রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ

ভূমিকা অধ্যায়

হাদীস নং: ১৬৮
আল্লাহর ফায়সালায় আনুগত্য প্রকাশের অপরিহার্যতা এবং যাকে সেদিকে ডাকা হয় এবং সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করা হয়, তার যা বলা উচিত।

আল্লাহর বান্দা হিসেবে মানুষের কর্তব্য তাঁর যেকোনও ফায়সালা খুশিমনে মেনে নেওয়া। তা তার পছন্দ হোক বা না-ই হোক। বান্দা হিসেবে আল্লাহ তা'আলার ফায়সালার বিপরীতে নিজের কোনও পছন্দ থাকাই উচিত নয়। কেননা তার জন্য কোনটা কল্যাণকর কোনটা কল্যাণকর নয় তা তার চেয়ে আল্লাহ তা'আলাই ভালো জানেন। তিনি তার সৃষ্টিকর্তা। আপন সৃষ্টি সম্পর্কে সৃষ্টি অপেক্ষা তার স্রষ্টা বেশি জানবেন “এটাই স্বাভাবিক। সুতরাং আল্লাহ তা'আলার কোনও ফায়সালা সম্পর্কে কারও যদি মনে হয় এটা তার বিরুদ্ধে গেল তবে মনে মনে ভাবতে হবে- বাহ্যত সেটি তার বিরুদ্ধে হলেও প্রকৃতপক্ষে তাতেই তার কল্যাণ নিহিত। আপাতত সে ফায়সালা দ্বারা তার প্রতিপক্ষ উপকৃত হয়েছে, কিন্তু পরিণামে উপকার সকলেরই। কেননা প্রথমত : যে ফায়সালা প্রতিপক্ষের অনুকূলে সেটিই ন্যায়সম্মত। সে ফায়সালা পরিবর্তন করে তার নিজের অনুকূলে আনা হলে তা হবে জুলুম ও অন্যায়। অন্যায় ফায়সালা দ্বারা যে সুবিধা ভোগ করা হবে তা সম্পূর্ণ হারাম ও পাপ। কাজেই আল্লাহপ্রদত্ত ফায়সালা মেনে নেয়ার দ্বারা এ পাপ থেকে সে বেঁচে গেল। এও তো এক কল্যাণই বটে। দ্বিতীয়ত : ন্যায়বিচার ও ইনসাফসম্মত ফায়সালা দ্বারা সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হয়। শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হলে আখেরে তার ফায়দা ভোগ করে পক্ষ-বিপক্ষ সকলেই। কেননা যে ঘটনার ব্যাপারে ফায়সালা দেয়া হয়েছে সেটিই যে একমাত্র ঘটনা—এমন তো নয়। কালপরিক্রমায় নিত্যনতুন ঘটনা ঘটতে থাকে এবং পরিবেশ-পরিস্থিতিরও পালাবদল হতে থাকে। বলা যায় না কখন এমন কী ঘটনা ঘটে যায় যখন ইনসাফসম্মত ফায়সালাটি নিজেরই অনুকূলে আসবে। আগে থেকে কার্যকর হয়ে আসলে এক্ষেত্রে সে ফায়সালাটি পাওয়ার নিশ্চয়তা লাভ হয়। পক্ষান্তরে আগে নিজের পক্ষ থেকে ন্যায়সম্মত ফায়সালা অগ্রাহ্য করার উদাহরণ সৃষ্টি হলে এক্ষেত্রে সে নিশ্চয়তাও থাকে না। এইযে অনিশ্চয়তার ক্ষতি, এটাতো আগেকার ন্যায়বিচার না মানারই পরিণাম। এ ক্ষতি থেকে বাঁচার উপায় একটাই, আর তা হচ্ছে সর্বাবস্থায় ন্যায়বিচার মেনে নেওয়া।
বলাবাহুল্য, ন্যায়বিচার সেটাই যা আল্লাহ তা'আলার ফায়সালা মোতাবেক হয়। কুরআন-সুন্নাহয় প্রদত্ত বিধানই আল্লাহর ফায়সালা। প্রত্যেকের কর্তব্য সর্বাবস্থায় এ ফায়সালা খুশিমনে গ্রহণ করে নেওয়া। আর তা কেবল সাধারণ বিধি-বিধানের ক্ষেত্রে নয়, আইন-আদালতের ক্ষেত্রেও। আদালতী বিচারাচারও কুরআন-সুন্নাহয় প্রদর নীতিমালা অনুযায়ী নিষ্পত্তি হওয়া উচিত। ইসলাম যেহেতু পূর্ণাঙ্গ দীন, তাই আইন. আদালতকে আলাদা করে দেখার কোনও অবকাশ নেই।
যাহোক, মূলকথা হচ্ছে জীবনের সকল ক্ষেত্রেই বান্দার কর্তব্য আল্লাহর ফায়সালায় আনুগত্য প্রকাশ করা। এক্ষেত্রে কারো দ্বারা ব্যতিক্রম ঘটলে অন্যদের কর্তব্য তাকে উপদেশ দেওয়া এবং তাকে আনুগত্যের দিকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা। আর তারও কর্তব্য যখন তাকে সঠিক পথের দিকে ডাকা হবে তখন অসংকোচে সে ডাকে সাড়া দেওয়া।
আল্লাহ তা'আলার ফায়সালায় আনুগত্য প্রকাশ যে প্রত্যেক বান্দার অবশ্যকর্তব্য এবং তাঁর আদেশ অমান্যকারী ও নিষিদ্ধ কাজে লিপ্তব্যক্তিকে তাঁর আদেশ-নিষেধ মেনে চলার দিকে ডাকা হলে তাতে সাড়া দেওয়া যে তার জন্য অপরিহার্য সেসম্পর্কে কুরআন মাজীদে বহু আয়াত রয়েছে এবং আছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বহু হাদীস।
ইমাম নববী এ অধ্যায়ে সেরকম কিছু আয়াত ও কয়েকটি হাদীস উল্লেখ করেছেন। আমরা নিচে তার বঙ্গানুবাদ ও সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা পেশ করছি। আল্লাহ তা'আল তাওফীক দান করুন- আমীন।

