ফিকহুস সুনান ওয়াল আসার

৩. নামাযের অধ্যায়

হাদীস নং: ১১৫৭
কবর দেওয়ার পরে মৃতের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা
(১১৫৭) উসমান রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মৃতের কবর দেওয়া সমাপ্ত করলে তার পাশে দাঁড়াতেন এবং বলতেন, তোমরা তোমাদের ভাইয়ের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করো এবং তার জন্য টিকে থাকার তাওফীক প্রাথনা করো; কারণ তাকে এখন প্রশ্ন করা হচ্ছে।
عن عثمان بن عفان رضي الله عنه قال: كان النبي صلى الله عليه وسلم إذا فرغ من دفن الميت وقف عليه فقال: استغفروا لأخيكم وسلوا له بالتثبيت فإنه الآن يسأل

হাদীসের ব্যাখ্যা:

নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন রাহমাতুল-লিল-আলামীন। উম্মতের প্রতি তাঁর দরদ ও মমতা ছিল অপরিসীম। মানুষ যাতে দুনিয়ার জীবনেও সুখ-শান্তি লাভ করতে পারে এবং আখিরাতের জীবনেও নাজাত পেতে পারে, সে লক্ষ্যেই তিনি জীবনভর কাজ করেছেন। তাঁর সে দরদ ও মমতার কিছুটা আঁচ এ হাদীছেও পাওয়া যায়। মায়্যিতকে দাফন করার পর তিনি তার কবরের পাশে দাঁড়াতেন। কবরে মায়্যিত কী অবস্থার সম্মুখীন হয়, আল্লাহ তা'আলা তাঁকে তা জানিয়ে দিয়েছিলেন। আর তা জানতেন বলেই তিনি কোনও মায়্যিতকে দাফন করার পর তার সম্পর্কে খুব চিন্তিত থাকতেন। তিনি কবরের পাশে দাঁড়িয়ে বলতেন-
اِسْتَغْفِرُوا لِأَخِيْكُمْ (তোমরা তোমাদের ভাইয়ের জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করো)। 'ভাই' শব্দটি বলে তিনি তাদের অন্তরে সহমর্মিতা জাগানোর চেষ্টা করেছেন। যাতে তারা মমতার সঙ্গে তার জন্য দু'আ করে। বলা হয়েছে, তার জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করো। অর্থাৎ আল্লাহ তা'আলার কাছে দু'আ করো যে, হে আল্লাহ! তুমি আমাদের ভাইকে ক্ষমা করে দাও। তার পাপরাশি মার্জনা করো। তাকে ক্ষমা করা না হলে নিঃসঙ্গ, সংকীর্ণ ও অন্ধকার কবরে না জানি কী কঠিন আচরণ তার উপর করা হয়। ক্ষমা করা হলে সে দয়ার আচরণ পাবে। কবরের সবরকম কষ্ট থেকে তাকে নাজাত দেওয়া হবে। কাজেই গুনাহ থেকে ক্ষমা পাওয়া তার এখন সর্বাপেক্ষা বেশি জরুরি। তিনি আরও বলেন-
وَسَلُوْا لَهُ التَّثْبِيْتَ، فَإِنَّهُ الْآنَ يُسْأَلُ (এবং তাকে শান্ত-স্থির রাখার জন্য আল্লাহর কাছে দু'আ করো। কেননা এখন তাকে প্রশ্ন করা হবে)। অর্থাৎ মুনকার-নাকীর ফিরিশতা এখন তাকে প্রশ্ন করবে। সে যাতে ভয় পেয়ে না যায়; বরং শান্তভাবে প্রশ্নের জবাব দিতে পারে, সেজন্য দু'আ করো। কবরে মায়্যিতকে কী প্রশ্ন করা হবে এবং প্রশ্নের জবাব অনুযায়ী মায়্যিতের সঙ্গে কেমন আচরণ করা হবে, তাও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিভিন্ন হাদীছে বর্ণনা করেছেন। যেমন দীর্ঘ একটি হাদীছে তিনি মুমিন মায়্যিত সম্পর্কে বলেন-
وَيَأْتِيهِ مَلَكَانِ فَيُجْلِسَانِهِ فَيَقُولَانِ لَهُ: مَنْ رَبُّكَ؟ فَيَقُولُ: رَبِّيَ اللَّهُ، فَيَقُولَانِ لَهُ: مَا دِينُكَ؟ فَيَقُولُ: دِينِيَ الْإِسْلَامُ، فَيَقُولَانِ لَهُ: مَا هذَا الرَّجُلُ الَّذِي بُعِثَ فِيكُمْ؟ قَالَ: فَيَقُولُ: هُوَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فَيَقُولَانِ: وَمَا يُدْرِيكَ؟ فَيَقُولُ: قَرَأْتُ كِتَابَ اللَّهِ فَآمَنْتُ بِهِ وَصَدَّقْتُ «زَادَ فِي حَدِيثِ جَرِيرٍ» فَذَلِكَ قَوْلُ اللَّهِ عَزَّ وَجَلَّ {يُثَبِّتُ اللَّهُ الَّذِينَ آمَنُوا} [إبراهيم: 27] الْآيَةُ - ثُمَّ اتَّفَقَا - قَالَ: فَيُنَادِي مُنَادٍ مِنَ السَّمَاءِ: أَنْ قَدْ صَدَقَ عَبْدِي، فَأَفْرِشُوهُ مِنَ الْجَنَّةِ، وَافْتَحُوا لَهُ بَابًا إِلَى الْجَنَّةِ، وَأَلْبِسُوهُ مِنَ الْجَنَّةِ
'তার কাছে দু'জন ফিরিশতা আসবে। তারা তাকে বসাবে। তারপর তাকে জিজ্ঞেস করবে, তোমার রব্ব কে? সে বলবে, আমার রব্ব আল্লাহ। তারপর তারা তাকে জিজ্ঞেস করবে, তোমার দীন কী? সে বলবে, আমার দীন ইসলাম। তারপর তারা তাকে জিজ্ঞেস করবে, ওই ব্যক্তি কে, যাকে তোমাদের কাছে পাঠানো হয়েছিল? সে বলবে, তিনি আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। তারপর তারা তাকে জিজ্ঞেস করবে, তুমি তা কীভাবে জান? সে বলবে, আমি আল্লাহর কিতাব পড়েছি এবং তাঁর প্রতি ঈমান এনেছি ও তাঁকে সত্য বলে বিশ্বাস করেছি। এটাই আল্লাহ তা'আলার এ বাণীর মর্ম যে-
يُثَبِّتُ اللَّهُ الَّذِينَ آمَنُوا بِالْقَوْلِ الثَّابِتِ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَفِي الْآخِرَةِ (যারা ঈমান এনেছে আল্লাহ তাদেরকে এ সুদৃঢ় কথার উপর স্থিতি দান করেন দুনিয়ার জীবনেও এবং আখিরাতেও (সূরা ইবরাহীম: ২৭)। তারপর আসমান থেকে এক ঘোষণাকারী ঘোষণা করবে যে, আমার বান্দা সত্য বলেছে। তোমরা তাকে জান্নাতের বিছানা বিছিয়ে দাও, তার জন্য জান্নাতের দিকে একটি দুয়ার খুলে দাও এবং তাকে জান্নাতের পোশাক পরিয়ে দাও। (সুনানে আবু দাউদ: ৪৭৫৩; মুসান্নাফে আব্দুর রায্‌যাক: ৬৭৩৭; মুসনাদে আহমাদ: ১৮৬১৪ )

তারপর তিনি কাফের মায়্যিত সম্পর্কে জানান-
وَيَأْتِيهِ مَلَكَانِ فَيُجْلِسَانِهِ فَيَقُولَانِ: لَهُ مَنْ رَبُّكَ؟ فَيَقُولُ: هَاهْ هَاهْ، لَا أَدْرِي، فَيَقُولَانِ لَهُ: مَا دِينُكَ؟ فَيَقُولُ: هَاهْ هَاهْ، لَا أَدْرِي، فَيَقُولَانِ: مَا هَذَا الرَّجُلُ الَّذِي بُعِثَ فِيكُمْ؟ فَيَقُولُ: هَاهْ هَاهْ، لَا أَدْرِي، فَيُنَادِي مُنَادٍ مِنَ السَّمَاءِ: أَنْ كَذَبَ، فَأَفْرِشُوهُ مِنَ النَّارِ، وَأَلْبِسُوهُ مِنَ النَّارِ، وَافْتَحُوا لَهُ بَابًا إِلَى النَّارِ
'তারপর তার কাছে দু'জন ফিরিশতা আসে। তারা তাকে বসিয়ে জিজ্ঞেস করে, তোমার রব্ব কে? সে বলে, হায় হায়, আমি তো জানি না! তারা তাকে জিজ্ঞেস করে, তোমার দীন কী? সে বলে, হায় হায়, আমি তো জানি না! তারপর তারা জিজ্ঞেস করে, ওই ব্যক্তি কে, যাকে তোমাদের কাছে পাঠানো হয়েছিল? সে বলে, হায় হায়, আমি তো জানি না! তখন আসমান থেকে এক ঘোষক ঘোষণা করে, সে মিথ্যা বলেছে। তার জন্য জাহান্নামের বিছানা বিছাও এবং তাকে জাহান্নামের পোশাক পরাও আর তার জন্য জাহান্নামের দিকে একটা দুয়ার খুলে দাও’। (সুনানে আবু দাউদ: ৪৭৫৩; মুসনাদে আহমাদ: ১৮৫৩৪; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা: ১২০৫৯)

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. কবরে মায়্যিতকে তার রব্ব, তার দীন ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে।

খ. জীবিতদের দু'আয় মায়্যিত উপকৃত হয়, যদি তার ঈমান থাকে।

গ. কবরে মায়্যিতের এক রকম জীবন ও চেতনা থাকে, যদিও তা দুনিয়ার জীবনের মতো নয়।

ঘ. দাফনের পর মায়্যিতের জন্য দু'আ করা শরী'আতসম্মত। বরং এটা সুন্নত।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান
ফিকহুস সুনান - হাদীস নং ১১৫৭ | মুসলিম বাংলা