রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ
ভূমিকা অধ্যায়
হাদীস নং: ১৭৭
নেককাজ ও তাকওয়া-পরহেযগারীতে পারস্পরিক সাহায্য-সহযোগিতা
মানুষ সমাজবদ্ধ জীব হওয়ায় একে অন্যের সাহায্যের মুখাপেক্ষী। অন্যের সাহায্য ছাড়া কারও পক্ষেই ইহজীবন যাপন করা সম্ভব নয়। তাই মানুষ প্রয়োজনে অন্যের সাহায্য চায়। যার কাছে সাহায্য চায় সে নিজ চিন্তা-ভাবনা ও শক্তি-সামর্থ্য অনুযায়ী কখনও তার সাহায্য করে আবার কখনও করে না। আবার তারও নিজ প্রয়োজনে অন্যের কাছে সাহায্যের আবেদন জানাতে হয়। তার সে আবেদনও কখনও শোনা হয়, কখনও শোনা হয় না। আবার কখনও মানুষ স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে অন্যের সাহায্যে এগিয়ে আসে।
এসকল ক্ষেত্রেই বিশুদ্ধ দিকনির্দেশনা প্রয়োজন। কারণ মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি ও রুচি-অভিরুচি বিচিত্র। তার মধ্যে সৎস্বভাব ও অসৎস্বভাব দুই-ই আছে। কখনও মন্দ স্বভাবে তাড়িত হয়ে এমন কাজ করতে চায়, যা তার নিজের জন্যও ক্ষতিকর এবং অন্যের জন্যও ক্ষতিকর। কখনও সে ক্ষতি নিজে বুঝতে পারে, আবার কখনও পারেও না। তা সত্ত্বেও সে কাজটি সম্পন্ন করতে চায় এবং তা করার জন্য অন্যের সাহায্যপ্রার্থী হয়। যার কাছে সাহায্যপ্রার্থী হয়, একইরকম ভালোমন্দ স্বভাব তার মধ্যেও আছে। সে যদি আপন স্বভাবের তাড়নায় তার সাহায্য করে বসে আর এভাবে কাজটি সম্পন্ন হয়ে যায়, তবে সে কাজটির কর্তা সম্ভাব্য ক্ষতির শিকার হয়ে যায়। ক্ষতির শিকার হয় অন্যরাও। যে ব্যক্তি সাহায্য করল, এ ক্ষতির দায় তার ওপরও বর্তায়, যেহেতু তার সাহায্যেই কাজটি সম্পন্ন হতে পেরেছে।
আবার অনেক সময় মানুষের মধ্যে কোনও ভালো কাজের ইচ্ছা জাগে, কিন্তু কাজটি সম্পন্ন করার ক্ষমতা তার থাকে না। এ অবস্থায় সে যদি কারও কাছে সাহায্য চায় আর সে তাকে সাহায্য করে, তবে তো কাজটি সম্পন্ন হয়ে যায়। পক্ষান্তরে সে সাহায্যের হাত না বাড়ালে কাজটি সম্পন্ন হতে পারে না। এভাবে একটি নেককাজের সদিচ্ছা অন্যের সাহায্যের অভাবে অপূর্ণ থেকে যায়।
তো দেখা যাচ্ছে যেমন সদিচ্ছা পূরণের জন্য অন্যের সাহায্য প্রয়োজন, তেমনি অন্যের অসদিচ্ছা যাতে পূরণ না হতে পারে সেজন্য তার সাহায্য করা হতে বিরত থাকা জরুরি। কিন্তু কোন্টা সৎ কোন্টা অসৎ তা স্পষ্ট না থাকলে সাহায্য করা বা না করার ক্ষেত্রে মানুষের বিভ্রান্ত হওয়া খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু তা স্পষ্ট করবে কে? মানুষ নিজে যেহেতু ভালোমন্দ উভয় স্বভাব ধারণ করে, তাই তার পক্ষে সৎ ও অসৎ নির্ণয় করে দেওয়া সম্ভব নয় । এটা নির্ণয় করা সম্ভব কেবল মানুষের সৃষ্টিকর্তার পক্ষে। সুতরাং তিনি তা করেও দিয়েছেন। এ সম্পর্কে কুরআন ও সুন্নাহে সুস্পষ্ট নির্দেশনা দিয়ে দেওয়া হয়েছে।
নেককাজ ও তাকওয়া-পরহেযগারীতে পারস্পরিক
সাহায্য-সহযোগিতা সম্পর্কিত কিছু আয়াত
এক নং আয়াত
وَتَعَاوَنُوا عَلَى الْبِرِّ وَالتَّقْوَى
অর্থ : তোমরা সৎকর্ম ও তাকওয়ার ক্ষেত্রে একে অন্যকে সহযোগিতা করবে।সূরা মায়িদা (৫), আয়াত ২
ব্যাখ্যা
الْبِرِّ বলা হয় ওই সকল কাজকে, শরী'আতের পক্ষ থেকে যা করতে আদেশ করা হয়েছে। আর التَّقْوَى হল ওই সকল কাজ থেকে বিরত থাকা, যা করতে নিষেধ করা হয়েছে। শরী'আতের যাবতীয় বিষয় এর মধ্যে এসে গেছে। এতে আমাদেরকে আদেশ করা হয়েছে, আমরা যেন করণীয় ও বর্জনীয় যাবতীয় বিষয়ে একে অন্যকে সাহায্য করি। অর্থাৎ বান্দার কর্তব্য কেবল সে কাজই করা, যা করার অনুমতি শরী'আতের পক্ষ থেকে দেওয়া হয়েছে। এমনিভাবে বান্দার কর্তব্য ওই সকল কাজ থেকে অবশ্যই বিরত থাকা, যা করতে শরী'আত তাকে নিষেধ করেছে। আর এভাবে প্রত্যেকে যাতে করণীয় কাজ সম্পাদন করতে ও বর্জনীয় কাজ পরিহার করতে সক্ষম হয়, সেজন্য অন্যদের কর্তব্য তাকে সাহায্য-সহযোগিতা করা। এ সাহায্য হয় শিক্ষাদান দ্বারা। অর্থাৎ কোন কাজ শরী'আতে অনুমোদিত এবং কোন্ কাজ অনুমোদিত নয় তা শেখানো। এমনিভাবে সাহায্য করা যায় নেক আমলের প্রতি উৎসাহ দেওয়ার দ্বারা এবং মন্দ আমলের দুনিয়াবী ও পরকালীন ক্ষতি সম্পর্কে সতর্ক করার দ্বারা। কারও আমলের পক্ষে যা-কিছু বাধা হয় তা অপসারণ দ্বারাও অন্যের সাহায্য করা যায়।
এ আয়াতে একে অন্যকে সাহায্য করতে বলা হয়েছে কেবল নেককাজ ও তাকওয়া- পরহেযগারীতে। সুতরাং নির্দেশনা পাওয়া গেল যে, কোনও কাজ সম্পন্ন করতে সাহায্য কেবল তখনই করা যাবে, যখন সে কাজটি শরী'আত মোতাবেক হবে। যদি তা শরী'আত মোতাবেক না হয় তবে কোনও অবস্থাতেই সে কাজে সাহায্য করা যাবে না, তাতে সাহায্যপ্রার্থী যত আপন লোকই হোক না কেন। এমনিভাবে শরী'আতবিরোধী কাজ থেকে বিরত থাকাও যেহেতু একটি নেককাজ ও পরহেযগারী, তাই তা থেকে বিরত থাকার ব্যাপারেও অন্যের সাহায্য করাও এ আয়াতের দাবি।
যেহেতু এ আয়াতে নেককাজ ও তাকওয়া-পরহেযগারীতে একে অন্যকে সাহায্য করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, তাই আপন আপন শক্তি ও ক্ষমতা অনুযায়ী এটা করা প্রত্যেকের জন্য অবশ্যকর্তব্য।
দুই নং আয়াত
وَالْعَصْرِ (1) إِنَّ الْإِنْسَانَ لَفِي خُسْرٍ (2) إِلَّا الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ وَتَوَاصَوْا بِالْحَقِّ وَتَوَاصَوْا بِالصَّبْرِ (3)
অর্থ : কালের শপথ! বস্তুত মানুষ অতি ক্ষতির মধ্যে আছে। তারা ব্যতীত, যারা ঈমান আনে, সৎকর্ম করে এবং একে অন্যকে সত্যের উপদেশ দেয় ও একে অন্যকে সবরের উপদেশ দেয়। সূরা 'আসর (১০৩), আয়াত ১-৩
ব্যাখ্যা
এ সূরায় কালের শপথ করে বলা হয়েছে সমস্ত মানুষ ক্ষতির মধ্যে আছে। কালের শপথ দ্বারা কালের গুরুত্ব ও মূল্যের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। কালই মানবজীবনের মূল পুঁজি। মানুষ মহাকালের সুনির্দিষ্ট একটা সময় নিয়ে পৃথিবীতে আসে। প্রত্যেকের আয়ু নির্ধারিত। তার সে নির্ধারিত আয়ু শেষ হলে দুনিয়া থেকে চিরবিদায় হবে, তার একমুহূর্ত আগেও নয় পরেও নয়। মৃত্যুর পর কবরের জীবন, তারপর হাশরের ময়দান, তারপর জান্নাত বা জাহান্নাম, সবকিছুর ফয়সালা নির্ভর করে দুনিয়ার নির্দিষ্ট আয়ু ব্যবহারের ওপর। যে ব্যক্তি তার জীবনের আয়ু ভালো কাজে ব্যবহার করবে, তার ফয়সালা হবে সন্তোষজনক। সে কবরে শান্তি পাবে, হাশরে নিরাপদ থাকবে, তারপর জাহান্নাম থেকে মুক্তি পেয়ে জান্নাতবাসী হবে। এটাই মানবজীবনের পরম সফলতা। ইরশাদ হয়েছে-
فَمَنْ زُحْزِحَ عَنِ النَّارِ وَأُدْخِلَ الْجَنَّةَ فَقَدْ فَازَ وَمَا الْحَيَاةُ الدُّنْيَا إِلَّا مَتَاعُ الْغُرُورِ (185)
অতঃপর যাকেই জাহান্নাম থেকে দূরে সরিয়ে দেওয়া হবে ও জান্নাতে প্রবেশ করিয়ে দেওয়া হবে, সে-ই প্রকৃত অর্থে সফলকাম হবে। আর (জান্নাতের বিপরীতে) পার্থিব জীবন তো প্রতারণার উপকরণ ছাড়া কিছুই নয়।সূরা আলে-ইমরান (৩), আয়াত ১৮৫
ব্যক্তি তার আয়ুষ্কালকে ভালো কাজে ব্যবহার করলে তার ব্যক্তিগত জীবন সফল হয়। যদি সমাজ ও সমষ্টি তাদের জীবনায়ু ভালো কাজে ব্যবহার করে, তবে সমষ্টির জীবন সফল হয়। জাতীয় জীবনের উন্নতি-অগ্রগতি সময়ের সদ্ব্যবহারের ওপর নির্ভর করে। গোটা মানবসভ্যতার ইতিহাস এবং ইতিহাসের যত উত্থান-পতন তা সময়ের সদ্ব্যবহার বা অসদ্ব্যবহারেরই অনিবার্য ফল মাত্র। সুতরাং সময়ের ব্যবহারে ব্যক্তিগত সচেতনতার পাশাপাশি সমষ্টিগত সচেতনতাও অতীব জরুরি। 'কালের শপথ' সেদিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
কালের শপথ করার পর বলা হয়েছে, সমস্ত মানুষ ক্ষতি ও লোকসানের মধ্যে আছে। এর দ্বারা মানুষকে একজন ব্যবসায়ী এবং তার আয়ুকে মূলধনের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। ব্যবসায়ী তার ব্যবসায়ে মূলধন খাটায় মুনাফার আশায়। মুনাফা না হওয়াই লোকসান। তাতে করে ক্রমান্বয়ে মূলধন হ্রাস পেতে থাকে। একপর্যায়ে সে চরম লোকসানের শিকার হয় এবং তার মূলধন শেষ হয়ে যায়। অনুরূপ মানুষের আয়ু তার ছাওয়াব ও পুণ্য লাভের মূলধন। সে যদি তার মুহূর্তগুলোকে পুণ্যার্জনে ব্যয় না করে, তবে লোকসান বাড়তেই থাকে। কেননা আয়ু দমে দমে কমতে থাকে। একপর্যায়ে গোটা আয়ু নিঃশেষ হয়ে যায়, কিন্তু আমলনামায় পুণ্য জমা থাকে না। মানুষের জন্য এরচে' বড় ক্ষতি আর কী হতে পারে? অধিকাংশ মানুষ চরম উদাসীনতার ভেতর জীবন কাটায়। দুনিয়ার ভোগ-উপভোগে মত্ত থেকে তার পরমায়ু বরবাদ করে দেয়। পরিশেষে যখন মৃত্যু হানা দেয় তখন আক্ষেপ করে বলতে থাকে, আমাকে একটুখানি সময় দেওয়া হোক। আমি নিজেকে সংশোধন করে ফেলব। কিন্তু ওই আক্ষেপ কোনও কাজের নয়। প্রত্যেকের উচিত সেই দিন আসার আগে আগে এখনই সময়ের সদ্ব্যবহার করা এবং এ মহামূল্যবান পুঁজির বিনিময়ে যতবেশি সম্ভব পুণ্যের মুনাফা অর্জন করে নেওয়া।
এ আয়াতে সকল মানুষকেই লোকসানগ্রস্ত বলা হয়েছে। অতঃপর এমন কয়েকটি গুণের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, যে গুণগুলো যাদের অর্জন হয়ে যায় তারা ব্যতিক্রম মানুষ। অর্থাৎ তারা লোকসানগ্রস্ত নয়। গুণগুলো হচ্ছে যথাক্রমে- ঈমান আমলে সালিহ, পারস্পরিক সত্যের উপদেশ ও ধৈর্যের উপদেশ।
ঈমান দ্বারা বোঝানো উদ্দেশ্য আল্লাহর অস্তিত্ব, তাঁর একত্বে বিশ্বাস, আখিরাতে বিশ্বাস ও রাসূলের প্রতি বিশ্বাসসহ এমন যাবতীয় বিষয় মেনে নেওয়া, যা আখিরী নবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদেরকে শিক্ষা দিয়েছেন। সেইসঙ্গে এই বিশ্বাস রাখা যে, কিয়ামত পর্যন্ত সমস্ত মানুষের দুনিয়ার সুখ-শান্তি ও আখিরাতের মুক্তি তাঁর নিয়ে আসা দীনের অনুসরণের মধ্যেই নিহিত। এর কোনও বিকল্প নেই, যেহেতু তিনি সর্বশেষ নবী, তাঁর পর আর কোনও নবীও নেই, কোনও কিতাবও নেই।
