রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ
ভূমিকা অধ্যায়
হাদীস নং: ১৬৪
সুন্নত ও তার আদবসমূহ রক্ষায় যত্নবান থাকার আদেশ।
খানা খাওয়ার কয়েকটি আদব
হাদীছ নং : ১৬৪
হযরত জাবির রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম আঙ্গুল ও থালা চেটে খাওয়ার আদেশ করেছেন এবং বলেছেন, তোমরা জান না তার কোথায় বরকত আছে. মুসলিম।
মুসলিমের অপর এক বর্ণনায় আছে, তোমাদের কারও খাদ্যের লোকমা পড়ে গেলে সে যেন তা তুলে নেয় এবং তাতে কোনও ময়লা থাকলে তা পরিষ্কার করে নেয়, তারপর তা খেয়ে ফেলে। সে যেন তা শয়তানের জন্য রেখে না দেয়। আর সে যেন আঙ্গুল চেটে না খাওয়া পর্যন্ত নিজ হাত রুমাল দিয়ে না মোছে। কেননা সে জানে না তার খাদ্যের কোন অংশে বরকত আছে।
মুসলিমের অপর এক বর্ণনায় আছে, নিশ্চয়ই শয়তান তোমাদের প্রত্যেকের নিকট তার প্রতিটি ব্যাপারে উপস্থিত হয়। এমনকি সে তার খাবার সময়ও তার কাছে হাজির হয়। সুতরাং তোমাদের কারও থেকে যদি লোকমা পড়ে যায়, তবে সে যেন তার ময়লা পরিষ্কার করে তা খেয়ে নেয় আর শয়তানের জন্য তা ফেলে না রাখে। (সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ২০৩৩; সুনানে ইবন মাজাহ, হাদীছ নং ৩২৭০; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ১৪২৫৯)
হাদীছ নং : ১৬৪
হযরত জাবির রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম আঙ্গুল ও থালা চেটে খাওয়ার আদেশ করেছেন এবং বলেছেন, তোমরা জান না তার কোথায় বরকত আছে. মুসলিম।
মুসলিমের অপর এক বর্ণনায় আছে, তোমাদের কারও খাদ্যের লোকমা পড়ে গেলে সে যেন তা তুলে নেয় এবং তাতে কোনও ময়লা থাকলে তা পরিষ্কার করে নেয়, তারপর তা খেয়ে ফেলে। সে যেন তা শয়তানের জন্য রেখে না দেয়। আর সে যেন আঙ্গুল চেটে না খাওয়া পর্যন্ত নিজ হাত রুমাল দিয়ে না মোছে। কেননা সে জানে না তার খাদ্যের কোন অংশে বরকত আছে।
মুসলিমের অপর এক বর্ণনায় আছে, নিশ্চয়ই শয়তান তোমাদের প্রত্যেকের নিকট তার প্রতিটি ব্যাপারে উপস্থিত হয়। এমনকি সে তার খাবার সময়ও তার কাছে হাজির হয়। সুতরাং তোমাদের কারও থেকে যদি লোকমা পড়ে যায়, তবে সে যেন তার ময়লা পরিষ্কার করে তা খেয়ে নেয় আর শয়তানের জন্য তা ফেলে না রাখে। (সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ২০৩৩; সুনানে ইবন মাজাহ, হাদীছ নং ৩২৭০; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ১৪২৫৯)
16 - باب في الأمر بالمحافظة على السنة وآدابها
164 - التاسع: عَنْهُ: أنَّ رَسُول الله - صلى الله عليه وسلم - أَمَرَ بِلَعْقِ (1) الأَصَابِعِ وَالصَّحْفَةِ (2)، وَقَالَ: «إنَّكُمْ لا تَدْرونَ في أَيِّها البَرَكَةُ». رواه مسلم. (3)
وفي رواية لَهُ: «إِذَا وَقَعَتْ لُقْمَةُ أَحَدِكُمْ فَلْيَأخُذْهَا، فَليُمِطْ مَا كَانَ بِهَا مِنْ أذىً، وَلْيَأكُلْهَا وَلاَ يَدَعْهَا لِلشَّيطَانِ، وَلا يَمْسَحْ يَدَهُ بالمنْدِيلِ حَتَّى يَلْعَقَ أصَابعَهُ فَإِنَّهُ لاَ يَدْرِي في أيِّ طَعَامِهِ البَرَكَةُ».