‘আল্লাহর ফায়সালায় আনুগত্য প্রকাশের অপরিহার্যতা এবং যাকে সেদিকে ডাকা হয় এবং সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করা হয়,তার যা বলা উচিত' সম্পর্কিত কিছু আয়াত

এক নং আয়াত

فَلَا وَرَبِّكَ لَا يُؤْمِنُونَ حَتَّى يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَيْنَهُمْ ثُمَّ لَا يَجِدُوا فِي أَنْفُسِهِمْ حَرَجًا مِمَّا قَضَيْتَ وَيُسَلِّمُوا تَسْلِيمًا (65)

অর্থ : না, (হে নবী!) তোমার প্রতিপালকের শপথ! তারা ততক্ষণ পর্যন্ত মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না নিজেদের পারস্পরিক ঝগড়া-বিবাদের ক্ষেত্রে তোমাকে বিচারক মানবে, তারপর তুমি যে রায় দাও সে ব্যাপারে নিজেদের অন্তরে কোনওরূপ কুণ্ঠাবোধ না করবে এবং অবনত মস্তকে তা গ্রহণ করে নেবে।সূরা নিসা (৪), আয়াত ৬৫

ব্যাখ্যা

এ আয়াতে আল্লাহ তা'আলা তাঁর নিজের শপথ করে জানিয়েছেন, কোনও ব্যক্তি ততক্ষণ পর্যন্ত মুমিন ও মুসলিম হতে পারে না, যতক্ষণ না সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতিটি সিদ্ধান্ত অকুন্ঠ ও সন্তুষ্টমনে মেনে নেবে।
আল্লাহ তা'আলা কসম করেছেন তাঁর 'রব্ব' নামের। রব্ব অর্থ প্রতিপালক। তিনি বান্দার বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ তথা দৈহিক ও আত্মিক উভয় রকম প্রতিপালন করেন। অর্থাৎ তিনি যেমন বান্দার দৈহিক প্রয়োজন ও চাহিদা পূরণের ব্যবস্থা করেন, তেমনি তার আত্মিক প্রয়োজন ও চাহিদা পূরণের জন্য যা-কিছু দরকার তারও যোগান দেন। বান্দার আত্মিক বিশেষ প্রয়োজন হচ্ছে- সে যে উপায়ে তাঁর সন্তুষ্টি লাভ করতে পারে তা বাতলে দেওয়া। নবী-রাসূলগণের মাধ্যমে তিনি মূলত তা-ই বাতলে দিয়ে থাকেন। সুতরাং তিনি তাঁর 'রব্ব' নামের কসম করে ইঙ্গিত করছেন যে, আমি রব্ব হিসেবে তোমাদের আত্মিক চাহিদা পূরণার্থে তোমাদের কাছে আমার রাসূল পাঠিয়েছি। তোমাদের কর্তব্য তাঁর হিদায়াত মোতাবেক চলা। যার একটা বিশেষ দিক হচ্ছে তোমাদের পারস্পরিক দ্বন্দ্ব-কলহে তিনি যে মীমাংসা দান করেন, অকুণ্ঠচিত্তে তা মেনে নেওয়া।
বস্তুত নবীর নবুওয়াতের প্রতি বিশ্বাস স্থাপনের উদ্দেশ্যই হচ্ছে তাঁর যাবতীয় আদেশ-নিষেধ মেনে নেওয়া, তাঁর প্রতিটি ফয়সালায় খুশি থাকা ও তাঁর পূর্ণাঙ্গ অনুসরণ বজায় রাখা। নবীর প্রতি বিশ্বাস কেবল ভক্তি প্রদর্শন ও গুণগান করার জন্য নয় এবং নয় কেবল তাঁর নাম নিয়ে গর্ব করার জন্য। সুতরাং তিনি যখন যে ফয়সালা দান করেন, সন্তুষ্টচিত্তে তা মেনে না নেওয়া হলে এ বিশ্বাসের কোনও সার্থকতা থাকে না। সেজন্যই এ আয়াতে তাঁর সিদ্ধান্ত মানার প্রতি জোর তাগিদ দেওয়া হয়েছে। এ তাগিদের দাবি হচ্ছে প্রত্যেকে তাঁর পূর্ণাঙ্গ আনুগত্যে বদ্ধপরিকর থাকবে, এমনকি তাঁর কোনও সিদ্ধান্ত যদি নিজ রুচি-অভিরুচির পরিপন্থীও হয়। তাঁর কোনও ফয়সালা মানতে গেলে যদি নিজ স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হয় কিংবা লোকসম্মুখে আপাতদৃষ্টিতে ছোট হতে