এই ঈমান ও বিশ্বাসের দাবি হচ্ছে আমলে সালিহে লিপ্ত থাকা। অর্থাৎ বিশ্বাসকে কেবল অন্তরের মধ্যে লালন করে রাখাই যথেষ্ট নয়, বরং তাকে কার্যে পরিণত করতে হবে। ব্যক্তির যাবতীয় কাজকর্ম ওই বিশ্বাসের আলোকে সম্পাদিত হতে হবে। শরী'আত হচ্ছে তার রূপরেখা। শরী'আতে যে কাজ অনুমোদিত তা করা এবং যা অনুমোদিত নয় তা থেকে বিরত থাকাই হচ্ছে আমলে সালিহ বা সৎকর্ম। জীবনকে লোকসান থেকে বাঁচানোর দ্বিতীয় শর্ত এই আমলে সালিহে লিপ্ত থাকা।
তৃতীয় গুণ হল সত্যের উপদেশ দেওয়া। অর্থাৎ কেবল ব্যক্তিগত সৎকর্মে সন্তুষ্ট থাকাই যথেষ্ট নয়; বরং অন্যকে লোকসান থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করাও জরুরি। প্রত্যেককেই নিজ দীনদারী হেফাজতের পাশাপাশি লক্ষ রাখতে হবে তার আওতাভুক্ত কেউ সত্যদীন থেকে কোনওভাবে বিচ্যুত হচ্ছে কি না। যদি বিচ্যুত হয়ে থাকে তবে তার সংশোধনে সচেষ্ট থাকতে হবে। সর্বদা নিজ আওতাভুক্ত প্রত্যেকের জন্য সদুপোদেশ জারি রাখতে হবে, যাতে তারা সত্যদীনে প্রতিষ্ঠিত থাকে।
লোকসান থেকে বাঁচার জন্য চতুর্থ অপরিহার্য গুণ হচ্ছে একে অন্যকে উপদেশ দেওয়া, যাতে সর্বাবস্থায় সবর ও ধৈর্য রক্ষা করে চলে। ধৈর্য রক্ষা করতে হবে যেমন শরী'আতের যাবতীয় আদেশ মেনে চলার ব্যাপারে, তেমনি শরী'আত যা-কিছু নিষিদ্ধ করেছে তা থেকে বেঁচে থাকার ব্যাপারেও। এমনিভাবে ধৈর্য রক্ষা করতে হবে আপতিত সকল বিপদাপদেও।
প্রকাশ থাকে যে, হক ও সবরের উপদেশদান যেমন কোনও মওসুমী কাজ নয় তেমনি নয় এটা ব্যক্তি বা দলবিশেষের দায়িত্বও। বরং এটা প্রত্যেক মুমিনের সবসময়কার যিম্মাদারী। অর্থাৎ যখনই যার সামনে কারো দ্বারা হক ও সবর পরিপন্থি কিছু ঘটবে তখনই সে তাকে হকের দিকে ফিরে আসার ও সবর অবলম্বনের উপদেশ দেবে। স্বামী তার স্ত্রীকে, স্ত্রী তার স্বামীকে, পিতা তার সন্তানকে, ভাই তার ভাইকে, এক প্রতিবেশী অপর প্রতিবেশীকে, এক বন্ধু অপর বন্ধুকে, এক পথিক অপর পথিককে, মোটকথা প্রতি দুইজনের একজন অপরজনকে যখনই পরিস্থিতি দেখা দেয় তখনই এ উপদেশ প্রদান করবে। এমনকি পরিস্থিতি ছাড়াও স্বাভাবিক অবস্থায়ও পারস্পরিক উপদেশদান অব্যাহত রাখা চাই। এ সূরা আমাদেরকে ক্ষতি থেকে বাঁচার জন্য এ ব্যবস্থাই অবলম্বন করতে বলেছে।
মোটকথা, যে ব্যক্তি এ সূরায় বর্ণিত চারটি গুণ অর্জন করতে সক্ষম হবে সে লোকসান থেকে বেঁচে যাবে। কেননা এর মাধ্যামে তার জীবনের মুহূর্তগুলো নেককাজে ব্যয় হবে। প্রতি মুহূর্তের বিনিময়ে তার আমলনামায় নেকী লেখা হতে থাকবে। ফলে তার পরমায়ু নিঃশেষ হবে বটে, কিন্তু সে একরকম অমরত্ব লাভ করবে। কেননা পারস্পরিক সত্য ও সবরের উপদেশদানের মাধ্যমে তার দ্বারা যে নেক আমলের প্রবাহ চালু হবে তা কিয়ামত পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে। ফলে মৃত্যুর পরও তার আমলনামায় নেকী লেখা জারি থাকবে। অসম্ভব নয় যে, দুনিয়ায় ও কিয়ামত পর্যন্ত মানুষের মুখে মুখে তার সুনাম-সুখ্যাতির চর্চা অব্যাহত থাকবে। এমন কত শত মানুষ আছে, যারা দুনিয়া থেকে চলে গেছেন কিন্তু মানুষ তাদের ভোলেনি। সত্য ও সবরের পথে মানুষকে প্রতিষ্ঠিত রাখার বহুমুখী মেহনতের কারণে তারা ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে আছে।
এটি অতি ছোট্ট একটি সূরা, কিন্তু বিপুল তাৎপর্যে ভরা। এ যেন সমগ্র দীনের সারকথা। তাই তো ইমাম শাফি'ঈ রহ. বলেন, যদি এই একটি মাত্র সূরাই নাযিল করা হত, তবে (সমঝদার ব্যক্তিদের জন্য) হিদায়াত হিসেবে যথেষ্ট হত। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ এ সূরাটির ব্যাপারে উদাসীন। তারা এর বিষয়বস্তুর মধ্যে চিন্তা করে না।
মানুষ সমাজবদ্ধ জীব হওয়ায় একে অন্যের সাহায্যের মুখাপেক্ষী। অন্যের সাহায্য ছাড়া কারও পক্ষেই ইহজীবন যাপন করা সম্ভব নয়। তাই মানুষ প্রয়োজনে অন্যের সাহায্য চায়। যার কাছে সাহায্য চায় সে নিজ চিন্তা-ভাবনা ও শক্তি-সামর্থ্য অনুযায়ী কখনও তার সাহায্য করে আবার কখনও করে না। আবার তারও নিজ প্রয়োজনে অন্যের কাছে সাহায্যের আবেদন জানাতে হয়। তার সে আবেদনও কখনও শোনা হয়, কখনও শোনা হয় না। আবার কখনও মানুষ স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে অন্যের সাহায্যে এগিয়ে আসে।
এসকল ক্ষেত্রেই বিশুদ্ধ দিকনির্দেশনা প্রয়োজন। কারণ মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি ও রুচি-অভিরুচি বিচিত্র। তার মধ্যে সৎস্বভাব ও অসৎস্বভাব দুই-ই আছে। কখনও মন্দ স্বভাবে তাড়িত হয়ে এমন কাজ করতে চায়, যা তার নিজের জন্যও ক্ষতিকর এবং অন্যের জন্যও ক্ষতিকর। কখনও সে ক্ষতি নিজে বুঝতে পারে, আবার কখনও পারেও না। তা সত্ত্বেও সে কাজটি সম্পন্ন করতে চায় এবং তা করার জন্য অন্যের সাহায্যপ্রার্থী হয়। যার কাছে সাহায্যপ্রার্থী হয়, একইরকম ভালোমন্দ স্বভাব তার মধ্যেও আছে। সে যদি আপন স্বভাবের তাড়নায় তার সাহায্য করে বসে আর এভাবে কাজটি সম্পন্ন হয়ে যায়, তবে সে কাজটির কর্তা সম্ভাব্য ক্ষতির শিকার হয়ে যায়। ক্ষতির শিকার হয় অন্যরাও। যে ব্যক্তি সাহায্য করল, এ ক্ষতির দায় তার ওপরও বর্তায়, যেহেতু তার সাহায্যেই কাজটি সম্পন্ন হতে পেরেছে।
আবার অনেক সময় মানুষের মধ্যে কোনও ভালো কাজের ইচ্ছা জাগে, কিন্তু কাজটি সম্পন্ন করার ক্ষমতা তার থাকে না। এ অবস্থায় সে যদি কারও কাছে সাহায্য চায় আর সে তাকে সাহায্য করে, তবে তো কাজটি সম্পন্ন হয়ে যায়। পক্ষান্তরে সে সাহায্যের হাত না বাড়ালে কাজটি সম্পন্ন হতে পারে না। এভাবে একটি নেককাজের সদিচ্ছা অন্যের সাহায্যের অভাবে অপূর্ণ থেকে যায়।
তো দেখা যাচ্ছে যেমন সদিচ্ছা পূরণের জন্য অন্যের সাহায্য প্রয়োজন, তেমনি অন্যের অসদিচ্ছা যাতে পূরণ না হতে পারে সেজন্য তার সাহায্য করা হতে বিরত থাকা জরুরি। কিন্তু কোন্টা সৎ কোন্টা অসৎ তা স্পষ্ট না থাকলে সাহায্য করা বা না করার ক্ষেত্রে মানুষের বিভ্রান্ত হওয়া খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু তা স্পষ্ট করবে কে? মানুষ নিজে যেহেতু ভালোমন্দ উভয় স্বভাব ধারণ করে, তাই তার পক্ষে সৎ ও অসৎ নির্ণয় করে দেওয়া সম্ভব নয় । এটা নির্ণয় করা সম্ভব কেবল মানুষের সৃষ্টিকর্তার পক্ষে। সুতরাং তিনি তা করেও দিয়েছেন। এ সম্পর্কে কুরআন ও সুন্নাহে সুস্পষ্ট নির্দেশনা দিয়ে দেওয়া হয়েছে।
নেককাজ ও তাকওয়া-পরহেযগারীতে পারস্পরিক
সাহায্য-সহযোগিতা সম্পর্কিত কিছু আয়াত
এক নং আয়াত
وَتَعَاوَنُوا عَلَى الْبِرِّ وَالتَّقْوَى
অর্থ : তোমরা সৎকর্ম ও তাকওয়ার ক্ষেত্রে একে অন্যকে সহযোগিতা করবে।সূরা মায়িদা (৫), আয়াত ২
ব্যাখ্যা
الْبِرِّ বলা হয় ওই সকল কাজকে, শরী'আতের পক্ষ থেকে যা করতে আদেশ করা হয়েছে। আর التَّقْوَى হল ওই সকল কাজ থেকে বিরত থাকা, যা করতে নিষেধ করা হয়েছে। শরী'আতের যাবতীয় বিষয় এর মধ্যে এসে গেছে। এতে আমাদেরকে আদেশ করা হয়েছে, আমরা যেন করণীয় ও বর্জনীয় যাবতীয় বিষয়ে একে অন্যকে সাহায্য করি। অর্থাৎ বান্দার কর্তব্য কেবল সে কাজই করা, যা করার অনুমতি শরী'আতের পক্ষ থেকে দেওয়া হয়েছে। এমনিভাবে বান্দার কর্তব্য ওই সকল কাজ থেকে অবশ্যই বিরত থাকা, যা করতে শরী'আত তাকে নিষেধ করেছে। আর এভাবে প্রত্যেকে যাতে করণীয় কাজ সম্পাদন করতে ও বর্জনীয় কাজ পরিহার করতে সক্ষম হয়, সেজন্য অন্যদের কর্তব্য তাকে সাহায্য-সহযোগিতা করা। এ সাহায্য হয় শিক্ষাদান দ্বারা। অর্থাৎ কোন কাজ শরী'আতে অনুমোদিত এবং কোন্ কাজ অনুমোদিত নয় তা শেখানো। এমনিভাবে সাহায্য করা যায় নেক আমলের প্রতি উৎসাহ দেওয়ার দ্বারা এবং মন্দ আমলের দুনিয়াবী ও পরকালীন ক্ষতি সম্পর্কে সতর্ক করার দ্বারা। কারও আমলের পক্ষে যা-কিছু বাধা হয় তা অপসারণ দ্বারাও অন্যের সাহায্য করা যায়।
এ আয়াতে একে অন্যকে সাহায্য করতে বলা হয়েছে কেবল নেককাজ ও তাকওয়া- পরহেযগারীতে। সুতরাং নির্দেশনা পাওয়া গেল যে, কোনও কাজ সম্পন্ন করতে সাহায্য কেবল তখনই করা যাবে, যখন সে কাজটি শরী'আত মোতাবেক হবে। যদি তা শরী'আত মোতাবেক না হয় তবে কোনও অবস্থাতেই সে কাজে সাহায্য করা যাবে না, তাতে সাহায্যপ্রার্থী যত আপন লোকই হোক না কেন। এমনিভাবে শরী'আতবিরোধী কাজ থেকে বিরত থাকাও যেহেতু একটি নেককাজ ও পরহেযগারী, তাই তা থেকে বিরত থাকার ব্যাপারেও অন্যের সাহায্য করাও এ আয়াতের দাবি।
যেহেতু এ আয়াতে নেককাজ ও তাকওয়া-পরহেযগারীতে একে অন্যকে সাহায্য করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, তাই আপন আপন শক্তি ও ক্ষমতা অনুযায়ী এটা করা প্রত্যেকের জন্য অবশ্যকর্তব্য।
দুই নং আয়াত
وَالْعَصْرِ (1) إِنَّ الْإِنْسَانَ لَفِي خُسْرٍ (2) إِلَّا الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ وَتَوَاصَوْا بِالْحَقِّ وَتَوَاصَوْا بِالصَّبْرِ (3)
অর্থ : কালের শপথ! বস্তুত মানুষ অতি ক্ষতির মধ্যে আছে। তারা ব্যতীত, যারা ঈমান আনে, সৎকর্ম করে এবং একে অন্যকে সত্যের উপদেশ দেয় ও একে অন্যকে সবরের উপদেশ দেয়। সূরা 'আসর (১০৩), আয়াত ১-৩
ব্যাখ্যা
এ সূরায় কালের শপথ করে বলা হয়েছে সমস্ত মানুষ ক্ষতির মধ্যে আছে। কালের শপথ দ্বারা কালের গুরুত্ব ও মূল্যের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। কালই মানবজীবনের মূল পুঁজি। মানুষ মহাকালের সুনির্দিষ্ট একটা সময় নিয়ে পৃথিবীতে আসে। প্রত্যেকের আয়ু নির্ধারিত। তার সে নির্ধারিত আয়ু শেষ হলে দুনিয়া থেকে চিরবিদায় হবে, তার একমুহূর্ত আগেও নয় পরেও নয়। মৃত্যুর পর কবরের জীবন, তারপর হাশরের ময়দান, তারপর জান্নাত বা জাহান্নাম, সবকিছুর ফয়সালা নির্ভর করে দুনিয়ার নির্দিষ্ট আয়ু ব্যবহারের ওপর। যে ব্যক্তি তার জীবনের আয়ু ভালো কাজে ব্যবহার করবে, তার ফয়সালা হবে সন্তোষজনক। সে কবরে শান্তি পাবে, হাশরে নিরাপদ থাকবে, তারপর জাহান্নাম থেকে মুক্তি পেয়ে জান্নাতবাসী হবে। এটাই মানবজীবনের পরম সফলতা। ইরশাদ হয়েছে-
فَمَنْ زُحْزِحَ عَنِ النَّارِ وَأُدْخِلَ الْجَنَّةَ فَقَدْ فَازَ وَمَا الْحَيَاةُ الدُّنْيَا إِلَّا مَتَاعُ الْغُرُورِ (185)
অতঃপর যাকেই জাহান্নাম থেকে দূরে সরিয়ে দেওয়া হবে ও জান্নাতে প্রবেশ করিয়ে দেওয়া হবে, সে-ই প্রকৃত অর্থে সফলকাম হবে। আর (জান্নাতের বিপরীতে) পার্থিব জীবন তো প্রতারণার উপকরণ ছাড়া কিছুই নয়।সূরা আলে-ইমরান (৩), আয়াত ১৮৫
ব্যক্তি তার আয়ুষ্কালকে ভালো কাজে ব্যবহার করলে তার ব্যক্তিগত জীবন সফল হয়। যদি সমাজ ও সমষ্টি তাদের জীবনায়ু ভালো কাজে ব্যবহার করে, তবে সমষ্টির জীবন সফল হয়। জাতীয় জীবনের উন্নতি-অগ্রগতি সময়ের সদ্ব্যবহারের ওপর নির্ভর করে। গোটা মানবসভ্যতার ইতিহাস এবং ইতিহাসের যত উত্থান-পতন তা সময়ের সদ্ব্যবহার বা অসদ্ব্যবহারেরই অনিবার্য ফল মাত্র। সুতরাং সময়ের ব্যবহারে ব্যক্তিগত সচেতনতার পাশাপাশি সমষ্টিগত সচেতনতাও অতীব জরুরি। 'কালের শপথ' সেদিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
কালের শপথ করার পর বলা হয়েছে, সমস্ত মানুষ ক্ষতি ও লোকসানের মধ্যে আছে। এর দ্বারা মানুষকে একজন ব্যবসায়ী এবং তার আয়ুকে মূলধনের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। ব্যবসায়ী তার ব্যবসায়ে মূলধন খাটায় মুনাফার আশায়। মুনাফা না হওয়াই লোকসান। তাতে করে ক্রমান্বয়ে মূলধন হ্রাস পেতে থাকে। একপর্যায়ে সে চরম লোকসানের শিকার হয় এবং তার মূলধন শেষ হয়ে যায়। অনুরূপ মানুষের আয়ু তার ছাওয়াব ও পুণ্য লাভের মূলধন। সে যদি তার মুহূর্তগুলোকে পুণ্যার্জনে ব্যয় না করে, তবে লোকসান বাড়তেই থাকে। কেননা আয়ু দমে দমে কমতে থাকে। একপর্যায়ে গোটা আয়ু নিঃশেষ হয়ে যায়, কিন্তু আমলনামায় পুণ্য জমা থাকে না। মানুষের জন্য এরচে' বড় ক্ষতি আর কী হতে পারে? অধিকাংশ মানুষ চরম উদাসীনতার ভেতর জীবন কাটায়। দুনিয়ার ভোগ-উপভোগে মত্ত থেকে তার পরমায়ু বরবাদ করে দেয়। পরিশেষে যখন মৃত্যু হানা দেয় তখন আক্ষেপ করে বলতে থাকে, আমাকে একটুখানি সময় দেওয়া হোক। আমি নিজেকে সংশোধন করে ফেলব। কিন্তু ওই আক্ষেপ কোনও কাজের নয়। প্রত্যেকের উচিত সেই দিন আসার আগে আগে এখনই সময়ের সদ্ব্যবহার করা এবং এ মহামূল্যবান পুঁজির বিনিময়ে যতবেশি সম্ভব পুণ্যের মুনাফা অর্জন করে নেওয়া।
এ আয়াতে সকল মানুষকেই লোকসানগ্রস্ত বলা হয়েছে। অতঃপর এমন কয়েকটি গুণের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, যে গুণগুলো যাদের অর্জন হয়ে যায় তারা ব্যতিক্রম মানুষ। অর্থাৎ তারা লোকসানগ্রস্ত নয়। গুণগুলো হচ্ছে যথাক্রমে- ঈমান আমলে সালিহ, পারস্পরিক সত্যের উপদেশ ও ধৈর্যের উপদেশ।
ঈমান দ্বারা বোঝানো উদ্দেশ্য আল্লাহর অস্তিত্ব, তাঁর একত্বে বিশ্বাস, আখিরাতে বিশ্বাস ও রাসূলের প্রতি বিশ্বাসসহ এমন যাবতীয় বিষয় মেনে নেওয়া, যা আখিরী নবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদেরকে শিক্ষা দিয়েছেন। সেইসঙ্গে এই বিশ্বাস রাখা যে, কিয়ামত পর্যন্ত সমস্ত মানুষের দুনিয়ার সুখ-শান্তি ও আখিরাতের মুক্তি তাঁর নিয়ে আসা দীনের অনুসরণের মধ্যেই নিহিত। এর কোনও বিকল্প নেই, যেহেতু তিনি সর্বশেষ নবী, তাঁর পর আর কোনও নবীও নেই, কোনও কিতাবও নেই।
এই ঈমান ও বিশ্বাসের দাবি হচ্ছে আমলে সালিহে লিপ্ত থাকা। অর্থাৎ বিশ্বাসকে কেবল অন্তরের মধ্যে লালন করে রাখাই যথেষ্ট নয়, বরং তাকে কার্যে পরিণত করতে হবে। ব্যক্তির যাবতীয় কাজকর্ম ওই বিশ্বাসের আলোকে সম্পাদিত হতে হবে। শরী'আত হচ্ছে তার রূপরেখা। শরী'আতে যে কাজ অনুমোদিত তা করা এবং যা অনুমোদিত নয় তা থেকে বিরত থাকাই হচ্ছে আমলে সালিহ বা সৎকর্ম। জীবনকে লোকসান থেকে বাঁচানোর দ্বিতীয় শর্ত এই আমলে সালিহে লিপ্ত থাকা।
তৃতীয় গুণ হল সত্যের উপদেশ দেওয়া। অর্থাৎ কেবল ব্যক্তিগত সৎকর্মে সন্তুষ্ট থাকাই যথেষ্ট নয়; বরং অন্যকে লোকসান থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করাও জরুরি। প্রত্যেককেই নিজ দীনদারী হেফাজতের পাশাপাশি লক্ষ রাখতে হবে তার আওতাভুক্ত কেউ সত্যদীন থেকে কোনওভাবে বিচ্যুত হচ্ছে কি না। যদি বিচ্যুত হয়ে থাকে তবে তার সংশোধনে সচেষ্ট থাকতে হবে। সর্বদা নিজ আওতাভুক্ত প্রত্যেকের জন্য সদুপোদেশ জারি রাখতে হবে, যাতে তারা সত্যদীনে প্রতিষ্ঠিত থাকে।
লোকসান থেকে বাঁচার জন্য চতুর্থ অপরিহার্য গুণ হচ্ছে একে অন্যকে উপদেশ দেওয়া, যাতে সর্বাবস্থায় সবর ও ধৈর্য রক্ষা করে চলে। ধৈর্য রক্ষা করতে হবে যেমন শরী'আতের যাবতীয় আদেশ মেনে চলার ব্যাপারে, তেমনি শরী'আত যা-কিছু নিষিদ্ধ করেছে তা থেকে বেঁচে থাকার ব্যাপারেও। এমনিভাবে ধৈর্য রক্ষা করতে হবে আপতিত সকল বিপদাপদেও।
প্রকাশ থাকে যে, হক ও সবরের উপদেশদান যেমন কোনও মওসুমী কাজ নয় তেমনি নয় এটা ব্যক্তি বা দলবিশেষের দায়িত্বও। বরং এটা প্রত্যেক মুমিনের সবসময়কার যিম্মাদারী। অর্থাৎ যখনই যার সামনে কারো দ্বারা হক ও সবর পরিপন্থি কিছু ঘটবে তখনই সে তাকে হকের দিকে ফিরে আসার ও সবর অবলম্বনের উপদেশ দেবে। স্বামী তার স্ত্রীকে, স্ত্রী তার স্বামীকে, পিতা তার সন্তানকে, ভাই তার ভাইকে, এক প্রতিবেশী অপর প্রতিবেশীকে, এক বন্ধু অপর বন্ধুকে, এক পথিক অপর পথিককে, মোটকথা প্রতি দুইজনের একজন অপরজনকে যখনই পরিস্থিতি দেখা দেয় তখনই এ উপদেশ প্রদান করবে। এমনকি পরিস্থিতি ছাড়াও স্বাভাবিক অবস্থায়ও পারস্পরিক উপদেশদান অব্যাহত রাখা চাই। এ সূরা আমাদেরকে ক্ষতি থেকে বাঁচার জন্য এ ব্যবস্থাই অবলম্বন করতে বলেছে।
মোটকথা, যে ব্যক্তি এ সূরায় বর্ণিত চারটি গুণ অর্জন করতে সক্ষম হবে সে লোকসান থেকে বেঁচে যাবে। কেননা এর মাধ্যামে তার জীবনের মুহূর্তগুলো নেককাজে ব্যয় হবে। প্রতি মুহূর্তের বিনিময়ে তার আমলনামায় নেকী লেখা হতে থাকবে। ফলে তার পরমায়ু নিঃশেষ হবে বটে, কিন্তু সে একরকম অমরত্ব লাভ করবে। কেননা পারস্পরিক সত্য ও সবরের উপদেশদানের মাধ্যমে তার দ্বারা যে নেক আমলের প্রবাহ চালু হবে তা কিয়ামত পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে। ফলে মৃত্যুর পরও তার আমলনামায় নেকী লেখা জারি থাকবে। অসম্ভব নয় যে, দুনিয়ায় ও কিয়ামত পর্যন্ত মানুষের মুখে মুখে তার সুনাম-সুখ্যাতির চর্চা অব্যাহত থাকবে। এমন কত শত মানুষ আছে, যারা দুনিয়া থেকে চলে গেছেন কিন্তু মানুষ তাদের ভোলেনি। সত্য ও সবরের পথে মানুষকে প্রতিষ্ঠিত রাখার বহুমুখী মেহনতের কারণে তারা ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে আছে।
এটি অতি ছোট্ট একটি সূরা, কিন্তু বিপুল তাৎপর্যে ভরা। এ যেন সমগ্র দীনের সারকথা। তাই তো ইমাম শাফি'ঈ রহ. বলেন, যদি এই একটি মাত্র সূরাই নাযিল করা হত, তবে (সমঝদার ব্যক্তিদের জন্য) হিদায়াত হিসেবে যথেষ্ট হত। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ এ সূরাটির ব্যাপারে উদাসীন। তারা এর বিষয়বস্তুর মধ্যে চিন্তা করে না।
মুজাহিদ ব্যক্তির আসবাবপত্রের ব্যবস্থা করে দেওয়া ও তার পরিবার-পরিজনের খোঁজখবর রাখার ফযীলত
হাদীছ নং: ১৭৭
হযরত আবূ আব্দুর রহমান যায়দ ইবন খালিদ জুহানী রাযি. থেকে বর্ণিত, আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর রাস্তার কোনও গাযীকে জিহাদের আসবাবপত্র দিয়ে সাহায্য করল, সে যেন নিজেই জিহাদে গেল। আর যে ব্যক্তি কোনও গাযীর পরিবারবর্গের মধ্যে তার স্থলাভিষিক্তরূপে উত্তম দায়িত্বপালন করল, সেও যেন জিহাদ করল -বুখারী ও মুসলিম।
(সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ২৮৪৩; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ১৮৯৫; সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ২৫০৯; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ১৬২৮)
হাদীছ নং: ১৭৭
হযরত আবূ আব্দুর রহমান যায়দ ইবন খালিদ জুহানী রাযি. থেকে বর্ণিত, আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর রাস্তার কোনও গাযীকে জিহাদের আসবাবপত্র দিয়ে সাহায্য করল, সে যেন নিজেই জিহাদে গেল। আর যে ব্যক্তি কোনও গাযীর পরিবারবর্গের মধ্যে তার স্থলাভিষিক্তরূপে উত্তম দায়িত্বপালন করল, সেও যেন জিহাদ করল -বুখারী ও মুসলিম।
(সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ২৮৪৩; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ১৮৯৫; সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ২৫০৯; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ১৬২৮)
21 - باب في التعاون على البر والتقوى
قَالَ الله تَعَالَى: {وَتَعَاوَنُوا عَلَى الْبِرِّ وَالتَّقْوَى} [المائدة: 2]، وَقالَ تَعَالَى: {وَالْعَصْرِ إِنَّ الإنْسَانَ لَفِي خُسْرٍ إِلاَّ الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ وَتَوَاصَوْا بِالْحَقِّ وَتَوَاصَوْا بِالصَّبْرِ} [العصر: 1 - 2] قَالَ الإمام الشافعي - رَحِمَهُ الله - كلامًا معناه: إنَّ النَّاسَ أَوْ أكثرَهم في غفلة عن تدبر هذِهِ السورة (1).
قَالَ الله تَعَالَى: {وَتَعَاوَنُوا عَلَى الْبِرِّ وَالتَّقْوَى} [المائدة: 2]، وَقالَ تَعَالَى: {وَالْعَصْرِ إِنَّ الإنْسَانَ لَفِي خُسْرٍ إِلاَّ الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ وَتَوَاصَوْا بِالْحَقِّ وَتَوَاصَوْا بِالصَّبْرِ} [العصر: 1 - 2] قَالَ الإمام الشافعي - رَحِمَهُ الله - كلامًا معناه: إنَّ النَّاسَ أَوْ أكثرَهم في غفلة عن تدبر هذِهِ السورة (1).
177 - وعن أَبي عبد الرحمان زيد بن خالد الجهني - رضي الله عنه - قَالَ: قَالَ رسولُ الله - صلى الله عليه وسلم: «مَنْ جَهَّزَ غَازِيًا في سَبيلِ اللهِ فَقَدْ غَزَا، وَمَنْ خَلَفَ غَازيًا في أهْلِهِ بِخَيرٍ فَقَدْ غَزَا». مُتَّفَقٌ عَلَيهِ. (1)
হাদীসের ব্যাখ্যা:
এ হাদীছে অতি গুরুত্বপূর্ণ দু'টি নেক আমলের কথা বলা হয়েছে, যা দ্বারা জিহাদে না গিয়েও জিহাদ করার ফযীলত লাভ হয়। তার মধ্যে একটি হচ্ছে মুজাহিদের যুদ্ধসামগ্রীর ব্যবস্থা করে দেওয়া। কোনও এক মুজাহিদ হয়তো জিহাদে যাওয়ার নিয়ত করেছে। কিন্তু জিহাদের জন্য যেসব আসবাবের প্রয়োজন তা তার নেই। যেমন বাহন, অস্ত্রশস্ত্র, রসদ ইত্যাদি। এসব না থাকায় নিয়ত থাকা সত্ত্বেও সে জিহাদে যেতে পারছে না। অপর এক ব্যক্তির এসব আসবাব আছে কিংবা এমন সামর্থ্য আছে, যা দ্বারা সে এগুলো কিনতে পারে। কিন্তু অসুখ-বিসুখ বা অন্য কোনও ওযর থাকায় সে জিহাদে যেতে পারছে না। এ অবস্থায় সে যদি জিহাদে যেতে ইচ্ছুক ব্যক্তিকে আসবাবের ব্যবস্থা করে দেয়, তবে মুজাহিদ ব্যক্তি জিহাদ করে যে ছাওয়াব অর্জন করবে অনুরূপ ছাওয়াবের অধিকারী সেও হয়ে যাবে। যদি প্রয়োজনীয় সবটা সামগ্রীর ব্যবস্থা করে দিতে পারে তবে তো পুরোপুরি তার মতই ছাওয়াব পাবে, আর তা দিতে না পারলে যতটুকু দিতে পারবে সেই পরিমাণ ছাওয়াব পাবে। কাজেই কোনও ব্যক্তি সবটা সামগ্রীর ব্যবস্থা করে দিতে না পারলে তার উচিত যতটুকু পারে ততটুকুই দেওয়া।
এমনিভাবে মুজাহিদ ব্যক্তি যুদ্ধে যাওয়ার পর তার পরিবারবর্গের দেখাশোনা করাও অনেক বড় ফযীলতের কাজ। এতে জিহাদে না গিয়েও জিহাদের ছাওয়াব পাওয়া যায়। কেননা এটাও অতীব গুরুত্বপূর্ণ কাজ। সকল সক্ষম পুরুষ যদি জিহাদে চলে যায়, তবে নারী ও শিশুরা অসহায় হয়ে পড়বে। তখন শত্রুদের পক্ষ থেকে তাদের অনেক বড় ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তাই তো দেখা যায় তাবূক যুদ্ধের মত এক গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধাভিযানে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত আলী রাযি.-কে সঙ্গে না নিয়ে মদীনা মুনাওয়ারায় রেখে যান এবং তাঁর ওপর তাঁর পরিবারবর্গের দেখাশোনার দায়িত্বভার অর্পণ করেন। হযরত আলী রাযি. বলেছিলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি আমাকে নারী ও শিশুদের সঙ্গে রেখে যাচ্ছেন? তখন তিনি তাঁকে বলেছিলেনঃ-
أما ترضى أن تكون مني بمنزلة هارون من موسى، إلا أنه لا نبي بعدي
‘তুমি কি এতে খুশি নও যে, মূসার সঙ্গে হারূনের যে অবস্থান ছিল, আমার সঙ্গে তুমি সেই অবস্থানে থাকবে? অবশ্য আমার পরে কোনও নবী নেই। (সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৪৪১৬; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ২৪০৪; জামে তিরমিযী,হাদীছ নং ৩৭২৪)
অর্থাৎ মূসা আলাইহিস সালাম তূর পাহাড়ে যাওয়ার সময় হযরত হারূন ‘আলাইহিস সালামকে কওমের মধ্যে নিজ স্থলাভিষিক্তরূপে রেখে গিয়েছিলেন। তেমনি তুমি আমার পরিবারবর্গের মধ্যে আমার স্থলাভিষিক্তরূপে দায়িত্ব পালন করবে। পার্থক্য এই যে, হারূন ‘আলাইহিস সালাম একজন নবী ছিলেন, কিন্তু তুমি নবী নও, যেহেতু আমার পর কারও নবী হওয়ার কোনও অবকাশ নেই।
যাহোক যে ব্যক্তি কোনও মুজাহিদের পরিবারবর্গের খোঁজখবর রাখবে, তাদের কোনও প্রয়োজন দেখা দিলে তার সমাধান করবে, তাদের বিপদাপদে পাশে দাঁড়াবে এবং যে-কোনও জরুরতে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবে, সে যুদ্ধে না গিয়েও মুজাহিদ ব্যক্তির অনুরূপ ছাওয়াব লাভ করবে। এ ক্ষেত্রেও যতটুকু সাহায্য করা সম্ভব তা করা উচিত। মুজাহিদ ব্যক্তির অনুপস্থিতিতে তার পরিবারের পরিপূর্ণ তত্ত্বাবধান করতে পারলে ছাওয়াবও পরিপূর্ণ লাভ করবে, অন্যথায় যতটুকু করতে পারে ততটুকু ছাওয়াবের অধিকারী হবে।
অবশ্য উভয় ক্ষেত্রেই সহীহ নিয়ত ও ইখলাসের বিষয়টিও লক্ষণীয়। এক তো ছাওয়াব পাবে তখনই, যখন ইখলাস থাকবে। দ্বিতীয়ত যদি কারও নিয়ত থাকে যে, আমার পক্ষে মুজাহিদ ব্যক্তির সবটা আসবাবের ব্যবস্থা করে দেওয়া সম্ভব হলে আমি তা অবশ্যই করতাম কিংবা তার পরিবারের পরিপূর্ণ তত্ত্বাবধান করার ক্ষমতা থাকলে আমি পরিপূর্ণ তত্ত্বাবধানই করতাম, তবে আংশিক করেও পরিপূর্ণ ছাওয়াব পেয়ে যাবে। আল্লাহ তা'আলা মহাদাতা। তাঁর ভাণ্ডারে কোনওকিছুর অভাব নেই ।
প্রকাশ থাকে যে, হাদীছে সুনির্দিষ্টভাবে জিহাদের কথা বলা হলেও অন্যান্য দীনী কাজও এ নিয়মের অন্তর্ভুক্ত হবে। যেমন কেউ যদি 'ইলমে দীন শেখার জন্য সফর করে, তাহলে যে ব্যক্তি তার পরিবারবর্গের খোঁজখবর রাখবে সেও ওই সফরকারীর মতই ছাওয়াবের অধিকারী হবে।
এমনিভাবে যে ব্যক্তি নিজে ইলমে দীন শেখার জন্য কোথাও যেতে পারে না সে যদি তালিবে ইলমকে সহযোগিতা করে, যেমন কিতাব কিনে দেওয়া, পথখরচা দেওয়া বা তার খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করে দেওয়া ইত্যাদি, তবে তার আমলনামায়ও তালিবে ইলমের মত ছাওয়াব লেখা হবে।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. এ হাদীছ দ্বারা জিহাদের গুরুত্ব উপলব্ধি করা যায়। সুতরাং প্রত্যেকেরই উচিত কোনও না কোনওভাবে এ মহান কাজের সাথে সম্পৃক্ত থাকা বা থাকার নিয়ত রাখা ।
খ. যে ব্যক্তির সক্রিয় জিহাদে অংশগ্রহণের সুযোগ আছে সে তো সক্রিয়ভাবেই অংশগ্রহণ করবে, আর যে ব্যক্তির ক্ষমতা নেই তার কর্তব্য আসবাবপত্র দিয়ে মুজাহিদকে সাহায্য করা।
গ. মুজাহিদ ব্যক্তি জিহাদে চলে যাওয়ার পর অন্যদের উচিত তার পরিবারবর্গের খোঁজখবর রাখা ও তাদের প্রয়োজনীয় সাহায্য করা।
ঘ. ইলমে দীন শেখা বা অন্য কোনও দীনী কাজের উদ্দেশ্যে কেউ সফরে যেতে চাইলে অন্যদের উচিত তার আসবাবপত্র বা অন্যান্য খরচায় সাহায্য করা। এমনিভাবে তার অনুপস্থিতিতে তার পরিবারবর্গের তত্ত্বাবধান করা।
এমনিভাবে মুজাহিদ ব্যক্তি যুদ্ধে যাওয়ার পর তার পরিবারবর্গের দেখাশোনা করাও অনেক বড় ফযীলতের কাজ। এতে জিহাদে না গিয়েও জিহাদের ছাওয়াব পাওয়া যায়। কেননা এটাও অতীব গুরুত্বপূর্ণ কাজ। সকল সক্ষম পুরুষ যদি জিহাদে চলে যায়, তবে নারী ও শিশুরা অসহায় হয়ে পড়বে। তখন শত্রুদের পক্ষ থেকে তাদের অনেক বড় ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তাই তো দেখা যায় তাবূক যুদ্ধের মত এক গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধাভিযানে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত আলী রাযি.-কে সঙ্গে না নিয়ে মদীনা মুনাওয়ারায় রেখে যান এবং তাঁর ওপর তাঁর পরিবারবর্গের দেখাশোনার দায়িত্বভার অর্পণ করেন। হযরত আলী রাযি. বলেছিলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি আমাকে নারী ও শিশুদের সঙ্গে রেখে যাচ্ছেন? তখন তিনি তাঁকে বলেছিলেনঃ-
أما ترضى أن تكون مني بمنزلة هارون من موسى، إلا أنه لا نبي بعدي
‘তুমি কি এতে খুশি নও যে, মূসার সঙ্গে হারূনের যে অবস্থান ছিল, আমার সঙ্গে তুমি সেই অবস্থানে থাকবে? অবশ্য আমার পরে কোনও নবী নেই। (সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৪৪১৬; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ২৪০৪; জামে তিরমিযী,হাদীছ নং ৩৭২৪)
অর্থাৎ মূসা আলাইহিস সালাম তূর পাহাড়ে যাওয়ার সময় হযরত হারূন ‘আলাইহিস সালামকে কওমের মধ্যে নিজ স্থলাভিষিক্তরূপে রেখে গিয়েছিলেন। তেমনি তুমি আমার পরিবারবর্গের মধ্যে আমার স্থলাভিষিক্তরূপে দায়িত্ব পালন করবে। পার্থক্য এই যে, হারূন ‘আলাইহিস সালাম একজন নবী ছিলেন, কিন্তু তুমি নবী নও, যেহেতু আমার পর কারও নবী হওয়ার কোনও অবকাশ নেই।
যাহোক যে ব্যক্তি কোনও মুজাহিদের পরিবারবর্গের খোঁজখবর রাখবে, তাদের কোনও প্রয়োজন দেখা দিলে তার সমাধান করবে, তাদের বিপদাপদে পাশে দাঁড়াবে এবং যে-কোনও জরুরতে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবে, সে যুদ্ধে না গিয়েও মুজাহিদ ব্যক্তির অনুরূপ ছাওয়াব লাভ করবে। এ ক্ষেত্রেও যতটুকু সাহায্য করা সম্ভব তা করা উচিত। মুজাহিদ ব্যক্তির অনুপস্থিতিতে তার পরিবারের পরিপূর্ণ তত্ত্বাবধান করতে পারলে ছাওয়াবও পরিপূর্ণ লাভ করবে, অন্যথায় যতটুকু করতে পারে ততটুকু ছাওয়াবের অধিকারী হবে।
অবশ্য উভয় ক্ষেত্রেই সহীহ নিয়ত ও ইখলাসের বিষয়টিও লক্ষণীয়। এক তো ছাওয়াব পাবে তখনই, যখন ইখলাস থাকবে। দ্বিতীয়ত যদি কারও নিয়ত থাকে যে, আমার পক্ষে মুজাহিদ ব্যক্তির সবটা আসবাবের ব্যবস্থা করে দেওয়া সম্ভব হলে আমি তা অবশ্যই করতাম কিংবা তার পরিবারের পরিপূর্ণ তত্ত্বাবধান করার ক্ষমতা থাকলে আমি পরিপূর্ণ তত্ত্বাবধানই করতাম, তবে আংশিক করেও পরিপূর্ণ ছাওয়াব পেয়ে যাবে। আল্লাহ তা'আলা মহাদাতা। তাঁর ভাণ্ডারে কোনওকিছুর অভাব নেই ।
প্রকাশ থাকে যে, হাদীছে সুনির্দিষ্টভাবে জিহাদের কথা বলা হলেও অন্যান্য দীনী কাজও এ নিয়মের অন্তর্ভুক্ত হবে। যেমন কেউ যদি 'ইলমে দীন শেখার জন্য সফর করে, তাহলে যে ব্যক্তি তার পরিবারবর্গের খোঁজখবর রাখবে সেও ওই সফরকারীর মতই ছাওয়াবের অধিকারী হবে।
এমনিভাবে যে ব্যক্তি নিজে ইলমে দীন শেখার জন্য কোথাও যেতে পারে না সে যদি তালিবে ইলমকে সহযোগিতা করে, যেমন কিতাব কিনে দেওয়া, পথখরচা দেওয়া বা তার খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করে দেওয়া ইত্যাদি, তবে তার আমলনামায়ও তালিবে ইলমের মত ছাওয়াব লেখা হবে।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. এ হাদীছ দ্বারা জিহাদের গুরুত্ব উপলব্ধি করা যায়। সুতরাং প্রত্যেকেরই উচিত কোনও না কোনওভাবে এ মহান কাজের সাথে সম্পৃক্ত থাকা বা থাকার নিয়ত রাখা ।
খ. যে ব্যক্তির সক্রিয় জিহাদে অংশগ্রহণের সুযোগ আছে সে তো সক্রিয়ভাবেই অংশগ্রহণ করবে, আর যে ব্যক্তির ক্ষমতা নেই তার কর্তব্য আসবাবপত্র দিয়ে মুজাহিদকে সাহায্য করা।
গ. মুজাহিদ ব্যক্তি জিহাদে চলে যাওয়ার পর অন্যদের উচিত তার পরিবারবর্গের খোঁজখবর রাখা ও তাদের প্রয়োজনীয় সাহায্য করা।
ঘ. ইলমে দীন শেখা বা অন্য কোনও দীনী কাজের উদ্দেশ্যে কেউ সফরে যেতে চাইলে অন্যদের উচিত তার আসবাবপত্র বা অন্যান্য খরচায় সাহায্য করা। এমনিভাবে তার অনুপস্থিতিতে তার পরিবারবর্গের তত্ত্বাবধান করা।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
