রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ
ভূমিকা অধ্যায়
হাদীস নং: ১৮১
নসীহত ও কল্যাণকামনা।
النصيحة (নসীহত) অর্থ কল্যাণকামনা। শব্দটির উৎপত্তি نصح الرجل ثوبه (লোকটি তার কাপড় সেলাই করল)-এর থেকে। মূলত কল্যাণ কামনাকারীর কল্যাণ কামনাকে কাপড় সেলাই করার সাথে তুলনা করা হয়েছে। সেলাই করার দ্বারা যেমন ছেঁড়া-ফাঁড়া কাপড় জোড়া লাগানো হয় তার ফাঁকফোকর বন্ধ করে দেওয়া হয়, তেমনি কল্যাণকামনা দ্বারা মানুষের দোষত্রুটি সংশোধন করা হয়। অথবা এর উৎপত্তি نصحت العسل (আমি মধু পরিশোধন করলাম)-এর থেকে। পরিশোধন দ্বারা মধুকে যেমন মোম ও অন্যান্য ময়লা থেকে মুক্ত করা হয়, তেমনি কল্যাণকামী ব্যক্তি যার কল্যাণ কামনা করে তার প্রতি নিজ আচার-আচরণ ধোঁকা, প্রতারণা থেকে মুক্ত রাখে এবং তাকেও ত্রুটিমুক্ত করা ও সম্ভাব্য ক্ষতি থেকে মুক্ত রাখার চেষ্টা করে।
ওয়াজ ও উপদেশকেও নসীহত বলা হয় এ কারণেই যে, তার মধ্যেও কল্যাণকামিতা থাকে এবং উপদেশদাতা যাকে উপদেশ দেয়, মনেপ্রাণে চায় সে যেন সংশোধন হয়ে যায় এবং অন্যায়-অসৎ পথ ছেড়ে ন্যায় ও সত্যের পথে ফিরে আসে।
বস্তুত নসীহত শব্দটি অতি ব্যাপক অর্থবোধক। যাকে নসীহত করা হয় বা যার কল্যাণ কামনা করা হয়, তার সর্বপ্রকার কল্যাণ ও শুভতা এ শব্দের মধ্যে নিহিত। তাই বলা হয়ে থাকে, আরবীতে এমন কোনও একক শব্দ নেই, যা দ্বারা নসীহত শব্দটির অর্থ পুরোপুরি আদায় হতে পারে।
নসীহত ও কল্যাণকামিতা একটি মহৎ গুণ। সমস্ত নবী-রাসূলের মধ্যেই এ গুণ ছিল। তাঁরা আপন আপন উম্মতের প্রতি অধিক কল্যাণকামী ছিলেন। ফলে তাঁদের উম্মত তাঁদেরকে অবর্ণনীয় কষ্ট দেওয়া সত্ত্বেও কখনও তাদের অমঙ্গল কামনা করেননি এবং বদ্দু'আও দেননি; বরং তাদের ক্ষমা করে দিয়েছেন এবং আল্লাহ তা'আলার কাছে তাদের হিদায়াতের দু'আ করেছেন। আমাদের নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম মানুষের কত কল্যাণকামী ছিলেন তা সকলেরই জানা। তায়েফের লোমহর্ষক ঘটনায় পর্যন্ত তিনি আল্লাহর কাছে দু'আ করেছেন, হে আল্লাহ তাদের ক্ষমা করে দাও,তারা বোঝে না। তাদের শাস্তি দেওয়ার প্রস্তাব করা হলে তিনি বলেছিলেন, এরা না হোক, এদের পরবর্তী প্রজন্ম হয়তো ঈমান আনবে। তিনি মহান সাহাবীগণকেও এই গুণে উজ্জীবিত করে তোলার চেষ্টা করেছিলেন। এ ব্যাপারে তাদের থেকে অঙ্গীকারও নিয়েছিলেন। তারা সে অঙ্গীকার রক্ষা করেছিলেন এবং জীবনভর তারা মানুষের প্রতি কল্যাণকামিতার আচরণ করেছিলেন। ইসলাম চায় তার সকল অনুসারী কল্যাণকামিতার গুণে ভূষিত হোক। কেননা এটা এমনই এক গুণ, যা দ্বারা মানুষ তার মানবিক উন্নতি ও আধ্যাত্মিক উৎকর্ষে এতটা উপরে চলে যেতে পারে, যতটা অন্য কিছুর দ্বারা সম্ভব হয় না।
ইমাম আবূ বকর আল-মুযানী রহ. হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি. সম্পর্কে বলেন, তিনি যে মহানবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের অন্যসব সাহাবীর উপরে চলে গিয়েছিলেন তা কিন্তু নামায-রোযা দ্বারা নয়; বরং এমন কিছুর দ্বারা, যা তাঁর অন্তরে বিরাজ করত। তাঁর অন্তরে ছিল গভীর আল্লাহপ্রেম ও আল্লাহর সৃষ্টির প্রতি নিখুঁত কল্যাণকামিতা।
বিখ্যাত আল্লাহপ্রেমিক ফুযায়ল ইব্ন ইয়ায রহ. বলেন, আমাদের দৃষ্টিতে যারা পূর্ণতা লাভ করেছিলেন তারা তা অত্যধিক নামায-রোযা দ্বারা লাভ করেছিলেন এমন নয়; বরং তারা তা লাভ করেছিলেন মনের বদান্যতা, হৃদয়ের শুদ্ধতা ও উম্মতের প্রতি কল্যাণকামিতার দ্বারা।*
এ সম্পর্কে আছে বহু আয়াত। আছে অনেক হাদীছও। ইমাম নববী রহ. এ অধ্যায়ে সেরকম কিছু আয়াত ও হাদীছ উল্লেখ করেছেন। নিচে তার বঙ্গানুবাদ ও সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা পেশ করা হল।
*ইমাম ইবন রজব হাম্বলী, জামিউল উলূমি ওয়াল হিকাম, পৃ. ৯৮।
নসীহত ও কল্যাণকামনা সম্পর্কিত কিছু আয়াত
এক নং আয়াত
إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ إِخْوَةٌ
অর্থ : প্রকৃতপক্ষে সমস্ত মুসলিম ভাই-ভাই। সূরা হুজুরাত (৪৯), আয়াত ১০
ব্যাখ্যা
এটি সূরা হুজুরাতের দশ নং আয়াত। পূর্ণ আয়াতটি এরকম-
إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ إِخْوَةٌ فَأَصْلِحُوا بَيْنَ أَخَوَيْكُمْ وَاتَّقُوا اللَّهَ لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُونَ
'প্রকৃতপক্ষে সমস্ত মুসলিম ভাই-ভাই। সুতরাং তোমরা তোমাদের দু' ভাইয়ের মধ্যে মীমাংসা করে দাও, আল্লাহকে ভয় কর, যাতে তোমাদের প্রতি রহমত করা হয়।'
অর্থাৎ মু'মিন-মুসলিমগণ পরস্পরে আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ কিংবা একই বংশীয় না হলেও তাদের মধ্যে ঈমানী ভ্রাতৃত্ব রয়েছে। তাদের মধ্যে ভাষাগত, স্থানগত ও বংশ- গোত্রগত যত পার্থক্য ও যত দূরত্বই থাকুক না কেন, তারা একে অন্যের ভাই। এক ভাইয়ের কর্তব্য আরেক ভাইয়ের প্রতি কল্যাণকামী থাকা এবং কথায় ও কাজে তার উপকার করার চেষ্টা করা।
এর আগের আয়াতে মুসলমানদের মধ্যে পরস্পরে কলহ-বিবাদ দেখা দিলে ন্যায় ও ইনসাফের সাথে তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। তারপর এ আয়াতে জানানো হয়েছে যে, সমস্ত মুসলিম যখন ভাই-ভাই, তখন দুই ভাইয়ের মধ্যে বিরোধ দেখা দিলে তোমরা তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দেবে। অর্থাৎ মীমাংসা করে দেওয়াটা ভ্রাতৃত্বের দাবি।
পারস্পরিক কলহ-বিবাদ সবরকম অনিষ্ট ডেকে আনে। আত্মকলহ মানুষের দুনিয়া ও আখিরাত ধ্বংস করে দেয়। কোনও মুসলিমের সামনে তার দুই মুসলিম ভাই আত্মকলহে লিপ্ত হয়ে নিজ দুনিয়া-আখিরাত ধ্বংস করবে আর সে তা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখবে, এটা মেনে নেওয়া যায় না। এটা ইসলামী ভ্রাতৃত্ববোধের পরিপন্থী। তার মানে সে নিজে যথার্থ মুসলিম হতে পারেনি। যথার্থ মুসলিম হলে সে তার অপর মুসলিম ভাইয়ের ক্ষতিকে নিজের ক্ষতি বলেই গণ্য করত। ফলে সে তাদের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ত এবং তাদের কলহ মিটিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করত।