হয়, তাও খুশিমনে তা মেনে নেওয়া চাই । কোনও সন্দেহ নেই তা মেনে নেওয়ার মধ্যেই গৌরব। তারই মধ্যে প্রকৃত মর্যাদা। নবীর ফয়সালা না মানা তাঁর অবাধ্যতা করার শামিল, যা ইসলাম ও মুসলমানিত্বের পরিপন্থী এবং প্রকৃতপক্ষে তা নিজ খেয়াল-খুশির গোলামী ও শয়তানের আনুগত্য। এর পরিণতিতে মানুষ গোমরাহীর শিকার হয়ে যায় ও সরল পথ থেকে বিচ্যুত হয়। এমনকি এটা মুনাফিকীরও আলামত। এ আয়াতের শানে নুযূলও সেদিকে ইঙ্গিত করে।
ইমাম কুরতুবী রহ. এ আয়াতের শানে নুযূল সম্পর্কে একটি ঘটনা বর্ণনা করেছেন। তাতে আছে, বিশর নামক জনৈক মুনাফিক ও এক ইয়াহুদীর মধ্যে কোনও এক বিষয়ে বিবাদ চলছিল। এর ফয়সালার জন্য ইয়াহুদী বলল, চল আমরা মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু "আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কাছে যাই। কারণ ইয়াহুদী জানত নবী কারীম সাল্লাল্লাহু "আলাইহি ওয়া সাল্লাম ন্যায়বিচারই করবেন এবং তা তার পক্ষেই যাবে। কেননা তার দাবি সঠিক ছিল। অপরদিকে বিশর বলল, না, আমরা কা'ব ইবন আশরাফের কাছে যাব। কা'ব ইবন আশরাফ ছিল ইয়াহুদীদের নেতা। কিন্তু ইয়াহুদীর অনড়। সে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছেই যাবে। অগত্যা বিশর তাতে রাজি হল। তারা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে গিয়ে আপন আপন বক্তব্য পেশ করল। তিনি ইয়াহুদীর পক্ষে রায় দিলেন। তাঁর সামনে বিশর তা মেনে নিলেও পরে তা প্রত্যাখ্যান করল। সে বলল, চল আমরা আবূ বকরের কাছে যাই। তিনিও একই রায় দিলেন। তখন সে বলল, চল 'উমরের কাছে যাই। তারা হযরত “উমর রাযি.-এর কাছে গিয়ে উপস্থিত হল। ইয়াহুদী হযরত উমর রাযি.-এর কাছে সম্পূর্ণ বৃত্তান্ত বর্ণনা করল। তিনি বিশরকে বললেন, সে যা বলছে তা সঠিক? বিশর বলল, হাঁ। তিনি বললেন, ঠিক আছে, তোমরা অপেক্ষা কর। আমি আসছি। তিনি ভেতর থেকে তরবারি নিয়ে আসলেন এবং বিশরকে এই বলে কতল করে ফেললেন যে, যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ফয়সালায় রাজি হয় না, তার ব্যাপারে এই হচ্ছে আমার ফয়সালা। এ অবস্থা দেখে ইয়াহুদী ভয়ে পালিয়ে গেল। তারই পরিপ্রেক্ষিতে এ আয়াত নাযিল হয়েছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম সব শুনে হযরত উমর রাযি.-কে লক্ষ্য করে বললেন, তুমি 'আল ফারূক'- সত্য ও মিথ্যার মধ্যে পার্থক্যকারী। তখন থেকেই হযরত উমর ফারূক রাযি, 'আল-ফারূক' উপাধিতে পরিচিতি লাভ করেন।কুরতুবী, আল-জামে লি আহকামিল কুরআন, ৫ম খণ্ড, ১৭০ পৃ.
প্রকাশ থাকে যে, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি এ নিঃশর্ত আনুগত্যের হুকুম কেবল তাঁর জীবদ্দশার জন্যই নির্দিষ্ট নয়; বরং তাঁর ওফাতের পরও এ হুকুম বলবৎ রয়েছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত বলবৎ থাকবে। এখন তাঁর আনুগত্য করার অর্থ হচ্ছে তাঁর জীবনাদর্শের অনুসরণ করা তথা জীবনের প্রতিটি কাজ কুরআন-সুন্নাহর নির্দেশনা মোতাবেক সম্পন্ন করা।

দুই নং আয়াত

إِنَّمَا كَانَ قَوْلَ الْمُؤْمِنِينَ إِذَا دُعُوا إِلَى اللَّهِ وَرَسُولِهِ لِيَحْكُمَ بَيْنَهُمْ أَنْ يَقُولُوا سَمِعْنَا وَأَطَعْنَا وَأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ (51)

অর্থ : মুমিনদেরকে যখন আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের দিকে ডাকা হয়, যাতে রাসূল তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দেন, তখন তাদের কথা কেবল এটাই হয় যে, তারা বলে আমরা (হুকুম) শুনলাম এবং মেনে নিলাম। আর তারাই সফলকাম।সূরা নূর (২৪), আয়াত ৫১

ব্যাখ্যা

এ আয়াতের আগের কয়েকটি আয়াতে মুনাফিকদের অবস্থা বর্ণিত হয়েছে। তাতে দেখানো হয়েছে যে, মুনাফিকরা মুখে তো বলে আমরা আল্লাহ ও তার রাসূলের প্রতি ঈমান এনেছি, কিন্তু যখন কোনও বিষয়ে কারও সঙ্গে তাদের দ্বন্দ্ব-কলহ দেখা দেয় আর তার মীমাংসার জন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে আসতে বলা হয়, তখন তারা তাতে সম্মত হয় না। কারণ তাদের জানা আছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু "আলাইহি ওয়া সাল্লাম ন্যয়বিচারই করবেন। তারা ঈমান আনার দাবি করায় ন্যায়- অন্যায় নির্বিচারে তাদের পক্ষে রায় দিয়ে দেবেন—এমন নয়। কাজেই তাঁর কাছে গেলে আমাদের স্বার্থ হাসিল হবে না। ফলে কোনও না কোনও বাহানায় তারা তাঁর কাছে যাওয়ার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করত। হাঁ, কোনও বিষয়ে যদি তাদের দাবি ন্যায্য হত, তখন আবার মীমাংসার জন্য খুব সহজেই তাঁর কাছে যেতে রাজি হয়ে যেত এবং তাঁকে ছাড়া অন্য কারও কাছে যাওয়ার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করত। তখন তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু "আলাইহি ওয়া সাল্লামের হুকুম মানা ও তাঁর আনুগত্য করার খুব জযবা দেখাত। কথা তো ছিল রায় নিজেদের পক্ষে যাক বা বিপক্ষে, সর্বাবস্থায়ই একমাত্র নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামকেই মীমাংসাকারী মানবে এবং সর্বান্তঃকরণে ফয়সালা মেনে নেবে। তারা যখন নিজেদেরকে মু'মিন বলে প্রকাশ করছে, তখন এরকমই তাদের নীতি হওয়া উচিত ছিল। কেননা এটাই ঈমানের দাবি।
মুনাফিকদের বিপরীতে আলোচ্য আয়াতে সাচ্চা মু'মিনদের নীতি তুলে ধরা হয়েছে। জানানো হয়েছে যে, কোনও বিষয়ে দ্বন্দ্ব-কলহ নিরসনের জন্য তাদেরকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের দিকে আসতে বলা হলে তৎক্ষণাৎ তারা রাজি হয়ে যায় এবং তিনি যে রায় দেন তা খুশিমনে মেনে নেয়। তারা বলে ওঠে, আমরা আপনার কথা শুনলাম এবং রায় মেনে নিলাম, তাতে বাহ্যিকভাবে আমাদের লাভ-লোকসান যাই হোক না কেন। এ আয়াত জানাচ্ছে, লাভ-লোকসানের তোয়াক্কা না করে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের ফয়সালা মেনে নেওয়ার মধ্যেই প্রকৃত সফলতা। সুতরাং এই সাচ্চা মু'মিনগণ অকুণ্ঠ আনুগত্য প্রকাশ দ্বারা সফল হয়ে গেছে। সে সফলতা দুনিয়ায়ও এবং আখিরাতেও। দুনিয়ায় এরূপ আনুগত্য দ্বারা সামাজিক শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হয় আর আখিরাতে জাহান্নাম থেকে মুক্তি পেয়ে জান্নাতের অধিকারী হওয়া যায়।
এ আয়াতে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের ফয়সালা মেনে নেওয়াকে মু'মিনদের কথা ও তাদের শান হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এর দ্বারা মৌলিকভাবে মুনাফিকদের বিপরীতে সাহাবায়ে কিরামের আদর্শ উল্লেখ করা হলেও সাধারণভাবে মুমিন শব্দের ব্যবহার লক্ষ করা যাচ্ছে। এর মধ্যে ইঙ্গিত রয়েছে যে, সব কালেই প্রকৃত মু'মিন হবে তারাই, যারা তাদের যাবতীয় দ্বন্দ্ব-কলহের ক্ষেত্রে আল্লাহ ও রাসূল তথা কুরআন-সুন্নাহ'র ফয়সালা মেনে নেবে। সুতরাং আমাদের জন্য এ আয়াতে অতি মূল্যবান শিক্ষা আছে এবং আছে কঠোর সতর্কবাণীও।
আল্লাহর ফায়সালায় আনুগত্য প্রকাশের শিক্ষণীয় দৃষ্টান্ত
হাদীছ নং : ১৬৮

হযরত আবূ হুরায়রা রাযি. বলেন, যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি (আয়াত) নাযিল হল-
لِلَّهِ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ وَإِنْ تُبْدُوا مَا فِي أَنْفُسِكُمْ أَوْ تُخْفُوهُ يُحَاسِبْكُمْ بِهِ اللَّهُ ….
[যা-কিছু আছে আকাশমণ্ডলে এবং যা-কিছু আছে পৃথিবীতে, সব আল্লাহরই। তোমাদের অন্তরে যা আছে, তা তোমরা প্রকাশ কর বা গোপন কর, আল্লাহ তোমাদের থেকে তার হিসাব নেবেন। অতঃপর যাকে ইচ্ছা তিনি ক্ষমা করবেন এবং যাকে ইচ্ছা শাস্তি দেবেন। আল্লাহ সর্ববিষয়ে শক্তিমান। -সূরা বাকারা, আয়াত ২৮৪
তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাহাবীগণের পক্ষে এটা খুব কঠিন মনে হল। ফলে তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট হাজির হলেন। তারপর নতজানু হয়ে বসে আরয করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমাদেরকে এমন এমন আমলের আদেশ করা হয়েছিল, যা আমরা পালন করার ক্ষমতা রাখি- নামায, জিহাদ, রোযা ও সদাকা । কিন্তু এখন তো আপনার প্রতি এ আয়াত নাযিল হল। অথচ আমরা এটা পালন করার ক্ষমতা রাখি না।
তাদের এ কথা শুনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তোমরা কি তোমাদের পূর্ববর্তী দুই আহলে কিতাব (ইয়াহুদী ও নাসারা)-এর মত বলতে চাচ্ছ যে, আমরা শুনলাম কিন্তু মানলাম না? বরং তোমরা বল, আমরা শুনলাম এবং মানলাম। হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা আপনার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করি এবং আপনারই কাছে প্রত্যাবর্তন।
যখন তারা এ কথা বললেন এবং তাদের জিহ্বা এতে আনুগত্য প্রকাশ করল, তখন এর পরই আল্লাহ তা'আলা নাযিল করলেন-
آمَنَ الرَّسُولُ بِمَا أُنْزِلَ إِلَيْهِ مِنْ رَبِّهِ وَالْمُؤْمِنُونَ كُلٌّ آمَنَ بِاللَّهِ وَمَلَائِكَتِهِ وَكُتُبِهِ وَرُسُلِهِ لَا نُفَرِّقُ بَيْنَ أَحَدٍ مِنْ رُسُلِهِ وَقَالُوا سَمِعْنَا وَأَطَعْنَا غُفْرَانَكَ رَبَّنَا وَإِلَيْكَ الْمَصِيرُ (285)
[রাসূল (অর্থাৎ হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সেই বিষয়ের প্রতি ঈমান এনেছে, যা তার ওপর তার প্রতিপালকের পক্ষ হতে নাযিল করা হয়েছে এবং (তার সাথে) মু'মিনগণও। তারা সকলে আল্লাহর প্রতি, তাঁর ফিরিশতাগণের প্রতি, তাঁর কিতাবসমূহের প্রতি এবং তাঁর রাসূলগণের প্রতি ঈমান এনেছে। (তারা বলে,) আমরা তাঁর রাসূলগণের মধ্যে কোনও পার্থক্য করি না। (যে, কারও প্রতি ঈমান আনব এবং কারও প্রতি আনব না)। এবং তাঁরা বলে, আমরা (আল্লাহ ও রাসূলের বিধানসমূহ মনোযোগ সহকারে) শুনেছি এবং তা (খুশিমনে) পালন করছি। হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা আপনার মাগফিরাতের ভিখারী, আর আপনারই কাছে আমাদের প্রত্যাবর্তন। -সূরা বাকারা, আয়াত ২৮৫
যখন তারা এটা করলেন (অর্থাৎ তাদেরকে যা বলতে বলা হয়েছিল তা বললেন), তখন আল্লাহ তা'আলা এটা রহিত করে দিলেন। তারপর আল্লাহ তা'আলা নাযিল করলেন-
لَا يُكَلِّفُ اللَّهُ نَفْسًا إِلَّا وُسْعَهَا لَهَا مَا كَسَبَتْ وَعَلَيْهَا مَا اكْتَسَبَتْ رَبَّنَا لَا تُؤَاخِذْنَا إِنْ نَسِينَا أَوْ أَخْطَأْنَا
[আল্লাহ কারও ওপর তার সাধ্যের বাইরে দায়িত্ব অর্পণ করেন না। তার কল্যাণ হবে সে কাজেই যা সে স্বেচ্ছায় করে এবং তার ক্ষতিও হবে সে কাজেই, যা সে স্বেচ্ছায় করে। (হে মুসলিমগণ! তোমরা আল্লাহর কাছে এই দু'আ কর যে,) হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের দ্বারা যদি কোনও ভুল-ত্রুটি হয়ে যায় তবে সেজন্য তুমি আমাদের পাকড়াও করো না।
তিনি বললেন, হাঁ (অর্থাৎ তোমাদের এ দু'আ কবুল করে নিলাম)।
তারপর তারা তিলাওয়াত করলেন-
رَبَّنَا وَلَا تَحْمِلْ عَلَيْنَا إِصْرًا كَمَا حَمَلْتَهُ عَلَى الَّذِينَ مِنْ قَبْلِنَا
[হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের প্রতি সেই রকমের দায়িত্বভার অর্পণ করো না, যেমন তা অর্পণ করেছিলে আমাদের পূর্ববর্তীদের প্রতি। তিনি বললেন, হাঁ (অর্থাৎ তোমাদের এ দু'আ কবুল করে নিলাম)।

তারপর তারা তিলাওয়াত করলেন-
رَبَّنَا وَلَا تُحَمِّلْنَا مَا لَا طَاقَةَ لَنَا بِهِ
[হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের ওপর এমন ভার চাপিয়ো না, যা বহন করার শক্তি আমাদের নেই।] তিনি বললেন, হাঁ (অর্থাৎ তোমাদের এ দু'আ কবুল করে নিলাম)।

তারপর তারা তিলাওয়াত করলেন-
وَاعْفُ عَنَّا وَاغْفِرْ لَنَا وَارْحَمْنَا أَنْتَ مَوْلَانَا فَانْصُرْنَا عَلَى الْقَوْمِ الْكَافِرِينَ (286)
[আমাদের (ত্রুটিসমূহ) মার্জনা কর, আমাদের ক্ষমা কর এবং আমাদের প্রতি দয়া কর। তুমিই আমাদের অভিভাবক ও সাহায্যকারী। সুতরাং কাফির সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে আমাদেরকে সাহায্য কর। -সূরা বাকারা, আয়াত ২৮৬
তিনি বললেন, হাঁ (অর্থাৎ তোমাদের এ দু'আ কবুল করে নিলাম) -মুসলিম। সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ১২৫; বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান, হাদীছ নং ৩২২
17 - باب في وجوب الانقياد لحكم الله وما يقوله من دُعِيَ إِلَى ذلِكَ وأُمِرَ بمعروف أَوْ نُهِيَ عن منكر

قَالَ الله تَعَالَى: {فَلا وَرَبِّكَ لا يُؤْمِنُونَ حَتَّى يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَيْنَهُمْ ثُمَّ لا يَجِدُوا فِي أَنْفُسِهِمْ حَرَجًا مِمَّا قَضَيْتَ وَيُسَلِّمُوا تَسْلِيمًا} [النساء: 65]، وَقالَ تَعَالَى: {إِنَّمَا كَانَ قَوْلَ الْمُؤْمِنِينَ إِذَا دُعُوا إِلَى اللهِ وَرَسُولِهِ لِيَحْكُمَ بَيْنَهُمْ أَنْ يَقُولُوا سَمِعْنَا وَأَطَعْنَا وَأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ} [النور: 51].
وفيه من الأحاديث: حديث أَبي هريرة المذكور (1) في أول الباب قبله وغيره من الأحاديث فِيهِ.
168 - عن أَبي هريرة - رضي الله عنه - قَالَ: لَمَّا نَزَلَتْ عَلَى رَسُول الله - صلى الله عليه وسلم: {للهِ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الأَرْضِ وَإِنْ تُبْدُوا مَا فِي أَنْفُسِكُمْ أَو تُخْفُوهُ يُحَاسِبْكُمْ بِهِ اللهُ} الآية [البقرة: 283] اشْتَدَّ ذلِكَ عَلَى أصْحَابِ رَسُول الله - صلى الله عليه وسلم - فَأتَوا رَسُول الله - صلى الله عليه وسلم - ثُمَّ بَرَكُوا عَلَى الرُّكَبِ، فَقَالُوا: أيْ (1) رسولَ الله، كُلِّفْنَا مِنَ الأَعمَالِ مَا نُطِيقُ: الصَّلاةَ والجِهَادَ والصِّيامَ والصَّدَقَةَ، وَقَدْ أُنْزِلَتْ عَلَيْكَ هذِهِ الآيَةُ وَلا نُطيقُها. قَالَ رَسُول الله - صلى الله عليه وسلم: «أتُرِيدُونَ أَنْ تَقُولُوا كَمَا قَالَ أَهْلُ الكتَابَينِ (2) مِنْ قَبْلِكُمْ: سَمِعْنَا وَعَصَيْنَا؟ بَلْ قُولُوا: سَمِعنَا وَأَطَعْنَا غُفْرَانَكَ رَبَّنَا وَإِلَيْكَ المَصِيرُ» فَلَمَّا اقْتَرَأَهَا (3) القومُ، وَذَلَّتْ بِهَا ألْسنَتُهُمْ أنْزَلَ اللهُ تَعَالَى في إثرِهَا: {آمَنَ الرَّسُولُ بِمَا أُنْزِلَ إِلَيْهِ مِنْ رَبِّهِ وَالْمُؤْمِنُونَ كُلٌّ آمَنَ بِاللهِ وَمَلائِكَتِهِ وَكُتُبِهِ وَرُسُلِهِ لا نُفَرِّقُ بَيْنَ أَحَدٍ مِنْ رُسُلِهِ وَقَالُوا سَمِعْنَا وَأَطَعْنَا غُفْرَانَكَ رَبَّنَا وَإِلَيْكَ الْمَصِيرُ} [البقرة: 285]. [ص:77] فَلَمَّا فَعَلُوا ذلِكَ نَسَخَهَا اللهُ تَعَالَى، فَأنزَلَ الله - عز وجل: {لا يُكَلِّفُ اللهُ نَفْسًا إِلاَّ وُسْعَهَا لَهَا مَا كَسَبَتْ وَعَلَيْهَا مَا اكْتَسَبَتْ رَبَّنَا لا تُؤَاخِذْنَا إِنْ نَسِينَا أَوْ أَخْطَأْنَا} [البقرة: 286] قَالَ: نَعَمْ {رَبَّنَا وَلا تَحْمِلْ عَلَيْنَا إِصْرًا كَمَا حَمَلْتَهُ عَلَى الَّذِينَ مِنْ قَبْلِنَا} قَالَ: نَعَمْ {رَبَّنَا وَلا تُحَمِّلْنَا مَا لا طَاقَةَ لَنَا بِه} قَالَ: نَعَمْ {وَاعْفُ عَنَّا وَاغْفِرْ لَنَا وَارْحَمْنَا أَنْتَ مَوْلانَا فَانْصُرْنَا عَلَى الْقَوْمِ الْكَافِرِينَ} قَالَ: نَعَمْ. رواه مسلم. (4)

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীছ দ্বারা আমরা জানতে পারি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম কী যত্নের সঙ্গে সাহাবায়ে কিরামকে ঈমান ও আমলের ওপর গড়ে তুলেছিলেন এবং সাহাবায়ে কিরামও কতটা আগ্রহ-উদ্দীপনার সঙ্গে তাঁর হুকুম মেনে চলতেন। সূরা বাকারার ২৮৪ নং আয়াতে যখন জানানো হল যে, তোমরা তোমাদের মনের যেসব বিষয় প্রকাশ কর এবং যা মনের মধ্যে গোপন রাখ সকল বিষয়ই আল্লাহ তা'আলা তোমাদের কাছ থেকে হিসাব নেবেন এবং তার বদলা দেবেন, তখন তাদের কাছে বিষয়টা একটু কঠিন মনে হল। কেননা তারা মনে করেছিলেন যে, মনের মধ্যে অনেক সময় অনিচ্ছাকৃত এমন এমন চিন্তাভাবনা এসে পড়ে, যা রোধ করা সম্ভব হয় না। এখন সেজন্যও যদি জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়, তবে তার অর্থ দাঁড়ায়- এ জাতীয় চিন্তাভাবনা কিছুতেই করা যাবে না। সে হিসেবে এটা এমন হুকুম হয়ে যায়, যা বান্দার পক্ষে পালন করা সম্ভব নয়। আর তা সম্ভব নয় বলে জিজ্ঞাসাবাদ থেকে বাঁচা ও এর শান্তি হতে আত্মরক্ষা করাও তো সম্ভব হবে না। তাহলে উপায় কী?

তারা এ সমস্যার নিরসনকল্পে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে আসলেন এবং অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে আরয করলেন যে, আমাদেরকে যে নামায, জিহাদ, রোযা ইত্যাদি বিধানগুলো পালন করতে আদেশ করা হয়েছে, তা পালন করতে তো আমরা সক্ষম। কিন্তু এ আয়াতে যে হুকুম করা হয়েছে তা পালনের ক্ষমতা আমাদের নেই। অর্থাৎ এখন আমাদের উপায় কী?

নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই বলে তাদেরকে মৃদু তিরস্কার করলেন যে, এটা তো ইয়াহুদী-খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের খাসলাত যে, আল্লাহর পক্ষ থেকে কোনও হুকুম আসলে তারা বলত, আমরা শুনলাম কিন্তু মানলাম না। তোমরাও কি সেরকম বলতে চাও নাকি? বরং তোমরা বল আমরা আপনার আদেশ শুনলাম এবং তা মেনে নিলাম। আর পালন করতে না পারার কারণে বল- আমরা আপনার কাছে ক্ষমা চাই। আমরা বিশ্বাস করি একদিন আপনার কাছে আমাদের ফিরে যেতে হবে। আমরা আশা করি সেদিন এ অক্ষমতার দরুন আপনি আমাদের নিষ্কৃতি দান করবেন।

নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম এভাবে সাহাবীগণকে শিক্ষা দিলেন যে, আল্লাহর পক্ষ থেকে কোনও হুকুম আসলে বান্দা হিসেবে আমাদের কর্তব্য সঙ্গে সঙ্গে তা মেনে নেওয়া। তা পালন করার ক্ষমতা আছে কি নেই বা তা পালন করার কী লাভ-লোকসান, সেদিকে ফিরে তাকানো বান্দার কাজ নয়। আল্লাহ যখন হুকুম দিয়েছেন তখন আমার একটাই কাজ সঙ্গে সঙ্গে সে হুকুম পালনে প্রস্তুত হয়ে যাওয়া। সাহাবীগণ তা-ই করলেন। তারা সঙ্গে সঙ্গে তাঁর এ হুকুম পালন করলেন এবং আন্তরিকভাবে এ কথাগুলো উচ্চারণ করলেন।

আল্লাহ তা'আলা তাঁর হুকুম পালনে তাদের এ তৎপরতা ও অকুন্ঠ আনুগত্য প্রকাশের কারণে তাদের প্রতি রাজিখুশি হয়ে গেলেন। সুতরাং তাদের প্রশংসা করে আয়াত নাযিল করলেন-
آمَنَ الرَّسُولُ...
[রাসূল (অর্থাৎ হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সেই বিষয়ের প্রতি ঈমান এনেছে, যা তার ওপর তার প্রতিপালকের পক্ষ হতে নাযিল করা হয়েছে এবং (তার সাথে) মু'মিনগণও। তারা সকলে আল্লাহর প্রতি, তাঁর ফিরিশতাগণের প্রতি, তাঁর কিতাবসমূহের প্রতি এবং তাঁর রাসূলগণের প্রতি ঈমান এনেছে। (তারা বলে,) আমরা তাঁর রাসূলগণের মধ্যে কোনও পার্থক্য করি না (যে, কারও প্রতি ঈমান আনব এবং কারও প্রতি আনব না)। এবং তাঁরা বলে, আমরা (আল্লাহ ও রাসূলের বিধানসমূহ মনোযোগ সহকারে) শুনেছি এবং তা (খুশিমনে) পালন করছি। হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা আপনার মাগফিরাতের ভিখারী, আর আপনারই কাছে আমাদের প্রত্যাবর্তন]।

মনের অনিচ্ছাকৃত ভাবনা ধর্তব্য না হওয়া
সাহাবীগণ যখন এরকম নিরঙ্কুশ আনুগত্য প্রকাশ করলেন, তখন তার পুরস্কারস্বরূপ আল্লাহ তা'আলা তাদের ভার লাঘব করে দিলেন। হাদীছে বলা হয়েছে যে, আগের বিধান রহিত করে দিলেন। অর্থাৎ আগের আয়াতে যে বলা হয়েছিল আল্লাহ তা'আলা মনের গোপন বিষয়েরও হিসাব নেবেন, যা দ্বারা বোঝা যাচ্ছিল- নিজের পক্ষে রোধ করা সম্ভব হয় না—এ জাতীয় যে ওয়াসওয়াসা ও মন্দ চিন্তাভাবনা কখনও কখনও মনের মধ্যে দেখা দেয়, সেজন্যও আল্লাহর দরবারে ধরপাকড় করা হবে, পরের আয়াত দ্বারা তা রহিত করে দেওয়া হয়। অর্থাৎ সেজন্য ধরপাকড় করা হবে না।

ইরশাদ হয়েছে-
لَا يُكَلِّفُ اللَّهُ نَفْسًا إِلَّا وُسْعَهَا
আল্লাহ কারও ওপর তার সাধ্যের বাইরে দায়িত্ব অর্পণ করেন না।' সুতরাং অনিচ্ছাকৃতভাবে মনের মধ্যে যে ওয়াসওয়াসা ও মন্দ চিন্তাভাবনা এসে পড়ে, তা যেহেতু বান্দার সাধ্যের অতীত, তাই তা থেকে বিরত থাকার হুকুম বান্দাকে দেওয়া হয়নি। হাঁ, বান্দা যদি ইচ্ছাকৃতভাবে অনুচিত চিন্তাভাবনা করে, তবে সেজন্য তাকে অবশ্যই ধরা হবে, যেমনটা এ আয়াতেই এর পরবর্তী অংশে বলা হয়েছে। কাজেই তা থেকে বিরত থাকা জরুরি।

বলা যেতে পারে- এ আয়াত দ্বারা আগের আয়াতের ব্যাখ্যা করে দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ মনের যে গোপন বিষয় সম্পর্কে হিসাব নেওয়া হবে বলে ওই আয়াতে জানানো হয়েছে, তার মানে ওইসকল অনিচ্ছাকৃত চিন্তাভাবনা নয়, যা ঠেকানোর কোনও ক্ষমতা বান্দার নেই, যেমনটা সাহাবায়ে কিরাম বুঝেছিলেন; বরং এমনসব চিন্তা, যা মানুষ ইচ্ছাকৃত করে থাকে এবং যা ঠেকানোর ক্ষমতাও তাদের আছে। অর্থাৎ মানুষ ইচ্ছাকৃতভাবে ভালো-মন্দ যা-কিছু চিন্তা করতে পারে কিংবা কোনও কাজ করা বা না করার সংকল্প করে, তা যেহেতু বান্দার সাধ্যের ভেতর, তাই এ ব্যাপারে শরী'আতের বিধানও আছে। সে চিন্তা ও সংকল্প শরী'আতসম্মত হলে ছাওয়াব পাবে আর শরী'আতসম্মত না হলে সেজন্য তাকে ধরা হবে।

তো মনের কোন্ গোপনীয় বিষয় সম্পর্কে ধরা হবে এবং কোনটা ধরা হবে না, তা ব্যাখ্যা করে দেওয়াকেই 'রহিত করা' বলা হয়েছে, যেহেতু এর দ্বারা অনিচ্ছাকৃত চিন্তা শর'ঈ বিধানের আওতা থেকে খারিজ হয়ে গেছে।

এ হাদীছে সাহাবায়ে কিরামের যে দু'আ বর্ণিত হয়েছে তার প্রত্যেকটি বিষয়ের জবাবে আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকে কবুল করার ঘোষণা দিয়ে দেওয়া হয়েছে। তার মধ্যে একটি বিষয় হচ্ছে-
رَبَّنَا لَا تُؤَاخِذْنَا إِنْ نَسِينَا أَوْ أَخْطَأْنَا
[হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের দ্বারা যদি কোনও ভুল-ত্রুটি হয়ে যায় তবে সেজন্য তুমি আমাদের পাকড়াও করো না।]
আল্লাহ তা'আলা এ দু'আও কবুল করেছেন। এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
إِنَّ اللَّهَ تَجَاوَزَ عَنْ أُمَّتِي الْخَطَأ وَالنِّسْيَان
"নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা আমার উম্মতের অনিচ্ছাকৃত ত্রুটি ও বিস্মৃতিজনিত ভুল ক্ষমা করে দিয়েছেন।" (সহীহ ইবন হিব্বান, হাদীছ নং ৭২১৯; আত-তাবারানী, আল-মু'জামুস সগীর, হাদীছ নং ৭৬৫: সুনানে ইবন মাজাহ, হাদীছ নং ২০৪৪; মুসতাদরাক হাকিম, হাদীছ নং ২৮০১) অর্থাৎ এ জাতীয় ভুল-ত্রুটির কারণে কোনও পাপ হয় না। যেমন ইচ্ছাকৃত নামায কাযা করা কঠিন পাপ। কিন্তু কারও যদি কোনও কারণে নামাযের কথা মনেই না থাকে, ফলে নামায কাযা হয়ে যায়, তবে এজন্য তার কোনও গুনাহ হয় না, যদিও তা পড়ে নিতে হয়। এমনিভাবে কুলি করতে গিয়ে যদি কারও গলার ভেতর পানি চলে যায় কিংবা কোনও শিকারকে গুলি করতে গিয়ে তা কোনও মানুষের গায়ে লেগে যায়, তবে এটা অনিচ্ছাকৃত ত্রুটি। এজন্য তার গুনাহ হবে না, যদিও তার রোযা কাযা করতে হবে এবং গুলিবিদ্ধ ব্যক্তির বিপরীতে অর্থদণ্ড আদায় করতে হবে।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. এ হাদীছটি আল্লাহর প্রতি নিঃশর্ত আনুগত্য প্রকাশের শিক্ষাদান করে। অর্থাৎ আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকে কোনও হুকুম এসে যাওয়ার পর বান্দার কর্তব্য বিনাবাক্যে তা মেনে নেওয়া।

খ. এ হাদীছ দ্বারা জানা যায় সাহাবায়ে কিরাম আখিরাতের জবাবদিহিতার ব্যাপারে কতটা সচেতন ছিলেন। আখিরাতে যাতে জবাবদিহিতা থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া যায়, সেজন্য তারা সর্বোচ্চ পর্যায়ে সচেষ্ট থাকতেন। আখিরাতে মুক্তিলাভের আশায় আমাদেরও কর্তব্য অন্তরে সে সচেতনতা জাগ্রত রাখা।

গ. দীন ও শরী'আতের কোনও বিষয়ে অন্তরে খটকা জাগলে কোনও বিজ্ঞ আলেমের কাছে গিয়ে তা নিরসনের চেষ্টা করা উচিত, যেমন সাহাবায়ে কিরাম নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে গিয়ে তা করেছিলেন।

ঘ. সাহাবীগণ সন্দেহ নিরসনের জন্য নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের সামনে গিয়ে নতজানু হয়ে বসেছেন। এর দ্বারা বোঝা যায় আলেমের কাছে কোনওকিছু জিজ্ঞাসা করার সময় আদব বজায় রাখা উচিত।

ঙ. আল্লাহর হুকুম অকুণ্ঠচিত্তে মেনে নিলে কেবল আখিরাতেই নয়, দুনিয়ায়ও নগদ পুরস্কার পাওয়া যায়। যেমন সাহাবায়ে কিরাম যখন আল্লাহর হুকুম শিরোধার্য করে নিলেন, তখন তাদের প্রশংসায় আয়াত নাযিল হয় এবং তাদের মনের ভার লাঘব করে স্বস্তি ও প্রশান্তি দিয়ে দেওয়া হয়। সেইসঙ্গে তাদের পরকালীন পুরস্কার তো রয়েছেই।

চ. অন্তরে অনিচ্ছাকৃত যে ওয়াসওয়াসা দেখা দেয় তা নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে নেই, কারণ তা মাফ। হাঁ, ইচ্ছাকৃত চিন্তাভাবনা ও জল্পনাকল্পনা যাতে কিছুতেই শরী'আতবিরোধী না হয় সে ব্যাপারে সতর্ক থাকা জরুরি। কেননা সে ব্যাপারে ধরা হবে।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:বিশুদ্ধ (পারিভাষিক সহীহ)
রিয়াযুস সালিহীন - হাদীস নং ১৬৮ | মুসলিম বাংলা