আল জামিউস সহীহ- ইমাম বুখারী রহঃ

৬৪- আদব - শিষ্টাচারের অধ্যায়

হাদীস নং:
আন্তর্জাতিক নং: ৬০২৬
৩১৯৮. মু’মিনদের পারস্পরিক সহযোগিতা।
৫৬০১। মুহাম্মাদ ইবনে ইউসুফ (রাহঃ) ......... আবু মুসা (আশআরী) (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত, নবী (ﷺ) বলেছেনঃ মু'মিন মুমিনের জন্য ইমারতের ন্যায়, যার এক অংশ অন্য অংশকে মজবুত করে রাখে। এরপর তিনি (হাতের) আঙ্গুলগুলো (আরেক হাতের) আঙ্গুল (এর ফাঁকে) ঢুকালেন। তখন নবী (ﷺ) উপবিষ্ট ছিলেন। এমন সময় এক ব্যক্তি কিছু প্রশ্ন করার জন্য কিংবা কোন প্রয়োজন পূরণের জন্য এল। তখন নবী (ﷺ) আমাদের দিকে ফিরে তাকালেন এবং বললেনঃ তোমরা তার জন্য (কিছু দেওয়ার) সুপারিশ করো। এতে তোমাদের সাওয়াব দেওয়া হবে। আল্লাহ তার নবীর আবেদন অনুযায়ী যা ইচ্ছা হয় তা করেন।

হাদীসের ব্যাখ্যা:

ঈমান ও ইসলামের বদৌলতে আল্লাহ তা'আলার কাছে একজন লোক অনেক মর্যাদাবান হয়ে যায়। তাঁর কাছে এরকম লোকের জান-মাল-ইজ্জত সবকিছুরই মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়। তিনি চান মানুষ এই মর্যাদা অনুভব করুক ও তা রক্ষায় যত্নবান থাকুক। তাই কুরআন-সুন্নাহর মাধ্যমে ঈমানদারদের এ তিন বস্তুর মর্যাদার প্রতি মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। তাদের হুকুম দেওয়া হয়েছে যেন প্রত্যেকে অন্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকে। যেন প্রত্যেকে অন্যের জান-মাল-ইজ্জতের মর্যাদা রক্ষায় আন্তরিক থাকে। এর জন্যে তাদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ জাগানোরও ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। বারবার ঘোষণা করা হয়েছে এক মুসলিম অপর মুসলিমের ভাই।
কাজেই তারা যেন ভ্রাতৃত্ববোধে উজ্জীবিত থাকে এবং কেউ কারও জান-মাল ইজ্জতের মর্যাদাক্ষুণ্নকারী কোনও কাজে লিপ্ত না হয়। সেরকম কাজে লিপ্ত হওয়ার দ্বারা অন্যের প্রতি জুলুম করা হয়। তাতে জুলুম হয় নিজের প্রতিও। জুলুম করা মহাপাপ। কাজেই একজন অন্যের প্রতি কোনওভাবেই জুলুম করবে না। নিজে জুলুম তো করবেই না। অন্যেও জুলুম করলে সেই ক্ষেত্রে সে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবে। অর্থাৎ মজলুমকে জুলুম থেকে রক্ষা করবে এবং জালেমকেও জুলুম করা হতে বাঁচাবে।
যেহেতু এক মুসলিম অপর মুসলিমের ভাই, তাই কেবল জুলুম থেকে নিবৃত্ত থাকাই যথেষ্ট নয়; বরং একজন আরেকজনের প্রতি স্নেহ-মমতার আচরণ করবে। স্নেহ-মমতার দাবি অন্যের সুখে সুখী হওয়া ও অন্যের দুঃখে দুঃখবোধ করা। অন্যের বিপদে সাহায্য করা এবং তার যে-কোনও অভাব ও প্রয়োজন মেটানোর চেষ্টা করা।অন্যের মান-সম্ভ্রম রক্ষায় ভূমিকা রাখা এবং যে-কোনও অনিষ্ট ও ক্ষতি থেকে তার হেফাজত করা।
এভাবে চলার দ্বারা পরস্পরের মধ্যে ঐক্য-সংহতি প্রতিষ্ঠিত হয়। গড়ে উঠে নিরাপত্তা ও শান্তিপূর্ণ সমাজ। ফলে প্রত্যেকের পক্ষে আল্লাহ তাআলার মর্জি মোতাবেক জীবন যাপন করা সহজ হয়। সুগম হয়—অন্তর্নিহিত প্রতিভা, সম্ভাবনা ও মুনষ্যত্বের বিকাশ ঘটিয়ে আখেরাতের মুক্তি ও আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের পথ।

নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ হাদীছে মুমিনদের পারস্পরিক সাহায্য-সহযোগিতার গুরুত্ব তুলে ধরেছেন। তিনি মুমিনদের সমাজকে প্রাচীরের সঙ্গে তুলনা করে বোঝাচ্ছেন যে, মুমিনগণ তাদের দীন ও দুনিয়া কোনও ক্ষেত্রেই পারস্পরিক সাহায্য-সহযোগিতা ছাড়া সুপ্রতিষ্ঠিত ও শক্তিশালী থাকতে পারে না।
তিনি বিষয়টাকে চাক্ষুষভাবে বোঝানোর জন্য এক হাতের আঙ্গুল অপর হাতের আঙ্গুলের মধ্যে ঢুকিয়ে দেখিয়ে দেন। شبك অর্থ জাল বানালেন। জাল বুনতে যেমন এক সুতার মধ্যে আরেক সুতা ঢুকাতে হয়, তেমনি করে যেহেতু এক হাতের আঙ্গুলগুলোর মধ্যে অপর হাতের আঙ্গুলগুলো ঢুকিয়ে দেখিয়েছিলেন, তাই একে شبك বা 'জাল বুনলেন' শব্দে প্রকাশ করেছেন। দু'হাতের আঙ্গুল দ্বারা জাল বুনলে তা ঠিক প্রাচীরের মতই শক্ত-পোক্ত হয়ে যায়। ফলে প্রাচীরের ইটসমূহের মতই আঙ্গুলগুলো পরস্পর বিচ্ছিন্ন করা সহজ হয় না। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ বাস্তব উদাহরণ দ্বারা দেখিয়ে দিয়েছেন কিভাবে মুমিনদেরকে পরস্পর মিলেমিশে একাকার হয়ে থাকতে হবে।
তিনি প্রাচীরের উদাহরণ দিয়েছেন। কোনও প্রাচীর নির্মাণের জন্য প্রথমে তার ভিত্তি স্থাপন করা হয়, তুলনামূলকভাবে উপর অংশের তুলনায় ভিত্তিকে বেশি মজবুতরূপে গড়ে তোলা হয়। তারপর সে ভিত্তির উপর এক-একটি করে ইট গেঁথে প্রাচীরের নির্মাণকার্য সম্পন্ন করা হয়। প্রাচীরে সবগুলো ইট পরস্পর সন্নিবিষ্ট হয়ে থাকে আর তার একটি দ্বারা অন্যটি এমন সুদৃঢ় হয় যে, সহজে সে প্রাচীর থেকে কোনও একটি ইট পৃথক করা যায় না। কিন্তু ইটগুলো যদি পরস্পর সংযুক্ত না থেকে বরং ফাঁকা ফাঁকা থাকে, তবে প্রাচীর তো নির্মিত হতেই পারে না এবং পৃথকভাবে সেগুলোর কোনও শক্তিও থাকে না, যার যেমনি ইচ্ছা তা সরিয়ে ফেলতে বা নিয়ে যেতে পারে। মুসলিম সমাজের অবস্থাও তদ্রূপ। তাদের মধ্যে কেউ থাকে শক্তিশালী, কেউ দুর্বল। দুর্বলের কর্তব্য শক্তিশালীর সাথে মিশে থাকা আর শক্তিশালীর কর্তব্য দুর্বলকে নিজ পাশে রাখা। এতে করে শক্তিশালীর শক্তি বৃদ্ধি পায় ও দীর্ঘস্থায়ী হয় এবং তার শক্তিতে দুর্বলও শক্তিশালী হয়ে ওঠে। আর এভাবে গোটা সমাজ সুগঠিত ও সুসংহত হয়। তখন কোনও শত্রুর পক্ষে সে সমাজের ক্ষতিসাধন করা সহজ হয় না। এমনকি শত্রুপক্ষ তাদের কোনও দুর্বল ব্যক্তির সঙ্গেও লাগার সাহস করে না। কেননা সংঘবদ্ধ হয়ে থাকার কারণে গোটা সমাজের শক্তি তার সঙ্গে।
অপরদিকে সকল মুসলিম একতাবদ্ধ না থাকলে কেবল দুর্বল ব্যক্তিই দুর্বল হয়ে থাকে না, শত্রুর চোখে সবল ব্যক্তিও দুর্বল হয়ে থাকে। কেননা একা এক ব্যক্তির শক্তি যতই বেশি হোক-না কেন, সংঘবদ্ধ শত্রুর বিরুদ্ধে তা কোনও কাজের নয়। এ কারণেই কুরআন মাজীদ মুমিনদেরকে পরস্পর দ্বন্দ্ব-কলহে লিপ্ত না হয়ে সংঘবদ্ধ হয়ে থাকতে জোর তাগিদ করেছে। ইরশাদ হয়েছেঃ- وَاعْتَصِمُوا بِحَبْلِ اللَّهِ جَمِيعًا وَلَا تَفَرَّقُوا তোমরা সকলে মিলে আল্লাহর রশিকে (অর্থাৎ তাঁর দ্বীন ও কিতাবকে) দৃঢ়ভাবে ধরে রাখ এবং পরস্পরে বিভেদ করো না।
আরও ইরশাদঃ- وَلَا تَنَازَعُوا فَتَفْشَلُوا وَتَذْهَبَ رِيحُكُمْ ‘এবং পরস্পরে কলহ করবে না, অন্যথায় তোমরা দুর্বল হয়ে পড়বে এবং তোমাদের হাওয়া (প্রভাব) বিলুপ্ত হবে।
এসব আয়াতের দাবি হচ্ছে সকল মুসলিম সর্বদা একতাবদ্ধ থাকবে। আত্মকলহেও লিপ্ত হবে না এবং কেউ বিচ্ছিন্ন হয়েও থাকবে না; বরং প্রত্যেকে অন্যের শক্তি যোগাবে ও নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী অন্যের সাহায্য-সহযোগিতা করবে।
পূর্ণাঙ্গ সমাজের জন্য সর্বস্তরের লোকের প্রয়োজনীয়তা
এ হাদীছে প্রাচীরের সঙ্গে তুলনা করে বোঝানো হচ্ছে যে, প্রাচীরের প্রত্যেক অংশ যেমন অন্য অংশকে শক্তি যোগায়, তেমনি প্রত্যেক মুসলিমেরই কর্তব্য অপর মুসলিমকে শক্তি যোগানো। কেউ প্রশ্ন করতে পারে, অন্যকে শক্তি যোগানো তো কেবল শক্তিমানের পক্ষেই সম্ভব; যে ব্যক্তি নিজেই দুর্বল সে কিভাবে অন্যের উপকারে আসবে?
প্রকৃতপক্ষে অন্যের কোনও না কোনও উপকার করা প্রত্যেকের পক্ষেই সম্ভব। কেননা শক্তি-সামর্থ্য বলতে কেবল পেশীশক্তি বা অর্থবলকেই বোঝায় না; বরং এর মধ্যে অনেক ব্যাপকতা রয়েছে। একেকজন মানুষ একেকরকম যোগ্যতা ও একেকরকম ক্ষমতা রাখে। কারও আছে বুদ্ধিবল, কারও বিদ্যাবল, কারও লোকবল, কারও অর্থবল। এমনিভাবে বিভিন্ন রকম কারিগরি-ক্ষমতা, বিচিত্র অভিজ্ঞতা, নানারকম বৃত্তি ও বিবিধ প্রতিভা, এর প্রত্যেকটিই মানুষের জন্য উপকারী ও কল্যাণকর। এমন কোনও ব্যক্তি নেই, যার মধ্যে এই বিবিধপ্রকার কল্যাণকর গুণের কোনও একটিও বিদ্যমান নেই। প্রত্যেকেই নিজের মধ্যে দৃষ্টিপাত করলে অন্যের উপকারে আসে এমন কোনও না কোনও যোগ্যতা ও ক্ষমতা পাবেই এবং সে ক্ষমতাটি এমন যে, একটি পূর্ণাঙ্গ সমাজের জন্য তা অতীব প্রয়োজন। একজন কামার তার পেশাজনিত যোগ্যতা ব্যবহার না করলে অন্যসব লোকের যে বহু প্রয়োজনীয় কাজ আটকে যাবে এবং তাদেরকে কঠিন জটিলতার সম্মুখীন হতে হবে– এ কথা প্রত্যেকেই স্বীকার করতে বাধ্য। কাজেই এ পেশার লোক সমাজের অবশিষ্ট লোকদের পক্ষে পরম উপকারী বৈকি। বাহ্যদৃষ্টিতে তাদেরকে যতই দুর্বল ভাবা হোক-না কেন, বাস্তবিকপক্ষে সামাজিক সচলতায় তারাও বিশেষ ধরনের শক্তি যুগিয়ে থাকে। সুতরাং এ হাদীছের মর্মার্থ তাদেরকেও শামিল করে।
ইমাম রাগিব রহ. বলেন, পৃথিবীতে জীবনধারণের জন্য কোনও ব্যক্তির যা-কিছু প্রয়োজন, তার সবটা তার নিজের একার পক্ষে যোগানো সম্ভব নয়। সেজন্য অন্যদের সহযোগিতা তার লাগবেই। এক লোকমা খাবার সংগ্রহ করতে প্রথমে জমি চাষাবাদ করতে হয়, সেখানে ফসল বুনতে হয়, তারপর ফসল কাটা, তা মাড়াই করা, তা পেষাই করা, তারপর রুটি তৈরি করা, এর জন্য যেসকল আসবাব-উপকরণ ও সরঞ্জামাদি
দরকার তা তৈরি করা ইত্যাদি যত কাজের প্রয়োজন তা হিসাব করে শেষ করাও তো কঠিন। কোন ব্যক্তির পক্ষে একা তা সব আঞ্জাম দেওয়া সম্ভব? এজন্যই বলা হয়, মানুষ স্বভাবগতভাবেই সামাজিক জীব। সমষ্টি থেকে পৃথক হয়ে একা জীবনযাপন কারও পক্ষেই সম্ভব নয়। দুনিয়া ও আখেরাত উভয় জগতের প্রয়োজন ও চাহিদা পূরণে প্রত্যেকেই অন্যের মুখাপেক্ষী। এ হাদীছ সেদিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
ইমাম নববী রহ. এ হাদীছটি মুসলমানদের পারস্পরিক মান-সম্ভ্রমের প্রতি মর্যাদা প্রদর্শন সম্পর্কিত অধ্যায়ে উল্লেখ করেছেন। এ হাদীছ দ্বারা পরোক্ষভাবে তা প্রমাণিত হয়। কেননা মুমিনগণ যখন পরস্পর প্রাচীরস্বরূপ, যাদের কর্তব্য একে অন্যকে শক্তিশালী করা ও একে অন্যের সাহায্য-সহযোগিতায় লিপ্ত থাকা, তখন তাদের একজন দ্বারা অন্যের জান-মাল ও ইজ্জতের ক্ষয়ক্ষতি করার তো প্রশ্নই আসে না; বরং প্রত্যেকে অন্যের জান-মাল ও ইজ্জতের হেফাজতে যত্নবান থাকবে। কেউ কারও কোনও প্রকার হক নষ্ট করবে না; বরং সর্বপ্রকার হক আদায়ে সদা সচেষ্ট থাকবে। অন্য কারও পক্ষ থেকে কোনও মুসলিমের প্রতি বিদ্বেষমূলক আচরণ করা হলে সকল মুসলিম তার পাশে দাঁড়াবে। যে-কোনও মুসলিমের জান-মাল বা ইজ্জতের উপর শত্রুর আক্রমণকে সকলে মিলে প্রতিহত করবে।

اشفعوا (সুপারিশ করো)-এর উৎপত্তি الشفاعة । (শাফাআত) থেকে। শাফাআতের অর্থ ও এ সম্পর্কিত জরুরি ব্যাখ্যা ভূমিকায় চলে গেছে। এ হাদীছে প্রথমত সুপারিশের আদেশ করা হয়েছে, দ্বিতীয়ত এর ফযীলত বয়ান করা হয়েছে এবং তৃতীয়ত এর হাকীকতের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে।
সুপারিশের আদেশ করে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ কাজটিকে তাঁর শরীআতের একটি ঐচ্ছিক অঙ্গ বানিয়ে দিয়েছেন। কারও সুপারিশের প্রয়োজন হয় বিভিন্ন কারণে। কেউ যখন অর্থসংকটে পড়ে, তখন আর্থিক অনুদান বা ঋণ গ্রহণের জন্য অনেক সময় সুপারিশের দরকার হয়। যার কাছে তা পাওয়া যাবে, তার কাছে সে নিজে সরাসরি যেতে পারে না। এ অবস্থায় তার কাছে যার যাতায়াত আছে বা তার সঙ্গে যার সুসম্পর্ক আছে, তাকে সুপারিশের জন্য ধরা হয়। সে বলে দিলে ওই ব্যক্তি তাকে ঋণ বা আর্থিক অনুদান দেবে বলে আশা আছে। এমনিভাবে এটা প্রয়োজন হয় মিথ্যা মামলায় সুবিচারের জন্য, প্রয়োজন হয় চাকরি-বাকরি বা কোনও কাজ পাওয়ার জন্য। এমনকি সুপারিশ প্রয়োজন হয় বেচাকেনা, বিবাহশাদি ইত্যাদিতেও। যে-কোনও ঠ্যাকার ক্ষেত্রে যার দ্বারা সেই ঠ্যাকার সমাধান হতে পারে, নিজে সরাসরি তার কাছে পৌঁছার সুযোগ না পেলে বা নিজ কথায় কাজ না হলে তখন মানুষ উপযুক্ত ব্যক্তির সুপারিশ কামনা করে। সে সুপারিশ করলে তার কাজটি হয়ে যায়, অন্যথায় তার পেরেশানি চলতে থাকে। এক মুমিন আরেক মুমিনের ভাই। তাই প্রত্যেকের কর্তব্য অন্যের পেরেশানিকে নিজ পেরেশানি গণ্য করা। যদি মুখের একটি কথা দ্বারা অন্যের পেরেশানি দূর হওয়ার আশা থাকে, এক মুমিন তা করবে না কেন? এ হাদীছে তাই উৎসাহ দেওয়া হয়েছে যে, তোমরা তোমাদের অভাবগ্রস্ত বা বিপদগ্রস্ত ভাইয়ের জন্য সুপারিশ করো।
সুপারিশ করার দ্বারা কারও উপকার হওয়ার আশা থাকলে নৈতিকভাবেই তা করা বাঞ্ছনীয় হয়ে যায়। তা ঈমানেরও দাবি। কাজেই একজন আদর্শ মুমিন তা করবে বৈকি। তবে যেহেতু এটা ফরয-ওয়াজিব নয়, তাই হয়তো কেউ সুপারিশের প্রয়োজন থাকা সত্ত্বেও তা করতে আগ্রহ দেখাবে না। এরূপ লোককে আগ্রহী করে তোলার জন্য হাদীছে সুপারিশ করার ফায়দাও বলে দেওয়া হয়েছে। বলাবাহুল্য আমাদের মহান দীন কোনও কাজে আগ্রহী করে তোলার লক্ষ্যে সাধারণত পরকালীন ফায়দাই বর্ণনা করে থাকে। এ ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন- تؤجروا - (তোমরা প্রতিদান পাবে)। অর্থাৎ সরাসরি প্রয়োজনগ্রস্ত ব্যক্তির প্রয়োজন মেটানোর দ্বারা যেই ছাওয়াব পাওয়া যায়, সুপারিশ করার দ্বারা তোমরাও অনুরূপ ছাওয়াবের অধিকারী হয়ে যাবে, তাতে তোমাদের সুপারিশ গৃহীত হোক বা নাই হোক।
হযরত মুআবিয়া রাযি. সম্পর্কে বর্ণিত আছে যে, তিনি তাঁর কাছে কোনও অভাবী বা বিপদগ্রস্ত লোক সাহায্যের জন্য আসলে তিনি সাহায্য করতে বিলম্ব করতেন, সঙ্গে সঙ্গেই তিনি তার আবেদন মঞ্জুর করতেন না। তিনি নিজেই এর কারণ ব্যাখ্যা করেন যে, আমি বিলম্ব করি এই ইচ্ছায় যে, তোমরা তার জন্য আমার কাছে সুপারিশ করবে। কেননা সুপারিশ করার দ্বারা ছাওয়াব পাওয়া যায়। এই বলে তিনি আলোচ্য হাদীছটি বর্ণনা করেন। এভাবে অন্যকে ছাওয়াব অর্জনের সুযোগ দান করাটা ছিল তাঁর এক মহত্ত্ব।
তৃতীয় পর্যায়ে হাদীছটিতে সুপারিশের হাকীকতের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। বলা হয়েছে- ويقضي الله على لسان نبيه ما أحب (আল্লাহ যা পসন্দ করেন, তাঁর নবীর জবানিতে তারই ফয়সালা করবেন)। অর্থাৎ তোমরা যা সুপারিশ করবে তাই হবে। এমন কোনও কথা নেই। হবে তাই, যা আল্লাহ চান। তিনি তাঁর নবীকে দিয়ে নিজ মর্জি মোতাবেক ফয়সালা করাবেন। তোমাদের সুপারিশে তার কোনও নড়চড় হবে না। তা সত্ত্বেও তোমরা সুপারিশ করবে। তা করবে এজন্য যে, তাতে নিজ ভাইয়ের প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ পাবে আর এ কারণে আল্লাহ তাআলা তোমাদেরকে আজর ও ছাওয়াব দান করবেন।
আল্লাহর ফয়সালা যেহেতু তোমাদের সুপারিশের উপর নির্ভরশীল নয় আবার তোমাদের সুপারিশও বৃথা যায় না, তোমরা ছাওয়াব ঠিকই পেয়ে যাও, তাই ফয়সালা যাই হোক তাতে তোমাদের সন্তুষ্ট থাকা চাই। কেন সুপারিশ মোতাবেক কাজ করা হল না, এই আপত্তি তোলা বাঞ্ছনীয় নয়। এর দ্বারা ফায়দা তো কিছু হয়ই না, উল্টো তাতে সুপারিশটি মন্দ সুপারিশ হয়ে যায় এবং ছাওয়াব নষ্ট হয়।
এস্থলে যে বলা হয়েছে আল্লাহ তাঁর রাসূলের মাধ্যমে নিজ পসন্দমত ফয়সালা করিয়ে থাকেন, এ কথাটি কেবল রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং এটি সর্বকালীন বিধান। প্রত্যেক সুপারিশকারীকেই সুপারিশকালে মনে রাখতে হবে যে, আমার সুপারিশ মোতাবেক কাজ হওয়া জরুরি নয়; হবে সেটাই, যা আল্লাহ চান। কাজেই আমি যার কাছে সুপারিশ করছি তিনি আমার সুপারিশ রাখলেও আমি খুশি থাকব, না রাখলেও খুশি থাকব। কোনও অবস্থায়ই তার উপর চাপ সৃষ্টি করব না ও নাখোশ হব না। ব্যস এটাই সুপারিশের হাকীকত যে, এর দ্বারা মুমিন ব্যক্তিকে মানবিকতাবোধে উজ্জীবিত করা ও আখেরাতের পুরস্কারে ভূষিত করা উদ্দেশ্য। এটা কোনও বাধ্যতামূলক বিষয় নয়, যা রক্ষা করা অবশ্যকর্তব্য।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. এ হাদীছ মুমিনদেরকে সর্বাবস্থায় একতাবদ্ধ হয়ে থাকার জোর তাকিদ দেয়।

খ. এর দ্বারা শিক্ষা পাওয়া যায় যে, একতাবদ্ধ হয়ে থাকার দ্বারা সামাজিক শক্তি অর্জিত হয় আর এতে করে সমাজের প্রত্যেকের পক্ষে তার জান, মাল ও ইজ্জতের হেফাজত করা সহজ হয়।

গ. এ হাদীছ যেহেতু সকলকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে থাকতে তাকিদ করেছে, তাই এর দ্বারা এ শিক্ষাও লাভ হয় যে, সকলকে ঐক্য পরিপন্থী যে-কোনও কাজ থেকে দূরে থাকতে হবে।

ঘ. জান, মাল ও ইজ্জতের নিরাপত্তা লাভ করা প্রত্যেকের সামাজিক অধিকার। এতে অন্যায় হস্তক্ষেপ সম্পূর্ণ হারাম। এর দ্বারা ঐক্য ও সংহতি বিনষ্ট হয়। তাই প্রত্যেকের এর থেকে বিরত থাকা অবশ্যকর্তব্য।

ঙ. ঐক্যবদ্ধ হয়ে থাকার এক দাবি এটাও যে, প্রত্যেকে তার সাধ্যমত অপরের সাহায্য-সহযোগিতা করে যাবে এবং একজনের দুঃখ-কষ্ট সকলে ভাগাভাগি করে নেবে।

চ. এ হাদীছ দ্বারা এ শিক্ষাও পাওয়া যায় যে, উপযুক্ত উদাহরণ বা দৃষ্টান্ত কোনও বিষয়বস্তু সহজে বোঝার পক্ষে সহায়ক হয়ে থাকে। কাজেই শিক্ষক বা উপদেশদাতা প্রয়োজনে এ নীতি অবলম্বন করতে পারে।

ছ. সুপারিশ করা একটি মহৎ কাজ। এর দ্বারা আখেরাতের প্রভূত ছাওয়াব লাভ করা যায়।

জ. সুপারিশ রক্ষা করা বাধ্যতামূলক নয়। কাজেই যার কাছে সুপারিশ করা হবে, তার সে অনুযায়ী কাজ করা বা না করা উভয় এখতিয়ারই থাকে।

ঝ. সুপারিশকালে তা রক্ষার জন্য চাপ সৃষ্টি করা বাঞ্ছনীয় নয়। তাতে সুপারিশের মহিমা ক্ষুণ্ণ হয়।

ঞ. সুপারিশ রক্ষা করা না হলে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করা উচিত নয়। কেননা আখেরাতের প্রতিদান পাওয়াই এর একমাত্র লক্ষ্য। সুপারিশ রক্ষা করা না হলেও সে প্রতিদান ঠিকই পাওয়া যাবে। কাজেই সুপারিশ না রাখায় সুপারিশ করা বৃথা যায়নি।
tahqiqতাহকীক:তাহকীক নিষ্প্রয়োজন