وفي رواية لَهُ: «إنَّ الشَّيطَانَ يَحْضُرُ أَحَدَكُمْ عِنْدَ كُلِّ شَيءٍ مِنْ شَأنِهِ، حَتَّى يَحْضُرَهُ عِنْدَ طَعَامِهِ، فَإذَا سَقَطَتْ مِنْ أَحَدِكُمْ اللُّقْمَةُ فَليُمِطْ مَا كَانَ بِهَا مِنْ أذَىً، فَلْيَأكُلْهَا وَلاَ يَدَعْهَا لِلشَّيطَانِ».
وفي رواية لَهُ: «إِذَا وَقَعَتْ لُقْمَةُ أَحَدِكُمْ فَلْيَأخُذْهَا، فَليُمِطْ مَا كَانَ بِهَا مِنْ أذىً، وَلْيَأكُلْهَا وَلاَ يَدَعْهَا لِلشَّيطَانِ، وَلا يَمْسَحْ يَدَهُ بالمنْدِيلِ حَتَّى يَلْعَقَ أصَابعَهُ فَإِنَّهُ لاَ يَدْرِي في أيِّ طَعَامِهِ البَرَكَةُ».
وفي رواية لَهُ: «إنَّ الشَّيطَانَ يَحْضُرُ أَحَدَكُمْ عِنْدَ كُلِّ شَيءٍ مِنْ شَأنِهِ، حَتَّى يَحْضُرَهُ عِنْدَ طَعَامِهِ، فَإذَا سَقَطَتْ مِنْ أَحَدِكُمْ اللُّقْمَةُ فَليُمِطْ مَا كَانَ بِهَا مِنْ أذَىً، فَلْيَأكُلْهَا وَلاَ يَدَعْهَا لِلشَّيطَانِ».
হাদীসের ব্যাখ্যা:
এ হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম খানা খাওয়ার কয়েকটি আদব শিক্ষা দিয়েছেন। যথা :
এক. খানা খাওয়া শেষে আঙ্গুল চেটে খাওয়া, যাতে খাদ্যের কোনও অংশ আঙ্গুলে থেকে না যায়।
দুই. থালা, বাসন ইত্যাদি চেটে পরিষ্কার করে খাওয়া।
তিন. খাদ্যের কিছু অংশ পড়ে গেলে তা তুলে নিয়ে খেয়ে ফেলা।
চার. পড়ে যাওয়া খাদ্যে ময়লা থাকলে তা পরিষ্কার করে খাওয়া।
পাঁচ আঙ্গুলে লেগে থাকা খাদ্যাংশ চেটে না খাওয়া পর্যন্ত হাত না মোছা।
এগুলো খানা খাওয়ার সুন্নত ও আদব। আমরা অবশ্যই এগুলো পালনের চেষ্টা করব। তা পালন করলে যেমন অনেক ছাওয়াব হবে, তেমনি লাভ হবে বরকত ও নূর। হালাল খাদ্যে যে এক বিশেষ নূর আছে এবং হারাম ও সন্দেহযুক্ত খাদ্যে আছে জুলমাত বা অন্ধকার, তা আল্লাহওয়ালাদের অভিজ্ঞতা দ্বারা প্রমাণিত। আমাদের নূরানী দিল নেই বলে তা অনুভব করতে পারি না।
এ আদবসমূহ শিক্ষা নিতে গিয়ে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কয়েকটি বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। তার মধ্যে একটি হচ্ছে খাদ্যের বরকত।
খাদ্যে বরকত কী ও কিভাবে
'বরকত'-এর শাব্দিক অর্থ বৃদ্ধি। এ বৃদ্ধি কখনও প্রকাশ্যভাবে হয়, যা চোখে দেখতে পাওয়া যায়। আবার কখনও হয় গুপ্তভাবে, যা চোখে দেখতে পাওয়া যায় না। পরিভাষায় কোনও জিনিসের বরকত বলতে সেই জিনিসটি ব্যবহারের যা উদ্দেশ্য তা যথাযথভাবে পূরণ হওয়া। সুতরাং খাদ্যের বরকত হচ্ছে ক্ষুধা মেটা, শরীরে শক্তি ও পুষ্টি লাভ হওয়া, মুখে খাদ্যের স্বাদ অনুভূত হওয়া এবং খাবার খেয়ে পরিতৃপ্তি লাভ হওয়া ইত্যাদি।
এ বরকত মূলত লাভ হয় অদৃশ্যভাবে আল্লাহর কুদরতে। আল্লাহ তা'আলা বান্দাকে তা দান করেন ঈমান ও তাকওয়ার ভিত্তিতে। এজন্যই যে ব্যক্তি প্রকৃত মু'মিন, সামান্য একটু খাবার খেয়েও উপরে বর্ণিত খাদ্যের উদ্দেশ্যসমূহ তার অর্জিত হয়ে যায়। অর্থাৎ অল্প খাবারেই তার পেট ভরে যায় এবং সে পরিতৃপ্তি লাভ করে। সামান্য একটু খাবারেই তার শরীরে যথেষ্ট শক্তি অর্জিত হয়। সাহাবায়ে কিরাম সম্পর্কে বর্ণিত আছে, এক- একটি খেজুর খেয়ে তাঁরা অমিত বিক্রমে যুদ্ধ করতেন। এটা বরকতেরই ফল। যার মধ্যে তাকওয়া-পরহেযগারী নেই সে এ বরকত থেকে বঞ্চিত থাকে। ফলে অনেক খেয়েও তার তৃপ্তি হয় না। ভালো দামী খাবারেও সে স্বাদ পায় না। ভালো ভালো খাবার খায়, অথচ শরীরে শক্তি পায় না। যে খাবারে নানারকম উপকার লাভ হওয়ার কথা, তার জন্য তা বিভিন্ন ক্ষতির কারণ হয়ে যায়। তা এ কারণেই হয় যে, তার খাবারে বরকত থাকে না।
বরকত সম্পর্কে বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন- রিয়াযুস সালেহীন, ১ম খণ্ড, ২৯৯-
৩০১ পৃষ্ঠা ৷
খাদ্যে বরকত যেহেতু আল্লাহ তা'আলার দান, তাই তিনি তা চাইলে পাত্রের সম্পূর্ণ খাদ্যের মধ্যেও দিতে পারেন এবং বিশেষ কোনও অংশেও দিতে পারেন। কিভাবে দেবেন তা তিনিই জানেন, আমাদের জানা নেই। যেহেতু আমাদের জানা নেই তাই পাত্রের সব খাবারকেই মর্যাদা দেওয়া উচিত। যে খাদ্য আঙ্গুলে লেগে আছে কিংবা যা নিচে পড়ে গেছে তাও গুরুত্বের সঙ্গে খাওয়া উচিত, যেমনটা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন। কেননা হতে পারে আল্লাহপ্রদত্ত বরকত তার মধ্যেই আছে।
খাওয়ার সময় শয়তানের উপস্থিতি
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম দ্বিতীয় যে বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন তা হচ্ছে শয়তানের উপস্থিতি। তিনি এ হাদীছে জানিয়েছেন, শয়তান মানুষের সকল বিষয়েই হাজির হয়ে যায়। শয়তান মানুষের ঘোর শত্রু। মানুষ যখন যে হালে থাকে তাতেই শরীক হয়ে মানুষের ক্ষতি করার চেষ্টা করে। সে ক্ষতি যাতে করতে না পারে তাই নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিভিন্ন দু'আ শিক্ষা দিয়েছেন। সে দু'আ পড়ার দ্বারা শয়তানের ক্ষতি থেকে আত্মরক্ষা করা যায়। তিনি যে সুন্নত ও আদব শিক্ষা দিয়েছেন তা পালনও শয়তানের ক্ষতি থেকে বাঁচার এক উত্তম উপায়, যেমন এ হাদীছে পড়ে যাওয়া খাদ্য তুলে খেতে বলা হয়েছে। তা তুলে না খেলে শয়তান নিয়ে নেবে। হয় তা সে নিজে খাবে, কিংবা তা দ্বারা মানুষের কোনও ক্ষতি করার চেষ্টা করবে। যদি সে নিজে খায়ও, তাও তো মু'মিনদের জন্য এক প্রকার ক্ষতিই বটে। কেননা শত্রুর খেয়ে-দেয়ে পরিপুষ্ট হওয়াটাও ক্ষতির কারণ বৈ কি।
খানা খাওয়া বা অন্য কোনও কাজের সময় শয়তানের উপস্থিতি আমরা টের না পেলেও এ হাদীছ যখন বলছে সে উপস্থিত হয়, তখন আমাদেরকে তা বিশ্বাস করতেই হবে। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে প্রমাণিত প্রতিটি কথা বিশ্বাস করা ঈমানের জন্য জরুরি। আমরা দেখতে পাই না বলে সন্দেহ করার কোনও সুযোগ নেই।
শয়তানকে এভাবেই সৃষ্টি করা হয়েছে যে, সে আমাদের কাছে থেকেও চোখের আড়াল থাকে। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-
إِنَّهُ يَرَاكُمْ هُوَ وَقَبِيلُهُ مِنْ حَيْثُ لَا تَرَوْنَهُمْ
অর্থ : সে ও তার দল এমন স্থান থেকে তোমাদেরকে দেখে, যেখান থেকে তোমরা তাদেরকে দেখতে পাও না। সূরা আ'রাফ (৭), আয়াত ২৭
আল্লাহ তা'আলা আমাদেরকে কুচক্রী শয়তান ও তার চেলাদের অনিষ্ট থেকে হেফাজত করুন।
পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার প্রতি তাকিদ
পড়ে যাওয়া খাদ্য তুলে খাওয়ার হুকুম দিতে গিয়ে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ কথাও বলেছেন যে, তাতে ময়লা লেগে থাকলে তা পরিষ্কার করে নেবে। এটা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার প্রতি ইসলামের বিশেষ গুরুত্বদানের প্রমাণ বহন করে। ইসলামে পাক-পবিত্রতার পাশাপাশি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতায় যত্নবান থাকার প্রতিও তাগিদ রয়েছে। পড়ে যাওয়া খাদ্য যখন পরিষ্কার করে খেতে বলা হয়েছে, তখন যে-কোনও খাদ্য খাওয়ার আগেও যে তার পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার প্রতি লক্ষ রাখা বাঞ্ছনীয় তা স্বাভাবিকভাবেই বোঝা যায়। খাদ্যসহ যাবতীয় বিষয়ে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা রক্ষার নির্দেশনা সম্পর্কে বিভিন্ন হাদীছ রয়েছে। তা সত্ত্বেও এ ব্যাপারে আমাদের মধ্যে একরকম অবহেলা লক্ষ করা যায়। এটা বিচ্ছিন্ন কোনও বিষয় নয়; বরং নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শিক্ষা অনুসরণে আমাদের সামগ্রিক গাফলাতিরই অংশ। দোজাহানের কল্যাণ ও সফলতা নিশ্চিত করতে হলে এ গাফলাতি ঝেড়ে ফেলতেই হবে। আল্লাহ তা'আলা আমাদের তাওফীক দান করুন।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. এ হাদীছ দ্বারা খানা খাওয়ার বিভিন্ন আদব জানা যায়। আমরা অবশ্যই তা রক্ষায় যত্নবান থাকব।
খ. খাদ্যেও বরকত আছে। সুন্নত মোতাবেক খাওয়ার দ্বারাই সে বরকত লাভ করা সম্ভব।
গ. খাদ্যেও শয়তান শরীক থাকার চেষ্টা করে। সে যাতে তাতে সক্ষম না হয় সেজন্য সুন্নত মোতাবেক খাওয়া উচিত।
ঘ. আঙ্গুল ও পাত্র চেটে খাওয়া এবং পড়ে যাওয়া খাবার তুলে খাওয়া যখন সুন্নত, তখন লোকে কী-না কী বলে – সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে গৌরবের সঙ্গেই এ সুন্নত পালন করা চাই।
এক. খানা খাওয়া শেষে আঙ্গুল চেটে খাওয়া, যাতে খাদ্যের কোনও অংশ আঙ্গুলে থেকে না যায়।
দুই. থালা, বাসন ইত্যাদি চেটে পরিষ্কার করে খাওয়া।
তিন. খাদ্যের কিছু অংশ পড়ে গেলে তা তুলে নিয়ে খেয়ে ফেলা।
চার. পড়ে যাওয়া খাদ্যে ময়লা থাকলে তা পরিষ্কার করে খাওয়া।
পাঁচ আঙ্গুলে লেগে থাকা খাদ্যাংশ চেটে না খাওয়া পর্যন্ত হাত না মোছা।
এগুলো খানা খাওয়ার সুন্নত ও আদব। আমরা অবশ্যই এগুলো পালনের চেষ্টা করব। তা পালন করলে যেমন অনেক ছাওয়াব হবে, তেমনি লাভ হবে বরকত ও নূর। হালাল খাদ্যে যে এক বিশেষ নূর আছে এবং হারাম ও সন্দেহযুক্ত খাদ্যে আছে জুলমাত বা অন্ধকার, তা আল্লাহওয়ালাদের অভিজ্ঞতা দ্বারা প্রমাণিত। আমাদের নূরানী দিল নেই বলে তা অনুভব করতে পারি না।
এ আদবসমূহ শিক্ষা নিতে গিয়ে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কয়েকটি বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। তার মধ্যে একটি হচ্ছে খাদ্যের বরকত।
খাদ্যে বরকত কী ও কিভাবে
'বরকত'-এর শাব্দিক অর্থ বৃদ্ধি। এ বৃদ্ধি কখনও প্রকাশ্যভাবে হয়, যা চোখে দেখতে পাওয়া যায়। আবার কখনও হয় গুপ্তভাবে, যা চোখে দেখতে পাওয়া যায় না। পরিভাষায় কোনও জিনিসের বরকত বলতে সেই জিনিসটি ব্যবহারের যা উদ্দেশ্য তা যথাযথভাবে পূরণ হওয়া। সুতরাং খাদ্যের বরকত হচ্ছে ক্ষুধা মেটা, শরীরে শক্তি ও পুষ্টি লাভ হওয়া, মুখে খাদ্যের স্বাদ অনুভূত হওয়া এবং খাবার খেয়ে পরিতৃপ্তি লাভ হওয়া ইত্যাদি।
এ বরকত মূলত লাভ হয় অদৃশ্যভাবে আল্লাহর কুদরতে। আল্লাহ তা'আলা বান্দাকে তা দান করেন ঈমান ও তাকওয়ার ভিত্তিতে। এজন্যই যে ব্যক্তি প্রকৃত মু'মিন, সামান্য একটু খাবার খেয়েও উপরে বর্ণিত খাদ্যের উদ্দেশ্যসমূহ তার অর্জিত হয়ে যায়। অর্থাৎ অল্প খাবারেই তার পেট ভরে যায় এবং সে পরিতৃপ্তি লাভ করে। সামান্য একটু খাবারেই তার শরীরে যথেষ্ট শক্তি অর্জিত হয়। সাহাবায়ে কিরাম সম্পর্কে বর্ণিত আছে, এক- একটি খেজুর খেয়ে তাঁরা অমিত বিক্রমে যুদ্ধ করতেন। এটা বরকতেরই ফল। যার মধ্যে তাকওয়া-পরহেযগারী নেই সে এ বরকত থেকে বঞ্চিত থাকে। ফলে অনেক খেয়েও তার তৃপ্তি হয় না। ভালো দামী খাবারেও সে স্বাদ পায় না। ভালো ভালো খাবার খায়, অথচ শরীরে শক্তি পায় না। যে খাবারে নানারকম উপকার লাভ হওয়ার কথা, তার জন্য তা বিভিন্ন ক্ষতির কারণ হয়ে যায়। তা এ কারণেই হয় যে, তার খাবারে বরকত থাকে না।
বরকত সম্পর্কে বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন- রিয়াযুস সালেহীন, ১ম খণ্ড, ২৯৯-
৩০১ পৃষ্ঠা ৷
খাদ্যে বরকত যেহেতু আল্লাহ তা'আলার দান, তাই তিনি তা চাইলে পাত্রের সম্পূর্ণ খাদ্যের মধ্যেও দিতে পারেন এবং বিশেষ কোনও অংশেও দিতে পারেন। কিভাবে দেবেন তা তিনিই জানেন, আমাদের জানা নেই। যেহেতু আমাদের জানা নেই তাই পাত্রের সব খাবারকেই মর্যাদা দেওয়া উচিত। যে খাদ্য আঙ্গুলে লেগে আছে কিংবা যা নিচে পড়ে গেছে তাও গুরুত্বের সঙ্গে খাওয়া উচিত, যেমনটা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন। কেননা হতে পারে আল্লাহপ্রদত্ত বরকত তার মধ্যেই আছে।
খাওয়ার সময় শয়তানের উপস্থিতি
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম দ্বিতীয় যে বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন তা হচ্ছে শয়তানের উপস্থিতি। তিনি এ হাদীছে জানিয়েছেন, শয়তান মানুষের সকল বিষয়েই হাজির হয়ে যায়। শয়তান মানুষের ঘোর শত্রু। মানুষ যখন যে হালে থাকে তাতেই শরীক হয়ে মানুষের ক্ষতি করার চেষ্টা করে। সে ক্ষতি যাতে করতে না পারে তাই নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিভিন্ন দু'আ শিক্ষা দিয়েছেন। সে দু'আ পড়ার দ্বারা শয়তানের ক্ষতি থেকে আত্মরক্ষা করা যায়। তিনি যে সুন্নত ও আদব শিক্ষা দিয়েছেন তা পালনও শয়তানের ক্ষতি থেকে বাঁচার এক উত্তম উপায়, যেমন এ হাদীছে পড়ে যাওয়া খাদ্য তুলে খেতে বলা হয়েছে। তা তুলে না খেলে শয়তান নিয়ে নেবে। হয় তা সে নিজে খাবে, কিংবা তা দ্বারা মানুষের কোনও ক্ষতি করার চেষ্টা করবে। যদি সে নিজে খায়ও, তাও তো মু'মিনদের জন্য এক প্রকার ক্ষতিই বটে। কেননা শত্রুর খেয়ে-দেয়ে পরিপুষ্ট হওয়াটাও ক্ষতির কারণ বৈ কি।