এ আয়াতের শেষে বলা হয়েছে- তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, যাতে তোমাদের প্রতি রহমত করা হয়। অর্থাৎ ভ্রাতৃত্ববোধে উজ্জীবিত ও আল্লাহর ভয়ে ভীত হয়ে তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দিলে তোমাদের প্রতি আল্লাহ রহমত করবেন। তোমরা পরস্পরে শান্তি- শৃঙ্খলার সাথে জীবনযাপন করতে পারবে এবং নির্বিঘ্নে আল্লাহপ্রদত্ত দায়িত্ব আঞ্জাম দিয়ে আখিরাতে মুক্তি লাভের ব্যবস্থা করতে সক্ষম হবে।
দুই নং আয়াত
وَقَالَ تَعَالَى إخْبَارًا عَنْ نُوح ﷺ : وَأَنْصَحُ لَكُمْ
অর্থ : আল্লাহ তা'আলা হযরত নূহ আলাইহিস সালামের বাণী বিবৃত করে বলেন,
আমি তোমাদের কল্যাণ কামনা করি।সূরা আ'রাফ (৭), আয়াত ৫২
ব্যাখ্যা
এ কথাটি হযরত নূহ আলাইহিস-সালামের। তিনি নিজ কওমকে যখন এক আল্লাহর ইবাদতের দিকে ডাকছিলেন, তখন তারা উল্টো তাঁকে বিপথগামী সাব্যস্ত করতে থাকে। তাদের দৃষ্টিতে দেব-দেবীর পূজা করাই সঠিক ছিল। বাপ-দাদার আমল থেকে তারা এটাই দেখে আসছে। সেই দেব-দেবীর পূজা ছেড়ে এক আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগী করাকে তারা মেনে নিতে পারছিল না এবং তারা এটাকে সঠিকও মনে করছিল না। তাই হযরত নূহ আলাইহিস সালামকে বিপথগামী ঠাওরাতে শুরু করে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে তিনি তাদের লক্ষ্য করে বলেন, আমি মোটেই বিপথগামী নই। আমি তো রাব্বুল "আলামীনের পক্ষ থেকে তোমাদের কাছে রাসূল হয়ে এসেছি। আমি তোমাদের কাছে তাঁর আদেশ-নিষেধ পৌছিয়ে থাকি। তোমরা বিভ্রান্ত বলেই আমাকে চিনতে পারছ না। বস্তুত আমি তোমাদের পরম হিতাকাঙ্ক্ষী। তোমাদের কল্যাণ চাই এবং তোমাদেরকে ভালো ভালো উপদেশ দিই। সুতরাং তোমাদের কর্তব্য- আমার কথা বুঝতে চেষ্টা করা এবং আমার উপদেশ অনুযায়ী শিরকের অন্ধকার পরিত্যাগ করে তাওহীদের আলোর দিকে চলে আসা এবং এক আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগী করে মানবজীবন সার্থক করে তোলা।
তিন নং আয়াত
وَعَنْ هُودٍ ﷺ : وَانَا لَكُمْ نَاصِحٌ أَمِينٌ
অর্থ : আর হুদ আলাইহিস সালামের বাণী বিবৃত করেন- 'এবং আমি তোমাদের এক বিশ্বস্ত কল্যাণকামী । সূরা আ'রাফ (৭), আয়াত ৬৮
ব্যাখ্যা
এ কথাটি হযরত হূদ 'আলাইহিস সালামের। তাঁকে 'আদ জাতির কাছে নবী করে পাঠানো হয়েছিল। তারাও এক আল্লাহর পরিবর্তে বহু দেব-দেবীর পূজা করত। তিনি যখন তাদেরকে দেব-দেবীর পূজার বিপরীতে এক আল্লাহর ইবাদতের দিকে ডাকলেন, তখন তারা তাঁকে নির্বোধ ও মিথ্যুক সাব্যস্ত করল। এরই জবাবে তিনি তাদেরকে এ কথাটি বলেছিলেন। তিনি তাদের বোঝানোর চেষ্টা করছিলেন যে, আমি রাব্বুল 'আলামীনের একজন রাসূল। আমি তোমাদের কাছে তাঁর বার্তা পৌঁছিয়ে থাকি। আমার কোনও কথাই নির্বুদ্ধিতা নয়। তোমরা আপন নির্বুদ্ধিতার কারণে আমার উপদেশকে নির্বুদ্ধিতা ঠাওরাচ্ছ। তোমাদের উচিত মনোযোগ দিয়ে আমার কথা শোনা। আমি তোমাদের এক পরম হিতাকাঙ্ক্ষী। আমি একজন বিশ্বস্ত আমানতদাররূপেই তোমাদের মধ্যে পরিচিত। এমন হিতাকাঙ্ক্ষী ও বিশ্বস্ত ব্যক্তির কথা বুঝতে চেষ্টা করা উচিত। তোমরা যদি তা বোঝ এবং মানতে চেষ্টা কর তবে তোমাদের কল্যাণ হবে, অন্যথায় তোমরা মহাক্ষতির সম্মুখীন হবে।
النصيحة (নসীহত) অর্থ কল্যাণকামনা। শব্দটির উৎপত্তি نصح الرجل ثوبه (লোকটি তার কাপড় সেলাই করল)-এর থেকে। মূলত কল্যাণ কামনাকারীর কল্যাণ কামনাকে কাপড় সেলাই করার সাথে তুলনা করা হয়েছে। সেলাই করার দ্বারা যেমন ছেঁড়া-ফাঁড়া কাপড় জোড়া লাগানো হয় তার ফাঁকফোকর বন্ধ করে দেওয়া হয়, তেমনি কল্যাণকামনা দ্বারা মানুষের দোষত্রুটি সংশোধন করা হয়। অথবা এর উৎপত্তি نصحت العسل (আমি মধু পরিশোধন করলাম)-এর থেকে। পরিশোধন দ্বারা মধুকে যেমন মোম ও অন্যান্য ময়লা থেকে মুক্ত করা হয়, তেমনি কল্যাণকামী ব্যক্তি যার কল্যাণ কামনা করে তার প্রতি নিজ আচার-আচরণ ধোঁকা, প্রতারণা থেকে মুক্ত রাখে এবং তাকেও ত্রুটিমুক্ত করা ও সম্ভাব্য ক্ষতি থেকে মুক্ত রাখার চেষ্টা করে।
ওয়াজ ও উপদেশকেও নসীহত বলা হয় এ কারণেই যে, তার মধ্যেও কল্যাণকামিতা থাকে এবং উপদেশদাতা যাকে উপদেশ দেয়, মনেপ্রাণে চায় সে যেন সংশোধন হয়ে যায় এবং অন্যায়-অসৎ পথ ছেড়ে ন্যায় ও সত্যের পথে ফিরে আসে।
বস্তুত নসীহত শব্দটি অতি ব্যাপক অর্থবোধক। যাকে নসীহত করা হয় বা যার কল্যাণ কামনা করা হয়, তার সর্বপ্রকার কল্যাণ ও শুভতা এ শব্দের মধ্যে নিহিত। তাই বলা হয়ে থাকে, আরবীতে এমন কোনও একক শব্দ নেই, যা দ্বারা নসীহত শব্দটির অর্থ পুরোপুরি আদায় হতে পারে।
নসীহত ও কল্যাণকামিতা একটি মহৎ গুণ। সমস্ত নবী-রাসূলের মধ্যেই এ গুণ ছিল। তাঁরা আপন আপন উম্মতের প্রতি অধিক কল্যাণকামী ছিলেন। ফলে তাঁদের উম্মত তাঁদেরকে অবর্ণনীয় কষ্ট দেওয়া সত্ত্বেও কখনও তাদের অমঙ্গল কামনা করেননি এবং বদ্দু'আও দেননি; বরং তাদের ক্ষমা করে দিয়েছেন এবং আল্লাহ তা'আলার কাছে তাদের হিদায়াতের দু'আ করেছেন। আমাদের নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম মানুষের কত কল্যাণকামী ছিলেন তা সকলেরই জানা। তায়েফের লোমহর্ষক ঘটনায় পর্যন্ত তিনি আল্লাহর কাছে দু'আ করেছেন, হে আল্লাহ তাদের ক্ষমা করে দাও,তারা বোঝে না। তাদের শাস্তি দেওয়ার প্রস্তাব করা হলে তিনি বলেছিলেন, এরা না হোক, এদের পরবর্তী প্রজন্ম হয়তো ঈমান আনবে। তিনি মহান সাহাবীগণকেও এই গুণে উজ্জীবিত করে তোলার চেষ্টা করেছিলেন। এ ব্যাপারে তাদের থেকে অঙ্গীকারও নিয়েছিলেন। তারা সে অঙ্গীকার রক্ষা করেছিলেন এবং জীবনভর তারা মানুষের প্রতি কল্যাণকামিতার আচরণ করেছিলেন। ইসলাম চায় তার সকল অনুসারী কল্যাণকামিতার গুণে ভূষিত হোক। কেননা এটা এমনই এক গুণ, যা দ্বারা মানুষ তার মানবিক উন্নতি ও আধ্যাত্মিক উৎকর্ষে এতটা উপরে চলে যেতে পারে, যতটা অন্য কিছুর দ্বারা সম্ভব হয় না।
