায়ে কিরামের আদর্শের এক ঝলক
কিন্তু মহান সাহাবীগণ তো নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাতেগড়া। তিনি এরূপ অভব্য লোকের সঙ্গে কথা বাড়ানো পসন্দ করলেন না। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-
وَإِذَا خَاطَبَهُمُ الْجَاهِلُونَ قَالُوا سَلَامًا (63)
এবং অজ্ঞলোক যখন তাদেরকে লক্ষ্য করে (অজ্ঞতাসুলভ) কথা বলে, তখন তারা শান্তিপূর্ণ কথা বলে। সূরা ফুরকান (২৫), আয়াত ৬৩
সুতরাং হযরত আইয রাযি. তাকে সংক্ষেপে এবং শান্ত ও দৃঢ় ভাষায় উত্তর দিলেন- وَهَلْ كَانَتْ لَهُمْ نُخَالَةٌ، إِنَّمَا كَانَتِ النُّخَالَةُ بَعْدَهُمْ أَوْ فِي غَيْرِهِمْ "তাদের মধ্যে আবার কেউ ভুসিতুল্য ছিল নাকি? ভুসি তো হয়েছে তাদের পরবর্তীকালে এবং তাদের ছাড়া অন্যদের মধ্যে"। একদম খাঁটি কথা। এ খাঁটি কথাটি কী চমৎকারভাবে একজন দুর্দান্ত শাসককে তিনি শুনিয়ে দিলেন। তিনি একটুও উত্তেজিত না হয়ে এক জালেম শাসকের সামনে হক কথা বলার জিহাদ করলেন। সে জিহাদও করলেন এমন হেকমতের সঙ্গে যে, তাতে উবায়দুল্লাহ ইবন যিয়াদকে তার আত্মোপলব্ধির সুযোগও তৈরি করে দিলেন আবার সরাসরি তার ওপর আঘাতও করলেন না।
বস্তুত সাহাবীদের মধ্যে এমন একজনও নেই, যাকে অবহেলা ও অবজ্ঞা করা যেতে পারে। তাদের প্রত্যেকেই আমাদের জন্য আদর্শ। প্রত্যেকেরই জীবন আমাদের জন্য শিক্ষণীয়। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের ঘোষণা-
«أَصْحَابِي كَالنُّجُومِ بِأَيِّهِمُ اقْتَدَيْتُمُ اهْتَدَيْتُمْ»
আমার সাহাবীগণ নক্ষত্রের মত। তাদের মধ্যে যারই অনুসরণ করবে হিদায়াত পেয়ে যাবে। (ইবন আবদিল বার্র, জামিউ বায়ানিল 'ইলম ওয়া ফাদলিহী, হাদীছ নং ১৬৮৪, ১৭০২, ১৭৫৫, ১৭৫৭, ১৭৬০; বায়হাকী, আল-মাদখাল ইলাস-সুনানিল কুবরা, হাদীছ নং ১৫৩; মুসনাদুশ শিহাব আল-কুয়াঈ, হাদীছ নং ১৩৪৬: মুন্তাখাব মুসনাদ আব্দ ইবন হুমায়দ, হাদীছ নং ৭৮১)
সকল সাহাবী ছিলেন খাঁটি মানুষ। রদ্দিমাল তো পরেই তৈরি হয়েছে। কিছু হয়েছে তাবি'ঈদের যুগে, যেমন উবায়দুল্লাহ ইবন যিয়াদ নিজে। কিছু রদ্দিমাল তৈরি হয়েছে তাবে-তাবিঈনের যুগে আর তাদের পরবর্তী যুগসমূহে তো ভেজাল লোক গাণিতিক হারেই বাড়তে থেকেছে। এ অবস্থায় পরবর্তীকালের কেউ যদি ভেজালত্ব দূর করে নিজেকে শুদ্ধ-ঘাঁটি মানুষ বানাতে চায়, তবে তার উপায় তো একটিই- সাহাবীগণের অনুসরণ করা, তাঁদের আলোয় নিজেকে উদ্ভাসিত করার চেষ্টা করা। এর পরিবর্তে কেউ যদি কোনও সাহাবীর ভেজালত্বের প্রশ্ন তোলে, তবে তার মত বাতুলতা আর কী হতে পারে? এটা কঠিন বেআদবীও বটে। আল্লাহ তা'আলা আমাদেরকে হেফাজত করুন।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. কোনও শাসক অন্যায়-অসৎকাজ করলে সে ব্যাপারে তাকে সতর্ক করা এবং তাকে তার অন্যায়-অসৎকাজ থেকে ফেরানোর চেষ্টা করা ঈমানী দায়িত্ব ।
