ফিকহুস সুনান ওয়াল আসার

৩. নামাযের অধ্যায়

হাদীস নং: ৬০৮
কুরআনের সূরা ও আয়াতের পরম্পরা উল্টে পাঠ করা
(৬০৮) হুযাইফা রা. বলেন, আমি একরাতে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর সাথে (তাহাজ্জুদের সালাত) আদায় করলাম। তিনি সূরা বাকারাহ শুরু করলেন। আমি (নিজের মনে) বললাম, তিনি ১০০ আয়াত শেষ করে রুকু করবেন । তিনি ১০০ আয়াত পার হয়ে গেলেন। আমি বললাম, তিনি এক রাকআতে এই সূরা শেষ করবেন। তিনি সূরা শেষ করলেন । আমি বললাম, তিনি হয়ত এখন রুকু করবেন। তিনি সূরা নিসা শুরু করলেন। তিনি । সূরা নিসা পাঠ করে শেষ করলেন। এরপর তিনি সূরা আল ইমরান শুরু করলেন। তিনি ধীরে ধীরে পাঠ করছিলেন...।
عن حذيفة رضي الله عنه قال: صليت مع النبي صلى الله عليه وسلم ذات ليلة فافتتح البقرة فقلت يركع عند المائة ثم مضى فقلت يصلي بها في ركعة فمضى فقلت يركع بها ثم افتتح النساء فقرأها ثم افتتح آل عمران فقرأها يقرأ مترسلا

হাদীসের ব্যাখ্যা:

১. গ্রন্থকার রাহ. বলেন, এ হল সূরার পরম্পরা রক্ষার বিধান। আর সূরার মধ্যকার আয়াতের পরম্পরা রক্ষা করা ওয়াজিব। সূরার মধ্যকার আয়াত উল্টে পড়া হারাম। নিম্নের হাদীস থেকে তা বোঝা যায়।

