ফিকহুস সুনান ওয়াল আসার

১৮. ক্রয়-বিক্রয় ও ব্যবসা-বাণিজ্য

হাদীস নং: ২০৩৭
আগন্তুক আরোহী বিক্রেতাদের সাথে সাক্ষাৎ, অন্যের বিক্রয়ের মধ্যে বিক্রয়, দালালি, বেদুঈনের জন্য শহরবাসীর বিক্রয়, পশুর স্তনে দুধ জমা করা ও একজনের দামদরের মধ্যে অন্যের দামদর করার নিষেধাজ্ঞা
(২০৩৭) আবু হুরাইরা রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, পণ্যসহ আগন্তুক আরোহীদের (বিক্রেতাদেরকে) বাজারে পৌঁছানোর আগে বেচাকেনার উদ্দেশ্যে তাদের সাথে সাক্ষাৎ করা যাবে না। তোমাদের কেউ অন্যের বিক্রয়ের মধ্যে বিক্রয় করবে না। তোমরা মূল্য বৃদ্ধির জন্য দালালি করবে না। শহরবাসী যাযাবর বেদুঈনের জন্য বিক্রয় করবে না। তোমরা (ক্রেতাকে ধোঁকা দেওয়ার জন্য) উট বা ছাগি-ভেড়ার স্তনে দুধ জমা করে বিক্রয় করবে না। যদি কেউ এইরূপ পশু ক্রয় করে তার দুধ দোহন করার পরে দুধ কম হচ্ছে বলে দেখতে পায় তবে তার জন্য দুটি বিকল্প রয়েছে: যে পরিমাণ দুধ হচ্ছে তাতে যদি যে সন্তুষ্ট হয় তবে সে পশুটি রেখে দেবে। আর যদি সে তাতে সন্তুষ্ট না হয় তবে সে পশুটি ফিরিয়ে দেবে এবং তার সাথে (যে দুধ দোহন করে নিয়েছে তার বিনিময়ে) এক সা' (প্রায় তিন কিলোগ্রাম) খেজুর প্রদান করবে।
عن أبي هريرة رضي الله عنه أن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال: لا يتلقى الركبان لبيع ولا يبع بعضكم على بيع بعض ولا تناجشوا ولا يبع حاضر لباد ولا تصروا الإبل والغنم فمن ابتاعها بعد ذلك فهو بخير النظرين بعد أن يحلبها فإن رضيها أمسكها وإن سخطها ردها وصاعا من ثمر.

হাদীসের ব্যাখ্যা:

১. গ্রন্থকার বলেন, স্তনে দুধ জমা করে বিক্রয় করা পশু ফেরত দেওয়ার ক্ষেত্রে এক সা' খেজুর দেওয়ার বিধানটি সাবধানতা ও তাকওয়া-ভিত্তিক নির্দেশনা । যেহেতু সে কিছু দুধ দোহন করে নিয়েছে, যার পরিমাণ ঠিক রাখা কঠিন, এজন্য দ্বীনদারির ভিত্তিতে সে এভাবে এক সা' খেজুর প্রদান করবে । তবে বিচারে গেলে এইরূপ বিধান হবে না। কারণ বিচারের ক্ষেত্রে ইসলামি মূলনীতি হল, 'দায়িত্বের বিনিময়ে উৎপাদন'। এ বিষয়ে নিম্নের হাদীসটি প্রণিধানযোগ্য ।