খ. শাসক ও প্রভাবশালী ব্যক্তিকে উপদেশ দানকালে তার বাহ্যিক মর্যাদার দিকে লক্ষ রাখা এবং নম্র-কোমল কথা বলা জরুরি।
গ. উপদেশ ও নসীহত করার কাজ কুরআন ও হাদীছের ভিত্তিতে হওয়া উচিত।
ঘ. অজ্ঞ ও অভব্য লোকদের সঙ্গে তর্কে না জড়িয়ে সংক্ষেপে কথা শেষ করে দেওয়াই শ্রেয়।
ঙ. সর্বাবস্থায় প্রত্যেক সাহাবীর প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধা বজায় রাখা অবশ্যকর্তব্য।
فَقُولَا لَهُ قَوْلًا لَيِّنًا لَعَلَّهُ يَتَذَكَّرُ أَوْ يَخْشَى (44)
তোমরা গিয়ে তার সাথে নম্র কথা বলবে। হয়ত সে উপদেশ গ্রহণ করবে অথবা (আল্লাহকে) ভয় করবে। সূরা তোয়াহা (২০), আয়াত ৪৪
হযরত আইয রাযি, উবায়দুল্লাহ ইবন যিয়াদকে নসীহত করতে গিয়ে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের একটি হাদীছ শোনান। হাদীছটিতে শাসককে রাখালের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। একজন ভালো রাখাল গবাদি পশুর প্রতি সদয় আচরণ করে থাকে। সে তাদের খাদ্য ও পানির ব্যাপারে খুব সতর্ক থাকে। কোন্ মাঠে তাদের চরালে ভালো ঘাস পাবে, কোথায় নিলে সহজে পানি পান করানো যাবে তার অনুসন্ধানে থাকে। পশুরা এদিক-সেদিক ছোটাছুটি করলে যত্নের সাথে তাদের ফিরিয়ে আনে এবং সর্বতোপ্রযত্নে তাদের আগলে রাখে। পশুদের প্রতি যে রাখাল নির্দয় ও নিষ্ঠুর, তার আচরণ এর সম্পূর্ণ বিপরীত। হাদীছটিতে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম শাসককে রাখালের সাথে তুলনা করে বোঝাচ্ছেন যে, তারও উচিত জনগণের প্রতি একজন দরদী রাখালের মত আচরণ করা। সে যদি তাদের প্রতি নিষ্ঠুরতা দেখায়, তবে সে একজন নিকৃষ্ট শাসকরূপে গণ্য হবে।
শাসককে রাখালের সাথে তুলনা করার তাৎপর্য
শাসককে রাখালের সাথে তুলনা করার একটা তাৎপর্য এই যে, গবাদি পশু বোধ-বুদ্ধিহীন হয়ে থাকে। তারা কোনও যুক্তিতর্ক বোঝে না। কল্যাণ-অকল্যাণেরও পার্থক্য করতে পারে না। কাজেই তাদের সঙ্গে রাগারাগি করার বা তাদেরকে মারামারি করার কোনও যুক্তি নেই এবং তার কোনও ফায়দাও নেই। সর্বাবস্থায় ধৈর্যের পরিচয় দিতে হবে। কোনও পশু হয়তো চারণভূমি ছেড়ে কারও শস্যক্ষেত্রে ঢুকে পড়ে, কোনওটি পালিয়ে যেতে চায় এবং আরও নানারকম বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করে। সব ক্ষেত্রেই রাখালকে ধৈর্য রক্ষা করতে হয় এবং হিকমত ও কৌশলের সাথে রক্ষণাবেক্ষণের কাজ আঞ্জাম দিতে হয়।
