ফিকহুস সুনান ওয়াল আসার

৩. নামাযের অধ্যায়

হাদীস নং: ৬৯০
মসজিদের দিকে ধীরে ও প্রশান্তির সাথে যেতে হবে। সালাতের যে অংশ মাসবুক ইমামের সাথে পান নি সেটুকু তিনি কাযা করবেন
(৬৯০) আবু হুরাইরা রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, তোমরা যখন ইকামত শুনবে তখন গাম্ভীর্য ও প্রশান্তির সাথে সালাতের দিকে হেঁটে যাবে । তোমরা তাড়াতাড়ি করবে না। তোমরা ইমামের সাথে যে পরিমাণ সালাত পাবে তা আদায় করবে। আর যা তোমরা পাবে না তা পূরণ করবে।
عن أبي هريرة رضي الله عنه عن النبي صلى الله عليه وسلم قال: إذا سمعتم الإقامة فامشوا إلى الصلاة وعليكم بالسكينة والوقار ولا تسرعوا فما أدركتم فصلوا وما فاتكم فأتموا

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীছটিতে নামাযে যাওয়ার আদব বর্ণিত হয়েছে এবং যাওয়ার পর যদি দেখা যায় ইমাম দু-এক রাকাত পড়ে ফেলেছে, সে ক্ষেত্রে কী করণীয় সে সম্পর্কে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। প্রথমে ইরশাদ হয়েছে-
إذا أقيمَتِ الصَّلاةُ ، فلا تَأتوها وأنتُمْ تَسعونَ ‘যখন নামাযের ইকামত হয়ে যায়, তখন তাতে (শরীক হওয়ার জন্য) তোমরা দৌড়ে আসবে না'। সাধারণত লক্ষ করা যায় যখন জামাতের ইকামত হয়ে যায়, তখন লোকে জামাত ধরার জন্য দ্রুত ছুটে যায়, যাতে তাকবীরে উলা বা কোনও রাকাত ছুটে না যায়। এ হাদীছে সেটা নিষেধ করা হয়েছে। কেননা জামাত বা তাকবীরে উলা ধরার নিয়তে বের হলে তার ছাওয়াব হাসিল হয়ে যায়, যদিও তা ধরা সম্ভব না হয়। কাজেই দ্রুত হাঁটা বা দৌড়ানোর কোনও প্রয়োজন নেই। যেহেতু প্রয়োজন নেই, তাই তা করাটা হবে নিরর্থক। সেইসঙ্গে তা আদবেরও পরিপন্থী। নামায যেহেতু দীনের গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন এবং নামাযে হাজির হওয়ার দ্বারা যেন আল্লাহর দরবারে ও তাঁর সমীপে হাজিরা দেওয়া হয়, তাই এ যাওয়ার বিশেষ মাহাত্ম্য ও মহিমা রয়েছে। যে-কোনও মর্যাদাপূর্ণ স্থানে গমনকালে গাম্ভীর্য ও ধীর-শান্ত ভাব রক্ষা করাই নিয়ম। নামাযের ক্ষেত্রে তো সে নিয়ম অনেক বেশি গুরুত্ব রাখে। সুতরাং নামাযে গমনকালে কিছুতেই দৌড়ানো বা দ্রুতবেগে হাঁটা বাঞ্ছনীয় নয়।

তাছাড়া দৌড়িয়ে যাওয়ার দ্বারা ছাওয়াব কমে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। কেননা তাতে কদমের সংখ্যা কমে যায়। হেঁটে যাওয়ায় যত কদম লাগে, দৌড়িয়ে গেলে ততো লাগে না। কেননা হাদীছে জানানো হয়েছে, নামাযে যাওয়ার প্রত্যেক কদমে ছাওয়াব পাওয়া যায়। সুতরাং ইরশাদ হয়েছে-
وَبِكُلِّ خَطْوَةٍ تَمْشِيْهَا إِلَى الصَّلَاةِ صَدَقَةٌ
‘কেউ নামাযে যাওয়ার জন্য যে পথ চলে, তার প্রতিটি কদম ফেলার দ্বারা একেকটি সদাকার ছাওয়াব হয়।' (সহীহ বুখারী: ২৭০৭; সহীহ মুসলিম: ১০০৯; সহীহ ইবন হিব্বান ৩৩৮১; মুসনাদে আহমাদ: ৮১৬৭; বায়হাকী, আস্ সুনানুল কুবরা: ৭৮২০; বাগাবী, শারহুস্ সুন্নাহ: ১৬৪৫)

হাদীছটিতে ইকামত হয়ে গেলে নামাযে দ্রুতগতিতে যেতে নিষেধ করা হয়েছে। এর দ্বারা বোঝা যায় ইকামতের আগে রওয়ানা করলে দ্রুতগতিতে চলার কোনও প্রশ্নই আসে না। কেননা ইকামতের পর রওয়ানা করলে রাকাত ছুটে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। সে ক্ষেত্রেই যখন শান্তভাবে চলতে বলা হয়েছে, তখন ইকামতের আগে রওয়ানা করলে যেহেতু রাকাত ছুটে যাওয়ার কোনও আশঙ্কা থাকে না, তাই তখন তো শান্তভাবে চলা আরও বেশি জরুরি।

প্রশ্ন হতে পারে, আযানের পর জুমু‘আয় যাওয়ার ক্ষেত্রে তো দ্রুতবেগেই চলার হুকুম করা হয়েছে? সুতরাং ইরশাদ হয়েছে-
يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِذَا نُودِيَ لِلصَّلَاةِ مِنْ يَوْمِ الْجُمُعَةِ فَاسْعَوْا إِلَى ذِكْرِ اللَّهِ
হে মুমিনগণ! জুমু‘আর দিন যখন নামাযের জন্য ডাকা হয়, তখন আল্লাহর যিকিরের দিকে ধাবিত হও। (সূরা জুমু'আ (৬২), আয়াত ৯)

তবে কি জুমু‘আর জন্য বিধান আলাদা? উত্তর হল, না। সকল নামাযেই ধীর-শান্তভাবে চলা নিয়ম। এ আয়াতে যে فَاسْعَوْا (ধাবিত হও) বলা হয়েছে, এর দ্বারাও দৌড়িয়ে যাওয়া বোঝানো উদ্দেশ্য নয়। এখানে ধাবিত হওয়ার দ্বারা চেষ্টা করা বোঝানো হয়েছে। অর্থাৎ জুমু‘আর আযান হয়ে গেলে তোমাদের কাজ হবে অন্যসব ছেড়ে জুমু‘আর নামাযের প্রস্তুতি নেওয়া এবং নামায ধরার চেষ্টা করা। কিন্তু চলতে হবে শান্তভাবেই, যেমনটা আলোচ্য হাদীছে বলা হয়েছে। মুফাসসিরদের অনেকেই فَاسْعَوْا এর অর্থ 'চেষ্টা করা'-ই বলেছেন। কুরআন মাজীদেও শব্দটি এ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন আছে-
وَإِذَا تَوَلَّى سَعَى فِي الْأَرْضِ لِيُفْسِدَ فِيهَا
‘সে যখন উঠে চলে যায়, তখন যমীনে অশান্তি বিস্তারের চেষ্টা করে।’ (সূরা বাকারা (২), আয়াত ২০৫)

আবার অনেকে বলেছেন, এর অর্থ আন্তরিক নিয়ত ও গাম্ভীর্যের সঙ্গে চলা। হাসান বসরী রহ. বলেন, আল্লাহর কসম! فَاسْعَوْا এর অর্থ দৌড়ানো নয়; বরং শান্তভাবে চলা। কাতাদা রহ. বলেন, سعي বলা হয় পায়ে হেঁটে চলাকে। যেমন ইরশাদ হয়েছে-
فَلَمَّا بَلَغَ مَعَهُ السَّعْيَ
‘অতঃপর সে পুত্র যখন ইবরাহীমের সাথে চলাফেরা করার উপযুক্ত হল।' (সূরা আস-সাফফাত (৩৭), আয়াত ১০২)

মোটকথা জুমু‘আসহ যে-কোনও নামাযের জামাতে শামিল হওয়ার জন্য ধীর-শান্তভাবে চলাটাই আদব। এ হাদীছটিতে সাধারণভাবেই বলা হয়েছে- إذا أقيمَتِ الصَّلاةُ (যখন নামাযের ইকামত হয়ে যায়)। অর্থাৎ তা যে নামাযই হোক। দৈনন্দিন পাঁচ ওয়াক্তের নামায হোক বা জুমু'আর নামায। সকল নামাযের জন্যই হুকুম হল-
وَأتُوهَا وَأنْتُمْ تَمْشُونَ، وَعَلَيْكُمُ السَّكِينَةُ (বরং তোমরা হেঁটে হেঁটে আসবে এবং ধীর-শান্ত ভাব রক্ষা করবে)। অর্থাৎ এমনভাবে হেঁটে আসবে, যাতে ভাবগাম্ভীর্য নষ্ট না হয় ও নামাযে আসার মাহাত্ম্য ক্ষুণ্ণ না হয়। চলবে শান্তভাবে। দৃষ্টিকটু অঙ্গভঙ্গি করবে না। বেহুদা কথা বলবে না। অহেতুক কাজ করবে না। মুসলিম শরীফের বর্ণনাটুকু এদিকে ইঙ্গিত করছে। বলা হয়েছে-
فَإنَّ أحَدَكُمْ إِذَا كَانَ يَعْمِدُ إِلَى الصَّلاَةِ فَهُوَ في صَلاَةٍ (কেননা তোমাদের কেউ যখন নামাযের উদ্দেশে যায়, তখন সে নামাযেই থাকে)। অর্থাৎ এ যাওয়াটা অন্যান্য কাজে যাওয়ার মতো নয়। এ যাওয়ার আলাদা মহিমা আছে। এটা নামাযের মতো মহান এক ইবাদতে শরীক হওয়ার জন্য যাওয়া। এর প্রত্যেক কদমে ছাওয়াব লেখা হয়, গুনাহ মাফ হয়। কাজেই এ সময় অহেতুক সব কাজ থেকে বিরত থাকা চাই। চলতে হবে আদবের সঙ্গে। ধীর-শান্তভাবে। যাতে মাহাত্ম্যপূর্ণ এ গমনের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ না হয়।

এভাবে আসার পর যদি দেখা যায় রাকাত ছুটে গেছে, সে ক্ষেত্রে কী করণীয়? নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
فَمَا أَدْرَكْتُمْ فَصَلُّوْا، وَمَا فَاتَكُمْ فَأَتِمُّوا (তারপর তোমরা নামাযের যে অংশ পাও তা পড়বে আর যা ছুটে যায় তা পূর্ণ করে নেবে)। অর্থাৎ ইমামের সঙ্গে যা পাবে তা ইমামের অনুসরণে পড়তে থাকবে। তারপর যা ছুটে গেল, ইমাম সালাম ফেরানোর পর উঠে তা আদায় করে নেবে। তাতে পূর্ণ জামাতের ছাওয়াব পেয়ে যাবে।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. জামাতে শামিল হওয়ার জন্য চলাটা অন্যান্য চলার মতো নয়। এর আলাদা মর্যাদা আছে। তাই চলাটা ধীর-শান্তভাবে হওয়া উচিত।

খ. যদি অলসতা করা না হয় এবং পূর্ণ জামাত ধরার ইচ্ছা থাকে, তবে শান্তভাবে যাওয়ার পর রাকাত ছুটে গেলেও ছাওয়াব কমে না; বরং পূর্ণ জামাতের ছাওয়াবই পাওয়া যায়।

গ. ইমামের সঙ্গে যে রাকাত পাওয়া যায়, তা মাসবুক ব্যক্তির শেষ রাকাত। আর যা ছুটে গেল তা প্রথম দিকের রাকাত। তাই তা শুরুর রাকাত হিসেবেই পড়ে নিতে হবে।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান