মুসনাদে ইমাম আযম আবু হানীফা রহঃ

১৫. শরীআতের দন্ড বিধি অধ্যায়

হাদীস নং: ৩১৬
বিবাহিত ব্যভিচারীকে পাথর নিক্ষেপ করে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা
হাদীস নং- ৩১৬

হযরত বুরায়দা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত, একবার মায়েয ইব্ন মালিক (রাযিঃ) নবী করীম (ﷺ)-এর খিদমতে আগমণ করেন এবং বলেন, কল্যাণ থেকে দূরে পতিত ব্যক্তি ব্যতিচার করেছে। আপনি তার উপর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করুন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাকে ফিরিয়ে দিলেন। এরপর ঐ ব্যক্তি দ্বিতীয়বার আগমণ করে একই কথা পুনরায় বলেন। হুযুর (ﷺ) এবারও তাকে ফিরিয়ে দেন। অতঃপর তৃতীয়বার আগমণ করে তার অপরাধের কথা স্বীকার করেন এবং শাস্তির আবেদন করেন। এবার তিনি তাকে ফিরিয়ে দেন। চতুর্থবার লোকটি এসে আরয করেন, কল্যাণ ও মঙ্গল থেকে দূরে পতিত বা অবস্থানকারী ব্যাক্তি ব্যাভিচার করেছে। আপনি তার উপর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করুন। তখন তিনি তাঁর সাহাবাদেরকে জিজ্ঞাসা করেন লোকটি কি পাগল? সাহাবাগণ বললেন, জ্বি না। নবী করীম (ﷺ) বললেন: লোকটিকে নিয়ে যাও এবং তার উপর পাথর নিক্ষেপ করে তাকে শাস্তি প্রদান কর (কেননা এ লোকটি বিবাহিত ছিল)।
বুরায়দা (রাযিঃ) বলেন, তাকে নিয়ে যাওয়া হলো এবং পাথর মেরে শাস্তি দেয়া শুরু হলো কিন্তু তার মৃত্যু বিলম্ব হতে লাগল। ফলে সে অধিক কংকরময় স্থানে গিয়ে দাঁড়াল যাতে দ্রুত মৃত্যু হয়। মুসলমানগণ পিছনে গমন করে এবং তাকে এভাবে পাথর নিক্ষেপ করে যার ফলে সে মৃত্যুবরণ করে। অতঃপর এ সংবাদ নবী করীম (ﷺ)-এর নিকট পৌঁছে, তখন তিনি বললেনঃ কেন তোমরা তার পিছু ত্যাগ করনি (যখন সে তার স্থান ত্যাগ করে)? লোকজন মায়েয ইব্ন মালিক সম্পর্কে বিভিন্ন উক্তি করতে থাকে। কেউ বলেন, মায়েয আত্মহত্যা করেছে। আবার কেউ বলেন, এটা তার জন্য তওবা হবে। এ সংবাদ নবী করীম (ﷺ) পর্যন্ত পৌঁছলে তিনি বললেন : মায়েয যে তওবা করেছে, যদি দলবদ্ধ হয়ে লোকজন এরূপ তওবা করে, তা হলে তা কবুল হবে। এ সংবাদ যখন লোকজনের নিকট পৌঁছে, তখন মায়েয-এর ক্ষমার ব্যাপারে তারা আশা পোষণ করে। এরপর হুযূর (ﷺ)-এর নিকট মায়েয-এর মৃতদেহ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে। তিনি বললেন: তোমরা তোমাদের মৃত ব্যক্তির জন্য যা কর, তার জন্যও এ সমস্ত কর অর্থাৎ দাফন কাফন কর, তার জন্য জানাযার নামায আদায় কর। বুঝায়দা (রাযিঃ) বলেন, অতঃপর লোকজন তাকে নিয়ে যায় এবং তার জানাযার নামায আদায় করে (দাফনের ব্যবস্থা করে)।
অপর এক রিওয়ায়েতে বর্ণিত আছে, মায়েয ইব্ন মালিক রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর খিদমতে আগমণ করে এবং ব্যভিচারের স্বীকার করে। তিনি তাকে ফিরিয়ে দেন। সে দ্বিতীয়বার এসে ব্যভিচারের স্বীকার করে। এবারও তিনি তাকে ফিরিয়ে দেন। সে তৃতীয়বারও এসে ব্যভিচারের স্বীকার করে। এবারও তিনি তাকে ফিরিয়ে দেন। পুনরায় সে আসে এবং চতুর্থবারের মত ব্যভিচারের স্বীকার করে। তখন নবী করীম (ﷺ) বলেন : তার বিবেক কি লোপ পেয়েছে অথবা সে কি পাগল হয়ে গিয়েছে। লোকজন বলল, জ্বি না। বুরায়দা (রাযিঃ) বলেন, তখন হুযুর (ﷺ) নির্দেশ প্রদান করেন যে, তাকে অপেক্ষাকৃত কম কংকরময় স্থানে পাথর নিক্ষেপ কর যেন তার শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়। বুবায়দা বলেন, (পাথর নিক্ষেপের পর) যখন তার মৃত্যুর বিলম্ব হচ্ছে তখন সে অধিক কংকরময় স্থানের দিকে সৌড়িয়ে যায়। লোকজনও তার পিছনে সেখানে গমন করে এবং এমনিভাবে পাথর নিক্ষেপ করে যে, সে মৃত্যুবরণ করে। অতঃপর লোকজন এ ঘটনা রাসূলূল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট বর্ণনা করল।তিনি বললেন তোমরা কেন তার পিছু ছাড়লে না, বুরায়দা (রাযিঃ) বলেন, তার গোত্রের লোকেরা আঁ হযরত (ﷺ)-এর নিকট তার দাফন ও জানাযার নামায সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেন। তিনি তাদেরকে দাফন-কাফনের অনুমতি প্রদান করেন এবং বলেন : সে এমন তওবা করেছে যে, দলবদ্ধ হয়ে যদি মানুষ এরূপ তওবা করে, তা হলে তাদের তওবাও কবুল হতো।
অপর এক রিওয়ায়েতে বর্ণিত আছে, হযরত বুরায়দা (রাযিঃ) বলেন, যখন নবী করীম (ﷺ) মায়েয ইব্ন মালিককে (অপরাধ স্বীকারোক্তির কারণে) পাথর মেরে শাস্তি প্রদানের জন্য নির্দেশ প্রদান করেন, তখন সে অপেক্ষাকৃত কম কংকরময় স্থানে গিয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু যখন মৃত্যু বিলম্ব হতে লাগল, তখন সে অধিক কংকরময় স্থানে গমন করে এবং মানুষও তার পিছনে সেখানে গমন করে, এরপর পাথর নিক্ষেপ করে। যার ফলে সে মৃত্যুবরণ করে। এ ঘটনা নবী করীম (ﷺ)-এর পৌঁছলো। তখন তিনি বললেন, তোমরা তার পথ কেন ছেড়ে দিলে না? (অর্থাৎ তাকে যেতে দেয়া উচিৎ ছিল)।
অপর এক রিওয়ায়েতে আছে, মায়েয যখন পাথর নিক্ষেপের মাধ্যমে মৃত্যুবরণ করে, তখন মানুষ তার সম্পর্কে বিভিন্ন সমালোচনা করতে থাকে। কোন এক ব্যক্তি বললেন, মায়েয আত্মহত্যা করেছে। আবার কেউ বলেন, মায়েয এভাবে তওবা করেছে। এ ঘটনা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট পৌঁছে। তখন তিনি বলেন: মায়েয এরূপ তওবা করেছে যদি এ তওবা কোন কর আদায়কারী করে, তাহলে তার তওবা কবুল করা হবে। অথবা লোকজন সম্মিলিতভাবে এ তওবা করলে তাদের তওবা কবূল হবে।
অপর এক রিওয়ায়েতে বর্ণিত আছে, একবার রাসূলুল্লাহ (ﷺ) উপবিষ্ট অবস্থায় ছিলেন। এ সময় মায়েয ইব্ন মালিক তাঁর খিদমতে উপস্থিত হয়ে আরয করলেন, আমি ব্যভিচার করেছি, আমার উপর শাস্তি প্রয়োগ করুন। নবী করীম (ﷺ) তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। হযরত বুরায়দা (রাযিঃ) বলেন, অতঃপর সে তিনবার এরূপ করে। আঁ হযরত (ﷺ) প্রত্যেকবার তাকে ফিরিয়ে দেন এবং নিজে মুখ ফিরিয়ে নেন। চতুর্থবারে তিনি লোকজনের নিকট জিজ্ঞাসা করেন। তোমরা কি তার জ্ঞানে কোন ত্রুটি দেখতে পেয়েছ? লোকজন বলল, আমরা তাকে একজন বুদ্ধিমান ও কল্যাণমূলক কাজ করে বলেই জানি। হুযূর (ﷺ) বললেনঃ তাকে নিয়ে যাও এবং রজম কর বা পাথর নিক্ষেপ করে শাস্তি প্রদান কর। বুরায়দা (রাযিঃ) বলেন, তাকে কম কংকরময় স্থানে নেয়া হলো। যখন তাকে পাথর মারা শুরু হলো, তখন সে ভীষণ ভয় পেয়ে গেল এবং সেখান থেকে দৌড়িয়ে অধিক কংকরময় স্থানে গিয়ে পৌঁছলো। সেখানে তার উপর পাথর নিক্ষেপ করা হলে সে মৃত্যুবরণ করে। অতঃপর লোকজন এ ঘটনা বর্ণনা করে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! যখন মায়েযের উপর পাথর নিক্ষেপ করা হলো, তখন সে ভয় পেয়ে যায় এবং পলায়ন করতে থাকে। তিনি এটা শুনে বললেন : তাকে কেন যেতে দিলে না। এরপর লোকজন তার সম্পর্কে বিভিন্ন সমালোচনা করতে লাগল। একদল বলল, মায়েয ধ্বংস হয়েছে এবং সে আত্মহত্যা করেছে। অপর একদল বলে, সে আল্লাহর দরবারে এমন মকবুল তওবা করেছে যে, যদি কোন একদল এরূপ করত, তাহলে তাদের তওবা কবুল হতো। লোকজন জিজ্ঞাসা করলো হে আল্লাহর রাসূল। তার মৃতদেহ কি করব? তিনি বললেন তোমরা তোমাদের মৃতব্যক্তির জন্য যা কর, তা এর জন্য কর। যেমন গোসল, কাফন, খুশবু, নামায এবং দাফন। এ হাদীস বিভিন্ন সূত্রে বর্ণিত হয়েছে।
عَنْ عَلْقَمَةَ، عَنِ ابْنِ بُرَيْدَةَ، عَنْ أَبِيهِ، أَنَّ مَاعِزَ بْنَ مَالِكٍ، أَتَى النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فَقَالَ: " إِنَّ الْآخَرَ قَدْ زَنَى، فَأَقِمْ عَلَيْهِ الْحَدَّ، فَرَدَّهُ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، ثُمَّ أَتَاهُ ثَانِيَةً، فَقَالَ لَهُ مِثْلَ ذَلِكَ، ثُمَّ أَتَاهُ الثَّالِثَةَ؛ فَقَالَ لَهُ مِثْلَ ذَلِكَ، ثُمَّ أَتَاهُ الرَّابِعَةَ، فَقَالَ: إِنَّ الْآخَرَ قَدْ زَنَى، فَأَقِمْ عَلَيْهِ الْحَدَّ، فَسَأَلَ عَنْهُ أَصْحَابَهُ: هَلْ تُنْكِرُونَ مِنْ عَقْلِهِ؟ قَالُوا: لَا، قَالَ: انْطَلِقُوا بِهِ فَارْجُمُوهُ، فَانْطَلَقَ بِهِ، فَرُجِمَ بِالْحِجَارَةِ، فَلَمَّا أَبْطَأَ عَلَيْهِ الْقَتْلُ، انْصَرَفَ إِلَى مَكَانٍ كَثِيرِ الْحِجَارَةِ، فَقَامَ فِيهِ فَأَتَاهُ الْمُسْلِمُونَ، فَرَجَمُوهُ بِالْحِجَارَةِ حَتَّى قَتَلُوهُ، فَبَلَغَ ذَلِكَ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فَقَالَ: هَلَّا خَلَّيْتُمْ سَبِيلَهُ، وَقَالَ قَائِلٌ: إِنَّا نَرْجُو أَنْ يَكُونَ تَوْبَةً، فَبَلَغَ ذَلِكَ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فَقَالَ: لَقَدْ تَابَ تَوْبَةً لَوْ تَابَهَا فِئَامٌ مِنَ النَّاسِ لَقُبِلَ مِنْهُمْ، فَلَمَّا بَلَغَ ذَلِكَ قَوْمَهُ طَمِعُوا فِيهِ، فَسَأَلُوهُ مَا يُصْنَعُ بِجَسَدِهِ؟ قَالَ: اصْنَعُوا بِهِ مَا تَصْنَعُونَ بِمَوْتَاكُمْ مِنَ الْكَفَنِ وَالصَّلَاةِ عَلَيْهِ وَالْمَدْفَنِ، قَالَ: فَانْطَلَقَ بِهِ أَصْحَابُهُ فَصَلُّوا عَلَيْهِ "، وَفِي رِوَايَةٍ، قَالَ: " أَتَى مَاعِزُ بْنُ مَالِكٍ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فَأَقَرَّ بِالزِّنَا فَرَدَّهُ، ثُمَّ عَادَ فَأَقَرَّ بِالزِّنَا فَرَدَّهُ، ثُمَّ عَادَ فَأَقَرَّ بِالزِّنَا الرَّابِعَةَ؛ فَسَأَلَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: هَلْ تُنْكِرُونَ مِنْ عَقْلِهِ شَيْئًا، قَالُوا: لَا، قَالَ: فَأَمَرَ بِهِ أَنْ يُرْجَمَ فِي مَوْضِعٍ قَلِيلِ الْحِجَارَةِ، قَالَ: فَأَبْطَأَ عَلَيْهِ الْمَوْتُ، فَانْطَلَقَ يَسْعَى إِلَى مَوْضِعٍ كَثِيرِ الْحِجَارَةِ، وَاتَّبَعَهُ النَّاسُ فَرَجَمُوهُ حَتَّى قَتَلُوهُ، ثُمَّ ذَكَرُوا شَأْنَهُ لِرَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، قَالَ: لَوْلَا خَلَّيْتُمْ سَبِيلَهُ، قَالَ: فَاسْتَأْذَنَ قَوْمُهُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِي دَفْنِهِ وَالصَّلَاةِ عَلَيْهِ، فَأَذِنَ لَهُمْ فِي ذَلِكَ، قَالَ: وَقَالَ عَلَيْهِ السَّلَامُ: لَقَدْ تَابَ تَوْبَةً لَوْ تَابَهَا فِئَامٌ مِنَ النَّاسِ قُبِلَ مِنْهُمْ ".
وَفِي رِوَايَةٍ، قَالَ: " لَمَّا أَمَرَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بِمَاعِزِ بْنِ مَالِكٍ أَنْ يُرْجَمَ قَامَ فِي مَوْضِعٍ قَلِيلِ الْحِجَارَةِ، فَأَبْطَأَ عَلَيْهِ الْقَتْلُ، فَذُهِبَ بِهِ مَكَانًا كَثِيرَ الْحِجَارَةِ، وَاتَّبَعَهُ النَّاسُ حَتَّى رَجَمُوهُ.
فَبَلَغَ ذَلِكَ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فَقَالَ: أَلَا خَلَّيْتُمْ سَبِيلَهُ! ؟ " وَفِي رِوَايَةٍ، قَالَ: لَمَّا هَلَكَ مَاعِزُ بْنُ مَالِكٍ بِالرَّجْمِ، اخْتَلَفَ النَّاسُ فِيهِ، فَقَالَ قَائِلٌ: مَاعِزٌ أَهْلَكَ نَفْسَهُ.
وَقَالَ قَائِلٌ: تَابَ.
فَبَلَغَ ذَلِكَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَالَ: «لَقَدْ تَابَ تَوْبَةً لَوْ تَابَهَا صَاحِبُ مَكْسٍ لَقُبِلَ مِنْهُ، أَوْ تَابَهَا فِئَامٌ مِنَ النَّاسِ لَقُبِلَ مِنْهُمْ» .
وَفِي رِوَايَةٍ، قَالَ: جَاءَ مَاعِزُ بْنُ مَالِكٍ إِلَى رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، وَهُوَ جَالِسٌ، فَقَالَ: يَا رَسُولَ اللَّهِ، إِنِّي زَنَيْتُ فَأَقِمِ الْحَدَّ عَلَيَّ، فَأَعْرَضَ عَنْهُ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، قَالَ: فَفَعَلَ ذَلِكَ أَرْبَعَ مَرَّاتٍ، كُلُّ ذَلِكَ يَرُدُّهُ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، وَيُعْرِضُ عَنْهُ، فَقَالَ فِي الرَّابِعَةِ: أَنْكَرْتُمْ مِنْ عَقْلِ هَذَا شَيْئًا؟ قَالُوا: مَا نَعْلَمُ إِلَّا عَاقِلًا، وَمَا نَعْلَمُ إِلَّا خَيْرًا، قَالَ: فَاذْهَبُوا بِهِ فَارْجُمُوهُ، قَالَ: فَذَهَبُوا بِهِ فِي مَكَانٍ قَلِيلِ الْحِجَارَةِ، فَلَمَّا أَصَابَتْهُ الْحِجَارَةُ جَزِعَ، قَالَ: فَخَرَجَ يَشْتَدُّ حَتَّى أَتَى الْحَرَّةَ، فَثَبَتَ لَهُمْ، قَالَ: فَرَجَمُوهُ بِجَلَامِيدِهَا حَتَّى سَكَتَ، قَالَ: فَقَالُوا: يَا رَسُولَ اللَّهِ، مَاعِزٌ حِينَ أَصَابَتْهُ الْحِجَارَةُ جَزِعَ، فَخَرَجَ يَشْتَدُّ، فَقَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: لَوْلَا خَلَّيْتُمْ سَبِيلَهُ؟ ! قَالَ: فَاخْتَلَفَ النَّاسُ فِي أَمْرِهِ، فَقَالَتْ طَائِفَةٌ: هَلَكَ مَاعِزٌ، وَأَهْلَكَ نَفْسَهُ.
وَقَالَتْ طَائِفَةٌ: بَلْ تَابَ إِلَى اللَّهِ تَوْبَةً لَوْ تَابَهَا فِئَامٌ مِنَ النَّاسِ لَقُبلَ مِنْهُمْ، قَالُوا: يَا رَسُولَ اللَّهِ، فَمَا نَصْنَعُ؟ قَالَ: «اصْنَعُوا مَا تَصْنَعُونَ بِمَوْتَاكُمْ مِنَ الْغُسْلِ وَالْكَفَنِ وَالْحَنُوطِ وَالصَّلَاةِ عَلَيْهِ وَالدَّفْنِ» .
وَقَدْ رُوِيَ الْحَدِيثُ بِرِوَايَاتٍ مُخْتَلِفَةٍ نَحْوَ مَا تَقَدَّمَ

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীসে কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ মাসয়ালা বর্ণনা করা হয়েছে।প্রথমত পবিত্র কুরআনে আয়াতঃ الزَّانِيَةُ وَالزَّانِي فَاجْلِدُوا كُلَّ وَاحِدٍ مِنْهُمَا مِائَةَ جَلْدَةٍ (ব্যভিচারকারী নারী ও পুরুষ প্রত্যেককে একশ' চাবুক মার)। (২৪ঃ২) বিবাহিত ‘অবিবাহিত সবার জন্য চাবুক নির্ধারণ করেছে। কিন্তু আয়াত : الشَّيْخُ وَالشَّيْخَةُ إِذَا زَنَيَا فَارْجُمُوهُمَا الْبَتَّةَ (বিবাহিত পুরুষ ও নারী যখন ব্যভিচার করে তখন অবশ্যই তাদের উপর পাথর নিক্ষেপ করে শাস্তি প্রদান কর)। উম্মতের ইজমা দ্বারা তিলাওয়াত রহিত হয়েছে কিন্তু এর বিধান এখনো বিদ্যামান রয়েছে এবং বিবাহিতদের রজম (رجم) বা পাথর নিক্ষেপ করা নির্ধারণ করে। রহিত আয়াত বিবাহিতদের জন্য এবং চাবুক বা বেত্রাঘাত অবিবাহিতদের জন্য। এ ছাড়া মুতাওয়াতির ও মশহুর হাদীসসমূহ রহিত আয়াতের জোর সমর্থন করে। বরং রজমের (পাথর নিক্ষেপ সংক্রান্ত) হাদীসসমূহ মুতাওয়াতির ও প্রসিদ্ধির কারণে অলংঘনীয় নির্দেশমূলক (قطعي الدلالة) আয়াতের উপরও অধিক ক্ষমতা রাখে। যেমন বর্ণিত হাদীস প্রসিদ্ধির চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছিয়েছে এবং হযরত উবাদা ইব্ন সামিত; ইব্ন আব্বাস, আবূ হুরায়রা, আবূ সাঈদ, বুবায়দা, হুসাইব আসলামী, জাবির ইব্ন আবদুল্লাহ (রা)-এর মত সম্মানিত সাহাবা থেকে বর্ণিত আছে এবং এরদ্বারা কুরআনের উপর অতিরিক্ত বিধান জারী করা জায়েয। সিহাহ সিত্তায় হযরত উমর (রা)-এর খুতবায় বর্ণিত আছে। তিনি শপথ করে বলেছেন, যদি মানুষের এটা বলার ভয় না হতো যে, উমর কুরআনের উপর হস্তক্ষেপ করেছে, তাহলে অবশ্যই আমি الشَّيْخُ وَالشَّيْخَةُ إِذَا زَنَيَا الايه আয়াতকে কুরআনের মধ্যে লিপিবদ্ধ করতাম।
দ্বিতীয় মাসয়ালা হলো ব্যভিচারীকে শাস্তি প্রদানের জন্য চারবার স্বীকারোক্তি জরুরী, না একবারই যথেষ্ট? ইমাম মালিক ও ইমাম শাফিঈ (র) শাস্তি প্রদানের জন্য একবার স্বীকারোক্তিই যথেষ্ট মনে করেন। তাঁদের মাযহাবের স্বপক্ষে দু'টি হাদীসকে ভিত্তি ও দলীল হিসেবে পেশ করেন। বাহ্যিক দৃষ্টিতে এগুলো দ্বারা স্বীকারোক্তির কোন সংখ্যা নির্ধারণ করা যায় না। এক, গামেদীয়ার হাদীস। মায়েয ইবন্ মালিক (রা)-এর মত তিনিও আঁ হযরত (সা)-এর সামনে ব্যভিচারের স্বীকারোক্তি করেছিলেন। তার একবার স্বীকারের ফলেই তাকে নবী করীম (সা)-এর নির্দেশে পাথর নিক্ষেপের মাধ্যমে শাস্তি প্রদান করা হয়। দ্বিতীয় হলো ঐ হাদীস, যা আসীফ-এর হাদীস নামে খ্যাত। এতে বর্ণিত আছে, এক অবিবাহিত ব্যভিচারকারী যুবকের উপর হুযুর (সা) একশ' চাবুক বা বেত্রাঘাত এবং এক বছরের জন্য দেশান্তরের শাস্তি প্রদান করেন। মহিলার কাছ থেকে স্বীকারোক্তি গ্রহণের জন্য হযরত উনাইস (রা)-কে নির্দেশ প্রদান করেন যে, যদি সে স্বীকার করে, তা হলে তাকে পাথর নিক্ষেপ করে শাস্তি প্রদান কর। সুতরাং এখানে চারবার স্বীকারোক্তি গ্রহণের জন্য হুযূর (সা) শর্ত আরোপ করেননি। এতে প্রতীয়মান হয় যে, চারবার স্বীকারোক্তিত্ব প্রয়োজন নেই। নতুবা তিনি এ ব্যাপারে বিস্তারিত ব্যাখ্যা করতেন।
ইমাম আবূ হানীফা, ইমাম আহমদ এবং কুফাবাসী সমস্ত আলিম এ ব্যাপারে মত পোষণ করেন যে, শাস্তি প্রদানের জন্য ব্যভিচারকারীর চারবার স্বীকারোক্তির প্রয়োজন রয়েছে। তাদের শক্তিশালী দলীল হলো মায়েয ইব্ন মালিকের হাদীস- যা সিহাহ সিত্তাহ গ্রন্থে বিভিন্ন সূত্রে বর্ণিত আছে। এতে বর্ণিত আছে, তিনি অপরাধীর কাছ থেকে চারবার স্বীকারোক্তি গ্রহণ করেছেন। অতঃপর শাস্তি প্রদানের জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। এখানে একটি বিষয় গভীরভাবে লক্ষণীয় যে, অপরাধ প্রমাণিত হওয়ার পর শাস্তি প্রদানে বিলম্ব করা কি নবী করীম (সা)-এর জন্য সম্ভব? অপরাধ প্রমাণের পর সাথে সাথে শাস্তি প্রদান ওয়াজিব, এতে বিলম্ব করার কোন অবকাশ নেই। সুতরাং এটা অনিবার্যভাবে বলতে হবে যে, এক, দু' অথবা তিনবার স্বীকার করার পরও হযরত (সা)-এর নিকট অপরাধ প্রমাণিত না হওয়ার কারণে চতুর্থবার স্বীকারোক্তির পর যখন অপরাধ প্রমাণিত হয়, তখন সাথে সাথে পাথর নিক্ষেপের মাধ্যমে শাস্তি প্রদানের নির্দেশ জারী করেন। তবে শুধু এটাই নয়, বরং এ হাদীসের কোন কোন রিওয়ায়েতের দ্বারা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, একই মজলিসে চারবার স্বীকারোক্তি করার পরও তিনি তা বাতিল করে দিয়েছেন। অতঃপর দ্বিতীয় দিন আগমণ করে স্বীকারোক্তি প্রদান করে। নবী করীম (সা) তার গোত্রের নিকট বিষয়টির সত্যতা নিরূপণের জন্য জিজ্ঞাসা করলেন। এ লোকটি তো পাগল নয়। এরপর তৃতীয়বার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটানো। এরপর চতুর্থবার যখন এসে সে স্বীকারোক্তি প্রদান করলো, তখন তাকে পাথর নিক্ষেপ করে শাস্তি প্রদান করা হয়।
ইমাম আহমদ ও ইসহাক (র) স্বীয় মুসনাদে এবং ইব্ন আবী শায়বা (র) স্বীয় মুসনাদের আবু বকর (রা) থেকে এ হাদীস গ্রহণ করেছেন, যাতে প্রত্যেকবার جاء শব্দ রয়েছে। যেমন বর্ণিত হাদীসে اتى শব্দ ব্যবহার হয়েছে। সুতরাং مجئيت واتيان (গমনাগমন) মজলিসের সংখ্যা প্রমাণ করে যে, সে যাতায়াত করেছে। ইব্ন হুমাম (র) এর ব্যাখ্যাও করেছেন। এজন্য হানাফীগণ বলেন, চারবার স্বীকারোক্তি চারটি মজলিসে হতে হবে। সুতরাং যখন এটাই বাস্তবতা, তা হলে কিভাবে গ্রহণ করা যায় যে, আঁ হযরত (সা) চারটি বিভিন্ন মজলিস পর্যন্ত শাস্তি প্রদানকে বিলম্বিত করেন। এবার রইল হাদীসে বর্ণিত আসীফের ঘটনা। তবে এটা ছিল ইসলামের প্রথম যুগের ঘটনা। বায়হাকীও এরূপ বর্ণনা করেছেন।
তৃতীয় মাসয়ালা হলো এই যে, অপরাধীর জন্য শাস্তি কি তওবা হিসেবে গণ্য হয় এবং এর দ্বারা গুনাহর কাফ্ফারা হয়ে যায়? পরকালের জবাবদিহি থেকে মুক্তি পেয়ে যায় অথবা পরকালের জবাবদিহির দায়িত্ব তার উপর বাকী থাকে এবং শাস্তি তার গুনাহর কাফফারা হয় না? হানাফীগণ এ দুটোর মধ্যে দ্বিতীয়টির পক্ষে অর্থাৎ তাদের মতে পরকালের জবাবদিহির দায়িত্ব অপরাধীর বাকী থাকে এবং শাস্তি তার গুনাহর কাফফারা হয় না। এ বিষয়ে দৃষ্টিভঙ্গি হলো, শাস্তির মূল উদ্দেশ্য অপরাধীকে ধমক দেয়া,সতর্ক করা এবং অন্যকে উপদেশ দেয়া, এর দ্বারা পৃথিবীর ব্যবস্থাপনায় শৃংখলা সৃষ্টি করা। যাতে শাস্তির ভয়ে মানুষ পরস্পরকে কষ্ট দেয়া থেকে বিরত থাকে এবং নিরাপনে শান্তি ও সুখে জীবন অতিবাহিত করে। পরকালের জবাবদিহি ও বিচারকার্য তার উপর বাকী থাকবে। এর থেকে মুক্ত থাকা তার খাঁটি তওবার দ্বারা হাসিল হতে পরে।
হানাফীগণের মতামতের ভিত্তি হলো পবিত্র কুরআনের সুস্পষ্ট আয়াত যাতে বলা হয়েছে যে, অপরাধের শাস্তি গুনাহর কাফ্ফারা নয়। যেমন محدود في القذف (কারো উপর দুর্নাম রটানোর পর যে শাস্তি প্রদান করা হয়) সে সম্পর্কে কুরআন মজীদে বলা হয়েছেঃ وَأُولَئِكَ هُمُ الْفَاسِقُونَ إِلَّا الَّذِينَ تَابُوا (তারা হলো ফাসিক, তবে যারা তওবা করেছে তারা নয়), قطاع الطريق (ডাকাতী) সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে : أُولَئِكَ لَهُمْ خِزْيٌ فِي الدُّنْيَا وَلَهُمْ فِي الْآخِرَةِ عَذَابٌ عَظِيمٌ إِلَّا الَّذِينَ تَابُو (তাদের জন্য পৃথিবীর রয়েছে লাঞ্ছনা এবং পরকালে রয়েছে কঠোর শাস্তি, কিন্তু যারা তওবা করেছে)। এখানে ফলাফল তওবার সাথে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। সুতরাং আল্লাহ পাকের কালামের যেহেতু এটাই উদ্দেশ্য, তাই ঐ হাদীস ব্যাখ্যার যোগ্য হবে যা শাস্তিকে (حد) তওবার সমার্থক হিসেবে স্থির করে যাতে قطع الدلالة (অকাট্যভাবে প্রমাণ করে) আয়াত স্বীয় অর্থের উপর অটল থাকে। যেমন বর্ণিত হাদীসে এ সন্দেহ হয় যে, ব্যভিচারের শাস্তিই হলো তওবা, সুতরাং আমরা এটাকে এর উপর ধারণা করব যে, শাস্তির সময় অপরাধী তওবা করেছে এবং বাহ্যিক দৃষ্টিতে এটাই প্রমাণিত হয়। কেননা অপরাধী এখানে একটি অপবাদ বা তিরস্কারের বস্তু হিসেবে আখ্যায়িত হয়েছে, যার আপাদমস্তকে তওবা দৃশ্যমান হচ্ছে। এটা কি আশ্চর্য বরং এটা খুবই সম্ভব যে, শাস্তির সময় সে তওবা করেছে। হুযুর (সা) যে তওবার ব্যাখ্যা অত্যন্ত ফলপ্রসূভাবে পেশ করেছেন। যেমন এ মতের শক্তিশালী দলীল হিসেবে মুসলিম শরীফে হযরত বুরায়দা (রা) থেকে এক হাদীস বর্ণনা করেছেন। হাদীসে বর্ণিত ঘটনা হলো এই যে, সাহাবাগণ উপবিষ্ট অবস্থায় একবার রাসূলুল্লাহ (সা) আগমণ করেন এবং সালাম জানিয়ে তিনি উপবেশ করেন। অতঃপর তিনি বলেন: মায়েয ইব্ন মালিকের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা কর। যখন শাস্তির পর ক্ষমা প্রার্থনার কোন সুযোগই না থাকে, তখন শাস্তি গুনাহ মাফের কারণ কিভাবে হতে পারে?
এছাড়া চুরি সম্পর্কে আবূ দাউদ শরীফে বর্ণিত আছে, চোরের হাত কর্তনের জন্য তিনি চোরকে ডাকালেন এবং বললেন : তওবা ও ইসতিগফার কর। সে তওবা করলো। এরপর হুযুর (সা) তার তওবা কবুলের জন্য দু'আ করেন। এছাড়া বুখারী ও মুসলিম শরীফে হযরত আয়েশা (রা) থেকে বর্ণিত আছে, ফাতিমাতুল মাখযূমিয়া চুরি করেছিল, তার পর সে তওবা করেছে। যদি শাস্তিই তওবা হতো, তা হলে এরপর নতুন তওবার কি প্রয়োজন হতো? এখানে একটি বিষয় মনে হচ্ছে যে, শাস্তিযোগ্য অপরাধী যখন নিজেই তার অপরাধের স্বীকার করে এবং শাস্তির জন্য প্রার্থনা করে, তখন এটা তার জন্য তওবা হিসেবে গণ্য হয় এবং যাকে অপরাধী সাব্যস্ত করে শাস্তির যোগ্য বলে প্রমাণ করা হয়, তখন তার জন্য তওবা করা প্রয়োজন।
tahqiqতাহকীক:তাহকীক নিষ্প্রয়োজন
মুসনাদে আবু হানীফা রহঃ - হাদীস নং ৩১৬ | মুসলিম বাংলা