আল জামিউস সহীহ- ইমাম বুখারী রহঃ

৬৫- অনুমতি গ্রহণ - প্রদান সংক্রান্ত

হাদীস নং:
আন্তর্জাতিক নং: ৬২৪৬
৩৩০৪. যখন কোন ব্যক্তিকে ডাকা হয় আর সে আসে, সেও কি প্রবেশের অনুমতি নিবে?
আবু হুরায়রা (রাযিঃ) হতে বর্ণিত, নবী (ﷺ) বলেছেনঃ এ ডাকাই তার জন্য অনুমতি।
৫৮১২। আবু নুআইম ও মুহাম্মাদ ইবনে মুকাতিল (রাহঃ) ......... আবু হুরায়রা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ একদিন আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর সঙ্গে তার ঘরে প্রবেশ করলাম। তিনি ঘরে গিয়ে এক পেয়ালা দুধ পেলেন। তিনি আমাকে বললেনঃ হে আবু হির! তুমি আহলে সুফফার নিকট গিয়ে তাদের আমার নিকট ডেকে আন। তখন আমি তাদের কাছে গিয়ে দাওয়াত দিয়ে এলাম। তারপর তারা এল এবং প্রবেশের অনুমতি চাইলে তাদের অনুমতি দেয়া হল। তারপর তারা প্রবেশ করল।

হাদীসের ব্যাখ্যা:

১. দাওয়াত দেওয়ার পর দ্বিতীয়বার অনুমতি লওয়ার প্রয়োজন নাই। যদি লওয়া হয় তবে তাহা হইবে ভদ্রতা ও শিষ্টাচারিতা। কিছুসংখ্যক গরীব মুহাজির মুসলমান — যাঁহাদের ঘর-বাড়ী কিছুই ছিল না, তাঁহারা মদীনার মসজিদে নববীর সম্মুখস্থ একটি চবুতরায় অবস্থান করিতেন। ইসলামের ইতিহাসে তাঁহারা 'আহলে সুফ্ফা' নামে পরিচিত।

২. এখানে হাদীসটি সংক্ষিপ্ত আকারে আনা হয়েছে। অন্যান্য বর্ণনার আলোকে নিম্নে পূর্ণাঙ্গ হাদীস ও তার ব্যাখ্যা পেশ করা হলো।

হযরত আবু হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহর কসম, যিনি ছাড়া কোনও মা'বূদ নেই, আমি ক্ষুধার কারণে আমার বুক মাটির উপর চেপে ধরতাম এবং ক্ষুধার কারণে পেটে পাথর বেঁধে রাখতাম। একদিন আমি মানুষের চলাচলপথে বসে থাকলাম। এ অবস্থায় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার নিকট দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি আমাকে দেখে মুচকি হাসলেন এবং আমার চেহারা ও আমার মনের অবস্থা বুঝে ফেললেন। তিনি বললেন, হে আবু হিরর। আমি বললাম, লাব্বাইকা ইয়া রাসুলাল্লাহ! তিনি বললেন, আমার সঙ্গে এসো। তিনি চলতে থাকলেন। আমি তাঁর পেছনে পেছনে চললাম। তিনি ঘরে প্রবেশ করলেন। আমি অনুমতি চাইলাম। আমাকে অনুমতি দিলেন। সুতরাং আমি প্রবেশ করলাম। তিনি একটি পেয়ালায় কিছু দুধ পেলেন। জিজ্ঞেস করলেন, এ দুধ কোথা হতে? ঘরের লোকজন বলল, অমুক ব্যক্তি বা অমুক মহিলা আপনার জন্য হাদিয়া পাঠিয়েছে।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আবু হিরর! আমি বললাম, লাব্বাইকা ইয়া রাসূলাল্লাহ! তিনি বললেন, সুফফাবাসীদের কাছে যাও এবং তাদেরকে আমার কাছে নিয়ে এসো।
হযরত আবু হুরায়রা রাযি. বলেন, সুফফাবাসীগন ছিলেন ইসলামের অতিথি। তাদের কোনও পরিবার–পরিজন, অর্থ–সম্পদ ছিল না এবং আশ্রয় নেওয়ার মত কোনও লোক তাদের ছিল না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট কোনও সদাকা আসলে তিনি তা তাদের কাছে পাঠিয়ে দিতেন। নিজে তা থেকে কিছু গ্রহণ করতেন না। আর যখন হাদিয়া আসত, তা তাদের কাছেও পাঠাতেন এবং নিজেও তা থেকে গ্রহণ করতেন আর তাদেরকে তাতে শরীক করতেন।
(আবু হুরায়রা রাযি. বলেন,) তাঁর এ কথা আমাকে চিন্তিত করল। আমি (মনে মনে) বললাম, এতটুকু দুধে সুফফাবাসীদের কী হবে? আমিই তো এ দুধ পান করে শক্তি অর্জনের বেশি হকদার ছিলাম। তারপর তারা যখন আসবে, তখন তিনি আমাকেই (পরিবেশনের) হুকুম দেবেন। আমি তাদেরকে তা দিতে থাকব আর সম্ভবত এ দুধ থেকে আমার ভাগে কিছুই পড়বে না। কিন্তু আল্লাহ তা'আলা ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদেশ পালন না করেও আমার কোনও উপায় ছিল না। সুতরাং আমি তাদের কাছে আসলাম এবং তাদেরকে ডাকলাম। তারা চলে আসল এবং প্রবেশের অনুমতি চাইল। তিনি তাদেরকে অনুমতি দিলেন। তারা ঘরে জায়গা নিয়ে বসে পড়ল।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আবু হিরর। আমি বললাম, লাব্বাইকা ইয়া রাসূলাল্লাহ! তিনি বললেন, নাও, তাদেরকে দাও।
আবু হুরায়রা রাযি. বলেন, আমি পেয়ালা নিয়ে একেকজনকে দিতে থাকলাম। প্রত্যেকে পরিতৃপ্ত হয়ে পান করছিল, তারপর পেয়ালা আমার হাতে ফিরিয়ে দিচ্ছিল। তারপর আমি অন্যজনকে তা দিচ্ছিলাম। সেও পরিতৃপ্ত হয়ে পান করে আমার হাতে পেয়ালা ফিরিয়ে দিচ্ছিল। এভাবে সবশেষে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্যন্ত পৌঁছলাম। তিনি ছাড়া উপস্থিত লোকদের সকলেই পরিতৃপ্ত হয়ে গেছে। তিনি পেয়ালাটি নিয়ে নিজ হাতে রাখলেন। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলেন।
তারপর বললেন, আবু হিরর। আমি বললাম, লাব্বাইকা ইয়া রাসূলাল্লাহ! তিনি বললেন, এখন বাকি আছি আমি আর তুমি। আমি বললাম, ঠিক বলেছেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! বললেন, বস, পান কর। আমি বসে পান করলাম। তিনি বললেন, আরও পান কর আমি আরও পান করলাম। তিনি বলতে থাকলেন, পান কর। পরিশেষে আমি বললাম, আর না। যিনি আপনাকে সত্যসহ পাঠিয়েছেন তাঁর কসম! পান করার জন্য (আমার পেটে আর খালি) জায়গা পাচ্ছি না। তিনি বললেন, তাহলে আমাকে তৃপ্ত কর। আমি পেয়ালাটি তাঁকে দিলাম। তিনি আলহামদুলিল্লাহ ও বিসমিল্লাহ বলে অবশিষ্টটুকু পান করলেন।

হাদীসের ব্যাখ্যাঃ

হযরত আবূ হুরায়রা রাযি. নিজের অবস্থা বর্ণনা করছেন যে, কী রকম অনাহারের ভেতর দিয়ে তাঁর দিন যাচ্ছিল। ক্ষুধার কষ্ট সইতে না পেরে খালি বুকে উপুড় হয়ে মাটিতে শুয়ে থাকতেন। কষ্ট লাঘবের জন্য পেটে পাথর বেঁধে রাখতেন। এরকম মাঝেমধ্যেই হতো।

নিজ জীবনের এ অবস্থা বর্ণনা করার উদ্দেশ্য মানুষের কাছে কষ্টের কথা বলে বেড়ানো নয়, বরং মানুষকে ঈমানী চেতনার সঙ্গে পরিচিত করা। এত কষ্টের মধ্যেও তাঁরা কিভাবে দীন ও ঈমান ধরে রেখেছেন, কী কঠিন মুজাহাদার মধ্যে ইসলামের শুরু দিনগুলো কেটেছে, তা জানতে পারলে মানুষ দীন ও ঈমানের মূল্য বুঝবে, তাদের আখিরাতমুখিতা বাড়বে, দুনিয়ার আসক্তি ও অর্থবিত্তের মোহ থেকে তারা বাঁচতে পারবে।

মানুষের সামনে কেবল কষ্টের কথা প্রকাশ করাই নয়; বরং সে কষ্টের ভেতর তাদের সঙ্গে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আচরণ কেমন ছিল, কিভাবে তিনি তাদের সকলকে একত্রে নিয়ে চলতেন, কিভাবে তাঁদের মধ্যে সহমর্মিতা ও ঐক্য সম্প্রীতির চেতনা সঞ্চার করতেন, তার সঙ্গে নতুন প্রজন্মকে পরিচিত করাও উদ্দেশ্য ছিল। তিনি বিশেষ একটি দিনের ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন-
(একদিন আমি মানুষের চলাচলপথে বসে থাকলাম)। অর্থাৎ লোকে যে পথ দিয়ে মসজিদে আসা-যাওয়া করত, সেই পথে বসে থাকলাম। উদ্দেশ্য ছিল তাঁর অবস্থা দেখে হয়তো লোকে তাঁর ক্ষুধার কষ্টের কথা বুঝতে পারবে।

সাহাবীগণ তো সহজে মানুষের কাছে কিছু চাইতেন না। অন্যের কাছে হাত পাতা তাঁদের অভ্যাস ছিল না। অথচ অনাহারের যে কঠিন কষ্ট তাঁদের ভোগ করতে হচ্ছিল, এরকম অবস্থায় অন্যের কাছে হাত পাতা নাজায়েয় নয়। তবে তা নাজায়েয না হলেও তারা এক উচ্চতর আদর্শের উপর অধিষ্ঠিত ছিলেন। দীন ও ঈমানের এক পৰিত্ৰ জীবনবোধ তারা পালন করছিলেন। তাঁদের দৃষ্টিতে কোনও অবস্থায়ই মাখলুকের কাছে সরাসরি কিছু চাওয়া সে জীবনবোধের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ছিল না। ওদিকে ছিল দুর্বিষহ ক্ষুধার যন্ত্রণা। তাই প্রয়োজন পুরণের তাগিদে তিনি পরোক্ষ পন্থা অবলম্বন করেছিলেন। মানুষের যাতায়াতপথে বসে থাকলেন। হয়তো লোকে দেখে বুঝবে।

কখনও তিনি এমনও করতেন যে, কাছে যাকে পেতেন তাকে কুরআন মাজীদের কোনও আয়াত জিজ্ঞেস করতেন। হয়তো সে তাঁর আওয়াজ শুনে অনাহারের কারণ বুঝতে পারবে।

এদিন লোক আসা-যাওয়া করল ঠিকই, কিন্তু কেউ তার অবস্থা আঁচ করতে পারল না। একপর্যায়ে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে সেখান দিয়ে অতিক্রম করলেন। তিনি তাঁর অবস্থা আঁচ করতে পারলেন। তিনি তাঁর দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে দিলেন। সাহাবীদের কাছে সে হাসিও এক খাবার বটে। প্রাণের খোরাক। এমন প্রাণজুড়ানো হাসি কে কবে কোথায় দেখেছে? সেইসঙ্গে যদি হয় মধুর সম্ভাষণও। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন-
(হে আবু হিরর)। আবু হুরায়রা রাযি. প্রিয় সম্ভাষণে হয়ে গেলেন আবু হিরর, যেমন তিনি আম্মাজান আয়েশা সিদ্দীকা রাযি.-কে ডাক দিতেন 'আয়েশু'। হযরত আবু হুরায়রা রাযি. হয়তো স্নেহের সে স্পর্শে আনন্দে ভাসছিলেন। তিনি সাড়া দিলেন-
(লাব্বায়কা ইয়া রাসূলাল্লাহ)। আমি হাজির ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি হাজির: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে নিজের সঙ্গে চলতে বললেন। তিনি তাঁর পেছনে পেছনে চললেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজ ঘরে প্রবেশ করলেন। ভেতরে একটা পেয়ালায় কিছু দুধ দেখতে পেলেন। জিজ্ঞেস করে জানতে পারলেন কেউ তা হাদিয়া হিসেবে পাঠিয়েছে। তিনি হাদিয়া গ্রহণ করতেন। তা নিজে খেতেন, অন্যদেরও খাওয়াতেন। সদাকা হলে তা খেতেন না, উপযুক্ত লোককে খাওয়াতেন।

কিছুটা খাদ্য যখন পাওয়া গেল, তখন তিনি সকলকে নিয়ে তা ভাগাভাগি করে খেতে চাইলেন। তিনি হযরত আবূ হুরায়রা রাযি.কে হুকুম দিলেন যেন সুফ্ফায় অবস্থিত সাহাবীদের ডেকে আনেন। সুফ্ফার সে সাহাবীগণ কারা? হযরত আবু হুরায়রা রাযি. তাঁদের পরিচয় দিচ্ছেন-
(সুফ্ফাবাসীগণ ছিলেন ইসলামের অতিথি। তাদের কোনও পরিবার-পরিজন, অর্থ-সম্পদ ছিল না এবং আশ্রয় নেওয়ার মত কোনও লোক তাদের ছিল না)। হযরত আবু হুরায়রা রাযি. নিজেও তাঁদের একজন ছিলেন। সুফফা হল মসজিদে নববী-সংলগ্ন চতুর। বিভিন্ন বর্ণনা দ্বারা জানা যায়, বাহির থেকে কেউ মদীনায় আসলে আর মদীনায় তার পরিচিত কেউ থাকলে সে তার পরিচিত সেই ব্যক্তির মেহমান হয়ে যেত। আর পরিচিত কেউ না থাকলে সে সুফফায় অবস্থিত সাহাবীদের সঙ্গী হয়ে যেত। এ সাহাবীগণ মসজিদেই ঘুমাতেন। রাত হলে তাঁরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে দেখা করতেন। তিনি স্থানীয় সাহাবীদেরকে আপন আপন সামর্থ্য অনুযায়ী যে যত জনকে পারে সঙ্গে নিয়ে যেতে বলতেন। তিনি হুকুম দিতেন-
যার কাছে দুজনের খাবার আছে সে তৃতীয় একজনকে নিয়ে যাক। যার কাছে চারজনের খাবার আছে, সে পঞ্চম বা ষষ্ঠ একজনকে নিয়ে যাক।

তারপর যারা অবশিষ্ট থাকত তাদেরকে তিনি নিজের সঙ্গে নিয়ে যেতেন। সংখ্যা কখনও দশজন, কখনও তার কম বা বেশি হতো। এ হাদীছে আবু হুরায়রা রাযি. জানাচ্ছেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট কোনও সদাকা আসলে তিনি তা তাদের কাছে পাঠিয়ে দিতেন। নিজে তা থেকে কিছু গ্রহণ করতেন না। আর যখন হাদিয়া আসত, তা তাদের কাছেও পাঠাতেন এবং নিজেও তা থেকে গ্রহণ করতেন আর তাদেরকে তাতে শরীক করতেন।

যাহোক, রাসূলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন সুফ্ফার সাহাবীদের ডাকতে বললেন, তখন হযরত আবু হুরায়রা রাযি.এর মনের অবস্থা কী হয়েছিল সে সম্পর্কে তিনি বলেন, তাঁর এ কথা আমাকে অখুশি করল। আমি (মনে মনে) বললাম, এতটুকু দুধে সুফফাবাসীদের কী হবে? আমিই তো এ দুধ পান করে শক্তি অর্জনের বেশি হকদার ছিলাম। তারপর তারা যখন আসবে, তখন তিনি আমাকেই (পরিবেশনের) হুকুম দেবেন। আমি তাদেরকে তা দিতে থাকব আর সম্ভবত এ দুখ থেকে আমার ভাগে কিছুই পড়বে না। কিন্তু আল্লাহ তাআলা তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদেশ পালন না করেও আমার কোনও উপায় ছিল না। অগত্যা তিনি তাদের ডেকে আনলেন। হযরত আবু হুরায়রা রাযি. বলেন-
(তারা চলে আসল এবং প্রবেশের অনুমতি চাইল। তিনি তাদেরকে অনুমতি দিলেন। তারা ঘরে জায়গা নিয়ে বসে পড়ল)। বোঝা গেল কাউকে নিজ বাড়িতে আসার সংবাদ পাঠালেও তাদের আসার পর ঘরে প্রবেশের জন্য অনুমতি চাওয়া উচিত। বিনা অনুমতিতে প্রবেশ জায়েয নয়।

যারা এসেছিলেন, এ বর্ণনায় তাদের সংখ্যা বলা হয়নি। অন্য কোনও বর্ণনা থেকে তা জানা যায় না। সুফফায় সাহাবীদের সংখ্যা সব সময় একরকম থাকত না। কখন ৪০ জন থাকত, কখনও এর বেশি, কখনও কম। যখন কোনও যুদ্ধভিযানে চলে যেতেন, তখন সুফফায় অবশিষ্ট সাহাবী খুব কমই থাকত।

সুফফার সর্বমোট সাহাবী কতজন তাও নির্দিষ্টভাবে জানা যায় না। বিভিন্নজন বিভিন্ন সংখ্যা বলেছেন। ইমাম আবু নুআয়ম রহ. 'আল-হিলয়া গ্রন্থে বলেছেন, তাদের সংখ্যা ছিল একশ'র কাছাকাছি। ইমাম সাহরাওয়ার্দী রহ. "আওয়ারিফুল মাআরিফ" গ্রন্থে তাদের সংখ্যা বলেছেন চারশ।

সকলে আসার পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত আবূ হুরায়রাকে তাদের মধ্যে দুধ পরিবেশন করতে বললেন। তিনি বলেন, আমি পেয়ালা নিয়ে একেকজনকে দিতে থাকলাম। প্রত্যেকে পরিতৃপ্ত হয়ে পান করছিল, তারপর পেয়ালা আমার হাতে ফিরিয়ে দিচ্ছিল। তারপর আমি অন্যজনকে তা দিচ্ছিলাম। সেও পরিতৃপ্ত হায় পান করে আমার হাতে পেয়ালা ফিরিয়ে দিচ্ছিল। এভাবে সবশেষে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্যন্ত পৌঁছলাম।

এর দ্বারা বোঝা গেল খাদ্য পরিবেশনকারী যখন পেয়ালায় করে অতিথিদের একজনের পর একজনকে খাদ্য বা পানীয় দেবে, তখন প্রত্যেকে খাওয়ার পর পেয়ালাটি পরিবেশনকারীর হাতে ফিরিয়ে দেবে। পরিবেশনকারীই তা পরবর্তীজনকে দেবে। অতিথি নিজে দেবে না। পরিবেশনকারীও তা দেওয়ার ভার অতিথির উপর ছাড়বে না।

হযরত আবু হুরায়রা রাযি. অতিধিদের দুধ পান করানো শেষ হওয়ার পর পেয়ালাটি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাতে রাখলেন। তিনি বলেন-
(তিনি আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলেন)। অর্থাৎ তিনি যেন হযরত আবু হুরায়রা রাযি.-এর মনের কথা পড়তে পেরেছিলেন। মুচকি হাসি দিয়ে তিনি তার জবাব দিয়ে দেন। যেন বোঝাচ্ছিলেন, হে আবূ হুরায়রা! তুমি তো ভাবছিলে সকলকে পান করানোর পর পেয়ালায় অবশিষ্ট কিছুই থাকবে না আর তোমার ভাগে কিছুই পড়বে না; তোমাকে অভুক্তই থাকতে হবে। এখন দেখলে তো, সবাই পরিতৃপ্তির সঙ্গে পান করার পরও কেমন থেকে গেল?

মুচকি হাসার পর নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত আবূ হুরায়রা রাযি.-কে লক্ষ্য করে বললেন, এখন বাকি আছি আমি আর তুমি। তিনি বললেন, ঠিকই বলেছেন ইয়া রাসূলাল্লাহ! অর্থাৎ আপনি আর আমিই বাকি আছি। অন্য সকলের খাওয়া হয়ে গেছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন-
(বসো, পান করো)। বোঝা গেল পানাহারকালে বসা সুন্নত। এছাড়া অন্যান্য হাদীছ দ্বারাও এরকম শিক্ষা পাওয়া যায়। হযরত আবু হুরায়রা রাযি. বসে বসে পান করলেন। একবার পান করার পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আরও পান কর। এভাবে একের পর এক তিনি পান করতে বলছিলেন আর আবু হুরায়রা রাযি. পান করে যাচ্ছিলেন। সবশেষে বললেন-
যিনি আপনাকে সত্যসহ পাঠিয়েছেন তাঁর কসম। পান করার জন্য (আমার পেটে আর খালি জায়গা পাচ্ছি না। অর্থাৎ তিনি দুধপান করে সম্পূর্ণ পেট ভরে ফেলেছেন, আর তা করেছেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশেই। কিন্তু প্রশ্ন আসতে পারে, অন্যান্য হাদীছে যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আল ওয়াসাল্লাম সম্পূর্ণ পেট ভরে খেতে নিষেধ করেছেন? এর কী জবাব?

জবাব হল, সব সময় পেট ভরে খাওয়া উচিত নয়। সম্পূর্ণ পেট ভরে পানাহারে অভ্যস্ত হওয়ার দ্বারা পানাহার সামগ্রীর প্রতি লোভ-লালসা সৃষ্টি হয়। তাছাড়া এতে শরীরে আলস্য দেখা দেয়। অতিরিক্ত খাওয়ার পর ইবাদত-বন্দেগী ও কাজকর্মের প্রতি উদ্যম-উদ্দীপনা থাকে না। তাই পানাহারের ক্ষেত্রে সাধারণ নিয়ম হল পেটের তিন ভাগের একভাগ পরিমাণ খাওয়ার জন্য, একভাগ পানি পান করার জন্য, আর একভাগ রাখবে শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য, যেমনটা বিভিন্ন হাদীছে এসেছে। কখনও কখনও এর ব্যতিক্রম হলে তাতে দোষ নেই, বিশেষত তাতে যদি কোনও দীনী ফায়দাও থাকে। হযরত আবু হুরায়রা রাযি.-এর এই পেট ভরে দুধ পান করাটা নিতান্তই ব্যতিক্রম ঘটনা। তিনি এটা করেছিলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশে। তিনি এর দ্বারা তাঁর সামনে নিজ মু'জিযার মহিমা পরিস্ফুট করতে চাচ্ছিলেন।

সবশেষে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহপ্রদত্ত বরকতের জন্য আলহামদুলিল্লাহ বলে শোকর আদায় করলেন এবং বিসমিল্লাহ বলে অবশিষ্ট দুধ নিজে পান করলেন।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. এ হাদীছ দ্বারা জানা গেল মু'জিযা সত্য। সামান্য একটু দুধে কিভাবে এত সংখ্যক লোক পরিতৃপ্ত হয়ে গেল।

খ. ক্ষুধার কষ্টের কথা প্রকাশ করা ভালো নয়। কষ্ট অসহ্য হয়ে গেলে তখনও মুখে কিছু না বলে অন্য কোনও পন্থায় বা ভাবভঙ্গি দ্বারা তা বোঝানো চাই।

গ. বসে বসে পানাহার করা সুন্নত।

ঘ. পানাহারের আগে বিসমিল্লাহ বলা সুন্নত।

ঙ. যে-কোনও নি'আমত লাভের পর আলহামদুলিল্লাহ বলে আল্লাহর শোকর আদায় করা চাই।

চ. কারও ঘরে প্রবেশর আগে অবশ্যই অনুমতি গ্রহণ করতে হবে।

ছ. নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাদিয়া গ্রহণ করতেন, হাদিয়ার খাবার খেতেন। এবং তাতে অন্যদেরও শরীক রাখতেন। এটা সুন্নত।

ছ. অল্প খাদ্যও নিজে একা ভোগ না করে অন্যদের নিয়ে খাওয়া নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদর্শ।

জ. অভাব-অনটন ও অনাহারের কষ্ট যত বেশিই হোক না কেন, তথাপি শরী'আতের আদেশ অবশ্যই মান্য করতে হবে, যেমন হযরত আবু হুরায়রা রাযি. ক্ষুধার অসহ্য কষ্ট সত্ত্বেও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদেশ মান্য করেছেন।

ঞ. অধীনস্থদের যে-কোনও কষ্টে তাদের প্রতি সহমর্মী আচরণ ও তাদের কষ্ট লাঘবের সর্বাত্মক চেষ্টা করা বাঞ্ছনীয়।
tahqiqতাহকীক:তাহকীক নিষ্প্রয়োজন