রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ

ভূমিকা অধ্যায়

হাদীস নং: ১০২
মুজাহাদা ও সাধনা-সংগ্ৰাম।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের দীর্ঘ নামায
হাদীছ নং: ১০২

হযরত আবূ আব্দুল্লাহ হুযায়ফা ইবনুল ইয়ামান আল-আনসারী রাযি. থেকে (যিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের গুপ্তবিষয়াবলির জ্ঞাতা উপাধিতে পরিচিত) বর্ণিত, তিনি বলেন, কোনও এক রাতে আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে নামায পড়ি। তিনি সূরা বাকারা পড়তে শুরু করলেন। আমি মনে মনে বললাম, তিনি একশ' আয়াতের মাথায় রুকূ করবেন। কিন্তু তিনি তারপরও চলতে থাকলেন। আমি মনে মনে বললাম, তিনি এক রাক'আতে পূর্ণ সূরা বাকারাটি পড়বেন। কিন্তু তিনি চলতে থাকলেন। আমি মনে মনে বললাম, এবার তিনি রুকূ করবেন। তারপর সূরা নিসা শুরু করলেন। সেটিও পড়ে ফেললেন। তারপর সূরা আলে-ইমরান শুরু করলেন। এটিও শেষ করলেন। তিনি পড়ছিলেন ধীর ও স্পষ্টভাবে। যখন এমন কোনও আয়াতে আসতেন, যাতে তাসবীহ'র কথা আছে, তখন তাসবীহ (سبحان الله ইত্যাদি) পড়তেন। যখন প্রার্থনা সম্বলিত কোনও আয়াতে পৌঁছতেন, তখন প্রার্থনা করতেন। যখন আশ্রয় চাওয়া সম্পর্কিত কোনও আয়াতে পৌঁছতেন, তখন আশ্রয় প্রার্থনা করতেন। তারপর রুকূ করলেন। রুকূতে বলতে থাকলেন- سبحان ربى العظيم (আমার মহান প্রতিপালক পবিত্র)। তাঁর রুকূ হয়েছিল কিয়ামের সমান দীর্ঘ। তারপর বললেন- سمع الله لمن حمده، ربنا لك الحمد (যে ব্যক্তি আল্লাহর প্রশংসা করে, তিনি তার সে প্রশংসা শোনেন। হে আমাদের প্রতিপালক! সকল প্রশংসা তোমারই)। তারপর তিনি দাঁড়িয়ে থাকলেন রুকূ'র প্রায় সমপরিমাণ দীর্ঘ। তারপর সিজদা করলেন। তাতে বললেন- سبحان ربى الاعلى (আমার সমুচ্চ প্রতিপালক পবিত্র)। তাঁর সিজদা ছিল তাঁর কিয়ামের প্রায় সমপরিমাণ। -মুসলিম'
(সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ৭৭২)
11 - باب في المجاهدة
102 - الثامن: عن أبي عبد الله حُذَيفَةَ بنِ اليمانِ رضي الله عنهما، قَالَ: صَلَّيْتُ مَعَ النَّبيّ - صلى الله عليه وسلم - ذَاتَ لَيلَةٍ فَافْتَتَحَ البقَرَةَ، فَقُلْتُ: يَرْكَعُ عِنْدَ المئَةِ، ثُمَّ مَضَى. فَقُلْتُ: يُصَلِّي بِهَا في ركعَة فَمَضَى، فقُلْتُ: يَرْكَعُ (1) بِهَا، ثُمَّ افْتَتَحَ النِّسَاءَ فَقَرَأَهَا، ثُمَّ افْتَتَحَ آلَ عِمْرَانَ فَقَرَأَهَا، يَقرَأُ مُتَرَسِّلًا: إِذَا مَرَّ بآية فِيهَا تَسبيحٌ سَبَّحَ، وَإذَا مَرَّ بسُؤَالٍ سَأَلَ، وَإذَا مَرَّ بتَعَوُّذٍ تَعَوَّذَ، ثُمَّ رَكَعَ، فَجَعَلَ يَقُولُ: «سُبْحَانَ رَبِّيَ العَظِيمِ» فَكَانَ رُكُوعُهُ نَحوًا مِنْ قِيَامِهِ، ثُمَّ قَالَ: «سَمِعَ اللهُ لِمَنْ حَمِدَهُ، رَبَّنَا لَكَ الحَمْدُ» ثُمَّ قَامَ طَويلًا قَريبًا مِمَّا رَكَعَ، ثُمَّ سَجَدَ، فَقَالَ: «سُبْحَانَ رَبِّيَ الأَعْلَى» فَكَانَ سُجُودُهُ قَريبًا مِنْ قِيَامِهِ. رواه مسلم. (2)

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীছে যে নামাযের কথা বলা হয়েছে তা ছিল তাহাজ্জুদের নামায। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাহাজ্জুদের নামায কখনও কখনও এরকম দীর্ঘ পড়তেন। তাঁর সাধারণ নিয়ম ছিল রাতের এক-তৃতীয়াংশ পরিমাণ সময় তাহাজ্জুদে কাটানো। অর্থাৎ তিনি রাতে ইবাদতও করতেন এবং ঘুমাতেনও। কেবল ‘ইবাদতের ভেতর সমস্ত রাত পার করতেন না। তাঁর সবকিছুতে ছিল মধ্যপন্থা। তাঁর জীবন যেহেতু উম্মতের জন্য আদর্শ, তাই মধ্যপন্থা রক্ষা করে চলতেন, যাতে উম্মত সহজে তাঁর অনুসরণ করতে পারে।
তবে কখনও কখনও ব্যতিক্রমও হত, যেমন আলোচ্য হাদীছে দেখা যাচ্ছে। এক রাক'আতে সূরা বাকারা, সূরা আলে-ইমরান ও সূরা নিসা পড়েছেন। এ তিন সূরায় পাঁচ পারারও বেশি হয়। পড়েছেন তারতীলের সঙ্গে। তাসবীহের আয়াত আসলে তাসবীহ পড়তেন। প্রার্থনার আয়াত আসলে প্রার্থনা করতেন। তিনি তিলাওয়াত করতেন তাদাব্বুরের সাথে। অর্থাৎ আয়াতের বিষয়বস্তু সম্পর্কে গভীর ধ্যান ও চিন্তা সহকারে পড়তেন। এভাবে এক রাক'আতে পাঁচ পারারও বেশি পরিমাণ তিলাওয়াত করতে নিশ্চয়ই অনেক দীর্ঘ সময় লাগার কথা। তারপর প্রায় সমপরিমাণ সময় রুকূ'তে, অনুরূপ সময় কওমায় (রুকুর পর দাঁড়ানো অবস্থা), অনুরূপ দীর্ঘ সময় সিজদায়, তারপর জলসা, তারপর দ্বিতীয় সিজদা, এভাবে প্রতিটি কাজ এতটা দীর্ঘ সময় নিয়ে করলে কতখানি সময়ের দরকার তা সহজেই অনুমান করা যায়।
নামায ছিল নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের চোখের শীতলতা এবং সর্বাপেক্ষা প্রিয় আমল। তাই কখনও কখনও তিনি এরূপ দীর্ঘ নামাযও পড়তেন। এটা ছিল নামাযে তাঁর মুজাহাদা। নফসের বিরুদ্ধে জিহাদকারীর মত ‘ইবাদত-বন্দেগীতে তিনি এরূপ কষ্টক্লেশ বরদাশত করতেন। তবে সে কষ্টক্লেশ হত কেবলই শারীরিক। মনে কোনও কষ্টবোধ হত না। বরং যত দীর্ঘ নামায পড়তেন, ততই তাঁর মন প্রশান্তিতে ভরে উঠত।
পূর্বে ৯৮ নং হাদীছে বর্ণিত হয়েছে, তিনি তাহাজ্জুদে এত দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থাকতেন যে, তাঁর পা ফুলে ফেটে যেত। সম্ভবত তা এরূপ দীর্ঘ কিরাআত সম্বলিত নামাযই ছিল। এমন দীর্ঘ নামাযে তাঁর কোনও ক্লান্তিবোধ হত না। কিন্তু আমরা যারা সাধারণ, তাদের পক্ষে এটা অত্যন্ত কষ্টকর হবে। এজন্যই নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাধারণত মধ্যপন্থা অবলম্বন করতেন এবং কখনও কখনও এতটা দীর্ঘ নামায পড়লেও আমাদেরকে হুকুম দিয়েছেন, যেন নিজেদের শক্তিসামর্থ্যের দিকে লক্ষ রেখেই ইবাদত করি, যেমনটা পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে।
এ হাদীছে বলা হয়েছে, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম সূরা বাকারার পর সূরা নিসা পড়েছেন। তারপর পড়েছেন সূরা আলে-ইমরান। কিন্তু কুরআন মাজীদের বিন্যাসে দেখা যায় সূরা নিসাকে রাখা হয়েছে সূরা আলে-ইমরানের পর। কুরআনের বিন্যাসে সূরা আলে-ইমরান আগে হওয়া সত্ত্বেও নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সূরা নিসা কেন আগে পড়লেন?
এর কারণ হল, এ কথা ঠিক যে, কুরআন মাজীদের সূরা ও আয়াতসমূহের বিন্যাস 'তাওকীফী' অর্থাৎ আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে প্রাপ্ত। আল্লাহ তা'আলাই হযরত জিবরীল 'আলাইহিস সালাম মারফত নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জানিয়ে দিয়েছেন কোন্ সূরার পর কোন্ সূরা হবে এবং কোন্ আয়াতের পর কোন্ আয়াত। কিন্তু এই চূড়ান্ত বিন্যাস হয়েছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনের একদম শেষপর্যায়ে। কুরআন মাজীদ শুরু থেকে এ বিন্যাস অনুযায়ীই যে নাযিল হয়েছে তা নয়। নাযিল করা হয়েছে যখন যা প্রয়োজন হয়েছে সে অনুপাতে। অনেক সূরাই নাযিল হয়েছে শুরুর দিকে, কিন্তু চূড়ান্ত বিন্যাসে তা স্থান পেয়েছে মাঝখানে বা শেষের দিকে। কাজেই চূড়ান্ত বিন্যাসের আগে যে সমস্ত নামায পড়া হয়েছে, তাতে সূরার তারতীব (বিন্যাস) বর্তমানে সূরাসমূহ যেভাবে আছে সেভাবে হওয়ার কথা নয়। আমাদের কাছে যেই কুরআন আছে তা কুরআনের চূড়ান্ত বিন্যস্ত রূপ। সুতরাং এ বিন্যাসের সাথে প্রথমদিকে পঠিত সূরাসমূহের মিল না হওয়ারই কথা। কাজেই নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম সূরা উলট-পালট করে পড়েছেন সে প্রশ্ন আসে না। এখন যদি কেউ নামাযে সূরা আলে-ইমরানের আগে সূরা নিসা পড়ে, তবে তার সে পড়া হবে কুরআনের বিন্যাস পরিপন্থি। আর একই রাক'আতে ইচ্ছাকৃতভাবে এরূপ পড়লে নামায মাকরূহ হয়ে যাবে। কেননা আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকে যখন চূড়ান্তভাবে আয়াত ও সূরা বিন্যস্ত করে দেওয়া হয়েছে, তখন বান্দার কর্তব্য তিলাওয়াতে সে বিন্যাসের অনুসরণ করা।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. এ হাদীছেও আমাদের জন্য মুজাহাদার শিক্ষা রয়েছে। মা'সূম ও নিষ্পাপ হওয়া সত্ত্বেও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন ‘ইবাদতে এত কষ্ট স্বীকার করতেন, তখন আমরা কিভাবে আরাম-আয়েশ খুঁজতে পারি?

খ. নফল নামাযে যখন কোনও দু'আর জায়গা আসে, তখন দু'আ করা মুস্তাহাব। যেমন, জান্নাতের আলোচনা আসলে জান্নাত প্রার্থনা করা, জাহান্নামের আলোচনা আসলে তা থেকে মুক্তি চাওয়া, আযাবের কথা আসলে তা থেকে আল্লাহর পানাহ চাওয়া ইত্যাদি।

গ. সূরা ফাতিহার পর যেমন একাধিক সূরা পড়া যায়, তেমনি রুকূ-সিজদায়ও দীর্ঘক্ষণ তাসবীহ পড়া যেতে পারে। বরং নফল নামাযে দীর্ঘক্ষণ তাসবীহ পড়া মুস্তাহাব।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক নিষ্প্রয়োজন
রিয়াযুস সালিহীন - হাদীস নং ১০২ | মুসলিম বাংলা