রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ
ভূমিকা অধ্যায়
হাদীস নং: ১৫৬
ভূমিকা অধ্যায়
অধ্যায়ঃ ১৬
সুন্নত ও তার আদবসমূহ রক্ষায় যত্নবান থাকার আদেশ।
সুন্নতের আভিধানিক ও পারিভাষিক অর্থ
সুন্নতের আভিধানিক অর্থ- পথ, পন্থা, তরিকা ও রীতি-নীতি। এ হিসেবে ভালো ও মন্দ উভয় পন্থার জন্যই শব্দটি ব্যবহার হয়ে থাকে। যেমন এক হাদীছে আছেঃ-
من سن سنة حسنة فله أجرها وأجر من عمل بها إلى يوم القيامة، ومن سن سنة سيئة فله وزرها ووزر من عمل بها إلى يوم القيامة
“যে ব্যক্তি কোনও ভালো সুন্নত (তরিকা) চালু করে, তার জন্য রয়েছে সে সুন্নত নিজে পালন করার ছাওয়াব এবং কিয়ামত পর্যন্ত যত লোক তা পালন করবে তারও ছাওয়াব। আর যে ব্যক্তি কোনও মন্দ সুন্নত (তরিকা) চালু করবে, তার জন্য রয়েছে তা নিজে করার গুনাহ এবং কিয়ামত পর্যন্ত যত লোক তা পালন করবে তারও গুনাহ।*
এ হাদীছে ভালো ও মন্দ উভয় তরিকা ও পন্থার জন্য 'সুন্নত' শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। তবে পরিভাষায় এ শব্দটি মন্দ তরিকার জন্য ব্যবহৃত হয় না।
পরিভাষায় এ শব্দটি বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়। ফিকহ শাস্ত্রে ইসলামী বিধানাবলীর বিভিন্ন স্তরের মধ্যে ফরয ও ওয়াজিবের পরবর্তী স্তরকে সুন্নত বলা হয়।
কখনও কখনও বিদ'আতের বিপরীত কাজকেও সুন্নত বলে। সে হিসেবে বিদ'আতের পাশাপাশি 'সুন্নত' শব্দের ব্যাপক ব্যবহার লক্ষ করা যায়।
অনেক সময় সুন্নত শব্দটি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের তরিকা বোঝানোর জন্যও ব্যবহৃত হয়। অর্থাৎ তিনি ‘ইবাদত-বন্দেগী, আখলাক-চরিত্র, আচার-আচরণ ও জীবনযাপনের যে পন্থা নিজে অবলম্বন করেছেন ও উম্মতের জন্য রেখে গেছেন, তাকেও সুন্নত বলা হয়।
এ অধ্যায়ে সুন্নত দ্বারা এ অর্থই বোঝানো উদ্দেশ্য।
এ হিসেবে ফিক্হ শাস্ত্রের ফরয, ওয়াজিব, সুন্নত ও মুস্তাহাব সর্বস্তরের বিধানই সুন্নতের অন্তর্ভুক্ত। কেননা এ সবই নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের তরিকার মধ্যে পড়ে।
বলা যায় এ অর্থ হিসেবে সুন্নত শব্দটি দীন ও ইসলামের সমার্থবোধক।
প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে দীন আমাদের জন্য রেখে গেছেন। সেটাই ইসলাম এবং তিনি ছিলেন তার বাস্তব নমুনা। তিনি নিজে এর হুবহু অনুসরণ করতেন এবং সে অনুযায়ীই জীবনযাপন করতেন। কাজেই ইসলামই তাঁর জীবনাদর্শ এবং ইসলামই তাঁর তরিকা। সুতরাং তাঁর সুন্নত হচ্ছে সমগ্র ইসলাম। ‘আকীদা-বিশ্বাস ও ‘ইবাদত-বন্দেগীসহ জীবনের সকল ক্ষেত্রে ইসলামের অনুসরণ করলেই তাঁর সুন্নত ও তরিকার অনুসরণ করা হয়। আবার তাঁর সুন্নত ও তরিকা অনুসরণ করে চললেই ইসলামের অনুসরণ হয়।
কালক্রমে সুন্নতের পরিপূর্ণ অনুসরণে শিথিলতা ও তার পরিণাম এবং আমাদের করণীয়
কুরআন মাজীদের বিভিন্ন আয়াত ও বহু হাদীছে 'পূর্ণাঙ্গ ইসলামে' প্রবেশ ও নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পরিপূর্ণ অনুসরণ করার হুকুম দেওয়া হয়েছে।সাহাবায়ে কিরাম তাঁর পরিপূর্ণ অনুসরণই করতেন। তাঁরা বিধানাবলীর স্তরভেদের প্রতি লক্ষ করতেন না যে, যা ফরয-ওয়াজিব কেবল তা-ই পালন করবেন আর ফরয-ওয়াজিব না হলে তাতে শিথিলতা প্রদর্শন করবেন। বরং তাঁরা কেবল এদিকেই লক্ষ করতেন যে, তিনি কী করছেন ও কী বলছেন। তিনি যা করতেন, তাঁরা তা-ই করতেন এবং যা করতে বলতেন, পূর্ণ গুরুত্বের সঙ্গে তা পালন করতেন। মুস্তাহাব কাজকেও সেই যত্নের সঙ্গেই করতেন, যে যত্ন ফরয-ওয়াজিবের ক্ষেত্রে দিয়ে থাকতেন। এভাবে তাঁরা জীবনের সব ক্ষেত্রে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নত ও তরিকার ওপরই চলতেন। তাঁদের দেখাদেখি তাবি'ঈগণও সেভাবেই জীবনযাপন করতেন। এভাবে চলেছে বহুযুগ। সুন্নতের সে পাবন্দীর কারণেই তখন মুসলিম উম্মাহ শৌর্য-বীর্যের চরম শিখরে পৌছে গিয়েছিলেন। মুসলিম জীবনের উন্নতি ও উৎকর্ষ মূলত এরই মধ্যে নিহিত।
কিন্তু কালক্রমে এ জাতির মধ্যে বিত্তবাসনা ও দুনিয়ার আসক্তি ঢুকে পড়ে। পার্থিব খেয়াল-খুশি পূরণ ও আনন্দ-স্ফূর্তিতে দিন কাটানোর প্রতি তাদের আগ্রহ দেখা দেয়। বলাবাহুল্য, সুন্নতের অনুসরণ সেরকম জীবনের পক্ষে অন্তরায়। তাই ধীরে ধীরে এ জাতি সুন্নত তথা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনাদর্শের অনুসরণ থেকে দূরে সরতে শুরু করে। আর যখন থেকে তারা তা থেকে দূরে সরতে শুরু করে,তখন থেকে তাদের অধঃপতনও শুরু হয়ে যায়। এভাবে তারা নামতে নামতে আজকের এ পর্যায়ে পৌঁছে যায়। মুসলিম উম্মাহর আজকের এ চরম অধঃপতন এবং তাদের লাঞ্ছনা ও হীনতার একমাত্র কারণ এটাই যে, তারা তাদের জীবন থেকে সুন্নত ও নববী তরিকা বাদ দিয়ে দিয়েছে।
সুতরাং এ জাতি যদি তাদের হৃত গৌরব পুনরুদ্ধার করতে চায়, তবে তাদেরকে সুন্নতের পথে ফিরে আসতে হবে। তারা যদি প্রথম যমানার মত ইজ্জত-সম্মানের জীবন আশা করে, তবে ফের নববী তরিকা আঁকড়ে ধরতে হবে। তা ধরতে পারলে তারা আবারও পৃথিবীর নেতৃত্বে সমাসীন হতে পারবে। অন্যথায় আর যে পথই ধরুক না কেন, এ লাঞ্ছনা থেকে তাদের রেহাই নেই। সবচে' বড় কথা, পরকালীন মুক্তির নিশ্চয়তাও আছে কেবল নববী তরিকার মধ্যেই। কাজেই আখিরাতের মুক্তির জন্য আমাদের সেদিকে ফিরে আসতেই হবে। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে তাওফীক দান করুন- আমীন।
ইমাম নববী রহ. এ অধ্যায়ে সুন্নত অর্থাৎ নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের রেখে যাওয়া তরিকার ওপর চলার গুরুত্ব ও মাহাত্ম্য সম্পর্কে কয়েকটি আয়াত ও কিছু সংখ্যক হাদীছ উল্লেখ করেছেন। আমরা তার অনুবাদ ও সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা পেশ করছি। আল্লাহ তা'আলাই তাওফীকদাতা।
সুন্নত ও তার আদবসমূহ রক্ষায় যত্নবান থাকার আদেশ সম্পর্কিত কয়েকটি আয়াত
এক নং আয়াত
وَمَا آتَاكُمُ الرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَاكُمْ عَنْهُ فَانْتَهُوا
অর্থ : রাসূল তোমাদেরকে যা দেয় তা গ্রহণ কর, আর তোমাদেরকে যা কিছুতে নিষেধ করে তা হতে বিরত থাক।সূরা হাশর (৫৯), আয়াত ৭
ব্যাখ্যা
এ আয়াত মূলত গনীমতের মাল বণ্টন প্রসঙ্গে নাযিল হয়েছে। কিন্তু আয়াতের শব্দ ব্যাপক। সে ব্যাপকতার ইঙ্গিত আয়াতের মধ্যেই আছে। আয়াতে দেওয়ার বিপরীত শব্দ আনা হয়েছে নিষেধ করা। প্রকৃতপক্ষে দেওয়ার বিপরীত শব্দ হল না দেওয়া বা দেওয়া হতে বিরত থাকা। কিন্তু তার পরিবর্তে 'নিষেধ করা' শব্দ ব্যবহারের মধ্যে ইঙ্গিত রয়েছে যে, দেওয়া দ্বারা কেবল মাল দেওয়া বোঝানো উদ্দেশ্য নয়; বরং আদেশ দেওয়াও এর অন্তর্ভুক্ত।
সুতরাং আয়াতের মর্ম হচ্ছে, রাসূল তোমাদেরকে যা-কিছুই দেন, তা অর্থ-সম্পদ হোক কিংবা হোক হিদায়াত, পথনির্দেশ, আখলাক-চরিত্রের শিক্ষা ও শরী'আতের বিধানাবলী, তা সবই গ্রহণ করে নাও। বহু সাহাবী থেকে এ ব্যাপক অর্থ বর্ণিত আছে এবং এরই ভিত্তিতে তাঁরা রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতিটি হুকুমকে কুরআনেরই হুকুম সাব্যস্ত করতেন এবং অবশ্যপালনীয় বলে বিশ্বাস করতেন।
হযরত 'আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ রাযি. একবার এক ব্যক্তিকে ইহরাম অবস্থায় সেলাইকৃত পোশাক পরতে দেখে বললেন, এ কাপড় খুলে ফেল। লোকটি বলল, এ সম্পর্কে কি আপনি কুরআনের কোনও আয়াত বলতে পারেন, যে আয়াতে এরূপ পোশাক পরতে নিষেধ করা হয়েছে? তিনি বললেন, হাঁ, সে আয়াত আমি তোমাকে জানাচ্ছি। এই বলে তিনি পাঠ করলেন-
وَمَا آتَاكُمُ الرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَاكُمْ عَنْهُ فَانْتَهُوا
অর্থ : রাসূল তোমাদেরকে যা দেয় তা গ্রহণ কর, আর তোমাদেরকে যা কিছুতে নিষেধ করে তা হতে বিরত থাক।
এর দ্বারা বোঝা গেল নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের দেওয়া আদেশ-নিষেধ কুরআন মাজীদের আদেশ-নিষেধের মতই উম্মতের জন্য অবশ্যপালনীয়। তিনি তাঁর আদেশ-নিষেধ দ্বারা মূলত উম্মতের চলার পথ ও পন্থা বাতলান। সুতরাং তাঁর আদেশ-নিষেধ সুন্নতই বটে। এভাবে এ আয়াত তাঁর আদেশ-নিষেধ আঁকড়ে ধরার হুকুম দিয়ে মূলত তাঁর সুন্নত অনুসারে চলারই তাগিদ করেছে।
দুই নং আয়াত
وَمَا يَنْطِقُ عَنِ الْهَوَى (3) إِنْ هُوَ إِلَّا وَحْيٌ يُوحَى (4)
অর্থ : সে তার নিজ খেয়াল-খুশি থেকে কিছু বলে না। এটা তো খালেস ওহী, যা তাঁর কাছে পাঠানো হয়।সূরা নাজম (৫৩), আয়াত ৩, ৪
ব্যাখ্যা
অর্থাৎ এটা কখনওই সম্ভব নয় যে, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজের পক্ষ থেকে কোনও কথা তৈরি করে সেটিকে আল্লাহ তা'আলার বাণী বলে প্রচার করবেন; বরং তিনি যা-ই বলেন তা আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকে ওহীই হয়ে থাকে।
হাদীছও ওহীই বটে
এক ওহী তো কুরআন মাজীদ, যার ভাব ও ভাষা সবই আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকে অবতীর্ণ। কিন্তু ওহী কেবল কুরআন মাজীদই নয়; নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদীছও ওহীই বটে। হাদীছের ভাব আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকে অবতীর্ণ, কিন্তু তার ভাষা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিজের। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম যা কিছু করেছেন তাও আল্লাহ তা'আলার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ হুকুমেই করেছেন। সুতরাং তাও ওহী। এমনিভাবে তিনি যা-কিছু অনুমোদন করেছেন তাও আল্লাহ তা'আলার হুকুমেই করেছেন। কাজেই তাও ওহীর অন্তর্ভুক্ত। যখন তাঁর সমস্ত কথা, কাজ ও অনুমোদন ওহী সাব্যস্ত হল, তখন উম্মতের জন্য তা সবই অনুসরণীয়।
কাফেরদের ধারণা ছিল তিনি নিজের পক্ষ থেকে কথা তৈরি করে আল্লাহর নামে প্রচার করছেন। কাজেই তা অনুসরণীয় ও ভ্রুক্ষেপযোগ্য নয়। এ আয়াতে তাদের সে ধারণা রদ করে জানানো হয়েছে, তিনি কোনওকিছুই বানিয়ে বলেন না। যা-কিছুই বলেন, তা আল্লাহ তা'আলার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ওহী। সুতরাং তা গুরুত্বের সঙ্গে শোনা ও মানা তোমাদের অবশ্যকর্তব্য।
যদিও কাফেরদের ধারণা খণ্ডনে এ আয়াত নাযিল হয়েছে, কিন্তু এর বক্তব্যবিষয় আমাদের জন্যও প্রযোজ্য। তাঁর পক্ষ থেকে পাওয়া সব যখন ওহী ও আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকে নাযিলকৃত, তখন উম্মত হিসেবে আমাদের জন্য তা অনুসরণ করা জরুরি হয়ে যায়। এভাবে এ আয়াত দ্বারা প্রমাণ হয় যে, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নত ও জীবনাদর্শের পূর্ণাঙ্গ অনুসরণ প্রত্যেক মুসলিমের অবশ্যকর্তব্য।
তিন নং আয়াত
قُلْ إِنْ كُنْتُمْ تُحِبُّونَ اللَّهَ فَاتَّبِعُونِي يُحْبِبْكُمُ اللَّهُ وَيَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوبَكُمْ
অর্থ : (হে নবী! মানুষকে) বলে দাও, তোমরা যদি আল্লাহকে ভালোবেসে থাক, তবে আমার অনুসরণ কর, তাহলে আল্লাহ তোমাদের ভালোবাসবেন এবং তোমাদের পাপরাশি ক্ষমা করবেন।সূরা আলে ইমরান (৩), আয়াত ৩১
ব্যাখ্যা
প্রত্যেক মু'মিনেরই কথা হচ্ছে সে আল্লাহ তা'আলাকে ভালোবাসে। এ আয়াতে সে ভালোবাসার দাবি জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ যে ব্যক্তি আল্লাহ তা'আলাকে ভালোবাসবে, তার অবশ্যকর্তব্য নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুসরণ করা। কেননা যে ব্যক্তি কাউকে ভালোবাসে, সে তার সন্তুষ্টি কামনা করে এবং তাকে পেতে চায়।
আল্লাহপ্রেমিকদের করণীয়
আমরা যখন আল্লাহ তা'আলাকে ভালোবাসি, তখন তাঁর সন্তুষ্টি কামনা তো করিই। প্রশ্ন হচ্ছে, কিভাবে তাঁকে সন্তুষ্ট করা যাবে? আমরা সরাসরি তাঁকে না দেখতে পাই, না তাঁর কথা শুনতে পারি। তাঁর সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগের কোনও উপায় আমাদের নেই। এ অবস্থায় কী করলে তিনি খুশি হবেন আর কী করলে নাখোশ হবেন- তা আমরা কিভাবে বুঝব? দয়াময় আল্লাহ আমাদেরকে তা বোঝানোর জন্য নবী-রাসুল পাঠান। তাঁদের প্রতি ওহী নাযিল করে আমাদেরকে তাঁকে পাওয়ার পথ জানিয়ে দেন। সেইসঙ্গে নবী-রাসূলগণকে ওহীর বাস্তব নমুনা বানিয়ে দেন, যাতে আমরা সেই নমুনা দেখে দেখে ওহীর পথে চলি ও জীবন গঠন করি। সেই ধারার সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আর কুরআন হচ্ছে সর্বশেষ ওহী।
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন ওহীর বাস্তব নমুনা। এখন কিয়ামত পর্যন্ত যারা আল্লাহ তা'আলাকে ভালোবাসবে, তাদের সকলের কর্তব্য সর্বশেষ নাযিলকৃত ওহীর পথে চলা আর সে পথে চলার জন্য নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুসরণ করা। যারা তাঁর যথাযথ অনুসরণ করবে, তাদের পথচলা ওহীর নির্দেশনা অনুযায়ীই হবে। আর সেভাবে চলতে থাকলে আল্লাহ তা'আলা পর্যন্ত পৌঁছা যাবে। ব্যস, একমাত্র এটাই আল্লাহ তা'আলাকে পাওয়া ও তাঁর সন্তুষ্টি লাভ করার উপায়। এ আয়াতে সে কথাই বলা হয়েছে যে, যারা আল্লাহ তাআলাকে ভালোবাসে বলে দাবি করে, তারা যেন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুসরণ করে।
সুন্নত অনুসরণের পুরস্কার
এ আয়াতে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুসরণ করার দ্বারা বান্দার কী অর্জিত হবে তাও জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। তার একটি হচ্ছে আল্লাহ তা'আলার ভালোবাসা লাভ। যারা তাঁর অনুসরণ করবে, আল্লাহ তাদের ভালোবাসবেন। অর্থাৎ তারা আল্লাহকে পেয়ে যাবে। প্রত্যেক প্রেমিকজনের তো এটাই কামনা যে, সে যাকে ভালোবাসে তাকে যেন পেয়ে যায়। তাকে পাওয়া মানে তার ভালোবাসা ও সন্তুষ্টি লাভ করা এবং তার মাহবূব হয়ে যাওয়া। আল্লাহ তা'আলা ভালোবাসার পরম লক্ষ্য তো এটাই যে, বান্দা আল্লাহর ভালোবাসা ও সন্তুষ্টি পেয়ে যাবে। আয়াত জানাচ্ছে, তা পাওয়ার একমাত্র উপায় হচ্ছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুসরণ করা।
দ্বিতীয় পুরস্কার হচ্ছে গুনাহ মাফ হওয়া। আল্লাহ তা'আলা যখন বান্দাকে ভালোবেসে ফেলবেন ও তার প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে যাবেন, তখন তাকে পাপের পঙ্কিলতায় রেখে দেবেন তা কি সম্ভব? তিনি নিজ মেহেরবানীতে পাপরাশি ক্ষমা করে তাকে শুদ্ধ ও পবিত্র করে ফেলবেন।
সারকথা, এ আয়াত আল্লাহপ্রেমিকদের উৎসাহ দিচ্ছে, তারা যেন নিজেদের গুনাহ মাফ করানো ও আল্লাহ তা'আলার ভালোবাসা লাভের জন্য প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নত ও জীবনাদর্শের অনুসরণ করে চলে। আল্লাহ তা'আলা আমাদেরকে তাওফীক দান করুন।
চার নং আয়াত
لَقَدْ كَانَ لَكُمْ فِي رَسُولِ اللهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ لِمَنْ كَانَ يَرْجُوا اللهَ وَالْيَوْمَ الْآخِرَ
অর্থ : বস্তুত রাসূলের মধ্যে তোমাদের জন্য রয়েছে উত্তম আদর্শ—এমন ব্যক্তির জন্য, যে আল্লাহ ও আখিরাত দিবসের আশা রাখে।সূরা আহযাব (৩৩), আয়াত ২১
ব্যাখ্যা
অর্থাৎ যারা আশা রাখে- আখিরাতে আল্লাহ তা'আলা তাদের প্রতি সন্তুষ্টি প্রকাশ করবেন এবং নিজ রহমতে তাদেরকে জাহান্নাম থেকে মুক্ত রেখে চিরসুখের জান্নাতে স্থান দেবেন, তাদের কর্তব্য মহানবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুসরণ করা। কেননা কেবল তার মধ্যেই আছে তাদের জন্য অনুসরণীয় আদর্শ।
সর্বাবস্থায় আল্লাহভক্তদের শ্রেষ্ঠতম আদর্শ
সরাসরি এ আয়াতের সম্পর্ক যুদ্ধাবস্থা ও সংকটময় পরিস্থিতির সাথে। খন্দকের যুদ্ধে মুসলিমগণ এরকম পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছিলেন। আরবের সমস্ত গোত্র একাট্রা হয়ে মদীনা মুনাওয়ারায় অভিযান চালিয়েছিল। তাদের লোকবল ও অস্ত্রবল ছিল মুসলিম বাহিনীর তুলনায় অনেক অনেক বেশি। সেইসঙ্গে ছিল প্রচণ্ড খাদ্যাভাব ও ক্ষুধার কষ্ট। সময়টাও ছিল প্রচণ্ড শীতের। তদুপরি ভেতর থেকে ইয়াহুদী গোত্রগুলো ষড়যন্ত্র চালাচ্ছিল। শত্রুবাহিনীর পক্ষ থেকে অবরোধও ছিল অনেক দীর্ঘ। এহেনও পরিস্থিতিতে মু'মিনগণ এমন কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হয়ে পড়েছিল যে, কুরআনের ভাষায় তাদের চোখ বিস্ফারিত হয়ে গিয়েছিল, প্রাণ হয়েছিল কণ্ঠাগত এবং তাদেরকে তীব্র প্রকম্পনে কাঁপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ফলে অনেকের মনে নানারকম ভাবনা দেখা দিয়েছিল এবং সৃষ্টি হয়েছিল বিভিন্ন ওয়াসওয়াসা। কিন্তু নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একবিন্দু টলেননি। আল্লাহর প্রতি তাঁর ভরসায় সামান্যতম চিড় ধরেনি। ইস্পাতকঠিন দৃঢ়তার সাথে তিনি পরিস্থিতি মোকাবেলা করে যাচ্ছিলেন। এ আয়াতে সে প্রসঙ্গেই বলা হয়েছে, কঠিন কঠিন পরিস্থিতিতে কিভাবে আল্লাহর প্রতি ভরসা রেখে আপন অবস্থানে অবিচল থাকতে হয়, সে ব্যাপারে তোমাদের জন্য আল্লাহর রাসূলের মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ।
আয়াতের পরিপ্রেক্ষিত যদিও এই বিশেষ ঘটনা, কিন্তু এর শব্দাবলী ব্যাপক অর্থবোধক। মানবজীবনের প্রতিটি অবস্থাই এর অন্তর্ভুক্ত। সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের অবস্থায় কিভাবে শোকর করতে হয়, দুঃখ-কষ্ট ও সংকটময় পরিস্থিতিতে কিভাবে সবর অটুট রাখতে হয়, তাঁর জীবনাদর্শের মধ্যে রয়েছে তার উত্তম নমুনা। সন্তানের লালন-পালন, স্ত্রীর প্রতি আচরণ, আত্মীয়তা রক্ষা, প্রতিবেশীর হক আদায়, বিচার-নিষ্পত্তি, দেশ- পরিচালনা এমনকি হাসি-কান্না, ওঠাবসা, চলাফেরা, রসিকতা প্রভৃতি মানুষের ব্যক্তিগত ও সামাজিক যত অনুষঙ্গ আছে প্রতিটি ক্ষেত্রে মহানবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনাচার মানবজাতির সর্বকালের শ্রেষ্ঠতম আদর্শ। সুতরাং আখিরাতমুখী ও আল্লাহর রহমতকামী প্রতিটি মানুষের কর্তব্য জীবনের সকল ব্যাপারে তাঁর সে আদর্শ অনুসরণ করে চলা। এ আয়াতে আমাদের সে নির্দেশই দেওয়া হয়েছে।
পাঁচ নং আয়াত
فَلَا وَرَبِّكَ لَا يُؤْمِنُونَ حَتَّى يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَيْنَهُمْ ثُمَّ لَا يَجِدُوا فِي أَنْفُسِهِمْ حَرَجًا مِمَّا قَضَيْتَ وَيُسَلِّمُوا تَسْلِيمًا (65)
অর্থ : না, (হে নবী!) তোমার প্রতিপালকের শপথ! তারা ততক্ষণ পর্যন্ত মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না নিজেদের পারস্পরিক ঝগড়া-বিবাদের ক্ষেত্রে তোমাকে বিচারক মানবে, তারপর তুমি যে রায় দাও সে ব্যাপারে নিজেদের অন্তরে কোনওরূপ কুণ্ঠাবোধ না করবে এবং অবনত মস্তকে তা গ্রহণ করে নেবে।সূরা নিসা (৪), আয়াত ৬৫
ব্যাখ্যা
এ আয়াতে আল্লাহ তা'আলা তাঁর নিজের শপথ করে জানিয়েছেন, কোনও ব্যক্তি ততক্ষণ পর্যন্ত মু'মিন ও মুসলিম হতে পারে না, যতক্ষণ না সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতিটি সিদ্ধান্ত অকুণ্ঠ ও সন্তুষ্টমনে মেনে নেবে।
রাসুলের প্রতি বিশ্বাসের উদ্দেশ্য
বস্তুত নবীর নবুওয়াতের প্রতি বিশ্বাস স্থাপনের উদ্দেশ্যই হচ্ছে তাঁর যাবতীয় আদেশ-নিষেধ মেনে নেওয়া, তাঁর প্রতিটি ফয়সালায় খুশি থাকা ও তাঁর পূর্ণাঙ্গ অনুসরণ বজায় রাখা। নবীর প্রতি বিশ্বাস কেবল ভক্তি প্রদর্শন ও গুণগান করার জন্য নয় এবং নয় কেবল তাঁর নাম নিয়ে গর্ব করার জন্য। সুতরাং তিনি যখন যে ফয়সালা দান করেন, সন্তুষ্টচিত্তে তা মেনে না নেওয়া হলে এ বিশ্বাসের কোনও সার্থকতা থাকে না। সেজন্যই এ আয়াতে তাঁর সিদ্ধান্ত মানার প্রতি জোর তাগিদ দেওয়া হয়েছে। এ তাগিদের দাবি হচ্ছে প্রত্যেকে তাঁর পূর্ণাঙ্গ আনুগত্যে বদ্ধপরিকর থাকবে, এমনকি তাঁর কোনও সিদ্ধান্ত যদি নিজ রুচি-অভিরুচির পরিপন্থীও হয়। তাঁর কোনও ফয়সালা মানতে গেলে যদি নিজ স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হয় কিংবা লোকসম্মুখে আপাতদৃষ্টিতে ছোট হতে হয়, তাও খুশিমনে তা মেনে নেওয়া চাই। কোনও সন্দেহ নেই তা মেনে নেওয়ার মধ্যেই গৌরব। তারই মধ্যে প্রকৃত মর্যাদা।
নবীর ফয়সালা না মানা তাঁর অবাধ্যতা করার শামিল, যা ইসলাম ও মুসলমানিত্বের পরিপন্থী এবং প্রকৃতপক্ষে তা নিজ খেয়াল-খুশির গোলামী ও শয়তানের আনুগত্য। এর পরিণতিতে মানুষ গোমরাহীর শিকার হয়ে যায় ও সরল পথ থেকে বিচ্যুত হয়। এমনকি এটা মুনাফিকীরও আলামত। এ আয়াতের শানে নুযূলও (অবতরণ- প্রেক্ষাপট) সেদিকে ইঙ্গিত করে।
একটি বিচারের ঘটনা ও হযরত উমর রাযি.-এর 'ফারূক' উপাধি লাভ
ইমাম কুরতুবী রহ. এ আয়াতের শানে নুযূল সম্পর্কে একটি ঘটনা বর্ণনা করেছেন। তাতে আছে, বিশর নামক জনৈক মুনাফিক ও এক ইয়াহুদীর মধ্যে কোনও এক বিষয়ে বিবাদ চলছিল। এর ফয়সালার জন্য ইয়াহুদী বলল, চল আমরা মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কাছে যাই। কারণ ইয়াহুদী জানত নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ন্যায়বিচারই করবেন এবং তা তার পক্ষেই যাবে। কেননা তার দাবি সঠিক ছিল। অপরদিকে বিশর বলল, না, আমরা কা‘ব ইবন আশরাফের কাছে যাব।
কা‘ব ইবন আশরাফ ছিল ইয়াহুদীদের নেতা। কিন্তু ইয়াহুদী অনড়। সে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছেই যাবে। অগত্যা বিশর তাতে রাজি হল। তারা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে গিয়ে আপন আপন বক্তব্য পেশ করল। তিনি ইয়াহুদীর পক্ষে রায় দিলেন। বিশর তাঁর সামনে তা মেনে নিলেও পরে তা প্রত্যাখ্যান করল। সে বলল, চল, আমরা আবূ বকরের কাছে যাই। তিনিও একই রায় দিলেন। তখন সে বলল, চল 'উমরের কাছে যাই। তারা হযরত উমর রাযি.-এর কাছে গিয়ে উপস্থিত হল। ইয়াহুদী হযরত উমর রাযি.-এর কাছে সম্পূর্ণ বৃত্তান্ত বর্ণনা করল। তিনি বিশরকে বললেন, সে যা বলছে তা সঠিক? বিশর বলল, হাঁ। তিনি বললেন, ঠিক আছে, তোমরা অপেক্ষা কর। আমি আসছি। তিনি ভেতর থেকে তরবারি নিয়ে আসলেন এবং বিশরকে এই বলে কতল করে ফেললেন যে, যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ফয়সালায় রাজি হয় না, তার ব্যাপারে এই হচ্ছে আমার ফয়সালা। এ অবস্থা দেখে ইয়াহুদী ভয়ে পালিয়ে গেল। তারই পরিপ্রেক্ষিতে এ আয়াত নাযিল হয়েছে।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম সব শুনে হযরত উমর রাযি.-কে লক্ষ্য করে বললেন, তুমি 'আল ফারূক'- সত্য ও মিথ্যার মধ্যে পার্থক্যকারী। তখন থেকেই হযরত 'উমর ফারূক রাযি. 'আল-ফারুক' উপাধিতে পরিচিতি লাভ করেন। কুরতুবী, আল-জামে লি আহকামিল কুরআন, ৫ম খণ্ড, ১৭০ পৃ.
প্রকাশ থাকে যে, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি এ নিঃশর্ত আনুগত্যের হুকুম কেবল তাঁর জীবদ্দশার জন্যই নির্দিষ্ট নয়; বরং তাঁর ওফাতের পরও এ হুকুম বলবৎ রয়েছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত বলবৎ থাকবে। এখন তাঁর আনুগত্য করার অর্থ হচ্ছে তাঁর জীবনাদর্শের অনুসরণ করা তথা জীবনের প্রতিটি কাজ কুরআন-সুন্নাহর নির্দেশনা মোতাবেক সম্পন্ন করা।
ছয় নং আয়াত
فَإِنْ تَنَازَعْتُمْ فِي شَيْءٍ فَرُدُّوهُ إِلَى اللَّهِ وَالرَّسُولِ
অর্থ: অতঃপর তোমাদের মধ্যে যদি কোনও বিষয়ে বিরোধ দেখা দেয়, তবে তোমরা সে বিষয়কে আল্লাহ ও রাসুলের ওপর ন্যস্ত কর।সূরা নিসা (৪), আয়াত ৫৯
ব্যাখ্যা
এ আয়াতের সরাসরি সম্পর্ক আমীর ও শাসকের আনুগত্য করার সাথে। বোঝানো হচ্ছে, শাসকের কোনও আদেশ যদি তোমাদের কাছে আপত্তিকর মনে হয় এবং তোমরা মনে কর—তা শরী'আত বিরোধী, অপরদিকে শাসক আদেশটিকে শরী'আতসম্মতই মনে করে আর এভাবে উভয়পক্ষের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দেয়, তবে উভয়পক্ষের কর্তব্য হবে বিষয়টিকে আল্লাহ ও রাসূলের ওপর ন্যস্ত করা অর্থাৎ কুরআন ও সুন্নাহর মাপকাঠিতে যাচাই করা। যে মত কুরআন-সুন্নাহ মোতাবেক হবে, উভয়পক্ষের কর্তব্য হবে সেটিই মেনে নেওয়া, মতটি যে পক্ষেরই হোক না কেন।
আসল কথা হচ্ছে কুরআন-সুন্নাহর অনুসরণ। মতটি কার সেটি বিবেচ্য নয়। আমার মত নয় বলে মানব না, তা যতই কুরআন-সুন্নাহ মোতাবেক হোক না কেন—এ মনোভাব নিছক অহমিকা ও হঠকারিতা। কিছুতেই এটা একজন মু'মিনের চরিত্র হতে পারে না। তাই তো আয়াতে শর্ত বলে দেওয়া হয়েছে যে, যদি আল্লাহ ও পরকালের ওপর তোমাদের ঈমান থাকে। অর্থাৎ তোমরা যদি মু'মিন হও, তবে বিতর্কিত বিষয়ে কুরআন-সুন্নাহর শরণাপন্ন হওয়া ও তার ফয়সালা মেনে নেওয়া তোমাদের জন্য ফরয ও অবশ্যকর্তব্য।
এ আয়াতের সরাসরি সম্পর্ক যদিও শাসক ও জনগণের পারস্পরিক বিষয়ের সাথে, কিন্তু এর মর্মবস্তু ব্যাপক। অর্থাৎ যে-কোনও বিষয়ে যে কোনও দুই ব্যক্তি বা দুই পক্ষের মধ্যে মতভিন্নতা দেখা দিলে তাদের কর্তব্য সে বিষয়ে কুরআন-সুন্নাহর আলোকে ফয়সালা গ্রহণ করা। যে মত কুরআন-সুন্নাহ দ্বারা সমর্থিত হয়, সকলের কর্তব্য কোনওরূপ দ্বিধা-সংকোচ ছাড়া সেটিই মেনে নেওয়া।
বলাবাহুল্য, কুরআন-সুন্নাহর ফয়সালা মেনে নেওয়া রাসূলের ফয়সালা মেনে নেওয়াই বটে। এভাবে এ আয়াত দ্বারাও কিয়ামত পর্যন্ত সকল মানুষের জন্য নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের রেখে যাওয়া তরিকা ও সুন্নতের অনুসরণ করার অপরিহার্যতা প্রমাণিত হয়।
সাত নং আয়াত
مَنْ يُطِعِ الرَّسُولَ فَقَدْ أَطَاعَ الله
অর্থ : যে ব্যক্তি রাসূলের আনুগত্য করে সে আল্লাহরই আনুগত্য করল।সূরা নিসা (৪), আয়াত ৮০
ব্যাখ্যা
এ আয়াতে রাসূলের আনুগত্যকে আল্লাহরই আনুগত্য সাব্যস্ত করা হয়েছে। আল্লাহ তা'আলার আনুগত্য করা প্রতিটি মানুষের অবশ্যকর্তব্য। আল্লাহ তা'আলা মানুষকে সৃষ্টিই করেছেন এজন্য যে, তারা তাঁর আনুগত্য করে চলবে। কিন্তু তিনি তো গায়েব। মানুষ তাঁর আনুগত্য কিভাবে করবে? কী করে তারা জানবে কী কাজ করলে আল্লাহর আনুগত্য করা হয় আর কী করলে তাঁর অবাধ্যতা হয়ে যায়?
রাসূলের আনুগত্য আল্লাহরই আনুগত্য
আল্লাহ তা'আলা নবী-রাসূল পাঠিয়ে মানুষের এ সমস্যার সমাধান করে দিয়েছেন। তাঁরা আল্লাহ তা'আলার নাযিল করা ওহীর মাধ্যমে মানুষকে জানিয়ে দেন কোন্ কাজ তাঁর আনুগত্যমূলক আর কোন কাজ তাঁর অবাধ্যতামূলক। সেইসঙ্গে তাঁরা নিজ আচার-আচরণ দ্বারা দেখিয়েও দেন কিভাবে তাঁর আনুগত্য করতে হয় এবং কিভাবে তাঁর অবাধ্যতা থেকে বাঁচতে হয়। সুতরাং তাঁদের জীবন মানুষের জন্য আল্লাহর আনুগত্য করা ও তাঁর অবাধ্যতা হতে বাঁচার নমুনা। কাজেই কেউ যদি আল্লাহর অনুগত বান্দা হতে চায়, তবে তার একান্ত কর্তব্য হবে নবী-রাসূলগণের অনুসরণ ও আনুগত্য করা। তাঁদের আনুগত্য করলে তা আল্লাহ তা'আলার আনুগত্য বলেই গণ্য হবে।
হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম যেহেতু সর্বশেষ নবী ও রাসূল, তাই তাঁর আবির্ভাবের পর কিয়ামত পর্যন্ত সকল মানুষের কর্তব্য তাঁর আনুগত্য করা তথা তাঁর রেখে যাওয়া তরিকা ও সুন্নত অনুযায়ী চলা। এখন আল্লাহ তা'আলার অনুগত বান্দা হওয়ার একমাত্র উপায় এটাই। যারা মহানবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের তরিকা অনুযায়ী চলবে, কেবল তারাই আল্লাহর অনুগত বান্দারূপে গণ্য হবে। আর যারা তাঁর তরিকা অমান্য করবে, তারা আল্লাহ তা'আলারও অবাধ্য সাব্যস্ত হবে। সুতরাং আল্লাহ তা'আলার অনুগত বান্দারূপে জীবনযাপনের জন্য আমাদের প্রত্যেকের কর্তব্য সকল কাজকর্মে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের তরিকা ও সুন্নত অনুসরণ করে চলা। আল্লাহ তা'আলা আমাদেরকে তাওফীক দান করুন।
আট নং আয়াত
وَإِنَّكَ لَتَهْدِي إِلَى صِرَاطٍ مُسْتَقِيمٍ (52) صِرَاطِ اللَّهِ
অর্থ : নিশ্চয়ই তুমি মানুষকে দেখাচ্ছ হিদায়াতের সেই সরল পথ, যা আল্লাহর পথ।সূরা শূরা (৪২), আয়াত ৫২-৫৩
ব্যাখ্যা
অর্থাৎ তোমার প্রতি যে ওহী নাযিল করি, তার মাধ্যমে তুমি মানুষকে আল্লাহ পর্যন্ত পৌঁছার সরল সোজা পথ দেখিয়ে থাক। যারা আল্লাহ পর্যন্ত পৌঁছতে চাবে, তাদের কর্তব্য- তোমার দেখানো পথেই চলা।
সুন্নতের অনুসরণ ছাড়া আল্লাহকে পাওয়ার কোনও বিকল্প পথ নেই
এ আয়াত দ্বারাও সুন্নত তথা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের তরিকা অনুসরণের অপরিহার্যতা প্রমাণিত হয়। কেননা তিনি যে তরিকা রেখে গেছেন, এক তো তা তাঁর নিজের মনগড়া নয়; বরং আল্লাহপ্রদত্ত, দ্বিতীয়ত সে তরিকাই মানুষকে আল্লাহ পর্যন্ত পৌছায়। কোনও কালেই আল্লাহ পর্যন্ত পৌছার জন্য নবীদের দেখানো পথের কোনও বিকল্প ছিল না। সে বিকল্প নেই আজও। অর্থাৎ শেষ নবীর আগমনের পর এখন আল্লাহ পর্যন্ত পৌছার একমাত্র পথ নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের রেখে যাওয়া তরিকা। সুতরাং আল্লাহকে পেতে হলে সকলকে এ তরিকার ওপরই চলতে হবে। কেউ যদি অন্য কোনও বিকল্প অবলম্বন করে, তবে তা আর যাই হোক, আল্লাহর পথ হবে না এবং সে ব্যক্তি আর যাই পাক না কেন, আল্লাহকে কিছুতেই পেতে পারে না; বরং সে আল্লাহ থেকে দূরে সরে যাবে এবং ইবলীসের পদাঙ্ক অনুসারী বলে গণ্য হবে। যেমন এক আয়াতে ইরশাদ হয়েছে-
وَأَنَّ هَذَا صِرَاطِي مُسْتَقِيمًا فَاتَّبِعُوهُ وَلَا تَتَّبِعُوا السُّبُلَ فَتَفَرَّقَ بِكُمْ عَنْ سَبِيلِهِ
অর্থ : (হে নবী! তাদেরকে) আরও বল, এটা আমার সরল-সঠিক পথ। সুতরাং এর অনুসরণ কর, অন্য কোনও পথের অনুসরণ করো না, করলে তা তোমাদেরকে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেবে।সূরা আন'আম (৬), আয়াত ১৫৩
নয় নং আয়াত
فَلْيَحْذَرِ الَّذِينَ يُخَالِفُونَ عَنْ أَمْرِهِ أَنْ تُصِيبَهُمْ فِتْنَةٌ أَوْ يُصِيبَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ (63)
অর্থ : সুতরাং যারা তাঁর আদেশের বিরুদ্ধাচরণ করে, তাদের ভয় করা উচিত না-জানি তাদের ওপর কোনও বিপদ আপতিত হয় অথবা যন্ত্রণাদায়ক কোনও শাস্তি তাদেরকে আক্রান্ত করে। সূরা নূর (২৪), আয়াত ৬৩
ব্যাখ্যা
এর আগে মুনাফিকদের সম্পর্কে জানানো হয়েছে যে, তারা নানা বাহানায় ও বিভিন্ন ছলচাতুরীর মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট থেকে সরে পড়ত ও তাঁর হুকুম অমান্য করত। এস্থলে তাদেরকে সতর্ক করা হয়েছে যে, তারা যদি আল্লাহ ও রাসূলের বিরুদ্ধাচরণ থেকে বিরত না হয়, তবে আল্লাহ তা'আলা যে-কোনও মুহূর্তে তাদেরকে কঠিন শাস্তি দিতে পারেন আর আখিরাতের শাস্তি তো অবধারিত আছেই।
যদিও এ শান্তির সতর্কবাণী মুনাফিকদের চরিত্র বর্ণনা প্রসঙ্গে দেওয়া হয়েছে, কিন্তু এর শব্দাবলী ব্যাপক। যারাই আল্লাহ তা'আলা ও রাসূল সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিরুদ্ধাচরণ করে, তারাই এ সতর্কবাণীর আওতার মধ্যে রয়েছে। সুতরাং আমাদের সকলেরই সতর্ক হওয়া উচিত যাতে আমাদের কোনও কর্মকাণ্ড দ্বারা আল্লাহ তা'আলা ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিরুদ্ধাচরণ না হয়ে যায় এবং তার পরিণামে আল্লাহ তা'আলার আযাবের কবলে না পড়ে যাই। সে বিরুদ্ধাচরণ থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় জীবনের সকল ক্ষেত্রে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নত ও তরিকার অনুসরণ করা।
দশ নং আয়াত
وَاذْكُرْنَ مَا يُتْلَى فِي بُيُوتِكُنَّ مِنْ آيَاتِ اللَّهِ وَالْحِكْمَةِ
অর্থ : এবং তোমাদের গৃহে আল্লাহর যে আয়াতসমূহ ও হিকমতের কথা পাঠ করা হয়, তা স্মরণ রাখ।সূরা আহযাব (৩৩), আয়াত ৩৪
ব্যাখ্যা
এ আয়াতে আল্লাহর আয়াত দ্বারা কুরআন মাজীদ এবং 'হিকমত' দ্বারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নত ও শিক্ষামালা বোঝানো হয়েছে। এখানে সরাসরি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের স্ত্রীগণকে লক্ষ্য করে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যে, তোমাদের ঘরে কুরআনের যে আয়াত পাঠ করা হয় এবং নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের যে সুন্নত চর্চা করা হয়, তোমাদের কর্তব্য তা স্মরণ রাখা। স্মরণ রাখার দু'টি দিক রয়েছে-
এক হচ্ছে কুরআন ও সুন্নত সংরক্ষণ করা এবং ভুলে যাওয়া হতে তা হেফাজত করা। আরেকটি দিক হচ্ছে সে অনুযায়ী আমল করা।
আমল করা হচ্ছে মূল উদ্দেশ্য। আর সে উদ্দেশ্য পূরণের জন্য কুরআন ও সুন্নতের সংরক্ষণও জরুরি। সুতরাং এ দু'টি বিষয়ই স্মরণ রাখার নির্দেশের অন্তর্ভুক্ত।
বিশেষভাবে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের স্ত্রীগণকে লক্ষ্য করে এ নির্দেশ দেওয়ার কারণ হচ্ছে, তাঁর পারিবারিক জীবন সম্পর্কে জানার সর্বাপেক্ষা নির্ভরযোগ্য মাধ্যম তারাই। পারিবারিক জীবনযাপন সম্পর্কে ইসলামের বহু বিধি-বিধান আছে। সেসব বিধান সংরক্ষিত না থাকলে ইসলামের একটা বড় অংশই আমাদের অজ্ঞাত থেকে যেত। সে ক্ষেত্রে আমরা ইসলামের পূর্ণাঙ্গ অনুসরণ করতে সক্ষম হতাম না। অথচ কিয়ামত পর্যন্ত সমস্ত মানুষের জীবনের সকল ক্ষেত্রেই ইসলামের অনুসরণ জরুরি। মানুষের এ প্রয়োজন পূরণার্থেই নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের পরিবারের নারীগণকে এদিকে বিশেষভাবে মনোযোগী থাকতে বলা হয়েছে। বস্তুত তাঁর বহু বিবাহের একটা রহস্য এটাও যে, তাঁর স্ত্রীগণ তাঁর গার্হস্থ্য ও পারিবারিক জীবনের যাবতীয় বিষয় মনোযোগের সঙ্গে লক্ষ করবেন এবং তা যথাযথভাবে সংরক্ষণ করে মানুষের কাছে পৌছাবেন। সন্দেহ নেই যে, তাঁরা অত্যন্ত বিশ্বস্ততার সঙ্গে এ দায়িত্ব পালন করেছেন। উম্মুল মু'মিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রাযি. হযরত যায়নাব বিনতে জাহশ রাযি, হযরত উম্মু সালামা রাযি, হযরত মায়মুনা রাযি, প্রমুখের কাছ থেকে আমরা নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনের যে শিক্ষা ও আদর্শসমূহ জানতে পেরেছি, তা ইসলামী শিক্ষামালার এক বিস্তৃত অধ্যায়। এজন্য আল্লাহ তা'আলা আমাদের এবং সমগ্র উম্মতের পক্ষ থেকে তাঁদেরকে তাঁর শান মোতাবেক জাযায়ে খায়র দান করুন।
যদিও সরাসরি এ হুকুম দেওয়া হয়েছে উম্মাহাতুল মু'মিনীনকে অর্থাৎ নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের স্ত্রীগণকে, কিন্তু পরোক্ষভাবে আমাদের জন্যও এ হুকুম প্রযোজ্য। কেননা কুরআন-হাদীছের বিধানাবলী বিশ্বের সমস্ত মানুষের জন্য দেওয়া। তাই সকলেরই কর্তব্য সেসব বিধান মেনে চলা। আর কিয়ামত পর্যন্ত সমস্ত মানুষ যাতে তা মেনে চলতে পারে, সে লক্ষ্যে এর হেফাজতের ব্যবস্থা গ্রহণও সকলের জন্য জরুরি। একদল তো সক্রিয়ভাবেই তাতে লিপ্ত থাকবে এবং কুরআন-হাদীছের হেফাজত সংক্রান্ত যাবতীয় কাজে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করবে, আর অন্যরা সেই জীবনোৎসর্গকারীদের সর্বাত্মক সমর্থন ও সহযোগিতা দিয়ে যাবে। আল্লাহ তা'আলা আমাদের সকলকে এ হুকুম মেনে চলার তাওফীক দান করুন।
* সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ১০১৭: সুনানে নাসাঈ, হাদীছ নং ২৫৫৪; সুনানে ইবন মাজাহ, হাদীছ নং ২০৩; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ১৯১৫৬
সুন্নত ও তার আদবসমূহ রক্ষায় যত্নবান থাকার আদেশ।
সুন্নতের আভিধানিক ও পারিভাষিক অর্থ
সুন্নতের আভিধানিক অর্থ- পথ, পন্থা, তরিকা ও রীতি-নীতি। এ হিসেবে ভালো ও মন্দ উভয় পন্থার জন্যই শব্দটি ব্যবহার হয়ে থাকে। যেমন এক হাদীছে আছেঃ-
من سن سنة حسنة فله أجرها وأجر من عمل بها إلى يوم القيامة، ومن سن سنة سيئة فله وزرها ووزر من عمل بها إلى يوم القيامة
“যে ব্যক্তি কোনও ভালো সুন্নত (তরিকা) চালু করে, তার জন্য রয়েছে সে সুন্নত নিজে পালন করার ছাওয়াব এবং কিয়ামত পর্যন্ত যত লোক তা পালন করবে তারও ছাওয়াব। আর যে ব্যক্তি কোনও মন্দ সুন্নত (তরিকা) চালু করবে, তার জন্য রয়েছে তা নিজে করার গুনাহ এবং কিয়ামত পর্যন্ত যত লোক তা পালন করবে তারও গুনাহ।*
এ হাদীছে ভালো ও মন্দ উভয় তরিকা ও পন্থার জন্য 'সুন্নত' শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। তবে পরিভাষায় এ শব্দটি মন্দ তরিকার জন্য ব্যবহৃত হয় না।
পরিভাষায় এ শব্দটি বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়। ফিকহ শাস্ত্রে ইসলামী বিধানাবলীর বিভিন্ন স্তরের মধ্যে ফরয ও ওয়াজিবের পরবর্তী স্তরকে সুন্নত বলা হয়।
কখনও কখনও বিদ'আতের বিপরীত কাজকেও সুন্নত বলে। সে হিসেবে বিদ'আতের পাশাপাশি 'সুন্নত' শব্দের ব্যাপক ব্যবহার লক্ষ করা যায়।
অনেক সময় সুন্নত শব্দটি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের তরিকা বোঝানোর জন্যও ব্যবহৃত হয়। অর্থাৎ তিনি ‘ইবাদত-বন্দেগী, আখলাক-চরিত্র, আচার-আচরণ ও জীবনযাপনের যে পন্থা নিজে অবলম্বন করেছেন ও উম্মতের জন্য রেখে গেছেন, তাকেও সুন্নত বলা হয়।
এ অধ্যায়ে সুন্নত দ্বারা এ অর্থই বোঝানো উদ্দেশ্য।
এ হিসেবে ফিক্হ শাস্ত্রের ফরয, ওয়াজিব, সুন্নত ও মুস্তাহাব সর্বস্তরের বিধানই সুন্নতের অন্তর্ভুক্ত। কেননা এ সবই নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের তরিকার মধ্যে পড়ে।
বলা যায় এ অর্থ হিসেবে সুন্নত শব্দটি দীন ও ইসলামের সমার্থবোধক।
প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে দীন আমাদের জন্য রেখে গেছেন। সেটাই ইসলাম এবং তিনি ছিলেন তার বাস্তব নমুনা। তিনি নিজে এর হুবহু অনুসরণ করতেন এবং সে অনুযায়ীই জীবনযাপন করতেন। কাজেই ইসলামই তাঁর জীবনাদর্শ এবং ইসলামই তাঁর তরিকা। সুতরাং তাঁর সুন্নত হচ্ছে সমগ্র ইসলাম। ‘আকীদা-বিশ্বাস ও ‘ইবাদত-বন্দেগীসহ জীবনের সকল ক্ষেত্রে ইসলামের অনুসরণ করলেই তাঁর সুন্নত ও তরিকার অনুসরণ করা হয়। আবার তাঁর সুন্নত ও তরিকা অনুসরণ করে চললেই ইসলামের অনুসরণ হয়।
কালক্রমে সুন্নতের পরিপূর্ণ অনুসরণে শিথিলতা ও তার পরিণাম এবং আমাদের করণীয়
কুরআন মাজীদের বিভিন্ন আয়াত ও বহু হাদীছে 'পূর্ণাঙ্গ ইসলামে' প্রবেশ ও নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পরিপূর্ণ অনুসরণ করার হুকুম দেওয়া হয়েছে।সাহাবায়ে কিরাম তাঁর পরিপূর্ণ অনুসরণই করতেন। তাঁরা বিধানাবলীর স্তরভেদের প্রতি লক্ষ করতেন না যে, যা ফরয-ওয়াজিব কেবল তা-ই পালন করবেন আর ফরয-ওয়াজিব না হলে তাতে শিথিলতা প্রদর্শন করবেন। বরং তাঁরা কেবল এদিকেই লক্ষ করতেন যে, তিনি কী করছেন ও কী বলছেন। তিনি যা করতেন, তাঁরা তা-ই করতেন এবং যা করতে বলতেন, পূর্ণ গুরুত্বের সঙ্গে তা পালন করতেন। মুস্তাহাব কাজকেও সেই যত্নের সঙ্গেই করতেন, যে যত্ন ফরয-ওয়াজিবের ক্ষেত্রে দিয়ে থাকতেন। এভাবে তাঁরা জীবনের সব ক্ষেত্রে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নত ও তরিকার ওপরই চলতেন। তাঁদের দেখাদেখি তাবি'ঈগণও সেভাবেই জীবনযাপন করতেন। এভাবে চলেছে বহুযুগ। সুন্নতের সে পাবন্দীর কারণেই তখন মুসলিম উম্মাহ শৌর্য-বীর্যের চরম শিখরে পৌছে গিয়েছিলেন। মুসলিম জীবনের উন্নতি ও উৎকর্ষ মূলত এরই মধ্যে নিহিত।
কিন্তু কালক্রমে এ জাতির মধ্যে বিত্তবাসনা ও দুনিয়ার আসক্তি ঢুকে পড়ে। পার্থিব খেয়াল-খুশি পূরণ ও আনন্দ-স্ফূর্তিতে দিন কাটানোর প্রতি তাদের আগ্রহ দেখা দেয়। বলাবাহুল্য, সুন্নতের অনুসরণ সেরকম জীবনের পক্ষে অন্তরায়। তাই ধীরে ধীরে এ জাতি সুন্নত তথা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনাদর্শের অনুসরণ থেকে দূরে সরতে শুরু করে। আর যখন থেকে তারা তা থেকে দূরে সরতে শুরু করে,তখন থেকে তাদের অধঃপতনও শুরু হয়ে যায়। এভাবে তারা নামতে নামতে আজকের এ পর্যায়ে পৌঁছে যায়। মুসলিম উম্মাহর আজকের এ চরম অধঃপতন এবং তাদের লাঞ্ছনা ও হীনতার একমাত্র কারণ এটাই যে, তারা তাদের জীবন থেকে সুন্নত ও নববী তরিকা বাদ দিয়ে দিয়েছে।
সুতরাং এ জাতি যদি তাদের হৃত গৌরব পুনরুদ্ধার করতে চায়, তবে তাদেরকে সুন্নতের পথে ফিরে আসতে হবে। তারা যদি প্রথম যমানার মত ইজ্জত-সম্মানের জীবন আশা করে, তবে ফের নববী তরিকা আঁকড়ে ধরতে হবে। তা ধরতে পারলে তারা আবারও পৃথিবীর নেতৃত্বে সমাসীন হতে পারবে। অন্যথায় আর যে পথই ধরুক না কেন, এ লাঞ্ছনা থেকে তাদের রেহাই নেই। সবচে' বড় কথা, পরকালীন মুক্তির নিশ্চয়তাও আছে কেবল নববী তরিকার মধ্যেই। কাজেই আখিরাতের মুক্তির জন্য আমাদের সেদিকে ফিরে আসতেই হবে। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে তাওফীক দান করুন- আমীন।
ইমাম নববী রহ. এ অধ্যায়ে সুন্নত অর্থাৎ নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের রেখে যাওয়া তরিকার ওপর চলার গুরুত্ব ও মাহাত্ম্য সম্পর্কে কয়েকটি আয়াত ও কিছু সংখ্যক হাদীছ উল্লেখ করেছেন। আমরা তার অনুবাদ ও সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা পেশ করছি। আল্লাহ তা'আলাই তাওফীকদাতা।
সুন্নত ও তার আদবসমূহ রক্ষায় যত্নবান থাকার আদেশ সম্পর্কিত কয়েকটি আয়াত
এক নং আয়াত
وَمَا آتَاكُمُ الرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَاكُمْ عَنْهُ فَانْتَهُوا
অর্থ : রাসূল তোমাদেরকে যা দেয় তা গ্রহণ কর, আর তোমাদেরকে যা কিছুতে নিষেধ করে তা হতে বিরত থাক।সূরা হাশর (৫৯), আয়াত ৭
ব্যাখ্যা
এ আয়াত মূলত গনীমতের মাল বণ্টন প্রসঙ্গে নাযিল হয়েছে। কিন্তু আয়াতের শব্দ ব্যাপক। সে ব্যাপকতার ইঙ্গিত আয়াতের মধ্যেই আছে। আয়াতে দেওয়ার বিপরীত শব্দ আনা হয়েছে নিষেধ করা। প্রকৃতপক্ষে দেওয়ার বিপরীত শব্দ হল না দেওয়া বা দেওয়া হতে বিরত থাকা। কিন্তু তার পরিবর্তে 'নিষেধ করা' শব্দ ব্যবহারের মধ্যে ইঙ্গিত রয়েছে যে, দেওয়া দ্বারা কেবল মাল দেওয়া বোঝানো উদ্দেশ্য নয়; বরং আদেশ দেওয়াও এর অন্তর্ভুক্ত।
সুতরাং আয়াতের মর্ম হচ্ছে, রাসূল তোমাদেরকে যা-কিছুই দেন, তা অর্থ-সম্পদ হোক কিংবা হোক হিদায়াত, পথনির্দেশ, আখলাক-চরিত্রের শিক্ষা ও শরী'আতের বিধানাবলী, তা সবই গ্রহণ করে নাও। বহু সাহাবী থেকে এ ব্যাপক অর্থ বর্ণিত আছে এবং এরই ভিত্তিতে তাঁরা রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতিটি হুকুমকে কুরআনেরই হুকুম সাব্যস্ত করতেন এবং অবশ্যপালনীয় বলে বিশ্বাস করতেন।
হযরত 'আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ রাযি. একবার এক ব্যক্তিকে ইহরাম অবস্থায় সেলাইকৃত পোশাক পরতে দেখে বললেন, এ কাপড় খুলে ফেল। লোকটি বলল, এ সম্পর্কে কি আপনি কুরআনের কোনও আয়াত বলতে পারেন, যে আয়াতে এরূপ পোশাক পরতে নিষেধ করা হয়েছে? তিনি বললেন, হাঁ, সে আয়াত আমি তোমাকে জানাচ্ছি। এই বলে তিনি পাঠ করলেন-
وَمَا آتَاكُمُ الرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَاكُمْ عَنْهُ فَانْتَهُوا
অর্থ : রাসূল তোমাদেরকে যা দেয় তা গ্রহণ কর, আর তোমাদেরকে যা কিছুতে নিষেধ করে তা হতে বিরত থাক।
এর দ্বারা বোঝা গেল নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের দেওয়া আদেশ-নিষেধ কুরআন মাজীদের আদেশ-নিষেধের মতই উম্মতের জন্য অবশ্যপালনীয়। তিনি তাঁর আদেশ-নিষেধ দ্বারা মূলত উম্মতের চলার পথ ও পন্থা বাতলান। সুতরাং তাঁর আদেশ-নিষেধ সুন্নতই বটে। এভাবে এ আয়াত তাঁর আদেশ-নিষেধ আঁকড়ে ধরার হুকুম দিয়ে মূলত তাঁর সুন্নত অনুসারে চলারই তাগিদ করেছে।
দুই নং আয়াত
وَمَا يَنْطِقُ عَنِ الْهَوَى (3) إِنْ هُوَ إِلَّا وَحْيٌ يُوحَى (4)
অর্থ : সে তার নিজ খেয়াল-খুশি থেকে কিছু বলে না। এটা তো খালেস ওহী, যা তাঁর কাছে পাঠানো হয়।সূরা নাজম (৫৩), আয়াত ৩, ৪
ব্যাখ্যা
অর্থাৎ এটা কখনওই সম্ভব নয় যে, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজের পক্ষ থেকে কোনও কথা তৈরি করে সেটিকে আল্লাহ তা'আলার বাণী বলে প্রচার করবেন; বরং তিনি যা-ই বলেন তা আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকে ওহীই হয়ে থাকে।
হাদীছও ওহীই বটে
এক ওহী তো কুরআন মাজীদ, যার ভাব ও ভাষা সবই আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকে অবতীর্ণ। কিন্তু ওহী কেবল কুরআন মাজীদই নয়; নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদীছও ওহীই বটে। হাদীছের ভাব আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকে অবতীর্ণ, কিন্তু তার ভাষা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিজের। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম যা কিছু করেছেন তাও আল্লাহ তা'আলার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ হুকুমেই করেছেন। সুতরাং তাও ওহী। এমনিভাবে তিনি যা-কিছু অনুমোদন করেছেন তাও আল্লাহ তা'আলার হুকুমেই করেছেন। কাজেই তাও ওহীর অন্তর্ভুক্ত। যখন তাঁর সমস্ত কথা, কাজ ও অনুমোদন ওহী সাব্যস্ত হল, তখন উম্মতের জন্য তা সবই অনুসরণীয়।
কাফেরদের ধারণা ছিল তিনি নিজের পক্ষ থেকে কথা তৈরি করে আল্লাহর নামে প্রচার করছেন। কাজেই তা অনুসরণীয় ও ভ্রুক্ষেপযোগ্য নয়। এ আয়াতে তাদের সে ধারণা রদ করে জানানো হয়েছে, তিনি কোনওকিছুই বানিয়ে বলেন না। যা-কিছুই বলেন, তা আল্লাহ তা'আলার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ওহী। সুতরাং তা গুরুত্বের সঙ্গে শোনা ও মানা তোমাদের অবশ্যকর্তব্য।
যদিও কাফেরদের ধারণা খণ্ডনে এ আয়াত নাযিল হয়েছে, কিন্তু এর বক্তব্যবিষয় আমাদের জন্যও প্রযোজ্য। তাঁর পক্ষ থেকে পাওয়া সব যখন ওহী ও আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকে নাযিলকৃত, তখন উম্মত হিসেবে আমাদের জন্য তা অনুসরণ করা জরুরি হয়ে যায়। এভাবে এ আয়াত দ্বারা প্রমাণ হয় যে, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নত ও জীবনাদর্শের পূর্ণাঙ্গ অনুসরণ প্রত্যেক মুসলিমের অবশ্যকর্তব্য।
তিন নং আয়াত
قُلْ إِنْ كُنْتُمْ تُحِبُّونَ اللَّهَ فَاتَّبِعُونِي يُحْبِبْكُمُ اللَّهُ وَيَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوبَكُمْ
অর্থ : (হে নবী! মানুষকে) বলে দাও, তোমরা যদি আল্লাহকে ভালোবেসে থাক, তবে আমার অনুসরণ কর, তাহলে আল্লাহ তোমাদের ভালোবাসবেন এবং তোমাদের পাপরাশি ক্ষমা করবেন।সূরা আলে ইমরান (৩), আয়াত ৩১
ব্যাখ্যা
প্রত্যেক মু'মিনেরই কথা হচ্ছে সে আল্লাহ তা'আলাকে ভালোবাসে। এ আয়াতে সে ভালোবাসার দাবি জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ যে ব্যক্তি আল্লাহ তা'আলাকে ভালোবাসবে, তার অবশ্যকর্তব্য নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুসরণ করা। কেননা যে ব্যক্তি কাউকে ভালোবাসে, সে তার সন্তুষ্টি কামনা করে এবং তাকে পেতে চায়।
আল্লাহপ্রেমিকদের করণীয়
আমরা যখন আল্লাহ তা'আলাকে ভালোবাসি, তখন তাঁর সন্তুষ্টি কামনা তো করিই। প্রশ্ন হচ্ছে, কিভাবে তাঁকে সন্তুষ্ট করা যাবে? আমরা সরাসরি তাঁকে না দেখতে পাই, না তাঁর কথা শুনতে পারি। তাঁর সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগের কোনও উপায় আমাদের নেই। এ অবস্থায় কী করলে তিনি খুশি হবেন আর কী করলে নাখোশ হবেন- তা আমরা কিভাবে বুঝব? দয়াময় আল্লাহ আমাদেরকে তা বোঝানোর জন্য নবী-রাসুল পাঠান। তাঁদের প্রতি ওহী নাযিল করে আমাদেরকে তাঁকে পাওয়ার পথ জানিয়ে দেন। সেইসঙ্গে নবী-রাসূলগণকে ওহীর বাস্তব নমুনা বানিয়ে দেন, যাতে আমরা সেই নমুনা দেখে দেখে ওহীর পথে চলি ও জীবন গঠন করি। সেই ধারার সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আর কুরআন হচ্ছে সর্বশেষ ওহী।
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন ওহীর বাস্তব নমুনা। এখন কিয়ামত পর্যন্ত যারা আল্লাহ তা'আলাকে ভালোবাসবে, তাদের সকলের কর্তব্য সর্বশেষ নাযিলকৃত ওহীর পথে চলা আর সে পথে চলার জন্য নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুসরণ করা। যারা তাঁর যথাযথ অনুসরণ করবে, তাদের পথচলা ওহীর নির্দেশনা অনুযায়ীই হবে। আর সেভাবে চলতে থাকলে আল্লাহ তা'আলা পর্যন্ত পৌঁছা যাবে। ব্যস, একমাত্র এটাই আল্লাহ তা'আলাকে পাওয়া ও তাঁর সন্তুষ্টি লাভ করার উপায়। এ আয়াতে সে কথাই বলা হয়েছে যে, যারা আল্লাহ তাআলাকে ভালোবাসে বলে দাবি করে, তারা যেন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুসরণ করে।
সুন্নত অনুসরণের পুরস্কার
এ আয়াতে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুসরণ করার দ্বারা বান্দার কী অর্জিত হবে তাও জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। তার একটি হচ্ছে আল্লাহ তা'আলার ভালোবাসা লাভ। যারা তাঁর অনুসরণ করবে, আল্লাহ তাদের ভালোবাসবেন। অর্থাৎ তারা আল্লাহকে পেয়ে যাবে। প্রত্যেক প্রেমিকজনের তো এটাই কামনা যে, সে যাকে ভালোবাসে তাকে যেন পেয়ে যায়। তাকে পাওয়া মানে তার ভালোবাসা ও সন্তুষ্টি লাভ করা এবং তার মাহবূব হয়ে যাওয়া। আল্লাহ তা'আলা ভালোবাসার পরম লক্ষ্য তো এটাই যে, বান্দা আল্লাহর ভালোবাসা ও সন্তুষ্টি পেয়ে যাবে। আয়াত জানাচ্ছে, তা পাওয়ার একমাত্র উপায় হচ্ছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুসরণ করা।
দ্বিতীয় পুরস্কার হচ্ছে গুনাহ মাফ হওয়া। আল্লাহ তা'আলা যখন বান্দাকে ভালোবেসে ফেলবেন ও তার প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে যাবেন, তখন তাকে পাপের পঙ্কিলতায় রেখে দেবেন তা কি সম্ভব? তিনি নিজ মেহেরবানীতে পাপরাশি ক্ষমা করে তাকে শুদ্ধ ও পবিত্র করে ফেলবেন।
সারকথা, এ আয়াত আল্লাহপ্রেমিকদের উৎসাহ দিচ্ছে, তারা যেন নিজেদের গুনাহ মাফ করানো ও আল্লাহ তা'আলার ভালোবাসা লাভের জন্য প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নত ও জীবনাদর্শের অনুসরণ করে চলে। আল্লাহ তা'আলা আমাদেরকে তাওফীক দান করুন।
চার নং আয়াত
لَقَدْ كَانَ لَكُمْ فِي رَسُولِ اللهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ لِمَنْ كَانَ يَرْجُوا اللهَ وَالْيَوْمَ الْآخِرَ
অর্থ : বস্তুত রাসূলের মধ্যে তোমাদের জন্য রয়েছে উত্তম আদর্শ—এমন ব্যক্তির জন্য, যে আল্লাহ ও আখিরাত দিবসের আশা রাখে।সূরা আহযাব (৩৩), আয়াত ২১
ব্যাখ্যা
অর্থাৎ যারা আশা রাখে- আখিরাতে আল্লাহ তা'আলা তাদের প্রতি সন্তুষ্টি প্রকাশ করবেন এবং নিজ রহমতে তাদেরকে জাহান্নাম থেকে মুক্ত রেখে চিরসুখের জান্নাতে স্থান দেবেন, তাদের কর্তব্য মহানবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুসরণ করা। কেননা কেবল তার মধ্যেই আছে তাদের জন্য অনুসরণীয় আদর্শ।
সর্বাবস্থায় আল্লাহভক্তদের শ্রেষ্ঠতম আদর্শ
সরাসরি এ আয়াতের সম্পর্ক যুদ্ধাবস্থা ও সংকটময় পরিস্থিতির সাথে। খন্দকের যুদ্ধে মুসলিমগণ এরকম পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছিলেন। আরবের সমস্ত গোত্র একাট্রা হয়ে মদীনা মুনাওয়ারায় অভিযান চালিয়েছিল। তাদের লোকবল ও অস্ত্রবল ছিল মুসলিম বাহিনীর তুলনায় অনেক অনেক বেশি। সেইসঙ্গে ছিল প্রচণ্ড খাদ্যাভাব ও ক্ষুধার কষ্ট। সময়টাও ছিল প্রচণ্ড শীতের। তদুপরি ভেতর থেকে ইয়াহুদী গোত্রগুলো ষড়যন্ত্র চালাচ্ছিল। শত্রুবাহিনীর পক্ষ থেকে অবরোধও ছিল অনেক দীর্ঘ। এহেনও পরিস্থিতিতে মু'মিনগণ এমন কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হয়ে পড়েছিল যে, কুরআনের ভাষায় তাদের চোখ বিস্ফারিত হয়ে গিয়েছিল, প্রাণ হয়েছিল কণ্ঠাগত এবং তাদেরকে তীব্র প্রকম্পনে কাঁপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ফলে অনেকের মনে নানারকম ভাবনা দেখা দিয়েছিল এবং সৃষ্টি হয়েছিল বিভিন্ন ওয়াসওয়াসা। কিন্তু নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একবিন্দু টলেননি। আল্লাহর প্রতি তাঁর ভরসায় সামান্যতম চিড় ধরেনি। ইস্পাতকঠিন দৃঢ়তার সাথে তিনি পরিস্থিতি মোকাবেলা করে যাচ্ছিলেন। এ আয়াতে সে প্রসঙ্গেই বলা হয়েছে, কঠিন কঠিন পরিস্থিতিতে কিভাবে আল্লাহর প্রতি ভরসা রেখে আপন অবস্থানে অবিচল থাকতে হয়, সে ব্যাপারে তোমাদের জন্য আল্লাহর রাসূলের মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ।
আয়াতের পরিপ্রেক্ষিত যদিও এই বিশেষ ঘটনা, কিন্তু এর শব্দাবলী ব্যাপক অর্থবোধক। মানবজীবনের প্রতিটি অবস্থাই এর অন্তর্ভুক্ত। সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের অবস্থায় কিভাবে শোকর করতে হয়, দুঃখ-কষ্ট ও সংকটময় পরিস্থিতিতে কিভাবে সবর অটুট রাখতে হয়, তাঁর জীবনাদর্শের মধ্যে রয়েছে তার উত্তম নমুনা। সন্তানের লালন-পালন, স্ত্রীর প্রতি আচরণ, আত্মীয়তা রক্ষা, প্রতিবেশীর হক আদায়, বিচার-নিষ্পত্তি, দেশ- পরিচালনা এমনকি হাসি-কান্না, ওঠাবসা, চলাফেরা, রসিকতা প্রভৃতি মানুষের ব্যক্তিগত ও সামাজিক যত অনুষঙ্গ আছে প্রতিটি ক্ষেত্রে মহানবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনাচার মানবজাতির সর্বকালের শ্রেষ্ঠতম আদর্শ। সুতরাং আখিরাতমুখী ও আল্লাহর রহমতকামী প্রতিটি মানুষের কর্তব্য জীবনের সকল ব্যাপারে তাঁর সে আদর্শ অনুসরণ করে চলা। এ আয়াতে আমাদের সে নির্দেশই দেওয়া হয়েছে।
পাঁচ নং আয়াত
فَلَا وَرَبِّكَ لَا يُؤْمِنُونَ حَتَّى يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَيْنَهُمْ ثُمَّ لَا يَجِدُوا فِي أَنْفُسِهِمْ حَرَجًا مِمَّا قَضَيْتَ وَيُسَلِّمُوا تَسْلِيمًا (65)
অর্থ : না, (হে নবী!) তোমার প্রতিপালকের শপথ! তারা ততক্ষণ পর্যন্ত মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না নিজেদের পারস্পরিক ঝগড়া-বিবাদের ক্ষেত্রে তোমাকে বিচারক মানবে, তারপর তুমি যে রায় দাও সে ব্যাপারে নিজেদের অন্তরে কোনওরূপ কুণ্ঠাবোধ না করবে এবং অবনত মস্তকে তা গ্রহণ করে নেবে।সূরা নিসা (৪), আয়াত ৬৫
ব্যাখ্যা
এ আয়াতে আল্লাহ তা'আলা তাঁর নিজের শপথ করে জানিয়েছেন, কোনও ব্যক্তি ততক্ষণ পর্যন্ত মু'মিন ও মুসলিম হতে পারে না, যতক্ষণ না সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতিটি সিদ্ধান্ত অকুণ্ঠ ও সন্তুষ্টমনে মেনে নেবে।
রাসুলের প্রতি বিশ্বাসের উদ্দেশ্য
বস্তুত নবীর নবুওয়াতের প্রতি বিশ্বাস স্থাপনের উদ্দেশ্যই হচ্ছে তাঁর যাবতীয় আদেশ-নিষেধ মেনে নেওয়া, তাঁর প্রতিটি ফয়সালায় খুশি থাকা ও তাঁর পূর্ণাঙ্গ অনুসরণ বজায় রাখা। নবীর প্রতি বিশ্বাস কেবল ভক্তি প্রদর্শন ও গুণগান করার জন্য নয় এবং নয় কেবল তাঁর নাম নিয়ে গর্ব করার জন্য। সুতরাং তিনি যখন যে ফয়সালা দান করেন, সন্তুষ্টচিত্তে তা মেনে না নেওয়া হলে এ বিশ্বাসের কোনও সার্থকতা থাকে না। সেজন্যই এ আয়াতে তাঁর সিদ্ধান্ত মানার প্রতি জোর তাগিদ দেওয়া হয়েছে। এ তাগিদের দাবি হচ্ছে প্রত্যেকে তাঁর পূর্ণাঙ্গ আনুগত্যে বদ্ধপরিকর থাকবে, এমনকি তাঁর কোনও সিদ্ধান্ত যদি নিজ রুচি-অভিরুচির পরিপন্থীও হয়। তাঁর কোনও ফয়সালা মানতে গেলে যদি নিজ স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হয় কিংবা লোকসম্মুখে আপাতদৃষ্টিতে ছোট হতে হয়, তাও খুশিমনে তা মেনে নেওয়া চাই। কোনও সন্দেহ নেই তা মেনে নেওয়ার মধ্যেই গৌরব। তারই মধ্যে প্রকৃত মর্যাদা।
নবীর ফয়সালা না মানা তাঁর অবাধ্যতা করার শামিল, যা ইসলাম ও মুসলমানিত্বের পরিপন্থী এবং প্রকৃতপক্ষে তা নিজ খেয়াল-খুশির গোলামী ও শয়তানের আনুগত্য। এর পরিণতিতে মানুষ গোমরাহীর শিকার হয়ে যায় ও সরল পথ থেকে বিচ্যুত হয়। এমনকি এটা মুনাফিকীরও আলামত। এ আয়াতের শানে নুযূলও (অবতরণ- প্রেক্ষাপট) সেদিকে ইঙ্গিত করে।
একটি বিচারের ঘটনা ও হযরত উমর রাযি.-এর 'ফারূক' উপাধি লাভ
ইমাম কুরতুবী রহ. এ আয়াতের শানে নুযূল সম্পর্কে একটি ঘটনা বর্ণনা করেছেন। তাতে আছে, বিশর নামক জনৈক মুনাফিক ও এক ইয়াহুদীর মধ্যে কোনও এক বিষয়ে বিবাদ চলছিল। এর ফয়সালার জন্য ইয়াহুদী বলল, চল আমরা মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কাছে যাই। কারণ ইয়াহুদী জানত নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ন্যায়বিচারই করবেন এবং তা তার পক্ষেই যাবে। কেননা তার দাবি সঠিক ছিল। অপরদিকে বিশর বলল, না, আমরা কা‘ব ইবন আশরাফের কাছে যাব।
কা‘ব ইবন আশরাফ ছিল ইয়াহুদীদের নেতা। কিন্তু ইয়াহুদী অনড়। সে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছেই যাবে। অগত্যা বিশর তাতে রাজি হল। তারা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে গিয়ে আপন আপন বক্তব্য পেশ করল। তিনি ইয়াহুদীর পক্ষে রায় দিলেন। বিশর তাঁর সামনে তা মেনে নিলেও পরে তা প্রত্যাখ্যান করল। সে বলল, চল, আমরা আবূ বকরের কাছে যাই। তিনিও একই রায় দিলেন। তখন সে বলল, চল 'উমরের কাছে যাই। তারা হযরত উমর রাযি.-এর কাছে গিয়ে উপস্থিত হল। ইয়াহুদী হযরত উমর রাযি.-এর কাছে সম্পূর্ণ বৃত্তান্ত বর্ণনা করল। তিনি বিশরকে বললেন, সে যা বলছে তা সঠিক? বিশর বলল, হাঁ। তিনি বললেন, ঠিক আছে, তোমরা অপেক্ষা কর। আমি আসছি। তিনি ভেতর থেকে তরবারি নিয়ে আসলেন এবং বিশরকে এই বলে কতল করে ফেললেন যে, যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ফয়সালায় রাজি হয় না, তার ব্যাপারে এই হচ্ছে আমার ফয়সালা। এ অবস্থা দেখে ইয়াহুদী ভয়ে পালিয়ে গেল। তারই পরিপ্রেক্ষিতে এ আয়াত নাযিল হয়েছে।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম সব শুনে হযরত উমর রাযি.-কে লক্ষ্য করে বললেন, তুমি 'আল ফারূক'- সত্য ও মিথ্যার মধ্যে পার্থক্যকারী। তখন থেকেই হযরত 'উমর ফারূক রাযি. 'আল-ফারুক' উপাধিতে পরিচিতি লাভ করেন। কুরতুবী, আল-জামে লি আহকামিল কুরআন, ৫ম খণ্ড, ১৭০ পৃ.
প্রকাশ থাকে যে, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি এ নিঃশর্ত আনুগত্যের হুকুম কেবল তাঁর জীবদ্দশার জন্যই নির্দিষ্ট নয়; বরং তাঁর ওফাতের পরও এ হুকুম বলবৎ রয়েছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত বলবৎ থাকবে। এখন তাঁর আনুগত্য করার অর্থ হচ্ছে তাঁর জীবনাদর্শের অনুসরণ করা তথা জীবনের প্রতিটি কাজ কুরআন-সুন্নাহর নির্দেশনা মোতাবেক সম্পন্ন করা।
ছয় নং আয়াত
فَإِنْ تَنَازَعْتُمْ فِي شَيْءٍ فَرُدُّوهُ إِلَى اللَّهِ وَالرَّسُولِ
অর্থ: অতঃপর তোমাদের মধ্যে যদি কোনও বিষয়ে বিরোধ দেখা দেয়, তবে তোমরা সে বিষয়কে আল্লাহ ও রাসুলের ওপর ন্যস্ত কর।সূরা নিসা (৪), আয়াত ৫৯
ব্যাখ্যা
এ আয়াতের সরাসরি সম্পর্ক আমীর ও শাসকের আনুগত্য করার সাথে। বোঝানো হচ্ছে, শাসকের কোনও আদেশ যদি তোমাদের কাছে আপত্তিকর মনে হয় এবং তোমরা মনে কর—তা শরী'আত বিরোধী, অপরদিকে শাসক আদেশটিকে শরী'আতসম্মতই মনে করে আর এভাবে উভয়পক্ষের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দেয়, তবে উভয়পক্ষের কর্তব্য হবে বিষয়টিকে আল্লাহ ও রাসূলের ওপর ন্যস্ত করা অর্থাৎ কুরআন ও সুন্নাহর মাপকাঠিতে যাচাই করা। যে মত কুরআন-সুন্নাহ মোতাবেক হবে, উভয়পক্ষের কর্তব্য হবে সেটিই মেনে নেওয়া, মতটি যে পক্ষেরই হোক না কেন।
আসল কথা হচ্ছে কুরআন-সুন্নাহর অনুসরণ। মতটি কার সেটি বিবেচ্য নয়। আমার মত নয় বলে মানব না, তা যতই কুরআন-সুন্নাহ মোতাবেক হোক না কেন—এ মনোভাব নিছক অহমিকা ও হঠকারিতা। কিছুতেই এটা একজন মু'মিনের চরিত্র হতে পারে না। তাই তো আয়াতে শর্ত বলে দেওয়া হয়েছে যে, যদি আল্লাহ ও পরকালের ওপর তোমাদের ঈমান থাকে। অর্থাৎ তোমরা যদি মু'মিন হও, তবে বিতর্কিত বিষয়ে কুরআন-সুন্নাহর শরণাপন্ন হওয়া ও তার ফয়সালা মেনে নেওয়া তোমাদের জন্য ফরয ও অবশ্যকর্তব্য।
এ আয়াতের সরাসরি সম্পর্ক যদিও শাসক ও জনগণের পারস্পরিক বিষয়ের সাথে, কিন্তু এর মর্মবস্তু ব্যাপক। অর্থাৎ যে-কোনও বিষয়ে যে কোনও দুই ব্যক্তি বা দুই পক্ষের মধ্যে মতভিন্নতা দেখা দিলে তাদের কর্তব্য সে বিষয়ে কুরআন-সুন্নাহর আলোকে ফয়সালা গ্রহণ করা। যে মত কুরআন-সুন্নাহ দ্বারা সমর্থিত হয়, সকলের কর্তব্য কোনওরূপ দ্বিধা-সংকোচ ছাড়া সেটিই মেনে নেওয়া।
বলাবাহুল্য, কুরআন-সুন্নাহর ফয়সালা মেনে নেওয়া রাসূলের ফয়সালা মেনে নেওয়াই বটে। এভাবে এ আয়াত দ্বারাও কিয়ামত পর্যন্ত সকল মানুষের জন্য নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের রেখে যাওয়া তরিকা ও সুন্নতের অনুসরণ করার অপরিহার্যতা প্রমাণিত হয়।
সাত নং আয়াত
مَنْ يُطِعِ الرَّسُولَ فَقَدْ أَطَاعَ الله
অর্থ : যে ব্যক্তি রাসূলের আনুগত্য করে সে আল্লাহরই আনুগত্য করল।সূরা নিসা (৪), আয়াত ৮০
ব্যাখ্যা
এ আয়াতে রাসূলের আনুগত্যকে আল্লাহরই আনুগত্য সাব্যস্ত করা হয়েছে। আল্লাহ তা'আলার আনুগত্য করা প্রতিটি মানুষের অবশ্যকর্তব্য। আল্লাহ তা'আলা মানুষকে সৃষ্টিই করেছেন এজন্য যে, তারা তাঁর আনুগত্য করে চলবে। কিন্তু তিনি তো গায়েব। মানুষ তাঁর আনুগত্য কিভাবে করবে? কী করে তারা জানবে কী কাজ করলে আল্লাহর আনুগত্য করা হয় আর কী করলে তাঁর অবাধ্যতা হয়ে যায়?
রাসূলের আনুগত্য আল্লাহরই আনুগত্য
আল্লাহ তা'আলা নবী-রাসূল পাঠিয়ে মানুষের এ সমস্যার সমাধান করে দিয়েছেন। তাঁরা আল্লাহ তা'আলার নাযিল করা ওহীর মাধ্যমে মানুষকে জানিয়ে দেন কোন্ কাজ তাঁর আনুগত্যমূলক আর কোন কাজ তাঁর অবাধ্যতামূলক। সেইসঙ্গে তাঁরা নিজ আচার-আচরণ দ্বারা দেখিয়েও দেন কিভাবে তাঁর আনুগত্য করতে হয় এবং কিভাবে তাঁর অবাধ্যতা থেকে বাঁচতে হয়। সুতরাং তাঁদের জীবন মানুষের জন্য আল্লাহর আনুগত্য করা ও তাঁর অবাধ্যতা হতে বাঁচার নমুনা। কাজেই কেউ যদি আল্লাহর অনুগত বান্দা হতে চায়, তবে তার একান্ত কর্তব্য হবে নবী-রাসূলগণের অনুসরণ ও আনুগত্য করা। তাঁদের আনুগত্য করলে তা আল্লাহ তা'আলার আনুগত্য বলেই গণ্য হবে।
হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম যেহেতু সর্বশেষ নবী ও রাসূল, তাই তাঁর আবির্ভাবের পর কিয়ামত পর্যন্ত সকল মানুষের কর্তব্য তাঁর আনুগত্য করা তথা তাঁর রেখে যাওয়া তরিকা ও সুন্নত অনুযায়ী চলা। এখন আল্লাহ তা'আলার অনুগত বান্দা হওয়ার একমাত্র উপায় এটাই। যারা মহানবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের তরিকা অনুযায়ী চলবে, কেবল তারাই আল্লাহর অনুগত বান্দারূপে গণ্য হবে। আর যারা তাঁর তরিকা অমান্য করবে, তারা আল্লাহ তা'আলারও অবাধ্য সাব্যস্ত হবে। সুতরাং আল্লাহ তা'আলার অনুগত বান্দারূপে জীবনযাপনের জন্য আমাদের প্রত্যেকের কর্তব্য সকল কাজকর্মে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের তরিকা ও সুন্নত অনুসরণ করে চলা। আল্লাহ তা'আলা আমাদেরকে তাওফীক দান করুন।
আট নং আয়াত
وَإِنَّكَ لَتَهْدِي إِلَى صِرَاطٍ مُسْتَقِيمٍ (52) صِرَاطِ اللَّهِ
অর্থ : নিশ্চয়ই তুমি মানুষকে দেখাচ্ছ হিদায়াতের সেই সরল পথ, যা আল্লাহর পথ।সূরা শূরা (৪২), আয়াত ৫২-৫৩
ব্যাখ্যা
অর্থাৎ তোমার প্রতি যে ওহী নাযিল করি, তার মাধ্যমে তুমি মানুষকে আল্লাহ পর্যন্ত পৌঁছার সরল সোজা পথ দেখিয়ে থাক। যারা আল্লাহ পর্যন্ত পৌঁছতে চাবে, তাদের কর্তব্য- তোমার দেখানো পথেই চলা।
সুন্নতের অনুসরণ ছাড়া আল্লাহকে পাওয়ার কোনও বিকল্প পথ নেই
এ আয়াত দ্বারাও সুন্নত তথা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের তরিকা অনুসরণের অপরিহার্যতা প্রমাণিত হয়। কেননা তিনি যে তরিকা রেখে গেছেন, এক তো তা তাঁর নিজের মনগড়া নয়; বরং আল্লাহপ্রদত্ত, দ্বিতীয়ত সে তরিকাই মানুষকে আল্লাহ পর্যন্ত পৌছায়। কোনও কালেই আল্লাহ পর্যন্ত পৌছার জন্য নবীদের দেখানো পথের কোনও বিকল্প ছিল না। সে বিকল্প নেই আজও। অর্থাৎ শেষ নবীর আগমনের পর এখন আল্লাহ পর্যন্ত পৌছার একমাত্র পথ নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের রেখে যাওয়া তরিকা। সুতরাং আল্লাহকে পেতে হলে সকলকে এ তরিকার ওপরই চলতে হবে। কেউ যদি অন্য কোনও বিকল্প অবলম্বন করে, তবে তা আর যাই হোক, আল্লাহর পথ হবে না এবং সে ব্যক্তি আর যাই পাক না কেন, আল্লাহকে কিছুতেই পেতে পারে না; বরং সে আল্লাহ থেকে দূরে সরে যাবে এবং ইবলীসের পদাঙ্ক অনুসারী বলে গণ্য হবে। যেমন এক আয়াতে ইরশাদ হয়েছে-
وَأَنَّ هَذَا صِرَاطِي مُسْتَقِيمًا فَاتَّبِعُوهُ وَلَا تَتَّبِعُوا السُّبُلَ فَتَفَرَّقَ بِكُمْ عَنْ سَبِيلِهِ
অর্থ : (হে নবী! তাদেরকে) আরও বল, এটা আমার সরল-সঠিক পথ। সুতরাং এর অনুসরণ কর, অন্য কোনও পথের অনুসরণ করো না, করলে তা তোমাদেরকে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেবে।সূরা আন'আম (৬), আয়াত ১৫৩
নয় নং আয়াত
فَلْيَحْذَرِ الَّذِينَ يُخَالِفُونَ عَنْ أَمْرِهِ أَنْ تُصِيبَهُمْ فِتْنَةٌ أَوْ يُصِيبَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ (63)
অর্থ : সুতরাং যারা তাঁর আদেশের বিরুদ্ধাচরণ করে, তাদের ভয় করা উচিত না-জানি তাদের ওপর কোনও বিপদ আপতিত হয় অথবা যন্ত্রণাদায়ক কোনও শাস্তি তাদেরকে আক্রান্ত করে। সূরা নূর (২৪), আয়াত ৬৩
ব্যাখ্যা
এর আগে মুনাফিকদের সম্পর্কে জানানো হয়েছে যে, তারা নানা বাহানায় ও বিভিন্ন ছলচাতুরীর মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট থেকে সরে পড়ত ও তাঁর হুকুম অমান্য করত। এস্থলে তাদেরকে সতর্ক করা হয়েছে যে, তারা যদি আল্লাহ ও রাসূলের বিরুদ্ধাচরণ থেকে বিরত না হয়, তবে আল্লাহ তা'আলা যে-কোনও মুহূর্তে তাদেরকে কঠিন শাস্তি দিতে পারেন আর আখিরাতের শাস্তি তো অবধারিত আছেই।
যদিও এ শান্তির সতর্কবাণী মুনাফিকদের চরিত্র বর্ণনা প্রসঙ্গে দেওয়া হয়েছে, কিন্তু এর শব্দাবলী ব্যাপক। যারাই আল্লাহ তা'আলা ও রাসূল সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিরুদ্ধাচরণ করে, তারাই এ সতর্কবাণীর আওতার মধ্যে রয়েছে। সুতরাং আমাদের সকলেরই সতর্ক হওয়া উচিত যাতে আমাদের কোনও কর্মকাণ্ড দ্বারা আল্লাহ তা'আলা ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিরুদ্ধাচরণ না হয়ে যায় এবং তার পরিণামে আল্লাহ তা'আলার আযাবের কবলে না পড়ে যাই। সে বিরুদ্ধাচরণ থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় জীবনের সকল ক্ষেত্রে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নত ও তরিকার অনুসরণ করা।
দশ নং আয়াত
وَاذْكُرْنَ مَا يُتْلَى فِي بُيُوتِكُنَّ مِنْ آيَاتِ اللَّهِ وَالْحِكْمَةِ
অর্থ : এবং তোমাদের গৃহে আল্লাহর যে আয়াতসমূহ ও হিকমতের কথা পাঠ করা হয়, তা স্মরণ রাখ।সূরা আহযাব (৩৩), আয়াত ৩৪
ব্যাখ্যা
এ আয়াতে আল্লাহর আয়াত দ্বারা কুরআন মাজীদ এবং 'হিকমত' দ্বারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নত ও শিক্ষামালা বোঝানো হয়েছে। এখানে সরাসরি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের স্ত্রীগণকে লক্ষ্য করে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যে, তোমাদের ঘরে কুরআনের যে আয়াত পাঠ করা হয় এবং নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের যে সুন্নত চর্চা করা হয়, তোমাদের কর্তব্য তা স্মরণ রাখা। স্মরণ রাখার দু'টি দিক রয়েছে-
এক হচ্ছে কুরআন ও সুন্নত সংরক্ষণ করা এবং ভুলে যাওয়া হতে তা হেফাজত করা। আরেকটি দিক হচ্ছে সে অনুযায়ী আমল করা।
আমল করা হচ্ছে মূল উদ্দেশ্য। আর সে উদ্দেশ্য পূরণের জন্য কুরআন ও সুন্নতের সংরক্ষণও জরুরি। সুতরাং এ দু'টি বিষয়ই স্মরণ রাখার নির্দেশের অন্তর্ভুক্ত।
বিশেষভাবে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের স্ত্রীগণকে লক্ষ্য করে এ নির্দেশ দেওয়ার কারণ হচ্ছে, তাঁর পারিবারিক জীবন সম্পর্কে জানার সর্বাপেক্ষা নির্ভরযোগ্য মাধ্যম তারাই। পারিবারিক জীবনযাপন সম্পর্কে ইসলামের বহু বিধি-বিধান আছে। সেসব বিধান সংরক্ষিত না থাকলে ইসলামের একটা বড় অংশই আমাদের অজ্ঞাত থেকে যেত। সে ক্ষেত্রে আমরা ইসলামের পূর্ণাঙ্গ অনুসরণ করতে সক্ষম হতাম না। অথচ কিয়ামত পর্যন্ত সমস্ত মানুষের জীবনের সকল ক্ষেত্রেই ইসলামের অনুসরণ জরুরি। মানুষের এ প্রয়োজন পূরণার্থেই নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের পরিবারের নারীগণকে এদিকে বিশেষভাবে মনোযোগী থাকতে বলা হয়েছে। বস্তুত তাঁর বহু বিবাহের একটা রহস্য এটাও যে, তাঁর স্ত্রীগণ তাঁর গার্হস্থ্য ও পারিবারিক জীবনের যাবতীয় বিষয় মনোযোগের সঙ্গে লক্ষ করবেন এবং তা যথাযথভাবে সংরক্ষণ করে মানুষের কাছে পৌছাবেন। সন্দেহ নেই যে, তাঁরা অত্যন্ত বিশ্বস্ততার সঙ্গে এ দায়িত্ব পালন করেছেন। উম্মুল মু'মিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রাযি. হযরত যায়নাব বিনতে জাহশ রাযি, হযরত উম্মু সালামা রাযি, হযরত মায়মুনা রাযি, প্রমুখের কাছ থেকে আমরা নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনের যে শিক্ষা ও আদর্শসমূহ জানতে পেরেছি, তা ইসলামী শিক্ষামালার এক বিস্তৃত অধ্যায়। এজন্য আল্লাহ তা'আলা আমাদের এবং সমগ্র উম্মতের পক্ষ থেকে তাঁদেরকে তাঁর শান মোতাবেক জাযায়ে খায়র দান করুন।
যদিও সরাসরি এ হুকুম দেওয়া হয়েছে উম্মাহাতুল মু'মিনীনকে অর্থাৎ নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের স্ত্রীগণকে, কিন্তু পরোক্ষভাবে আমাদের জন্যও এ হুকুম প্রযোজ্য। কেননা কুরআন-হাদীছের বিধানাবলী বিশ্বের সমস্ত মানুষের জন্য দেওয়া। তাই সকলেরই কর্তব্য সেসব বিধান মেনে চলা। আর কিয়ামত পর্যন্ত সমস্ত মানুষ যাতে তা মেনে চলতে পারে, সে লক্ষ্যে এর হেফাজতের ব্যবস্থা গ্রহণও সকলের জন্য জরুরি। একদল তো সক্রিয়ভাবেই তাতে লিপ্ত থাকবে এবং কুরআন-হাদীছের হেফাজত সংক্রান্ত যাবতীয় কাজে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করবে, আর অন্যরা সেই জীবনোৎসর্গকারীদের সর্বাত্মক সমর্থন ও সহযোগিতা দিয়ে যাবে। আল্লাহ তা'আলা আমাদের সকলকে এ হুকুম মেনে চলার তাওফীক দান করুন।
* সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ১০১৭: সুনানে নাসাঈ, হাদীছ নং ২৫৫৪; সুনানে ইবন মাজাহ, হাদীছ নং ২০৩; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ১৯১৫৬
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের যাবতীয় আদেশ-নিষেধ পালনে যত্নবান থাকা ও বাড়তি প্রশ্ন হতে বিরত থাকার গুরুত্ব
হাদীছ নং: ১৫৬
আবূ হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, আমি যতক্ষণ তোমাদের ছেড়ে দিই (অর্থাৎ কোনও বিষয়ে বিস্তারিত কিছু না বলি), ততক্ষণ তোমরাও আমাকে ছেড়ে দিও (অর্থাৎ সে বিষয়ে কোনও প্রশ্ন করো না)। তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদেরকে তো ধ্বংস করেছে তাদের অত্যধিক প্রশ্ন এবং তাদের নবীদের সঙ্গে বিরোধতায় লিপ্ত হওয়া। সুতরাং আমি যখন তোমাদেরকে কোনও বিষয়ে নিষেধ করি, তখন তোমরা তা থেকে বিরত থাকবে। আর যখন তোমাদেরকে কোনও বিষয়ে আদেশ করি, তখন যথাসাধ্য তা পালন করবে -বুখারী ও মুসলিম।
(সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৭২৮৮; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ১৩৩৭; সুনানে নাসাঈ, হাদীছ নং ২৬১৯: জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ২৮৭৪; সুনানে ইবন মাজাহ, হাদীছ নং ২)
হাদীছ নং: ১৫৬
আবূ হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, আমি যতক্ষণ তোমাদের ছেড়ে দিই (অর্থাৎ কোনও বিষয়ে বিস্তারিত কিছু না বলি), ততক্ষণ তোমরাও আমাকে ছেড়ে দিও (অর্থাৎ সে বিষয়ে কোনও প্রশ্ন করো না)। তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদেরকে তো ধ্বংস করেছে তাদের অত্যধিক প্রশ্ন এবং তাদের নবীদের সঙ্গে বিরোধতায় লিপ্ত হওয়া। সুতরাং আমি যখন তোমাদেরকে কোনও বিষয়ে নিষেধ করি, তখন তোমরা তা থেকে বিরত থাকবে। আর যখন তোমাদেরকে কোনও বিষয়ে আদেশ করি, তখন যথাসাধ্য তা পালন করবে -বুখারী ও মুসলিম।
(সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৭২৮৮; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ১৩৩৭; সুনানে নাসাঈ, হাদীছ নং ২৬১৯: জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ২৮৭৪; সুনানে ইবন মাজাহ, হাদীছ নং ২)
مقدمة الامام النووي
16 - باب في الأمر بالمحافظة عَلَى السنة وآدابها
قَالَ الله تَعَالَى: {وَمَا آتَاكُمُ الرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَاكُمْ عَنْهُ فَانْتَهُوا} [الحشر: 7]، وَقالَ تَعَالَى: {وَمَا يَنْطِقُ عَنِ الْهَوَى إِنْ هُوَ إِلا وَحْيٌ يُوحَى} [النجم:3 - 4]، وَقالَ تَعَالَى: {قُلْ إِنْ كُنْتُمْ تُحِبُّونَ اللهَ فَاتَّبِعُونِي يُحْبِبْكُمُ اللهُ وَيَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوبَكُمْ} [آل عمران: 31]، وَقالَ تَعَالَى: {لَقَدْ كَانَ لَكُمْ فِي رَسُولِ اللهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ لِمَنْ كَانَ يَرْجُو اللهَ وَالْيَوْمَ الآخِر} [الأحزاب:21]، وَقالَ تَعَالَى: {فَلا وَرَبِّكَ لا يُؤْمِنُونَ حَتَّى يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَيْنَهُمْ ثُمَّ لا يَجِدُوا فِي أَنْفُسِهِمْ حَرَجًا مِمَّا قَضَيْتَ وَيُسَلِّمُوا تَسْلِيمًا} [النساء: 65]، وَقالَ تَعَالَى: {فَإِنْ تَنَازَعْتُمْ فِي شَيْءٍ فَرُدُّوهُ إِلَى اللهِ وَالرَّسُولِ} [النساء: 59] قَالَ العلماء: معناه إِلَى الكتاب والسُنّة، وَقالَ تَعَالَى: {مَنْ يُطِعِ الرَّسُولَ فَقَدْ أَطَاعَ الله} [النساء:80]، وَقالَ تَعَالَى: {وَإِنَّكَ لَتَهْدِي إِلَى صِرَاطٍ مُسْتَقِيمٍ صِراطِ اللهِ} [الشورى: 52 - 53]، وَقالَ تَعَالَى: {فَلْيَحْذَرِ الَّذِينَ يُخَالِفُونَ عَنْ أَمْرِهِ أَنْ تُصِيبَهُمْ فِتْنَةٌ أَوْ يُصِيبَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ} [النور: 63]، وَقالَ تَعَالَى: {وَاذْكُرْنَ مَا يُتْلَى فِي بُيُوتِكُنَّ مِنْ آيَاتِ اللهِ وَالْحِكْمَةِ} [الأحزاب: 34]، والآيات في الباب كثيرة.
قَالَ الله تَعَالَى: {وَمَا آتَاكُمُ الرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَاكُمْ عَنْهُ فَانْتَهُوا} [الحشر: 7]، وَقالَ تَعَالَى: {وَمَا يَنْطِقُ عَنِ الْهَوَى إِنْ هُوَ إِلا وَحْيٌ يُوحَى} [النجم:3 - 4]، وَقالَ تَعَالَى: {قُلْ إِنْ كُنْتُمْ تُحِبُّونَ اللهَ فَاتَّبِعُونِي يُحْبِبْكُمُ اللهُ وَيَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوبَكُمْ} [آل عمران: 31]، وَقالَ تَعَالَى: {لَقَدْ كَانَ لَكُمْ فِي رَسُولِ اللهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ لِمَنْ كَانَ يَرْجُو اللهَ وَالْيَوْمَ الآخِر} [الأحزاب:21]، وَقالَ تَعَالَى: {فَلا وَرَبِّكَ لا يُؤْمِنُونَ حَتَّى يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَيْنَهُمْ ثُمَّ لا يَجِدُوا فِي أَنْفُسِهِمْ حَرَجًا مِمَّا قَضَيْتَ وَيُسَلِّمُوا تَسْلِيمًا} [النساء: 65]، وَقالَ تَعَالَى: {فَإِنْ تَنَازَعْتُمْ فِي شَيْءٍ فَرُدُّوهُ إِلَى اللهِ وَالرَّسُولِ} [النساء: 59] قَالَ العلماء: معناه إِلَى الكتاب والسُنّة، وَقالَ تَعَالَى: {مَنْ يُطِعِ الرَّسُولَ فَقَدْ أَطَاعَ الله} [النساء:80]، وَقالَ تَعَالَى: {وَإِنَّكَ لَتَهْدِي إِلَى صِرَاطٍ مُسْتَقِيمٍ صِراطِ اللهِ} [الشورى: 52 - 53]، وَقالَ تَعَالَى: {فَلْيَحْذَرِ الَّذِينَ يُخَالِفُونَ عَنْ أَمْرِهِ أَنْ تُصِيبَهُمْ فِتْنَةٌ أَوْ يُصِيبَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ} [النور: 63]، وَقالَ تَعَالَى: {وَاذْكُرْنَ مَا يُتْلَى فِي بُيُوتِكُنَّ مِنْ آيَاتِ اللهِ وَالْحِكْمَةِ} [الأحزاب: 34]، والآيات في الباب كثيرة.
156 - فالأول: عن أبي هريرةَ - رضي الله عنه - عن النَّبيّ - صلى الله عليه وسلم - قَالَ: «دَعُونِي مَا تَرَكْتُكُمْ، إِنَّمَا أهْلَكَ مَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ كَثْرَةُ سُؤَالِهِمْ واخْتِلافُهُمْ عَلَى أَنْبيَائِهِمْ، فَإِذَا نَهَيْتُكُمْ عَنْ شَيْء فَاجْتَنِبُوهُ، وَإِذَا أمَرْتُكُمْ بِأمْرٍ فَأْتُوا مِنْهُ مَا اسْتَطَعْتُمْ». مُتَّفَقٌ عَلَيهِ. (1)
হাদীসের ব্যাখ্যা:
এ হাদীছটির একটি পটভূমি আছে, যা মুসলিম শরীফের বর্ণনায় এভাবে উল্লেখ আছে যে, হযরত আবূ হুরায়রা রাযি. বলেন, একদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের লক্ষ্য করে ভাষণ দেন। তাতে তিনি বলেন, হে লোকসকল! আল্লাহ তা'আলা তোমাদের প্রতি হজ্জ ফরয করেছেন। সুতরাং তোমরা হজ্জ আদায় করবে। তখন এক ব্যক্তি উঠে বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! তা কি প্রতি বছর? তিনি নীরব থাকলেন। লোকটি আবারও সেই প্রশ্ন করল। এভাবে তিনবার। শেষে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আমি যদি হাঁ বলতাম, তবে (প্রতি বছরই হজ্জ আদায় করা) অবশ্যকর্তব্য হয়ে যেত এবং তোমরা তা পালন করতে পারতে না। তারপর তিনি এ হাদীছ ইরশাদ করেন।
ইমাম দারাকুতনীর বর্ণনায় আছে, এরই পরিপ্রেক্ষিতে নিম্নোক্ত আয়াত নাযিল হয়ঃ-
يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَسْأَلُوا عَنْ أَشْيَاءَ إِنْ تُبْدَ لَكُمْ تَسُؤْكُمْ وَإِنْ تَسْأَلُوا عَنْهَا حِينَ يُنَزَّلُ الْقُرْآنُ تُبْدَ لَكُمْ عَفَا اللَّهُ عَنْهَا وَاللَّهُ غَفُورٌ حَلِيمٌ
অর্থ : হে মুমিনগণ! তোমরা এমন সব বিষয়ে প্রশ্ন করো না, যা প্রকাশ করা হলে তোমাদের কাছে অপ্রীতিকর মনে হবে। তোমরা যদি এমন সময়ে সে সম্পর্কে জিজ্ঞেস কর, যখন কুরআন নাযিল হয়, তবে তা তোমাদের কাছে প্রকাশ করা হবে। (অবশ্য) আল্লাহ ইতঃপূর্বে যা হয়েছে তা ক্ষমা করে দিয়েছেন। আল্লাহ অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। (সূরা মায়িদা (৫), আয়াত ১০১)
অপ্রয়োজনীয় প্রশ্ন করার নিন্দা ও তার অশুভ পরিণাম সম্পর্কে সতর্কবাণী
আয়াতের মর্ম এই যে, যেসব বিষয়ের বিশেষ কোনও প্রয়োজন নেই, প্রথমত তার অনুসন্ধানে লিপ্ত হওয়া একটা নিরর্থক কাজ। দ্বিতীয়ত আল্লাহ তাআলা অনেক সময় কোনও কোনও বিষয়ে সংক্ষিপ্ত আদেশ দান করেন। সেই আদেশ অনুসারে মোটামুটিভাবে কাজ করলেই যথেষ্ট হয়ে যায়। সে বিষয়ে বিস্তারিতভাবে কিছু জানানোর দরকার হলে খোদ কুরআন মাজীদ কিংবা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদীসের মাধ্যমে তা জানিয়ে দেওয়া হত। তা যখন করা হয়নি তখন এর চুলচেরা বিশ্লেষণের পেছনে পড়ার কোনও দরকার নেই। সেইসঙ্গে এটাও বলে দেওয়া হয়েছে যে, কুরআন নাযিলের সময় তোমাদের প্রশ্নের উত্তরে এ সম্পর্কে কোনও কঠিন বিধান এসে গেলে তোমাদের নিজেদের পক্ষেই সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। তাই এর থেকে বিরত থাকাই বাঞ্ছনীয়।
বনী ইসরাঈলের স্বভাব ছিল আল্লাহর পক্ষ থেকে কোনও হুকুম দেওয়া হলে সে সম্পর্কে অহেতুক প্রশ্ন করতে থাকা। ফলে বিষয়টা তাদের জন্য জটিল হয়ে যেত। এ ব্যাপারে গাভী জবাই সংক্রান্ত ঘটনাটি প্রসিদ্ধ। জনৈক নিহত ব্যক্তির হত্যাকারীকে শনাক্ত করার জন্য তাদেরকে একটি গাভী জবাইয়ের হুকুম দেওয়া হয়েছিল। হুকুমটি স্পষ্ট। ফলে যে-কোনও একটি গাভী জবাই করলেই চলত। কিন্তু তারা বাড়াবাড়ি শুরু করল। গাভীটি কী বয়সী হবে, কী রঙের হবে ইত্যাদি নানা বিষয়ে তারা একের পর এক প্রশ্ন করতে থাকল। এতে করে শেষপর্যন্ত যে ধরনের গাভী নির্ধারিত হল, তা সংগ্রহ করতে তাদেরকে অনেক বেগ পেতে হয়েছিল। এটা ছিল তাদের অহেতুক প্রশ্ন করতে থাকার পরিণাম।
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম আশঙ্কাবোধ করেছিলেন, অহেতুক প্রশ্নের কারণে তাঁর উম্মতও পাছে কোনও জটিলতার সম্মুখীন হয় এবং এমন কোনও বিধান তাদের দিয়ে দেওয়া হয়, যা পালন করতে তাদের হিমশিম খেতে হবে। কাজেই ‘হজ্জ প্রতি বছর করতে হবে কি না? -এ প্রশ্ন যখন তাঁকে করা হল, তখন এর উত্তর না দিয়ে বরং এ জাতীয় প্রশ্ন করতেই নিষেধ করে দিলেন। কেননা প্রশ্নটি করার কোনও দরকার ছিল না। হজ্জ করার হুকুম দেওয়া হয়েছে। ব্যস একবার হজ্জ করলেই তো হুকুম পালন হয়ে গেল। প্রতি বছর করতে হবে কি না, এটা অতিরিক্ত কৌতূহল। বনী ইসরাঈলের মত এ কৌতূহল যদি মিটিয়ে দেওয়া হত আর প্রতি বছর হজ্জ ফরয করা হত, তবে তা কতই না কঠিন হয়ে যেত! তাই প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্পষ্ট বলে দেন-
دعوني ما تركتكم
“আমি যতক্ষণ তোমাদের ছেড়ে দিই (অর্থাৎ কোনও বিষয়ে বিস্তারিত কিছু না বলি), ততক্ষণ তোমরাও আমাকে ছেড়ে দিও।”
যে বিষয়ে খুঁটিনাটি বিবরণ দেওয়া হয়নি, তার যতটুকু বলা হয়েছে তা পালন করা যদি সম্ভব হয়, তবে তোমরা তার খুঁটিনাটির পেছনে পড়বে না। যতটুকু বলা হয়েছে অতটুকুতেই ক্ষান্ত থাকবে, যদিও বিষয়টি খুঁটিনাটি ব্যাখ্যার অবকাশ রাখে। যেমন এ হজ্জের আদেশ। একবার হজ্জ করলেই আদেশের ওপর আমল হয়ে যায়। যদিও এর মধ্যে এ অবকাশ আছে যে, হয়তো এটা প্রতি বছরই করতে হবে, কিন্তু তা যখন পরিষ্কারভাবে বলে দেওয়া হয়নি, তখন শুধু শুধু তার পেছনে পড়া কেন এবং কেন এই প্রশ্ন করতে যাওয়া যে, প্রতি বছরই হজ্জ করতে হবে কি? অসম্ভব নয় এ প্রশ্নের পরিণামে হুকুম দিয়ে দেওয়া হবে যে, হাঁ, প্রতি বছরই হজ্জ করতে হবে আর এভাবে সহজ বিষয়টি কঠিন হয়ে যাবে। এ কারণেই বাড়তি প্রশ্ন করতে নিষেধ করা হয়েছে।
এক হাদীছে ইরশাদ-
إن أعظم المسلمين جرما : من سأل عن شيء لم يحرم، فحرم من أجل مسألته
‘মুসলমানদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা গুরুতর অপরাধী সেই ব্যক্তি, যে ব্যক্তি এমন কোনও বিষয়ে প্রশ্ন করে, যা হারাম করা হয়নি। অতঃপর তার প্রশ্নের কারণে তা হারাম করে দেওয়া হয়েছে। (সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৭২৮৯; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ২৩৫৮)
প্রকাশ থাকে যে, যে প্রশ্নের কারণে কোনও হালাল বস্তু হারাম কিংবা কোনও সহজ বিধান কঠিন হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে, সেরকম প্রশ্ন নিষিদ্ধ ছিল কেবল রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আমলে। কেননা এরকম আশঙ্কা কেবল তাঁর আমলেই হতে পারত। তাঁর ওফাতের পর সেরকম কোনও আশঙ্কা থাকেনি। কেননা বিধান তো তাঁর মাধ্যমেই দেওয়া হত। তাঁর ওফাতের পর নতুন কোনও বিধান আসার সুযোগ নেই। ফলে এরূপ প্রশ্নের নিষেধাজ্ঞাও আর বাকি নেই। এখন কোনও বিধান সম্পর্কে বিস্তারিত অবগতি লাভের জন্য উলামায়ে কিরামের কাছে এরূপ প্রশ্ন করার অবকাশ আছে।
প্রশ্ন করা বৈধ হয় কেবল তখনই, যখন উদ্দেশ্য হয় নিজ অজ্ঞতা দূর করা। উদ্দেশ্য যদি হয় কাউকে আটকানো, তবে এরূপ প্রশ্ন করা কিছুতেই জায়েয নয়। এমনিভাবে নিজ বাহাদুরী ফলানোর জন্যও প্রশ্ন করা বৈধ হতে পারে না। যেসব বিষয় জানার কোনও প্রয়োজন নেই, সে সম্পর্কে প্রশ্ন করাও একটি অহেতুক কাজ। ইসলামে অহেতুক কাজ পছন্দনীয় নয়।
অতঃপর তিনি ইরশাদ করেনঃ-
إنما أهلك من كان قبلكم كثرة سؤالهم واختلافهم على أنبيائهم
তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদেরকে তো ধ্বংস করেছে তাদের অত্যধিক প্রশ্ন এবং তাদের নবীদের সঙ্গে বিরোধতায় লিপ্ত হওয়া। অর্থাৎ যে সকল বিষয় জানার দরকার ছিল না বা কোনও বিষয়ের যে খুঁটিনাটি জানানো হয়নি, তারা তাদের নবীগণের কাছে সে সম্পর্কে খুব বেশি বেশি প্রশ্ন করত আর সে কারণে সহজ সহজ বিধানের সাথে নানারকম খুঁটিনাটি যোগ হয়ে তা অত্যন্ত কঠিন ও জটিল হয়ে যেত। সে সকল জটিল বিধান পালন করতে তাদের অত্যন্ত বেগ পেতে হত। অনেক সময় নানা ছলছুতায় তা পালন করা হতে বিরত থাকত। এভাবে কালক্রমে তারা তাদের শরী'আতের বিধি-বিধান থেকে বিমুখ হয়ে পড়ত। একটা জাতির শরী‘আতবিমুখ হয়ে পড়াটা তাদের ধ্বংস হওয়াই তো বটে। কেননা সে ক্ষেত্রে তাদের সামগ্রিক জীবন শর'ঈ জীবনকাঠামো থেকে আলাদা হয়ে যায়। তাদের দীনী জাতিসত্তা বিলুপ্ত হয়ে নতুন এক জাতিতে পরিণত হয়, যা সম্পূর্ণ বিকৃত ও নষ্টভ্রষ্ট এক জাতি।
অনেক সময় আসমানী আযাব দ্বারা তাদেরকে ভূপৃষ্ঠ থেকেই সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হত। কুরআন মাজীদে এমন বহু জাতির কথা উল্লেখ করা হয়েছে, আল্লাহ তা'আলা যাদেরকে বিভিন্ন রকম আযাব দিয়ে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দিয়েছেন।
নবীর আদেশের বিপরীতে নিজস্ব মত খাটানো
তাদের ধ্বংসের দ্বিতীয় কারণ বলা হয়েছে নবীদের সঙ্গে ইখতিলাফ করা ও বিরোধিতায় লিপ্ত হওয়া। এর দ্বারা বোঝানো উদ্দেশ্য নবীগণ কোনও হুকুম দিলে সেই হুকুম সম্পর্কে প্রশ্ন তোলা ও তার বিপরীতে নিজেদের মতামত উত্থাপন করা। উম্মতের কাজ হলো নবী যে হুকুম দেন তা বিনাবাক্যে মেনে নেওয়া। হুকুমের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা বা তার বিপরীতে নিজেদের মতামত দিতে যাওয়া—একরকম স্পর্ধা ও অবাধ্যতা। বনী ইসরাঈল তাদের নবীদের সঙ্গে এরকম অবাধ্যতা বার বার করেছে আর এ কারণে তাদেরকে আল্লাহ তা'আলার পক্ষ হতে বিভিন্ন শাস্তিও ভোগ করতে হয়েছে। তাই প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজ উম্মতকে সতর্ক করছেন, তারা যেন নবীর হুকুমের বিপরীত নিজেদের মতামত খাটানোর চেষ্টা না করে বা সে হুকুমের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন না তোলে। কেননা তাহলে আগের উম্মতের মত তাদেরকেও শাস্তির সম্মুখীন হতে হবে।
অতঃপর নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেনঃ-
فإذا نهيتكم عن شيء فاجتنبوه، وإذا أمرتكم بأمر فأتوا منه ما استطعتم
‘সুতরাং আমি যখন তোমাদেরকে কোনও বিষয়ে নিষেধ করি, তখন তোমরা তা থেকে বিরত থাকবে। আর যখন তোমাদেরকে কোনও বিষয়ে আদেশ করি, তখন যথাসাধ্য তা পালন করবে।'
এর দ্বারা শরী'আতের যাবতীয় আদেশ-নিষেধ মেনে চলার প্রতি তাগিদ করা হয়েছে।
আদেশ পালনের ক্ষেত্রে ‘যথাসাধ্য' কথাটি যোগ করা হয়েছে। নিষেধাজ্ঞা পালনের ক্ষেত্রে এ কথা যোগ করা হয়নি। অথচ শরী'আত তার যাবতীয় বিধানেই মানুষের সক্ষমতার বিষয়টি বিবেচনায় রেখেছে। কুরআন মাজীদ সুস্পষ্টই বলেছেঃ-
وما جعل عليكم في الدين من حرج
অর্থ : তিনি দীনের ব্যাপারে তোমাদের প্রতি কোনও সংকীর্ণতা আরোপ করেননি। (সূরা হজ্জ (২২), আয়াত ৭৮) অর্থাৎ শরী'আতের বিধান পালনের ব্যাপারে কোনওরকম ওযর গ্রহণযোগ্য নয় ব্যাপারটা এরকম নয়। বরং ওযর অনুপাতে ছাড়ও দেওয়া হয়েছে। যেমন মরা জন্তু খাওয়া নিষেধ। কিন্তু কারও যদি কোনও হালাল খাদ্য না থাকে আর এ অবস্থায় ক্ষুধায় মারা যাওয়ার উপক্রম হয়, সে ক্ষেত্রে তার জন্য মরা জন্তু খেয়ে প্রাণ রক্ষা করা জায়েয। দেখা যাচ্ছে নিষেধাজ্ঞার ক্ষেত্রেও সাধ্য ও সক্ষমতার বিষয়টা বিবেচনায় রাখা হয়েছে।
সক্ষমতা অনুযায়ী আদেশ পালন
সুতরাং প্রশ্ন ওঠে, এ হাদীছে কেবল আদেশের ক্ষেত্রে 'যথাসাধ্য শব্দ কেন ব্যবহৃত হল? এর উত্তর হচ্ছে, তুলনামূলকভাবে নিষেধাজ্ঞার চেয়ে আদেশ পালন করা কঠিন। কেননা নিষেধাজ্ঞার অর্থ হচ্ছে কোনও কাজ করা হতে বিরত থাকা। অপরদিকে আদেশ পালন করতে গেলে কাজটি করতে হয়। বলাবাহুল্য, বিরত থাকা অপেক্ষা কাজ সম্পাদন করা কঠিন। তাই তুলনামূলকভাবে নিষেধাজ্ঞার চেয়ে আদেশ পালনের ক্ষেত্রেই অক্ষমতা বেশি দেখা দিয়ে থাকে। আর সে কারণেই বলা হয়েছে- তোমাদেরকে যা আদেশ করা হয়েছে তা যথাসাধ্য অর্থাৎ সক্ষমতা অনুযায়ী পালন করবে।
উদাহরণ দেওয়া যায় নামায দ্বারা। নামায দাঁড়িয়ে পড়া ফরয। কিন্তু কারও যদি এমন ওযর থাকে, যদ্দরুন দাঁড়িয়ে নামায পড়া তার পক্ষে সম্ভব নয়, তবে সে বসে বসে পড়বে। যদি বসতেও না পারে তবে শুয়ে শুয়ে পড়বে। নামায কিবলার দিকে ফিরে পড়া ফরয। কেউ যদি এমন কোনও জায়গায় থাকে, যেখানে তার পক্ষে নিশ্চিত কিবলা ঠিক করা সম্ভব নয়, তবে সে অনুমানের ওপর নির্ভর করবে এবং যেদিকে কিবলা বলে তার অনুমান ও প্রবল ধারণা হয়, সেদিকে ফিরে নামায পড়বে। এমনিভাবে মাটিতে মাথা রেখে সিজদা করা ফরয। কিন্তু কারও যদি ওযরের কারণে এভাবে সিজদা করা সম্ভব না হয়, তবে সে ইশারা দ্বারা সিজদা আদায় করবে। আর যদি কোনওভাবেই তার পক্ষে নামায পড়া সম্ভব না হয়, তবে তার জন্য পুরোপুরি মাফ। নামায পড়ার দায়িত্ব থেকে তাকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে।
এভাবে শরী'আতের সবগুলো বিধান পালনের ক্ষেত্রেই সাধ্য ও সক্ষমতার প্রতি দৃষ্টি রাখা হয়েছে। অর্থাৎ ক্ষমতা থাকলেই পালন করতে হবে। যার যতটুকু ক্ষমতা থাকে, সে ততটুকু পালন করবে। যার বিলকুল ক্ষমতা থাকে না, সে পুরোপুরি মুক্ত। এ ক্ষেত্রে প্রত্যেকের কর্তব্য ‘উলামায়ে কিরামের শরণাপন্ন হওয়া। নিজে নিজে কোনও একটা বিষয়কে ওযর ধরে হুকুম পালনে কাটছাট করা কিছুতেই উচিত হবে না।
এ হাদীছে মূলত নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের যাবতীয় আদেশ নিষেধ পালনে যত্নবান থাকা ও বাড়তি প্রশ্ন করা হতে বিরত থাকা সম্পর্কে তাগিদ করা হয়েছে। অর্থাৎ প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম বোঝাচ্ছেন, তোমাদের কাজ কেবল আমার যাবতীয় আদেশ-নিষেধ পালন করে যাওয়া। তাঁর আদেশ-নিষেধের সমষ্টিকেই শরী'আত বলে এবং তা তাঁর সুন্নত ও তরিকাও বটে। ব্যস উম্মতের কাজ হচ্ছে সেই তরিকার ওপর চলতে থাকা। বাড়তি প্রশ্নের পেছনে পড়ার কোনও ফায়দা নেই; বরং তাতে ক্ষতিরই আশঙ্কা থাকে, যেমনটা পূর্বে বলা হয়েছে।
উল্লেখ্য : হাদীছে প্রয়োজনের অতিরিক্ত প্রশ্ন করতে বারণ করা হয়েছে। বোঝা গেল দরকারি প্রশ্ন করা নিষেধ নয়; বরং যে বিষয়ে জানার প্রয়োজন আছে এবং যার সাথে ঈমান ও আমলের সম্পর্ক আছে, সে সম্পর্কে তো জিজ্ঞেস করাই জরুরি। এরকম বিষয়ে প্রশ্ন করতে কুরআন ও হাদীছে হুকুমও করা হয়েছে। যেমন কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছেঃ-
فَاسْأَلُوا أَهْلَ الذِّكْرِ إِنْ كُنْتُمْ لَا تَعْلَمُونَ
অর্থ : তোমরা নিজেরা যদি না জান, তবে জ্ঞানীজনকে জিজ্ঞেস কর। (সূরা নাহল (১৬), আয়াত ৪৩)
এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেনঃ-
إنما شفاء العي السؤال
‘অজ্ঞতার উপশম তো জিজ্ঞেস করাই। (সুনানে আবু দাউদ, হাদীছ নং ৩৩৬; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীছ নং ৫৭২)
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. আমাদের কর্তব্য নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের যাবতীয় আদেশ নিষেধ পালন তথা তাঁর তরিকার ওপর চলাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া।
খ. নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের তরিকার ওপর চলাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়ার দাবি এটাও যে, তাঁর তরিকা কী, আমরা তা ভালোভাবে জেনে নেব।
গ. জানার একটি পন্থা হচ্ছে খাঁটি 'উলামায়ে কিরামের কাছে জিজ্ঞেস করা। সুতরাং আমরা দীনের জ্ঞাতব্য বিষয় সম্পর্কে জানার জন্য তাঁদের শরণাপন্ন হব।
ঘ. ‘উলামায়ে কিরামের কাছে কেবল এমন বিষয়ই জানতে চাব, যার সাথে ঈমান ও আমলের সম্পর্ক আছে। এর বাইরে ফযূল প্রশ্নের (অহেতুক) পেছনে পড়ব না। ফযূল প্রশ্ন করা একটি নিন্দনীয় কাজ।
ঙ. শরী'আতের আদেশ-নিষেধের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা একটি ধ্বংসাত্মক কাজ।
চ. কুরআন-হাদীছের বিপরীতে নিজেদের মতামত খাটানো সুস্পষ্ট গোমরাহী। এতে ব্যাপকভাবে লিপ্ত হওয়ার পরিণাম জাতীয় অস্তিত্বের বিলুপ্তি।
ইমাম দারাকুতনীর বর্ণনায় আছে, এরই পরিপ্রেক্ষিতে নিম্নোক্ত আয়াত নাযিল হয়ঃ-
يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَسْأَلُوا عَنْ أَشْيَاءَ إِنْ تُبْدَ لَكُمْ تَسُؤْكُمْ وَإِنْ تَسْأَلُوا عَنْهَا حِينَ يُنَزَّلُ الْقُرْآنُ تُبْدَ لَكُمْ عَفَا اللَّهُ عَنْهَا وَاللَّهُ غَفُورٌ حَلِيمٌ
অর্থ : হে মুমিনগণ! তোমরা এমন সব বিষয়ে প্রশ্ন করো না, যা প্রকাশ করা হলে তোমাদের কাছে অপ্রীতিকর মনে হবে। তোমরা যদি এমন সময়ে সে সম্পর্কে জিজ্ঞেস কর, যখন কুরআন নাযিল হয়, তবে তা তোমাদের কাছে প্রকাশ করা হবে। (অবশ্য) আল্লাহ ইতঃপূর্বে যা হয়েছে তা ক্ষমা করে দিয়েছেন। আল্লাহ অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। (সূরা মায়িদা (৫), আয়াত ১০১)
অপ্রয়োজনীয় প্রশ্ন করার নিন্দা ও তার অশুভ পরিণাম সম্পর্কে সতর্কবাণী
আয়াতের মর্ম এই যে, যেসব বিষয়ের বিশেষ কোনও প্রয়োজন নেই, প্রথমত তার অনুসন্ধানে লিপ্ত হওয়া একটা নিরর্থক কাজ। দ্বিতীয়ত আল্লাহ তাআলা অনেক সময় কোনও কোনও বিষয়ে সংক্ষিপ্ত আদেশ দান করেন। সেই আদেশ অনুসারে মোটামুটিভাবে কাজ করলেই যথেষ্ট হয়ে যায়। সে বিষয়ে বিস্তারিতভাবে কিছু জানানোর দরকার হলে খোদ কুরআন মাজীদ কিংবা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদীসের মাধ্যমে তা জানিয়ে দেওয়া হত। তা যখন করা হয়নি তখন এর চুলচেরা বিশ্লেষণের পেছনে পড়ার কোনও দরকার নেই। সেইসঙ্গে এটাও বলে দেওয়া হয়েছে যে, কুরআন নাযিলের সময় তোমাদের প্রশ্নের উত্তরে এ সম্পর্কে কোনও কঠিন বিধান এসে গেলে তোমাদের নিজেদের পক্ষেই সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। তাই এর থেকে বিরত থাকাই বাঞ্ছনীয়।
বনী ইসরাঈলের স্বভাব ছিল আল্লাহর পক্ষ থেকে কোনও হুকুম দেওয়া হলে সে সম্পর্কে অহেতুক প্রশ্ন করতে থাকা। ফলে বিষয়টা তাদের জন্য জটিল হয়ে যেত। এ ব্যাপারে গাভী জবাই সংক্রান্ত ঘটনাটি প্রসিদ্ধ। জনৈক নিহত ব্যক্তির হত্যাকারীকে শনাক্ত করার জন্য তাদেরকে একটি গাভী জবাইয়ের হুকুম দেওয়া হয়েছিল। হুকুমটি স্পষ্ট। ফলে যে-কোনও একটি গাভী জবাই করলেই চলত। কিন্তু তারা বাড়াবাড়ি শুরু করল। গাভীটি কী বয়সী হবে, কী রঙের হবে ইত্যাদি নানা বিষয়ে তারা একের পর এক প্রশ্ন করতে থাকল। এতে করে শেষপর্যন্ত যে ধরনের গাভী নির্ধারিত হল, তা সংগ্রহ করতে তাদেরকে অনেক বেগ পেতে হয়েছিল। এটা ছিল তাদের অহেতুক প্রশ্ন করতে থাকার পরিণাম।
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম আশঙ্কাবোধ করেছিলেন, অহেতুক প্রশ্নের কারণে তাঁর উম্মতও পাছে কোনও জটিলতার সম্মুখীন হয় এবং এমন কোনও বিধান তাদের দিয়ে দেওয়া হয়, যা পালন করতে তাদের হিমশিম খেতে হবে। কাজেই ‘হজ্জ প্রতি বছর করতে হবে কি না? -এ প্রশ্ন যখন তাঁকে করা হল, তখন এর উত্তর না দিয়ে বরং এ জাতীয় প্রশ্ন করতেই নিষেধ করে দিলেন। কেননা প্রশ্নটি করার কোনও দরকার ছিল না। হজ্জ করার হুকুম দেওয়া হয়েছে। ব্যস একবার হজ্জ করলেই তো হুকুম পালন হয়ে গেল। প্রতি বছর করতে হবে কি না, এটা অতিরিক্ত কৌতূহল। বনী ইসরাঈলের মত এ কৌতূহল যদি মিটিয়ে দেওয়া হত আর প্রতি বছর হজ্জ ফরয করা হত, তবে তা কতই না কঠিন হয়ে যেত! তাই প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্পষ্ট বলে দেন-
دعوني ما تركتكم
“আমি যতক্ষণ তোমাদের ছেড়ে দিই (অর্থাৎ কোনও বিষয়ে বিস্তারিত কিছু না বলি), ততক্ষণ তোমরাও আমাকে ছেড়ে দিও।”
যে বিষয়ে খুঁটিনাটি বিবরণ দেওয়া হয়নি, তার যতটুকু বলা হয়েছে তা পালন করা যদি সম্ভব হয়, তবে তোমরা তার খুঁটিনাটির পেছনে পড়বে না। যতটুকু বলা হয়েছে অতটুকুতেই ক্ষান্ত থাকবে, যদিও বিষয়টি খুঁটিনাটি ব্যাখ্যার অবকাশ রাখে। যেমন এ হজ্জের আদেশ। একবার হজ্জ করলেই আদেশের ওপর আমল হয়ে যায়। যদিও এর মধ্যে এ অবকাশ আছে যে, হয়তো এটা প্রতি বছরই করতে হবে, কিন্তু তা যখন পরিষ্কারভাবে বলে দেওয়া হয়নি, তখন শুধু শুধু তার পেছনে পড়া কেন এবং কেন এই প্রশ্ন করতে যাওয়া যে, প্রতি বছরই হজ্জ করতে হবে কি? অসম্ভব নয় এ প্রশ্নের পরিণামে হুকুম দিয়ে দেওয়া হবে যে, হাঁ, প্রতি বছরই হজ্জ করতে হবে আর এভাবে সহজ বিষয়টি কঠিন হয়ে যাবে। এ কারণেই বাড়তি প্রশ্ন করতে নিষেধ করা হয়েছে।
এক হাদীছে ইরশাদ-
إن أعظم المسلمين جرما : من سأل عن شيء لم يحرم، فحرم من أجل مسألته
‘মুসলমানদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা গুরুতর অপরাধী সেই ব্যক্তি, যে ব্যক্তি এমন কোনও বিষয়ে প্রশ্ন করে, যা হারাম করা হয়নি। অতঃপর তার প্রশ্নের কারণে তা হারাম করে দেওয়া হয়েছে। (সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৭২৮৯; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ২৩৫৮)
প্রকাশ থাকে যে, যে প্রশ্নের কারণে কোনও হালাল বস্তু হারাম কিংবা কোনও সহজ বিধান কঠিন হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে, সেরকম প্রশ্ন নিষিদ্ধ ছিল কেবল রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আমলে। কেননা এরকম আশঙ্কা কেবল তাঁর আমলেই হতে পারত। তাঁর ওফাতের পর সেরকম কোনও আশঙ্কা থাকেনি। কেননা বিধান তো তাঁর মাধ্যমেই দেওয়া হত। তাঁর ওফাতের পর নতুন কোনও বিধান আসার সুযোগ নেই। ফলে এরূপ প্রশ্নের নিষেধাজ্ঞাও আর বাকি নেই। এখন কোনও বিধান সম্পর্কে বিস্তারিত অবগতি লাভের জন্য উলামায়ে কিরামের কাছে এরূপ প্রশ্ন করার অবকাশ আছে।
প্রশ্ন করা বৈধ হয় কেবল তখনই, যখন উদ্দেশ্য হয় নিজ অজ্ঞতা দূর করা। উদ্দেশ্য যদি হয় কাউকে আটকানো, তবে এরূপ প্রশ্ন করা কিছুতেই জায়েয নয়। এমনিভাবে নিজ বাহাদুরী ফলানোর জন্যও প্রশ্ন করা বৈধ হতে পারে না। যেসব বিষয় জানার কোনও প্রয়োজন নেই, সে সম্পর্কে প্রশ্ন করাও একটি অহেতুক কাজ। ইসলামে অহেতুক কাজ পছন্দনীয় নয়।
অতঃপর তিনি ইরশাদ করেনঃ-
إنما أهلك من كان قبلكم كثرة سؤالهم واختلافهم على أنبيائهم
তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদেরকে তো ধ্বংস করেছে তাদের অত্যধিক প্রশ্ন এবং তাদের নবীদের সঙ্গে বিরোধতায় লিপ্ত হওয়া। অর্থাৎ যে সকল বিষয় জানার দরকার ছিল না বা কোনও বিষয়ের যে খুঁটিনাটি জানানো হয়নি, তারা তাদের নবীগণের কাছে সে সম্পর্কে খুব বেশি বেশি প্রশ্ন করত আর সে কারণে সহজ সহজ বিধানের সাথে নানারকম খুঁটিনাটি যোগ হয়ে তা অত্যন্ত কঠিন ও জটিল হয়ে যেত। সে সকল জটিল বিধান পালন করতে তাদের অত্যন্ত বেগ পেতে হত। অনেক সময় নানা ছলছুতায় তা পালন করা হতে বিরত থাকত। এভাবে কালক্রমে তারা তাদের শরী'আতের বিধি-বিধান থেকে বিমুখ হয়ে পড়ত। একটা জাতির শরী‘আতবিমুখ হয়ে পড়াটা তাদের ধ্বংস হওয়াই তো বটে। কেননা সে ক্ষেত্রে তাদের সামগ্রিক জীবন শর'ঈ জীবনকাঠামো থেকে আলাদা হয়ে যায়। তাদের দীনী জাতিসত্তা বিলুপ্ত হয়ে নতুন এক জাতিতে পরিণত হয়, যা সম্পূর্ণ বিকৃত ও নষ্টভ্রষ্ট এক জাতি।
অনেক সময় আসমানী আযাব দ্বারা তাদেরকে ভূপৃষ্ঠ থেকেই সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হত। কুরআন মাজীদে এমন বহু জাতির কথা উল্লেখ করা হয়েছে, আল্লাহ তা'আলা যাদেরকে বিভিন্ন রকম আযাব দিয়ে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দিয়েছেন।
নবীর আদেশের বিপরীতে নিজস্ব মত খাটানো
তাদের ধ্বংসের দ্বিতীয় কারণ বলা হয়েছে নবীদের সঙ্গে ইখতিলাফ করা ও বিরোধিতায় লিপ্ত হওয়া। এর দ্বারা বোঝানো উদ্দেশ্য নবীগণ কোনও হুকুম দিলে সেই হুকুম সম্পর্কে প্রশ্ন তোলা ও তার বিপরীতে নিজেদের মতামত উত্থাপন করা। উম্মতের কাজ হলো নবী যে হুকুম দেন তা বিনাবাক্যে মেনে নেওয়া। হুকুমের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা বা তার বিপরীতে নিজেদের মতামত দিতে যাওয়া—একরকম স্পর্ধা ও অবাধ্যতা। বনী ইসরাঈল তাদের নবীদের সঙ্গে এরকম অবাধ্যতা বার বার করেছে আর এ কারণে তাদেরকে আল্লাহ তা'আলার পক্ষ হতে বিভিন্ন শাস্তিও ভোগ করতে হয়েছে। তাই প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজ উম্মতকে সতর্ক করছেন, তারা যেন নবীর হুকুমের বিপরীত নিজেদের মতামত খাটানোর চেষ্টা না করে বা সে হুকুমের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন না তোলে। কেননা তাহলে আগের উম্মতের মত তাদেরকেও শাস্তির সম্মুখীন হতে হবে।
অতঃপর নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেনঃ-
فإذا نهيتكم عن شيء فاجتنبوه، وإذا أمرتكم بأمر فأتوا منه ما استطعتم
‘সুতরাং আমি যখন তোমাদেরকে কোনও বিষয়ে নিষেধ করি, তখন তোমরা তা থেকে বিরত থাকবে। আর যখন তোমাদেরকে কোনও বিষয়ে আদেশ করি, তখন যথাসাধ্য তা পালন করবে।'
এর দ্বারা শরী'আতের যাবতীয় আদেশ-নিষেধ মেনে চলার প্রতি তাগিদ করা হয়েছে।
আদেশ পালনের ক্ষেত্রে ‘যথাসাধ্য' কথাটি যোগ করা হয়েছে। নিষেধাজ্ঞা পালনের ক্ষেত্রে এ কথা যোগ করা হয়নি। অথচ শরী'আত তার যাবতীয় বিধানেই মানুষের সক্ষমতার বিষয়টি বিবেচনায় রেখেছে। কুরআন মাজীদ সুস্পষ্টই বলেছেঃ-
وما جعل عليكم في الدين من حرج
অর্থ : তিনি দীনের ব্যাপারে তোমাদের প্রতি কোনও সংকীর্ণতা আরোপ করেননি। (সূরা হজ্জ (২২), আয়াত ৭৮) অর্থাৎ শরী'আতের বিধান পালনের ব্যাপারে কোনওরকম ওযর গ্রহণযোগ্য নয় ব্যাপারটা এরকম নয়। বরং ওযর অনুপাতে ছাড়ও দেওয়া হয়েছে। যেমন মরা জন্তু খাওয়া নিষেধ। কিন্তু কারও যদি কোনও হালাল খাদ্য না থাকে আর এ অবস্থায় ক্ষুধায় মারা যাওয়ার উপক্রম হয়, সে ক্ষেত্রে তার জন্য মরা জন্তু খেয়ে প্রাণ রক্ষা করা জায়েয। দেখা যাচ্ছে নিষেধাজ্ঞার ক্ষেত্রেও সাধ্য ও সক্ষমতার বিষয়টা বিবেচনায় রাখা হয়েছে।
সক্ষমতা অনুযায়ী আদেশ পালন
সুতরাং প্রশ্ন ওঠে, এ হাদীছে কেবল আদেশের ক্ষেত্রে 'যথাসাধ্য শব্দ কেন ব্যবহৃত হল? এর উত্তর হচ্ছে, তুলনামূলকভাবে নিষেধাজ্ঞার চেয়ে আদেশ পালন করা কঠিন। কেননা নিষেধাজ্ঞার অর্থ হচ্ছে কোনও কাজ করা হতে বিরত থাকা। অপরদিকে আদেশ পালন করতে গেলে কাজটি করতে হয়। বলাবাহুল্য, বিরত থাকা অপেক্ষা কাজ সম্পাদন করা কঠিন। তাই তুলনামূলকভাবে নিষেধাজ্ঞার চেয়ে আদেশ পালনের ক্ষেত্রেই অক্ষমতা বেশি দেখা দিয়ে থাকে। আর সে কারণেই বলা হয়েছে- তোমাদেরকে যা আদেশ করা হয়েছে তা যথাসাধ্য অর্থাৎ সক্ষমতা অনুযায়ী পালন করবে।
উদাহরণ দেওয়া যায় নামায দ্বারা। নামায দাঁড়িয়ে পড়া ফরয। কিন্তু কারও যদি এমন ওযর থাকে, যদ্দরুন দাঁড়িয়ে নামায পড়া তার পক্ষে সম্ভব নয়, তবে সে বসে বসে পড়বে। যদি বসতেও না পারে তবে শুয়ে শুয়ে পড়বে। নামায কিবলার দিকে ফিরে পড়া ফরয। কেউ যদি এমন কোনও জায়গায় থাকে, যেখানে তার পক্ষে নিশ্চিত কিবলা ঠিক করা সম্ভব নয়, তবে সে অনুমানের ওপর নির্ভর করবে এবং যেদিকে কিবলা বলে তার অনুমান ও প্রবল ধারণা হয়, সেদিকে ফিরে নামায পড়বে। এমনিভাবে মাটিতে মাথা রেখে সিজদা করা ফরয। কিন্তু কারও যদি ওযরের কারণে এভাবে সিজদা করা সম্ভব না হয়, তবে সে ইশারা দ্বারা সিজদা আদায় করবে। আর যদি কোনওভাবেই তার পক্ষে নামায পড়া সম্ভব না হয়, তবে তার জন্য পুরোপুরি মাফ। নামায পড়ার দায়িত্ব থেকে তাকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে।
এভাবে শরী'আতের সবগুলো বিধান পালনের ক্ষেত্রেই সাধ্য ও সক্ষমতার প্রতি দৃষ্টি রাখা হয়েছে। অর্থাৎ ক্ষমতা থাকলেই পালন করতে হবে। যার যতটুকু ক্ষমতা থাকে, সে ততটুকু পালন করবে। যার বিলকুল ক্ষমতা থাকে না, সে পুরোপুরি মুক্ত। এ ক্ষেত্রে প্রত্যেকের কর্তব্য ‘উলামায়ে কিরামের শরণাপন্ন হওয়া। নিজে নিজে কোনও একটা বিষয়কে ওযর ধরে হুকুম পালনে কাটছাট করা কিছুতেই উচিত হবে না।
এ হাদীছে মূলত নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের যাবতীয় আদেশ নিষেধ পালনে যত্নবান থাকা ও বাড়তি প্রশ্ন করা হতে বিরত থাকা সম্পর্কে তাগিদ করা হয়েছে। অর্থাৎ প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম বোঝাচ্ছেন, তোমাদের কাজ কেবল আমার যাবতীয় আদেশ-নিষেধ পালন করে যাওয়া। তাঁর আদেশ-নিষেধের সমষ্টিকেই শরী'আত বলে এবং তা তাঁর সুন্নত ও তরিকাও বটে। ব্যস উম্মতের কাজ হচ্ছে সেই তরিকার ওপর চলতে থাকা। বাড়তি প্রশ্নের পেছনে পড়ার কোনও ফায়দা নেই; বরং তাতে ক্ষতিরই আশঙ্কা থাকে, যেমনটা পূর্বে বলা হয়েছে।
উল্লেখ্য : হাদীছে প্রয়োজনের অতিরিক্ত প্রশ্ন করতে বারণ করা হয়েছে। বোঝা গেল দরকারি প্রশ্ন করা নিষেধ নয়; বরং যে বিষয়ে জানার প্রয়োজন আছে এবং যার সাথে ঈমান ও আমলের সম্পর্ক আছে, সে সম্পর্কে তো জিজ্ঞেস করাই জরুরি। এরকম বিষয়ে প্রশ্ন করতে কুরআন ও হাদীছে হুকুমও করা হয়েছে। যেমন কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছেঃ-
فَاسْأَلُوا أَهْلَ الذِّكْرِ إِنْ كُنْتُمْ لَا تَعْلَمُونَ
অর্থ : তোমরা নিজেরা যদি না জান, তবে জ্ঞানীজনকে জিজ্ঞেস কর। (সূরা নাহল (১৬), আয়াত ৪৩)
এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেনঃ-
إنما شفاء العي السؤال
‘অজ্ঞতার উপশম তো জিজ্ঞেস করাই। (সুনানে আবু দাউদ, হাদীছ নং ৩৩৬; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীছ নং ৫৭২)
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. আমাদের কর্তব্য নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের যাবতীয় আদেশ নিষেধ পালন তথা তাঁর তরিকার ওপর চলাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া।
খ. নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের তরিকার ওপর চলাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়ার দাবি এটাও যে, তাঁর তরিকা কী, আমরা তা ভালোভাবে জেনে নেব।
গ. জানার একটি পন্থা হচ্ছে খাঁটি 'উলামায়ে কিরামের কাছে জিজ্ঞেস করা। সুতরাং আমরা দীনের জ্ঞাতব্য বিষয় সম্পর্কে জানার জন্য তাঁদের শরণাপন্ন হব।
ঘ. ‘উলামায়ে কিরামের কাছে কেবল এমন বিষয়ই জানতে চাব, যার সাথে ঈমান ও আমলের সম্পর্ক আছে। এর বাইরে ফযূল প্রশ্নের (অহেতুক) পেছনে পড়ব না। ফযূল প্রশ্ন করা একটি নিন্দনীয় কাজ।
ঙ. শরী'আতের আদেশ-নিষেধের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা একটি ধ্বংসাত্মক কাজ।
চ. কুরআন-হাদীছের বিপরীতে নিজেদের মতামত খাটানো সুস্পষ্ট গোমরাহী। এতে ব্যাপকভাবে লিপ্ত হওয়ার পরিণাম জাতীয় অস্তিত্বের বিলুপ্তি।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)