২. এ হাদীছে যে নামাযের কথা বলা হয়েছে তা ছিল তাহাজ্জুদের নামায। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাহাজ্জুদের নামায কখনও কখনও এরকম দীর্ঘ পড়তেন। তাঁর সাধারণ নিয়ম ছিল রাতের এক-তৃতীয়াংশ পরিমাণ সময় তাহাজ্জুদে কাটানো। অর্থাৎ তিনি রাতে ইবাদতও করতেন এবং ঘুমাতেনও। কেবল ‘ইবাদতের ভেতর সমস্ত রাত পার করতেন না। তাঁর সবকিছুতে ছিল মধ্যপন্থা। তাঁর জীবন যেহেতু উম্মতের জন্য আদর্শ, তাই মধ্যপন্থা রক্ষা করে চলতেন, যাতে উম্মত সহজে তাঁর অনুসরণ করতে পারে।
তবে কখনও কখনও ব্যতিক্রমও হত, যেমন আলোচ্য হাদীছে দেখা যাচ্ছে। এক রাক'আতে সূরা বাকারা, সূরা আলে-ইমরান ও সূরা নিসা পড়েছেন। এ তিন সূরায় পাঁচ পারারও বেশি হয়। পড়েছেন তারতীলের সঙ্গে। তাসবীহের আয়াত আসলে তাসবীহ পড়তেন। প্রার্থনার আয়াত আসলে প্রার্থনা করতেন। তিনি তিলাওয়াত করতেন তাদাব্বুরের সাথে। অর্থাৎ আয়াতের বিষয়বস্তু সম্পর্কে গভীর ধ্যান ও চিন্তা সহকারে পড়তেন। এভাবে এক রাক'আতে পাঁচ পারারও বেশি পরিমাণ তিলাওয়াত করতে নিশ্চয়ই অনেক দীর্ঘ সময় লাগার কথা। তারপর প্রায় সমপরিমাণ সময় রুকূ'তে, অনুরূপ সময় কওমায় (রুকুর পর দাঁড়ানো অবস্থা), অনুরূপ দীর্ঘ সময় সিজদায়, তারপর জলসা, তারপর দ্বিতীয় সিজদা, এভাবে প্রতিটি কাজ এতটা দীর্ঘ সময় নিয়ে করলে কতখানি সময়ের দরকার তা সহজেই অনুমান করা যায়।
নামায ছিল নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের চোখের শীতলতা এবং সর্বাপেক্ষা প্রিয় আমল। তাই কখনও কখনও তিনি এরূপ দীর্ঘ নামাযও পড়তেন। এটা ছিল নামাযে তাঁর মুজাহাদা। নফসের বিরুদ্ধে জিহাদকারীর মত ‘ইবাদত-বন্দেগীতে তিনি এরূপ কষ্টক্লেশ বরদাশত করতেন। তবে সে কষ্টক্লেশ হত কেবলই শারীরিক। মনে কোনও কষ্টবোধ হত না। বরং যত দীর্ঘ নামায পড়তেন, ততই তাঁর মন প্রশান্তিতে ভরে উঠত।
পূর্বে ৯৮ নং হাদীছে বর্ণিত হয়েছে, তিনি তাহাজ্জুদে এত দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থাকতেন যে, তাঁর পা ফুলে ফেটে যেত। সম্ভবত তা এরূপ দীর্ঘ কিরাআত সম্বলিত নামাযই ছিল। এমন দীর্ঘ নামাযে তাঁর কোনও ক্লান্তিবোধ হত না। কিন্তু আমরা যারা সাধারণ, তাদের পক্ষে এটা অত্যন্ত কষ্টকর হবে। এজন্যই নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাধারণত মধ্যপন্থা অবলম্বন করতেন এবং কখনও কখনও এতটা দীর্ঘ নামায পড়লেও আমাদেরকে হুকুম দিয়েছেন, যেন নিজেদের শক্তিসামর্থ্যের দিকে লক্ষ রেখেই ইবাদত করি, যেমনটা পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে।
এ হাদীছে বলা হয়েছে, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম সূরা বাকারার পর সূরা নিসা পড়েছেন। তারপর পড়েছেন সূরা আলে-ইমরান। কিন্তু কুরআন মাজীদের বিন্যাসে দেখা যায় সূরা নিসাকে রাখা হয়েছে সূরা আলে-ইমরানের পর। কুরআনের বিন্যাসে সূরা আলে-ইমরান আগে হওয়া সত্ত্বেও নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সূরা নিসা কেন আগে পড়লেন?
এর কারণ হল, এ কথা ঠিক যে, কুরআন মাজীদের সূরা ও আয়াতসমূহের বিন্যাস 'তাওকীফী' অর্থাৎ আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে প্রাপ্ত। আল্লাহ তা'আলাই হযরত জিবরীল 'আলাইহিস সালাম মারফত নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জানিয়ে দিয়েছেন কোন্ সূরার পর কোন্ সূরা হবে এবং কোন্ আয়াতের পর কোন্ আয়াত। কিন্তু এই চূড়ান্ত বিন্যাস হয়েছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনের একদম শেষপর্যায়ে। কুরআন মাজীদ শুরু থেকে এ বিন্যাস অনুযায়ীই যে নাযিল হয়েছে তা নয়। নাযিল করা হয়েছে যখন যা প্রয়োজন হয়েছে সে অনুপাতে। অনেক সূরাই নাযিল হয়েছে শুরুর দিকে, কিন্তু চূড়ান্ত বিন্যাসে তা স্থান পেয়েছে মাঝখানে বা শেষের দিকে। কাজেই চূড়ান্ত বিন্যাসের আগে যে সমস্ত নামায পড়া হয়েছে, তাতে সূরার তারতীব (বিন্যাস) বর্তমানে সূরাসমূহ যেভাবে আছে সেভাবে হওয়ার কথা নয়। আমাদের কাছে যেই কুরআন আছে তা কুরআনের চূড়ান্ত বিন্যস্ত রূপ। সুতরাং এ বিন্যাসের সাথে প্রথমদিকে পঠিত সূরাসমূহের মিল না হওয়ারই কথা। কাজেই নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম সূরা উলট-পালট করে পড়েছেন সে প্রশ্ন আসে না। এখন যদি কেউ নামাযে সূরা আলে-ইমরানের আগে সূরা নিসা পড়ে, তবে তার সে পড়া হবে কুরআনের বিন্যাস পরিপন্থি। আর একই রাক'আতে ইচ্ছাকৃতভাবে এরূপ পড়লে নামায মাকরূহ হয়ে যাবে। কেননা আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকে যখন চূড়ান্তভাবে আয়াত ও সূরা বিন্যস্ত করে দেওয়া হয়েছে, তখন বান্দার কর্তব্য তিলাওয়াতে সে বিন্যাসের অনুসরণ করা।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. এ হাদীছেও আমাদের জন্য মুজাহাদার শিক্ষা রয়েছে। মা'সূম ও নিষ্পাপ হওয়া সত্ত্বেও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন ‘ইবাদতে এত কষ্ট স্বীকার করতেন, তখন আমরা কিভাবে আরাম-আয়েশ খুঁজতে পারি?

খ. নফল নামাযে যখন কোনও দু'আর জায়গা আসে, তখন দু'আ করা মুস্তাহাব। যেমন, জান্নাতের আলোচনা আসলে জান্নাত প্রার্থনা করা, জাহান্নামের আলোচনা আসলে তা থেকে মুক্তি চাওয়া, আযাবের কথা আসলে তা থেকে আল্লাহর পানাহ চাওয়া ইত্যাদি।

গ. সূরা ফাতিহার পর যেমন একাধিক সূরা পড়া যায়, তেমনি রুকূ-সিজদায়ও দীর্ঘক্ষণ তাসবীহ পড়া যেতে পারে। বরং নফল নামাযে দীর্ঘক্ষণ তাসবীহ পড়া মুস্তাহাব।
২. ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক নিষ্প্রয়োজন
ফিকহুস সুনান - হাদীস নং ৬০৮ | মুসলিম বাংলা