রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ

ভূমিকা অধ্যায়

হাদীস নং: ১৯১
সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ প্রসঙ্গ।
পুরুষের জন্য স্বর্ণালংকার ব্যবহারের অবৈধতা
হাদীছ নং : ১৯১

হযরত আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাযি. থেকে বর্ণিত, একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম জনৈক ব্যক্তির হাতে একটি সোনার আংটি দেখলেন। তিনি সেটি টেনে নিয়ে ছুঁড়ে ফেললেন এবং বললেন, তোমাদের একেকজন আগুনের জ্বলন্ত অঙ্গার খুঁজে নিয়ে নিজ হাতে ব্যবহার করে! তারপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম চলে গেলে সে ব্যক্তিকে বলা হল, তোমার আংটিটি তুলে নাও এবং কাজে লাগাও। সে ব্যক্তি বলল, আল্লাহর কসম! রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে জিনিস ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছেন তা আমি কখনও ধরব না - মুসলিম।
(সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ২০৯০: বায়হাকী, 'শুআবুল ঈমান, হাদীছ নং ৫৯২১। মুসনাদুল বাযযার, হাদীছ নং ৫২২৮; মুস্তাখরাজ আবূ 'আওয়ানা, হাদীছ নং ৮৬১০)
23 - باب في الأمر بالمعروف والنهي عن المنكر
191 - الثامن: عن ابن عباس رضي الله عنهما: أن رَسُول الله - صلى الله عليه وسلم - رأى خاتَمًا مِنْ ذهبٍ في يدِ رجلٍ فنَزعه فطرحه، وَقالَ: «يَعْمدُ أحَدُكُمْ إِلَى جَمْرَةٍ مِنْ نَارٍ فَيَجْعَلُهَا في يَدِهِ!».‍‍‍‍‍‍ فقِيلَ لِلرَّجُلِ بَعْدَمَا ذهب رَسُول اللهِ - صلى الله عليه وسلم: خُذْ خَاتَمَكَ انْتَفِعْ بِهِ. قَالَ: لاَ واللهِ لا آخُذُهُ أبَدًا وَقَدْ طَرَحَهُ رسولُ الله - صلى الله عليه وسلم. رواه مسلم. (1)

হাদীসের ব্যাখ্যা:

সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ সম্পর্কে এ হাদীছটি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা দান করে। এর আগে আমরা জেনে এসেছি অসৎকাজে বাধা দেওয়ার সর্বোচ্চ স্তর হচ্ছে হাত দিয়ে বাধা দেওয়া বা বাহুবল ব্যবহার করা। এখানে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাই করেছেন। তিনি নিজে লোকটির হাত থেকে সোনার আংটিটি টেনে নিয়ে ফেলে দিয়েছেন।

তিনি কোন্ সাহাবীর হাতে আংটিটি দেখেছিলেন, এ হাদীছে তার উল্লেখ নেই। অন্য কোনও সূত্রেও তার নাম-পরিচয় জানা যায় না। খুবসম্ভব সে সাহাবীর জানা ছিল না যে, পুরুষের জন্য স্বর্ণালংকার ব্যবহার জায়েয নয়। জানা থাকলে নিশ্চয়ই তিনি সেটি ব্যবহার করতেন না। তবে শরী'আত যা নিষেধ করেছে তা না জানাটা কোনও ওযর নয়। কোনটা হালাল কোনটা হারাম তা জেনে নেওয়া জরুরি, যাতে হারাম থেকে বাঁচা যায় এবং হালালের ওপর থাকা যায়।

পুরুষের জন্য স্বর্ণালংকার ব্যবহার কত গর্হিত তা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের এ মন্তব্য দ্বারা উপলব্ধি করা যায় যে, তিনি স্বর্ণালংকার পরাকে জ্বলন্ত অঙ্গার ব্যবহার করার সাথে তুলনা করেছেন।

এ হাদীছ দ্বারা উপলব্ধি করা যায় নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের আদেশ পালনকে সাহাবায়ে কিরাম কতটা গুরুত্ব দিতেন এবং সে ব্যাপারে কী কঠোর সংকল্পে আবদ্ধ থাকতেন। নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম চলে যাওয়ার পর যখন তাকে সেটি তুলে নিতে বলা হল, তখন কী দৃঢ়তার সঙ্গে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেছেন। এবং এই বলে নিজ সংকল্পের দৃঢ়তা ব্যক্ত করেছেন যে, যে জিনিস নবী সাল্লাল্লাহু “আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছুঁড়ে ফেলেছেন আমি তা কক্ষণও তুলে নেওয়ার নই।

সাহাবায়ে কিরামের আনুগত্যের দৃষ্টান্ত

এমনিতে তুলে নেওয়া তার জন্য জায়েয ছিল। কেননা পুরুষের জন্য নিষেধ তো কেবল স্বর্ণালংকার ব্যবহার করা। অন্য কোনও কাজে লাগানো নিষেধ নয়। যেমন তিনি চাইলে সেটি কোনও মহিলাকে হাদিয়া দিতে পারতেন কিংবা সেটি বিক্রি করে তার বিক্রয়মূল্য কোনও কাজে ব্যবহার করতে পারতেন অথবা কিছুই না করে সেটি হেফাজত করেও রাখতে পারতেন। কিন্তু এ সাহাবী অতকিছু বিবেচনা করেননি। তিনি কেবল এই দেখেছেন যে, নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেটি ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছেন। তিনি যা ছুঁড়ে ফেলেছেন তা ফেলে দেওয়া বস্তু হিসেবেই থাকুক। সেটি তুলে নেওয়া বাহ্যিকভাবে হলেও 'তাঁর ছুঁড়ে ফেলা' কাজটির বিপরীত করা হয়ে যায়। এতটুকু বিপরীত কাজ করাকেও তিনি মেনে নিতে পারেননি। এর দ্বারা আমাদের শিক্ষাগ্রহণের প্রয়োজন রয়েছে। আমরা কেবল বাহ্যিক নয়, বাস্তবিকভাবেও নবী কারীম সাল্লাল্লাহু "আলাইহি ওয়া সাল্লামের আদেশ-নিষেধ অমান্য করে থাকি। তাহলে আমরা তাঁর কেমন উম্মত এবং আমরা কেমন নবীপ্রেমিক?

এরকমই আরেকটি ঘটনা অপর এক সাহাবী সম্পর্কে বর্ণিত আছে। তিনি ছিলেন আশজা' গোত্রীয় এক ব্যক্তি। তিনি বলেন, আমি একটি সোনার আংটি পরিহিত অবস্থায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে আসলাম। তিনি একটি খেজুরের ডালা নিয়ে আমার হাতে আঘাত করলেন এবং বললেন, এটি ফেলে দাও। আমি সেটি ফেলে দিলাম। সেটি ফেলে দেওয়ার পর আবার তাঁর কাছে আসলাম। তিনি বললেন, আংটিটি কই? বললাম, ফেলে দিয়েছি। তিনি বললেন, আমি তোমাকে সেটি একদম ফেলে দিতে বলিনি। আমি তোমাকে বোঝাতে চেয়েছি যে, (সেটি ব্যবহার করো না; বরং) সেটিকে কোনও কাজে লাগাও, একদম ফেলে দিও না। মুসান্নাফ ইবন আবী শায়বা ও মুসনাদে আহমাদের বরাতে মুখতাসারু ইতহাফিল মাহারাহ- দালীলুল ফালিহীন, ১ম খণ্ড. ৪০৮ পৃষ্ঠা। নাসাঈ, আস-সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ৯৪৪০: আত-তাবারানী, আল-মু'জামুল আওসাত, হাদীছ নং ৮০৩৪

সাহাবায়ে কিরামের এরকম অসংখ্য ঘটনা আছে। তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের আদেশ ব্যবহারিক অর্থে তো বটেই, আক্ষরিক অর্থেও পালনের চেষ্টা করতেন। তারই ফল যে, আখিরাতে জান্নাত লাভের সুসংবাদ পাওয়ার পাশাপাশি দুনিয়ায়ও মর্যাদার জীবন লাভ করেছিলেন। মানুষের অন্তরে তাদের প্রভাব ছিল। মানুষ তাদের সমীহ করত। আজ আমাদের যত অধঃপতন এবং যত লাঞ্ছনা ও অমর্যাদা, তার আসল কারণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের যথার্থ অনুসরণে গাফলাতি। এখনও সময় আছে। আমাদের ফিরে আসা উচিত। আল্লাহ তা'আলা আমাদের সচেতনতা দান করুন।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. পুরুষের জন্য স্বর্ণালংকার ব্যবহার জায়েয নয়।

খ. কারও সামনে কোনও অসৎকাজ ঘটলে তার যদি ক্ষমতা থাকে তবে হাত দিয়েই তাতে বাধা দেওয়া উচিত।

গ. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতিটি আদেশ-নিষেধ সর্বোচ্চ গুরুত্বের সঙ্গে পালন করা চাই।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:বিশুদ্ধ (পারিভাষিক সহীহ)