রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ
ভূমিকা অধ্যায়
৪৩। পার্থিব জীবনে মু'মিনদের শাস্তিভোগ আল্লাহর অনুগ্রহবিশেষ এবং যতবড় পরীক্ষা ততবড় প্রতিদান:
হযরত আনাস রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, আল্লাহ তা'আলা যখন তাঁর কোনও বান্দার কল্যাণ চান, তখন দুনিয়াতেই তাকে নগদ শাস্তি দান করেন। পক্ষান্তরে আল্লাহ যখন তাঁর কোনও বান্দার অমঙ্গল চান, তখন তার শাস্তি বিলম্বিত করে তাকে পাপে লিপ্ত রাখেন। পরিশেষে কিয়ামতের দিন তাকে পুরোপুরি বদলা দেন।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেন, নিশ্চয়ই বিরাট প্রতিদান বিরাট মুসিবতের সংগে যুক্ত। আল্লাহ যখন কোনও জাতিকে ভালোবাসেন, তখন তাদের পরীক্ষায় ফেলেন। যে ব্যক্তি তাতে সন্তুষ্ট থাকে, তার জন্য রয়েছে আল্লাহর সন্তুষ্টি। আর যে ব্যক্তি অসন্তুষ্ট হয়, তার জন্য রয়েছে আল্লাহর অসন্তুষ্টি।
ইমাম তিরমিযী রহ. এ হাদীছ বর্ণনা করেন এবং বলেন, এটি একটি 'হাসান' হাদীছ। (হাদীস নং ২৩৯৮)
হাদীসের ব্যাখ্যাঃ
ইহজীবনে মানুষের দ্বারা নানারকম ভুল-ত্রুটি ও পাপাচার হয়ে যায়। তার ইবাদত- বন্দেগীতে অবহেলা হয়ে যায়। মানুষের সংগে আচার-আচরণে ভুল-ত্রুটি করে ফেলে। অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের যথাযথ ব্যবহার হয় না। নিআমতের নাশোকরী হয়ে যায়। প্রতিদিন কত রকমের পাপকর্ম হয়ে যায়, তার ইয়ত্তা নেই। বেশিরভাগই আল্লাহ তাআলা ক্ষমা করে দেন। কোনও কোনওটি ধরেন। যেগুলো ধরেন সেগুলোর ক্ষেত্রে আল্লাহ তা'আলার নীতি হল, কোনও না কোনও কৌশলে নেককার মুমিনদের তা থেকে পবিত্র করে ফেলা হয়। আল্লাহ তাওবার তাওফীক দেন, ফলে তাওবা করে সে তা থেকে পবিত্র হয়ে যায়। অথবা তাকে কোনও মুসিবতে ফেলেন এবং তাতে সবরের তাওফিক দেন। এর মাধ্যমেও তার গুনাহ মাফ হয়। এ হাদীছে বলা হয়েছে, আল্লাহ তাআলা যার কল্যাণ চান তাকে দুনিয়ায় নগদ শাস্তি দিয়ে দেন। হয়তো তার অর্থ-সম্পদের ক্ষয়-ক্ষতি হয়, বা কোনও প্রিয়জন মারা যায়, বা সে কোনও রোগে আক্রান্ত হয় কিংবা অন্য কোনও মুসিবতে পড়ে। এটা তার প্রতি আল্লাহ তাআলার এক বিরাট রহমত। কেননা এর মাধ্যমে আল্লাহ তার পাপমোচন করেন। নগদ শাস্তির মাধ্যমে যখন পাপমোচন হয়ে যায়, তখন তার কবরে যাওয়া হয় নিষ্পাপ অবস্থায়। ফলে হাশরে আল্লাহ তাআলার সামনে পুতঃপবিত্র বান্দারূপে হাজির হবে। সে জাহান্নামের শাস্তি থেকে নিষ্কৃতি পেয়ে জান্নাতে পৌঁছে যাবে। ভাবা যায় এটা কত বড় সৌভাগ্যের কথা! তুচ্ছ দুনিয়ায় শাস্তিভোগের বিনিময়ে আখিরাতে জাহান্নামের শাস্তি থেকে বেঁচে গেল এবং জান্নাতলাভের মাধ্যমে অনন্ত সৌভাগ্যের অধিকারী হয়ে গেল। আর আল্লাহ তাআলা যার অনিষ্ট চান তাকে দুনিয়ায় শাস্তিদান করেন না। সে সুখ-সাচ্ছন্দ্যে দিন কাটায় আর নিশ্চিন্তমনে পাপাচার করে যায়। দুনিয়ায় শাস্তি না পাওয়ার কারণে তার সব পাপই জমা থাকে। এর পুরোপুরি শাস্তি তাকে আখিরাতে দেওয়া হবে। এ ব্যক্তি কাফির হয়ে থাকলে জাহান্নামের অনন্তকালীন শাস্তি ভোগ করতে থাকবে। যদি মুমিন হয়, তবে ঈমানের বদৌলতে একদিন জান্নাতে যাবে বটে, কিন্তু তার আগে কতকাল যে জাহান্নামের শাস্তি ভোগ করতে হবে তার তো কোনও ঠিকানা নেই। বলাবাহুল্য, জাহান্নামের শাস্তির সংগে দুনিয়ার শাস্তির কোনও তুলনা নেই। সেখানকার এক মুহূর্তের শাস্তিও দুনিয়ার গোটা জীবনের শাস্তি অপেক্ষা কঠিন। দুনিয়ায় সারা জীবনও যদি বিপদ-আপদে থাকতে হয়, তাও কোনও না কোনওভাবে হয়তো সহ্য করা সম্ভব, কিন্তু আখিরাতের এক মুহূর্তের শাস্তিও তো সহ্য করা সম্ভব নয়। কাজেই সেই শাস্তির বদলে দুনিয়ার শাস্তিভোগ একরকম রহমতই তো বটে। আর সেই শাস্তি যথারীতি বহাল রেখে ইহজীবনে সুখ-সাচ্ছন্দ্য ভোগ চরম অকল্যাণই তো বটে। হযরত জাবির রাযি. থেকে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন- «يود أهل العافية يوم القيامة حين يعطى أهل البلاء الثواب لو أن جلودهم كانت قرضت في الدنيا بالمقاريض» অর্থ: দুনিয়ায় যারা শান্তি ও নিরাপত্তার সংগে জীবনযাপন করে, কিয়ামতের দিন তারা যখন দুনিয়ায় বিপদ-আপদ ভোগকারী লোকদেরকে প্রতিদান লাভ করতে দেখবে, তখন তারা আক্ষেপ করে বলবে, আহা! দুনিয়ায় যদি তাদের চামড়া কাঁচি দ্বারা কেটে ফেলা হত (তবে তাদের পক্ষে তা কতই না ভালো হত। আজ তারাও ওইসব লোকের মত প্রতিদানের অধিকারী হত)! –তিরমিযী হাদীস নং ২৪০২– তবে আখিরাতের শাস্তি থেকে বাঁচার লক্ষ্যে আল্লাহ তাআলার কাছে দুনিয়ায় শাস্তি চাওয়া উচিত নয়। অজ্ঞতাবশত এক সাহাবী তা চেয়েছিলেন। ফলে তিনি কঠিন রোগাক্রান্ত হয়ে পড়েন। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গিয়ে দেখেন, পাখির ছানার মত তাঁর জরাজীর্ণ অবস্থা। তিনি যখন জানতে পারলেন এই সাহাবী আখিরাতের শাস্তির বদলে দুনিয়ার শাস্তি চেয়েছিলেন, তখন তাকে নিষেধ করে দেন। এবং বলেন, আল্লাহর কাছে শান্তি ও নিরাপত্তা চাও। তো শাস্তি চেয়ে নেওয়া ঠিক নয়। আল্লাহ তাআলা নিজেই যদি দেন, তখন কর্তব্য ধৈর্যধারণ করা। যে শাস্তির সাথে ধৈর্যের তাওফীক হয়, সেই শাস্তি রহমত ও নিআমত বটে। হাদীছের শেষাংশে বলা হয়েছে, যতবড় পরীক্ষা ততবড় প্রতিদান। এটা অনেক বড় সুসংবাদ এবং স্বস্তিদায়ক কথা। মানুষ বিপদ-আপদ দেখে ভয় পায়। বিপদ যদি বড় হয়, তখন হতাশ হয়ে পড়ে। নিজেকে দুর্ভাগ্যবান মনে করে। অন্যকে আরামে থাকতে দেখে আক্ষেপ করে। মনে করে, সে কত সৌভাগ্যবান। তার কোনও বিপদ-আপদ নেই। এ হাদীছ জানাচ্ছে, বিপদ-আপদ দুর্ভাগ্যের বিষয় নয়। এটা আল্লাহর পরীক্ষা। পরীক্ষা যত কঠিন হয়, পুরস্কারও তত বড় হয়। তোমার যদি বড় বিপদ দেখা দেয়, তোমার কর্তব্য তাকে পরীক্ষা মনে করে সবর অবলম্বন করা। সবর করতে পারলে তোমার জন্য রয়েছে অনেক বড় পুরস্কার। তুমি স্বস্তি ও শান্তি কামনা করছিলে, তার বিপরীতে আল্লাহ বিপদ দিয়েছেন। তাতে তোমার খুশি হওয়া উচিত। তোমার জন্য তোমার নিজ পসন্দ অপেক্ষা আল্লাহর পসন্দ শ্রেয় বৈকি। তোমাকে পুরস্কৃত করার জন্যই তোমার কামনার বিপরীত অবস্থা তিনি দান করেছেন। সুতরাং সেই পুরস্কারপ্রাপ্তির আশায় মনে-প্রাণে সন্তুষ্ট থাক। এ সন্তষ্টি প্রকাশ বন্দেগীর উচ্চতর স্তর। এই স্তরে যদি উপনীত হতে না পার, অন্ততপক্ষে সবরই অবলম্বন কর। এর নিচে নামতে যেয়ো না অর্থাৎ অধৈর্য হয়ো না। তুমি চিন্তা করে দেখ, তোমাকে যদি দুনিয়ার আনন্দ উপভোগের ভেতর ছেড়ে দেওয়া হত, তবে হয়তো তুমি তাতে এমনভাবে নিমজ্জিত হয়ে পড়তে যে, তুমি প্রকৃত দাতাকে ভুলে যেতে অর্থাৎ আল্লাহ সম্বন্ধে গাফিল হয়ে যেতে, যেমনটা কাফির ও ফাসিকগণ হয়ে থাকে। আল্লাহ চান তুমি তাঁর অভিমুখী হয়ে থাক। তাই সে অভিমুখীতার পক্ষে যা-কিছু বাধা, অর্থাৎ আরাম ও বিলাসিতা, তিনি তা তোমার থেকে দূর করে দিয়েছেন এবং তোমাকে দুঃখ-কষ্ট ও বিপদ-আপদের মধ্যে ফেলেছেন। এখন তোমার কর্তব্য তাঁর দিকে রুজু হওয়া ও তাঁকে ডাকা। এই যে তাঁর দিকে অভিমুখী হওয়ার সুযোগ তিনি তোমাকে করে দিয়েছেন, এও তো অনেক বড় নিআমত। এ নিআমতের জন্য তুমি শোকর আদায় কর এবং আল্লাহর ফয়সালাকে সন্তুষ্টচিত্তে মেনে নাও। তা যদি মেনে নিতে পার তবে তোমার জন্য রয়েছে তাঁর সন্তুষ্টি। তিনি তোমাকে মুসিবতের এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার তাওফীক দান করবেন এবং আখিরাতে জান্নাতের নিআমত দ্বারা পুরস্কৃত করবেন। পক্ষান্তরে তুমি যদি আল্লাহর এ ফয়সালায় সন্তুষ্ট থাকতে না পার, তবে তা বড়ই দুর্ভাগ্যের কথা। তুমি তোমার অসন্তুষ্টি দ্বারা বিপদ তো দূর করতে পারবে না; বরং উল্টো আল্লাহর অসন্তোষের পাত্রে পরিণত হবে। ফলে বিপদ-আপদের বিনিময়ে কোনও পুরস্কার তো লাভ করবেই না, উল্টো দুনিয়ায়ও বিপদ-আপদ ভোগ করবে, আবার আল্লাহর অসন্তোষের পাত্র হয়ে আখিরাতেও শাস্তির উপযুক্ত হয়ে গেলে দুনিয়া ও আখিরাত উভয়ই গেল। হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ ক. কোনও বিপদ-আপদ দেখা দিলে মু'মিন ব্যক্তির কর্তব্য তার পক্ষে তাকে কল্যাণকর মনে করা। খ. যে গুনাহগার ব্যক্তি আরাম-আয়েশের জীবনযাপন করে তার কর্তব্য এই ভেবে সতর্ক হওয়া যে, এটা আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকে তাকে গুনাহে লিপ্ত থাকার অবকাশ দান কিনা। গ. অন্যকে আরাম-আয়েশে থাকতে দেখে আক্ষেপ করা উচিত নয়; বরং নিজ কষ্টের কারণে আখিরাতে পুরস্কার লাভের জন্য আশান্বিত থাকা উচিত।

তাহকীক:
তাহকীক চলমান