ফিকহুস সুনান ওয়াল আসার

১- সামগ্রিক মূলনীতিসমূহ

হাদীস নং: ৬২
ফকীহগণের (Jurists: শাস্ত্রবিদ) মর্যাদা
(৬২) আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আরবদের বিষয়ে বলেছেন, যারা জাহিলিয়াতের সময় ভালো ছিল তারা যদি ফিকহ (ইসলামের বিষয়ে গভীর জ্ঞান ও প্রজ্ঞা ) অর্জন করতে পারে তাহলে ইসলামেও তারাই ভালো বলে গণ্য হবে।(বুখারি)।
عن أبي هريرة رضي الله عنه مرفوعا في معادن العرب: خيارهم في الجاهلية خيارهم في الإسلام إذا فقهوا

হাদীসের ব্যাখ্যা:

معادن শব্দটি معدن -এর বহুবচন। এর অর্থ খনি। এ হাদীছে মানুষকে খনির সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। খনিতে সোনা-রুপা, লোহা, শীসা প্রভৃতি সম্পদ থাকে। তদ্রূপ মানুষও বিভিন্ন গুণের ধারক হয়ে থাকে, তাই রূপকার্থে তাকে معدن (খনি) বলা হয়েছে।

খনিজ সম্পদ প্রাকৃতিক হয়ে থাকে। তেমনিভাবে মানুষও প্রাকৃতিক তথা জন্মগতভাবে বিভিন্ন গুণের অধিকারী হয়ে থাকে। খনিজ সম্পদের মধ্যে কোনওটি অপেক্ষা কোনওটি বেশি দামী। মানুষের জন্মগত গুণাবলীতেও পার্থক্য থাকে। জন্মগতভাবে একজন অপেক্ষা অন্যজন উন্নত গুণের অধিকারী হয়। বিশেষ বিশেষ গুণের কারণে কেউ কেউ এত উপরে চলে যায় যে, অন্যরা তাদেরকে নেতৃত্বের আসনে বসাতে বাধ্য হয়। অনেক সময় গোত্রবিশেষের মধ্যেও অন্যদের তুলনায় ভালো ভালো গুণ বেশি পাওয়া যায়। ফলে সেসব গোত্র অন্যান্য গোত্র অপেক্ষা অভিজাত বলে গণ্য হয়। তাদেরকে অন্যদের তুলনায় শ্রেষ্ঠ মনে করা হয়।

বোঝা গেল ঈমান ও ইসলামের শর্ত ছাড়াও জন্মগত সদ্‌গুণের কারণেও কেউ কেউ অপেক্ষাকৃত শ্রেষ্ঠ বলে গণ্য হতে পারে। তবে এ শ্রেষ্ঠত্ব কেবলই পার্থিব বিষয়। আল্লাহ তাআলার কাছে শ্রেষ্ঠত্ব লাভের জন্য ইসলাম শর্ত। জন্মগত সদ্‌গুণের সঙ্গে যদি ইসলাম যুক্ত হয়ে যায়, তবে তুলনামূলকভাবে অপরাপর মুসলিম অপেক্ষা তার মর্যাদা উপরে চলে যায়। সেইসঙ্গে সে যদি ইলমে দীনের অধিকারীও হয়, তবে সর্বশ্রেষ্ঠদের কাতারে চলে যায়। আলোচ্য হাদীছে সেদিকে ইঙ্গিত রয়েছে।

দীনের বুঝ-জ্ঞান থাকার মর্যাদা
হাদীসে আছে, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন- (জাহেলী যুগে তাদের মধ্যে যারা শ্রেষ্ঠ ছিল, ইসলামেও তারাই শ্রেষ্ঠ, যখন তারা দীনের বুঝ-জ্ঞান অর্জন করবে)। অর্থাৎ ইসলামেও তারাই শ্রেষ্ঠ, যারা জাহিলী যুগে শ্রেষ্ঠ ছিল। তবে একটা শর্ত রয়েছে। শর্তটি হলো দীনের জ্ঞান বুঝ থাকা। যারা দীনের জ্ঞান-বুঝ হাসিল করেছে, প্রকৃত শ্রেষ্ঠত্ব তাদেরই। জাহিলী যুগে যদি তারা শ্রেষ্ঠ হয়ে থাকে, তবে ইসলামে তারা অধিকতর শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী হবে। কেননা জাহিলী যুগে যে সমস্ত সদগুণের কারণে তারা অন্যদের ছাড়িয়ে গিয়েছিল, যেমন সাহসিকতা, অতিথিপরায়ণতা, প্রতিশ্রুতি রক্ষা, সত্যবাদিতা ইত্যাদি, ইসলামেও সেগুলোর বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। তো যখন এসব সদগুণ আগে থেকেই তাদের মধ্যে বিদ্যমান রয়েছে, সেইসঙ্গে দীনের 'ইলম ও অনুসরণের বাড়তি মহিমাও অর্জন হয়ে গেল, তখন স্বাভাবিকভাবেই তারা ইসলামেও অন্যান্যদের থেকে এগিয়ে থাকবে। বাস্তব ইতিহাসও তাই প্রমাণ করে।

জাহিলী যুগে কুরায়শ গোত্র বিভিন্ন সদগুণে অন্যসব গোত্রের চেয়ে অগ্রসর ছিল। এ কারণে তারা অন্যান্য গোত্রের উপর নেতৃত্ব দান করত। ইসলামী যুগেও দেখা গেল তারা সকলের অগ্রগামী। সেই কুরায়শ গোত্রের ভেতর আবার বনু হাশিমকে শ্রেষ্ঠ মনে করা হতো। তার মানে বনূ হাশিম সর্বকালের শ্রেষ্ঠ গোত্র। তাই এ গোত্রেই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আবির্ভাব হয়। এক হাদীছে তিনি এ গোত্রের শ্রেষ্ঠত্বের সাক্ষ্য দান করেছেন। ইসলামী যুগেও তাদের সে শ্রেষ্ঠত্ব বজায় থাকে।

শ্রেষ্ঠত্ব লাভের জন্য এ হাদীছে যে শর্তের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, অর্থাৎ দীনের বুঝ-জ্ঞান, তা না পাওয়া গেলে কোনও ব্যক্তি বা কোনও গোত্র শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী হতে পারবে না, তাতে সে ব্যক্তি বা সে গোত্র জাহিলী যুগে যতই অভিজাত গণ্য হোক না কেন। বরং জাহিলী যুগে সর্বনিম্ন স্তরের গণ্য হওয়া সত্ত্বেও যে ব্যক্তি দীন বুঝবে ও দীনের অনুসরণ করবে, সে অবশ্যই বেদীনদের তুলনায় অনেক বেশি মর্যাদাবান সাব্যস্ত হবে। ইসলামে প্রকৃত মর্যাদার মাপকাঠি কেবলই দীনের বুঝ-জ্ঞান।

উল্লেখ্য, দীনের বুঝ-জ্ঞান ও আমল-অনুসরণ পরস্পর অবিচ্ছেদ্য। দীনের অনুসরণ যদি না করা হয়, তবে কেবল বুঝ জ্ঞানের কোনও মূল্য নেই। সুতরাং যে সকল স্থানে দীনের ইলম ও দীনের বুঝ-সমঝের মর্যাদা বর্ণনা করা হয়েছে, তাতে আমল ও অনুসরণের বিষয়টাও অপরিহার্যভাবে তার অন্তর্ভুক্ত থাকবে।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. অমুসলিম ব্যক্তির মধ্যেও উল্লেখযোগ্য ভালো গুণ থাকতে পারে। তা দ্বারা সে দুনিয়ায় উপকৃত হবে, কিন্তু ঈমান না থাকার কারণে আখেরাতে তা কোনও কাজে আসবে না।

খ. সদ্গুণসম্পন্ন অমুসলিম ব্যক্তি ঈমান আনলে মুসলিম হিসেবে তার মর্যাদা অনেক বেড়ে যায়।

গ. কোনও মুসলিম ব্যক্তির মধ্যে জন্মগতভাবে বিশেষ কোনও অসদ্গুণ থাকলে তার কর্তব্য সাধনা-মুজাহাদা দ্বারা তা সংযত ও দমিত রাখা।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক নিষ্প্রয়োজন