ঠিক তেমনি জনগণের মধ্যেও নানারকমের লোক থাকে। অধিকাংশেরই ভালোমন্দ জ্ঞান পরিপক্ক থাকে না। ফলে নানারকম অশান্তিকর ও বিশৃঙ্খলাপূর্ণ কর্মকাণ্ড তাদের দ্বারা হয়ে যায়। এ অবস্থায় তাদের প্রতি নিষ্ঠুর ও নির্দয় আচরণ কখনও কল্যাণ বয়ে আনে না। সাময়িকভাবে হয়তো তাদেরকে দমন করা যায়, কিন্তু কঠোরতার ফলে তাদের অন্তরে যে ঘৃণা-বিদ্বেষ দানা বাঁধতে থাকে, একপর্যায়ে তার বিস্ফোরণ ঘটে। তাই একজন ভালো শাসকের কর্তব্য আইনের যথাযথ প্রয়োগের পাশাপাশি আচার-আচরণে কোমলতা রক্ষা করা এবং সর্বাবস্থায় জনগণের প্রতি কল্যাণকামিতার পরিচয় দেওয়া।
হযরত আইয রাযি. যখন এ হাদীছটি শোনালেন, তখন উবায়দুল্লাহর কর্তব্য ছিল একজন সাহাবী হিসেবে তাঁর প্রতি সম্মানজনক আচরণ করা এবং সর্বোপরি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদীছকে ভক্তি-শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে দেখা আর সে অনুযায়ী আমলের চেষ্টা করা। কিন্তু 'চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনী'। নিষ্ঠুরতা ও রূঢ়তাই যার স্বভাব, সে সাহাবীর মত মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তিত্বকেও কটুকথা শোনাতে ছাড়ে না। কেমন শিষ্টতাবর্জিত উক্তি তাঁর উদ্দেশ্যে করে বসল যে, তুমি তো সাহাবীদের মধ্যে একজন তুচ্ছ লোক!
نخالة অর্থ আটার ভুসি, ধানের চিটা, শস্যের শাঁসবিহীন খোসা, অপুষ্ট অবস্থায় শুকিয়ে যাওয়া খেজুর ইত্যাদি। এককথায় রদ্দিমাল। একজন সাহাবী সম্পর্কে এ জাতীয় শব্দ ব্যবহার কী গুরুতর অসভ্যতা! আল্লাহ তা'আলা আমাদের হেফাজত করুন।
সাহাবায়ে কিরামের আদর্শের এক ঝলক
কিন্তু মহান সাহাবীগণ তো নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাতেগড়া। তিনি এরূপ অভব্য লোকের সঙ্গে কথা বাড়ানো পসন্দ করলেন না। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-
وَإِذَا خَاطَبَهُمُ الْجَاهِلُونَ قَالُوا سَلَامًا (63)
এবং অজ্ঞলোক যখন তাদেরকে লক্ষ্য করে (অজ্ঞতাসুলভ) কথা বলে, তখন তারা শান্তিপূর্ণ কথা বলে। সূরা ফুরকান (২৫), আয়াত ৬৩