২. প্রতারণামূলক দালালী করার নিষেধাজ্ঞা
প্রতারণামূলক দালালী এটা পাপকর্ম। ইসলাম এটা করতে নিষেধ করেছে। যেমন এ হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন- ولا تناجشوا 'তোমরা প্রতারণামূলক দালালী করো না। تناجشوا ক্রিয়াটির উৎপত্তি النجش থেকে। ইমাম নববী রহ. এর ব্যাখ্যা করেছেন- বাজারে বা অন্য কোথাও যে পণ্য বিক্রির জন্য তোলা হয়, তার দাম অন্যের বলা দামের চেয়ে বেশি বলা, উদ্দেশ্য তা নিজে কেনা নয়; বরং কেবলই অন্যকে ধোঁকা দেওয়া। অর্থাৎ তার বলা দাম শুনে অন্যে মনে করবে পণ্যটির দাম সে যা ভেবেছে তারচে' আরও বেশি। তখন সে আরও বেশি দামে সেটি কিনে নেবে আর এভাবে প্রকৃত দামের চেয়ে বেশি দামে কিনে সে প্রতারিত হবে। এটা সুস্পষ্টই ধোঁকা। আর ধোঁকা দেওয়া সম্পূর্ণ হারাম।

এরকম দালালী অনেক সময় বিক্রেতার সঙ্গে যোগসাজশ করে হয়। আবার অনেক সময় স্বেচ্ছাপ্রণোদিতভাবেও করা হয়। উভয়টাই হারাম ও নাজায়েয। কেননা এতে ভোক্তাসাধারণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অন্যের ক্ষতি হয় এমন যে-কোনও তৎপরতা কল্যাণকামিতার পরিপন্থী। অথচ মুসলিম ভাইয়ের প্রতি কল্যাণ কামনা করা দীনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। এটা ফরয ও অবশ্যকর্তব্য।

النجش সম্পর্কে উল্লিখিত আলোচনা ইমাম নববী রহ.-কৃত ব্যাখ্যার আলোকে করা হল। তার মত ব্যাখ্যা আরও অনেকে করেছেন। আবার কেউ কেউ এর ব্যাখ্যা করেছেন আরও ব্যাপকভাবে। তারা বলেছেন, النجش এর আভিধানিক অর্থ কাউকে ধোঁকা ও প্রতারণামূলক পন্থায় কোনও জিনিসের প্রতি প্ররোচিত করা। ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে দালালকে এ কারণেই الناجش বলা হয় যে, সেও ধোঁকা দিয়ে ক্রেতাকে বেশি মূল্যে পণ্যক্রয়ে প্ররোচিত করে। কখনও বিক্রেতাকেও কম মূল্যে বিক্রির প্ররোচনা দেয়। শিকারীকেও الناجش বলা হয়। কারণ সেও শিকারকে তার ধোঁকার ফাঁদে ফেলে। এ হিসেবে ولا تناجشوا অর্থ হবে- তোমরা একে অন্যকে ধোঁকা দিও না এবং একে অন্যের প্রতি প্রতারণামূলক আচরণ করো না। সুতরাং বেচাকেনাসহ যে-কোনও লেনদেনে যে-কোনওরকম প্রতারণা এ নিষেধাজ্ঞার অন্তর্ভুক্ত হবে, যেমন মালে ভেজাল মেশানো, ভালো মাল দেখিয়ে মন্দ মাল বিক্রি, পণ্যের দোষত্রুটি গোপন করা, সরলসোজা ভোক্তাকে চালাকি করে মন্দ মাল গছিয়ে দেওয়া বা অতিরিক্ত বেশি দামে তার কাছে মাল বিক্রি করা কিংবা অতিরিক্ত কম দামে তার থেকে কিনে নেওয়া। এমনিভাবে ইজারা, আমানত, বিবাহ ইত্যাদি ক্ষেত্রেও এ জাতীয় প্রতারণা আলোচ্য নিষেধাজ্ঞার আওতায় আসবে।

ধোঁকা ও প্রতারণার উদ্দেশ্য থাকে অন্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করা। কোনও মুসলিমকে ক্ষতিগ্রস্ত করা সম্পূর্ণ হারাম। আখেরে এর দ্বারা প্রতারক ব্যক্তি নিজেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আখেরাতে তো হয়ই, দুনিয়ায়ও তার ধোঁকা ও প্রতারণার কথা যখন প্রকাশ হয়ে যায়,তখন সকলেই তাকে এড়িয়ে চলে। ফলে সামাজিক নানা সুযোগ-সুবিধা থেকে সে বঞ্চিত হয়ে যায়। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
وَلَا يَحِيقُ الْمَكْرُ السَّيِّئُ إِلَّا بِأَهْلِهِ
‘অথচ কূট-চক্রান্ত খোদ তার উদ্যোক্তাদেরকেই পরিবেষ্টন করে নেয়। সূরা ফাতির (৩৫), আয়াত ৪৩

হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-

مَلْعُونٌ مَنْ صَارٌ مُؤْمِنًا أَوْ مَكَرَ بِه
‘ওই ব্যক্তি অভিশপ্ত, যে কোনও মুমিনকে কষ্ট দেয় বা তার সঙ্গে প্রতারণা করে।[৫]

বাজারে গেলে লক্ষ করা যায়, বিক্রেতা স্তুপের উপর দিকে ভালো ভালো মাল রাখে। তা দেখে ক্রেতা আকৃষ্ট হয়। কিন্তু নিচের দিকে থাকে নিম্নমানের মাল। যারা উপরের ভালোটা দেখে তা কেনে, তারা প্রতারিত হয়। ফলমূল, তরি-তরকারি, মাছ- মাংস ইত্যাদি সবরকম পণ্যের বিক্রেতাদেরকেই ব্যাপকভাবে এরকম কাণ্ড করতে দেখা যায়। জাহিলী যুগেও মানুষ এরকম করত। যারা নতুন নতুন ইসলাম গ্রহণ করেছে, তাদের কেউ কেউ পুরোপুরি সংশোধনের আগে এরকম কাণ্ড করে ফেলত। একদিন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বাজারে গিয়ে এক বিক্রেতার খাদ্যস্তুপের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে দিলেন। তিনি অনুভব করলেন নিচের দিকের মাল ভেজা। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ওহে বিক্রেতা, এটা কী? সে বলল, বৃষ্টিতে ভিজে গেছে। তখন তিনি ইরশাদ করলেন-
أَفَلَا جَعَلْتَهُ فَوْقَ الطَّعَامِ حَتَّى يَرَاهُ النَّاسُ، ثُمَّ قَالَ: مَنْ غَش فَلَيْسَ مِنَّا
‘তুমি তা (অর্থাৎ ভেজাটা) খাদ্যশস্যের উপরে রাখতে পারলে না, যাতে মানুষ তা দেখতে পায়? যে ধোঁকা দেয় সে আমাদের একজন নয়।

একজনের বেচাকেনার উপর আরেকজনের বেচাকেনায় লিপ্ত হওয়ার নিষিদ্ধতা
এ হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আরেকটি নিষেধাজ্ঞা হচ্ছে তোমরা একজনের বেচাকেনার উপর আরেকজন বেচাকেনা করো না'। একজনের বেচাকেনার উপর আরেকজনের বেচাকেনায় লিপ্ত হওয়ার অর্থ- কেউ কারও কাছে কোনও মাল বিক্রি করার পর বিক্রেতাকে গিয়ে এ কথা বলা যে, তুমি তার কাছে বিক্রি বাতিল করে দাও, আমি আরও বেশি দামে তোমার কাছ থেকে কিনব। অথবা ক্রেতার কাছে গিয়ে বলা যে, তুমি এ ক্রয় বাতিল করে দাও, আমি এরকম মাল আরও সস্তায় তোমাকে দেব। এটা সম্পূর্ণ নিষেধ। এটা ইসলামী ভ্রাতৃত্বের পরিপন্থী। ভ্রাতৃত্বের দাবি হচ্ছে নিজের জন্য যা পসন্দ করা হয়, অন্যের জন্যও তা পসন্দ করা। এমনিভাবে ভ্রাতৃত্বের দাবি প্রত্যেক মুসলিমের কল্যাণ কামনা করা। এ জাতীয় কাজ সে দাবির পরিপন্থী। কেননা প্রথম অবস্থায় ক্রেতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, আর দ্বিতীয় অবস্থায় বিক্রেতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কোনও মুসলিমকে ক্ষতিগ্রস্ত করা সম্পূর্ণ হারাম। এমনকি অকারণে কোনও অমুসলিমেরও ক্ষতি করা জায়েয নয়।

ক্রয়-বিক্রয় সম্পন্ন হয়ে যাওয়ার পর তৃতীয় ব্যক্তি কর্তৃক তা বাতিল করার প্রস্তাব নাজায়েয তো বটেই, এমনকি ক্রয়-বিক্রয় সম্পন্ন হওয়ার আগে যখন ক্রেতা- বিক্রেতার মধ্যে দরদাম চলে, তখনও সেই দরদামের মাঝখানে তৃতীয় ব্যক্তির ঢুকে পড়া জায়েয নয়। উদাহরণত, এক ব্যক্তির একটা বস্তু পসন্দ হল। সে বিক্রেতাকে একটা দামও বলল। বিক্রেতা সে দামে বিক্রি করতে রাজি হল না। ক্রেতা ভাবছে আরও বেশি দাম বলবে কি না। সে মালটি না নেওয়ার সিদ্ধান্ত জানাল না। ঠিক ওই মুহূর্তে আরেকজন সেটি কেনার আগ্রহ দেখাল এবং একটা দামও বলে ফেলল। এভাবে একজনের দরদামের উপর আরেকজনের দরদাম করার এ কাজটি একরকম অশিষ্টতা। এটা একরকম স্বার্থপরতাও বটে, যা ইসলামী নীতি-নৈতিকতার সম্পূর্ণ পরিপন্থী। সুতরাং নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
لَا يَسم الْمُسْلِمُ عَلَى سَوْمِ الْمُسْلِم وَلَا يَخْطُبُ عَلَى خِطبته
‘এক মুসলিম অপর মুসলিমের দরদাম করার উপর দরদাম করবে না এবং তার বিবাহের প্রস্তাবের উপর বিবাহের প্রস্তাব করবে না।

বেচাকেনার দরদামের মতই কারও গাড়ি ভাড়ার কথাবার্তার সময় একই গাড়ি ভাড়া নেওয়ার জন্য অন্য ব্যক্তির পক্ষ থেকে প্রস্তাব করা কিংবা শ্রমিক নিয়োগের কথাবার্তাকালে একই শ্রমিক নেওয়ার জন্য অন্য ব্যক্তির আগ্রহ দেখানো এ নিষেধাজ্ঞার আওতায় এসে যায়। এমনিভাবে যে-কোনও দ্বিপাক্ষিক চুক্তির আলোচনাকালে অপর ব্যক্তি তাতে ঢুকে পড়া ইসলামী ভ্রাতৃত্বের পরিপন্থী ও নাজায়েয। এ ব্যাপারে আমাদের অনেকেরই সতর্কতা নেই। কোনও বস্তুতে চোখ পড়ল, অমনি তাতে প্রস্তাব দিয়ে বসে, অথচ তখন তার লেনদেন সম্পর্কে দু'জনের মধ্যে কথা চলছে। এটা কিছুতেই ইসলামের শেখানো শিষ্টাচারের মধ্যে পড়ে না। ইসলামের সামাজিক শিক্ষা অনেক মূল্যবান ও পূর্ণাঙ্গ। মুমিন ব্যক্তির কর্তব্য তা শিখে নিয়ে সে অনুযায়ী চলতে সচেষ্ট থাকা।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. প্রতারণামূলক দালালি করা জায়েজ নয়। কাজেই কোনও মুসলিম ব্যক্তির এরূপ কাজে লিপ্ত হওয়ার সুযোগ নেই।

খ. দুজন ব্যক্তির পারস্পরিক বেচাকেনা ও দরদাম করার মাঝখানে তৃতীয় ব্যক্তির প্রবেশ করা কিছুতেই উচিত নয়। এটা নাজায়েয কাজ।
২. ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক নিষ্প্রয়োজন
ফিকহুস সুনান - হাদীস নং ২০৩৭ | মুসলিম বাংলা