রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ
ভূমিকা অধ্যায়
হাদীস নং: ৭৪
ইয়াকীন ও তাওয়াক্কুল।
ইয়াকীনের অর্থ ও ব্যাখ্যা
ইয়াকীনের শাব্দিক অর্থ প্রত্যয়। অর্থাৎ সন্দেহমুক্ত জ্ঞান ও নিশ্চয়াত্মক ধারণা। পরিভাষায় ইয়াকীন বলা হয় কোনও বিষয় সম্পর্কে এ বিশ্বাস রাখা যে, তা এই এই রকম এবং তা এরকমই হওয়া সম্ভব, এর বিপরীত হওয়া সম্ভব নয়। কিংবা বলা যায় কোনও বিষয় সম্পর্কে এমন বাস্তবানুগ বিশ্বাসকে ইয়াকীন বলে, যে বিশ্বাস কখনও টলে না।
দীন ও শরী'আত সম্পর্কে কুরআন মাজীদে তিন রকম ইয়াকীনের উল্লেখ পাওয়া যায়ঃ- ১. 'ইলমুল ইয়াকীন, ২. 'আইনুল ইয়াকীন, ৩. ও হাক্কুল ইয়াকীন। এ তিন প্রকার ইয়াকীনের মধ্যে কিছুটা পার্থক্য আছে। 'ইলমুল ইয়াকীনের সম্পর্ক দুনিয়ার সাথে। কোনও ব্যক্তি দীন ও শরী'আত সম্পর্কিত জ্ঞানলাভের পর যতদিন সে দুনিয়ায় থাকে, ততদিন তার জন্য সে জ্ঞান 'ইলমুল ইয়াকীনের পর্যায়ে থাকে।
তারপর যখন মৃত্যু শুরু হয় এবং পরকালের দৃশ্যাবলি চোখের সামনে চলে আসে, তখন সে 'ইলম 'আইনুল ইয়াকীনে পরিণত হয়। অর্থাৎ চাক্ষুষ প্রত্যয় হয়ে যায়। এতদিন সে গভীর বিশ্বাসের সাথে যা জানত, এখন তার সত্যতা চোখে দেখতে পাচ্ছে।
তারপর যখন কিয়ামত সংঘটিত হবে, ঈমানদার ব্যক্তি জান্নাতে চলে যাবে,জান্নাতের নি'আমতরাজি ও তার মনোরোম দৃশ্য নিজ চোখে দেখতে পারে, সর্বোপরি আল্লাহ তা'আলার দীদার লাভ হবে, তখন তার জ্ঞান হাক্কুল ইয়াকীন তথা বাস্তব প্রত্যয়ে পরিণত হয়।
মনে করুন- 'কালোজাম। যে ব্যক্তি কালোজাম কোনওদিন দেখেনি, সে যদি বিশ্বস্ত সূত্রে জানতে পারে এটা একরকম মিষ্টান্ন দ্রব্য, তবে এ সম্পর্কে তার যে বিশ্বাস অর্জিত হবে তা 'ইলমুল ইয়াকীন'। তারপর সে যদি এটা নিজ চোখে দেখতে পায়, তবে তার বিশ্বাস একধাপ উন্নত হবে। এরূপ বিশ্বাসকে বলা হয় 'আইনুল ইয়াকীন। তারপর সে যদি তা খাওয়ারও সুযোগ পায়, তবে তার বিশ্বাস চূড়ান্ত পর্যায়ে উন্নীত হবে। একে বলা হবে 'হাক্কুল ইয়াকীন'।
দুনিয়ায় 'ইলমুল ইয়াকীন সকল মু'মিনেরই অর্জিত থাকে। এ ব্যাপারে উলামায়ে কিরামের স্থান সবার উপরে। আইনুল ইয়াকীন অর্জিত থাকে বিশেষ শ্রেণির মুমিনদের। তাদেরকে ‘আরেফ বলা হয়, যারা মৃত্যুর জন্য সদা প্রস্তুত থাকে। যেন মৃত্যু তাদের চোখের সামনে। 'হাক্কুল ইয়াকীন অর্জিত হয় সেইসব আওলিয়া কিরামের, যাদের অন্তর সমস্ত মাখলুকাতের ভালোবাসা থেকে ছিন্ন হয়ে এক আল্লাহর 'ইশক ও ভালোবাসায় বিলীন হয়ে যায়।
তাওয়াক্কুলের অর্থ ও ব্যাখ্যা
তাওয়াক্কুল-এর অর্থ নির্ভর করা। বিশেষ অর্থে আল্লাহর প্রতি নির্ভরতাকে তাওয়াক্কুল বলে। পরিভাষায় তাওয়াক্কুল বলা হয় নিজ শক্তি-সামর্থ্য, চেষ্টা ও ব্যবস্থাপনার উপর থেকে নির্ভরশীলতা ছিন্ন করে পরম মনিব আল্লাহ তা'আলার ইচ্ছা ও শক্তির উপর নির্ভরশীল হওয়াকে। এ সম্পর্কে বিভিন্ন তত্ত্বজ্ঞানী বিভিন্ন ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন। তবে সর্বাপেক্ষা গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন ইমাম তাবারী রহ.।তিনি বলেন তাওয়াক্কুল অর্থ- আল্লাহর প্রতি নির্ভর করা ও আল্লাহ তা'আলার ফয়সালাই কার্যকর হয় এ বিশ্বাসের সাথে নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নত মোতাবেক খাদ্য, পানীয় ও জীবনধারণের জন্য অপরিহার্য আসবাব-উপকরণ অর্জনের চেষ্টা করা এবং শত্রু থেকে আত্মরক্ষায় সচেষ্ট থাকা।
প্রকাশ থাকে যে, তাওয়াক্কুলের স্থান বান্দার অন্তর। আসবাব-উপকরণ অবলম্বন করা বাহ্যিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের কাজ। এটা তাওয়াক্কুলের পরিপন্থি নয়- যদি অন্তরে আল্লাহর প্রতি নির্ভরতা দৃঢ় থাকে এবং বিশ্বাস থাকে যে, হবে সেটাই যা আল্লাহর ফয়সালা; আমি চেষ্টা পরিশ্রম করছি কেবল এ কারণে যে, তা করা আল্লাহর হুকুম। আল্লাহর ফয়সালা ছাড়া আমার চেষ্টা পরিশ্রম কোনও সুফল বয়ে আনার ক্ষমতা রাখে না। আবার বিনা চেষ্টা-পরিশ্রমে কোনওকিছু দান করাও আল্লাহর নীতি নয়, যদিও তা দান করার ক্ষমতা আল্লাহ তা'আলার আছে।
সারকথা, তাওয়াক্কুল হচ্ছে আল্লাহর হুকুম মোতাবেক চেষ্টা পরিশ্রম করা এবং তার ফলাফলের ব্যাপারে আল্লাহর প্রতি নির্ভর করা। প্রথমটি আল্লাহর আনুগত্য আর দ্বিতীয়টি তাঁর প্রতি ঈমান। তাওয়াক্কুল এ দুইয়ের সমন্বিত রূপ।
চেষ্টা-পরিশ্রম ছাড়া কেবল আল্লাহর প্রতি ভরসা করার নাম তাওয়াক্কুল নয়; বরং এটা আল্লাহর হুকুমের অবাধ্যতা করার নামান্তর। আবার আল্লাহর প্রতি ভরসা না করে কেবল চেষ্টা-পরিশ্রমকেই সবকিছু মনে করা বেঈমানী কাজ। প্রকৃত সত্য এর মাঝখানে। অর্থাৎ আল্লাহর প্রতি নির্ভরও করতে হবে এবং শরী'আত মোতাবেক চেষ্টাও চালিয়ে যেতে হবে।
একবার এক সাহাবী জিজ্ঞেস করেছিলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি উটটি ছেড়ে দিয়ে আল্লাহর উপর ভরসা করব (যে, আল্লাহ তা'আলা এটি হেফাজত করবেন), নাকি আগে বাঁধব তারপর আল্লাহর উপর ভরসা করব? তিনি বললেন, আগে এটি বাঁধ, তারপর আল্লাহর উপর ভরসা কর। এর দ্বারা নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাওয়াক্কুল কী তা বুঝিয়ে দিলেন।
হযরত সাহল তুসতারী রহ. বলেন, যে ব্যক্তি চেষ্টা-পরিশ্রমকে আপত্তিকর মনে করে, সে মূলত নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের তরীকার উপরই আপত্তি করে। আর যে ব্যক্তি তাওয়াক্কুলের উপর আপত্তি করে, সে যেন ঈমানের উপরই আপত্তি তোলে।
হযরত ফুযায়ল ইব্ন 'ইয়ায রহ.-কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, কেউ যদি নিজ ঘরে বসে থাকে আর মনে করে সে আল্লাহর প্রতি ভরসা করেছে, ফলে তার রিযিক তার কাছে এসে যাবে, তবে কি এটা ঠিক হবে? তিনি বললেন, সে যদি আল্লাহর প্রতি পুরোপুরি আস্থা রেখে এভাবে বসে থাকে, তবে আল্লাহ তার ইচ্ছা অবশ্যই পূরণ করবেন। কিন্তু এটা নিয়ম নয়। আল্লাহর কোনও নবী এমন করেননি। নবীগণ শ্রম খেটেছেন। আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেও পরিশ্রম করে উপার্জন করেছেন। কাজ করেছেন হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি. ও উমর ফারূক রাযি.। তাঁরা এমন বলেননি যে, আমরা বসে থাকলাম, আল্লাহ আমাদের খাওয়াবেন।
বস্তুত তাওয়াক্কুল নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চরিত্র। আর কামাইরোজগার তাঁর সুন্নত। উভয়টিই অবলম্বন করতে হবে। এর মধ্যেই দুনিয়া ও আখিরাতের সফলতা।
ইয়াকীন ও তাওয়াক্কুল সম্পর্কিত আয়াতসমূহ
এক নং আয়াত
وَلَمَّا رَأَى الْمُؤْمِنُونَ الْأَحْزَابَ قَالُوا هَذَا مَا وَعَدَنَا اللَّهُ وَرَسُولُهُ وَصَدَقَ اللَّهُ وَرَسُولُهُ وَمَا زَادَهُمْ إِلَّا إِيمَانًا وَتَسْلِيمًا (22)
অর্থঃ মুমিনগণ যখন (শত্রুদের) সম্মিলিত বাহিনীকে দেখেছিল, তখন তারা বলেছিল, এটাই সেই বিষয় যার প্রতিশ্রুতি আল্লাহ ও তাঁর রাসূল আমাদেরকে দিয়েছিলেন। আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সত্যই বলেছিলেন। আর এ ঘটনা তাদের ঈমান ও আনুগত্যের চেতনাকে আরও বৃদ্ধি করে দিয়েছিল।.সূরা আহযাব (৩৩), আয়াত ২২
ব্যাখ্যা
এ আয়াতে আহযাবের যুদ্ধকালীন একটি অবস্থা বর্ণিত হয়েছে।আহযাব (احزاب) শব্দটি হিযব (حزب)-এর বহুবচন। হিযব অর্থ দল। আহযাব অর্থ দলসমূহ। এ যুদ্ধে আরবের বিভিন্ন গোত্র একত্র হয়ে মদীনায় হামলা চালিয়েছিল। তাই একে আহযাবের বা সম্মিলিত বাহিনীর যুদ্ধ বলা হয়। এর আরেক নাম খন্দকের যুদ্ধ। খন্দক মানে পরিখা এ যুদ্ধে মদীনা মুনাওয়ারার হেফাজতের জন্য দীর্ঘ পরিখা খনন করা হয়েছিল। এ যুদ্ধটি সংঘটিত হয়েছিল হিজরী ৫ম সালে। যুদ্ধের সংক্ষিপ্ত বিবরণ এরকম-
আহযাবের যুদ্ধ
প্রসিদ্ধ ইয়াহুদী গোত্র বনু নাজীরের চক্রান্তে কুরাইশ পৌত্তলিকগণ সিদ্ধান্ত স্থির করেছিল যে, তারা আরবের বিভিন্ন গোত্রকে একাট্টা করে সকলে যৌথভাবে মদীনা মুনাওয়ারায় হামলা চালাবে। সেমতে কুরাইশ গোত্র ছাড়াও বনু গাতফান, বনু আসলাম, বনু মুররা, বনু আশজা', বনু কিনানা ও বনু ফাযারা- গোত্রসমূহ সম্মিলিতভাবে এক বিশাল বাহিনী তৈরি করে ফেলল। তাদের সংখ্যা বারো হাজার থেকে পনেরো হাজার পর্যন্ত বর্ণনা করা হয়ে থাকে। এই বিপুল সশস্ত্র সেনাদল পূর্ণ প্রস্তুতি সহকারে মদীনা মুনাওয়ারার উদ্দেশে যাত্রা করল। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সংবাদ পাওয়ামাত্র সাহাবায়ে কিরামকে নিয়ে পরামর্শে বসলেন।
হযরত সালমান ফারসী রাযি. পরামর্শ দিলেন, মদীনা মুনাওয়ারার উত্তর দিকে, যে দিক থেকে হানাদার বাহিনী আসতে পারে, একটি গভীর পরিখা খনন করা হোক, যাতে তারা নগরে প্রবেশ করতে সক্ষম না হয়। সুতরাং সমস্ত সাহাবী কাজে লেগে গেলেন।মাত্র ছয় দিনে তারা সাড়ে তিন মাইল দীর্ঘ ও পাঁচ গজ গভীর একটি পরিখা খনন করে ফেললেন।
মুসলিমদের পক্ষে এ যুদ্ধটি পূর্ববর্তী সকল যুদ্ধ অপেক্ষা বেশি কঠিন ছিল। শত্রুসৈন্য ছিল তাদের চার গুণেরও বেশি। এর উপর বাড়তি বিষফোড়াস্বরূপ কুখ্যাত ইয়াহুদী গোত্র বনু কুরাইজা সম্পর্কে খবর পাওয়া গেল, তারা মুসলিমদের সাথে সম্পাদিত চুক্তি ভঙ্গ করে হানাদারদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে। তারা যেহেতু ছিল মুসলিমদের প্রতিবেশী, তাই তাদের দিক থেকে অনিষ্টের আশঙ্কা ছিল অনেক বেশি।
তখন ছিল প্রচণ্ড শীতকাল। খাদ্যসামগ্রীরও ছিল অভাব। এতটা দীর্ঘ পরিখার খননকার্যে দিনরাত ব্যস্ত থাকার দরুন রোজগারেরও কোনও সুযোগ মেলেনি। ফলে খাদ্য সংকট তীব্রাকার ধারণ করল। এ অবস্থায় হানাদার বাহিনী পরিখার কিনারায় এসে শিবির ফেলল। অতঃপর উভয় পক্ষে তীর ও পাথর ছোড়াছুড়ি চলতে থাকল। লাগাতার প্রায় এক মাস এ অবস্থা চলল।
রাত-দিন একটানা পাহারা দিতে দিতে মুজাহিদগণ ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে পড়েছিল। পরিশেষে এক সময় সুদীর্ঘ এ কঠিন পরীক্ষার অবসান হল আর তা এভাবে যে, আল্লাহ তাআলা হানাদারদের ছাউনির উপর দিয়ে এক হিমশীতল তীব্র ঝড়ো হাওয়া বইয়ে দিলেন। তাতে তাদের তাঁবু ছিঁড়ে গেল, হাড়ি-পাতিল সব ছড়িয়ে-ছিটিয়ে গেল, চুলা নিভে গেল এবং সওয়ারীর পশুগুলো ভয় পেয়ে চারদিকে ছোটাছুটি করতে লাগল । এভাবে তাদের গোটা শিবির তছনছ হয়ে গেল। অগত্যা তাদেরকে অবরোধ ত্যাগ করে ব্যর্থতার গ্লানি নিয়ে ফিরে যেতে হল।-তাফসীরে তাওযীহুল কুরআন
এখানে যে আয়াত উল্লেখ করা হয়েছে, তা দ্বারা আল্লাহ তা'আলার প্রতি সাহাবায়ে কিরামের গভীর আস্থা ও নির্ভরতার ছবি এঁকে দেওয়া হয়েছে। আরবের শক্তিশালী ও রণকুশলী গোত্রসমূহ তাদের বিরুদ্ধে একাট্টা। তারা মুষ্টিমেয় একটি দল। তাদের রণসামগ্রীও অতি সামান্য। তদুপরি ভেতরে রয়েছে বিশ্বাসঘাতক ইহুদী গোত্রসমূহ। যে- কোনও সময় তারা মদীনায় অবস্থিত অসহায় নারী ও শিশুদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। এমন কঠিন পরিস্থিতিতেও সাহাবীগণ বিন্দুমাত্র হতোদ্যম হননি, তাঁদের ঈমানে কোনও দুর্বলতা দেখা দেয়নি। বরং তারা আল্লাহর প্রতি পরম নির্ভরতা ও ঈমানী বলিষ্ঠতার সাথে উচ্চারণ করেন- “এটাই সেই বিষয় যার প্রতিশ্রুতি আল্লাহ ও তাঁর রাসূল আমাদেরকে দিয়েছিলেন”।
কী ছিল সে প্রতিশ্রুতি? উত্তর সূরা বাকারায়। ইরশাদ হয়েছে-
أَمْ حَسِبْتُمْ أَنْ تَدْخُلُوا الْجَنَّةَ وَلَمَّا يَأْتِكُمْ مَثَلُ الَّذِينَ خَلَوْا مِنْ قَبْلِكُمْ مَسَّتْهُمُ الْبَأْسَاءُ وَالضَّرَّاءُ وَزُلْزِلُوا حَتَّى يَقُولَ الرَّسُولُ وَالَّذِينَ آمَنُوا مَعَهُ مَتَى نَصْرُ اللَّهِ أَلَا إِنَّ نَصْرَ اللَّهِ قَرِيبٌ (214)
অর্থঃ (হে মুসলিমগণ!) তোমরা কি মনে করেছ, তোমরা জান্নাতে (এমনিতেই) প্রবেশ করবে, অথচ এখনও পর্যন্ত তোমাদের উপর সেই রকম অবস্থা আসেনি, যেমনটা এসেছিল তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের উপর? তাদেরকে স্পর্শ করেছিল অর্থসংকট ও দুঃখকষ্ট এবং তাদেরকে করা হয়েছিল প্রকম্পিত, এমনকি রাসূল এবং তাঁর ঈমানদার সঙ্গীগণ বলে উঠেছিল, আল্লাহর সাহায্য কখন আসবে? মনে রেখ, আল্লাহর সাহায্য নিকটেই। সূরা বাকারা, আয়াত ২১৪
এর দাবি হচ্ছে মুশরিকদের মত দুঃখকষ্টের সম্মুখীন মুমিনদেরও হতে হবে। সে দুঃখকষ্টে তাদের কর্তব্য হবে আল্লাহর প্রতি পূর্ণ তাওয়াক্কুল ও চরম ধৈর্যধারণ করা। তা করতে পারলে আল্লাহর সাহায্য ও বিজয় তাদের লাভ হবে। এটাই সেই ওয়াদা, যা আহযাবের যুদ্ধে বাস্তবায়িত হয়েছে আর এ ওয়াদার প্রতিই ইঙ্গিত করে সাহাবায়ে কিরাম বলেছিলেন- “এটাই সেই বিষয় যার প্রতিশ্রুতি আল্লাহ ও তাঁর রাসূল আমাদেরকে দিয়েছিলেন। এবং তাঁরা যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তা সত্যই দিয়েছিলেন”। এভাবে সম্মিলিত বাহিনীর অভিযানে সাহাবায়ে কিরামের ঈমান ও আনুগত্য বৃদ্ধি পেল, আল্লাহর প্রতি ইয়াকীন ও তাওয়াক্কুল আরও দৃঢ় হল এবং আল্লাহর ফয়সালায় তারা পূর্ণ সন্তুষ্টি জ্ঞাপন করলেন।
তাদের এ ঈমান, ইয়াকীন ও তাওয়াক্কুল দ্বারা আমরা শিক্ষা গ্রহণ করতে পারি- যখনই কোনও কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন আমরা হই, তখন আমাদের কর্তব্য তাদের থেকে শিক্ষা নিয়ে আল্লাহর প্রতি আস্থাশীল থাকা ও তাঁর দিকে রুজু হওয়া।
দুই নং আয়াত
الَّذِينَ قَالَ لَهُمُ النَّاسُ إِنَّ النَّاسَ قَدْ جَمَعُوا لَكُمْ فَاخْشَوْهُمْ فَزَادَهُمْ إِيمَانًا وَقَالُوا حَسْبُنَا اللَّهُ وَنِعْمَ الْوَكِيلُ (173) فَانْقَلَبُوا بِنِعْمَةٍ مِنَ اللَّهِ وَفَضْلٍ لَمْ يَمْسَسْهُمْ سُوءٌ وَاتَّبَعُوا رِضْوَانَ اللَّهِ وَاللَّهُ ذُو فَضْلٍ عَظِيمٍ (174)
অর্থঃ যাদেরকে লোকে বলেছিল, (মক্কার কাফির) লোকেরা তোমাদের (সাথে যুদ্ধ করার) জন্য (পুনরায়) সেনা সংগ্রহ করেছে, সুতরাং তাদেরকে ভয় কর। তখন এট (এই সংবাদ) তাদের ঈমানের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দেয় এবং তারা বলে ওঠে, আমাদের জন্য আল্লাহই যথেষ্ট এবং তিনি উত্তম কর্মবিধায়ক। পরিণামে তারা আল্লাহর নি‘আমত ও অনুগ্রহ নিয়ে এভাবে ফিরে আসল যে, বিন্দুমাত্র অনিষ্ট তাদের স্পর্শ করেনি এবং তারা আল্লাহ যাতে খুশি হন তার অনুসরণ করেছে। বস্তুত আল্লাহ মহা অনুগ্রহের মালিক।, সূরা আলে-ইমরান, আয়াত ১৭৩-১৭৪
ব্যাখ্যা
এ আয়াতেও সাহাবায়ে কিরামের আল্লাহনির্ভরতা ও অটুট ঈমানের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। এতে ইঙ্গিত করা হয়েছে ‘হামরাউল আসাদ’ নামক যুদ্ধের প্রতি। যুদ্ধের ঘটনাটি সংক্ষেপে নিরূপ-
‘হামরাউল আসাদ’-এর যুদ্ধ
মক্কার কাফেরগণ উহুদের যুদ্ধ থেকে ফিরে যাওয়ার সময় রাস্তায় এই বলে আক্ষেপ করতে লাগল যে, যুদ্ধে জয়লাভ করা সত্ত্বেও আমরা অহেতুক ফিরে আসলাম। আমরা আরেকটু অগ্রসর হলে তো সমস্ত মুসলিমকেই নিশ্চিহ্ন করে ফেলতে পারতাম। এই চিন্তা করে তারা পুনরায় মদীনা মুনাওয়ারার দিকে অগ্রসর হওয়ার ইচ্ছা করল। অন্যদিকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সম্ভবত তাদের এ ইচ্ছা সম্পর্কে অবহিত হয়ে অথবা উহুদ যুদ্ধের ক্ষতিপূরণের ইচ্ছায় পরদিন ভোরে ঘোষণা করে দিলেন যে, আমরা শত্রুর পশ্চাদ্ধাবনের উদ্দেশ্যে বের হব আর এতে আমাদের সঙ্গে কেবল তারাই যাবে, যারা উহুদের যুদ্ধে শরীক ছিল।
সাহাবায়ে কেরাম যদিও উহুদের যুদ্ধে ক্ষতবিক্ষত ও ক্লান্ত-শ্রান্ত ছিলেন, কিন্তু মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এ ডাকে সাড়া দিতে তারা এক মুহূর্ত দেরি করলেন না। এ আয়াতে তাদের সে আত্মোৎসর্গেরই প্রশংসা করা হয়েছে।
মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবায়ে কেরামকে নিয়ে ‘হামরাউল আসাদ’ নামক স্থানে পৌঁছলে সেখানে বনু খুযাআর এক ব্যক্তির সঙ্গে দেখা হয়। তার নাম ছিল মা‘বাদ। কাফির হওয়া সত্ত্বেও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি তার সহানুভূতি ছিল। এ সময় মুসলিমদের উদ্যম ও সাহসিকতা তার নজর কাড়ে। অতঃপর সে আরও সামনে অগ্রসর হলে আবু সুফিয়ানসহ অন্যান্য কুরাইশ নেতাদের সাথে তার সাক্ষাৎ হল। তখন সে তাদেরকে মুসলিম সৈন্যদের উদ্দীপনা ও সাহসিকতার কথা জানাল এবং পরামর্শ দিল যে, তাদের উচিত মদীনায় গিয়ে হামলা করার পরিকল্পনা ত্যাগ করে মক্কায় ফিরে যাওয়া। এতে কাফিরদের অন্তরে ভীতি সঞ্চার হল। ফলে তারা ফিরে চলে গেল। কিন্তু যাওয়ার সময় তারা আবদুল কায়স গোত্রের মদীনাগামী এক কাফেলাকে বলে গেল যে, পথে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে তাদের সাক্ষাৎ হলে যেন জানিয়ে দেয়, আবু সুফিয়ান এক বিশাল বাহিনী সংগ্রহ করেছে এবং সে মুসলিমদের নিপাত করার জন্য মদীনার দিকে এগিয়ে আসছে। এর দ্বারা উদ্দেশ্য ছিল মুসলিমদের মনে ত্রাস সৃষ্টি করা। সেমতে এ কাফেলা হামরাউল আসাদে পৌঁছে যখন মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাক্ষাৎ পেল তখন তাঁকে এ কথা বলল। কিন্তু সাহাবায়ে কেরাম তাতে ভয় তো পেলেনই না, উল্টো তাঁরা তাদের ঈমানদীপ্ত সেই কথা শুনিয়ে দিলেন, যা প্রশংসার সাথে এ আয়াতে বর্ণিত হয়েছে।-তাফসীরে তাওযীহুল কুরআন
তারা বললেন, আল্লাহই আমাদের জন্য যথেষ্ট। তিনি আমাদের রক্ষাকর্তা। তিনিই আমাদের যাবতীয় বিষয়ের ব্যবস্থাপক। তিনি উত্তম আশ্রয়স্থল। আমরা তাঁর প্রতি ভরসা রাখি। আর যে-কেউ আল্লাহর প্রতি ভরসা রাখে, তিনি তার সাহায্য করে থাকেন। এই দৃঢ় ঈমান ও তাওয়াক্কুলের যে সুফল তারা লাভ করেছিলেন, দ্বিতীয় আয়াতে তা বর্ণিত হয়েছে। তারা মদীনা মুনাওয়ারায় ফিরে আসলেন আল্লাহর নি‘আমত ও অনুগ্রহ নিয়ে। অর্থাৎ ফিরে আসলেন সম্পূর্ণ নিরাপদে ও অক্ষত অবস্থায়। সেইসঙ্গে লাভ করলেন আখিরাতের অফুরন্ত ছওয়াব ও প্রতিদান। কাফিরগণ তাদের বিন্দুমাত্র ক্ষতি করতে পারল না। উপরন্তু তারা লাভ করলেন আল্লাহর সন্তুষ্টি ও দোজাহানের সফলতা। বস্তুত আল্লাহ মহা অনুগ্রহশীল। যারা তাঁর প্রতি ঈমান ও ভরসা রাখে, তাদের প্রতি তিনি অভাবনীয় অনুগ্রহ করে থাকেন।
তিন নং আয়াত
وَتَوَكَّلْ عَلَى الْحَيِّ الَّذِي لَا يَمُوتُ
অর্থঃ তুমি নির্ভর কর সেই সত্তার উপর, যিনি চিরঞ্জীব, যাঁর মৃত্যু নেই।সূরা ফুরকান, আয়াত ৫৮
ব্যাখ্যা
এ আয়াতে আল্লাহ তা'আলা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামকে লক্ষ্য করে তাওয়াক্কুলের হুকুম দিয়েছেন। এতে কোনও সন্দেহ নেই যে, তিনি তাওয়াক্কুলের সর্বোচ্চ স্তরে অধিষ্ঠিত ছিলেন। তা সত্ত্বেও যে তাঁকে তাওয়াক্কুলের হুকুম দেওয়া হয়েছে, এর দ্বারা মূলত উদ্দেশ্য তাঁর উম্মতকে শিক্ষা দান করা।
তাওয়াক্কুলের হুকুমদান প্রসঙ্গে আল্লাহ তা'আলা তাঁর বিশেষ গুণবাচক নাম الحي- এর উল্লেখ করেছেন। এর অর্থ তিনি চিরঞ্জীব, যার মৃত্যু নেই। তিনি অমর অক্ষয় সত্তা। এর দ্বারা ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, তাওয়াক্কুল ও ভরসা কেবল তাঁর উপরই করা যায়। তিনি ছাড়া আর যা-কিছু আছে সকলেই তাঁর সৃষ্টি। তারা নশ্বর ও মরণশীল। তাদের যাবতীয় শক্তি সামান্য ও সীমাবদ্ধ। এরূপ সীমিত শক্তির মরণশীল সৃষ্টির উপর ভরসা করা মানে নিজের ধ্বংস ডেকে আনা। যে ব্যক্তি দুর্বল সৃষ্টির উপর ভরসা করবে, সে কেবল সময়েরই অপচয় করবে এবং তার চেষ্টা ও পরিশ্রম বৃথা যাবে। বুদ্ধিমান ব্যক্তির উচিত এর থেকে বিরত থাকা এবং এক আল্লাহর উপরই ভরসা করা। আল্লাহ এক অমর অক্ষয় সত্তা। কোনও উত্থান-পতন, পরিবর্তন ও পারিপার্শ্বিকতা তাঁকে স্পর্শ করতে পারে না। তাঁর উপর যে ভরসা করবে তার কোনও ব্যর্থতা নেই। নেই কোনও পরাজয়। তিনি অতি মমতাভরে ডেকে বলছেন- তুমি ভরসা কর সেই চিরঞ্জীবের প্রতি, যাঁর মৃত্যু নেই।
চার নং আয়াত
وَعَلَى اللَّهِ فَلْيَتَوَكَّلِ الْمُؤْمِنُوْنَ
অর্থঃ মুমিনগণ যেন আল্লাহর উপরই নির্ভর করে।সূরা ইবরাহীম, আয়াত ১১
ব্যাখ্যা
এ আয়াতেও আল্লাহ তা'আলা মুমিনদেরকে তাঁর প্রতি ভরসা করার হুকুম দিয়েছেন। মু'মিন বলে সম্বোধন করার পর এ হুকুম দেওয়ার দ্বারা ইশারা পাওয়া যায় যে, তাওয়াক্কুল করা ঈমানের দাবি। আল্লাহর প্রতি যার ঈমান আছে, আসবাব-উপকরণ ও নিজ চেষ্টার উপর সে ভরসা করতে পারে না। কারণ সে জানে আসবাব- উপকরণের কোনও শক্তি নেই। এগুলো আল্লাহরই সৃষ্টি। যিনি এর স্রষ্টা, এতে আছর ও সুফলও তিনিই দান করেন। তিনি না চাইলে আসবাব-উপকরণ দ্বারা কোনও সুফল পাওয়া সম্ভব নয়। সুতরাং সে তাঁর নির্দেশ মোতাবেক আসবাব-উপকরণের ব্যবহার করবে বটে, কিন্তু ভরসা করবে তাঁরই উপর। অতঃপর তিনি যে ফলাফল দান করেন তাতেই সন্তুষ্ট থাকবে।
পাঁচ নং আয়াত
فَإِذَا عَرَّمْتَ فَتَوَكَّلْ عَلَى اللَّهِ
অর্থঃ অতঃপর তুমি যখন (কোনও বিষয়ে) মনস্থির করবে, তখন আল্লাহর উপর নির্ভর করো। সূরা আলে-ইমরান, আয়াত ১৫৯
ব্যাখ্যা
এ আয়াতের আগে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পরামর্শ করার হুকুম দেওয়া হয়েছে। তারপর এ বাক্যে বলা হয়েছে, পরামর্শের পর যখন কোনও বিষয়ে সিদ্ধান্ত স্থির করবে, তখন আল্লাহর উপর ভরসা করে সে সিদ্ধান্ত কার্যকরের চেষ্টা করবে। এর দ্বারা তাওয়াক্কুল সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ ধারণা পাওয়া যায়। প্রথমে পরামর্শ করতে বলা হয়েছে। পরামর্শ করাও এক ধরনের উপকরণ ও এক প্রকার চেষ্টা। তারপর বলা হয়েছে সিদ্ধান্ত মোতাবেক কাজ করবে আল্লাহর প্রতি ভরসার সাথে। এর দ্বারা যেমন নিজ সাধ্য অনুযায়ী চেষ্টা করার জরুরত বোঝা গেল, তেমনি আল্লাহর প্রতি ভরসা করারও হুকুম জানা গেল। এমন নয় যে, কেবল আল্লাহর প্রতি ভরসা করলেই চলবে, কোনও চেষ্টা-মেহনতের দরকার নেই। আবার এমনও নয় যে, কেবল চেষ্টাই করবে, নিজ বিদ্যা-বুদ্ধি খাটাবে আর ভাববে এতেই সব হয়ে যাবে, আল্লাহর উপর ভরসার কোনও প্রয়োজন নেই। বরং এ আয়াত চেষ্টা ও ভরসা সমানতালে উভয়টিই আঁকড়ে ধরতে বলছে। এটাই তাওয়াক্কুলের হাকীকত। তাওয়াক্কুলের আদেশ সম্পর্কে আরও প্রচুর আয়াত আছে, যা সুপরিচিত ও সকলের জানা।
তাওয়াক্কুলের ফযীলত সম্পর্কিত আয়াত
এক নং আয়াত
وَمَنْ يَتَوَكَّلْ عَلَى اللَّهِ فَهُوَ حَسْبُهُ
অর্থঃ যে-কেউ আল্লাহর উপর নির্ভর করে, আল্লাহই তার (কর্মসম্পাদনের) জন্য যথেষ্ট।সূরা তালাক, আয়াত ৩
ব্যাখ্যা
অর্থাৎ আল্লাহ তা'আলা তার সমুদয় কাজ পূর্ণ করে দেন। সে যা-কিছু নিয়ে চিন্তিত, তার সুবন্দোবস্ত করে দেন। সবরকম দুশ্চিন্তা থেকে তাকে হেফাজত করেন। তার মানে এ নয় যে, তার পার্থিব কোনও ব্যর্থতা দেখা দেবে না বা তাকে কোনও দুঃখকষ্টের সম্মুখীন হতে হবে না। দুঃখকষ্ট, ব্যর্থতা ও সফলতা আল্লাহ তা'আলা যে প্রাকৃতিক নিয়ম সৃষ্টি করেছেন সে অনুযায়ী হয়ে থাকে। সবকিছু তাকদীরে লিপিবদ্ধ আছে। কখন কী ঘটবে- না ঘটবে তা স্থিরীকৃত আছে। সে অনুযায়ী তা হবেই হবে। তাওয়াক্কুলের দ্বারা তার ব্যতিক্রম হবে এমন নয়। তবে তাওয়াক্কুল করলে আল্লাহ তা'আলা অন্তরে হিম্মত দান করেন ও ধৈর্যধারণের শক্তি যোগান। ফলে বান্দা অন্যান্য লোকের মত ব্যর্থতায় ও বিপদ-আপদে অস্থির হয়ে পড়ে না। বাহ্যিক কষ্টের ভেতরও তার মনে প্রশান্তি বিরাজ করে। চেষ্টা শ্রমের ফলাফল হাসিমুখে গ্রহণ করে নেয়। বাহ্যিক ব্যর্থতাকেও আল্লাহর ফয়সালা মনে করে সন্তুষ্টচিত্তে মেনে নেয়। সে শান্তমনে আল্লাহর অভিমুখী থাকে। এতে করে একই কষ্ট অন্যদের কাছে যত কঠিন মনে হয়, তার কাছে তত কঠিন থাকে না। তার কাছে তুলনামূলক হালকা মনে হয়। সেইসঙ্গে আখিরাতের ছওয়াব ও প্রতিদান তো আছেই। আল্লাহর উপর ভরসা করার কারণে দুনিয়ার কষ্টক্লেশের বিনিময়ে সে আখিরাতে প্রভূত ছওয়াবের অধিকারী হয়।
দুই নং আয়াত
মু'মিনের বিশেষ পাঁচটি গুণ
إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ الَّذِينَ إِذَا ذُكِرَ اللَّهُ وَجِلَتْ قُلُوبُهُمْ وَإِذَا تُلِيَتْ عَلَيْهِمْ آيَاتُهُ زَادَتْهُمْ إِيمَانًا وَعَلَى رَبِّهِمْ يَتَوَكَّلُونَ (2)
অর্থঃ মুমিন তো তারাই, (যাদের সামনে) আল্লাহকে স্মরণ করা হলে তাদের হৃদয় ভীত হয়, যখন তাদের সামনে তাঁর আয়াতসমূহ পড়া হয়, তখন তা তাদের ঈমানের উন্নতি সাধন করে এবং তারা তাদের প্রতিপালকের উপর ভরসা করে।সূরা আনফাল, আয়াত ২
ব্যাখ্যা
এ আয়াতে আল্লাহ তা'আলা মু'মিনদের বিশেষ তিনটি গুণ উল্লেখ করেছেন।
প্রথম গুণ- যখন আল্লাহর কথা স্মরণ হয় বা আল্লাহর কথা উল্লেখ করা হয়, তখন তাদের অন্তরে ভয়ভীতি দেখা দেয়। কেননা মু'মিন ব্যক্তি জানে আল্লাহ সর্বজ্ঞ ও সর্বশক্তিমান। বান্দার যাবতীয় অবস্থা তিনি জানেন। প্রত্যেককে আখিরাতে তাঁর সামনে দাঁড়াতে হবে। সবকিছুর হিসাব দিতে হবে। হিসাব ঠিক না হলে তিনি কঠিন শাস্তি দান করবেন। আল্লাহ সম্পর্কে এ কথা জানা থাকার ফলে যখনই তাঁকে স্মরণ হয়, বান্দা তাঁর ভয়ে কেঁপে ওঠে। তখন সে সতর্ক হয়ে যায় এবং যে অবস্থায় বা যে কাজে থাকে, তা আল্লাহর হুকুম মোতাবেক না হলে সঙ্গে সঙ্গে ছেড়ে দেয় ও নিজেকে শুধরে নেয়।
দ্বিতীয় গুণ বলা হয়েছে- যখন তাদের সামনে আল্লাহর আয়াত তিলাওয়াত করা হয়, তাদের ঈমান বৃদ্ধি পায়। অর্থাৎ তার ঈমান আরও শক্তিশালী হয় এবং ঈমানের আলোয় তার অন্তর আরও বেশি আলোকিত হয়। কেননা সে বিশ্বাস করে, এ আয়াত আল্লাহর বাণী। ফলে তার বুঝে আসুক বা না-ই আসুক, সর্বাবস্থায় তার সত্যতা সে স্বীকার করে নেয়। অতঃপর তা উপদেশমূলক হলে উপদেশ গ্রহণ করে। তাতে তার আল্লাহপ্রেম আরও উজ্জীবিত হয় এবং আল্লাহর পথে চলতে অধিকতর অনুপ্রাণিত হয়। আর যদি সে আয়াত বিধানমূলক হয়, তবে তাতে যে আদেশ-নিষেধ থাকে, তা পালনে তৎপর হয়। এভাবে ঈমানের পথে তার আরও বেশি অগ্রগতি লাভ হয়।
তৃতীয় গুণ বলা হয়েছে- তারা তাদের প্রতিপালকের উপর ভরসা করে। অর্থাৎ তারা নিজ বিদ্যা-বুদ্ধি ও শক্তি-ক্ষমতার উপর ভরসা করে না এবং কোনও মাখলুকের কাছে আশাবাদী হয় না। বরং নিজেদের যাবতীয় বিষয় আল্লাহর উপর ন্যস্ত করে। কেবল তাঁকেই ভয় পায় এবং তাঁরই কাছে আশা করে।
এর পরের আয়াতে মু'মিনদের আরও দু'টি গুণ উল্লেখ করা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে- الَّذِينَ يُقِيمُونَ الصَّلوةَ وَ مِمَّا رَزَقْنَهُمْ يُنفِقُونَ
অর্থঃ তারা নামায কায়েম করে এবং আল্লাহ তাদেরকে যে রিযিক দিয়েছেন তা থেকে ব্যয় করে।সূরা আনফাল, আয়াত ৩
সর্বমোট এ পাঁচটি গুণ হল। যে সকল মু'মিন এ পাঁচটি গুণের অধিকারী, তাদের সম্পর্কে সবশেষে ঘোষণা হয়েছে-
أُولَئِكَ هُمُ الْمُؤْمِنُونَ حَقًّا لَهُمْ دَرَجَاتٌ عِنْدَ رَبِّهِمْ وَمَغْفِرَةٌ وَرِزْقٌ كَرِيمٌ
অর্থঃ এরাই প্রকৃত মুমিন। তাদের জন্য তাদের প্রতিপালকের কাছে রয়েছে উচ্চ মর্যাদা, ক্ষমা ও সম্মানজনক রিযিক। সূরা আনফাল, আয়াত ৪
আল্লাহ তা'আলা আমাদেরকে এরূপ মু'মিন হওয়ার তাওফীক দান করুন। তাওয়াক্কুলের ফযীলত সম্পর্কিত আয়াত প্রচুর এবং তা সুবিদিত।
ইয়াকীনের অর্থ ও ব্যাখ্যা
ইয়াকীনের শাব্দিক অর্থ প্রত্যয়। অর্থাৎ সন্দেহমুক্ত জ্ঞান ও নিশ্চয়াত্মক ধারণা। পরিভাষায় ইয়াকীন বলা হয় কোনও বিষয় সম্পর্কে এ বিশ্বাস রাখা যে, তা এই এই রকম এবং তা এরকমই হওয়া সম্ভব, এর বিপরীত হওয়া সম্ভব নয়। কিংবা বলা যায় কোনও বিষয় সম্পর্কে এমন বাস্তবানুগ বিশ্বাসকে ইয়াকীন বলে, যে বিশ্বাস কখনও টলে না।
দীন ও শরী'আত সম্পর্কে কুরআন মাজীদে তিন রকম ইয়াকীনের উল্লেখ পাওয়া যায়ঃ- ১. 'ইলমুল ইয়াকীন, ২. 'আইনুল ইয়াকীন, ৩. ও হাক্কুল ইয়াকীন। এ তিন প্রকার ইয়াকীনের মধ্যে কিছুটা পার্থক্য আছে। 'ইলমুল ইয়াকীনের সম্পর্ক দুনিয়ার সাথে। কোনও ব্যক্তি দীন ও শরী'আত সম্পর্কিত জ্ঞানলাভের পর যতদিন সে দুনিয়ায় থাকে, ততদিন তার জন্য সে জ্ঞান 'ইলমুল ইয়াকীনের পর্যায়ে থাকে।
তারপর যখন মৃত্যু শুরু হয় এবং পরকালের দৃশ্যাবলি চোখের সামনে চলে আসে, তখন সে 'ইলম 'আইনুল ইয়াকীনে পরিণত হয়। অর্থাৎ চাক্ষুষ প্রত্যয় হয়ে যায়। এতদিন সে গভীর বিশ্বাসের সাথে যা জানত, এখন তার সত্যতা চোখে দেখতে পাচ্ছে।
তারপর যখন কিয়ামত সংঘটিত হবে, ঈমানদার ব্যক্তি জান্নাতে চলে যাবে,জান্নাতের নি'আমতরাজি ও তার মনোরোম দৃশ্য নিজ চোখে দেখতে পারে, সর্বোপরি আল্লাহ তা'আলার দীদার লাভ হবে, তখন তার জ্ঞান হাক্কুল ইয়াকীন তথা বাস্তব প্রত্যয়ে পরিণত হয়।
মনে করুন- 'কালোজাম। যে ব্যক্তি কালোজাম কোনওদিন দেখেনি, সে যদি বিশ্বস্ত সূত্রে জানতে পারে এটা একরকম মিষ্টান্ন দ্রব্য, তবে এ সম্পর্কে তার যে বিশ্বাস অর্জিত হবে তা 'ইলমুল ইয়াকীন'। তারপর সে যদি এটা নিজ চোখে দেখতে পায়, তবে তার বিশ্বাস একধাপ উন্নত হবে। এরূপ বিশ্বাসকে বলা হয় 'আইনুল ইয়াকীন। তারপর সে যদি তা খাওয়ারও সুযোগ পায়, তবে তার বিশ্বাস চূড়ান্ত পর্যায়ে উন্নীত হবে। একে বলা হবে 'হাক্কুল ইয়াকীন'।
দুনিয়ায় 'ইলমুল ইয়াকীন সকল মু'মিনেরই অর্জিত থাকে। এ ব্যাপারে উলামায়ে কিরামের স্থান সবার উপরে। আইনুল ইয়াকীন অর্জিত থাকে বিশেষ শ্রেণির মুমিনদের। তাদেরকে ‘আরেফ বলা হয়, যারা মৃত্যুর জন্য সদা প্রস্তুত থাকে। যেন মৃত্যু তাদের চোখের সামনে। 'হাক্কুল ইয়াকীন অর্জিত হয় সেইসব আওলিয়া কিরামের, যাদের অন্তর সমস্ত মাখলুকাতের ভালোবাসা থেকে ছিন্ন হয়ে এক আল্লাহর 'ইশক ও ভালোবাসায় বিলীন হয়ে যায়।
তাওয়াক্কুলের অর্থ ও ব্যাখ্যা
তাওয়াক্কুল-এর অর্থ নির্ভর করা। বিশেষ অর্থে আল্লাহর প্রতি নির্ভরতাকে তাওয়াক্কুল বলে। পরিভাষায় তাওয়াক্কুল বলা হয় নিজ শক্তি-সামর্থ্য, চেষ্টা ও ব্যবস্থাপনার উপর থেকে নির্ভরশীলতা ছিন্ন করে পরম মনিব আল্লাহ তা'আলার ইচ্ছা ও শক্তির উপর নির্ভরশীল হওয়াকে। এ সম্পর্কে বিভিন্ন তত্ত্বজ্ঞানী বিভিন্ন ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন। তবে সর্বাপেক্ষা গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন ইমাম তাবারী রহ.।তিনি বলেন তাওয়াক্কুল অর্থ- আল্লাহর প্রতি নির্ভর করা ও আল্লাহ তা'আলার ফয়সালাই কার্যকর হয় এ বিশ্বাসের সাথে নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নত মোতাবেক খাদ্য, পানীয় ও জীবনধারণের জন্য অপরিহার্য আসবাব-উপকরণ অর্জনের চেষ্টা করা এবং শত্রু থেকে আত্মরক্ষায় সচেষ্ট থাকা।
প্রকাশ থাকে যে, তাওয়াক্কুলের স্থান বান্দার অন্তর। আসবাব-উপকরণ অবলম্বন করা বাহ্যিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের কাজ। এটা তাওয়াক্কুলের পরিপন্থি নয়- যদি অন্তরে আল্লাহর প্রতি নির্ভরতা দৃঢ় থাকে এবং বিশ্বাস থাকে যে, হবে সেটাই যা আল্লাহর ফয়সালা; আমি চেষ্টা পরিশ্রম করছি কেবল এ কারণে যে, তা করা আল্লাহর হুকুম। আল্লাহর ফয়সালা ছাড়া আমার চেষ্টা পরিশ্রম কোনও সুফল বয়ে আনার ক্ষমতা রাখে না। আবার বিনা চেষ্টা-পরিশ্রমে কোনওকিছু দান করাও আল্লাহর নীতি নয়, যদিও তা দান করার ক্ষমতা আল্লাহ তা'আলার আছে।
সারকথা, তাওয়াক্কুল হচ্ছে আল্লাহর হুকুম মোতাবেক চেষ্টা পরিশ্রম করা এবং তার ফলাফলের ব্যাপারে আল্লাহর প্রতি নির্ভর করা। প্রথমটি আল্লাহর আনুগত্য আর দ্বিতীয়টি তাঁর প্রতি ঈমান। তাওয়াক্কুল এ দুইয়ের সমন্বিত রূপ।
চেষ্টা-পরিশ্রম ছাড়া কেবল আল্লাহর প্রতি ভরসা করার নাম তাওয়াক্কুল নয়; বরং এটা আল্লাহর হুকুমের অবাধ্যতা করার নামান্তর। আবার আল্লাহর প্রতি ভরসা না করে কেবল চেষ্টা-পরিশ্রমকেই সবকিছু মনে করা বেঈমানী কাজ। প্রকৃত সত্য এর মাঝখানে। অর্থাৎ আল্লাহর প্রতি নির্ভরও করতে হবে এবং শরী'আত মোতাবেক চেষ্টাও চালিয়ে যেতে হবে।
একবার এক সাহাবী জিজ্ঞেস করেছিলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি উটটি ছেড়ে দিয়ে আল্লাহর উপর ভরসা করব (যে, আল্লাহ তা'আলা এটি হেফাজত করবেন), নাকি আগে বাঁধব তারপর আল্লাহর উপর ভরসা করব? তিনি বললেন, আগে এটি বাঁধ, তারপর আল্লাহর উপর ভরসা কর। এর দ্বারা নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাওয়াক্কুল কী তা বুঝিয়ে দিলেন।
হযরত সাহল তুসতারী রহ. বলেন, যে ব্যক্তি চেষ্টা-পরিশ্রমকে আপত্তিকর মনে করে, সে মূলত নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের তরীকার উপরই আপত্তি করে। আর যে ব্যক্তি তাওয়াক্কুলের উপর আপত্তি করে, সে যেন ঈমানের উপরই আপত্তি তোলে।
হযরত ফুযায়ল ইব্ন 'ইয়ায রহ.-কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, কেউ যদি নিজ ঘরে বসে থাকে আর মনে করে সে আল্লাহর প্রতি ভরসা করেছে, ফলে তার রিযিক তার কাছে এসে যাবে, তবে কি এটা ঠিক হবে? তিনি বললেন, সে যদি আল্লাহর প্রতি পুরোপুরি আস্থা রেখে এভাবে বসে থাকে, তবে আল্লাহ তার ইচ্ছা অবশ্যই পূরণ করবেন। কিন্তু এটা নিয়ম নয়। আল্লাহর কোনও নবী এমন করেননি। নবীগণ শ্রম খেটেছেন। আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেও পরিশ্রম করে উপার্জন করেছেন। কাজ করেছেন হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি. ও উমর ফারূক রাযি.। তাঁরা এমন বলেননি যে, আমরা বসে থাকলাম, আল্লাহ আমাদের খাওয়াবেন।
বস্তুত তাওয়াক্কুল নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চরিত্র। আর কামাইরোজগার তাঁর সুন্নত। উভয়টিই অবলম্বন করতে হবে। এর মধ্যেই দুনিয়া ও আখিরাতের সফলতা।
ইয়াকীন ও তাওয়াক্কুল সম্পর্কিত আয়াতসমূহ
এক নং আয়াত
وَلَمَّا رَأَى الْمُؤْمِنُونَ الْأَحْزَابَ قَالُوا هَذَا مَا وَعَدَنَا اللَّهُ وَرَسُولُهُ وَصَدَقَ اللَّهُ وَرَسُولُهُ وَمَا زَادَهُمْ إِلَّا إِيمَانًا وَتَسْلِيمًا (22)
অর্থঃ মুমিনগণ যখন (শত্রুদের) সম্মিলিত বাহিনীকে দেখেছিল, তখন তারা বলেছিল, এটাই সেই বিষয় যার প্রতিশ্রুতি আল্লাহ ও তাঁর রাসূল আমাদেরকে দিয়েছিলেন। আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সত্যই বলেছিলেন। আর এ ঘটনা তাদের ঈমান ও আনুগত্যের চেতনাকে আরও বৃদ্ধি করে দিয়েছিল।.সূরা আহযাব (৩৩), আয়াত ২২
ব্যাখ্যা
এ আয়াতে আহযাবের যুদ্ধকালীন একটি অবস্থা বর্ণিত হয়েছে।আহযাব (احزاب) শব্দটি হিযব (حزب)-এর বহুবচন। হিযব অর্থ দল। আহযাব অর্থ দলসমূহ। এ যুদ্ধে আরবের বিভিন্ন গোত্র একত্র হয়ে মদীনায় হামলা চালিয়েছিল। তাই একে আহযাবের বা সম্মিলিত বাহিনীর যুদ্ধ বলা হয়। এর আরেক নাম খন্দকের যুদ্ধ। খন্দক মানে পরিখা এ যুদ্ধে মদীনা মুনাওয়ারার হেফাজতের জন্য দীর্ঘ পরিখা খনন করা হয়েছিল। এ যুদ্ধটি সংঘটিত হয়েছিল হিজরী ৫ম সালে। যুদ্ধের সংক্ষিপ্ত বিবরণ এরকম-
আহযাবের যুদ্ধ
প্রসিদ্ধ ইয়াহুদী গোত্র বনু নাজীরের চক্রান্তে কুরাইশ পৌত্তলিকগণ সিদ্ধান্ত স্থির করেছিল যে, তারা আরবের বিভিন্ন গোত্রকে একাট্টা করে সকলে যৌথভাবে মদীনা মুনাওয়ারায় হামলা চালাবে। সেমতে কুরাইশ গোত্র ছাড়াও বনু গাতফান, বনু আসলাম, বনু মুররা, বনু আশজা', বনু কিনানা ও বনু ফাযারা- গোত্রসমূহ সম্মিলিতভাবে এক বিশাল বাহিনী তৈরি করে ফেলল। তাদের সংখ্যা বারো হাজার থেকে পনেরো হাজার পর্যন্ত বর্ণনা করা হয়ে থাকে। এই বিপুল সশস্ত্র সেনাদল পূর্ণ প্রস্তুতি সহকারে মদীনা মুনাওয়ারার উদ্দেশে যাত্রা করল। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সংবাদ পাওয়ামাত্র সাহাবায়ে কিরামকে নিয়ে পরামর্শে বসলেন।
হযরত সালমান ফারসী রাযি. পরামর্শ দিলেন, মদীনা মুনাওয়ারার উত্তর দিকে, যে দিক থেকে হানাদার বাহিনী আসতে পারে, একটি গভীর পরিখা খনন করা হোক, যাতে তারা নগরে প্রবেশ করতে সক্ষম না হয়। সুতরাং সমস্ত সাহাবী কাজে লেগে গেলেন।মাত্র ছয় দিনে তারা সাড়ে তিন মাইল দীর্ঘ ও পাঁচ গজ গভীর একটি পরিখা খনন করে ফেললেন।
মুসলিমদের পক্ষে এ যুদ্ধটি পূর্ববর্তী সকল যুদ্ধ অপেক্ষা বেশি কঠিন ছিল। শত্রুসৈন্য ছিল তাদের চার গুণেরও বেশি। এর উপর বাড়তি বিষফোড়াস্বরূপ কুখ্যাত ইয়াহুদী গোত্র বনু কুরাইজা সম্পর্কে খবর পাওয়া গেল, তারা মুসলিমদের সাথে সম্পাদিত চুক্তি ভঙ্গ করে হানাদারদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে। তারা যেহেতু ছিল মুসলিমদের প্রতিবেশী, তাই তাদের দিক থেকে অনিষ্টের আশঙ্কা ছিল অনেক বেশি।
তখন ছিল প্রচণ্ড শীতকাল। খাদ্যসামগ্রীরও ছিল অভাব। এতটা দীর্ঘ পরিখার খননকার্যে দিনরাত ব্যস্ত থাকার দরুন রোজগারেরও কোনও সুযোগ মেলেনি। ফলে খাদ্য সংকট তীব্রাকার ধারণ করল। এ অবস্থায় হানাদার বাহিনী পরিখার কিনারায় এসে শিবির ফেলল। অতঃপর উভয় পক্ষে তীর ও পাথর ছোড়াছুড়ি চলতে থাকল। লাগাতার প্রায় এক মাস এ অবস্থা চলল।
রাত-দিন একটানা পাহারা দিতে দিতে মুজাহিদগণ ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে পড়েছিল। পরিশেষে এক সময় সুদীর্ঘ এ কঠিন পরীক্ষার অবসান হল আর তা এভাবে যে, আল্লাহ তাআলা হানাদারদের ছাউনির উপর দিয়ে এক হিমশীতল তীব্র ঝড়ো হাওয়া বইয়ে দিলেন। তাতে তাদের তাঁবু ছিঁড়ে গেল, হাড়ি-পাতিল সব ছড়িয়ে-ছিটিয়ে গেল, চুলা নিভে গেল এবং সওয়ারীর পশুগুলো ভয় পেয়ে চারদিকে ছোটাছুটি করতে লাগল । এভাবে তাদের গোটা শিবির তছনছ হয়ে গেল। অগত্যা তাদেরকে অবরোধ ত্যাগ করে ব্যর্থতার গ্লানি নিয়ে ফিরে যেতে হল।-তাফসীরে তাওযীহুল কুরআন
এখানে যে আয়াত উল্লেখ করা হয়েছে, তা দ্বারা আল্লাহ তা'আলার প্রতি সাহাবায়ে কিরামের গভীর আস্থা ও নির্ভরতার ছবি এঁকে দেওয়া হয়েছে। আরবের শক্তিশালী ও রণকুশলী গোত্রসমূহ তাদের বিরুদ্ধে একাট্টা। তারা মুষ্টিমেয় একটি দল। তাদের রণসামগ্রীও অতি সামান্য। তদুপরি ভেতরে রয়েছে বিশ্বাসঘাতক ইহুদী গোত্রসমূহ। যে- কোনও সময় তারা মদীনায় অবস্থিত অসহায় নারী ও শিশুদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। এমন কঠিন পরিস্থিতিতেও সাহাবীগণ বিন্দুমাত্র হতোদ্যম হননি, তাঁদের ঈমানে কোনও দুর্বলতা দেখা দেয়নি। বরং তারা আল্লাহর প্রতি পরম নির্ভরতা ও ঈমানী বলিষ্ঠতার সাথে উচ্চারণ করেন- “এটাই সেই বিষয় যার প্রতিশ্রুতি আল্লাহ ও তাঁর রাসূল আমাদেরকে দিয়েছিলেন”।
কী ছিল সে প্রতিশ্রুতি? উত্তর সূরা বাকারায়। ইরশাদ হয়েছে-
أَمْ حَسِبْتُمْ أَنْ تَدْخُلُوا الْجَنَّةَ وَلَمَّا يَأْتِكُمْ مَثَلُ الَّذِينَ خَلَوْا مِنْ قَبْلِكُمْ مَسَّتْهُمُ الْبَأْسَاءُ وَالضَّرَّاءُ وَزُلْزِلُوا حَتَّى يَقُولَ الرَّسُولُ وَالَّذِينَ آمَنُوا مَعَهُ مَتَى نَصْرُ اللَّهِ أَلَا إِنَّ نَصْرَ اللَّهِ قَرِيبٌ (214)
অর্থঃ (হে মুসলিমগণ!) তোমরা কি মনে করেছ, তোমরা জান্নাতে (এমনিতেই) প্রবেশ করবে, অথচ এখনও পর্যন্ত তোমাদের উপর সেই রকম অবস্থা আসেনি, যেমনটা এসেছিল তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের উপর? তাদেরকে স্পর্শ করেছিল অর্থসংকট ও দুঃখকষ্ট এবং তাদেরকে করা হয়েছিল প্রকম্পিত, এমনকি রাসূল এবং তাঁর ঈমানদার সঙ্গীগণ বলে উঠেছিল, আল্লাহর সাহায্য কখন আসবে? মনে রেখ, আল্লাহর সাহায্য নিকটেই। সূরা বাকারা, আয়াত ২১৪
এর দাবি হচ্ছে মুশরিকদের মত দুঃখকষ্টের সম্মুখীন মুমিনদেরও হতে হবে। সে দুঃখকষ্টে তাদের কর্তব্য হবে আল্লাহর প্রতি পূর্ণ তাওয়াক্কুল ও চরম ধৈর্যধারণ করা। তা করতে পারলে আল্লাহর সাহায্য ও বিজয় তাদের লাভ হবে। এটাই সেই ওয়াদা, যা আহযাবের যুদ্ধে বাস্তবায়িত হয়েছে আর এ ওয়াদার প্রতিই ইঙ্গিত করে সাহাবায়ে কিরাম বলেছিলেন- “এটাই সেই বিষয় যার প্রতিশ্রুতি আল্লাহ ও তাঁর রাসূল আমাদেরকে দিয়েছিলেন। এবং তাঁরা যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তা সত্যই দিয়েছিলেন”। এভাবে সম্মিলিত বাহিনীর অভিযানে সাহাবায়ে কিরামের ঈমান ও আনুগত্য বৃদ্ধি পেল, আল্লাহর প্রতি ইয়াকীন ও তাওয়াক্কুল আরও দৃঢ় হল এবং আল্লাহর ফয়সালায় তারা পূর্ণ সন্তুষ্টি জ্ঞাপন করলেন।
তাদের এ ঈমান, ইয়াকীন ও তাওয়াক্কুল দ্বারা আমরা শিক্ষা গ্রহণ করতে পারি- যখনই কোনও কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন আমরা হই, তখন আমাদের কর্তব্য তাদের থেকে শিক্ষা নিয়ে আল্লাহর প্রতি আস্থাশীল থাকা ও তাঁর দিকে রুজু হওয়া।
দুই নং আয়াত
الَّذِينَ قَالَ لَهُمُ النَّاسُ إِنَّ النَّاسَ قَدْ جَمَعُوا لَكُمْ فَاخْشَوْهُمْ فَزَادَهُمْ إِيمَانًا وَقَالُوا حَسْبُنَا اللَّهُ وَنِعْمَ الْوَكِيلُ (173) فَانْقَلَبُوا بِنِعْمَةٍ مِنَ اللَّهِ وَفَضْلٍ لَمْ يَمْسَسْهُمْ سُوءٌ وَاتَّبَعُوا رِضْوَانَ اللَّهِ وَاللَّهُ ذُو فَضْلٍ عَظِيمٍ (174)
অর্থঃ যাদেরকে লোকে বলেছিল, (মক্কার কাফির) লোকেরা তোমাদের (সাথে যুদ্ধ করার) জন্য (পুনরায়) সেনা সংগ্রহ করেছে, সুতরাং তাদেরকে ভয় কর। তখন এট (এই সংবাদ) তাদের ঈমানের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দেয় এবং তারা বলে ওঠে, আমাদের জন্য আল্লাহই যথেষ্ট এবং তিনি উত্তম কর্মবিধায়ক। পরিণামে তারা আল্লাহর নি‘আমত ও অনুগ্রহ নিয়ে এভাবে ফিরে আসল যে, বিন্দুমাত্র অনিষ্ট তাদের স্পর্শ করেনি এবং তারা আল্লাহ যাতে খুশি হন তার অনুসরণ করেছে। বস্তুত আল্লাহ মহা অনুগ্রহের মালিক।, সূরা আলে-ইমরান, আয়াত ১৭৩-১৭৪
ব্যাখ্যা
এ আয়াতেও সাহাবায়ে কিরামের আল্লাহনির্ভরতা ও অটুট ঈমানের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। এতে ইঙ্গিত করা হয়েছে ‘হামরাউল আসাদ’ নামক যুদ্ধের প্রতি। যুদ্ধের ঘটনাটি সংক্ষেপে নিরূপ-
‘হামরাউল আসাদ’-এর যুদ্ধ
মক্কার কাফেরগণ উহুদের যুদ্ধ থেকে ফিরে যাওয়ার সময় রাস্তায় এই বলে আক্ষেপ করতে লাগল যে, যুদ্ধে জয়লাভ করা সত্ত্বেও আমরা অহেতুক ফিরে আসলাম। আমরা আরেকটু অগ্রসর হলে তো সমস্ত মুসলিমকেই নিশ্চিহ্ন করে ফেলতে পারতাম। এই চিন্তা করে তারা পুনরায় মদীনা মুনাওয়ারার দিকে অগ্রসর হওয়ার ইচ্ছা করল। অন্যদিকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সম্ভবত তাদের এ ইচ্ছা সম্পর্কে অবহিত হয়ে অথবা উহুদ যুদ্ধের ক্ষতিপূরণের ইচ্ছায় পরদিন ভোরে ঘোষণা করে দিলেন যে, আমরা শত্রুর পশ্চাদ্ধাবনের উদ্দেশ্যে বের হব আর এতে আমাদের সঙ্গে কেবল তারাই যাবে, যারা উহুদের যুদ্ধে শরীক ছিল।
সাহাবায়ে কেরাম যদিও উহুদের যুদ্ধে ক্ষতবিক্ষত ও ক্লান্ত-শ্রান্ত ছিলেন, কিন্তু মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এ ডাকে সাড়া দিতে তারা এক মুহূর্ত দেরি করলেন না। এ আয়াতে তাদের সে আত্মোৎসর্গেরই প্রশংসা করা হয়েছে।
মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবায়ে কেরামকে নিয়ে ‘হামরাউল আসাদ’ নামক স্থানে পৌঁছলে সেখানে বনু খুযাআর এক ব্যক্তির সঙ্গে দেখা হয়। তার নাম ছিল মা‘বাদ। কাফির হওয়া সত্ত্বেও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি তার সহানুভূতি ছিল। এ সময় মুসলিমদের উদ্যম ও সাহসিকতা তার নজর কাড়ে। অতঃপর সে আরও সামনে অগ্রসর হলে আবু সুফিয়ানসহ অন্যান্য কুরাইশ নেতাদের সাথে তার সাক্ষাৎ হল। তখন সে তাদেরকে মুসলিম সৈন্যদের উদ্দীপনা ও সাহসিকতার কথা জানাল এবং পরামর্শ দিল যে, তাদের উচিত মদীনায় গিয়ে হামলা করার পরিকল্পনা ত্যাগ করে মক্কায় ফিরে যাওয়া। এতে কাফিরদের অন্তরে ভীতি সঞ্চার হল। ফলে তারা ফিরে চলে গেল। কিন্তু যাওয়ার সময় তারা আবদুল কায়স গোত্রের মদীনাগামী এক কাফেলাকে বলে গেল যে, পথে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে তাদের সাক্ষাৎ হলে যেন জানিয়ে দেয়, আবু সুফিয়ান এক বিশাল বাহিনী সংগ্রহ করেছে এবং সে মুসলিমদের নিপাত করার জন্য মদীনার দিকে এগিয়ে আসছে। এর দ্বারা উদ্দেশ্য ছিল মুসলিমদের মনে ত্রাস সৃষ্টি করা। সেমতে এ কাফেলা হামরাউল আসাদে পৌঁছে যখন মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাক্ষাৎ পেল তখন তাঁকে এ কথা বলল। কিন্তু সাহাবায়ে কেরাম তাতে ভয় তো পেলেনই না, উল্টো তাঁরা তাদের ঈমানদীপ্ত সেই কথা শুনিয়ে দিলেন, যা প্রশংসার সাথে এ আয়াতে বর্ণিত হয়েছে।-তাফসীরে তাওযীহুল কুরআন
তারা বললেন, আল্লাহই আমাদের জন্য যথেষ্ট। তিনি আমাদের রক্ষাকর্তা। তিনিই আমাদের যাবতীয় বিষয়ের ব্যবস্থাপক। তিনি উত্তম আশ্রয়স্থল। আমরা তাঁর প্রতি ভরসা রাখি। আর যে-কেউ আল্লাহর প্রতি ভরসা রাখে, তিনি তার সাহায্য করে থাকেন। এই দৃঢ় ঈমান ও তাওয়াক্কুলের যে সুফল তারা লাভ করেছিলেন, দ্বিতীয় আয়াতে তা বর্ণিত হয়েছে। তারা মদীনা মুনাওয়ারায় ফিরে আসলেন আল্লাহর নি‘আমত ও অনুগ্রহ নিয়ে। অর্থাৎ ফিরে আসলেন সম্পূর্ণ নিরাপদে ও অক্ষত অবস্থায়। সেইসঙ্গে লাভ করলেন আখিরাতের অফুরন্ত ছওয়াব ও প্রতিদান। কাফিরগণ তাদের বিন্দুমাত্র ক্ষতি করতে পারল না। উপরন্তু তারা লাভ করলেন আল্লাহর সন্তুষ্টি ও দোজাহানের সফলতা। বস্তুত আল্লাহ মহা অনুগ্রহশীল। যারা তাঁর প্রতি ঈমান ও ভরসা রাখে, তাদের প্রতি তিনি অভাবনীয় অনুগ্রহ করে থাকেন।
তিন নং আয়াত
وَتَوَكَّلْ عَلَى الْحَيِّ الَّذِي لَا يَمُوتُ
অর্থঃ তুমি নির্ভর কর সেই সত্তার উপর, যিনি চিরঞ্জীব, যাঁর মৃত্যু নেই।সূরা ফুরকান, আয়াত ৫৮
ব্যাখ্যা
এ আয়াতে আল্লাহ তা'আলা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামকে লক্ষ্য করে তাওয়াক্কুলের হুকুম দিয়েছেন। এতে কোনও সন্দেহ নেই যে, তিনি তাওয়াক্কুলের সর্বোচ্চ স্তরে অধিষ্ঠিত ছিলেন। তা সত্ত্বেও যে তাঁকে তাওয়াক্কুলের হুকুম দেওয়া হয়েছে, এর দ্বারা মূলত উদ্দেশ্য তাঁর উম্মতকে শিক্ষা দান করা।
তাওয়াক্কুলের হুকুমদান প্রসঙ্গে আল্লাহ তা'আলা তাঁর বিশেষ গুণবাচক নাম الحي- এর উল্লেখ করেছেন। এর অর্থ তিনি চিরঞ্জীব, যার মৃত্যু নেই। তিনি অমর অক্ষয় সত্তা। এর দ্বারা ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, তাওয়াক্কুল ও ভরসা কেবল তাঁর উপরই করা যায়। তিনি ছাড়া আর যা-কিছু আছে সকলেই তাঁর সৃষ্টি। তারা নশ্বর ও মরণশীল। তাদের যাবতীয় শক্তি সামান্য ও সীমাবদ্ধ। এরূপ সীমিত শক্তির মরণশীল সৃষ্টির উপর ভরসা করা মানে নিজের ধ্বংস ডেকে আনা। যে ব্যক্তি দুর্বল সৃষ্টির উপর ভরসা করবে, সে কেবল সময়েরই অপচয় করবে এবং তার চেষ্টা ও পরিশ্রম বৃথা যাবে। বুদ্ধিমান ব্যক্তির উচিত এর থেকে বিরত থাকা এবং এক আল্লাহর উপরই ভরসা করা। আল্লাহ এক অমর অক্ষয় সত্তা। কোনও উত্থান-পতন, পরিবর্তন ও পারিপার্শ্বিকতা তাঁকে স্পর্শ করতে পারে না। তাঁর উপর যে ভরসা করবে তার কোনও ব্যর্থতা নেই। নেই কোনও পরাজয়। তিনি অতি মমতাভরে ডেকে বলছেন- তুমি ভরসা কর সেই চিরঞ্জীবের প্রতি, যাঁর মৃত্যু নেই।
চার নং আয়াত
وَعَلَى اللَّهِ فَلْيَتَوَكَّلِ الْمُؤْمِنُوْنَ
অর্থঃ মুমিনগণ যেন আল্লাহর উপরই নির্ভর করে।সূরা ইবরাহীম, আয়াত ১১
ব্যাখ্যা
এ আয়াতেও আল্লাহ তা'আলা মুমিনদেরকে তাঁর প্রতি ভরসা করার হুকুম দিয়েছেন। মু'মিন বলে সম্বোধন করার পর এ হুকুম দেওয়ার দ্বারা ইশারা পাওয়া যায় যে, তাওয়াক্কুল করা ঈমানের দাবি। আল্লাহর প্রতি যার ঈমান আছে, আসবাব-উপকরণ ও নিজ চেষ্টার উপর সে ভরসা করতে পারে না। কারণ সে জানে আসবাব- উপকরণের কোনও শক্তি নেই। এগুলো আল্লাহরই সৃষ্টি। যিনি এর স্রষ্টা, এতে আছর ও সুফলও তিনিই দান করেন। তিনি না চাইলে আসবাব-উপকরণ দ্বারা কোনও সুফল পাওয়া সম্ভব নয়। সুতরাং সে তাঁর নির্দেশ মোতাবেক আসবাব-উপকরণের ব্যবহার করবে বটে, কিন্তু ভরসা করবে তাঁরই উপর। অতঃপর তিনি যে ফলাফল দান করেন তাতেই সন্তুষ্ট থাকবে।
পাঁচ নং আয়াত
فَإِذَا عَرَّمْتَ فَتَوَكَّلْ عَلَى اللَّهِ
অর্থঃ অতঃপর তুমি যখন (কোনও বিষয়ে) মনস্থির করবে, তখন আল্লাহর উপর নির্ভর করো। সূরা আলে-ইমরান, আয়াত ১৫৯
ব্যাখ্যা
এ আয়াতের আগে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পরামর্শ করার হুকুম দেওয়া হয়েছে। তারপর এ বাক্যে বলা হয়েছে, পরামর্শের পর যখন কোনও বিষয়ে সিদ্ধান্ত স্থির করবে, তখন আল্লাহর উপর ভরসা করে সে সিদ্ধান্ত কার্যকরের চেষ্টা করবে। এর দ্বারা তাওয়াক্কুল সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ ধারণা পাওয়া যায়। প্রথমে পরামর্শ করতে বলা হয়েছে। পরামর্শ করাও এক ধরনের উপকরণ ও এক প্রকার চেষ্টা। তারপর বলা হয়েছে সিদ্ধান্ত মোতাবেক কাজ করবে আল্লাহর প্রতি ভরসার সাথে। এর দ্বারা যেমন নিজ সাধ্য অনুযায়ী চেষ্টা করার জরুরত বোঝা গেল, তেমনি আল্লাহর প্রতি ভরসা করারও হুকুম জানা গেল। এমন নয় যে, কেবল আল্লাহর প্রতি ভরসা করলেই চলবে, কোনও চেষ্টা-মেহনতের দরকার নেই। আবার এমনও নয় যে, কেবল চেষ্টাই করবে, নিজ বিদ্যা-বুদ্ধি খাটাবে আর ভাববে এতেই সব হয়ে যাবে, আল্লাহর উপর ভরসার কোনও প্রয়োজন নেই। বরং এ আয়াত চেষ্টা ও ভরসা সমানতালে উভয়টিই আঁকড়ে ধরতে বলছে। এটাই তাওয়াক্কুলের হাকীকত। তাওয়াক্কুলের আদেশ সম্পর্কে আরও প্রচুর আয়াত আছে, যা সুপরিচিত ও সকলের জানা।
তাওয়াক্কুলের ফযীলত সম্পর্কিত আয়াত
এক নং আয়াত
وَمَنْ يَتَوَكَّلْ عَلَى اللَّهِ فَهُوَ حَسْبُهُ
অর্থঃ যে-কেউ আল্লাহর উপর নির্ভর করে, আল্লাহই তার (কর্মসম্পাদনের) জন্য যথেষ্ট।সূরা তালাক, আয়াত ৩
ব্যাখ্যা
অর্থাৎ আল্লাহ তা'আলা তার সমুদয় কাজ পূর্ণ করে দেন। সে যা-কিছু নিয়ে চিন্তিত, তার সুবন্দোবস্ত করে দেন। সবরকম দুশ্চিন্তা থেকে তাকে হেফাজত করেন। তার মানে এ নয় যে, তার পার্থিব কোনও ব্যর্থতা দেখা দেবে না বা তাকে কোনও দুঃখকষ্টের সম্মুখীন হতে হবে না। দুঃখকষ্ট, ব্যর্থতা ও সফলতা আল্লাহ তা'আলা যে প্রাকৃতিক নিয়ম সৃষ্টি করেছেন সে অনুযায়ী হয়ে থাকে। সবকিছু তাকদীরে লিপিবদ্ধ আছে। কখন কী ঘটবে- না ঘটবে তা স্থিরীকৃত আছে। সে অনুযায়ী তা হবেই হবে। তাওয়াক্কুলের দ্বারা তার ব্যতিক্রম হবে এমন নয়। তবে তাওয়াক্কুল করলে আল্লাহ তা'আলা অন্তরে হিম্মত দান করেন ও ধৈর্যধারণের শক্তি যোগান। ফলে বান্দা অন্যান্য লোকের মত ব্যর্থতায় ও বিপদ-আপদে অস্থির হয়ে পড়ে না। বাহ্যিক কষ্টের ভেতরও তার মনে প্রশান্তি বিরাজ করে। চেষ্টা শ্রমের ফলাফল হাসিমুখে গ্রহণ করে নেয়। বাহ্যিক ব্যর্থতাকেও আল্লাহর ফয়সালা মনে করে সন্তুষ্টচিত্তে মেনে নেয়। সে শান্তমনে আল্লাহর অভিমুখী থাকে। এতে করে একই কষ্ট অন্যদের কাছে যত কঠিন মনে হয়, তার কাছে তত কঠিন থাকে না। তার কাছে তুলনামূলক হালকা মনে হয়। সেইসঙ্গে আখিরাতের ছওয়াব ও প্রতিদান তো আছেই। আল্লাহর উপর ভরসা করার কারণে দুনিয়ার কষ্টক্লেশের বিনিময়ে সে আখিরাতে প্রভূত ছওয়াবের অধিকারী হয়।
দুই নং আয়াত
মু'মিনের বিশেষ পাঁচটি গুণ
إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ الَّذِينَ إِذَا ذُكِرَ اللَّهُ وَجِلَتْ قُلُوبُهُمْ وَإِذَا تُلِيَتْ عَلَيْهِمْ آيَاتُهُ زَادَتْهُمْ إِيمَانًا وَعَلَى رَبِّهِمْ يَتَوَكَّلُونَ (2)
অর্থঃ মুমিন তো তারাই, (যাদের সামনে) আল্লাহকে স্মরণ করা হলে তাদের হৃদয় ভীত হয়, যখন তাদের সামনে তাঁর আয়াতসমূহ পড়া হয়, তখন তা তাদের ঈমানের উন্নতি সাধন করে এবং তারা তাদের প্রতিপালকের উপর ভরসা করে।সূরা আনফাল, আয়াত ২
ব্যাখ্যা
এ আয়াতে আল্লাহ তা'আলা মু'মিনদের বিশেষ তিনটি গুণ উল্লেখ করেছেন।
প্রথম গুণ- যখন আল্লাহর কথা স্মরণ হয় বা আল্লাহর কথা উল্লেখ করা হয়, তখন তাদের অন্তরে ভয়ভীতি দেখা দেয়। কেননা মু'মিন ব্যক্তি জানে আল্লাহ সর্বজ্ঞ ও সর্বশক্তিমান। বান্দার যাবতীয় অবস্থা তিনি জানেন। প্রত্যেককে আখিরাতে তাঁর সামনে দাঁড়াতে হবে। সবকিছুর হিসাব দিতে হবে। হিসাব ঠিক না হলে তিনি কঠিন শাস্তি দান করবেন। আল্লাহ সম্পর্কে এ কথা জানা থাকার ফলে যখনই তাঁকে স্মরণ হয়, বান্দা তাঁর ভয়ে কেঁপে ওঠে। তখন সে সতর্ক হয়ে যায় এবং যে অবস্থায় বা যে কাজে থাকে, তা আল্লাহর হুকুম মোতাবেক না হলে সঙ্গে সঙ্গে ছেড়ে দেয় ও নিজেকে শুধরে নেয়।
দ্বিতীয় গুণ বলা হয়েছে- যখন তাদের সামনে আল্লাহর আয়াত তিলাওয়াত করা হয়, তাদের ঈমান বৃদ্ধি পায়। অর্থাৎ তার ঈমান আরও শক্তিশালী হয় এবং ঈমানের আলোয় তার অন্তর আরও বেশি আলোকিত হয়। কেননা সে বিশ্বাস করে, এ আয়াত আল্লাহর বাণী। ফলে তার বুঝে আসুক বা না-ই আসুক, সর্বাবস্থায় তার সত্যতা সে স্বীকার করে নেয়। অতঃপর তা উপদেশমূলক হলে উপদেশ গ্রহণ করে। তাতে তার আল্লাহপ্রেম আরও উজ্জীবিত হয় এবং আল্লাহর পথে চলতে অধিকতর অনুপ্রাণিত হয়। আর যদি সে আয়াত বিধানমূলক হয়, তবে তাতে যে আদেশ-নিষেধ থাকে, তা পালনে তৎপর হয়। এভাবে ঈমানের পথে তার আরও বেশি অগ্রগতি লাভ হয়।
তৃতীয় গুণ বলা হয়েছে- তারা তাদের প্রতিপালকের উপর ভরসা করে। অর্থাৎ তারা নিজ বিদ্যা-বুদ্ধি ও শক্তি-ক্ষমতার উপর ভরসা করে না এবং কোনও মাখলুকের কাছে আশাবাদী হয় না। বরং নিজেদের যাবতীয় বিষয় আল্লাহর উপর ন্যস্ত করে। কেবল তাঁকেই ভয় পায় এবং তাঁরই কাছে আশা করে।
এর পরের আয়াতে মু'মিনদের আরও দু'টি গুণ উল্লেখ করা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে- الَّذِينَ يُقِيمُونَ الصَّلوةَ وَ مِمَّا رَزَقْنَهُمْ يُنفِقُونَ
অর্থঃ তারা নামায কায়েম করে এবং আল্লাহ তাদেরকে যে রিযিক দিয়েছেন তা থেকে ব্যয় করে।সূরা আনফাল, আয়াত ৩
সর্বমোট এ পাঁচটি গুণ হল। যে সকল মু'মিন এ পাঁচটি গুণের অধিকারী, তাদের সম্পর্কে সবশেষে ঘোষণা হয়েছে-
أُولَئِكَ هُمُ الْمُؤْمِنُونَ حَقًّا لَهُمْ دَرَجَاتٌ عِنْدَ رَبِّهِمْ وَمَغْفِرَةٌ وَرِزْقٌ كَرِيمٌ
অর্থঃ এরাই প্রকৃত মুমিন। তাদের জন্য তাদের প্রতিপালকের কাছে রয়েছে উচ্চ মর্যাদা, ক্ষমা ও সম্মানজনক রিযিক। সূরা আনফাল, আয়াত ৪
আল্লাহ তা'আলা আমাদেরকে এরূপ মু'মিন হওয়ার তাওফীক দান করুন। তাওয়াক্কুলের ফযীলত সম্পর্কিত আয়াত প্রচুর এবং তা সুবিদিত।
যে সত্তর হাজার মু'মিন বিনা হিসাবে জান্নাতে যাবে
হাদীছ নং : ৭৪
হযরত আব্দুল্লাহ ইবন ‘আব্বাস রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন,উম্মতসমূহকে (স্বপ্নে বা মি‘রাজে) আমার সামনে পেশ করা হল। আমি এক নবীকে দেখলাম তাঁর সঙ্গে রয়েছে ছোট একটি দল। আরেক নবীকে দেখলাম তাঁর সঙ্গে এক-দুইজন লোক। আরেকজন নবীকে দেখলাম তাঁর সাথে কেউ নেই। হঠাৎ আমাকে একটি বিরাট দল দেখানো হল। আমি মনে করলাম নিশ্চয়ই তারা আমার উম্মত। কিন্তু আমাকে বলা হল এ হচ্ছে মূসা ও তাঁর কওম। তবে আপনি আকাশের দিগন্তে লক্ষ করুন। আমি লক্ষ করলাম। দেখি কি এক বিশাল দল! তারপর আবার আমাকে বলা হল আকাশের ওই দিগন্তে লক্ষ করুন। আমি তাকিয়ে দেখি সেখানেও এক বিশাল দল। তারপর আমাকে বলা হল এরা আপনার উম্মত। তাদের সঙ্গে আরও সত্তর হাজার এমন আছে, যারা জান্নাতে প্রবেশ করবে বিনা হিসাবে ও বিনা আযাবে।
তারপর নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম উঠে নিজ ঘরে প্রবেশ করলেন। তখন সাহাবীগণ ওই সত্তর হাজার সম্পর্কে আলোচনায় লিপ্ত হলেন, যারা বিনা হিসাবে ও বিনা আযাবে জান্নাতে প্রবেশ করবে। কেউ বললেন, তারা সম্ভবত ওই সকল লোক যারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাহচর্য লাভ করেছে। কেউ বললেন, তারা সম্ভবত ওই সকল লোক যারা ইসলামের উপর (অর্থাৎ মুসলিম বাবা-মা'র ঘরে) জন্মগ্রহণ করেছে। ফলে আল্লাহর সঙ্গে কোনওকিছুকে শরীক করেনি। এভাবে তারা আরও বিভিন্ন মতামত ব্যক্ত করলেন। ইত্যবসরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের কাছে বের হয়ে আসলেন। জিজ্ঞেস করলেন, এতক্ষণ তোমরা কোন্ বিষয়ে আলোচনা করছিলে? তারা তাঁকে জানালেন (কী আলোচনা এতক্ষণ করছিলেন)। তিনি বললেন, তারা ওই সকল লোক যারা নিজেরা ঝাড়ফুঁক করে না, অন্যকে দিয়ে ঝাড়ফুঁক করায় না। কোনওকিছুকে অশুভ লক্ষণ হিসেবে গ্রহণ করে না। এবং তারা তাদের প্রতিপালকের উপর তাওয়াক্কুল করে। তখন হযরত ‘উক্কাশা ইবন মিহসান রাযি. উঠে বললেন, আমার জন্য দু‘আ করুন যেন আল্লাহ তা'আলা আমাকে তাদের অন্তর্ভুক্ত করেন। তিনি বললেন, তুমি তাদের অন্তর্ভুক্ত। তারপর আরেকজন উঠে বললেন, আমার জন্য দু‘আ করুন যেন আল্লাহ তা'আলা আমাকে তাদের অন্তর্ভুক্ত করেন। তিনি বললেন, ‘উক্কাশা তোমার অগ্রবর্তী হয়ে গেছে। -বুখারী ও মুসলিম।
(সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৫৭০৭: সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ২২০; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ২৪৪৬)
হাদীছ নং : ৭৪
হযরত আব্দুল্লাহ ইবন ‘আব্বাস রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন,উম্মতসমূহকে (স্বপ্নে বা মি‘রাজে) আমার সামনে পেশ করা হল। আমি এক নবীকে দেখলাম তাঁর সঙ্গে রয়েছে ছোট একটি দল। আরেক নবীকে দেখলাম তাঁর সঙ্গে এক-দুইজন লোক। আরেকজন নবীকে দেখলাম তাঁর সাথে কেউ নেই। হঠাৎ আমাকে একটি বিরাট দল দেখানো হল। আমি মনে করলাম নিশ্চয়ই তারা আমার উম্মত। কিন্তু আমাকে বলা হল এ হচ্ছে মূসা ও তাঁর কওম। তবে আপনি আকাশের দিগন্তে লক্ষ করুন। আমি লক্ষ করলাম। দেখি কি এক বিশাল দল! তারপর আবার আমাকে বলা হল আকাশের ওই দিগন্তে লক্ষ করুন। আমি তাকিয়ে দেখি সেখানেও এক বিশাল দল। তারপর আমাকে বলা হল এরা আপনার উম্মত। তাদের সঙ্গে আরও সত্তর হাজার এমন আছে, যারা জান্নাতে প্রবেশ করবে বিনা হিসাবে ও বিনা আযাবে।
তারপর নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম উঠে নিজ ঘরে প্রবেশ করলেন। তখন সাহাবীগণ ওই সত্তর হাজার সম্পর্কে আলোচনায় লিপ্ত হলেন, যারা বিনা হিসাবে ও বিনা আযাবে জান্নাতে প্রবেশ করবে। কেউ বললেন, তারা সম্ভবত ওই সকল লোক যারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাহচর্য লাভ করেছে। কেউ বললেন, তারা সম্ভবত ওই সকল লোক যারা ইসলামের উপর (অর্থাৎ মুসলিম বাবা-মা'র ঘরে) জন্মগ্রহণ করেছে। ফলে আল্লাহর সঙ্গে কোনওকিছুকে শরীক করেনি। এভাবে তারা আরও বিভিন্ন মতামত ব্যক্ত করলেন। ইত্যবসরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের কাছে বের হয়ে আসলেন। জিজ্ঞেস করলেন, এতক্ষণ তোমরা কোন্ বিষয়ে আলোচনা করছিলে? তারা তাঁকে জানালেন (কী আলোচনা এতক্ষণ করছিলেন)। তিনি বললেন, তারা ওই সকল লোক যারা নিজেরা ঝাড়ফুঁক করে না, অন্যকে দিয়ে ঝাড়ফুঁক করায় না। কোনওকিছুকে অশুভ লক্ষণ হিসেবে গ্রহণ করে না। এবং তারা তাদের প্রতিপালকের উপর তাওয়াক্কুল করে। তখন হযরত ‘উক্কাশা ইবন মিহসান রাযি. উঠে বললেন, আমার জন্য দু‘আ করুন যেন আল্লাহ তা'আলা আমাকে তাদের অন্তর্ভুক্ত করেন। তিনি বললেন, তুমি তাদের অন্তর্ভুক্ত। তারপর আরেকজন উঠে বললেন, আমার জন্য দু‘আ করুন যেন আল্লাহ তা'আলা আমাকে তাদের অন্তর্ভুক্ত করেন। তিনি বললেন, ‘উক্কাশা তোমার অগ্রবর্তী হয়ে গেছে। -বুখারী ও মুসলিম।
(সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৫৭০৭: সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ২২০; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ২৪৪৬)
7 - باب في اليقين والتوكل (1)
قَالَ الله تَعَالَى: {وَلَمَّا رَأى الْمُؤْمِنُونَ الأَحْزَابَ قَالُوا هَذَا مَا وَعَدَنَا اللهُ وَرَسُولُهُ وَصَدَقَ اللهُ [ص:44] وَرَسُولُهُ وَمَا زَادَهُمْ إِلاَّ إِيمَانًا وَتَسْلِيمًا} [الأحزاب: 22]، وَقالَ تَعَالَى: {الَّذِينَ قَالَ لَهُمُ النَّاسُ إِنَّ النَّاسَ قَدْ جَمَعُوا لَكُمْ فَاخْشَوْهُمْ فَزَادَهُمْ إِيمَانًا وَقَالُوا حَسْبُنَا اللهُ وَنِعْمَ الْوَكِيلُ، فَانْقَلَبُوا بِنِعْمَةٍ مِنَ اللهِ وَفَضْلٍ لَمْ يَمْسَسْهُمْ سُوءٌ وَاتَّبَعُوا رِضْوَانَ اللهِ وَاللهُ ذُو فَضْلٍ عَظِيمٍ} [آل عمران:173 - 174]، وَقالَ تَعَالَى: {وَتَوَكَّلْ عَلَى الْحَيِّ الَّذِي لاَ يَمُوتُ} [الفرقان:58]، وَقالَ تَعَالَى: {وَعَلَى اللهِ فَلْيَتَوَكَّلِ الْمُؤْمِنُونَ} [إبراهيم: 11]، وَقالَ تَعَالَى: {فَإِذَا عَزَمْتَ فَتَوَكَّلْ عَلَى الله} [آل عمران: 159]، والآيات في الأمرِ بالتَّوكُّلِ كثيرةٌ معلومةٌ. وَقالَ تَعَالَى: {وَمَنْ يَتَوَكَّلْ عَلَى اللهِ فَهُوَ حَسْبُهُ} [الطلاق: 3]: أي كافِيهِ. وَقالَ تَعَالَى: {إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ الَّذِينَ إِذَا ذُكِرَ اللهُ وَجِلَتْ قُلُوبُهُمْ وَإِذَا تُلِيَتْ عَلَيْهِمْ آيَاتُهُ زَادَتْهُمْ إِيمَانًا وَعَلَى رَبِّهِمْ يَتَوَكَّلُونَ} [الأنفال: 2]، والآيات في فضل التوكل كثيرةٌ معروفةٌ.
قَالَ الله تَعَالَى: {وَلَمَّا رَأى الْمُؤْمِنُونَ الأَحْزَابَ قَالُوا هَذَا مَا وَعَدَنَا اللهُ وَرَسُولُهُ وَصَدَقَ اللهُ [ص:44] وَرَسُولُهُ وَمَا زَادَهُمْ إِلاَّ إِيمَانًا وَتَسْلِيمًا} [الأحزاب: 22]، وَقالَ تَعَالَى: {الَّذِينَ قَالَ لَهُمُ النَّاسُ إِنَّ النَّاسَ قَدْ جَمَعُوا لَكُمْ فَاخْشَوْهُمْ فَزَادَهُمْ إِيمَانًا وَقَالُوا حَسْبُنَا اللهُ وَنِعْمَ الْوَكِيلُ، فَانْقَلَبُوا بِنِعْمَةٍ مِنَ اللهِ وَفَضْلٍ لَمْ يَمْسَسْهُمْ سُوءٌ وَاتَّبَعُوا رِضْوَانَ اللهِ وَاللهُ ذُو فَضْلٍ عَظِيمٍ} [آل عمران:173 - 174]، وَقالَ تَعَالَى: {وَتَوَكَّلْ عَلَى الْحَيِّ الَّذِي لاَ يَمُوتُ} [الفرقان:58]، وَقالَ تَعَالَى: {وَعَلَى اللهِ فَلْيَتَوَكَّلِ الْمُؤْمِنُونَ} [إبراهيم: 11]، وَقالَ تَعَالَى: {فَإِذَا عَزَمْتَ فَتَوَكَّلْ عَلَى الله} [آل عمران: 159]، والآيات في الأمرِ بالتَّوكُّلِ كثيرةٌ معلومةٌ. وَقالَ تَعَالَى: {وَمَنْ يَتَوَكَّلْ عَلَى اللهِ فَهُوَ حَسْبُهُ} [الطلاق: 3]: أي كافِيهِ. وَقالَ تَعَالَى: {إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ الَّذِينَ إِذَا ذُكِرَ اللهُ وَجِلَتْ قُلُوبُهُمْ وَإِذَا تُلِيَتْ عَلَيْهِمْ آيَاتُهُ زَادَتْهُمْ إِيمَانًا وَعَلَى رَبِّهِمْ يَتَوَكَّلُونَ} [الأنفال: 2]، والآيات في فضل التوكل كثيرةٌ معروفةٌ.
74 - فالأول: عن ابن عباس رضي الله عنهما، قَالَ: قَالَ رسولُ الله - صلى الله عليه وسلم: «عُرِضَتْ عَلَيَّ الأُمَمُ، فَرَأيْتُ النَّبيَّ ومَعَهُ الرُّهَيطُ، والنبِيَّ وَمَعَهُ الرَّجُلُ وَالرَّجُلانِ، والنبيَّ لَيْسَ مَعَهُ أَحَدٌ، إِذْ رُفِعَ لي سَوَادٌ عَظيمٌ، فَظَنَنْتُ أَنَّهُمْ أُمَّتِي، فقيلَ لِي: هَذَا مُوسَى وَقَومُهُ، ولكنِ انْظُرْ إِلَى الأُفُقِ، فَنَظَرتُ فَإِذا سَوادٌ عَظِيمٌ، فقيلَ لي: انْظُرْ إِلَى الأفُقِ الآخَرِ، فَإِذَا سَوَادٌ عَظيمٌ، فقيلَ لِي: هذِهِ أُمَّتُكَ، وَمَعَهُمْ سَبْعُونَ (1) ألفًا يَدْخُلُونَ الجَنَّةَ بِغَيرِ حِسَابٍ ولا عَذَابٍ»،
ثُمَّ نَهَضَ فَدخَلَ مَنْزِلَهُ فَخَاضَ النَّاسُ في أُولئكَ الَّذِينَ يَدْخُلُونَ الجَنَّةَ بِغَيْرِ حِسَابٍ ولا عَذَابٍ، فَقَالَ بَعْضُهُمْ: فَلَعَلَّهُمْ الَّذينَ صَحِبوا رسولَ الله - صلى الله عليه وسلم - وَقالَ بعْضُهُمْ: فَلَعَلَّهُمْ الَّذِينَ وُلِدُوا في الإِسْلامِ فَلَمْ يُشْرِكُوا بِالله شَيئًا - وذَكَرُوا أشيَاءَ - فَخَرجَ عَلَيْهِمْ رسولُ الله - صلى الله عليه وسلم - فَقَالَ: «مَا الَّذِي تَخُوضُونَ فِيهِ؟» فَأَخْبَرُوهُ، فقالَ: «هُمُ الَّذِينَ لاَ يَرْقُونَ (2)، [ص:45] وَلا يَسْتَرقُونَ (3)، وَلا يَتَطَيَّرُونَ (4)؛ وعَلَى رَبِّهِمْ يَتَوكَّلُون» فقامَ عُكَّاشَةُ ابنُ محصنٍ، فَقَالَ: ادْعُ اللهَ أَنْ يَجْعَلني مِنْهُمْ، فَقَالَ: «أنْتَ مِنْهُمْ» ثُمَّ قَامَ رَجُلٌ آخَرُ، فَقَالَ: ادْعُ اللهَ أَنْ يَجْعَلنِي مِنْهُمْ، فَقَالَ: «سَبَقَكَ بِهَا عُكَّاشَةُ». مُتَّفَقٌ عَلَيهِ.
(5)
«الرُّهَيْطُ» بضم الراء تصغير رهط: وهم دون عشرة أنفس، وَ «الأُفقُ» الناحية والجانب. و «عُكَّاشَةُ» بضم العين وتشديد الكاف وبتخفيفها، والتشديد أفصح.
ثُمَّ نَهَضَ فَدخَلَ مَنْزِلَهُ فَخَاضَ النَّاسُ في أُولئكَ الَّذِينَ يَدْخُلُونَ الجَنَّةَ بِغَيْرِ حِسَابٍ ولا عَذَابٍ، فَقَالَ بَعْضُهُمْ: فَلَعَلَّهُمْ الَّذينَ صَحِبوا رسولَ الله - صلى الله عليه وسلم - وَقالَ بعْضُهُمْ: فَلَعَلَّهُمْ الَّذِينَ وُلِدُوا في الإِسْلامِ فَلَمْ يُشْرِكُوا بِالله شَيئًا - وذَكَرُوا أشيَاءَ - فَخَرجَ عَلَيْهِمْ رسولُ الله - صلى الله عليه وسلم - فَقَالَ: «مَا الَّذِي تَخُوضُونَ فِيهِ؟» فَأَخْبَرُوهُ، فقالَ: «هُمُ الَّذِينَ لاَ يَرْقُونَ (2)، [ص:45] وَلا يَسْتَرقُونَ (3)، وَلا يَتَطَيَّرُونَ (4)؛ وعَلَى رَبِّهِمْ يَتَوكَّلُون» فقامَ عُكَّاشَةُ ابنُ محصنٍ، فَقَالَ: ادْعُ اللهَ أَنْ يَجْعَلني مِنْهُمْ، فَقَالَ: «أنْتَ مِنْهُمْ» ثُمَّ قَامَ رَجُلٌ آخَرُ، فَقَالَ: ادْعُ اللهَ أَنْ يَجْعَلنِي مِنْهُمْ، فَقَالَ: «سَبَقَكَ بِهَا عُكَّاشَةُ». مُتَّفَقٌ عَلَيهِ.
(5)
«الرُّهَيْطُ» بضم الراء تصغير رهط: وهم دون عشرة أنفس، وَ «الأُفقُ» الناحية والجانب. و «عُكَّاشَةُ» بضم العين وتشديد الكاف وبتخفيفها، والتشديد أفصح.
হাদীসের ব্যাখ্যা:
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন সায়্যিদুল-আম্বিয়া ওয়াল মুরসালীন। নবী-রাসূলগণের প্রধান। আল্লাহ তা'আলা তাঁর সঙ্গে এমন অনেক মর্যাদাপূর্ণ আচরণ করেছেন, যা আর কারও সাথে করা হয়নি। যেমন তাঁর মি‘রাজ যাত্রা। এ হাদীছে সেরকম এক মর্যাদাপূর্ণ বিষয়ের উল্লেখ করা হয়েছে। তা হচ্ছে সমস্ত নবী রাসূল ও তাঁদের উম্মতকে তাঁকে দেখিয়ে দেওয়া। এ দেখানোটা মি‘রাজের সফরে হয়েছিল না স্বপ্নযোগে, তা এ হাদীছে স্পষ্ট করা হয়নি। যেভাবেই হোক না কেন, তাঁকে দেখানো হয়েছে এটাই সত্য। কখন কিভাবে দেখানো হয়েছে, তা জানা আমাদের জন্য জরুরি নয়। আমাদের জন্য জরুরি কেবল হাদীছ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা। এ হাদীছে সে শিক্ষা স্পষ্টভাবেই আছে।
এ হাদীছ দ্বারা জানা যায় প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের উম্মতসংখ্যা সবচে' বেশি। এর আগে যত নবী-রাসূল দুনিয়ায় এসেছেন, তাঁদের কারও উম্মতসংখ্যাই তাঁর উম্মতের সমান নয়। এখানে সর্বপ্রথম যে নবীর উল্লেখ করা হয়েছে তাঁর সঙ্গে ছিল একটি ক্ষুদ্র দল। শব্দ বলা হয়েছে 'রুহাইত' (رهيط)। এটি 'রাহত' (رهط)-এর তাসগীর (ক্ষুদ্রতাজ্ঞাপক রূপ)। এর দ্বারা তিন থেকে নয় পর্যন্ত সংখ্যাকে বোঝায়।
কোনও নবীর সঙ্গে ছিল এক-দুইজন লোক এবং কোনও নবীর সঙ্গে একজনও নয়। এ সকল নবী কে কে ছিলেন তা উল্লেখ করা হয়নি। শুধু হযরত মূসা আ.-এরই নাম বলা হয়েছে যে, তাঁর সাথে মোটামুটি একটা বড় দল ছিল। অন্যান্য নবীদের উম্মতের সংখ্যা কম হওয়ার মানে তাঁদের ডাকে অল্প লোকই সাড়া দিয়েছিল। আবার কোনও নবী এমন ছিলেন, যাঁর ডাকে কেউ সাড়া দেয়নি। ফলে তাঁর সঙ্গে কেউ ছিল না।
দীনী কাজে সফলতা ও ব্যর্থতার মাপকাঠি
এখানে কারও মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, যাঁর ডাকে কেউ সাড়া দেয়নি তাঁর দা'ওয়াতী মেহনত কি ব্যর্থ হয়েছে? কিংবা যাঁর ডাকে অল্পসংখ্যক লোক সাড়া দিয়েছে, তাঁর সফলতা কি কম?
না, তাঁদের কারওই মেহনত ব্যর্থ হয়নি এবং কেউই অসফল বা অল্প সফল হননি। তাঁদের প্রত্যেকেই পুরোপুরি সফল, তাতে কেউ সাড়া দিক বা না দিক। কেননা সফলতা ও ব্যর্থতা পার্থিব ফলাফলের উপর নির্ভর করে না। কার ডাকে বেশি লোক সাড়া দিয়েছে এবং কার ডাকে কম, সেটা বিবেচ্য বিষয় নয়। এর দ্বারা সফলতা-ব্যর্থতা নিরূপিত হয় না। দীনী কাজে সফলতা-অসফলতা নির্ভর করে কে কতটুকু ইখলাসের সাথে সঠিক পদ্ধতিতে কাজ করল তার উপর। যার কাজ যতবেশি ইখলাসভিত্তিক ও শুদ্ধ-সঠিক হবে সে ততবেশি সফল, তাতে পার্থিব ফলাফল যাই হোক না কেন। নবীদের কাজ ছিল আল্লাহর হুকুম মানুষের কাছে পৌঁছানো ও মানুষকে আল্লাহর দিকে ডাকা। তাঁরা এ দায়িত্ব পরিপূর্ণভাবে আদায় করেছিলেন। শতভাগ ইখলাসের সঙ্গে করেছিলেন। তাঁরা মানুষের কাছে কোনওরকম বিনিময় আশা করেননি। তাঁদের যা-কিছু চাওয়া-পাওয়ার, সবই ছিল আল্লাহর কাছে। তাঁদের একজনও আপন দায়িত্ব পালনে বিন্দুমাত্র ত্রুটি করেননি। সাড়া দেওয়া না দেওয়া যাকে দাওয়াত দেওয়া হয়েছে তার কাজ। সাড়া দিলে সে সফল, না দিলে ব্যর্থ। তার ব্যর্থতা কেবল তারই। তা নবীকে স্পর্শ করে না। সে সাড়া না দিয়ে ব্যর্থ হয়েছে বলে নবীও ব্যর্থ হয়ে যাবেন এমন কোনও কথা নেই। সুতরাং সকল নবীই সফল, যেহেতু তাঁদের সকলেই পরিপূর্ণভাবে নবুওয়াতী দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
এর দ্বারা দীনী দাওয়াতের অঙ্গনে যারা কাজ করে তারা শিক্ষা নিতে পারে। তাদেরও কাজ কেবল দা'ওয়াত দিয়ে যাওয়া। তাদের কোনও ব্যর্থতা নেই, যদি ইখলাসের সাথে সঠিক পদ্ধতিতে কাজ করে থাকে। তাদের ডাকে একজনও যদি সাড়া না দেয়, তাতে তাদের দমে যাওয়ার কারণ নেই। যথার্থভাবে কাজ করতে পারাটাই সফলতা। যদি তা করে থাকে, তবে সে সফল। তার কর্তব্য সেজন্য শোকর আদায় করা।
হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিশ্বনবী
সবশেষে নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের সামনে তাঁর নিজ উম্মতকে তুলে ধরা হয়। তাঁকে তাদের দেখানো হয় আকাশের দুই প্রান্তে। হযরত মূসা আ.-এর উম্মতকেও একই স্থানে দেখানো হয়, যদিও তাঁর উম্মতের সংখ্যা আখেরী উম্মত ছাড়া অন্যান্য নবীদের উম্মত অপেক্ষা বেশি ছিল। কিন্তু এ উম্মতকে দেখানো হয় আকাশের দুই দিকে। দুই দিগন্তে। খুব সম্ভব এর দ্বারা ইঙ্গিত করা হয়েছে অন্যান্য নবীর মত আমাদের নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুওয়াত পৃথিবীর কোনও এক স্থানের জন্য সীমাবদ্ধ নয়। তিনি জাতিবিশেষের নবী নন। তিনি আরব-অনারব, পূর্ব-পশ্চিম নির্বিশেষে সারা পৃথিবীর সকলের নবী। ইরশাদ হয়েছে–
وَمَا أَرْسَلْنَاكَ إِلَّا كَافَّةً لِلنَّاسِ بَشِيرًا وَنَذِيرًا وَلَكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لَا يَعْلَمُونَ
অর্থ এবং (হে নবী!) আমি তোমাকে সমস্ত মানুষের জন্য একজন সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপেই পাঠিয়েছি, কিন্তু অধিকাংশ মানুষ বুঝছে না। (সূরা সাবা, আয়াত ২৮)
অপর এক আয়াতে আছে–
قُلْ يَاأَيُّهَا النَّاسُ إِنِّي رَسُولُ اللَّهِ إِلَيْكُمْ جَمِيعًا
অর্থঃ বল, হে মানুষ! আমি তোমাদের সকলের নিকট আল্লাহর প্রেরিত রাসূল। (সূরা আ'রাফ, আয়াত ১৫৮)
এ হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম জানান, তাঁর উম্মতের সত্তর হাজার লোক বিনা হিসাবে ও বিনা আযাবে জান্নাতে যাবে। হাশরের ময়দানে তাদের ইহজীবনের কাজকর্মের কোনও হিসাব নেওয়া হবে না। তারা সরাসরি জান্নাতে চলে যাবে। এমন হবে না যে, পাপকর্মের শাস্তি ভোগের জন্য প্রথমে তাদের জাহান্নামে দেওয়া হবে। তারপর যখন শাস্তি ভোগের মেয়াদ শেষ হবে, তখন জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিয়ে জান্নাত দেওয়া হবে। বরং তারা প্রথমেই চিরকালের জন্য জান্নাতে চলে যাবে।
প্রশ্ন হতে পারে, হাদীছে যে গুণগুলোর কথা বলা হয়েছে সেগুণ যাদের মধ্যে থাকবে তারা যদি অন্যান্য পাপকর্মে লিপ্ত থাকে, তবুও বিনা হিসাবে জান্নাতে যাবে?
এর উত্তর হল, ব্যাপারটা এরকম হবে না। হাদীছে বর্ণিত চারটি গুণ যাদের মধ্যে থাকবে তারা অবশ্যই যাবতীয় পাপকর্ম থেকে মুক্ত থাকবে। কেননা ওই চারটি গুণ তাকওয়ার উচ্চতর স্তরের। যারা তাকওয়ার উচ্চতর স্তরে অধিষ্ঠিত থাকে, তারা সাধারণত কবীরা গুনাহ ও কঠিনতম পাপে লিপ্ত হয় না। কখনও শয়তানের প্ররোচনায় ও নফসের ধোঁকায় পড়ে কঠিন কোনও পাপ করে ফেললেও যথাশীঘ্র তাওবা করে নেয়। ফলে আল্লাহ তা'আলা তাদের ক্ষমা করে দেন এবং পাপমুক্ত হয়েই তারা কবরে যায়।
বিনা হিসাবে যারা জান্নাতে যাবে, এ হাদীছে তাদের সংখ্যা বলা হয়েছে সত্তর হাজার। অপর এক বর্ণনায় আছে, এ সত্তর হাজারের প্রত্যেকের সঙ্গে থাকবে আরও সত্তর হাজার। সে হিসেবে সত্তর হাজারকে সত্তর হাজার দ্বারা গুণ দিতে হবে। সুতরাং বিনা হিসাবে যারা জান্নাত লাভ করবে তাদের সর্বমোট সংখ্যা চারশ' নব্বই কোটি। আল্লাহ তা'আলা আমাদেরকেও তাদের অন্তর্ভুক্ত করুন।
যে তিনটি গুণ থাকলে বিনা হিসাবে জান্নাত লাভ হবে
বিনা হিসাবে জান্নাত লাভকারীদের প্রথম গুণ বলা হয়েছে- তারা ঝাড়ফুঁক করে না এবং অন্যকে দিয়ে ঝাড়ফুঁক করায় না।
ঝাড়ফুঁক করার অর্থ কোনওকিছু পড়ে অসুস্থ ব্যক্তির উপর দম করা, যেমন সূরা ফাতিহা পড়ে দম করা, সূরা নাস ও ফালাক পড়ে দম করা কিংবা হাদীছে বর্ণিত বিভিন্ন দু’আ পড়ে দম করা। একে 'রুকয়া' (رقية) বলে। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজে রুকয়া করেছেন এবং করার অনুমতিও দিয়েছেন। সাহাবায়ে কিরাম থেকেও তা করার কথা বর্ণিত আছে। এ হাদীছে দেখা যাচ্ছে যারা বিনা হিসাবে জান্নাতে যাবে তারা এটা করে না। তার মানে এটা করা বিনা হিসাবে জান্নাতে যাওয়ার পক্ষে বাধা। প্রশ্ন ওঠে, যে কাজ বিনা হিসাবে জান্নাতে যাওয়ার পক্ষে বাধা হয় তা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজে এবং সাহাবায়ে কিরাম কিভাবে করতেন? কিংবা প্রশ্নটি এভাবেও করা যায় যে কাজ তিনি নিজে এবং সাহাবায়ে কিরাম করতেন তা জান্নাতে যাওয়ার পক্ষে বাধা হয় কিভাবে?
‘উলামায়ে কিরাম এর বিভিন্ন উত্তর দিয়েছেন। সারকথা হল, রুকয়া তিন প্রকার।
ক. জাহিলী যুগের প্রচলিত রুকয়া। তখন এমনসব মন্ত্র পড়ে ঝাড়ফুঁক করা হত, যার অর্থ বোধগম্য ছিল না। এরূপ ঝাড়ফুঁক জায়েয নয়। কেননা হতে পারে তা শিরকী কথা। অথবা এমন কথা, পরিণামে যা শিরকীর দিকে গড়ায়।
খ. আল্লাহর কালাম বা আল্লাহর নাম দ্বারা ঝাড়ফুঁক করা। এটা নিঃসন্দেহে জায়েয।বরং যে ঝাড়ফুঁক নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণিত আছে, তা করা মুস্তাহাব।
গ. যে ঝাড়ফুঁক ফিরিশতা, ওলী-বুযুর্গ, 'আরশ প্রভৃতি মর্যাদাপূর্ণ মাখলুকের নামে করা হয়, এমনিতে তা করা নাজায়েয নয় বটে, তবে এর থেকে বিরত থাকাই শ্রেয়। কেননা এতে শিরকে লিপ্ত হয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকে।
এ হাদীছে বিনা হিসাবে জান্নাতে প্রবেশকারীদের বৈশিষ্ট্য হিসেবে যে ঝাড়ফুঁক না করার কথা বর্ণিত হয়েছে, তা দ্বারা প্রথম ও শেষ প্রকারের ঝাড়ফুঁক বোঝানো হয়েছে,দ্বিতীয় প্রকারের ঝাড়ফুঁক নয়।
এমনও হতে পারে যে, সর্বপ্রকার রুকয়াই এর অন্তর্ভুক্ত। সে ক্ষেত্রে বলা হবে এটা সর্বোচ্চ স্তরের তাওয়াক্কুলের বিষয়, যাদের অন্তরে আল্লাহর প্রতি এমন গভীর আস্থা আছে যে, আসবাব-উপকরণ গ্রহণ করা না করা উভয়ই তাদের পক্ষে সমান। অসুস্থ অবস্থায় যদি কোনও চিকিৎসা গ্রহণ না করে, তারপর দেখা যায় রোগ আরও বেড়ে গেছে, তখনও তাদের আস্থায় কোনও চিড় ধরে না। তারা মনে করে না যে, চিকিৎসা গ্রহণ করলে এ অবস্থা হত না, তার রোগ ভালো হয়ে যেত। মোটকথা আল্লাহ যখন যে হালে রাখেন তাতেই সন্তুষ্ট থাকে, কোনওরকম অভিযোগ-আপত্তিমূলক কথা মুখে তো উচ্চারণ করেই না, মনেও আসে না। হাদীছে এ শ্রেণির আওলিয়ার কথাই বলা হয়েছে।
বলাবাহুল্য, আম্বিয়া আলাইহিমুস-সালাম-এর তাওয়াক্কুল ছিল সর্বোচ্চ স্তরের। অধিকাংশ সাহাবায়ে কিরামের তাওয়াক্কুলও উচ্চ পর্যায়েরই ছিল। তা সত্ত্বেও যে তারা রুকয়া করেছেন, তা তাদের তাওয়াক্কুলের পরিপন্থি নয়। কেননা রুকয়া না করা অবস্থায় তাঁদের মনের যে হাল থাকত, রুকয়া করা অবস্থায়ও সেই একই হাল বিরাজ করত। আসবাব অবলম্বন করা না করায় তাঁদের তাওয়াক্কুলে কোনও প্রভেদ হত না। বরং তাঁদের রুকয়া বা আসবার অবলম্বন করা ছিল আল্লাহর প্রতি অধিকতর সমর্পিত থাকার আলামত। তা এভাবে যে, রোগ দিয়েছেন আল্লাহ। চিকিৎসার ব্যবস্থাও দিয়েছেন তিনিই। কাজেই অসুস্থ অবস্থায় ওষুধ খাওয়া বা রুকয়া করার দ্বারা প্রকারান্তরে তাঁর দিকে রুজু করাই হয়। এটাও নিজেকে তাঁর হাতে ছেড়ে দেওয়ার এক পন্থা। ওষুধে কী হবে না হবে সেটা কোনও কথা নয়। ওষুধ তাঁর দান। তাঁর দান গ্রহণ করাতেই বান্দার বন্দেগী। তাই দেখা যায় সমস্ত নবী-রাসূল আসবাব-উপকরণ গ্রহণ করেছেন। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজে রুকয়া করেছেন এবং তাঁর সুন্নতের অনুসরণে সাহাবায়ে কিরামও তা করেছেন। আমাদেরও কর্তব্য তাঁদের পদাঙ্ক অনুসরণ করা।
তাঁদের পদাঙ্ক অনুসরণ করার ভেতরই আমাদের দীন ও ঈমানের নিরাপত্তা। আমাদের তাওয়াক্কুল তাঁদের পর্যায়ে না হলেও এ দৃষ্টিকোণ থেকে আসবাব-উপকরণ গ্রহণ করা নিরাপদ যে, তা গ্রহণ না করলে আমাদের তাওয়াক্কুল ঝুঁকিতে পড়ে যেতে পারে। ঈমানের দুর্বলতার কারণে হয়তো বলে বসব- যথাসময়ে ওষুধ খেলে আমার এ অবস্থা হত না অথবা অমুক উপায় অবলম্বন করলে আমার এ দশা ঘটত না। সর্বাবস্থায় আল্লাহর ফয়সালা খুশিমনে মেনে নেওয়ার মত দৃঢ় ঈমান না থাকা অবস্থায় আসবাব-উপকরণ পরিত্যাগ করা কিছুতেই উচিত নয়। কেননা সে ক্ষেত্রে প্রতিকূল পরিস্থিতি ঈমানের পক্ষে বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। তবে ঝাড়ফুঁক ও তাবিজ-কবজ গ্রহণকালে অবশ্যই লক্ষ রাখতে হবে যেন তা নাজায়েয কিসিমের রুকয়া না হয়। যদি কুরআনের আয়াত, আল্লাহর নাম বা হাদীছের দু'আ দ্বারা রুকয়া করা হয়, তবে তা আলোচ্য হাদীছের পরিপন্থি হবে না এবং তা বিনা হিসাবে জান্নাত লাভের পক্ষেও বাধা হবে না ইনশাআল্লাহ।
অশুভ লক্ষণ প্রসঙ্গ
বিনা হিসাবে জান্নাত লাভকারীদের দ্বিতীয় গুণ- তারা কোনওকিছুকে অশুভ লক্ষণ মনে করে না। হাদীছের শব্দ হল لا يتطيرون । এর মূল শব্দ طير, যার অর্থ পাখি। জাহিলী যুগে মানুষ বিশেষ কোনও কাজ করার সময় বা কোনওদিকে যাত্রাকালে পাখির দিকে লক্ষ করত। যদি দেখত পাখি ডানদিকে উড়ে গেছে, তবে তাকে শুভলক্ষণ মনে করত এবং কাজটি সম্পন্ন করত। আর যদি বামদিকে উড়ত, তবে অশুভলক্ষণ মনে করত এবং সে কাজ থেকে বিরত থাকত। অনেক সময় তারা ইচ্ছাকৃতই পাখি উড়াত এবং লক্ষ করত সেটি ডানে যাচ্ছে না বামে। আর সে হিসেবে কাজ করা বা না করার ফয়সালা নিত। ইসলাম এটাকে নিষিদ্ধ করেছে। কেননা এটা মূর্খতা। পাখির ডানে বামে উড়ার সাথে শুভ-অশুভের কী সম্পর্ক? এটা একটা কুসংস্কার। ইসলাম কুসংস্কারকে প্রশ্রয় দেয় না। তাছাড়া এটা তাওয়াক্কুলেরও পরিপন্থি। শুভ-অশুভ আল্লাহর হাতে। হবে সেটাই, যা তিনি চান। পাখির উড়ায় কিছু হবে না। এর প্রতি বিশ্বাস রাখা শিরকও বটে। এটা আল্লাহর একচ্ছত্র ক্ষমতায় অন্যকে অংশীদার বানানোর নামান্তর। সুতরাং এর থেকে বেঁচে থাকা অবশ্যকর্তব্য। এরকম আরও যত কুসংস্কার আছে, যেমন কাকের ডাককে কোনও বিপদের সংকেত মনে করা, যাত্রাকালে ঝাড়ু দেখলে যাত্রা অশুভ মনে করা, যাত্রাকালে কেউ হাঁচি দিলে তাকে বিপদসংকেত মনে করা ইত্যাদি, এসবই অবশ্যই পরিত্যাজ্য। ইসলামে এসব কুসংস্কারের কোনও স্থান নেই। এ জাতীয় ধারণা কঠিন পাপ।
আল্লাহর প্রতি তাওয়াক্কুল
সর্বশেষ গুণ আল্লাহর প্রতি তাওয়াক্কুল। বিনা হিসাবে জান্নাতে যাবে সে সকল লোক, যারা সর্বাবস্থায় আল্লাহর প্রতি ভরসা রাখে। তারা তাওয়াক্কুলের সর্বোচ্চ স্তরে থাকার কারণে হয় আসবাব-উপকরণ গ্রহণই করে না, অথবা তা গ্রহণ করলেও বিন্দুমাত্র তার প্রতি ভরসা থাকে না। মনেপ্রাণে ভরসা আল্লাহরই উপর থাকে। ফলে আসবাব উপকরণের প্রত্যাশিত ফল না পেলে আশাহত হয় না ও আক্ষেপ করে না। বরং ফলাফল যাই হয়, তাকে আল্লাহর ফয়সালা মনে করে পুরোপুরি সন্তুষ্ট থাকে এবং নিজ পসন্দের উপর আল্লাহর পসন্দকে প্রাধান্য দেয়।
হযরত ‘উক্কাশা ইব্ন মিহসান রাযি.
হযরত উক্কাশা ইব্ন মিহসান রাযি. যখন জানতে পারলেন উল্লিখিত তিনগুণ বিশিষ্ট মু'মিনগণ বিনা হিসাবে জান্নাত লাভ করবে, তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামকে অনুরোধ করলেন যেন তার জন্য দু'আ করেন, যাতে আল্লাহ তা'আলা তাকে তাদের অন্তর্ভুক্ত করেন। তিনি তার জন্য দু'আ করলেন এবং বললেন, তুমিও তাদের একজন।
হযরত উক্কাশা রাযি. বনূ আসাদ গোত্রের একজন বিশিষ্ট সাহাবী। তিনি একজন সুদর্শন ও বীরপুরুষ ছিলেন। ছিলেন আরবের একজন শ্রেষ্ঠ অশ্বারোহী যোদ্ধা। নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর সম্পর্কে বলেন, আরবের শ্রেষ্ঠ অশ্বারোহী আমাদেরই একজন। সাহাবায়ে কিরাম জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! তিনি কে? তিনি বললেন, 'উক্কাশা ইব্ন মিহসান। বদর যুদ্ধে তাঁর বীরত্বের ঘটনা সুপ্রসিদ্ধ। এ যুদ্ধে তাঁর তরবারি ভেঙে গিয়েছিল। নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর হাতে একটি কাঠের টুকরা প্রদান করেন। তিনি সেটি নাড়া দিলে ধারালো তরবারিতে পরিণত হয়ে যায়। তিনি সেটি দ্বারা যুদ্ধ করতে থাকেন। আল্লাহ তা'আলা এ যুদ্ধে মুমিনদের জয়যুক্ত করেন। তরবারিটির নাম দেওয়া হয়েছিল 'আওন' (সাহায্য)। অর্থাৎ এর দ্বারা আল্লাহ তা'আলা সাহাবীগণকে সাহায্য করেছিলেন। তরবারিটি মৃত্যু পর্যন্ত তাঁর কাছে থাকে। এর দ্বারা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে থেকে বহু যুদ্ধে লড়াই করেছিলেন। তিনি হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি.-এর যমানায় ভণ্ড নবী তুলায়হা ইব্ন খুওয়াইলিদ আল-আসাদীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন। সে যুদ্ধেও তিনি এ তরবারি ব্যবহার করেন। তিনি তুলায়হার হাতে শাহাদাত বরণ করেন। নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওফাতকালে তাঁর বয়স ছিল ৪৪ বছর।
হযরত উক্কাশা রাযি.-এর দেখাদেখি আরও এক সাহাবী যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দু'আ করতে অনুরোধ করলেন যে, আল্লাহ তা'আলা তাকেও যেন উল্লিখিত গুণবিশিষ্ট লোকদের অন্তর্ভুক্ত করেন, যারা বিনা হিসাবে জান্নাত লাভ করবে, তখন তিনি বললেন, 'উক্কাশা তোমার অগ্রবর্তী হয়ে গেছে। সম্ভবত তিনি ওহী মারফত জানতে পেরেছিলেন যে, উক্কাশা রাযি, তাদের অন্তর্ভূক্ত। আর দ্বিতীয় ব্যক্তি সম্পর্কে তাঁকে কিছু জানানো হয়নি। কাজেই তিনি যে তাদের অন্তর্ভুক্ত নন, এ কথা নিশ্চিত করে বলা যাবে না। বিশেষত তিনি যখন একজন সাহাবী আর সাহাবায়ে কিরাম সম্পর্কে আল্লাহ তা'আলা তাঁদের জীবদ্দশায়ই নিজ সন্তুষ্টির কথা জানিয়ে দিয়েছেন, তখন তাঁদের প্রত্যেকের ব্যাপারেই জান্নাতবাসী হওয়ার প্রবল আশা রয়েছে।
ওই সাহাবী সম্পর্কে তখন ওহী মারফত জান্নাতবাসী হওয়ার কথা না জানানোর কারণ এই হয়ে থাকবে যে, তখন যদি বলা হত তুমিও তাদের একজন, তাহলে একের পর এক দু'আর আবেদন চলতে থাকত আর তাঁকে বলতে হত তুমিও তাদের একজন। এক তো এটা নবুওয়াতী দায়িত্বের বিষয় নয় যে, প্রত্যেককে জান্নাতবাসী হওয়ার সুসংবাদ দিয়ে দেওয়া হবে। নবীর কাজ কেবল জান্নাতের পথ দেখিয়ে দেওয়া আর উম্মতের কাজ সে পথে চলে জান্নাত লাভের চেষ্টা করা। দ্বিতীয়ত ওরকম বলতে থাকলে তা কতক্ষণ বলা যেত? একের পর একজন দাঁড়িয়ে অনুরোধ জানাতে থাকত। কখনও এ সিলসিলা শেষ হত না। তাই তখন ক্ষান্ত করে দেওয়াই সমীচীন ছিল।
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম উত্তর দিয়েছেন 'উক্কাশা তোমার অগ্রবর্তী হয়ে গেছে। এমন বলেননি যে, তুমি তাদের অন্তর্ভুক্ত নও। এ কথা বললে তাঁর অন্তরে আঘাত লাগত এবং হতাশার সৃষ্টি হত। কাউকে হতাশ করা ঠিক নয়। কারও অন্তরে আঘাত দিয়ে কথা বলাও তাঁর চরিত্র ছিল না। এর দ্বারা জানা গেল যে, কারও প্রশ্নের উত্তর এমন নম্র-কোমল ভাষায় ও যৌক্তিক পন্থায় দেওয়া উচিত, যাতে প্রশ্নকর্তার মনে আঘাত না লাগে এবং সে সন্তুষ্ট হতে পারে।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. এ হাদীছের প্রধান বিষয় আল্লাহর প্রতি তাওয়াক্কুল ও নির্ভরতা। বান্দার উচিত সকল কাজে আল্লাহরই উপর নির্ভর করা, আসবাব-উপকরণের উপর নয়।
খ. প্রত্যেকের উচিত বিনা হিসাবে জান্নাত লাভের জন্য আশাবাদী হওয়া এবং সেজন্য শরী'আত নির্দেশিত পন্থা শক্তভাবে আঁকড়ে ধরা।
গ. দীনী কাজে ইখলাসের সঙ্গে মেহনত করে যাওয়াই আমাদের কাজ। ফলাফল আল্লাহর উপর ন্যস্ত করা উচিত। তা একান্তই আল্লাহর কাজ। কাঙ্ক্ষিত ফল দেখতে না পাওয়ার অর্থ মেহনত ব্যর্থ যাওয়া নয়। মেহনতের পরকালীন পুরস্কার অবশ্যই পাওয়া যাবে।
ঘ. অবৈধ ঝাড়ফুঁক ও তাবিজ-তুমার থেকে অবশ্যই বেঁচে থাকতে হবে। বৈধ রুকয়া ও চিকিৎসা করাতে কোনও দোষ নেই। তা তাওয়াক্কুলেরও পরিপন্থি নয়।
এ হাদীছ দ্বারা জানা যায় প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের উম্মতসংখ্যা সবচে' বেশি। এর আগে যত নবী-রাসূল দুনিয়ায় এসেছেন, তাঁদের কারও উম্মতসংখ্যাই তাঁর উম্মতের সমান নয়। এখানে সর্বপ্রথম যে নবীর উল্লেখ করা হয়েছে তাঁর সঙ্গে ছিল একটি ক্ষুদ্র দল। শব্দ বলা হয়েছে 'রুহাইত' (رهيط)। এটি 'রাহত' (رهط)-এর তাসগীর (ক্ষুদ্রতাজ্ঞাপক রূপ)। এর দ্বারা তিন থেকে নয় পর্যন্ত সংখ্যাকে বোঝায়।
কোনও নবীর সঙ্গে ছিল এক-দুইজন লোক এবং কোনও নবীর সঙ্গে একজনও নয়। এ সকল নবী কে কে ছিলেন তা উল্লেখ করা হয়নি। শুধু হযরত মূসা আ.-এরই নাম বলা হয়েছে যে, তাঁর সাথে মোটামুটি একটা বড় দল ছিল। অন্যান্য নবীদের উম্মতের সংখ্যা কম হওয়ার মানে তাঁদের ডাকে অল্প লোকই সাড়া দিয়েছিল। আবার কোনও নবী এমন ছিলেন, যাঁর ডাকে কেউ সাড়া দেয়নি। ফলে তাঁর সঙ্গে কেউ ছিল না।
দীনী কাজে সফলতা ও ব্যর্থতার মাপকাঠি
এখানে কারও মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, যাঁর ডাকে কেউ সাড়া দেয়নি তাঁর দা'ওয়াতী মেহনত কি ব্যর্থ হয়েছে? কিংবা যাঁর ডাকে অল্পসংখ্যক লোক সাড়া দিয়েছে, তাঁর সফলতা কি কম?
না, তাঁদের কারওই মেহনত ব্যর্থ হয়নি এবং কেউই অসফল বা অল্প সফল হননি। তাঁদের প্রত্যেকেই পুরোপুরি সফল, তাতে কেউ সাড়া দিক বা না দিক। কেননা সফলতা ও ব্যর্থতা পার্থিব ফলাফলের উপর নির্ভর করে না। কার ডাকে বেশি লোক সাড়া দিয়েছে এবং কার ডাকে কম, সেটা বিবেচ্য বিষয় নয়। এর দ্বারা সফলতা-ব্যর্থতা নিরূপিত হয় না। দীনী কাজে সফলতা-অসফলতা নির্ভর করে কে কতটুকু ইখলাসের সাথে সঠিক পদ্ধতিতে কাজ করল তার উপর। যার কাজ যতবেশি ইখলাসভিত্তিক ও শুদ্ধ-সঠিক হবে সে ততবেশি সফল, তাতে পার্থিব ফলাফল যাই হোক না কেন। নবীদের কাজ ছিল আল্লাহর হুকুম মানুষের কাছে পৌঁছানো ও মানুষকে আল্লাহর দিকে ডাকা। তাঁরা এ দায়িত্ব পরিপূর্ণভাবে আদায় করেছিলেন। শতভাগ ইখলাসের সঙ্গে করেছিলেন। তাঁরা মানুষের কাছে কোনওরকম বিনিময় আশা করেননি। তাঁদের যা-কিছু চাওয়া-পাওয়ার, সবই ছিল আল্লাহর কাছে। তাঁদের একজনও আপন দায়িত্ব পালনে বিন্দুমাত্র ত্রুটি করেননি। সাড়া দেওয়া না দেওয়া যাকে দাওয়াত দেওয়া হয়েছে তার কাজ। সাড়া দিলে সে সফল, না দিলে ব্যর্থ। তার ব্যর্থতা কেবল তারই। তা নবীকে স্পর্শ করে না। সে সাড়া না দিয়ে ব্যর্থ হয়েছে বলে নবীও ব্যর্থ হয়ে যাবেন এমন কোনও কথা নেই। সুতরাং সকল নবীই সফল, যেহেতু তাঁদের সকলেই পরিপূর্ণভাবে নবুওয়াতী দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
এর দ্বারা দীনী দাওয়াতের অঙ্গনে যারা কাজ করে তারা শিক্ষা নিতে পারে। তাদেরও কাজ কেবল দা'ওয়াত দিয়ে যাওয়া। তাদের কোনও ব্যর্থতা নেই, যদি ইখলাসের সাথে সঠিক পদ্ধতিতে কাজ করে থাকে। তাদের ডাকে একজনও যদি সাড়া না দেয়, তাতে তাদের দমে যাওয়ার কারণ নেই। যথার্থভাবে কাজ করতে পারাটাই সফলতা। যদি তা করে থাকে, তবে সে সফল। তার কর্তব্য সেজন্য শোকর আদায় করা।
হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিশ্বনবী
সবশেষে নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের সামনে তাঁর নিজ উম্মতকে তুলে ধরা হয়। তাঁকে তাদের দেখানো হয় আকাশের দুই প্রান্তে। হযরত মূসা আ.-এর উম্মতকেও একই স্থানে দেখানো হয়, যদিও তাঁর উম্মতের সংখ্যা আখেরী উম্মত ছাড়া অন্যান্য নবীদের উম্মত অপেক্ষা বেশি ছিল। কিন্তু এ উম্মতকে দেখানো হয় আকাশের দুই দিকে। দুই দিগন্তে। খুব সম্ভব এর দ্বারা ইঙ্গিত করা হয়েছে অন্যান্য নবীর মত আমাদের নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুওয়াত পৃথিবীর কোনও এক স্থানের জন্য সীমাবদ্ধ নয়। তিনি জাতিবিশেষের নবী নন। তিনি আরব-অনারব, পূর্ব-পশ্চিম নির্বিশেষে সারা পৃথিবীর সকলের নবী। ইরশাদ হয়েছে–
وَمَا أَرْسَلْنَاكَ إِلَّا كَافَّةً لِلنَّاسِ بَشِيرًا وَنَذِيرًا وَلَكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لَا يَعْلَمُونَ
অর্থ এবং (হে নবী!) আমি তোমাকে সমস্ত মানুষের জন্য একজন সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপেই পাঠিয়েছি, কিন্তু অধিকাংশ মানুষ বুঝছে না। (সূরা সাবা, আয়াত ২৮)
অপর এক আয়াতে আছে–
قُلْ يَاأَيُّهَا النَّاسُ إِنِّي رَسُولُ اللَّهِ إِلَيْكُمْ جَمِيعًا
অর্থঃ বল, হে মানুষ! আমি তোমাদের সকলের নিকট আল্লাহর প্রেরিত রাসূল। (সূরা আ'রাফ, আয়াত ১৫৮)
এ হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম জানান, তাঁর উম্মতের সত্তর হাজার লোক বিনা হিসাবে ও বিনা আযাবে জান্নাতে যাবে। হাশরের ময়দানে তাদের ইহজীবনের কাজকর্মের কোনও হিসাব নেওয়া হবে না। তারা সরাসরি জান্নাতে চলে যাবে। এমন হবে না যে, পাপকর্মের শাস্তি ভোগের জন্য প্রথমে তাদের জাহান্নামে দেওয়া হবে। তারপর যখন শাস্তি ভোগের মেয়াদ শেষ হবে, তখন জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিয়ে জান্নাত দেওয়া হবে। বরং তারা প্রথমেই চিরকালের জন্য জান্নাতে চলে যাবে।
প্রশ্ন হতে পারে, হাদীছে যে গুণগুলোর কথা বলা হয়েছে সেগুণ যাদের মধ্যে থাকবে তারা যদি অন্যান্য পাপকর্মে লিপ্ত থাকে, তবুও বিনা হিসাবে জান্নাতে যাবে?
এর উত্তর হল, ব্যাপারটা এরকম হবে না। হাদীছে বর্ণিত চারটি গুণ যাদের মধ্যে থাকবে তারা অবশ্যই যাবতীয় পাপকর্ম থেকে মুক্ত থাকবে। কেননা ওই চারটি গুণ তাকওয়ার উচ্চতর স্তরের। যারা তাকওয়ার উচ্চতর স্তরে অধিষ্ঠিত থাকে, তারা সাধারণত কবীরা গুনাহ ও কঠিনতম পাপে লিপ্ত হয় না। কখনও শয়তানের প্ররোচনায় ও নফসের ধোঁকায় পড়ে কঠিন কোনও পাপ করে ফেললেও যথাশীঘ্র তাওবা করে নেয়। ফলে আল্লাহ তা'আলা তাদের ক্ষমা করে দেন এবং পাপমুক্ত হয়েই তারা কবরে যায়।
বিনা হিসাবে যারা জান্নাতে যাবে, এ হাদীছে তাদের সংখ্যা বলা হয়েছে সত্তর হাজার। অপর এক বর্ণনায় আছে, এ সত্তর হাজারের প্রত্যেকের সঙ্গে থাকবে আরও সত্তর হাজার। সে হিসেবে সত্তর হাজারকে সত্তর হাজার দ্বারা গুণ দিতে হবে। সুতরাং বিনা হিসাবে যারা জান্নাত লাভ করবে তাদের সর্বমোট সংখ্যা চারশ' নব্বই কোটি। আল্লাহ তা'আলা আমাদেরকেও তাদের অন্তর্ভুক্ত করুন।
যে তিনটি গুণ থাকলে বিনা হিসাবে জান্নাত লাভ হবে
বিনা হিসাবে জান্নাত লাভকারীদের প্রথম গুণ বলা হয়েছে- তারা ঝাড়ফুঁক করে না এবং অন্যকে দিয়ে ঝাড়ফুঁক করায় না।
ঝাড়ফুঁক করার অর্থ কোনওকিছু পড়ে অসুস্থ ব্যক্তির উপর দম করা, যেমন সূরা ফাতিহা পড়ে দম করা, সূরা নাস ও ফালাক পড়ে দম করা কিংবা হাদীছে বর্ণিত বিভিন্ন দু’আ পড়ে দম করা। একে 'রুকয়া' (رقية) বলে। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজে রুকয়া করেছেন এবং করার অনুমতিও দিয়েছেন। সাহাবায়ে কিরাম থেকেও তা করার কথা বর্ণিত আছে। এ হাদীছে দেখা যাচ্ছে যারা বিনা হিসাবে জান্নাতে যাবে তারা এটা করে না। তার মানে এটা করা বিনা হিসাবে জান্নাতে যাওয়ার পক্ষে বাধা। প্রশ্ন ওঠে, যে কাজ বিনা হিসাবে জান্নাতে যাওয়ার পক্ষে বাধা হয় তা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজে এবং সাহাবায়ে কিরাম কিভাবে করতেন? কিংবা প্রশ্নটি এভাবেও করা যায় যে কাজ তিনি নিজে এবং সাহাবায়ে কিরাম করতেন তা জান্নাতে যাওয়ার পক্ষে বাধা হয় কিভাবে?
‘উলামায়ে কিরাম এর বিভিন্ন উত্তর দিয়েছেন। সারকথা হল, রুকয়া তিন প্রকার।
ক. জাহিলী যুগের প্রচলিত রুকয়া। তখন এমনসব মন্ত্র পড়ে ঝাড়ফুঁক করা হত, যার অর্থ বোধগম্য ছিল না। এরূপ ঝাড়ফুঁক জায়েয নয়। কেননা হতে পারে তা শিরকী কথা। অথবা এমন কথা, পরিণামে যা শিরকীর দিকে গড়ায়।
খ. আল্লাহর কালাম বা আল্লাহর নাম দ্বারা ঝাড়ফুঁক করা। এটা নিঃসন্দেহে জায়েয।বরং যে ঝাড়ফুঁক নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণিত আছে, তা করা মুস্তাহাব।
গ. যে ঝাড়ফুঁক ফিরিশতা, ওলী-বুযুর্গ, 'আরশ প্রভৃতি মর্যাদাপূর্ণ মাখলুকের নামে করা হয়, এমনিতে তা করা নাজায়েয নয় বটে, তবে এর থেকে বিরত থাকাই শ্রেয়। কেননা এতে শিরকে লিপ্ত হয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকে।
এ হাদীছে বিনা হিসাবে জান্নাতে প্রবেশকারীদের বৈশিষ্ট্য হিসেবে যে ঝাড়ফুঁক না করার কথা বর্ণিত হয়েছে, তা দ্বারা প্রথম ও শেষ প্রকারের ঝাড়ফুঁক বোঝানো হয়েছে,দ্বিতীয় প্রকারের ঝাড়ফুঁক নয়।
এমনও হতে পারে যে, সর্বপ্রকার রুকয়াই এর অন্তর্ভুক্ত। সে ক্ষেত্রে বলা হবে এটা সর্বোচ্চ স্তরের তাওয়াক্কুলের বিষয়, যাদের অন্তরে আল্লাহর প্রতি এমন গভীর আস্থা আছে যে, আসবাব-উপকরণ গ্রহণ করা না করা উভয়ই তাদের পক্ষে সমান। অসুস্থ অবস্থায় যদি কোনও চিকিৎসা গ্রহণ না করে, তারপর দেখা যায় রোগ আরও বেড়ে গেছে, তখনও তাদের আস্থায় কোনও চিড় ধরে না। তারা মনে করে না যে, চিকিৎসা গ্রহণ করলে এ অবস্থা হত না, তার রোগ ভালো হয়ে যেত। মোটকথা আল্লাহ যখন যে হালে রাখেন তাতেই সন্তুষ্ট থাকে, কোনওরকম অভিযোগ-আপত্তিমূলক কথা মুখে তো উচ্চারণ করেই না, মনেও আসে না। হাদীছে এ শ্রেণির আওলিয়ার কথাই বলা হয়েছে।
বলাবাহুল্য, আম্বিয়া আলাইহিমুস-সালাম-এর তাওয়াক্কুল ছিল সর্বোচ্চ স্তরের। অধিকাংশ সাহাবায়ে কিরামের তাওয়াক্কুলও উচ্চ পর্যায়েরই ছিল। তা সত্ত্বেও যে তারা রুকয়া করেছেন, তা তাদের তাওয়াক্কুলের পরিপন্থি নয়। কেননা রুকয়া না করা অবস্থায় তাঁদের মনের যে হাল থাকত, রুকয়া করা অবস্থায়ও সেই একই হাল বিরাজ করত। আসবাব অবলম্বন করা না করায় তাঁদের তাওয়াক্কুলে কোনও প্রভেদ হত না। বরং তাঁদের রুকয়া বা আসবার অবলম্বন করা ছিল আল্লাহর প্রতি অধিকতর সমর্পিত থাকার আলামত। তা এভাবে যে, রোগ দিয়েছেন আল্লাহ। চিকিৎসার ব্যবস্থাও দিয়েছেন তিনিই। কাজেই অসুস্থ অবস্থায় ওষুধ খাওয়া বা রুকয়া করার দ্বারা প্রকারান্তরে তাঁর দিকে রুজু করাই হয়। এটাও নিজেকে তাঁর হাতে ছেড়ে দেওয়ার এক পন্থা। ওষুধে কী হবে না হবে সেটা কোনও কথা নয়। ওষুধ তাঁর দান। তাঁর দান গ্রহণ করাতেই বান্দার বন্দেগী। তাই দেখা যায় সমস্ত নবী-রাসূল আসবাব-উপকরণ গ্রহণ করেছেন। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজে রুকয়া করেছেন এবং তাঁর সুন্নতের অনুসরণে সাহাবায়ে কিরামও তা করেছেন। আমাদেরও কর্তব্য তাঁদের পদাঙ্ক অনুসরণ করা।
তাঁদের পদাঙ্ক অনুসরণ করার ভেতরই আমাদের দীন ও ঈমানের নিরাপত্তা। আমাদের তাওয়াক্কুল তাঁদের পর্যায়ে না হলেও এ দৃষ্টিকোণ থেকে আসবাব-উপকরণ গ্রহণ করা নিরাপদ যে, তা গ্রহণ না করলে আমাদের তাওয়াক্কুল ঝুঁকিতে পড়ে যেতে পারে। ঈমানের দুর্বলতার কারণে হয়তো বলে বসব- যথাসময়ে ওষুধ খেলে আমার এ অবস্থা হত না অথবা অমুক উপায় অবলম্বন করলে আমার এ দশা ঘটত না। সর্বাবস্থায় আল্লাহর ফয়সালা খুশিমনে মেনে নেওয়ার মত দৃঢ় ঈমান না থাকা অবস্থায় আসবাব-উপকরণ পরিত্যাগ করা কিছুতেই উচিত নয়। কেননা সে ক্ষেত্রে প্রতিকূল পরিস্থিতি ঈমানের পক্ষে বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। তবে ঝাড়ফুঁক ও তাবিজ-কবজ গ্রহণকালে অবশ্যই লক্ষ রাখতে হবে যেন তা নাজায়েয কিসিমের রুকয়া না হয়। যদি কুরআনের আয়াত, আল্লাহর নাম বা হাদীছের দু'আ দ্বারা রুকয়া করা হয়, তবে তা আলোচ্য হাদীছের পরিপন্থি হবে না এবং তা বিনা হিসাবে জান্নাত লাভের পক্ষেও বাধা হবে না ইনশাআল্লাহ।
অশুভ লক্ষণ প্রসঙ্গ
বিনা হিসাবে জান্নাত লাভকারীদের দ্বিতীয় গুণ- তারা কোনওকিছুকে অশুভ লক্ষণ মনে করে না। হাদীছের শব্দ হল لا يتطيرون । এর মূল শব্দ طير, যার অর্থ পাখি। জাহিলী যুগে মানুষ বিশেষ কোনও কাজ করার সময় বা কোনওদিকে যাত্রাকালে পাখির দিকে লক্ষ করত। যদি দেখত পাখি ডানদিকে উড়ে গেছে, তবে তাকে শুভলক্ষণ মনে করত এবং কাজটি সম্পন্ন করত। আর যদি বামদিকে উড়ত, তবে অশুভলক্ষণ মনে করত এবং সে কাজ থেকে বিরত থাকত। অনেক সময় তারা ইচ্ছাকৃতই পাখি উড়াত এবং লক্ষ করত সেটি ডানে যাচ্ছে না বামে। আর সে হিসেবে কাজ করা বা না করার ফয়সালা নিত। ইসলাম এটাকে নিষিদ্ধ করেছে। কেননা এটা মূর্খতা। পাখির ডানে বামে উড়ার সাথে শুভ-অশুভের কী সম্পর্ক? এটা একটা কুসংস্কার। ইসলাম কুসংস্কারকে প্রশ্রয় দেয় না। তাছাড়া এটা তাওয়াক্কুলেরও পরিপন্থি। শুভ-অশুভ আল্লাহর হাতে। হবে সেটাই, যা তিনি চান। পাখির উড়ায় কিছু হবে না। এর প্রতি বিশ্বাস রাখা শিরকও বটে। এটা আল্লাহর একচ্ছত্র ক্ষমতায় অন্যকে অংশীদার বানানোর নামান্তর। সুতরাং এর থেকে বেঁচে থাকা অবশ্যকর্তব্য। এরকম আরও যত কুসংস্কার আছে, যেমন কাকের ডাককে কোনও বিপদের সংকেত মনে করা, যাত্রাকালে ঝাড়ু দেখলে যাত্রা অশুভ মনে করা, যাত্রাকালে কেউ হাঁচি দিলে তাকে বিপদসংকেত মনে করা ইত্যাদি, এসবই অবশ্যই পরিত্যাজ্য। ইসলামে এসব কুসংস্কারের কোনও স্থান নেই। এ জাতীয় ধারণা কঠিন পাপ।
আল্লাহর প্রতি তাওয়াক্কুল
সর্বশেষ গুণ আল্লাহর প্রতি তাওয়াক্কুল। বিনা হিসাবে জান্নাতে যাবে সে সকল লোক, যারা সর্বাবস্থায় আল্লাহর প্রতি ভরসা রাখে। তারা তাওয়াক্কুলের সর্বোচ্চ স্তরে থাকার কারণে হয় আসবাব-উপকরণ গ্রহণই করে না, অথবা তা গ্রহণ করলেও বিন্দুমাত্র তার প্রতি ভরসা থাকে না। মনেপ্রাণে ভরসা আল্লাহরই উপর থাকে। ফলে আসবাব উপকরণের প্রত্যাশিত ফল না পেলে আশাহত হয় না ও আক্ষেপ করে না। বরং ফলাফল যাই হয়, তাকে আল্লাহর ফয়সালা মনে করে পুরোপুরি সন্তুষ্ট থাকে এবং নিজ পসন্দের উপর আল্লাহর পসন্দকে প্রাধান্য দেয়।
হযরত ‘উক্কাশা ইব্ন মিহসান রাযি.
হযরত উক্কাশা ইব্ন মিহসান রাযি. যখন জানতে পারলেন উল্লিখিত তিনগুণ বিশিষ্ট মু'মিনগণ বিনা হিসাবে জান্নাত লাভ করবে, তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামকে অনুরোধ করলেন যেন তার জন্য দু'আ করেন, যাতে আল্লাহ তা'আলা তাকে তাদের অন্তর্ভুক্ত করেন। তিনি তার জন্য দু'আ করলেন এবং বললেন, তুমিও তাদের একজন।
হযরত উক্কাশা রাযি. বনূ আসাদ গোত্রের একজন বিশিষ্ট সাহাবী। তিনি একজন সুদর্শন ও বীরপুরুষ ছিলেন। ছিলেন আরবের একজন শ্রেষ্ঠ অশ্বারোহী যোদ্ধা। নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর সম্পর্কে বলেন, আরবের শ্রেষ্ঠ অশ্বারোহী আমাদেরই একজন। সাহাবায়ে কিরাম জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! তিনি কে? তিনি বললেন, 'উক্কাশা ইব্ন মিহসান। বদর যুদ্ধে তাঁর বীরত্বের ঘটনা সুপ্রসিদ্ধ। এ যুদ্ধে তাঁর তরবারি ভেঙে গিয়েছিল। নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর হাতে একটি কাঠের টুকরা প্রদান করেন। তিনি সেটি নাড়া দিলে ধারালো তরবারিতে পরিণত হয়ে যায়। তিনি সেটি দ্বারা যুদ্ধ করতে থাকেন। আল্লাহ তা'আলা এ যুদ্ধে মুমিনদের জয়যুক্ত করেন। তরবারিটির নাম দেওয়া হয়েছিল 'আওন' (সাহায্য)। অর্থাৎ এর দ্বারা আল্লাহ তা'আলা সাহাবীগণকে সাহায্য করেছিলেন। তরবারিটি মৃত্যু পর্যন্ত তাঁর কাছে থাকে। এর দ্বারা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে থেকে বহু যুদ্ধে লড়াই করেছিলেন। তিনি হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি.-এর যমানায় ভণ্ড নবী তুলায়হা ইব্ন খুওয়াইলিদ আল-আসাদীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন। সে যুদ্ধেও তিনি এ তরবারি ব্যবহার করেন। তিনি তুলায়হার হাতে শাহাদাত বরণ করেন। নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওফাতকালে তাঁর বয়স ছিল ৪৪ বছর।
হযরত উক্কাশা রাযি.-এর দেখাদেখি আরও এক সাহাবী যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দু'আ করতে অনুরোধ করলেন যে, আল্লাহ তা'আলা তাকেও যেন উল্লিখিত গুণবিশিষ্ট লোকদের অন্তর্ভুক্ত করেন, যারা বিনা হিসাবে জান্নাত লাভ করবে, তখন তিনি বললেন, 'উক্কাশা তোমার অগ্রবর্তী হয়ে গেছে। সম্ভবত তিনি ওহী মারফত জানতে পেরেছিলেন যে, উক্কাশা রাযি, তাদের অন্তর্ভূক্ত। আর দ্বিতীয় ব্যক্তি সম্পর্কে তাঁকে কিছু জানানো হয়নি। কাজেই তিনি যে তাদের অন্তর্ভুক্ত নন, এ কথা নিশ্চিত করে বলা যাবে না। বিশেষত তিনি যখন একজন সাহাবী আর সাহাবায়ে কিরাম সম্পর্কে আল্লাহ তা'আলা তাঁদের জীবদ্দশায়ই নিজ সন্তুষ্টির কথা জানিয়ে দিয়েছেন, তখন তাঁদের প্রত্যেকের ব্যাপারেই জান্নাতবাসী হওয়ার প্রবল আশা রয়েছে।
ওই সাহাবী সম্পর্কে তখন ওহী মারফত জান্নাতবাসী হওয়ার কথা না জানানোর কারণ এই হয়ে থাকবে যে, তখন যদি বলা হত তুমিও তাদের একজন, তাহলে একের পর এক দু'আর আবেদন চলতে থাকত আর তাঁকে বলতে হত তুমিও তাদের একজন। এক তো এটা নবুওয়াতী দায়িত্বের বিষয় নয় যে, প্রত্যেককে জান্নাতবাসী হওয়ার সুসংবাদ দিয়ে দেওয়া হবে। নবীর কাজ কেবল জান্নাতের পথ দেখিয়ে দেওয়া আর উম্মতের কাজ সে পথে চলে জান্নাত লাভের চেষ্টা করা। দ্বিতীয়ত ওরকম বলতে থাকলে তা কতক্ষণ বলা যেত? একের পর একজন দাঁড়িয়ে অনুরোধ জানাতে থাকত। কখনও এ সিলসিলা শেষ হত না। তাই তখন ক্ষান্ত করে দেওয়াই সমীচীন ছিল।
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম উত্তর দিয়েছেন 'উক্কাশা তোমার অগ্রবর্তী হয়ে গেছে। এমন বলেননি যে, তুমি তাদের অন্তর্ভুক্ত নও। এ কথা বললে তাঁর অন্তরে আঘাত লাগত এবং হতাশার সৃষ্টি হত। কাউকে হতাশ করা ঠিক নয়। কারও অন্তরে আঘাত দিয়ে কথা বলাও তাঁর চরিত্র ছিল না। এর দ্বারা জানা গেল যে, কারও প্রশ্নের উত্তর এমন নম্র-কোমল ভাষায় ও যৌক্তিক পন্থায় দেওয়া উচিত, যাতে প্রশ্নকর্তার মনে আঘাত না লাগে এবং সে সন্তুষ্ট হতে পারে।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. এ হাদীছের প্রধান বিষয় আল্লাহর প্রতি তাওয়াক্কুল ও নির্ভরতা। বান্দার উচিত সকল কাজে আল্লাহরই উপর নির্ভর করা, আসবাব-উপকরণের উপর নয়।
খ. প্রত্যেকের উচিত বিনা হিসাবে জান্নাত লাভের জন্য আশাবাদী হওয়া এবং সেজন্য শরী'আত নির্দেশিত পন্থা শক্তভাবে আঁকড়ে ধরা।
গ. দীনী কাজে ইখলাসের সঙ্গে মেহনত করে যাওয়াই আমাদের কাজ। ফলাফল আল্লাহর উপর ন্যস্ত করা উচিত। তা একান্তই আল্লাহর কাজ। কাঙ্ক্ষিত ফল দেখতে না পাওয়ার অর্থ মেহনত ব্যর্থ যাওয়া নয়। মেহনতের পরকালীন পুরস্কার অবশ্যই পাওয়া যাবে।
ঘ. অবৈধ ঝাড়ফুঁক ও তাবিজ-তুমার থেকে অবশ্যই বেঁচে থাকতে হবে। বৈধ রুকয়া ও চিকিৎসা করাতে কোনও দোষ নেই। তা তাওয়াক্কুলেরও পরিপন্থি নয়।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