সুতরাং হযরত আইয রাযি. তাকে সংক্ষেপে এবং শান্ত ও দৃঢ় ভাষায় উত্তর দিলেন- وَهَلْ كَانَتْ لَهُمْ نُخَالَةٌ، إِنَّمَا كَانَتِ النُّخَالَةُ بَعْدَهُمْ أَوْ فِي غَيْرِهِمْ "তাদের মধ্যে আবার কেউ ভুসিতুল্য ছিল নাকি? ভুসি তো হয়েছে তাদের পরবর্তীকালে এবং তাদের ছাড়া অন্যদের মধ্যে"। একদম খাঁটি কথা। এ খাঁটি কথাটি কী চমৎকারভাবে একজন দুর্দান্ত শাসককে তিনি শুনিয়ে দিলেন। তিনি একটুও উত্তেজিত না হয়ে এক জালেম শাসকের সামনে হক কথা বলার জিহাদ করলেন। সে জিহাদও করলেন এমন হেকমতের সঙ্গে যে, তাতে উবায়দুল্লাহ ইবন যিয়াদকে তার আত্মোপলব্ধির সুযোগও তৈরি করে দিলেন আবার সরাসরি তার ওপর আঘাতও করলেন না।
বস্তুত সাহাবীদের মধ্যে এমন একজনও নেই, যাকে অবহেলা ও অবজ্ঞা করা যেতে পারে। তাদের প্রত্যেকেই আমাদের জন্য আদর্শ। প্রত্যেকেরই জীবন আমাদের জন্য শিক্ষণীয়। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের ঘোষণা-
«أَصْحَابِي كَالنُّجُومِ بِأَيِّهِمُ اقْتَدَيْتُمُ اهْتَدَيْتُمْ»
আমার সাহাবীগণ নক্ষত্রের মত। তাদের মধ্যে যারই অনুসরণ করবে হিদায়াত পেয়ে যাবে। (ইবন আবদিল বার্র, জামিউ বায়ানিল 'ইলম ওয়া ফাদলিহী, হাদীছ নং ১৬৮৪, ১৭০২, ১৭৫৫, ১৭৫৭, ১৭৬০; বায়হাকী, আল-মাদখাল ইলাস-সুনানিল কুবরা, হাদীছ নং ১৫৩; মুসনাদুশ শিহাব আল-কুয়াঈ, হাদীছ নং ১৩৪৬: মুন্তাখাব মুসনাদ আব্দ ইবন হুমায়দ, হাদীছ নং ৭৮১)
সকল সাহাবী ছিলেন খাঁটি মানুষ। রদ্দিমাল তো পরেই তৈরি হয়েছে। কিছু হয়েছে তাবি'ঈদের যুগে, যেমন উবায়দুল্লাহ ইবন যিয়াদ নিজে। কিছু রদ্দিমাল তৈরি হয়েছে তাবে-তাবিঈনের যুগে আর তাদের পরবর্তী যুগসমূহে তো ভেজাল লোক গাণিতিক হারেই বাড়তে থেকেছে। এ অবস্থায় পরবর্তীকালের কেউ যদি ভেজালত্ব দূর করে নিজেকে শুদ্ধ-ঘাঁটি মানুষ বানাতে চায়, তবে তার উপায় তো একটিই- সাহাবীগণের অনুসরণ করা, তাঁদের আলোয় নিজেকে উদ্ভাসিত করার চেষ্টা করা। এর পরিবর্তে কেউ যদি কোনও সাহাবীর ভেজালত্বের প্রশ্ন তোলে, তবে তার মত বাতুলতা আর কী হতে পারে? এটা কঠিন বেআদবীও বটে। আল্লাহ তা'আলা আমাদেরকে হেফাজত করুন।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. কোনও শাসক অন্যায়-অসৎকাজ করলে সে ব্যাপারে তাকে সতর্ক করা এবং তাকে তার অন্যায়-অসৎকাজ থেকে ফেরানোর চেষ্টা করা ঈমানী দায়িত্ব ।
খ. শাসক ও প্রভাবশালী ব্যক্তিকে উপদেশ দানকালে তার বাহ্যিক মর্যাদার দিকে লক্ষ রাখা এবং নম্র-কোমল কথা বলা জরুরি।
গ. উপদেশ ও নসীহত করার কাজ কুরআন ও হাদীছের ভিত্তিতে হওয়া উচিত।
ঘ. অজ্ঞ ও অভব্য লোকদের সঙ্গে তর্কে না জড়িয়ে সংক্ষেপে কথা শেষ করে দেওয়াই শ্রেয়।
ঙ. সর্বাবস্থায় প্রত্যেক সাহাবীর প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধা বজায় রাখা অবশ্যকর্তব্য।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)


বর্ণনাকারী: