আল জামিউস সহীহ- ইমাম বুখারী রহঃ
৬৪- আদব - শিষ্টাচারের অধ্যায়
হাদীস নং:
আন্তর্জাতিক নং: ৬১৭৩
৩২৫৯. কেউ কাউকে ‘দূর হও’ বলা।
৫৭৪২। আবুল ইয়ামান (রাহঃ) ......... আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, উমর ইবনে খাত্তাব (রাযিঃ) একদল সাহাবীসহ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর সঙ্গে ইবনে সাইয়্যাদের নিকট গমন করেন। তারা সেখানে গিয়ে তাকে বনু মাগালার দূর্গের পাশে ছেলেদের সাথে খেলায় মত্ত পেলেন। তখন সে বালেগ হওয়ার কাছাকাছি বয়সে পৌঁছেছে। সে নবী (ﷺ) এর আগমন টের পেল না, যতক্ষণ না রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁর হাত দিয়ে তার পিঠে মারলেন। তারপর তিনি বললেনঃ তুমি কি সাক্ষ্য দাও যে, আমিই আল্লাহর রাসূল? তখন সে নবী (ﷺ) এর দিকে তাকিয়ে বললঃ আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আপনি উম্মি সম্প্রদায়ের রাসূল। এরপর ইবনে সাইয়্যাদ বললঃ আপনি কি সাক্ষ্য দিচ্ছেন যে, আমিই আল্লাহর রাসূল? রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাকে ধাক্কা মেরে বললেন, আমি আল্লাহ ও তার রাসূলদের উপর ঈমান রাখি।
তারপর আবার তিনি ইবনে সাইয়্যাদকে জিজ্ঞাসা করলেনঃ তুমি কী দেখতে পাও? সে বললঃ আমার নিকট সত্যবাদী ও মিথ্যাবাদী উভয়ই আসেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেনঃ বিষয়টি তোমার উপর এলোমেলো করে দেয়া হয়েছে। এরপর নবী (ﷺ) তাকে বললেনঃ আমি তোমার (পরীক্ষার) জন্য কিছু গোপন রাখছি। সে বললঃ তা ‘দুখ’। তখন তিনি বললেনঃ দূর হও। তুমি কখনো তোমার ভাগ্যকে অতিক্রম করতে পারবে না। উমর (রাযিঃ) বললেনঃ ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি কি তার ব্যাপারে আমাকে অনুমতি দেন যে, আমি তার গর্দান উড়িয়ে দেই। তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেনঃ এ যদি সেই (দাজ্জালই) হয়ে থাকে, তবে তার উপর তোমাকে ক্ষমতা দেওয়া হবে না। আর এ যদি সে না হয়ে থাকে, তবে তাকে হত্যা করা তোমার জন্যই ভাল হবে না।
সালিম (রাহঃ) বলেনঃ এরপর আমি আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রাযিঃ) কে বলতে শুনেছি যে, এ ঘটনার পর একদিন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এবং উবাই ইবনে কা'ব (রাযিঃ) সেই খেজুর বাগানের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেন, যেখানে ইবনে সাইয়্যাদ ছিল। অবশেষে যখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বাগানে প্রবেশ করলেন, তখন তিনি খেজুরের কাণ্ডের আড়ালে আড়ালে চলতে লাগলেন। তার লক্ষ্য ছিল যে, ইবনে সাইয়্যাদ তাকে দেখার আগেই যেন তিনি তার কিছু কথাবার্তা শুনে নিতে পারেন। এ সময় ইবনে সাইয়্যাদ তার বিছানায় একখানা চাঁদর মুড়ি দিয়ে শুয়েছিল। আর তার চাদরের ভেতর থেকে বিড়বিড় শব্দ শোনা যাচ্ছিল। ইতিমধ্যে ইবনে সাইয়্যাদের মা নবী (ﷺ) কে দেখল যে, তিনি খেজুরের কাণ্ডের আড়ালে লুকিয়ে লুকিয়ে আসছেন। তখন তার মা তাকে ডেকে বললোঃ ওহে সাফ! –এটা তার ডাক নাম ছিল– এই যে মুহাম্মাদ (ﷺ)। তখন ইবনে সাইয়্যাদ (যে বিষয়ে মগ্ন ছিল তা থেকে) বিরত হল। তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেনঃ যদি তার মা তাকে সতর্ক না করত, তবে তার (রহস্য) প্রকাশ পেয়ে যেত।
রাবী সালিম রাহঃ আরও বলেনঃ আব্দুল্লাহ (রাযিঃ) বর্ণনা করেছেন যে, একদিন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সাহাবাদের মধ্যে দাঁড়িয়ে আল্লাহ তাআলার যথোপযুক্ত প্রশংসার পর দাজ্জালের উল্লেখ করে বললেনঃ আমি তোমাদের তার সম্পর্কে সতর্ক করে দিচ্ছি। প্রত্যেক নবীই এর সম্পর্কে তার কওমকে সতর্ক করে গিয়েছেন। আমি এর সম্পর্কে এমন কথা বলছি, যা অন্যকোন নবী তার কওমকে বলেননি। তোমরা জেনে রাখ, সে কানা; কিন্তু আল্লাহ তাআলা কানা নন।
তারপর আবার তিনি ইবনে সাইয়্যাদকে জিজ্ঞাসা করলেনঃ তুমি কী দেখতে পাও? সে বললঃ আমার নিকট সত্যবাদী ও মিথ্যাবাদী উভয়ই আসেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেনঃ বিষয়টি তোমার উপর এলোমেলো করে দেয়া হয়েছে। এরপর নবী (ﷺ) তাকে বললেনঃ আমি তোমার (পরীক্ষার) জন্য কিছু গোপন রাখছি। সে বললঃ তা ‘দুখ’। তখন তিনি বললেনঃ দূর হও। তুমি কখনো তোমার ভাগ্যকে অতিক্রম করতে পারবে না। উমর (রাযিঃ) বললেনঃ ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি কি তার ব্যাপারে আমাকে অনুমতি দেন যে, আমি তার গর্দান উড়িয়ে দেই। তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেনঃ এ যদি সেই (দাজ্জালই) হয়ে থাকে, তবে তার উপর তোমাকে ক্ষমতা দেওয়া হবে না। আর এ যদি সে না হয়ে থাকে, তবে তাকে হত্যা করা তোমার জন্যই ভাল হবে না।
সালিম (রাহঃ) বলেনঃ এরপর আমি আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রাযিঃ) কে বলতে শুনেছি যে, এ ঘটনার পর একদিন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এবং উবাই ইবনে কা'ব (রাযিঃ) সেই খেজুর বাগানের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেন, যেখানে ইবনে সাইয়্যাদ ছিল। অবশেষে যখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বাগানে প্রবেশ করলেন, তখন তিনি খেজুরের কাণ্ডের আড়ালে আড়ালে চলতে লাগলেন। তার লক্ষ্য ছিল যে, ইবনে সাইয়্যাদ তাকে দেখার আগেই যেন তিনি তার কিছু কথাবার্তা শুনে নিতে পারেন। এ সময় ইবনে সাইয়্যাদ তার বিছানায় একখানা চাঁদর মুড়ি দিয়ে শুয়েছিল। আর তার চাদরের ভেতর থেকে বিড়বিড় শব্দ শোনা যাচ্ছিল। ইতিমধ্যে ইবনে সাইয়্যাদের মা নবী (ﷺ) কে দেখল যে, তিনি খেজুরের কাণ্ডের আড়ালে লুকিয়ে লুকিয়ে আসছেন। তখন তার মা তাকে ডেকে বললোঃ ওহে সাফ! –এটা তার ডাক নাম ছিল– এই যে মুহাম্মাদ (ﷺ)। তখন ইবনে সাইয়্যাদ (যে বিষয়ে মগ্ন ছিল তা থেকে) বিরত হল। তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেনঃ যদি তার মা তাকে সতর্ক না করত, তবে তার (রহস্য) প্রকাশ পেয়ে যেত।
রাবী সালিম রাহঃ আরও বলেনঃ আব্দুল্লাহ (রাযিঃ) বর্ণনা করেছেন যে, একদিন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সাহাবাদের মধ্যে দাঁড়িয়ে আল্লাহ তাআলার যথোপযুক্ত প্রশংসার পর দাজ্জালের উল্লেখ করে বললেনঃ আমি তোমাদের তার সম্পর্কে সতর্ক করে দিচ্ছি। প্রত্যেক নবীই এর সম্পর্কে তার কওমকে সতর্ক করে গিয়েছেন। আমি এর সম্পর্কে এমন কথা বলছি, যা অন্যকোন নবী তার কওমকে বলেননি। তোমরা জেনে রাখ, সে কানা; কিন্তু আল্লাহ তাআলা কানা নন।
হাদীসের ব্যাখ্যা:
দাজ্জাল সম্পর্কে সতর্কীকরণ
বিদায় হজ্জের দীর্ঘ ভাষণে নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিভিন্ন জরুরি বিষয় সম্পর্কে আলোচনা করেন। তার মধ্যে একটা ছিল দাজ্জাল সম্পর্কে সতর্ক করা ও তার কিছু আলামত বলে দেওয়া।
দাজ্জালকে ‘মাসীহুদ-দাজ্জাল' বলা হয়ে থাকে। ‘মাসীহ' শব্দের বিভিন্ন অর্থ আছে, যেমন- অত্যধিক ভ্রমণকারী, হাতের স্পর্শে রোগ নিরাময়কারী। দাজ্জালের মধ্যে এ দু'টি বিশেষত্ব থাকবে। হযরত ঈসা আলাইহিস সালামকেও মাসীহ বলা হয়ে থাকে। কেননা তিনিও দাওয়াতী কাজে খুব সফর করতেন এবং তাঁর হাতের স্পর্শে অন্ধ ও কুষ্ঠ রোগী নিরাময় লাভ করত। এদিক থেকে দাজ্জালের সঙ্গে হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের সাদৃশ্য আছে। তাই তো দাজ্জালকে বধ করার জন্য হযরত ঈসা আলাইহিস সালামকে এখনও পর্যন্ত আসমানে জীবিত ও নিরাপদ রাখা হয়েছে। দাজ্জালের আবির্ভাবের পর তাঁকে দুনিয়ায় পাঠানো হবে। তাঁর হাতেই দাজ্জালের বিনাশ ঘটবে।
'মাসীহ'-এর আরেক অর্থ- যা মুছে ফেলা হয়েছে। দাজ্জালের ডান চোখের স্থান মুছে ফেলা। অর্থাৎ সেখানে চোখ নেই। জায়গাটি সম্পূর্ণ ভরাট, সমতল। তার থাকবে শুধু বাম চোখ। তাও উপরের দিকে তোলা।
নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম দাজ্জালের চোখকে এমন একটি আঙ্গুরদানার সাথে তুলনা করেছেন, যে দানাটি সন্নিবদ্ধ আঙ্গুর থোকার ওপর আলাদাভাবে ভাসমান। এমনিই ডান চোখ নেই। সে জায়গাটি চামড়া দিয়ে ঢাকা সম্পূর্ণ সমতল। আছে কেবল বাম চোখ। তাও এভাবে উপরে তোলা। তিনি জানানঃ-
إنَّ ربكم ليس بأعور، وإنه أعور عين اليمنى، كأن عينه عنبة طافية
তোমাদের প্রতিপালক কানা নন, অথচ সে হবে ডান চোখের কানা। তার চোখ যেন (আঙ্গুরের থোকার) উপরে ভেসে থাকা একটি আঙ্গুর।
এই যার চোখের অবস্থা, দেখতে সে কতই না কুৎসিত ও বীভৎস হবে! নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দাজ্জালের এই বিদঘুটে রূপটির প্রতি বিশেষভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন এ কারণে যে, দাজ্জাল অনেক তেলেসমাতি দেখাবে- মৃতকে জীবিত করবে, বৃষ্টি নামিয়ে দেখাবে, আবার বৃষ্টি বন্ধ করে খরার অবস্থা বানাবে, সঙ্গে জান্নাত ও জাহান্নামের আকৃতি রাখবে আর এসবের ভিত্তিতে নিজেকে আল্লাহ বলে দাবি করবে। তো ঈমানদার ব্যক্তি যাতে এসব দেখে বিভ্রান্ত না হয়, তাই বিশেষভাবে বিদঘুটে চোখের আলামতটি উল্লেখ করে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলছেন- সে যদি তোমাদের মধ্যে আত্মপ্রকাশ করে, তবে তার অবস্থা সম্পর্কে তোমাদের যা-কিছুই অজানা থাকুক না কেন, এ বিষয়টা তো অজানা থাকতে পারে না যে, তোমাদের প্রতিপালক কানা নন, অথচ সে হবে ডান চোখের কানা। তার চোখ যেন (আঙ্গুরের থোকার) উপরে ভেসে থাকা একটি আঙ্গুর।
বস্তুত দাজ্জালের ফিতনা হবে অত্যন্ত ভয়ংকর। আল্লাহ তা'আলা যাকে হেফাজত করবেন কেবল সে-ই তার ফিতনা থেকে বাঁচতে পারবে। তার ফিতনা এমনকি কবরবাসীদেরকেও স্পর্শ করবে। এজন্যই হযরত নূহ আলাইহিস সালাম থেকে পরবর্তী সমস্ত নবী-রাসূল আপন আপন উম্মতকে তার ব্যাপারে সতর্ক করেছেন। তবে আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার ব্যাপারে সর্বাপেক্ষা বেশি স্পষ্ট ধারণা দিয়েছেন। তার আলামতসমূহের মধ্যে একটা বিশেষ আলামত এই যে, তার কপালে ك ف ر লেখা থাকবে। তা দেখে মু'মিনগণ বুঝে ফেলবে যে, সে এক ঘোর কাফের। যার কুফর এতই পূর্ণাঙ্গ ও বলিষ্ঠ যে, তার আছর অন্তর ও দেহের স্থূলতা ভেদ করে কপালেও পরিস্ফুট হবে। মোটকথা কেউ যাতে তার ফিতনায় পড়ে ঈমান না হারায় সেজন্য তিনি তার আলামতসমূহ পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিয়েছেন। আমাদেরকে তার ফিতনা থেকে বাঁচার দু'আও শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। যেমন একটি দু'আ হচ্ছে-
«اللهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنْ عَذَابِ الْقَبْرِ، وَأَعُوذُ بِكَ مِنْ عَذَابِ النَّارِ، وَأَعُوذُ بِكَ مِنْ فِتْنَةِ الْمَسِيحِ الدَّجَّالِ ، وَأَعُوذُ بِكَ مِنَ فِتْنَةِ الْمَحْيَا وَالْمَمَاتِ»
হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে আশ্রয় চাই কবরের আযাব থেকে, আপনার কাছে আশ্রয় চাই জাহান্নামের আযাব থেকে, আপনার কাছে আশ্রয় চাই মাসীহুদ-দাজ্জালের ফিতনা থেকে এবং আপনার কাছে আশ্রয় চাই জীবন ও মৃত্যুর যাবতীয় ফিতনা থেকে। (সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৮৩২; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ৫৮৮; সুনানে আবু দাউদ, হাদীছ নং ৮৮০; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ৩৪৯৪; সুনানে নাসাঈ, হাদীছ নং ১৩০৯; সুনানে ইবন মাজাহ, হাদীছ নং ৯০৯; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ২১৬৭)
এ দু'আটি নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেও পড়তেন। এক হাদীছে তিনি ইরশাদ করেনঃ-
من حفظ عشر آيات من أول سورة الكهف، عصم من فتنة الدجال
যে ব্যক্তি সূরা কাহফের প্রথম দশ আয়াত মুখস্থ করবে, তাকে দাজ্জালের ফিতনা থেকে রক্ষা করা হবে। (সহীহ মুসলিম,হাদীছ নং ৮০৯; সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ৪৩২৩; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ৩১০৫; নাসাঈ, হাদীছ নং ৮০২৫; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ২১৭১২; মুস্তাদরাক হাকিম, হাদীছ নং ৩৩৯১: শু'আবুল ঈমান, হাদীছ নং ৬৬৮৩)
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. কিয়ামতের আগে দাজ্জালের আবির্ভাব ঘটবে। তাঁর ফিতনা সম্পর্কে নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন, এটা সত্য। এতে বিশ্বাস রাখতে হবে।
বিদায় হজ্জের দীর্ঘ ভাষণে নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিভিন্ন জরুরি বিষয় সম্পর্কে আলোচনা করেন। তার মধ্যে একটা ছিল দাজ্জাল সম্পর্কে সতর্ক করা ও তার কিছু আলামত বলে দেওয়া।
দাজ্জালকে ‘মাসীহুদ-দাজ্জাল' বলা হয়ে থাকে। ‘মাসীহ' শব্দের বিভিন্ন অর্থ আছে, যেমন- অত্যধিক ভ্রমণকারী, হাতের স্পর্শে রোগ নিরাময়কারী। দাজ্জালের মধ্যে এ দু'টি বিশেষত্ব থাকবে। হযরত ঈসা আলাইহিস সালামকেও মাসীহ বলা হয়ে থাকে। কেননা তিনিও দাওয়াতী কাজে খুব সফর করতেন এবং তাঁর হাতের স্পর্শে অন্ধ ও কুষ্ঠ রোগী নিরাময় লাভ করত। এদিক থেকে দাজ্জালের সঙ্গে হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের সাদৃশ্য আছে। তাই তো দাজ্জালকে বধ করার জন্য হযরত ঈসা আলাইহিস সালামকে এখনও পর্যন্ত আসমানে জীবিত ও নিরাপদ রাখা হয়েছে। দাজ্জালের আবির্ভাবের পর তাঁকে দুনিয়ায় পাঠানো হবে। তাঁর হাতেই দাজ্জালের বিনাশ ঘটবে।
'মাসীহ'-এর আরেক অর্থ- যা মুছে ফেলা হয়েছে। দাজ্জালের ডান চোখের স্থান মুছে ফেলা। অর্থাৎ সেখানে চোখ নেই। জায়গাটি সম্পূর্ণ ভরাট, সমতল। তার থাকবে শুধু বাম চোখ। তাও উপরের দিকে তোলা।
নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম দাজ্জালের চোখকে এমন একটি আঙ্গুরদানার সাথে তুলনা করেছেন, যে দানাটি সন্নিবদ্ধ আঙ্গুর থোকার ওপর আলাদাভাবে ভাসমান। এমনিই ডান চোখ নেই। সে জায়গাটি চামড়া দিয়ে ঢাকা সম্পূর্ণ সমতল। আছে কেবল বাম চোখ। তাও এভাবে উপরে তোলা। তিনি জানানঃ-
إنَّ ربكم ليس بأعور، وإنه أعور عين اليمنى، كأن عينه عنبة طافية
তোমাদের প্রতিপালক কানা নন, অথচ সে হবে ডান চোখের কানা। তার চোখ যেন (আঙ্গুরের থোকার) উপরে ভেসে থাকা একটি আঙ্গুর।
এই যার চোখের অবস্থা, দেখতে সে কতই না কুৎসিত ও বীভৎস হবে! নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দাজ্জালের এই বিদঘুটে রূপটির প্রতি বিশেষভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন এ কারণে যে, দাজ্জাল অনেক তেলেসমাতি দেখাবে- মৃতকে জীবিত করবে, বৃষ্টি নামিয়ে দেখাবে, আবার বৃষ্টি বন্ধ করে খরার অবস্থা বানাবে, সঙ্গে জান্নাত ও জাহান্নামের আকৃতি রাখবে আর এসবের ভিত্তিতে নিজেকে আল্লাহ বলে দাবি করবে। তো ঈমানদার ব্যক্তি যাতে এসব দেখে বিভ্রান্ত না হয়, তাই বিশেষভাবে বিদঘুটে চোখের আলামতটি উল্লেখ করে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলছেন- সে যদি তোমাদের মধ্যে আত্মপ্রকাশ করে, তবে তার অবস্থা সম্পর্কে তোমাদের যা-কিছুই অজানা থাকুক না কেন, এ বিষয়টা তো অজানা থাকতে পারে না যে, তোমাদের প্রতিপালক কানা নন, অথচ সে হবে ডান চোখের কানা। তার চোখ যেন (আঙ্গুরের থোকার) উপরে ভেসে থাকা একটি আঙ্গুর।
বস্তুত দাজ্জালের ফিতনা হবে অত্যন্ত ভয়ংকর। আল্লাহ তা'আলা যাকে হেফাজত করবেন কেবল সে-ই তার ফিতনা থেকে বাঁচতে পারবে। তার ফিতনা এমনকি কবরবাসীদেরকেও স্পর্শ করবে। এজন্যই হযরত নূহ আলাইহিস সালাম থেকে পরবর্তী সমস্ত নবী-রাসূল আপন আপন উম্মতকে তার ব্যাপারে সতর্ক করেছেন। তবে আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার ব্যাপারে সর্বাপেক্ষা বেশি স্পষ্ট ধারণা দিয়েছেন। তার আলামতসমূহের মধ্যে একটা বিশেষ আলামত এই যে, তার কপালে ك ف ر লেখা থাকবে। তা দেখে মু'মিনগণ বুঝে ফেলবে যে, সে এক ঘোর কাফের। যার কুফর এতই পূর্ণাঙ্গ ও বলিষ্ঠ যে, তার আছর অন্তর ও দেহের স্থূলতা ভেদ করে কপালেও পরিস্ফুট হবে। মোটকথা কেউ যাতে তার ফিতনায় পড়ে ঈমান না হারায় সেজন্য তিনি তার আলামতসমূহ পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিয়েছেন। আমাদেরকে তার ফিতনা থেকে বাঁচার দু'আও শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। যেমন একটি দু'আ হচ্ছে-
«اللهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنْ عَذَابِ الْقَبْرِ، وَأَعُوذُ بِكَ مِنْ عَذَابِ النَّارِ، وَأَعُوذُ بِكَ مِنْ فِتْنَةِ الْمَسِيحِ الدَّجَّالِ ، وَأَعُوذُ بِكَ مِنَ فِتْنَةِ الْمَحْيَا وَالْمَمَاتِ»
হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে আশ্রয় চাই কবরের আযাব থেকে, আপনার কাছে আশ্রয় চাই জাহান্নামের আযাব থেকে, আপনার কাছে আশ্রয় চাই মাসীহুদ-দাজ্জালের ফিতনা থেকে এবং আপনার কাছে আশ্রয় চাই জীবন ও মৃত্যুর যাবতীয় ফিতনা থেকে। (সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ৮৩২; সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং ৫৮৮; সুনানে আবু দাউদ, হাদীছ নং ৮৮০; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ৩৪৯৪; সুনানে নাসাঈ, হাদীছ নং ১৩০৯; সুনানে ইবন মাজাহ, হাদীছ নং ৯০৯; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ২১৬৭)
এ দু'আটি নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেও পড়তেন। এক হাদীছে তিনি ইরশাদ করেনঃ-
من حفظ عشر آيات من أول سورة الكهف، عصم من فتنة الدجال
যে ব্যক্তি সূরা কাহফের প্রথম দশ আয়াত মুখস্থ করবে, তাকে দাজ্জালের ফিতনা থেকে রক্ষা করা হবে। (সহীহ মুসলিম,হাদীছ নং ৮০৯; সুনানে আবূ দাউদ, হাদীছ নং ৪৩২৩; জামে তিরমিযী, হাদীছ নং ৩১০৫; নাসাঈ, হাদীছ নং ৮০২৫; মুসনাদে আহমাদ, হাদীছ নং ২১৭১২; মুস্তাদরাক হাকিম, হাদীছ নং ৩৩৯১: শু'আবুল ঈমান, হাদীছ নং ৬৬৮৩)
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. কিয়ামতের আগে দাজ্জালের আবির্ভাব ঘটবে। তাঁর ফিতনা সম্পর্কে নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন, এটা সত্য। এতে বিশ্বাস রাখতে হবে।