ইমাম আবূ বকর আল-মুযানী রহ. হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি. সম্পর্কে বলেন, তিনি যে মহানবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের অন্যসব সাহাবীর উপরে চলে গিয়েছিলেন তা কিন্তু নামায-রোযা দ্বারা নয়; বরং এমন কিছুর দ্বারা, যা তাঁর অন্তরে বিরাজ করত। তাঁর অন্তরে ছিল গভীর আল্লাহপ্রেম ও আল্লাহর সৃষ্টির প্রতি নিখুঁত কল্যাণকামিতা।
বিখ্যাত আল্লাহপ্রেমিক ফুযায়ল ইব্ন ইয়ায রহ. বলেন, আমাদের দৃষ্টিতে যারা পূর্ণতা লাভ করেছিলেন তারা তা অত্যধিক নামায-রোযা দ্বারা লাভ করেছিলেন এমন নয়; বরং তারা তা লাভ করেছিলেন মনের বদান্যতা, হৃদয়ের শুদ্ধতা ও উম্মতের প্রতি কল্যাণকামিতার দ্বারা।*
এ সম্পর্কে আছে বহু আয়াত। আছে অনেক হাদীছও। ইমাম নববী রহ. এ অধ্যায়ে সেরকম কিছু আয়াত ও হাদীছ উল্লেখ করেছেন। নিচে তার বঙ্গানুবাদ ও সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা পেশ করা হল।
*ইমাম ইবন রজব হাম্বলী, জামিউল উলূমি ওয়াল হিকাম, পৃ. ৯৮।
নসীহত ও কল্যাণকামনা সম্পর্কিত কিছু আয়াত
এক নং আয়াত
إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ إِخْوَةٌ
অর্থ : প্রকৃতপক্ষে সমস্ত মুসলিম ভাই-ভাই। সূরা হুজুরাত (৪৯), আয়াত ১০
ব্যাখ্যা
এটি সূরা হুজুরাতের দশ নং আয়াত। পূর্ণ আয়াতটি এরকম-
إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ إِخْوَةٌ فَأَصْلِحُوا بَيْنَ أَخَوَيْكُمْ وَاتَّقُوا اللَّهَ لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُونَ
'প্রকৃতপক্ষে সমস্ত মুসলিম ভাই-ভাই। সুতরাং তোমরা তোমাদের দু' ভাইয়ের মধ্যে মীমাংসা করে দাও, আল্লাহকে ভয় কর, যাতে তোমাদের প্রতি রহমত করা হয়।'
অর্থাৎ মু'মিন-মুসলিমগণ পরস্পরে আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ কিংবা একই বংশীয় না হলেও তাদের মধ্যে ঈমানী ভ্রাতৃত্ব রয়েছে। তাদের মধ্যে ভাষাগত, স্থানগত ও বংশ- গোত্রগত যত পার্থক্য ও যত দূরত্বই থাকুক না কেন, তারা একে অন্যের ভাই। এক ভাইয়ের কর্তব্য আরেক ভাইয়ের প্রতি কল্যাণকামী থাকা এবং কথায় ও কাজে তার উপকার করার চেষ্টা করা।
এর আগের আয়াতে মুসলমানদের মধ্যে পরস্পরে কলহ-বিবাদ দেখা দিলে ন্যায় ও ইনসাফের সাথে তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। তারপর এ আয়াতে জানানো হয়েছে যে, সমস্ত মুসলিম যখন ভাই-ভাই, তখন দুই ভাইয়ের মধ্যে বিরোধ দেখা দিলে তোমরা তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দেবে। অর্থাৎ মীমাংসা করে দেওয়াটা ভ্রাতৃত্বের দাবি।
পারস্পরিক কলহ-বিবাদ সবরকম অনিষ্ট ডেকে আনে। আত্মকলহ মানুষের দুনিয়া ও আখিরাত ধ্বংস করে দেয়। কোনও মুসলিমের সামনে তার দুই মুসলিম ভাই আত্মকলহে লিপ্ত হয়ে নিজ দুনিয়া-আখিরাত ধ্বংস করবে আর সে তা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখবে, এটা মেনে নেওয়া যায় না। এটা ইসলামী ভ্রাতৃত্ববোধের পরিপন্থী। তার মানে সে নিজে যথার্থ মুসলিম হতে পারেনি। যথার্থ মুসলিম হলে সে তার অপর মুসলিম ভাইয়ের ক্ষতিকে নিজের ক্ষতি বলেই গণ্য করত। ফলে সে তাদের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ত এবং তাদের কলহ মিটিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করত।
এ আয়াতের শেষে বলা হয়েছে- তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, যাতে তোমাদের প্রতি রহমত করা হয়। অর্থাৎ ভ্রাতৃত্ববোধে উজ্জীবিত ও আল্লাহর ভয়ে ভীত হয়ে তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দিলে তোমাদের প্রতি আল্লাহ রহমত করবেন। তোমরা পরস্পরে শান্তি- শৃঙ্খলার সাথে জীবনযাপন করতে পারবে এবং নির্বিঘ্নে আল্লাহপ্রদত্ত দায়িত্ব আঞ্জাম দিয়ে আখিরাতে মুক্তি লাভের ব্যবস্থা করতে সক্ষম হবে।
দুই নং আয়াত
وَقَالَ تَعَالَى إخْبَارًا عَنْ نُوح ﷺ : وَأَنْصَحُ لَكُمْ
অর্থ : আল্লাহ তা'আলা হযরত নূহ আলাইহিস সালামের বাণী বিবৃত করে বলেন,
আমি তোমাদের কল্যাণ কামনা করি।সূরা আ'রাফ (৭), আয়াত ৫২
ব্যাখ্যা
এ কথাটি হযরত নূহ আলাইহিস-সালামের। তিনি নিজ কওমকে যখন এক আল্লাহর ইবাদতের দিকে ডাকছিলেন, তখন তারা উল্টো তাঁকে বিপথগামী সাব্যস্ত করতে থাকে। তাদের দৃষ্টিতে দেব-দেবীর পূজা করাই সঠিক ছিল। বাপ-দাদার আমল থেকে তারা এটাই দেখে আসছে। সেই দেব-দেবীর পূজা ছেড়ে এক আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগী করাকে তারা মেনে নিতে পারছিল না এবং তারা এটাকে সঠিকও মনে করছিল না। তাই হযরত নূহ আলাইহিস সালামকে বিপথগামী ঠাওরাতে শুরু করে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে তিনি তাদের লক্ষ্য করে বলেন, আমি মোটেই বিপথগামী নই। আমি তো রাব্বুল "আলামীনের পক্ষ থেকে তোমাদের কাছে রাসূল হয়ে এসেছি। আমি তোমাদের কাছে তাঁর আদেশ-নিষেধ পৌছিয়ে থাকি। তোমরা বিভ্রান্ত বলেই আমাকে চিনতে পারছ না। বস্তুত আমি তোমাদের পরম হিতাকাঙ্ক্ষী। তোমাদের কল্যাণ চাই এবং তোমাদেরকে ভালো ভালো উপদেশ দিই। সুতরাং তোমাদের কর্তব্য- আমার কথা বুঝতে চেষ্টা করা এবং আমার উপদেশ অনুযায়ী শিরকের অন্ধকার পরিত্যাগ করে তাওহীদের আলোর দিকে চলে আসা এবং এক আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগী করে মানবজীবন সার্থক করে তোলা।
তিন নং আয়াত
وَعَنْ هُودٍ ﷺ : وَانَا لَكُمْ نَاصِحٌ أَمِينٌ
অর্থ : আর হুদ আলাইহিস সালামের বাণী বিবৃত করেন- 'এবং আমি তোমাদের এক বিশ্বস্ত কল্যাণকামী । সূরা আ'রাফ (৭), আয়াত ৬৮
ব্যাখ্যা
এ কথাটি হযরত হূদ 'আলাইহিস সালামের। তাঁকে 'আদ জাতির কাছে নবী করে পাঠানো হয়েছিল। তারাও এক আল্লাহর পরিবর্তে বহু দেব-দেবীর পূজা করত। তিনি যখন তাদেরকে দেব-দেবীর পূজার বিপরীতে এক আল্লাহর ইবাদতের দিকে ডাকলেন, তখন তারা তাঁকে নির্বোধ ও মিথ্যুক সাব্যস্ত করল। এরই জবাবে তিনি তাদেরকে এ কথাটি বলেছিলেন। তিনি তাদের বোঝানোর চেষ্টা করছিলেন যে, আমি রাব্বুল 'আলামীনের একজন রাসূল। আমি তোমাদের কাছে তাঁর বার্তা পৌঁছিয়ে থাকি। আমার কোনও কথাই নির্বুদ্ধিতা নয়। তোমরা আপন নির্বুদ্ধিতার কারণে আমার উপদেশকে নির্বুদ্ধিতা ঠাওরাচ্ছ। তোমাদের উচিত মনোযোগ দিয়ে আমার কথা শোনা। আমি তোমাদের এক পরম হিতাকাঙ্ক্ষী। আমি একজন বিশ্বস্ত আমানতদাররূপেই তোমাদের মধ্যে পরিচিত। এমন হিতাকাঙ্ক্ষী ও বিশ্বস্ত ব্যক্তির কথা বুঝতে চেষ্টা করা উচিত। তোমরা যদি তা বোঝ এবং মানতে চেষ্টা কর তবে তোমাদের কল্যাণ হবে, অন্যথায় তোমরা মহাক্ষতির সম্মুখীন হবে।
নসীহত ও কল্যাণকামিতার গুরুত্ব
হাদীছ নং: ১৮১
হযরত আবূ রুকাইয়া তামীম ইবন আওস আদ-দারী রাযি. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, দীন তো কল্যাণকামনারই নাম। আমরা জিজ্ঞেস করলাম, কার জন্য (কল্যাণকামনা)? তিনি বললেন, আল্লাহর জন্য, তাঁর কিতাবের জন্য, তাঁর রাসূলের জন্য, মুসলিমদের ইমামদের (নেতাদের) জন্য এবং সাধারণ মুসলিমদের জন্য -মুসলিম।
(সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ৫৫; সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ৪৯৪৪; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ১৯২৬; সুনানে নাসাঈ, হাদীছ নং ৪১৯৭)
হাদীছ নং: ১৮১
হযরত আবূ রুকাইয়া তামীম ইবন আওস আদ-দারী রাযি. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, দীন তো কল্যাণকামনারই নাম। আমরা জিজ্ঞেস করলাম, কার জন্য (কল্যাণকামনা)? তিনি বললেন, আল্লাহর জন্য, তাঁর কিতাবের জন্য, তাঁর রাসূলের জন্য, মুসলিমদের ইমামদের (নেতাদের) জন্য এবং সাধারণ মুসলিমদের জন্য -মুসলিম।
(সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ৫৫; সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ৪৯৪৪; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ১৯২৬; সুনানে নাসাঈ, হাদীছ নং ৪১৯৭)
22 - باب في النصيحة
قَالَ تَعَالَى: {إِنَّمَا المُؤْمِنُونَ إخْوَةٌ} [الحجرات: 10]، وَقالَ تَعَالَى: إخبارًا عن نوحٍ - صلى الله عليه وسلم: {وَأنْصَحُ لَكُمْ} [الأعراف: 62]، وعن هود - صلى الله عليه وسلم: {وَأنَا لَكُمْ نَاصِحٌ أمِينٌ} [الأعراف: 68].
قَالَ تَعَالَى: {إِنَّمَا المُؤْمِنُونَ إخْوَةٌ} [الحجرات: 10]، وَقالَ تَعَالَى: إخبارًا عن نوحٍ - صلى الله عليه وسلم: {وَأنْصَحُ لَكُمْ} [الأعراف: 62]، وعن هود - صلى الله عليه وسلم: {وَأنَا لَكُمْ نَاصِحٌ أمِينٌ} [الأعراف: 68].
181 - فالأول: عن أَبي رُقَيَّةَ تَمِيم بن أوس الداريِّ - رضي الله عنه: أنَّ النَّبيّ - صلى الله عليه وسلم - قَالَ: «الدِّينُ النَّصِيحةُ» قلنا: لِمَنْ؟ قَالَ: «لِلهِ وَلِكِتَابِهِ وَلِرَسُولِهِ وَلأئِمَّةِ المُسْلِمِينَ وَعَامَّتِهِمْ (1)». رواه مسلم. (2)
হাদীসের ব্যাখ্যা:
এ হাদীছটি ইসলামের একটি মৌলিক শিক্ষামূলক হাদীছ। বলা হয়েছে দীন তো কল্যাণকামনাই। অর্থাৎ দীনের স্তম্ভ ও সারনির্যাস হচ্ছে কল্যাণকামনা। অত্যধিক গুরুত্বের কারণে দীনকে কল্যাণকামিতার মধ্যে সীমাবদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে। যেমন এক হাদীছে বলা হয়েছে- الحج عرفة 'হজ্জ তো আরাফায় অবস্থানই'। তার মানে আরাফায় অবস্থানই সম্পূর্ণ হজ্জ নয়; বরং আরাফায় অবস্থান করা হজ্জের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ কাজ। তদ্রূপ এ হাদীছেও এ কথা বোঝানো উদ্দেশ্য নয় যে, সম্পূর্ণ দীন বাস কল্যাণকামনাই, এর বাইরে আর কিছু নেই। এর বাইরে দীনের আরও অনেক কিছুই আছে। তবে হাঁ, নসীহত ও কল্যাণকামনা দীনের অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
সে গুরুত্বের প্রতি লক্ষ করেই বলা হয়ে থাকে, এ হাদীছের মধ্যে দীনের এক- চতুর্থাংশ শিক্ষা বিদ্যমান। ইমাম নববী রহ. বলেন, বরং এই একটি হাদীছই সমগ্র দীনের শিক্ষার সারমর্ম। তাঁর এ কথা যথার্থ। কেননা সমগ্র দীন মূলত আল্লাহ ও বান্দার হক আদায়ের সমষ্টির নাম। কল্যাণকামনা দ্বারা মূলত হক আদায়ের কথা বোঝানো উদ্দেশ্য। সে হিসেবে এ হাদীছে আল্লাহ তা'আলার হক, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের হক, মুসলিম জাতির ইমামদের হক এবং আমজনগণের হক আদায়ের তাকিদ করা হয়েছে। এঁদের সকলের হকের শিক্ষা রয়েছে আল্লাহর কিতাবে। এ হাদীছে আল্লাহ তা'আলার কিতাবের হক আদায়ের কথাও আছে। এভাবে দীনের যাবতীয় বিধি-বিধান পালনের নির্দেশ এ হাদীছের মধ্যে এসে গেছে। সুতরাং এটি সমগ্র দীনের শিক্ষার সারমর্মই বটে।
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন বললেন, দীন তো কল্যাণকামিতাই, তখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে, এর দ্বারা কার প্রতি কল্যাণকামিতা বোঝানো উদ্দেশ্য? এটা স্পষ্টভাবে বুঝে নেওয়া প্রয়োজন। অন্যথায় এর যথার্থ প্রয়োগ সম্ভব নয়। তাই উপস্থিত সাহাবায়ে কিরাম জিজ্ঞেস করলেন, কার প্রতি কল্যাণকামনা? নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম উত্তরে পাঁচ প্রকার কল্যাণকামনার কথা উল্লেখ করলেন। নিচে সে পাঁচ প্রকার কল্যাণকামনার সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা দেওয়া গেল।
১. আল্লাহর প্রতি কল্যাণকামিতা
সর্বপ্রথম বলা হয়েছে আল্লাহর প্রতি কল্যাণকামনার কথা। আল্লাহর প্রতি কল্যাণকামনা মানে আল্লাহ তা'আলার প্রতি বিশুদ্ধ আকীদা-বিশ্বাস পোষণ করা অর্থাৎ তাঁর অস্তিত্ব ও তাঁর একত্বে বিশ্বাস করা, কোনওকিছুকে তাঁর সঙ্গে শরীক না করা, তাঁর সিফাত ও গুণবাচক নামসমূহে বিশ্বাস রাখা এবং তা অস্বীকার ও তার ভুল ব্যাখ্যা হতে বিরত থাকা। যাবতীয় উৎকৃষ্ট গুণে তাঁর পরিপূর্ণতা এবং সর্বপ্রকার দোষত্রুটি থেকে তাঁর পবিত্রতা ঘোষণা করা।
এমনিভাবে আল্লাহ তা'আলার প্রতি কল্যাণকামিতা হচ্ছে প্রকাশ্যে ও আন্তরিকভাবে তাঁর প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করা ও তাঁর অবাধ্যতা হতে বিরত থাকা, তাঁর জন্যই কাউকে ভালোবাসা ও তাঁর জন্যই কারও প্রতি শত্রুতা পোষণ করা, তাঁর বন্ধুকে বন্ধু জানা ও তাঁর শত্রুকে শত্রু গণ্য করা, তাঁর শত্রুদের বিরুদ্ধে কার্যত জিহাদ করা বা জিহাদের নিয়ত রাখা, তাঁর যাবতীয় অনুগ্রহ স্বীকার করা ও নি'আমতসমূহের শোকর আদায় করা, তাঁর ইবাদত-বন্দেগীতে অন্তরে ইখলাস বজায় রাখা, তাঁর আদেশসমূহ পালনের ক্ষেত্রে তাঁর ঘোষিত পুরস্কারের আশা রাখা, তাঁর অবাধ্যতার ক্ষেত্রে তাঁর শাস্তির ভয় রাখা।
এ যা-কিছু বলা হল, এর প্রতি মানুষকে দাওয়াত দেওয়া, মানুষকে এর প্রতি উৎসাহী করে তোলার ব্যবস্থা নেওয়া, তাদেরকে এর শিক্ষাদান করা এবং এ লক্ষ্যে তাদের প্রতি নম্র-কোমল ব্যবহার করাও আল্লাহর প্রতি কল্যাণকামিতার অন্তর্ভুক্ত।
হযরত আলী রাযি. থেকে বর্ণিত আছে যে, হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের শিষ্যগণ তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিল, আল্লাহর প্রতি কল্যাণকামী কে? তিনি বলেছিলেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর হককে মানুষের হকের ওপর প্রাধান্য দেয়।
প্রকাশ থাকে যে, আল্লাহ তা'আলা কারও প্রতি ঠেকা নন। তিনি সর্বপ্রকার অভাব ও কমতি থেকে মুক্ত-পবিত্র। সুতরাং তাঁর প্রতি প্রকৃত অর্থে কারও কল্যাণকামনার প্রশ্নই আসে না। তাঁর প্রতি কল্যাণকামনা হিসেবে যে কাজগুলোর কথা উল্লেখ করা হল, তার সুফল মূলত বান্দা নিজেই লাভ করে। সে হিসেবে কল্যাণকামনা আল্লাহর প্রতি নয়; বরং বান্দার নিজের প্রতি। তা সত্ত্বেও হাদীছে যে একে "আল্লাহর কল্যাণকামনা' শব্দে ব্যক্ত করা হয়েছে, এটা বান্দার প্রতি আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ। হাদীছের কথা মূলত আল্লাহরই কথা। সুতরাং বান্দার প্রতি মহব্বত ও অনুগ্রহবশত আল্লাহ তা'আলা বান্দার নিজের প্রতি নিজ কল্যাণকামনাকে আল্লাহর প্রতি কল্যাণকামনা বলে অভিহিত করেছেন। সুবহানাল্লাহ! তিনি কতই না মহানুভব এবং কত উচ্চ তাঁর গুণগ্রাহিতা। এর দৃষ্টান্ত হচ্ছে কুরআন মাজীদের এ আয়াত-
ولَيَنْصُرَنَّ الله مَنْ يَنصُرُهُ
আল্লাহ তাআলা অবশ্যই তার সাহায্য করবেন, যে তাঁর সাহায্য করবে। সুরা হজ্জ (২২), আয়াত ৪০
এ মর্মে আরও একাধিক আয়াত আছে, যাতে আল্লাহর দীনের সাহায্য করাকে আল্লাহর সাহায্য সাব্যস্ত করা হয়েছে। দীন মানুষেরই জন্য। কাজেই দীনের সাহায্য করার দ্বারা প্রকৃতপক্ষে নিজেরই সাহায্য করা হয়। তা সত্ত্বেও আল্লাহ তা'আলা আপন অনুগ্রহে বান্দার কাজের মর্যাদা দানের লক্ষ্যে সে সাহায্যকে আল্লাহর সাহায্য বলে প্রকাশ করেছেন।
২. আল্লাহর কিতাবের প্রতি কল্যাণকামিতা
আল্লাহর কিতাবের প্রতি কল্যাণকামিতার অর্থ প্রথমত এর প্রতি ঈমান আনা যে, এটা আল্লাহর কিতাব ও তাঁর বাণী। তিনিই এ কিতাব নাযিল করেছেন। এটা কোনও মানুষের কথা নয়। কোনও মানুষের পক্ষে এরকম কথা বলা সম্ভব নয়। দুনিয়ার সমস্ত মানুষ মিলেও যদি চেষ্টা করে, তবে এর ছোট্ট একটি সূরার মত সূরাও বানাতে পারবে না। তারপর অন্তরে এ কিতাবের প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধা লালন করা, এর শিক্ষা গ্রহণ করা ও শিক্ষা দান করা, এর তিলাওয়াত করা ও অর্থ বোঝার চেষ্টা করা এবং এর মধ্যে তাদাব্বুর ও চিন্তাভাবনা করে আপন আপন সামর্থ্য অনুযায়ী এর অন্তহীন জ্ঞানরাশি থেকে যতদূর সম্ভব আহরণে যত্নবান থাকা। তারপর এর উপদেশ গ্রহণ করা ও এর শিক্ষা অনুযায়ী আমল করা। তারপর এর প্রচার-প্রসারে ভূমিকা রাখা, ব্যক্তিজীবন ও সমাজজীবনে এর বিধানাবলী বাস্তবায়নের চেষ্টা করা এবং সর্বপ্রকার অপব্যাখ্যা থেকে তার হেফাজত করা।
৩. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি কল্যাণকামিতা
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি কল্যাণকামিতার অর্থ প্রথমত তাঁর প্রতি এ বিশ্বাস রাখা যে, তিনি আল্লাহর প্রেরিত সর্বশেষ নবী। কিয়ামত পর্যন্ত সমস্ত মানুষের হিদায়াতের জন্য তাঁকে পাঠানো হয়েছে। তারপর যথার্থ ভক্তি-শ্রদ্ধার সাথে তাঁর প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করা, তাঁর আদেশ-নিষেধ মেনে চলা, আল্লাহ তা'আলার মহব্বত ও ভালোবাসা পাওয়ার লক্ষ্যে তাঁর পরিপূর্ণ অনুসরণ করা, তাঁর জীবদ্দশায় এবং তাঁর ওফাতের পর তাঁকে সাহায্য-সহযোগিতা করা, তাঁর সুন্নত ও জীবনাদর্শ শেখা ও শিক্ষাদান করা, তাঁর রেখে যাওয়া দীনের প্রতি মানুষকে দাওয়াত দেওয়া এবং সর্বত্র তার প্রচার ও প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখা।
এমনিভাবে নবীর আহলে বাইত ও সাহাবায়ে কিরামকে ভালোবাসা, যে-কোনও সাহাবীর নিন্দা ও সমালোচনা থেকে বিরত থাকা; বরং তাদের নিন্দাকারী এবং বিদ'আত ও বিদ'আতপন্থীদের প্রতি ঘৃণা ও অশ্রদ্ধা পোষণ করা এ কল্যাণকামিতার অতি গুরুত্বপূর্ণ দিক।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি কল্যাণকামিতার একটা অংশ এইও যে, তাঁর ওয়ারিশ তথা উলামায়ে কিরামের প্রতি মহব্বত রাখা হবে, তাদের কাছ থেকে দীনের শিক্ষা গ্রহণ করা হবে, দীনের বহুমুখী খেদমতে ঐকান্তিকভাবে তাদের সহযোগিতা করা হবে এবং দীনের প্রচার ও প্রতিষ্ঠায় তাদের দিকনির্দেশনা গ্রহণ করা হবে।
মুসলিম নেতৃবর্গের প্রতি কল্যাণকামিতা
এ হাদীছে মুসলিমদের ইমাম বলতে তাদের নেতৃবর্গকে বোঝানো হয়েছে। তাদের প্রতি কল্যাণকামিতার অর্থ তাদের প্রতি অর্পিত দায়-দায়িত্ব যাতে তারা যথাযথভাবে আঞ্জাম দিতে পারে সে ব্যাপারে তাদের সাহায্য-সহযোগিতা করা, তাদের দ্বারা কোনও ভুলত্রুটি হয়ে গেলে সে ব্যাপারে তাদের সতর্ক করা, তাদের নেতৃত্বে সকলের ঐক্যবদ্ধ থাকা, তাদের বিরুদ্ধাচারীদেরকে তাদের প্রতি অনুগত করে তোলার চেষ্টা করা এবং উত্তম পন্থায় তাদেরকে জনগণের প্রতি জুলুম-অত্যাচার করা থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করা।
ইমাম ও নেতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ না করা; বরং তার বিরুদ্ধে কোথাও বিদ্রোহ হলে যদি তা দমনের জন্য ডাক দেওয়া হয়, তবে তাতে সাড়া দেওয়াও তাদের কল্যাণকামিতার অন্তর্ভুক্ত। সক্ষম ও সামর্থ্যবান ব্যক্তিদের এ ক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকার সুযোগ নেই। কেননা যে কাজে আল্লাহর নাফরমানী হয় না এবং তা জনগণের স্বার্থবিরোধী ও শাসকের স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে না হয়, সে কাজে ইমামের আনুগত্য করা ফরয।
আমজনগণের প্রতি কল্যাণকামিতা
আমজনগণের প্রতি কল্যাণকামিতার অর্থ তাদের প্রতি মমত্ব প্রদর্শন করা, তাদেরকে কল্যাণকর বিষয় শেখানো, দীন ও দুনিয়ার উপকারী বিষয়ে তাদের সাহায্য-সহযোগিতা করা, তাদেরকে কষ্টদান থেকে বিরত থাকা, তাদের জান-মাল ও ইজ্জতের কোনও প্রকার ক্ষতিসাধন না করা, বরং তার হেফাজতে ভূমিকা রাখা। মোটকথা, তাদের দীনী ও দুনিয়াবী সর্বপ্রকার হক আদায়ে যত্নবান থাকা, কোনওভাবেই তাদের কোনও অধিকার ক্ষুণ্ণ না করা এবং নিজের জন্য যা পসন্দ করা হয় তাদের জন্যও তা পসন্দ করা আর নিজের জন্য যা অপসন্দ করা হয় তাদের জন্যও তা অপসন্দ করা।
আমীর ও শাসক এবং আমজনগণের কল্যাণকামিতার একটা অংশ হচ্ছে তাদেরকে সদুপদেশ দেওয়া। তাদের দ্বারা আল্লাহর হক ও বান্দার হক আদায়ে গড়িমসি হলে কিংবা তাদেরকে কোনও অন্যায়-অসৎকর্মে লিপ্ত দেখতে পেলে তখন ইখলাস ও আন্তরিকতার সঙ্গে তাদেরকে সদুপদেশ দেওয়া ও সংশোধনের চেষ্টা করাই তাদের প্রতি শ্রেষ্ঠতম কল্যাণকামিতা। এ ক্ষেত্রে উপদেশদান ও সংশোধন চেষ্টার রীতিনীতি রক্ষা করাও জরুরি, অন্যথায় উপকারের চেয়ে ক্ষতি বেশি হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এ প্রসঙ্গে ইমাম ইবন হাজার আসকালানী রহ.-এর বক্তব্য উল্লেখযোগ্য। তিনি বলেন-
“আদেশ-উপদেশ দেওয়ার উদ্দেশ্য যদি থাকে তার প্রতি কল্যাণকামনা আর সে লক্ষ্যেই তার অবস্থা (তার দোষত্রুটি) তুলে ধরা হয়, তবেই সে আদেশ-উপদেশ জায়েয। পক্ষান্তরে যদি উদ্দেশ্য হয় কেবলই তার নিন্দা করা, তার দোষ প্রকাশ করা ও তাকে কষ্ট দেওয়া, তবে তা জায়েয হবে না। কেননা শরী'আতের পক্ষ থেকে আদেশ হচ্ছে অপরাধীর দোষ গোপন করা, তাকে শিক্ষাদান করা ও উত্তম পন্থায় তাকে নসীহত করা। সুতরাং যতক্ষণ পর্যন্ত নম্র-কোমলতার দ্বারা এটা সম্ভব, ততক্ষণ পর্যন্ত তার প্রতি কঠোর আচরণ ও নিন্দা-ধিক্কারের পন্থা অবলম্বন জায়েয নয়। কেননা তা অনেক সময় তাকে আরও বেশি অন্যায়-অপরাধের প্রতি উস্কানি দেওয়ার এবং তার আপন কাজে জেদী হয়ে ওঠার কারণ হয়। কিছু মানুষ স্বভাবগতভাবেই আত্মাভিমানী হয়ে থাকে। বিশেষত যাকে আদেশ-উপদেশ দেওয়া হয়, আদেশদাতা যদি মর্যাদায় তার তুলনায় নিচে হয় (তখন নিন্দা-তিরস্কারে তার আত্মাভিমান জেগে ওঠে, ফলে সে তার কৃত অন্যায়-অপরাধে আরও জেদী হয়ে ওঠে)। ফাতহুল বারী, ১০ম খণ্ড, ৫৭২ নং পৃষ্ঠা।
আদেশ-উপদেশদাতার নিজ আমলেরও তদারকি করা উচিত। কেননা সে যদি মুত্তাকী-পরহেযগার হয় এবং তার আখলাক-চরিত্র উন্নত হয়, তখন তার মুখের কথা অপেক্ষা তার কর্ম ও চরিত্র দ্বারাই মানুষ আত্মসংশোধনে বেশি উৎসাহ পায় এবং তার বয়ান-বক্তব্য অপেক্ষা তার আমল-আখলাক দ্বারাই মানুষের উপকার বেশি হয়।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. এ হাদীছ দ্বারা ইসলামে কল্যাণকামিতার গুরুত্ব কত বেশি তা উপলব্ধি করা যায়। সুতরাং আমাদের প্রত্যেকের জন্য এ গুণের অধিকারী হওয়া অবশ্যকর্তব্য।
খ. এই হাদীছ দ্বারা এ শিক্ষাও পাওয়া যায় যে, কুরআন ও হাদীছের কোনও বিষয় ভালোভাবে বুঝে না আসলে যার তা ভালোভাবে জানা আছে তার কাছ থেকে জেনে নেওয়া চাই।
গ. আল্লাহর প্রতি ঈমান ও আনুগত্য প্রকাশের পাশাপাশি আল্লাহর কিতাবের হকসমূহ জেনে নিয়ে তা আদায়ে সচেষ্ট থাকা উচিত।
ঘ. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের আদব ও হকসমূহ ভালোভাবে জানা ও তা আদায় করাও প্রত্যেক মুসলিমের অবশ্যকর্তব্য।
ঙ. মুসলিম জাতির যারা নেতা হবে তাদের নিজেদের যেমন আপন দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন থাকা উচিত, তেমনি আমজনগণেরও কর্তব্য তাদের প্রতি কল্যাণকামিতার আচরণ করা।
চ. মুসলিম-সাধারণের প্রত্যেকের উচিত অন্যের প্রতি কল্যাণকামিতার আচরণ করা। তাদের মধ্যে শরী'আতপ্রদত্ত পারস্পরিক দায়িত্ব-কর্তব্য আছে। সেসব দায়িত্ব-কর্তব্য পালন করাও দীনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ।
সে গুরুত্বের প্রতি লক্ষ করেই বলা হয়ে থাকে, এ হাদীছের মধ্যে দীনের এক- চতুর্থাংশ শিক্ষা বিদ্যমান। ইমাম নববী রহ. বলেন, বরং এই একটি হাদীছই সমগ্র দীনের শিক্ষার সারমর্ম। তাঁর এ কথা যথার্থ। কেননা সমগ্র দীন মূলত আল্লাহ ও বান্দার হক আদায়ের সমষ্টির নাম। কল্যাণকামনা দ্বারা মূলত হক আদায়ের কথা বোঝানো উদ্দেশ্য। সে হিসেবে এ হাদীছে আল্লাহ তা'আলার হক, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের হক, মুসলিম জাতির ইমামদের হক এবং আমজনগণের হক আদায়ের তাকিদ করা হয়েছে। এঁদের সকলের হকের শিক্ষা রয়েছে আল্লাহর কিতাবে। এ হাদীছে আল্লাহ তা'আলার কিতাবের হক আদায়ের কথাও আছে। এভাবে দীনের যাবতীয় বিধি-বিধান পালনের নির্দেশ এ হাদীছের মধ্যে এসে গেছে। সুতরাং এটি সমগ্র দীনের শিক্ষার সারমর্মই বটে।
