মুসনাদে ইমাম আযম আবু হানীফা রহঃ

১৭. ক্রয়-বিক্রয়ের বিধান

হাদীস নং: ৩৪১
শিকারী কুকুরের মূল্য আদায় করার অনুমতি
হাদীস নং- ৩৪১

হযরত ইব্‌ন আব্বাস (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) শিকারী কুকুরের মূল্য প্রদানের অনুমতি দান করেছেন।
عَنِ الْهَيْثَمِ بْنِ حَبِيبٍ، عَنْ عِكْرِمَةَ، عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا، قَالَ: «رَخَّصَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِي ثَمَنِ كَلْبِ الصَّيْدِ»

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীসে কুকুরের ক্রয়-বিক্রয় সম্পর্কে মাসয়ালা বর্ণিত হয়েছে। ইমাম শাফিঈ ও ইমাম আবূ হানীফা (র)-এর মধ্যে এটা নিয়ে মতপার্থক্য রয়েছে। সুতরাং ইমামগণের মতপার্থক্য ও এ সম্পর্কিত সঠিক মাসয়ালা এখানে বর্ণনা করা হলো।
ইমাম শাফিঈ (র)-এর মতে কুকুর শিকারী হোক বা না হোক, এর ক্রয়-বিক্রয় বৈধ নয়। তিনি হাদীস ও কিয়াস দ্বারা তাঁর স্বপক্ষে দলীল পেশ করেছেন। বুখারী ও মুসলিম শরীফে হযরত ইব্‌ন মাসউদ (রা) বর্ণিত হাদীসে রয়েছে, নবী করীম (সা) কুকুরের মূল্য, ব্যভিচারিণী নারী এবং গণকের পারিশ্রমিক প্রদানের ব্যাপারে নিষেধ করেছেন। কিয়াসের মাধ্যমে তাঁরা বলেন যে, কুকুর হলো মৌলিকভাবে অপবিত্র এবং অপবিত্রতা ও ময়লা ঘৃণার উদ্রেক করে। আর বিক্রয় সম্মান ও মর্যাদা প্রকাশ করে। সুতরাং এ দুটো একত্র হবে কিভাবে? তাই এটা বিক্রি বৈধ নয়।
ইমাম আবূ হানীফা (র)-এর মতে এ সাধারণ নিষেধাজ্ঞার দ্বারা শিকারী কুকুর, গৃহ পালিত জন্তুর পাহারায় নিয়োজিত কুকুর, ফসলের হিফাযত ও বাড়ির পাহারায় নিয়োজিত কুকুর ব্যতিক্রম বা বাদ দেয়া হয়েছে। তাবিঈনের মধ্যে অনেকেই এ মত পোষণ করেন। যেমন আতা, যুহরী ও অন্যান্যগণ। ইমাম আবূ হানীফা (র)-এর মাযহারের স্বপক্ষে শক্তিশালী দলীল হলো বর্ণিত হাদীস যা বাক্য ও বর্ণনার দিক দিয়ে সুস্পষ্ট ও সঠিক।হায়সুম ইব্ন হাবিব আস-সিয়াবনীর নির্ভরযোগ্য হওয়ার ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। ইকরামা ও হযরত ইব্ন আব্বাস (রা)-এর নির্ভরযোগ্যতা খুবই সুপ্রসিদ্ধ। অন্যান্য হাদীস এ মাযহাবের ভিত্তিকে আরো শক্তিশালী করেছে। যেমন তিরমিযী শরীফে হযরত আবূ হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত হাদীসঃ
نهى رسول الله صلى الله عليه وسلم عن ثمن الكلب إلا كلب صيد
"রাসূলুল্লাহ (সা) কুকুরের মূল্য (গ্রহণ থেকে) নিষেধ করেছেন, তবে শিকারী কুকুর ব্যতীত।" যদিও তিরমিযী এ হাদীসকে সহীহ বলেনি, কিন্তু অন্য রিওয়ায়েতে এর স্বপক্ষে হাদীস বিদ্যমান রয়েছে। সর্ব প্রথম বর্ণিত হাদীস এগুলোর সাথে নিলে এ ব্যতিক্রম (استثناء) সৃষ্টি করেছে। যদি হাদীস সহীহ না হয়, তবে হাসান (حسن) অবশ্যই হবে।
ইমাম বায়হাকী এর উপর বিরোধিতা করে বলেন, এ হাদীসে হাম্মাদের রিওয়ায়েত কায়েস থেকে সহীহ নয়, মুসলিমের রিজাল (رجال) -এর মধ্যে কারো কোন সমালোচনা নেই। অতঃপর বায়হাকী স্বয়ং এক সূত্রে হযরত জাবির (রা) থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেনঃنهى عن ثمن الكلب والسنور إلا كلب الصيد "নবী করীম (সা) কুকুর ও বিড়ালের মূল্য (গ্রহণ) থেকে নিষেধ করেছেন, শুধু শিকারী কুকুর ব্যতীত।"
এ হাদীসে একটি সন্দেহ সৃষ্টি হয় যে, হাম্মাদ (বর্ণনাকারীদের মধ্যে একজন) عن النبي صلى الله عليه وسلم বলেননি, অর্থাৎ এ হাদীসকে মরফু বলেননি। অথচ সমালোচনা কারীদের মতে এ হাদীস হলো হরফু। বলা হয়েছে যে, উবায়দুল্লাহ ইব্ন মূসা হাম্মাদ থেকে মরফূ রিওয়ায়েত করতে সন্দেহ করেছেন। অথচ সন্দেহ এর দূরীভূত করার মধ্যে কোন বাঁধা নেই। যদি رفع হাকীকী না হয়, তবে হুকমী হবে। দারে কুতনী হযরত জাবির (রা) থেকে হাদীস গ্রহণ করেছেন যে : لا اعلمه الا من النبي صلى الله عليه وسلم (এটা আমি নবী করীম (সা) থেকে অবগত হয়েছি)। সুতরাং এটা তো নিঃসন্দেহে মরফু হলো। এছাড়া স্বয়ং বায়হাকী লিখেছেন যে, হায়সুম ইব্‌ন জামিল হাম্মাদ থেকে : نهى رسول الله صلى الله عليه وسلم এভাবে হাদীস বর্ণনা করেছেন। এবার এর মধ্যে কি সন্দেহ থাকতে পারে এবং হয়সুম হলেন নির্ভরযোগ্য (ثقه) এবং অধিক নির্ভরযোগ্যতা নিঃসন্দেহে গ্রহণযোগ্য। এমনিভাবে ইমাম নাসাঈ (র) হযরত জাবির (রা) থেকে বর্ণনা করেছেন যে, নবী করীম (সা) বিড়াল ও কুকুরের মূল্য গ্রহণ থেকে নিষেধ করেছেন, শিকারী কুকুর ব্যতীত। এ হাদীসের সমস্ত বর্ণনাকারী নির্ভরযোগ্য (ثقه) মোট কথা এ সমস্ত ব্যতিক্রম বা استثناء এর হাদীসের কোন একটির সনদে দুর্বলতা পাওয়া গেলেও তা متابعت এর দ্বারা শক্তিশালী হয়ে যায় এবং حسن এর মর্যাদা পর্যন্ত পৌঁছে যায়, যা দলীল হিসেবে গ্রহণযোগ্য।
এবার যে সমস্ত হাদীস দ্বারা ইমাম শাফিঈ (র) দলীল গ্রহণ করেছেন, এর জওয়াব হলো এই যা পূর্বে বর্ণিত হয়েছে যে, এটা হলো সাধারণ, যা সমস্ত কুকুরের বিক্রি নিষিদ্ধ করে এবং এ সহীহ হাদীসসমূহ বিশেষভাবে নির্দিষ্ট করে দিয়েছে, শিকারী কুকুর, ফসলাদি, ঘরবাড়ি এবং গৃহপালিত জন্তুর পাহারায় নিয়োজিত কুকুর এ বিধান থেকে ব্যতিক্রম। অথবা সাধারণ নিষেধাজ্ঞার হাদীস রহিত করা হয়েছে। ইসলামের প্রারম্ভে এরূপ বিধানই ছিল যে, আঁ হযরত (সা) কুকুর থেকে যে কোন প্রকার উপকারিতা লাভ করা হারাম বলেছেন, কিন্তু পরে অনুমতি প্রদান করেছেন। বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ (সা) শিকারী কুকুর হত্যা করলে চল্লিশ দিরহাম আদায় করার নির্দেশ দিয়েছেন এবং ফসলাদি পাহারায় নিয়োজিত কুকুর হত্যা করলে এক কাবাশ (كبش) আদায় করার নির্দেশ জারী করেছেন। ইবনুল মালিক এটা উল্লেখ করেছেন। এটাও হতে পারে যে, নিষেধাজ্ঞার এ হাদীসে দংশনকারী ও অশিক্ষিত কুকুরকে বুঝানো হয়েছে, যে কুকুর পোষ মানানো, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এবং উপকারিতা লাভের যোগ্য, সেগুলো নয়।
ইমাম আবূ হানীফা (রা) কিয়াস দ্বারাও স্বীয় মাযহাবের স্বপক্ষে দলীল পেশ করেছেন। তাহলো এই যে, শরীয়তের দৃষ্টিতে কুকুর হলো সম্পদ। কেননা এটা পালন করা এবং এরদ্বারা উপকারিতা লাভ করার অনুমতি রয়েছে। বুখারী শরীফে হযরত আবূ হুরায়রা (রা) থেকে মরফু হাদীস বর্ণিত আছে, যে ব্যক্তি কুকুর লালন পালন করবে, তার আমল থেকে প্রত্যহ এক কিরাত হ্রাস হয়ে থাকে। কিন্তু ফসলাদি ও গৃহপালিত জন্তুর পাহারার কাজে নিয়োজিত কুকুর পালন বৈধ। অতঃপর ইব্ন সীরিন এবং আবূ সালিহের সূত্রে যে রিওয়ায়েত বর্ণনা করা হয়েছে, এতে শিকারী কুকুর ব্যতিক্রম বা আলাদা করা হয়েছে। যখন কুকুর মাল হিসেবে উপকারিতা লাভের যোগ্য এবং সম্পদের মধ্যে গণ্য হয়েছে, তাই অন্যান্য মাল ও সম্পদের মত এটাও ক্রয়-বিক্রয় বৈধ। এ ছাড়া কুকুরের মূল অপবিত্রতার কারণে ক্রয়-বিক্রয়ে কোন বাধা নেই, যেমন ইমাম শাফিঈ মনে করেন। কেননা হাতিও যেমন অপবিত্র কিন্তু এটা ক্রয়-বিক্রয় বৈধ এবং সম্পদ হিসেবে গণ্য। এভাবে কুকুরও সম্পদ হিসেবে গণ্য। পবিত্র কুরআনে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কুকুরের শিকার হালাল বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সুতরাং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কুকুর মূল্য ও টাকা ছাড়া কোথায় পাওয়া যাবে?
মুসনাদে আবু হানীফা রহঃ - হাদীস নং ৩৪১ | মুসলিম বাংলা