খানা খাওয়া বা অন্য কোনও কাজের সময় শয়তানের উপস্থিতি আমরা টের না পেলেও এ হাদীছ যখন বলছে সে উপস্থিত হয়, তখন আমাদেরকে তা বিশ্বাস করতেই হবে। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে প্রমাণিত প্রতিটি কথা বিশ্বাস করা ঈমানের জন্য জরুরি। আমরা দেখতে পাই না বলে সন্দেহ করার কোনও সুযোগ নেই।
শয়তানকে এভাবেই সৃষ্টি করা হয়েছে যে, সে আমাদের কাছে থেকেও চোখের আড়াল থাকে। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-
إِنَّهُ يَرَاكُمْ هُوَ وَقَبِيلُهُ مِنْ حَيْثُ لَا تَرَوْنَهُمْ
অর্থ : সে ও তার দল এমন স্থান থেকে তোমাদেরকে দেখে, যেখান থেকে তোমরা তাদেরকে দেখতে পাও না। সূরা আ'রাফ (৭), আয়াত ২৭
আল্লাহ তা'আলা আমাদেরকে কুচক্রী শয়তান ও তার চেলাদের অনিষ্ট থেকে হেফাজত করুন।
পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার প্রতি তাকিদ
পড়ে যাওয়া খাদ্য তুলে খাওয়ার হুকুম দিতে গিয়ে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ কথাও বলেছেন যে, তাতে ময়লা লেগে থাকলে তা পরিষ্কার করে নেবে। এটা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার প্রতি ইসলামের বিশেষ গুরুত্বদানের প্রমাণ বহন করে। ইসলামে পাক-পবিত্রতার পাশাপাশি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতায় যত্নবান থাকার প্রতিও তাগিদ রয়েছে। পড়ে যাওয়া খাদ্য যখন পরিষ্কার করে খেতে বলা হয়েছে, তখন যে-কোনও খাদ্য খাওয়ার আগেও যে তার পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার প্রতি লক্ষ রাখা বাঞ্ছনীয় তা স্বাভাবিকভাবেই বোঝা যায়। খাদ্যসহ যাবতীয় বিষয়ে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা রক্ষার নির্দেশনা সম্পর্কে বিভিন্ন হাদীছ রয়েছে। তা সত্ত্বেও এ ব্যাপারে আমাদের মধ্যে একরকম অবহেলা লক্ষ করা যায়। এটা বিচ্ছিন্ন কোনও বিষয় নয়; বরং নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শিক্ষা অনুসরণে আমাদের সামগ্রিক গাফলাতিরই অংশ। দোজাহানের কল্যাণ ও সফলতা নিশ্চিত করতে হলে এ গাফলাতি ঝেড়ে ফেলতেই হবে। আল্লাহ তা'আলা আমাদের তাওফীক দান করুন।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. এ হাদীছ দ্বারা খানা খাওয়ার বিভিন্ন আদব জানা যায়। আমরা অবশ্যই তা রক্ষায় যত্নবান থাকব।
খ. খাদ্যেও বরকত আছে। সুন্নত মোতাবেক খাওয়ার দ্বারাই সে বরকত লাভ করা সম্ভব।
গ. খাদ্যেও শয়তান শরীক থাকার চেষ্টা করে। সে যাতে তাতে সক্ষম না হয় সেজন্য সুন্নত মোতাবেক খাওয়া উচিত।
ঘ. আঙ্গুল ও পাত্র চেটে খাওয়া এবং পড়ে যাওয়া খাবার তুলে খাওয়া যখন সুন্নত, তখন লোকে কী-না কী বলে – সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে গৌরবের সঙ্গেই এ সুন্নত পালন করা চাই।
রিয়াযুস সালিহীন,মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম