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন বললেন, দীন তো কল্যাণকামিতাই, তখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে, এর দ্বারা কার প্রতি কল্যাণকামিতা বোঝানো উদ্দেশ্য? এটা স্পষ্টভাবে বুঝে নেওয়া প্রয়োজন। অন্যথায় এর যথার্থ প্রয়োগ সম্ভব নয়। তাই উপস্থিত সাহাবায়ে কিরাম জিজ্ঞেস করলেন, কার প্রতি কল্যাণকামনা? নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম উত্তরে পাঁচ প্রকার কল্যাণকামনার কথা উল্লেখ করলেন। নিচে সে পাঁচ প্রকার কল্যাণকামনার সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা দেওয়া গেল।
১. আল্লাহর প্রতি কল্যাণকামিতা
সর্বপ্রথম বলা হয়েছে আল্লাহর প্রতি কল্যাণকামনার কথা। আল্লাহর প্রতি কল্যাণকামনা মানে আল্লাহ তা'আলার প্রতি বিশুদ্ধ আকীদা-বিশ্বাস পোষণ করা অর্থাৎ তাঁর অস্তিত্ব ও তাঁর একত্বে বিশ্বাস করা, কোনওকিছুকে তাঁর সঙ্গে শরীক না করা, তাঁর সিফাত ও গুণবাচক নামসমূহে বিশ্বাস রাখা এবং তা অস্বীকার ও তার ভুল ব্যাখ্যা হতে বিরত থাকা। যাবতীয় উৎকৃষ্ট গুণে তাঁর পরিপূর্ণতা এবং সর্বপ্রকার দোষত্রুটি থেকে তাঁর পবিত্রতা ঘোষণা করা।
এমনিভাবে আল্লাহ তা'আলার প্রতি কল্যাণকামিতা হচ্ছে প্রকাশ্যে ও আন্তরিকভাবে তাঁর প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করা ও তাঁর অবাধ্যতা হতে বিরত থাকা, তাঁর জন্যই কাউকে ভালোবাসা ও তাঁর জন্যই কারও প্রতি শত্রুতা পোষণ করা, তাঁর বন্ধুকে বন্ধু জানা ও তাঁর শত্রুকে শত্রু গণ্য করা, তাঁর শত্রুদের বিরুদ্ধে কার্যত জিহাদ করা বা জিহাদের নিয়ত রাখা, তাঁর যাবতীয় অনুগ্রহ স্বীকার করা ও নি'আমতসমূহের শোকর আদায় করা, তাঁর ইবাদত-বন্দেগীতে অন্তরে ইখলাস বজায় রাখা, তাঁর আদেশসমূহ পালনের ক্ষেত্রে তাঁর ঘোষিত পুরস্কারের আশা রাখা, তাঁর অবাধ্যতার ক্ষেত্রে তাঁর শাস্তির ভয় রাখা।
এ যা-কিছু বলা হল, এর প্রতি মানুষকে দাওয়াত দেওয়া, মানুষকে এর প্রতি উৎসাহী করে তোলার ব্যবস্থা নেওয়া, তাদেরকে এর শিক্ষাদান করা এবং এ লক্ষ্যে তাদের প্রতি নম্র-কোমল ব্যবহার করাও আল্লাহর প্রতি কল্যাণকামিতার অন্তর্ভুক্ত।
হযরত আলী রাযি. থেকে বর্ণিত আছে যে, হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের শিষ্যগণ তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিল, আল্লাহর প্রতি কল্যাণকামী কে? তিনি বলেছিলেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর হককে মানুষের হকের ওপর প্রাধান্য দেয়।
প্রকাশ থাকে যে, আল্লাহ তা'আলা কারও প্রতি ঠেকা নন। তিনি সর্বপ্রকার অভাব ও কমতি থেকে মুক্ত-পবিত্র। সুতরাং তাঁর প্রতি প্রকৃত অর্থে কারও কল্যাণকামনার প্রশ্নই আসে না। তাঁর প্রতি কল্যাণকামনা হিসেবে যে কাজগুলোর কথা উল্লেখ করা হল, তার সুফল মূলত বান্দা নিজেই লাভ করে। সে হিসেবে কল্যাণকামনা আল্লাহর প্রতি নয়; বরং বান্দার নিজের প্রতি। তা সত্ত্বেও হাদীছে যে একে "আল্লাহর কল্যাণকামনা' শব্দে ব্যক্ত করা হয়েছে, এটা বান্দার প্রতি আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ। হাদীছের কথা মূলত আল্লাহরই কথা। সুতরাং বান্দার প্রতি মহব্বত ও অনুগ্রহবশত আল্লাহ তা'আলা বান্দার নিজের প্রতি নিজ কল্যাণকামনাকে আল্লাহর প্রতি কল্যাণকামনা বলে অভিহিত করেছেন। সুবহানাল্লাহ! তিনি কতই না মহানুভব এবং কত উচ্চ তাঁর গুণগ্রাহিতা। এর দৃষ্টান্ত হচ্ছে কুরআন মাজীদের এ আয়াত-
ولَيَنْصُرَنَّ الله مَنْ يَنصُرُهُ
আল্লাহ তাআলা অবশ্যই তার সাহায্য করবেন, যে তাঁর সাহায্য করবে। সুরা হজ্জ (২২), আয়াত ৪০
এ মর্মে আরও একাধিক আয়াত আছে, যাতে আল্লাহর দীনের সাহায্য করাকে আল্লাহর সাহায্য সাব্যস্ত করা হয়েছে। দীন মানুষেরই জন্য। কাজেই দীনের সাহায্য করার দ্বারা প্রকৃতপক্ষে নিজেরই সাহায্য করা হয়। তা সত্ত্বেও আল্লাহ তা'আলা আপন অনুগ্রহে বান্দার কাজের মর্যাদা দানের লক্ষ্যে সে সাহায্যকে আল্লাহর সাহায্য বলে প্রকাশ করেছেন।
২. আল্লাহর কিতাবের প্রতি কল্যাণকামিতা
আল্লাহর কিতাবের প্রতি কল্যাণকামিতার অর্থ প্রথমত এর প্রতি ঈমান আনা যে, এটা আল্লাহর কিতাব ও তাঁর বাণী। তিনিই এ কিতাব নাযিল করেছেন। এটা কোনও মানুষের কথা নয়। কোনও মানুষের পক্ষে এরকম কথা বলা সম্ভব নয়। দুনিয়ার সমস্ত মানুষ মিলেও যদি চেষ্টা করে, তবে এর ছোট্ট একটি সূরার মত সূরাও বানাতে পারবে না। তারপর অন্তরে এ কিতাবের প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধা লালন করা, এর শিক্ষা গ্রহণ করা ও শিক্ষা দান করা, এর তিলাওয়াত করা ও অর্থ বোঝার চেষ্টা করা এবং এর মধ্যে তাদাব্বুর ও চিন্তাভাবনা করে আপন আপন সামর্থ্য অনুযায়ী এর অন্তহীন জ্ঞানরাশি থেকে যতদূর সম্ভব আহরণে যত্নবান থাকা। তারপর এর উপদেশ গ্রহণ করা ও এর শিক্ষা অনুযায়ী আমল করা। তারপর এর প্রচার-প্রসারে ভূমিকা রাখা, ব্যক্তিজীবন ও সমাজজীবনে এর বিধানাবলী বাস্তবায়নের চেষ্টা করা এবং সর্বপ্রকার অপব্যাখ্যা থেকে তার হেফাজত করা।
৩. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি কল্যাণকামিতা
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি কল্যাণকামিতার অর্থ প্রথমত তাঁর প্রতি এ বিশ্বাস রাখা যে, তিনি আল্লাহর প্রেরিত সর্বশেষ নবী। কিয়ামত পর্যন্ত সমস্ত মানুষের হিদায়াতের জন্য তাঁকে পাঠানো হয়েছে। তারপর যথার্থ ভক্তি-শ্রদ্ধার সাথে তাঁর প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করা, তাঁর আদেশ-নিষেধ মেনে চলা, আল্লাহ তা'আলার মহব্বত ও ভালোবাসা পাওয়ার লক্ষ্যে তাঁর পরিপূর্ণ অনুসরণ করা, তাঁর জীবদ্দশায় এবং তাঁর ওফাতের পর তাঁকে সাহায্য-সহযোগিতা করা, তাঁর সুন্নত ও জীবনাদর্শ শেখা ও শিক্ষাদান করা, তাঁর রেখে যাওয়া দীনের প্রতি মানুষকে দাওয়াত দেওয়া এবং সর্বত্র তার প্রচার ও প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখা।
এমনিভাবে নবীর আহলে বাইত ও সাহাবায়ে কিরামকে ভালোবাসা, যে-কোনও সাহাবীর নিন্দা ও সমালোচনা থেকে বিরত থাকা; বরং তাদের নিন্দাকারী এবং বিদ'আত ও বিদ'আতপন্থীদের প্রতি ঘৃণা ও অশ্রদ্ধা পোষণ করা এ কল্যাণকামিতার অতি গুরুত্বপূর্ণ দিক।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি কল্যাণকামিতার একটা অংশ এইও যে, তাঁর ওয়ারিশ তথা উলামায়ে কিরামের প্রতি মহব্বত রাখা হবে, তাদের কাছ থেকে দীনের শিক্ষা গ্রহণ করা হবে, দীনের বহুমুখী খেদমতে ঐকান্তিকভাবে তাদের সহযোগিতা করা হবে এবং দীনের প্রচার ও প্রতিষ্ঠায় তাদের দিকনির্দেশনা গ্রহণ করা হবে।
মুসলিম নেতৃবর্গের প্রতি কল্যাণকামিতা
এ হাদীছে মুসলিমদের ইমাম বলতে তাদের নেতৃবর্গকে বোঝানো হয়েছে। তাদের প্রতি কল্যাণকামিতার অর্থ তাদের প্রতি অর্পিত দায়-দায়িত্ব যাতে তারা যথাযথভাবে আঞ্জাম দিতে পারে সে ব্যাপারে তাদের সাহায্য-সহযোগিতা করা, তাদের দ্বারা কোনও ভুলত্রুটি হয়ে গেলে সে ব্যাপারে তাদের সতর্ক করা, তাদের নেতৃত্বে সকলের ঐক্যবদ্ধ থাকা, তাদের বিরুদ্ধাচারীদেরকে তাদের প্রতি অনুগত করে তোলার চেষ্টা করা এবং উত্তম পন্থায় তাদেরকে জনগণের প্রতি জুলুম-অত্যাচার করা থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করা।
ইমাম ও নেতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ না করা; বরং তার বিরুদ্ধে কোথাও বিদ্রোহ হলে যদি তা দমনের জন্য ডাক দেওয়া হয়, তবে তাতে সাড়া দেওয়াও তাদের কল্যাণকামিতার অন্তর্ভুক্ত। সক্ষম ও সামর্থ্যবান ব্যক্তিদের এ ক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকার সুযোগ নেই। কেননা যে কাজে আল্লাহর নাফরমানী হয় না এবং তা জনগণের স্বার্থবিরোধী ও শাসকের স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে না হয়, সে কাজে ইমামের আনুগত্য করা ফরয।
আমজনগণের প্রতি কল্যাণকামিতা
আমজনগণের প্রতি কল্যাণকামিতার অর্থ তাদের প্রতি মমত্ব প্রদর্শন করা, তাদেরকে কল্যাণকর বিষয় শেখানো, দীন ও দুনিয়ার উপকারী বিষয়ে তাদের সাহায্য-সহযোগিতা করা, তাদেরকে কষ্টদান থেকে বিরত থাকা, তাদের জান-মাল ও ইজ্জতের কোনও প্রকার ক্ষতিসাধন না করা, বরং তার হেফাজতে ভূমিকা রাখা। মোটকথা, তাদের দীনী ও দুনিয়াবী সর্বপ্রকার হক আদায়ে যত্নবান থাকা, কোনওভাবেই তাদের কোনও অধিকার ক্ষুণ্ণ না করা এবং নিজের জন্য যা পসন্দ করা হয় তাদের জন্যও তা পসন্দ করা আর নিজের জন্য যা অপসন্দ করা হয় তাদের জন্যও তা অপসন্দ করা।
আমীর ও শাসক এবং আমজনগণের কল্যাণকামিতার একটা অংশ হচ্ছে তাদেরকে সদুপদেশ দেওয়া। তাদের দ্বারা আল্লাহর হক ও বান্দার হক আদায়ে গড়িমসি হলে কিংবা তাদেরকে কোনও অন্যায়-অসৎকর্মে লিপ্ত দেখতে পেলে তখন ইখলাস ও আন্তরিকতার সঙ্গে তাদেরকে সদুপদেশ দেওয়া ও সংশোধনের চেষ্টা করাই তাদের প্রতি শ্রেষ্ঠতম কল্যাণকামিতা। এ ক্ষেত্রে উপদেশদান ও সংশোধন চেষ্টার রীতিনীতি রক্ষা করাও জরুরি, অন্যথায় উপকারের চেয়ে ক্ষতি বেশি হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এ প্রসঙ্গে ইমাম ইবন হাজার আসকালানী রহ.-এর বক্তব্য উল্লেখযোগ্য। তিনি বলেন-
“আদেশ-উপদেশ দেওয়ার উদ্দেশ্য যদি থাকে তার প্রতি কল্যাণকামনা আর সে লক্ষ্যেই তার অবস্থা (তার দোষত্রুটি) তুলে ধরা হয়, তবেই সে আদেশ-উপদেশ জায়েয। পক্ষান্তরে যদি উদ্দেশ্য হয় কেবলই তার নিন্দা করা, তার দোষ প্রকাশ করা ও তাকে কষ্ট দেওয়া, তবে তা জায়েয হবে না। কেননা শরী'আতের পক্ষ থেকে আদেশ হচ্ছে অপরাধীর দোষ গোপন করা, তাকে শিক্ষাদান করা ও উত্তম পন্থায় তাকে নসীহত করা। সুতরাং যতক্ষণ পর্যন্ত নম্র-কোমলতার দ্বারা এটা সম্ভব, ততক্ষণ পর্যন্ত তার প্রতি কঠোর আচরণ ও নিন্দা-ধিক্কারের পন্থা অবলম্বন জায়েয নয়। কেননা তা অনেক সময় তাকে আরও বেশি অন্যায়-অপরাধের প্রতি উস্কানি দেওয়ার এবং তার আপন কাজে জেদী হয়ে ওঠার কারণ হয়। কিছু মানুষ স্বভাবগতভাবেই আত্মাভিমানী হয়ে থাকে। বিশেষত যাকে আদেশ-উপদেশ দেওয়া হয়, আদেশদাতা যদি মর্যাদায় তার তুলনায় নিচে হয় (তখন নিন্দা-তিরস্কারে তার আত্মাভিমান জেগে ওঠে, ফলে সে তার কৃত অন্যায়-অপরাধে আরও জেদী হয়ে ওঠে)। ফাতহুল বারী, ১০ম খণ্ড, ৫৭২ নং পৃষ্ঠা।
আদেশ-উপদেশদাতার নিজ আমলেরও তদারকি করা উচিত। কেননা সে যদি মুত্তাকী-পরহেযগার হয় এবং তার আখলাক-চরিত্র উন্নত হয়, তখন তার মুখের কথা অপেক্ষা তার কর্ম ও চরিত্র দ্বারাই মানুষ আত্মসংশোধনে বেশি উৎসাহ পায় এবং তার বয়ান-বক্তব্য অপেক্ষা তার আমল-আখলাক দ্বারাই মানুষের উপকার বেশি হয়।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. এ হাদীছ দ্বারা ইসলামে কল্যাণকামিতার গুরুত্ব কত বেশি তা উপলব্ধি করা যায়। সুতরাং আমাদের প্রত্যেকের জন্য এ গুণের অধিকারী হওয়া অবশ্যকর্তব্য।
খ. এই হাদীছ দ্বারা এ শিক্ষাও পাওয়া যায় যে, কুরআন ও হাদীছের কোনও বিষয় ভালোভাবে বুঝে না আসলে যার তা ভালোভাবে জানা আছে তার কাছ থেকে জেনে নেওয়া চাই।
গ. আল্লাহর প্রতি ঈমান ও আনুগত্য প্রকাশের পাশাপাশি আল্লাহর কিতাবের হকসমূহ জেনে নিয়ে তা আদায়ে সচেষ্ট থাকা উচিত।
ঘ. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের আদব ও হকসমূহ ভালোভাবে জানা ও তা আদায় করাও প্রত্যেক মুসলিমের অবশ্যকর্তব্য।
ঙ. মুসলিম জাতির যারা নেতা হবে তাদের নিজেদের যেমন আপন দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন থাকা উচিত, তেমনি আমজনগণেরও কর্তব্য তাদের প্রতি কল্যাণকামিতার আচরণ করা।
চ. মুসলিম-সাধারণের প্রত্যেকের উচিত অন্যের প্রতি কল্যাণকামিতার আচরণ করা। তাদের মধ্যে শরী'আতপ্রদত্ত পারস্পরিক দায়িত্ব-কর্তব্য আছে। সেসব দায়িত্ব-কর্তব্য পালন করাও দীনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)


বর্ণনাকারী: