ফিকহুস সুনান ওয়াল আসার

৩. নামাযের অধ্যায়

হাদীস নং: ১০৮৩
বিপদগ্রস্থ ব্যক্তি কী বলবে
(১০৮৩) উম্মু সালামা রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, যে কোনো মুসলিম যদি কোনো বিপদাপদে আক্রান্ত হয় এবং তখন আল্লাহর তাকে যে নির্দেশ দিয়েছেন সেমতো সে বলে, 'নিশ্চয় আমরা আল্লাহর নিমিত্ত এবং নিশ্চয় আমরা তার দিকেই ফিরে যাব, হে আল্লাহ, আমাকে আমার এই বিপদের সাওয়াব ও পুরস্কার প্রদান করুন এবং আমাকে এর স্থলে এর থেকে উত্তম বিনিময় প্রদান করুন'; তাহলে আল্লাহ তাকে তার বিপদে হারানো বস্তুর স্থলে তার চেয়ে উত্তম বস্তু দান করবেন ।
عن أم سلمة رضي الله عنها مرفوعا: ما من مسلم تصيبه مصيبة فيقول ما أمره الله: إنا لله وإنا إليه راجعون اللهم أجرني في مصيبتي وأخلف لي خيرا منها إلا أخلف الله له خيرا منها

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এখানে হাদীসটি সংক্ষিপ্ত আকারে আনা হয়েছে। অন্যান্য বর্ণনার আলোকে নিম্নে পূর্ণাঙ্গ হাদীস ও তার ব্যাখ্যা পেশ করা হলো।

হযরত উম্মু সালামা রাযি. বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, যে বান্দার উপরই কোনও মসিবত আসে, সে যদি বলে–
{إِنَّا لِلَّهِ وَإِنَّا إِلَيْهِ رَاجِعُونَ} اللهُمَّ أْجُرْنِي فِي مُصِيبَتِي, وَأَخْلِفْ لِي خَيْرًا مِنْهَا, إِلاَّ أَخْلَفَ اللهُ لَهُ خَيْرًا مِنْهَا
‘আমরা আল্লাহর এবং আমাদেরকে তাঁরই কাছে ফিরে যেতে হবে। হে আল্লাহ! আমার মসিবতে আমারে প্রতিদান দিন এবং আমাকে তার চেয়ে উত্তম স্থলাভিষিক্ত দান করুন), তবে আল্লাহ অবশ্যই তার মসিবতে তাকে প্রতিদান দেবেন এবং তার চেয়ে উত্তম স্থলাভিষিক্ত তারে দান করবেন। হযরত উম্মু সালামা রাযি. বলেন, আবূ সালামা মারা গেলে আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেমন হুকুম করেছিলেন তেমনি বললাম। ফলে আল্লাহ তা'আলা আমাকে তার চেয়ে উত্তম স্থলাভিষিক্ত দান করলেন। অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে।

ব্যাখ্যাঃ

হাদীছটিতে বর্ণিত দু'আ সম্পর্কে ওয়াদা দেওয়া হয়েছে যে, কোনও বিপদ-আপদে পতিত ব্যক্তি এটি পড়লে আল্লাহ তা'আলা তাকে অবশ্যই প্রতিদান দেবেন এবং সে যা হারাল তার বদলে উত্তম স্থলাভিষিক্ত দান করবেন। বলাবাহুল্য এ ওয়াদা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজের পক্ষ থেকে নয়; বরং আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকেই দিয়েছেন। কাজেই এ ওয়াদার সত্যতায় কোনও সন্দেহ নেই।

হাদীছটির বর্ণনাকারী হযরত উম্মু সালামা রাযি. বলেন, আবূ সালামার ইন্তিকালের পর এ দু'আটি আমার স্মরণ হল। আমি দু'আটি পড়লাম। কিন্তু এর শেষাংশ বলতে আমার মন প্রস্তুত হচ্ছিল না। মনে মনে ভাবছিলাম, আবূ সালামার চেয়ে ভালো আর কে হতে পারে! তিনি এমন ছিলেন, এমন ছিলেন- এই বলে তাঁর গুণাবলি কল্পনা করছিলাম। তারপরও নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেহেতু এ দু'আটি পড়তে বলেছেন, তাই তাঁর প্রতি উৎসর্গিতপ্রাণ ও তাঁর কথার উপর গভীর আস্থাবতী সাহাবিয়া উম্মু সালামা রাযি. দু’আটি শেষপর্যন্ত পড়লেন। আল্লাহ তা’আলা সে দু’আ কবুল করলেন। আবূ সালামার স্থানে তিনি (স্বামী হিসেবে) রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লামকে পেলেন।

উল্লেখ্য, কারও জীবনে এ জাতীয় ওয়াদার সুফল পাওয়ার বিষয়টি তার ঈমান ও বিশ্বাসের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক রাখে। একটি হাদীছে কুদসীতে ইরশাদ হয়েছে-
أَنَا عِنْدَ ظَنّ عَبْدِي بِي
'আমি আমার সম্পর্কে আমার বান্দার ধারণার কাছে থাকি (অর্থাৎ আমার সম্পর্কে আমার বান্দা যেমন ধারণা করে, আমি তার প্রতি সেরকম আচরণই করে থাকি)’।
(সহীহ বুখারী: ৭৫০৫; সহীহ মুসলিম: ২৬৭৫; জামে' তিরমিযী: ২৩৮৮; নাসাঈ, আস সুনানুল কুবরা: ৭৬৮৩; সুনানে ইবন মাজাহ ৩৮২৩; মুসনাদে আহমাদ: ৮১৬৩; সুনানে দারিমী: ২৭৭৩; মুনাদুল বাযযার: ৮৯০৮; সহীহ ইবনে হিব্বান: ৬৩৩; বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান: ৯৭৪)

সুতরাং এ দু'আটি পড়ার সময় মনোযোগ যত গভীর ও বিশ্বাস যত দৃঢ় থাকবে, সুফল পাওয়ার সম্ভাবনাও ততো বেশি থাকবে।

হাদীছটিতে যে-কোনও মসিবতের বেলায়ই এ দু'আটি পড়তে বলা হয়েছে। সে মসিবত শারীরিক হোক, আর্থিক হোক কিংবা হোক মান-সম্মান সম্পর্কিত। এরূপ যে-কোনও বিপদে এ দু'আটি পড়া উচিত। এমনিভাবে সে মসিবত যদি হয় কারও প্রাণবিয়োগ, যেমন পিতা-মাতা, সন্তান, স্বামী, স্ত্রী, ভাইবোন বা যে-কোনও প্রিয়জনের মৃত্যু, তবে মুমিন ব্যক্তিকে গভীর বিশ্বাসের সঙ্গে অবশ্যই এ দু'আটি পড়তে হবে। হযরত উম্মু সালামা রাযি. এ দু'আটি পড়ে দুনিয়াতেই তার সুফল পেয়েছিলেন। আমরাও যদি তাঁর মতো করে বিপদ-আপদে এ দু'আটি পড়ি, তবে অবশ্যই আমরাও এর সুফল পাব।

এ দু'আটি পড়ার দাবি বিপদে নিজেকে স্থির রাখা ও ধৈর্যের পরিচয় দেওয়া। কেউ মুখে দু'আটি পড়ল কিন্তু মনে সবর নেই, আচার-আচরণে স্থিরতা নেই এবং নেই আল্লাহর ফয়সালায় আত্মসমর্পণ ও আদব-কায়দার লেহাজ, তবে সে দু'আপাঠ অসার কথামাত্র হয়ে যায়। এরূপ ব্যক্তি দু'আর কী সুফল পেতে পারে? মনে রাখতে হবে, কুরআন-সুন্নাহর দু'আ গভীর অর্থ ও ভাব বহন করে। তার সম্পর্ক বিশ্বাস ও কর্মের সঙ্গে। দু'আর সঙ্গে জীবনপগঠনেরও সম্পর্ক রয়েছে। প্রকৃত অর্থে ইসলামী দু’আসমূহ জীবনগঠনেরই মূলমন্ত্র। তাই দু'আপাঠ দ্বারা জীবনগঠনে অনুপ্রাণিত হওয়া ও আচার-আচরণ পরিশীলিত করে তোলার চেষ্টা অব্যাহত রাখা অতীব জরুরি। সুন্দর সুফল পাওয়ার বিষয়টা এরই মধ্যে নিহিত। আল্লাহ তা'আলা আমাদেরকে তাওফীক দান করুন।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. যে-কোনও মসিবত প্রকৃত অর্থে বান্দার জন্য আল্লাহ তা'আলার নি'আমত, যেহেতু তা দ্বারা আল্লাহ অভিমুখী হওয়া ও দু'আয় রত হওয়ার সুযোগ মেলে এবং লাভ হয় অশেষ নেকী।

খ. প্রিয়জনকে হারানো ছাড়াও যে-কোনও মসিবতে হাদীছে বর্ণিত দু'আটি পড়তে হবে।

গ. যে-কোনও দু'আ পড়ার সময় সে দু'আ সম্পর্কে হাদীছে যে ওয়াদা আছে তার উপর দৃঢ় বিশ্বাস রাখা অতীব জরুরি। সে বিশ্বাসের বদৌলতেই হযরত উম্মু সালামা রাযি. দু'আটির সুফল লাভ করেছিলেন।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক নিষ্প্রয়োজন
ফিকহুস সুনান - হাদীস নং ১০৮৩ | মুসলিম বাংলা