ফিকহুস সুনান ওয়াল আসার

৪০. অপরাধ ও সাজার অধ্যায়

হাদীস নং: ২৪৫৯
অবৈধ রক্তপাতের নিন্দা ও মুসলিম হত্যার নিষেধাজ্ঞা
(২৪৫৯) ইবন উমার রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, যতক্ষণ না একজন মুমিন কোনো অবৈধ রক্তপাতে জড়িত হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত সে তার দ্বীনের বিষয়ে প্রশস্ততার মধ্যে থাকবে।
عن ابن عمر رضي الله عنهما مرفوعا: لا يزال المؤمن في فسحة من دينه ما لم يصب دما حراما.

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করা যে কী কঠিন গুনাহ এবং তার পরিণাম কত মন্দ সেদিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। আল্লাহ তা'আলা অসীম রহমতের অধিকারী। বান্দা যত কঠিন পাপই করুক, তার জন্য তিনি তাওবার দুয়ার খোলা রেখেছেন। খাঁটি মনে তাওবা করলে তিনি নিজ রহমতে সমস্ত পাপ ক্ষমা করে দেন। তাঁর দরবারে কারও জন্য হতাশার কোনও স্থান নেই। তিনি ইরশাদ করেন-

قُلْ يَاعِبَادِيَ الَّذِينَ أَسْرَفُوا عَلَى أَنْفُسِهِمْ لَا تَقْنَطُوا مِنْ رَحْمَةِ اللَّهِ إِنَّ اللَّهَ يَغْفِرُ الذُّنُوبَ جَمِيعًا إِنَّهُ هُوَ الْغَفُورُ الرَّحِيمُ (53)

বলে দাও, হে আমার বান্দাগণ! যারা নিজ সত্তার ওপর সীমালঙ্ঘন করেছে, আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ সমস্ত পাপ ক্ষমা করেন। নিশ্চয়ই তিনি অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। (সূরা যুমার (৩৯), আয়াত ৫৩) অর্থাৎ বান্দা যত কঠিন পাপই করুক, হতাশার কোনও কারণ নেই। সে আল্লাহর সর্বব্যাপী রহমতের অছিলায় ক্ষমালাভের আশা করতে পারে। তবে অন্যায় নরহত্যার ব্যাপারটা অনেক কঠিন। অন্যায় নরহত্যা এত কঠিন পাপ, যে সম্পর্কে কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-

أَنَّهُ مَنْ قَتَلَ نَفْسًا بِغَيْرِ نَفْسٍ أَوْ فَسَادٍ فِي الْأَرْضِ فَكَأَنَّمَا قَتَلَ النَّاسَ جَمِيعًا

কেউ যদি কাউকে হত্যা করে এবং তা অন্য কাউকে হত্যা করার কারণে কিংবা পৃথিবীতে অশান্তি বিস্তারের কারণে না হয়, তবে সে যেন সমস্ত মানুষকে হত্যা করল। (সূরা মায়িদা (৫), আয়াত ৩২)

এ হাদীছে বলা হয়েছে-

لن يزال المؤمن في فسحة من دينه

মুমিন ব্যক্তি সর্বদা তার দীনের ক্ষেত্রে অবকাশের মধ্যে থাকে।

فسحة অর্থ অবকাশ, প্রশস্ততা। অর্থাৎ দীন ও ঈমানের কারণে আল্লাহ তাআলা মুমিন ব্যক্তির জন্য এ অবকাশ রেখেছেন যে, সে যত বড় গুনাহই করুক, সত্যিকার তাওবা করলে আল্লাহ তা'আলা তাকে মাফ করে দেবেন। কাফের-মুশরিক তার গুনাহ থেকে যতই তাওবা করুক না কেন, যতক্ষণ না কুফরী ত্যাগ করবে ততক্ষণ তার ক্ষমা নেই। অথবা এর অর্থ- মুমিন ব্যক্তি পাপকর্ম করলে তার দীন ও ঈমানের খাতিরে আল্লাহ তা'আলা তাকে তাওবার সুযোগ দান করেন কিংবা অন্য কোনও ছলে তাকে ক্ষমা করেন। যে ব্যক্তি মুমিন নয়, এরকম সুযোগ তার নেই। তবে মুমিন ব্যক্তিরও এ সুযোগ থাকে ততক্ষণই, যতক্ষণ না সে কোনও অন্যায় নরহত্যায় লিপ্ত হয়।

ইবনুল আরাবী রহ. এভাবে ব্যাখ্যা করেছেন যে, মুমিন ব্যক্তি তার নেক আমলের ছত্রচ্ছায়ায় থাকে। অর্থাৎ সে যত পাপই করুক না কেন, সে যদি নেক আমলে লিপ্ত থাকে তবে আল্লাহ তা'আলা সে অছিলায় তাকে পাপ থেকে মুক্তির ব্যবস্থা করে দেন, তা তাওবার মাধ্যমে হোক বা অন্য কোনও অছিলায়। কিন্তু সে যদি অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করে বসে, তখন আর এ অবকাশ তার থাকে না। তখন তার জগত সংকীর্ণ হয়ে যায়। কেননা সে পাপ এতই কঠিন যে, সমস্ত নেক আমল দ্বারাও তার প্রতিকার হবে না।

অপর এক বর্ণনায় من دينه -এর স্থলে من ذنبه আছে। সে হিসেবে অর্থ হবে- মুমিন ব্যক্তি তার গুনাহের ব্যাপারে এই অবকাশ ও প্রশস্ততার মধ্যে থাকে যে, তাওবা করলেই তা মাফ হয়ে যায়, যতক্ষণ না সে কোনও নরহত্যায় লিপ্ত হয়। সে কাউকে অন্যায়ভাবে হত্যা করলে তখন আর এ অবকাশ থাকে না, তার জন্য ক্ষমাপ্রাপ্তির সুযোগ সংকীর্ণ হয়ে যায়।

এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-

يَجِيءُ الْقَاتِلُ وَالْمَقْتُولُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ, مُتَعَلِّقٌ بِرَأْسِ صَاحِبِهِ يَقُولُ: رَبِّ سَلْ هَذَا لِمَ قَتَلَنِي؟

কিয়ামতের দিন হত্যাকারী ও নিহত ব্যক্তি এভাবে উপস্থিত হবে যে, নিহত ব্যক্তি হত্যাকারীর মাথার সাথে ঝুলে থাকবে আর সে বলবে, হে আমার প্রতিপালক! একে জিজ্ঞেস করুন, সে আমাকে কেন হত্যা করেছিল? (সুনানে ইবন মাজাহ, হাদীছ নং ২৬২১; আত-তাবারানী, আল-মু'জামুল আওসাত, হাদীছ নং ৭৬৬)

বস্তুত অন্যায় নরহত্যা অত্যন্ত কঠিন পাপ। কুরআনে কারীমের কোনও কোনও আয়াত এবং কোনও কোনও হাদীছ দ্বারা বাহ্যত এটাই বোঝা যায় যে, অন্যায় হত্যাকারীর তাওবা কবূল হবে না এবং সে তার এ পাপ থেকে ক্ষমা পাবে না। যেমন এ হাদীছেও বলা হয়েছে- مَا لَمْ يُصِبْ دَما حَرَامًا (যতক্ষণ না কোনও অন্যায় রক্তপাতে লিপ্ত হয়)। অর্থাৎ কাউকে অন্যায়ভাবে হত্যা করলে অবকাশ শেষ হয়ে যায়, এ পাপ থেকে সে ক্ষমা পায় না।

যদিও এর দ্বারা বাহ্যত অন্যায় নরহত্যাকারীর তাওবা কবুল না হওয়া ও তার ক্ষমা না পাওয়ার কথাই বোঝা যাচ্ছে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আদৌ ক্ষমা হবে না তা বোঝানো উদ্দেশ্যে নয়। বোঝানো উদ্দেশ্য কেবল এটাই যে, তার ক্ষমালাভ অত্যন্ত কঠিন। খাঁটি মনে তাওবা করলে যে ক্ষমার আশা থাকে, তা ওই ব্যক্তির ঘটনা দ্বারা বোঝা যায়, যে একশ'টি নরহত্যা করার পরও আল্লাহ তা'আলার অশেষ দয়ায় ক্ষমা পেয়েছিল। তাওবা অধ্যায়ে তার সে ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। তাছাড়া কুরআন মাজীদেও ইরশাদ হয়েছে-

وَمَنْ يَعْمَلْ سُوءًا أَوْ يَظْلِمْ نَفْسَهُ ثُمَّ يَسْتَغْفِرِ اللَّهَ يَجِدِ اللَّهَ غَفُورًا رَحِيمًا (110)

যে ব্যক্তি কোনও মন্দ কাজ করে ফেলে বা নিজের প্রতি জুলুম করে বসে, তারপর আল্লাহর কাছে ক্ষমা চায়, সে অবশ্যই আল্লাহকে অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালুই পাবে। (সূরা নিসা (৪), আয়াত ১১০)

অপর এক আয়াতে ইরশাদ-

إِنَّ اللهَ لَا يَغْفِرُ أَن يُشْرَكَ بِهِ وَيَغْفِرُ مَا دُونَ ذلِكَ لِمَن يَشَاءُ

নিশ্চয়ই আল্লাহ এ বিষয়কে ক্ষমা করেন না যে, তার সঙ্গে কাউকে শরীক করা হবে। এর চেয়ে নিচের যে-কোনও বিষয়ে যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করেন। সূরা নিসা (৪), আয়াত ৪৮

এর দ্বারা বোঝা গেল শিরকের নিচের সর্বপ্রকার গুনাহ আল্লাহ তা'আলা ক্ষমা করে দেন। কাজেই নরহত্যার গুনাহও তিনি অবশ্যই ক্ষমা করবেন। তবে হাঁ, এর জন্য তাওবা হতে হবে ঘাঁটি তাওবা। তার একটা অংশ এইও যে, এর জন্য সে বিচারের সম্মুখীন হতে কুণ্ঠাবোধ করবে না। আখিরাতের শাস্তি থেকে বাঁচার আশায় সে কিসাস অর্থাৎ হত্যার বদলে হত্যার শাস্তিও মাথা পেতে নিতে প্রস্তুত থাকবে। কেবল মৌখিক তাওবা যথেষ্ট হবে না। বলাবাহুল্য এরকম খাঁটি তাওবা কঠিনই বটে। সুতরাং যে পাপের তাওবা এরূপ কঠিন, আবার তাওবা ছাড়া মারা গেলে জাহান্নামের শাস্তি অবধারিত, মুমিন ব্যক্তি সেরকম পাপ কেন করতে যাবে?
প্রকাশ থাকে যে, এ হাদীছে অন্যায় রক্তপাতের কথা বলা হয়েছে, মুমিন ব্যক্তিকে হত্যা কথা বলা হয়নি। এর দ্বারা বোঝা যাচ্ছে অন্যায়ভাবে হত্যা করা জায়েয নয় কাউকেই, তা মুসলিম হোক বা অমুসলিম। এ কথা সত্য বটে যে, মুসলিম ব্যক্তিকে অন্যায়ভাবে হত্যা করা অমুসলিমকে হত্যা করা অপেক্ষা অধিকতর কঠিন পাপ।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. অন্যায় নরহত্যা অত্যন্ত কঠিন পাপ। মুমিন ব্যক্তির কর্তব্য কিছুতেই এরূপ পাপে লিপ্ত না হওয়া।

খ. দীন ও ঈমান মুমিন ব্যক্তির অতি বড় সম্পদ। এর অছিলায় তাওবা কবুলের আশা থাকে।

গ. অন্যায়ভাবে কোনও অমুসলিমকেও হত্যা করা জায়েয নয়।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক নিষ্প্রয়োজন