রিয়াযুস সালিহীন-ইমাম নববী রহঃ

ভূমিকা অধ্যায়

হাদীস নং:
অধ্যায় : ৩ সবর।
৩০। সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকায় ধৈর্যধারণ ও তার অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত:

হযরত সুহায়ব রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের মধ্যে এক বাদশা ছিল। তার ছিল এক জাদুকর। সে যখন বৃদ্ধ হয়ে গেল তখন বাদশাকে বলল, আমি বৃদ্ধ হয়ে গিয়েছি। কাজেই আমার কাছে একটি বালক পাঠিয়ে দিন। আমি তাকে জাদু শিক্ষা দেব। বাদশা জাদুবিদ্যা শেখানোর জন্যে তার কাছে একটি বালক পাঠিয়ে দিল। তার (অর্থাৎ বালকটির) যাতায়াতপথে ছিলেন এক রাহিব (খৃষ্টান সন্ন্যাসী)। (একদিন) সে তার কাছে বসল এবং তার কথা শুনল। তাতে সে মুগ্ধ হয়ে গেল। অতঃপর যখনই সে জাদুকরের কাছে আসত, তখন পথে ওই রাহিবের কাছে (কিছুক্ষণ) বসত। (এতে জাদুকরের কাছে পৌঁছতে তার দেরি হয়ে যেত) ফলে যখন জাদুকরের কাছে আসত, সে তাকে মারপিট করত। সুতরাং (একদিন) সে রাহিবের কাছে এ ব্যাপারে অভিযোগ করল। রাহিব বললেন, যখন তোমার জাদুকরকে ভয় হয় (যে, সে তোমাকে মারবে) তখন তাকে বলবে, আমার পরিবারবর্গ আমাকে আটকে রেখেছিল। আর যখন পরিবারবর্গকে ভয় করবে তাদেরকে বলবে, জাদুকর আমাকে আটকে রেখেছিল। এভাবেই সে চলছিল। সহসা সে একদিন এক বিশাল প্রাণীর সম্মুখীন হল, যেটি লোকদের পথ বন্ধ করে দিয়েছিল। বালকটি তখন (মনে মনে) বলল, আজ আমি জেনে নেব জাদুকর শ্রেষ্ঠ, নাকি রাহিব শ্রেষ্ঠ? সুতরাং সে একটি পাথরখণ্ড হাতে নিয়ে বলল, হে আল্লাহ! যদি রাহিবের কাজকর্ম আপনার নিকট জাদুকরের কাজকর্ম অপেক্ষা বেশি পসন্দনীয় হয়, তবে এই প্রাণীটি মেরে ফেলুন, যাতে লোকজন পথ চলতে পারে। এই বলে সে পাথরখণ্ডটি নিক্ষেপ করল এবং প্রাণীটিকে মেরে ফেলল। আর মানুষজনও চলাচল করতে পারল।
তারপর বালকটি রাহিবের কাছে গিয়ে এ বৃত্তান্ত তাকে অবহিত করল। রাহিব তাকে বললেন, ওহে বাছা! আজ তুমি আমার চেয়ে শ্রেষ্ঠ। তোমার ব্যাপার কোন স্তরে পৌঁছেছে আমি তা দেখতে পাচ্ছি। অচিরেই তুমি পরীক্ষার সম্মুখীন হবে। যদি তুমি পরীক্ষার সম্মুখীন হও, তবে আমার কথা কিন্তু বলে দিও না। বালকটি জন্মান্ধ ও কুষ্ঠ রোগীকে নিরাময় করে দিত এবং মানুষের সর্বপ্রকার রোগের চিকিৎসা করত। বাদশার এক পারিষদ এ কথা শুনতে পেল। সে অন্ধ হয়ে গিয়েছিল। সুতরাং সে বিপুল হাদিয়া নিয়ে তার কাছে আসল এবং বলল, তুমি যদি আমাকে নিরাময় করে দিতে পার, তবে এই সবকিছু তোমার। সে বলল, আমি কাউকে নিরাময় করতে পারি না। নিরাময় তো আল্লাহ তাআলাই করেন। তুমি যদি আল্লাহ তাআলার প্রতি ঈমান আন, আমি আল্লাহ তাআলার কাছে দু'আ করব, তিনি তোমাকে আরোগ্য দান করবেন। এ কথায় সে আল্লাহর প্রতি ঈমান আনল। ফলে আল্লাহ তাআলা তাকে আরোগ্য দান করলেন। তারপর সে বাদশার কাছে আসল এবং আগে যেমন বসত, তেমনি তার দরবারে বসল। বাদশা তাকে বললেন, কে তোমার দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দিল? সে বলল, আমার রব (প্রতিপালক)। বাদশা বললেন, আমি ছাড়াও কি তোমার কোনও রব আছে? সে বলল, আমার ও আপনার রব্ব আল্লাহ। এতে বাদশা তাকে পাকড়াও করল এবং তাকে শাস্তি দিতে থাকল। অবশেষে সে বালকটির কথা বলে দিল। তখন বালকটিকে নিয়ে আসা হল। বাদশা তাকে বলল, ওহে বাছা! তোমার জাদু এ পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, তুমি জন্মান্ধ ও কুষ্ঠ রোগীকে আরোগ্য দান করে থাক। তাছাড়াও তুমি এই এই কর। সে বলল, আমি কাউকে আরোগ্য দান করতে পারি না। আল্লাহ তাআলাই আরোগ্য দান করেন। এ কথায় বাদশা তাকে পাকড়াও করল এবং তাকে শাস্তি দিতে থাকল। শেষে সে রাহিবের কথা বলে দিল। তখন রাহিবকে নিয়ে আসা হল। তাকে বলা হল, তুমি তোমার দীন থেকে ফিরে এস। তিনি অস্বীকার করলেন। তখন বাদশা করাত আনতে বলল। করাত তার মাথার মাঝখানে রাখা হল এবং তা দিয়ে তাকে চিরে ফেলা হল। এমনকি তার দুই ভাগ দু'পাশে পড়ে রইলো ।
তারপর বাদশার পারিষদকে নিয়ে আসা হল। তাকে বলা হল, তুমি তোমার দীন থেকে ফিরে এস। কিন্তু সে অস্বীকার করল। ফলে তারও মাথার মাঝখানে করাত রাখা হল এবং তাকে তা দ্বারা চিরে ফেলা হল। এমনকি তার দুই ভাগ দু'পাশে পড়ে রইলো।
তারপর বালককে নিয়ে আসা হল। তাকেও বলা হল, তুমি তোমার দীন থেকে ফিরে এস। সেও অস্বীকার করল। ফলে বাদশা তাঁকে তার একদল অনুচরের হাতে সমর্পণ করল এবং হুকুম দিল, তাকে অমুক পাহাড়ে নিয়ে যাও এবং তাকে পাহাড়টির উপর ওঠাও। যখন তোমরা পাহাড়ের চূড়ায় পৌঁছবে (তাকে আবার তার দীন পরিত্যাগের আহ্বান জানাবে), তখন যদি সে তার দীন থেকে ফিরে আসে তবে তো ভালো, অন্যথায় তাকে সেখান থেকে নিচে ফেলে দিও। সেমতে তারা তাকে নিয়ে গেল এবং পাহাড়ে চড়ল । তখন সে দুআ করল, হে আল্লাহ! তুমি যেভাবে ইচ্ছা কর, আমার পক্ষ থেকে তাদের বুঝে নাও। তখন পাহাড়টি তাদের নিয়ে প্রকম্পিত হল। ফলে তারা নিচে পড়ে গেল। তারপর সে হেঁটে হেঁটে বাদশার কাছে চলে আসল। বাদশা তাকে বলল, তোমার সঙ্গীদের খবর কী? সে বলল, আল্লাহ তাআলা আমার পক্ষ থেকে তাদের বুঝে নিয়েছেন। তারপর বাদশা তাকে তার আরেকদল অনুচরের হাতে সমর্পণ করল এবং বল্ল, তাকে নিয়ে যাও। তারপর তাকে একটা বড় নৌকায় তুলে সাগরের মাঝখানে নিয়ে যাও। তখন যদি সে তার দীন থেকে ফিরে আসে তো ভালো, অন্যথায় তাকে সাগরে নিক্ষেপ কর। সেমতে তারা তাকে নিয়ে গেল (এবং সাগরের মাঝখানে পৌঁছে গেল)। তখন বালকটি দুআ করল, হে আল্লাহ! তুমি আমার হয়ে যেভাবে চাও তাদের বুঝে নাও। ফলে নৌকাটি তাদের নিয়ে উল্টে গেল এবং তারা সকলে পানিতে ডুবে (মারা) গেল আর বালকটি হেঁটে হেঁটে বাদশার কাছে চলে আসল। বাদশা তাকে বলল, তোমার সঙ্গীদের খবর কী? সে বলল, আল্লাহ তাআলা আমার হয়ে তাদের বুঝে নিয়েছেন। তারপর বাদশাকে লক্ষ্য করে বলল, আপনি যতক্ষণ পর্যন্ত আমার হুকুম মত কাজ না করবেন, ততক্ষণ পর্যন্ত আমাকে হত্যা করতে পারবেন না। বাদশা বলল, তা কী? সে বলল, আপনি একটি মাঠে লোকজনকে সমবেত করবেন এবং আমাকে একটি খেজুর গাছে লটকাবেন (অর্থাৎ আমাকে শূলে চড়াবেন)। তারপর আমার তূনীর (তীর রাখার থলি) থেকে একটি তীর নিয়ে ধনুকের মাঝখানে রাখবেন। তারপর "বিসমিল্লাহি রাব্বিল গুলাম" (এই বালকের প্রতিপালকের নামে) বলে আমার প্রতি নিক্ষেপ করবেন। এরূপ করলে আপনি আমাকে হত্যা করতে সক্ষম হবেন। সেমতে বাদশা এক মাঠে লোকজনকে জমা করল এবং তাকে শূলে চড়াল। তারপর তার তূনীর থেকে একটি তীর নিয়ে ধনুকে স্থাপন করল। তারপর 'বিসমিল্লাহি রাব্বিল গুলাম' বলে তার প্রতি নিক্ষেপ করল। অমনি সেটা তাঁর কানের গোড়ায় গিয়ে বিদ্ধ হল। তখন বালকটি তার কানের গোড়ায় হাত রাখল এবং মারা গেল।
এ অবস্থা দেখে উপস্থিত লোকজন (সমঃস্বরে) বলে উঠল, আমরা বালকটির রব্বের প্রতি ঈমান আনলাম। তখনই এ খবর বাদশার কাছে পৌঁছে দেওয়া হল। তাকে বলা হল, দেখলেন তো, আপনি যা আশংকা করছিলেন তাই ঘটে গেল। আল্লাহর কসম! সমস্ত মানুষ আল্লাহর প্রতি ঈমান এনে ফেলেছে। আপনার আশংকা ফলে গেছে। তখন বাদশা রাস্তার মুখে মুখে গর্ত খননের হুকুম দিল। গর্ত খনন করা হল এবং তাতে আগুন জ্বালানো হল। বাদশা বলল, যে কেউ তার দীন থেকে না ফিরবে, তাকেই এতে নিক্ষেপ করবে। তারা তাই করল। পরিশেষে এক মহিলার পালা আসল। তার সংগে তার একটি শিশু ছিল। সে আগুনে পড়তে ইতস্তত করছিল। তখন তার শিশুটি বলে উঠল, মা! ধৈর্যধারণ করুন। নিশ্চয়ই আপনি সত্যের উপর আছেন - মুসলিম। (মুসলিম হাদীস নং ৩০০৫)

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীছে সবর সম্পর্কে একটি দৃষ্টান্তমূলক ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। ঘটনাটি আমাদের পূর্ববর্তী জাতির। অর্থাৎ হযরত ঈসা আলাইহিস-সালামের অনুসারী খ্রিষ্ট সম্প্রদায়ের, যেহেতু এর ভেতর এক রাহিবের উল্লেখ আছে। আর রাহিব বলা হয় খৃষ্টান সন্ন্যাসীকে। তবে সুনির্দিষ্ট করে বলা যায় না ঠিক কখন এটি ঘটেছিল। তা জানা না গেলেও ঈমানের উপর অবিচলতা ও ঈমানী পরীক্ষায় ধৈর্যধারণ সম্পর্কে অতি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা এর দ্বারা পাওয়া যায়।

বলা হয়েছে, পূর্বকালে এক রাজার একজন জাদুকর ছিল। সেকালে রাজা-বাদশার কাছে জাদুকরদের খুব খাতির ছিল। তখন জাদুবিদ্যারও খুব প্রসার ছিল। মানুষের বিশ্বাস ছিল, জাদুকর ভূত ও ভবিষ্যত এবং শুভ-অশুভ জানে। জাদুকরগণও মানুষের এ বিশ্বাসের খুব সুযোগ নিত। রাজা-বাদশাগণ যুদ্ধ-বিগ্রহ ও রাজকীয় কাজকর্মে তাদের পরামর্শ নিত। কোন কাজের পরিণাম শুভ এবং কোন কাজের পরিণাম অশুভ, তা তাদের জিজ্ঞেস করত। তারা তাদের ভোজভাজি ও শাস্ত্রীয় তেলেসমাতির ভিত্তিতে একটা কিছু ভবিষ্যদ্বাণী করে দিত। যে জাদুকর যতবেশি ভোজভাজি জানত, তার ততবেশি কদর হত। খুব বেশি দক্ষতা থাকলে রাজদরবারেও স্থান হয়ে যেত। ঠিক রাজ-কবির মত তখন রাজ-জাদুকরেরও একটা পদ ছিল। বর্ণিত এ ঘটনায়ও রাজার একজন রাজ-জাদুকর ছিল। রাজ-জাদুকর বুড়ো হয়ে গেলে রাজার কাছ থেকে একটি বালক চেয়ে নিল, যাতে তাকে জাদুবিদ্যা শিখিয়ে তার জায়গায় বসাতে পারে আর তার মৃত্যুর পর তার স্থলাভিষিক্ত হিসেবে সে রাজ-জাদুকরের দায়িত্ব আঞ্জাম দিতে পারে।
বলা হয়েছে, জাদুকরের কাছে বালকটির যাতায়াতপথে এক রাহিব (খৃষ্টান সন্ন্যাসী) ছিলেন। একদিন বালকটি তার কাছে বসে যখন তার কথাবার্তা শুনল, তাতে খুব মুগ্ধ হয়ে গেল। তা মুগ্ধ হওয়ারই কথা। কারণ তার কথাবার্তা কাঁচাবয়সী বালকের বাইরের প্রভাবমুক্ত স্বাভাবিক চিন্তা-ভাবনার সাথে সংগতিপূর্ণ ছিল। সব শিশুই তো স্বভাবধর্ম তথা এক আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস ও তাঁর আনুগত্যের স্বভাব নিয়ে জন্ম নেয়। যতক্ষণ পর্যন্ত বাইরের দূষিত চিন্তা-ভাবনা দ্বারা তার বিশুদ্ধ স্বভাব নষ্ট না হয়ে যায়, ততক্ষণ তাওহীদ ও ইসলামের শিক্ষা সে খুব কবুল করে। বালকটি যদিও নষ্ট পরিবেশে প্রতিপালিত হচ্ছিল, তদুপরি জাদুকরের শিরকী শিক্ষা তার স্বভাবধর্মকে বিকৃত করে ফেলার প্রয়াস পাচ্ছিল, কিন্তু বয়স অল্প হওয়ায় এবং ওই বিকৃত শিক্ষা গ্রহণে সদ্য অবতীর্ণ হওয়ায় তার স্বভাবধর্ম এখনও পুরোপুরি নষ্ট হতে পারেনি। এখনও পর্যন্ত তা সুস্থ ও শুদ্ধ শিক্ষা গ্রহণের পক্ষে প্রস্তুতই ছিল। সুতরাং সে তা গ্রহণ করে নিল। তাওহীদের শিক্ষা তার অন্তরে বেশ ভালোভাবেই শিকড় গেড়ে নিল। সে একজন পাক্কা ঈমানদার হয়ে উঠল। তার সে ঈমান কতটা পরিপক্ক ছিল, পরবর্তী ঘটনাবলীই তার প্রমাণ।

জাদুকরের কাছে আসা-যাওয়ার পথে রাহিবের কাছে শিক্ষাগ্রহণ করতে গিয়ে সে জাদুকর ও নিজ পরিবার উভয়দিক থেকে বাধাগ্রস্ত হচ্ছিল। জাদুকরের কাছে উপস্থিত হতে দেরি হলে জাদুকর তাকে মারধর করত, আবার জাদুকরের কাছ থেকে ছুটির পর পরিবারের কাছে পৌঁছতে দেরি হলেও জবাবদিহিতার সম্মুখীন হতে হত। এই জটিলতা থেকে মুক্তির জন্যে রাহিব তাকে এই কৌশল শিক্ষা দিলেন যে, জাদুকরকে বলবে আমার বাড়ি থেকে বের হতে দেরি হয়েছে আর পরিবারকে বলবে, জাদুকরের কাছ থেকে ছুটি দেরিতে হয়েছে। সুস্পষ্ট অসত্য কথা। প্রশ্ন হতে পারে, রাহিব তাকে অসত্য বলতে শিক্ষা দিলেন যে? এর উত্তর হল, এখানে দুই মন্দের ভেতরে অপেক্ষাকৃত সহজ মন্দকে অবলম্বনের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে, যাকে বলা হয় মন্দের ভালো। অর্থাৎ মিথ্যা বলাটাও পাপ। কিন্তু শিরক ও জাদুশিক্ষা আরও কঠিন পাপ। এই মিথ্যা বলে যদি সে নিজেকে রক্ষা না করে, তবে তাদের জুলুম-নির্যাতনে নির্ঘাত শিরকে লিপ্ত হতে হবে। সেই শিরক থেকে বাঁচার লক্ষে এই সাময়িক মিথ্যার আশ্রয় নিতে বলা হয়েছে। বড় স্বার্থ ও অধিকতর কল্যাণ রক্ষার্থে এরকম কৌশল অবলম্বনের অবকাশ আছে। উদাহরণস্বরূপ- বিবদমান দুই ব্যক্তির মধ্যে মীমাংসার জন্যে যদি মিথ্যা বলার প্রয়োজন পড়ে. শরী'আতের পক্ষ থেকে তা বলার অনুমতি আছে। এমনিভাবে কাউকে অন্যের জুলুম থেকে বাঁচানোর উদ্দেশ্যে মিথ্যা বলার প্রয়োজন দেখা দিলে তাও বলার অবকাশ আছে।

বলা হয়েছে, একটি বিরাট প্রাণী মানুষের যাতায়াত বন্ধ করে দিল। কোনও কোনও বর্ণনা দ্বারা জানা যায়, কোথা থেকে একটি সিংহ এসে রাস্তায় বসে গিয়েছিল। সিংহের ভয়ে সেই পথে মানুষ চলাচল করার সাহস পাচ্ছিল না। মানুষকে এই বিপদ থেকে বাঁচানোর উদ্দেশ্যে বালকটি এগিয়ে আসল। এর জন্য সে এমন একটি পন্থা বেছে নিল, যাতে একই সংগে মানুষ সিংহের কবল থেকে বাঁচতে পারে আবার রাহিব ও জাদুকরের মধ্যে কে সত্যের উপর আছে তাও প্রমাণিত হয়ে যায়। আল্লাহ তা'আলা তার ইচ্ছা পূরণ করলেন। তার ছোঁড়া পাথরের আঘাতে সিংহটি মেরে ফেলে মানুষের চলাচল পথও মুক্ত করে দিলেন, সেইসংগে এটাও প্রমাণ করে দিলেন যে, রাহিবই সত্যের উপর আছে, তার পথই সঠিক।

বস্তুত তার এ ঘটনাটি সেই এলাকায় ইসলাম প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট রচনা করেছিল। অভিজ্ঞ রাহিব বুঝতে পেরেছিলেন সামনে বালকটির কঠিন দিন আসছে। তাকে ঈমানের অগ্নিপরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে হবে। কেননা নবী-রাসূলগণের ইতিহাস তো আছেই, তাছাড়াও যুগে-যুগে যারা আল্লাহর পথে মানুষকে দা'ওয়াত দিয়েছেন, যারা শিরক ও বিদ'আত এবং কুসংস্কারের বিপরীতে অবস্থান নিয়েছেন, যারা প্রচলিত ধ্যান-ধারণার বিপরীত কথা বলেছেন, তাদেরকে নিজ জাতির পক্ষ থেকেই কঠিন জুলুম-নির্যাতনের সম্মুখীন হতে হয়েছে। রাজা-বাদশা ও সমাজপতিগণ তাদের কণ্ঠরোধের চেষ্টা করেছে। স্বার্থান্বেষী মহল তাদের প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দিতে চেয়েছে। প্রথমত নানারকম প্রলোভন দিয়ে তাদেরকে ক্ষান্ত করার চেষ্টা করেছে। তাতে ব্যর্থ হলে শক্তি আরোপ করেছে। নানারকম কষ্ট দিয়েছে। এমনকি শহীদ পর্যন্ত করে দিয়েছে। বস্তুত দীনী দাওয়াতের পথ কখনওই মসৃণ হয় না। কঠিন ত্যাগ স্বীকার ছাড়া এ পথে সফলতা লাভ হয় না। তো এই বালকের যখন দীনের সত্যতা বুঝে এসে গেছে এবং হিংস্র পশুটিকে হত্যার মাধ্যমে আল্লাহর কাছে তার উচ্চ মর্যাদারও ইশারা পাওয়া গেছে, তখন সে এই সত্যের পতাকা নিয়ে সামনে অগ্রসর হবেই হবে। কোনও শক্তি তাকে নিরস্ত করতে পারবে না। তাকে কঠিন জুলুম-নির্যাতনের সম্মুখীন হতে হবে। কিন্তু বোঝাই যাচ্ছে এ উদ্যমী বালক তাতে দমার পাত্র নয়। রাহিব এটাও বুঝতে পেরেছিলেন যে, ঈমানী দৃঢ়তায় বালকটি তারচে' অনেক দূর এগিয়ে গেছে। যত কঠিন পরীক্ষাই হোক, তাতে সে অবশ্যই উত্তীর্ণ হবে। তিনি চাচ্ছিলেন যেন তার নিজের সেরকম পরীক্ষায় পড়তে না হয়। কেননা জুলুম-নির্যাতনের মুখে নিজেকে সত্যের উপর ধরে রাখা খুব সহজ কথা নয়। সে ক্ষেত্রে ঈমান মস্তবড় ঝুঁকিতে পড়ে যায়। তিনি সেই ঝুঁকি এড়াতে চাচ্ছিলেন। তাই তাকে বলে দিলেন, তুমি যদি পরীক্ষায় পড়ে যাও, ঈমানের কারণে জুলুম-নির্যাতনের শিকার হও এবং কে তোমাকে এই পথ দেখিয়েছে তোমার কাছে তা জানতে চাওয়া হয়, তবে সাবধান! আমার নাম কিন্তু বলে দিও না।

ঈমানদার বালকটি আল্লাহ তা'আলার ইচ্ছায় বিভিন্ন রোগের চিকিৎসা করত। তার চিকিৎসায় জন্মান্ধ ও কুষ্ঠরোগীসহ বিভিন্ন দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত লোক ভালো হয়ে যেত। তারা ভালো হত আল্লাহ তা'আলার ইচ্ছাতেই। বালকের নিজস্ব কোনও ক্ষমতা ছিল না। তা কারও থাকেও না। রোগ ভালো হয় দেখে কেউ যাতে বিভ্রান্তিতে না পড়ে, সে লক্ষ্যে বালকটি পরিষ্কারই বলে দিত আমি কাউকে নিরাময় করি না, নিরাময় করেন আল্লাহ তা'আলাই। আমি কেবল আল্লাহ তা'আলার কাছে দু'আই করতে পারি। আমার দু'আ কবুল করে আল্লাহ তা'আলা রোগ ভালো করে দেন।

রোগীর জন্য দু'আ করা ও তাতে রোগ ভালো হয়ে যাওয়া বালকটির পক্ষ থেকে ছিল সৃষ্টির এক বিরাট সেবা। সৃষ্টির সেবা দ্বারা যেমন বিপুল ছওয়াব লাভ হয়, তেমনি মানুষের ভেতর ভালোবাসা ও সম্প্রীতিও প্রতিষ্ঠিত হয়। সেই সম্প্রীতি ও ভালোবাস দীনী দাওয়াতের ক্ষেত্র তৈরি করে। ঈমানে উজ্জীবিত এই বালক এভাবে দেবর মাধ্যমে ক্ষেত্র প্রস্তুত করছিল এবং মানুষকে আল্লাহর পথে দাওয়াত দিয়ে যাচ্ছিল। তার দাওয়াত কবুল করে একের পর এক পথহারা মানুষ আল্লাহর পথে ফিরে আসছিল। সবশেষে রাজার মন্ত্রীও তার দাওয়াতে সাড়া দিয়ে আল্লাহর পথে ঈমান এনে ফেলে। আর তখনই শুরু হয়ে যায় পরীক্ষা, যার বিবরণ এ হাদীছে দেওয়া হয়েছে।

রাজার তো উচিত ছিল অন্ধ মন্ত্রীকে চক্ষুষ্মান দেখে বিবেক-বুদ্ধি কাজে লাগানো। নিজেকে রব্ব ও প্রতিপালক গণ্য করা এমনিতেও চরম নির্বুদ্ধিতা। আল্লাহর পথের ডাক শুনে তার কর্তব্য ছিল নিজ নির্বুদ্ধিতা সম্পর্কে সচেতন হওয়া। মন্ত্রীর ইসলামগ্রহণ দ্বারা আল্লাহ তা'আলা তাকে সচেতন হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। কিন্তু কায়েমী স্বার্থবাদীরা কোথায় কখন সচেতন হয়েছে? স্বার্থরক্ষার ধান্ধায় তারা চরম অন্ধ ও বধির হয়ে যায়। তাদের সে অন্ধত্ব ও বধিরতা কোনও কিছুতেই ঘোচে না। বস্তুত তারা তা ঘোচাতে চায়ও না। বরং যে সত্যের ধ্বনি তা ঘোচানোর চেষ্টা করে, সেই সত্যকেই যারা স্তব্ধ করে দেওয়ার পায়তারা চালায়। এ রাজাও সেই কায়েমী স্বার্থবাদীদের একজন ছিল। তাই যখন তার পাঠানো পেয়াদারা পাহাড় থেকে পড়ে মারা গেল কিন্তু বালকটির কিছুই হল না, সে সম্পূর্ণ অক্ষত অবস্থায় হেঁটে হেঁটে রাজার কাছে ফিরে আসল, তখনও তার চোখ খুলল না। যখন তার পাঠানো লোকেরা সাগরে ডুবে মারা গেল কিন্তু বালকটির কিছুই হল না; বরং সহী-সালামতে রাজার কাছে ফিরে আসল, তখনও তার হুঁশ হল না। যখন বালকটি নিজে থেকে তাকে হত্যা করার কৌশল শিখিয়ে দিল এবং তাতে আল্লাহর নাম উচ্চারণেরও পরামর্শ দিল, তখনও তার অন্তরে কৌতূহল জাগল না। এমনকি যখন আল্লাহর নাম নিয়ে তীর ছুঁড়ল এবং তাতে বিদ্ধ হয়ে বালকটি শহীদ হয়ে গেল, তখনও তার চৈতন্যোদয় হল না। তখনও তার ভাববার অবকাশ হল না যে, প্রকৃতপক্ষে সেই আল্লাহই সবকিছু করেন, যাঁর প্রতি এ বালকটি ঈমান আনার দা'ওয়াত দিচ্ছে। অথচ এই ঘটনা উপস্থিত লোকজনের অন্তরে ঠিকই নাড়া দিয়েছিল। তারা তখনই দলে দলে ঈমান এনেছিল। তারা সমস্বরে বলে উঠেছিল, আমরা এই বালকের প্রতিপালকের প্রতি ঈমান আনলাম। অন্ততপক্ষে তাদের ঈমান আনয়ন দেখেও সে বিবেকের একটু তাড়া বোধ করতে পারত। কিন্ত তাও করল না। উল্টো তাদেরকে নির্যাতন করল এবং আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করল।

যাদেরকে আগুনে নিক্ষেপ করেছিল, তাদের মধ্যে এক মহিলা ও তার শিশুও ছিল। শিশুটি ছিল খুবই ছোট। তখনও তার কথা বলার বয়স হয়নি। কোনও কোনও বর্ণনায় আছে, তার বয়স ছিল মাত্র সাত মাস। তার মা যখন আগুনে পড়তে ইতস্তত করছিল, তখন শিশুটি তার মাকে ডেকে সাহস যোগায়। সে বলে ওঠে, মা তুমি ধৈর্য ধর। কেননা তুমি সত্যের উপর আছ ধৈর্যধারণ করলে আল্লাহর কাছে প্রভৃত ছওয়াবের অধিকারী হবে।

এই শিশুর কথা বলাটা ছিল একটি অলৌকিক ঘটনা। কথা বলার বয়স হওয়ার বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন উদ্দেশ্যে শিশুর আল্লাহ তা'আলা ক্ষণিকের জন্যে বাকশক্তি আগেই শিশুর মুখে বাকশক্তি দান করা আল্লাহ তা'আলার পক্ষে অসম্ভব কিছুই নয়। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন উদ্দেশ্যে শিশুরমুখে আল্লাহ্ তা'আলা ক্ষণিকের জন্য বাকশক্তি দান করেছেন। ইমাম জালালুদ্দীন সুতী রহ এরকম দশটি শিশুর উল্লেখ করেছেন। এর মধ্যে এই শিশুও একটি। হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের জন্মের পরপরই কথা বলার ঘটনা তো সকলেরই জানা। কুরআন মাজীদেও তা বর্ণিত হয়েছে।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. এ হাদীছের প্রধান শিক্ষা তো ধৈর্য সম্পর্কে। বিশেষত দীনের পথে শত্রুদের পক্ষ থেকে যে জুলুম-নির্যাতন আসে, তাতে ধৈর্যধারণ করা এবং ঈমান ও সত্যের উপর অবিচলিত থাকা নবীগণের শান। প্রত্যেক মু'মিন ও দাওয়াতদাতার কর্তব্য এই শান ও বৈশিষ্ট্য অর্জন করা।

খ. বালক-বয়সেই দীন শিক্ষায় মনোনিবেশ করা উচিত। শৈশবের শিক্ষা মনে গভীর রেখাপাত করে এবং তা বেশি দিন স্মরণ থাকে। তাছাড়া শৈশবের সুশিক্ষা মানুষের স্বভাবগত গুণের মত হয়ে যায়। ফলে কর্মজীবনে সেই শিক্ষা অনুযায়ী চলা তার পক্ষে সহজ হয়।

গ. বালকের পাথর নিক্ষেপে সিংহের মৃত্যু দ্বারা প্রমাণ হয় বুযুর্গানে দীনের কারামত সত্য। বিভিন্ন
রোগীকে ভালো করাও ছিল তার কারামত।

ঘ. কারও কোনও কাজে অন্যের বিভ্রান্ত হওয়ার আশংকা থাকলে তার উচিত বিষয়টা পরিষ্কার করে দেওয়া, যাতে লোকে বিভ্রান্তি থেকে রক্ষা পায়, যেমন বালকটি রোগ নিরাময়ের বিষয়টি সম্পর্কে স্পষ্ট বলে দিয়েছে যে, এটা আমি করি না, আল্লাহ তা'আলাই করেন (আমি কেবল আল্লাহ তা'আলার কাছে দু'আই করে থাকি)।

ঙ. শত্রুর জুলুম-নির্যাতনে সত্যে অবিচলিত থাকার ব্যাপারে কারও নিজের প্রতি যদি পুরোপুরি আস্থা না থাকে, তবে সে ক্ষেত্রে তার জুলুম-নির্যাতন এড়ানোর পথ খোঁজা জায়েয আছে। যার হিম্মত ও মনোবল উঁচু, বলাবাহুল্য সে তো প্রাণ দিতেও কুণ্ঠিত হবে না। এটা 'আযীমাত বা আমলের উচ্চতর স্তর। বালকটির আমল ছিল এই স্তরের। প্রথমটি অবকাশের স্তর। সে স্তর অবলম্বনেও দোষ নেই। যেমন নবুওয়াতের মিথ্যা দাবিদার মুসায়লিমা আল-কাযযাব নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুজন সাহাবীকে পাকড়াও করে একজনকে বলেছিল, মুহাম্মাদ সম্পর্কে তুমি কী বল? সাহাবী উত্তর দিয়েছিলেন, তিনি আল্লাহর রাসূল। তারপর জিজ্ঞেস করেছিল, আমার সম্পর্কে কী বল? তিনি বলেছিলেন, তুমিও। সে তখন তাকে ছেড়ে দেয়। অন্যজনকে জিজ্ঞেস করেছিল, তুমি মুহাম্মাদ সম্পর্কে কী বল? তিনি বলেছিলেন, আল্লাহর রাসূল। তারপর জিজ্ঞেস করেছিল, আমার সম্পর্কে কী বল? তিনি বলেছিলেন, জানি না। সে একের পর এক ওই প্রশ্ন করতে থাকে। তিনি প্রতিবারই বলতে থাকেন, আমি জানি না। শেষে মুসায়লিমা তার একেকটি অঙ্গ কাটতে শুরু করে। কিন্তু তিনি ঈমানে অবিচল থাকেন। তাদের এ বৃত্তান্ত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে পৌঁছলে তিনি মন্তব্য করেছিলেন, তাদের একজন আল্লাহ প্রদত্ত অবকাশকে গ্রহণ করেছে, আর দ্বিতীয় জন সত্যের দ্ব্যর্থহীন ঘোষণা দিয়েছে। তাকে সাধুবাদ জানাই। ইবন কাছীর রহঃ এ হাদীছ উল্লেখ করেছেন।
tahqiqতাহকীক:তাহকীক নিষ্প্রয়োজন
rabi
বর্ণনাকারী: