আল জামিউস সহীহ- ইমাম বুখারী রহঃ

৬৪- আদব - শিষ্টাচারের অধ্যায়

হাদীস নং:
আন্তর্জাতিক নং: ৬০১১
৩১৮৯. মানুষ ও পশুর প্রতি দয়া।
৫৫৮৬। আবু নুআয়ম (রাহঃ) ......... নু'মান ইবনে বশীর (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ তুমি মু’মিনদের পারস্পরিক দয়া, ভালবাসা ও সহানুভূতি প্রদর্শনে একটি দেহের ন্যায় দেখতে পাবে। যখন দেহের একটি অঙ্গ রোগে আক্রান্ত হয়, তখন শরীরের সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ রাত জাগে এবং জ্বরে অংশ গ্রহণ করে।

হাদীসের ব্যাখ্যা:

تواد — تراحم ---- تعاطف এ শব্দ তিনটি কাছাকাছি অর্থের। তবে সূক্ষ্ম পার্থক্যও আছে। যেমন تواد -এর অর্থ পরস্পরে এমন আচরণ করা, যা অন্তরে ভালোবাসা সঞ্চার করে, যেমন একে অন্যের সঙ্গে সাক্ষাত করা, হাদিয়া বিনিময় করা ইত্যাদি। تراحم -এর অর্থ হচ্ছে কেবল ঈমানী ভ্রাতৃত্বের কারণে একে অন্যের প্রতি দয়ামায়ার আচরণ করা, অন্য কোনও কারণে নয়। আর تعاطف হচ্ছে মায়া-মমতার সঙ্গে একে অন্যের সাহায্য-সহযোগিতা করা।
পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রকৃত মুমিনদের কেমন হতে হয়, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ হাদীছে তা একটি দৃষ্টান্তের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলেছেন। তিনি ঈমানকে তুলনা করেছেন শরীরের সঙ্গে এবং মুমিনকে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সঙ্গে। কেননা ঈমান হচ্ছে মূল আর শর'ঈ বিধানাবলী তার শাখা-প্রশাখা। কোনও ব্যক্তি যখন বিধানাবলী পালনে ত্রুটি করে, তখন তার মূল ঈমানকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। ঠিক এরকমই শরীর হচ্ছে গাছের কাণ্ডের মত মূল আর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ডালপালার মত তার শাখা। শরীরের কোনও অঙ্গ যখন অসুস্থ হয়ে পড়ে, তখন প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে, যেমন গাছের কোনও ডালে আঘাত করলে সমস্ত শাখা-প্রশাখায় নাড়া পড়ে যায়। ইব্ন আবী জামরা রহ. উপমাটি এভাবে ব্যাখ্যা করেছেন।
কাযী ইয়াদ রহ. বলেন, মুমিনদেরকে একদেহের সঙ্গে তুলনা করাটা একটি বাস্তবসম্মত উপমা। এতে বিষয়বস্তুটিকে সহজে বোধগম্য করা হয়েছে এবং অর্থ ও মর্মবাণী দৃশ্যমান বস্তুতে প্রকাশ করা হয়েছে।
এ হাদীছে মুমিনদেরকে একটি দেহের সঙ্গে তুলনা করে মূলত এই আদেশ করা উদ্দেশ্য যে, কোনও ব্যক্তির অঙ্গবিশেষ অসুস্থ হয়ে পড়লে যেমন তার ব্যথা-বেদনা সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে, তেমনি মুমিনগণও যেন সকলে মিলে এমন একাত্মা ও একদেহতুল্য হয়ে যায় যে, তাদের কোনও একজন দুঃখ-কষ্টে পড়লে সকলেই তার সমব্যথী হবে এবং তাকে তা থেকে মুক্ত করার চেষ্টা করবে। অপর এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেনঃ- المسلمون كرجل واحد إن اشتكى عينه إشتكى كله وإن اشتكى رأسه اشتكى كله ‘মুসলিমগণ সকলে মিলে এক ব্যক্তিতুল্য, যার চোখ অসুস্থ হলে সারা শরীর অসুস্থ হয়ে যায় এবং মাথা অসুস্থ হলে সারা শরীর অসুস্থ হয়ে যায়।
আলোচ্য হাদীছটির মত এ হাদীছেও মূলত মুমিনদেরকে পরস্পর সহমর্মী ও সমব্যথী হয়ে থাকতে আদেশ করা হয়েছে। এ সমবেদনা ও সহমর্মিতার দাবি হচ্ছে মুসলিমগণ একে অন্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে থাকবে। কেউ কাউকে কোনওভাবেই কষ্ট দেবে না। কেউ কারও কোনও হক নষ্ট করবে না। যখন অন্যের ব্যথা-বেদনাকে নিজের ব্যথা-বেদনা গণ্য করতে বলা হয়েছে, তখন নিজে কিভাবে অন্যকে কষ্ট দেওয়ার কথা ভাবতে পারে? যখন অন্যের দুঃখ-কষ্ট নিবারণের চেষ্টা করতে বলা হয়েছে, তখন নিজেকে কিভাবে অন্যের দুঃখ-কষ্টের কারণ বানানো যেতে পারে? যে ব্যক্তি অন্য মুসলিমের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকবে, সে অবশ্যই লক্ষ রাখবে যাতে তার দ্বারা অন্য কারও জান, মাল ও ইজ্জতের কোনও ক্ষতি না হয়ে যায়। নিজের জান, মাল ও ইজ্জতের যেভাবে হেফাজত করা হয়ে থাকে, সে অন্যের জান, মাল ও ইজ্জতের হেফাজতেও সেরকম ভূমিকা রাখবে।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. এ হাদীছ মুমিনদেরকে পারস্পরিক সহমর্মিতার শিক্ষাদান করে।

খ. মুমিন ব্যক্তির কর্তব্য অন্যের দুঃখ-কষ্টকে নিজ দুঃখ-কষ্ট গণ্য করা এবং নিজ সাধ্য অনুযায়ী তা লাঘবের চেষ্টা করা।

গ. মুমিন ব্যক্তি অন্যের হক সম্পর্কে সচেতন থাকবে। সে তার কাছে অন্যের যা-কিছু প্রাপ্য আছে তা আদায়ে যত্নবান থাকবে এবং সতর্ক থাকবে, যাতে তার দ্বারা অন্যের জান, মাল ও ইজ্জতের কোনও ক্ষতি না হয়ে যায়।
tahqiqতাহকীক:তাহকীক নিষ্প্রয়োজন