রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ
ভূমিকা অধ্যায়
হাদীস নং:
অধ্যায় : ৩ সবর।
৪৮। রাগ না করার উপদেশ:
হযরত আবু হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত, এক ব্যক্তি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে আরয করল, আমাকে নসীহত করুন। তিনি বললেন, রাগ করো না। ওই ব্যক্তি বার বার একই আবেদন করল। প্রতিবারই তিনি বললেন, রাগ করো না - বুখারী। (বুখারী শরীফ হাদীস নং ৬১১৬)
হযরত আবু হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত, এক ব্যক্তি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে আরয করল, আমাকে নসীহত করুন। তিনি বললেন, রাগ করো না। ওই ব্যক্তি বার বার একই আবেদন করল। প্রতিবারই তিনি বললেন, রাগ করো না - বুখারী। (বুখারী শরীফ হাদীস নং ৬১১৬)
হাদীসের ব্যাখ্যা:
এ হাদীছে যে রাগ করতে নিষেধ করা হয়েছে, তার মানে রাগ চরিতার্থ করো না। এবং রাগের বশে কোনও কাজ করো না। রাগ উঠতেই পারবে না, এমন কথা বোঝানো হয়নি। কেননা রাগ স্বভাবগত ব্যাপার। তা নির্মূল করা যায় না। শরী'আত এমন কোনও কাজের হুকুম দেয়নি, যা করার ক্ষমতা বান্দার নেই।
এ বর্ণনায় উপদেশপ্রার্থী সাহাবীর নাম উল্লেখ নেই। কেউ কেউ তাঁর নাম বলেছেন সুফয়ান ইবন আব্দুল্লাহ রাযি. । কোনও বর্ণনায় তাঁর নাম বলা হয়েছে আব্দুল্লাহ ইবন উমর রাযি.। তাছাড়া হযরত আব্দুল্লাহ ইবন আমর ইবনুল আস রাযি. হযরত আবুদ দারদা রাযি., হযরত জাবির রাযি. হযরত জারিয়া ইবন কুদামা রাযি. ও হযরত মু'আয ইবন জাবাল রাযি.-এর নামও পাওয়া যায়। সম্ভবত তাদের প্রত্যেকেই এ আবেদন জানিয়েছিলেন। এক বর্ণনায় আছে, উপদেশপ্রার্থী বলেছিলেন, আমাকে এমন এক আমলের কথা বলে দিন, যা আমাকে জান্নাতে পৌঁছাবে। খুব দীর্ঘ কথা বলবেন না, যাতে আমি যথাযথভাবে বুঝতে সক্ষম হই। তাঁর অনুরোধমত নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সংক্ষেপে বললেন, রাগ করো না।
এই ব্যক্তিকে বিশেষভাবে রাগ না করার হুকুম দেওয়ার কারণ সম্ভবত এই যে, লোকটি হয়তো অতিরিক্ত রাগী ছিল। কথায় কথায় রাগ করত। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রত্যেককে এমন উপদেশই দিতেন, যা তার জন্য বেশি প্রয়োজনীয়। সে কারণেই এ ব্যক্তিকে কেবল এই এক উপদেশ দিয়েই ক্ষান্ত হয়েছেন। বস্তুত সংক্ষিপ্ত হলেও এটি এমন এক উপদেশ, দুনিয়া ও আখিরাতের সমুদয় কল্যাণ যার অন্তর্ভুক্ত। রাগের কারণে মানুষ দুনিয়ায় নিজেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়, অন্যকেও ক্ষতিগ্রস্ত করে। অন্যের ক্ষতি করা দ্বারা তো তার নিজেরও দীনের ক্ষতি হয়ে যায়। অনেক সময় সরাসরিও নিজের দীনী ক্ষতি করে ফেলে। রাগের বশে অনেক সময় লোকে কুফরী কথা পর্যন্ত বলে ফেলে। এক বর্ণনায় আছে, উপদেশপ্রার্থী ব্যক্তি পরে মন্তব্য করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন আমাকে এই উপদেশ দিলেন, আমি তখন চিন্তা করে দেখলাম, যত রকম মন্দ আছে সবই রাগের আওতায় এসে যায়।
আসলে রাগের সময় মানুষের হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। আগুন যেমন সবকিছু পুড়িয়ে ছারখার করে দেয়, রাগও তেমনি মানুষের ভালোমন্দ বিবেচনাবোধ লোপ করে দেয়। আগুনের সংগে রাগের অনেক মিল। মানুষ সৃষ্টির চার উপদানের একটি আগুনও। বলা হয়ে থাকে, রাগের উৎপত্তি সে আগুন থেকেই। ওদিকে শয়তান আগুনের সৃষ্টি। মানুষের ভেতর যখন রাগের আগুন জ্বলে ওঠে, তখন আগুনের সৃষ্টি শয়তানের সংগে তার একরকম সাদৃশ্য স্থাপিত হয়ে যায়। শয়তান সৃষ্টিগতভাবেই মন্দপ্রবণ। এ ব্যক্তির ভেতরও তখন মন্দের প্রবণতা প্রবল হয়ে ওঠে। শয়তানও তাতে উস্কানি দেয় ও উৎসাহ যোগায়। ফলে দীনী ও দুনিয়াবী যে-কোনও মন্দ কাজ সে অনায়াসে করে ফেলে। এভাবে তার ইহজীবন ও পরকালীন জীবন উভয়ই বরবাদ হয়ে যায়। সেই পরিণতি থেকে বাঁচতে হলে অবশ্যই ক্রোধ সংবরণ করতে হবে। সে কারণেই নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিশেষভাবে রাগ না করার উপদেশ দিয়েছেন।
প্রশ্ন হতে পারে, এ হাদীছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাগ করতে নিষেধ করেছেন, কিন্তু তিনি নিজে তো অনেক সময়ই রাগ করেছেন, যেমন বিভিন্ন রেওয়ায়েতে পাওয়া যায়? এর উত্তর হল, এ হাদীছে যে রাগ করতে নিষেধ করা হয়েছে তা ব্যক্তিগত বিষয়ে রাগ, দীনী বিষয়ে নয়। দীনী অনেক বিষয় এমন আছে, যেখানে রাগ করাই জরুরি। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেসকল ক্ষেত্রে রাগ করেছেন তা সবই দীনী বিষয়। তিনি তাঁর ব্যক্তিগত বিষয়ে কখনও রাগ করতেন না। মুশরিকগণ ও মুনাফিকগণ তাঁকে কতভাবে কষ্ট দিয়েছে। গালাগাল করেছে, অপবাদ রটিয়েছে, শরীরিক নির্যাতন করেছে, মোটকথা কষ্টদানের কোনও পন্থাই বাকি রাখেনি। কিন্তু তিনি সর্বাবস্থায়ই কেবল ক্ষমাই করেছেন। কখনও প্রতিশোধ নেননি।
কিন্তু কেউ যদি দীনের কোনও বিষয়ে সীমালঙ্ঘন করত, সে ক্ষেত্রে তিনি অবশ্যই রাগ করতেন। সে রাগ হত একান্তই আল্লাহর জন্য। শামাঈলে এসেছেঃ-
ولا تغضبه الدنيا ، ولا ما كان لها ، فإذا تعدي الحق لم يقم لغضبه شيء حتى ينتصر له ، ولا يغضب لنفسه ، ولا ينتصر لها
"পার্থিব কোন বিষয় বা কাজের উপর নবীজী ক্রোধ প্রকাশ করতেন না এবং তার জন্য আক্ষেপও করতেন না। অবশ্য কেউ ধর্মীয় কোন বিষয়ে সীমা লংঘন করলে তখন তাঁর গোস্বার সীমা থাকত না। এমনকি তখন কেউ তাঁকে বশে রাখতে পারত না। তিনি তাঁর ব্যক্তিগত কারণে ক্রোধান্বিত হতেন না"
আল্লাহর জন্য রাগ করা ঈমানের অঙ্গ। এটা আমাদের জন্যও প্রযোজ্য । কিন্তু আমাদের অবস্থা এর বিপরীত। আমাদের রাগ অধিকাংশই দীনের জন্য হয় না; বরং ব্যক্তিগত ব্যাপারে হয়। আল্লাহ তা'আলা আমাদেরকে এর থেকে হেফাজত করুন।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. বহু সাহাবীর অনুরোধে সংক্ষিপ্ত এই উপদেশ দান করা যে, রাগ করো না, এর দ্বারা রাগ কতবড় ক্ষতিকর জিনিস এবং এর থেকে বেঁচে থাকা কত গুরুত্বপূর্ণ, তা সহজেই উপলব্ধি করা যায়। সুতরাং আমাদের প্রত্যেকের কর্তব্য রাগ সংযত করা।
খ. নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের এ উপদেশদান দ্বারা এই শিক্ষা পাওয়া যায় যে, অন্যকে উপদেশ দানকালে লম্বা-চওড়া কথা না বলে এমন সংক্ষিপ্ত উপদেশ দান করা উচিত, উপদেশপ্রার্থী ব্যক্তি যা সহজে বুঝতে, স্মরণ রাখতে ও আমল করতে পারে।
এ বর্ণনায় উপদেশপ্রার্থী সাহাবীর নাম উল্লেখ নেই। কেউ কেউ তাঁর নাম বলেছেন সুফয়ান ইবন আব্দুল্লাহ রাযি. । কোনও বর্ণনায় তাঁর নাম বলা হয়েছে আব্দুল্লাহ ইবন উমর রাযি.। তাছাড়া হযরত আব্দুল্লাহ ইবন আমর ইবনুল আস রাযি. হযরত আবুদ দারদা রাযি., হযরত জাবির রাযি. হযরত জারিয়া ইবন কুদামা রাযি. ও হযরত মু'আয ইবন জাবাল রাযি.-এর নামও পাওয়া যায়। সম্ভবত তাদের প্রত্যেকেই এ আবেদন জানিয়েছিলেন। এক বর্ণনায় আছে, উপদেশপ্রার্থী বলেছিলেন, আমাকে এমন এক আমলের কথা বলে দিন, যা আমাকে জান্নাতে পৌঁছাবে। খুব দীর্ঘ কথা বলবেন না, যাতে আমি যথাযথভাবে বুঝতে সক্ষম হই। তাঁর অনুরোধমত নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সংক্ষেপে বললেন, রাগ করো না।
এই ব্যক্তিকে বিশেষভাবে রাগ না করার হুকুম দেওয়ার কারণ সম্ভবত এই যে, লোকটি হয়তো অতিরিক্ত রাগী ছিল। কথায় কথায় রাগ করত। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রত্যেককে এমন উপদেশই দিতেন, যা তার জন্য বেশি প্রয়োজনীয়। সে কারণেই এ ব্যক্তিকে কেবল এই এক উপদেশ দিয়েই ক্ষান্ত হয়েছেন। বস্তুত সংক্ষিপ্ত হলেও এটি এমন এক উপদেশ, দুনিয়া ও আখিরাতের সমুদয় কল্যাণ যার অন্তর্ভুক্ত। রাগের কারণে মানুষ দুনিয়ায় নিজেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়, অন্যকেও ক্ষতিগ্রস্ত করে। অন্যের ক্ষতি করা দ্বারা তো তার নিজেরও দীনের ক্ষতি হয়ে যায়। অনেক সময় সরাসরিও নিজের দীনী ক্ষতি করে ফেলে। রাগের বশে অনেক সময় লোকে কুফরী কথা পর্যন্ত বলে ফেলে। এক বর্ণনায় আছে, উপদেশপ্রার্থী ব্যক্তি পরে মন্তব্য করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন আমাকে এই উপদেশ দিলেন, আমি তখন চিন্তা করে দেখলাম, যত রকম মন্দ আছে সবই রাগের আওতায় এসে যায়।
আসলে রাগের সময় মানুষের হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। আগুন যেমন সবকিছু পুড়িয়ে ছারখার করে দেয়, রাগও তেমনি মানুষের ভালোমন্দ বিবেচনাবোধ লোপ করে দেয়। আগুনের সংগে রাগের অনেক মিল। মানুষ সৃষ্টির চার উপদানের একটি আগুনও। বলা হয়ে থাকে, রাগের উৎপত্তি সে আগুন থেকেই। ওদিকে শয়তান আগুনের সৃষ্টি। মানুষের ভেতর যখন রাগের আগুন জ্বলে ওঠে, তখন আগুনের সৃষ্টি শয়তানের সংগে তার একরকম সাদৃশ্য স্থাপিত হয়ে যায়। শয়তান সৃষ্টিগতভাবেই মন্দপ্রবণ। এ ব্যক্তির ভেতরও তখন মন্দের প্রবণতা প্রবল হয়ে ওঠে। শয়তানও তাতে উস্কানি দেয় ও উৎসাহ যোগায়। ফলে দীনী ও দুনিয়াবী যে-কোনও মন্দ কাজ সে অনায়াসে করে ফেলে। এভাবে তার ইহজীবন ও পরকালীন জীবন উভয়ই বরবাদ হয়ে যায়। সেই পরিণতি থেকে বাঁচতে হলে অবশ্যই ক্রোধ সংবরণ করতে হবে। সে কারণেই নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিশেষভাবে রাগ না করার উপদেশ দিয়েছেন।
প্রশ্ন হতে পারে, এ হাদীছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাগ করতে নিষেধ করেছেন, কিন্তু তিনি নিজে তো অনেক সময়ই রাগ করেছেন, যেমন বিভিন্ন রেওয়ায়েতে পাওয়া যায়? এর উত্তর হল, এ হাদীছে যে রাগ করতে নিষেধ করা হয়েছে তা ব্যক্তিগত বিষয়ে রাগ, দীনী বিষয়ে নয়। দীনী অনেক বিষয় এমন আছে, যেখানে রাগ করাই জরুরি। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেসকল ক্ষেত্রে রাগ করেছেন তা সবই দীনী বিষয়। তিনি তাঁর ব্যক্তিগত বিষয়ে কখনও রাগ করতেন না। মুশরিকগণ ও মুনাফিকগণ তাঁকে কতভাবে কষ্ট দিয়েছে। গালাগাল করেছে, অপবাদ রটিয়েছে, শরীরিক নির্যাতন করেছে, মোটকথা কষ্টদানের কোনও পন্থাই বাকি রাখেনি। কিন্তু তিনি সর্বাবস্থায়ই কেবল ক্ষমাই করেছেন। কখনও প্রতিশোধ নেননি।
কিন্তু কেউ যদি দীনের কোনও বিষয়ে সীমালঙ্ঘন করত, সে ক্ষেত্রে তিনি অবশ্যই রাগ করতেন। সে রাগ হত একান্তই আল্লাহর জন্য। শামাঈলে এসেছেঃ-
ولا تغضبه الدنيا ، ولا ما كان لها ، فإذا تعدي الحق لم يقم لغضبه شيء حتى ينتصر له ، ولا يغضب لنفسه ، ولا ينتصر لها
"পার্থিব কোন বিষয় বা কাজের উপর নবীজী ক্রোধ প্রকাশ করতেন না এবং তার জন্য আক্ষেপও করতেন না। অবশ্য কেউ ধর্মীয় কোন বিষয়ে সীমা লংঘন করলে তখন তাঁর গোস্বার সীমা থাকত না। এমনকি তখন কেউ তাঁকে বশে রাখতে পারত না। তিনি তাঁর ব্যক্তিগত কারণে ক্রোধান্বিত হতেন না"
আল্লাহর জন্য রাগ করা ঈমানের অঙ্গ। এটা আমাদের জন্যও প্রযোজ্য । কিন্তু আমাদের অবস্থা এর বিপরীত। আমাদের রাগ অধিকাংশই দীনের জন্য হয় না; বরং ব্যক্তিগত ব্যাপারে হয়। আল্লাহ তা'আলা আমাদেরকে এর থেকে হেফাজত করুন।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. বহু সাহাবীর অনুরোধে সংক্ষিপ্ত এই উপদেশ দান করা যে, রাগ করো না, এর দ্বারা রাগ কতবড় ক্ষতিকর জিনিস এবং এর থেকে বেঁচে থাকা কত গুরুত্বপূর্ণ, তা সহজেই উপলব্ধি করা যায়। সুতরাং আমাদের প্রত্যেকের কর্তব্য রাগ সংযত করা।
খ. নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের এ উপদেশদান দ্বারা এই শিক্ষা পাওয়া যায় যে, অন্যকে উপদেশ দানকালে লম্বা-চওড়া কথা না বলে এমন সংক্ষিপ্ত উপদেশ দান করা উচিত, উপদেশপ্রার্থী ব্যক্তি যা সহজে বুঝতে, স্মরণ রাখতে ও আমল করতে পারে।
