রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ

ভূমিকা অধ্যায়

হাদীস নং: ১৫৯
ভূমিকা অধ্যায়
সুন্নত ও তার আদবসমূহ রক্ষায় যত্নবান থাকার আদেশ।
ডান হাতে পানাহার করা সুন্নত; এর বিরুদ্ধাচরণ করার পরিণতি
হাদীছ নং: ১৫৯

হযরত সালামা ইবনুল আকওয়া' রাযি. থেকে বর্ণিত, জনৈক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকটে বসে বাম হাত দিয়ে খাচ্ছিল। তিনি তাকে বললেন, তোমার ডান হাত দিয়ে খাও। সে বলল, আমি পারি না। তিনি বললেন, তুমি যেন না-ই পার।
মূলত তার অহংকারই তাকে তা করতে বাধা দিচ্ছিল। তারপর আর সে তার সেই হাত মুখের কাছে উঠাতে পারেনি.- মুসলিম।(সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ২০২১ মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ১৬৪৯৩: তাবারানী, আল-মু'জামুল কাবীর, হাদীছ নং ৬২৩৬: বায়হাকী, আস-সুনানুল কুবরা, হাদীছ নং ৪৬১১)
مقدمة الامام النووي
16 - باب في الأمر بالمحافظة على السنة وآدابها
159 - الرابع: عن أَبي مسلم، وقيل: أَبي إياس سَلمة بنِ عمرو بنِ الأكوع - رضي الله عنه: أنَّ رَجُلًا أَكَلَ عِنْدَ رَسُول الله - صلى الله عليه وسلم - بِشِمَالِهِ، فَقَالَ: «كُلْ بِيَمِينكَ» قَالَ: لا أسْتَطيعُ. قَالَ: «لاَ استَطَعْتَ» مَا مَنَعَهُ إلاَّ الكِبْرُ فمَا رَفَعَهَا إِلَى فِيهِ. رواه مسلم. (1)

হাদীসের ব্যাখ্যা:

ডান হাতে পানাহার করা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নত। বিনা ওযরে কিছুতেই পানাহারে বাম হাত ব্যবহার করা উচিত নয়। কেননা বাম হাতে পানাহার করা শয়তানের কাজ। হযরত আব্দুল্লাহ ইবন উমর রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
إِذَا أَكَلَ أَحَدُكُمْ فَلْيَأْكُلْ بِيَمِينِهِ، وَإِذَا شَرِبَ فَلْيَشْرَب بِيَمِينِهِ فَإِنَّ الشَّيْطَانَ يَأْكُلُ بِشِمَالِهِ، وَيَشْرَبُ بِشِمَالِهِ
‘তোমাদের কেউ যখন খায়, যেন ডান হাতে খায়। আর যখন পান করে, যেন ডান হাতে পান করে। শয়তান বাম হাতে খায় ও বাম হাতে পান করে।’ (সহীহ মুসলিম: ২০২০; সুনানে আবূ দাউদ: ৩৭৭৬; জামে তিরমিযী: ১৭৯৯; সুনানে ইবন মাজাহ : ৩২৬৬; আল আদাবুল মুফরাদ: ১১৮৯; সুনানে দারিমী: ২০৭৩; মুসনাদে আহমাদ: ৪৫৩৭; মুসান্নাফে ইবন আবী শাইবা: ২৪৪৩৮; সহীহ ইবন হিব্বান: ৫২২৬)

অবশ্য ওযর থাকলে আলাদা কথা। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজে ডান হাতে পানাহার করতেন; অন্যদেরকেও এর আদেশ করতেন। কাউকে বাম হাতে পানাহার করতে দেখলে তার ইসলাহ করতেন এবং তাকে ডান হাত ব্যবহার করতে বলতেন।

অন্যের ইসলাহ করাও ছিল তাঁর আদর্শ। কাউকে কোনও অন্যায় ও ভুলত্রুটি করতে দেখলে তিনি তাকে সংশোধন করে দিতেন। এ হাদীছের বর্ণনায়ও তা-ই আছে। তার সামনে যখন কোনও এক লোক বাম হাতে খেতে শুরু করল, তখন তিনি তাকে ডান হাতে খেতে বললেন। কিন্তু সে তাঁর হুকুম মানল না। ওপরন্তু অহমিকাবশে বলে দিল, আমি ডান হাতে খেতে পারি না।

নবীর সামনে এভাবে অহমিকা প্রকাশ এবং সরাসরি তাঁর হুকুমের প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন চরম পর্যায়ের ধৃষ্টতা। সেইসঙ্গে ডান হাতে খেতে পারা সত্ত্বেও 'পারি না' বলাটা মিথ্যাচারও বটে। তাই নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামও বলে দিলেন, ঠিক আছে, তুমি যেন না-ই পার। সুতরাং আল্লাহ তা'আলার কাছে তাঁর এ কথা কবুল হয়ে যায়। সারাজীবনে সে কখনও আর ডান হাত মুখের কাছে নিতে পারেনি।

এই ব্যক্তি কে, তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। এক বর্ণনায় (بسر بن راعي العير) বুসর ইবন রা-ঈল 'আইর-এর নাম পাওয়া যায়, যিনি আশজা' গোত্রের একজন সাহাবী ছিলেন। কিন্তু সাহাবায়ে কিরামের যে মাত্রার নবীপ্রেম ছিল এবং নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নত অনুসরণে তাঁদের যে জযবা ও স্পৃহা ছিল, সেদিকে লক্ষ করলে এটা মেনে নেওয়া কঠিন যে, তাঁদের মধ্যকার কেউ প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের সামনে বাম হাতে খেতে জিদ ধরবেন এবং নবী কারীম সাল্লাল্লাহু "আলাইহি ওয়া সাল্লামের হুকুম সরাসরি অগ্রাহ্য করবেন। সুতরাং কাযী ‘ইয়ায রহ সহীহ মুসলিমের ভাষ্যগ্রন্থে মন্তব্য করেন যে, এ ব্যক্তি ছিল একজন মুনাফিক।

অবশ্য ইমাম নববী রহ. তার এ মতকে দুর্বল সাব্যস্ত করেছেন। তিনি এর কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন যে, ইবন মান্দা রহ, আবূ নু'আইম রহ., ইবন মা'কূলা রহ. প্রমুখ বুসরকে সাহাবীদের তালিকাভুক্ত করেছেন। কিন্তু তারপরও প্রশ্ন থেকে যায় যে, সত্যিই যদি এই ব্যক্তি বুসরই হয়ে থাকেন, তবে হাদীছে বর্ণিত ঘটনাটি যখন ঘটেছিল, তখন যে তিনি মু'মিনই ছিলেন তার প্রমাণ কী? তাই তো হাফেজ ইবন হাজার আসকালানী রহ, এভাবে উভয় মতের মধ্যে সামঞ্জস্যবিধান করেন যে, হতে পারে এ ঘটনার সময় পর্যন্ত তিনি ইসলাম গ্রহণ করেননি, পরবর্তী কোনও সময় তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন ও সাহাবায়ে কিরামের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যান।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. ডান হাত দ্বারা পানাহার করা সুন্নত। এ সুন্নত পালনে যত্নবান থাকা উচিত বর্তমানকালে এ সুন্নত পালনের গুরুত্ব এ কারণে আরও বেড়ে গেছে যে, লোকে বাম হাতে পানাহার করাকে ফ্যাশন বানিয়ে নিয়েছে। এটা এখন কেবল অমুসলিম কালচারই নয়; তাদের অনুকরণে অভ্যস্ত বহু মুসলিম পর্যন্ত এ বদ-অভ্যাসে আক্রান্ত। সুতরাং এখন এ অপসংস্কৃতির নির্মূল ও সুন্নতটির সুরক্ষাকল্পেও ডান হাতে পানাহার করা অনেক বেশি জরুরি।

খ. কাউকে বাম হাতে পানাহার করতে দেখলে হিকমত ও আন্তরিকতার সাথে তার ইসলাহ করে দেওয়া চাই।

গ. কেউ কোনও সদুপদেশ দিলে তা অগ্রাহ্য করা গুরুতর অপরাধ। এর থেকে বিরত থাকা চাই।

ঘ. অহংকার একটি কঠিন আত্মিক রোগ। এটা আযাব ও গযব এবং পতনের কারণ। এ রোগ নির্মূলে সচেষ্ট থাকা অতি জরুরি।

ঙ. সুন্নতের ওপর আমল না করা এক কথা, আর এর বিরুদ্ধাচরণও এর প্রতি ধৃষ্টতা প্রদর্শন আরেক কথা। প্রথমটি অন্যায় বটে, কিন্তু দ্বিতীয়টি কেবল অন্যায়ই নয়; বরং ঈমানবিরোধী আচরণ। এরূপ আচরণ হতে বিরত থাকার ব্যাপারে সর্বোচ্চ সতর্কতা জরুরি।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:বিশুদ্ধ (পারিভাষিক সহীহ)
রিয়াযুস সালিহীন - হাদীস নং ১৫৯ | মুসলিম বাংলা