মুসনাদে ইমাম আযম আবু হানীফা রহঃ

১১. ত্বালাক - বিবাহ বিচ্ছেদ অধ্যায়

হাদীস নং: ২৯৩
দাসীর তালাকের বর্ণনা
হাদীস নং- ২৯৩

হযরত ইব্ন উমর (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন : দাসীর তালাক
হলো দু'টি এবং তার ইদ্দত হলো দুই ঋতু পর্যন্ত।
عَنْ عَطِيَّةَ، عَنِ ابْنِ عُمَرَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «طَلَاقُ الْأَمَةِ اثْنَتَانِ، وَعِدَّتُهَا حَيْضَتَانِ»

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীস দু'টি বিষয়ে শাফিঈ ও মালিকী মাযহাবের বিরুদ্ধে হানাফী মাযহাবের দলীল। প্রথমত তালাকের সংখ্যা কার্যকর হওয়ার জন্য নারীদের উপর নির্ভর করে, না পুরুষের উপর। দ্বিতীয়ত ইদ্দত হায়যের সাথে (ঋতু) সম্পর্কিত, না পবিত্রতার সাথে। হানাফীগণ বলেন, দু'টি বিষয়ই প্রথম পদ্ধতি অর্থাৎ তালাকের কার্যকর হওয়ার বিষয়টি নারীদের উপর নির্ভর করবে এবং ইদ্দত হায়েযের সাথে সম্পর্কিত হবে।
ইমাম শাফিঈ ও ইমাম মালিক (র) দ্বিতীয় পদ্ধতির পক্ষে মত প্রকাশ করেছেন। অর্থাৎতালাকের ক্ষেত্রে যদি স্বামী গোলাম হয় এবং স্ত্রী আযাদ হয়, তা হলে হানাফীদের মতে ঐ স্ত্রী তিন তালাকের পর স্বামীর উপর হারাম হয়ে যাবে। ইমাম শাফিঈ (র)-এর মতে দু' তালাকে হারাম হবে। আর যদি স্বামী আযাদ হয় এবং স্ত্রী দাসী হয়, তা হলে এর বিপরীত। হানাফীদের মতে দু' তালাকের পর ঐ স্ত্রী স্বামীর উপর হারাম হয়ে যাবে এবং ইমাম শাফিঈ ও মালিক (র)-এর মতে তিন তালাকের পর ঐ স্ত্রী স্বামীর উপর হারাম হয়ে যাবে। তালাকের বিষয়ে ইমাম শাফিঈ (র)-এর দলীল হলো : الطلاق بالرجال والعدة بالنساء (তালাক পুরুষের সাথে এবং ইন্দত নারীদের সাথে সম্পর্কিত)।
হানাফীদের শাক্তিশালী দলীল হলো বর্ণিত মরফূ হাদীস, যাতে সুষ্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, তালাকের সংখ্যা কার্যকর হওয়ার ব্যাপারে এটা নারীদের উপর নির্ভর করে, পুরুষের উপর নয়।
এবার দ্বিতীয় দলের দলীল পর্যালোচনা করা যায়। তাদের পেশকৃত হাদীস সহীহ অথবা হাসান সূত্রের মাধ্যমে মরফূ'ভাবে বর্ণিত নয়, বরং তা হলো মওকুফ। হাফিয আবুল ফারায ইবন জওযী (র)-এর বর্ণনানুযায়ী এ হাদীস হযরত ইব্ন আব্বাস (রা)-এর উপর মওকুফ। কারো কারো মতে এটা হযরত যায়দ ইবন সাবিতের বর্ণনা। হানাফীদের নিকট বর্ণিত মরফু হাদীস রয়েছে, যা আবু দাউ, তিরমিযী, দারেমী, ইব্ন মাজাহ, ইব্ন জুরাইজ (র)-এর সূত্রে বর্ণনা করেছে এবং মুজাহির ইব্ন আসলাম থেকে, তিনি কাসিম থেকে, তিনি হযরত আয়েশা (রা) থেকে বর্ণনা করেছেন। সুতরাং শুধু সাহাবীর সূত্রে বর্ণনার বিপরীতে সহীহ মরফু হাদীস অগ্রগণ্য হবে। যদি কোথাও হানাফীদের নিকট শুধু সাহাবীর বর্ণনা হতো এবং তাদের নিকট মরফু হাদীস হতো, তা হলে তাদের শক্তিশালী দলীলের কারণে বিরোধী পক্ষ লাপাত্তা হয়ে যেত। তবে তাঁদের মতের জয়লাভের জন্য তাদের কৌশল রয়েছে। যদি কারো কাছে মরফু হাদীস থাকে, তা হলে ঐ হাদীসের কোন বর্ণনাকারীর বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন করা এবং বিরোধী পক্ষকে ঘায়েল করে দেয়া। সুতরাং এখানেও মুজাহিরের উপর অভিযোগ আনা হয়েছে, যা দাউদ (র) বলেছেন যে, এ হাদীস মজহুল। তিরমিযী এক দিক থেকে বলেছেন ইলম-এর মধ্যে মুজাহির থেকে এই হাদীস হলো মারূফ। আল্লামা যাহবী (র) আবূ আসিম আন-নুবাইল, ইয়াহইয়া ইব্ন মুঈন, আবু হাতিম আর-রাযী এবং ইমাম বুখারী (র)-ও এ হাদীসকে যঈফ বা দুর্বল বলেছেন। কিন্তু সাথে সাথে এটাও বলেছেন যে, ইব্ন হিব্বান (র) এ হাদীসকে নির্ভরযোগ্য বলেছেন।
হানাফীগণ এর জওয়াবে বলেন, ইব্ন হিব্বানের মতামত তাঁর ব্যক্তিগত চিন্তা এবং হাকিম ইব্ন আব্বাস থেকে এ হাদীস গ্রহণ করেছেন এবং বলেছেন, এ হাদীস যদিও সহীহ কিন্তু ইমাম বুখারী ও মুসলিম (র) তা বর্ণনা করেননি। অতঃপর হযরত আয়েশা (র)-এর হাদীস বর্ণনা করে বলেন, মুজাহির ইব্ন আসলাম বসরার একজন শায়খ। আমাদের বর্তমান মাশায়েখদের মধ্যে কেউ তাঁর বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ উত্থাপন করেননি এবং বাস্তবে কেউ তাঁকে মিথ্যাবাদী বলেননি। হিফয ও সংরক্ষণ এবং তাঁর ন্যায়নীতির ব্যাপারে কেউ সমালোচনা করেননি। জাহালতের ব্যাপারে আবূ দাউদে যে প্রশ্ন উত্থাপন করা হয়েছে এবং ইমাম তিরমিয়ী সে দিকে ইঙ্গিত করেছেন, এ অভিযোগ এভাবে দূর করা যায় যে, বর্ণনাকারীর জাহালত হলো এই যে, একাধিক ব্যক্তি তার থেকে রিওয়ায়েতকারী না হওয়া। কিন্তু এখানে তা হয়নি। মুজাহির থেকে ইব্ন জুরাইল, ইমাম সওরী এবং আবূ আসিম রিওয়ায়েত করেছেন। ইব্ন আদী (র) তাঁর সূত্রে হযরত আবূ হুরায়রা (রা) থেকে রিওয়ায়েত করেছেন যে, আঁ হযরত (সা) প্রতি রাতে সূরা আল-ইমরানের শেষ দশ আয়াত তিলাওয়াত করতেন। সুতরাং জাহালত কিভাবে থাকে? বিনা কারণে মাযহাবকে দুর্বল আখ্যায়িত করার জন্য মুবহাম, জরাহ ( সন্দেহ, অনির্দিষ্ট অভিযোগ গ্রহণযোগ্য নয়।)
কোন কোন পদ্ধতি ও নীতিতে শাফিঈ মাযহাবও অর্থহীন হয়ে পড়ে। যেমন একবার ঈসা ইব্ন আবান ইমাম শাফিঈ (র)-কে এক বিশেষ পরিবেশে প্রশ্ন করে এমন বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেন যে, তিনি এর কোন উত্তর দিতে পারেননি। ঈসা ইব্ন আবান তাঁকে জিজ্ঞাসা করেন, যদি স্বামী আবাদ হয় এবং দাসী স্ত্রীকে (যার সাথে সঙ্গম করা হয়েছে) সুন্নাত তালাক দেয়ার ইচ্ছা পৌষণ করে, তা হলে কি করবে? ইমাম শাফিঈ (র) বলেন, পবিত্র অবস্থায় তালাক প্রদান করবে। অতঃপর হায়েয থেকে পবিত্র হয়ে দ্বিতীয় তুহরে (পবিত্র অবস্থায়) এবং তিনি এটাই বলতে চেয়েছেন যে, হায়েয থেকে পবিত্র হয়ে তৃতীয় তুহরে তালাক দান করবে। ঈসা ইব্ন আবান বলেন, তা হলে তালাক কিভাবে হবে, ইদ্দত তো শেষ হয়ে গিয়েছে। কেননা তাদের মতেও ইদ্দত মহিলাদের অবস্থার প্রেক্ষিতেই পালন করা হয়ে থাকে।
ইমাম মুহাম্মদ (র) এখানে পবিত্র কুরআনের আয়াত দ্বারা একটি সূক্ষ্ম দলীল পেশ করেছেন। আল্লাহপাক বলেছেন : فَطَلِّقُوهُنَّ لِعِدَّتِهِنَّ তাদেরকে (স্ত্রীদেরকে) তালাক প্রদান কর তাদের ইদ্দতের মধ্যে) (৬৫: ১) অর্থাৎ ইদ্দতের প্রতি লক্ষ্য রেখে তালাক প্রদান কর। যেমন যদি স্বামী গোলাম হয় এবং তার স্ত্রী আবাদ হয়, তাহলে সর্বসম্মতিক্রমে তার ইদ্দত তিন قرؤ (কুরু বা হায়েয) হবে এবং এ দৃষ্টিকোণ থেকে তালাকও তিনটি হবে। অথবা যেমন- স্বামী আবাদ কিন্তু তার স্ত্রী হলো দাসী, তাহলে তার ইদ্দত হতে দুই قرؤ (কুরু বা হায়েয) হবে। সুতরাং ইদ্দতের দৃষ্টিকোণ থেকে তার তালাকও দুটিই হবে। তালাকের মাসয়ালার উপর এ সমস্ত আলোচনা হলো।
উপরোক্ত বিষয়ে ইমাম শাফিঈ ও ইমাম মালিক (র) হযরত আয়েশা (রা), হযরত যায়দ ইব্ন সাবিত (রা) এবং হযরত ইব্ন উমর (রা)-এর বর্ণনা পেশ করে থাকেন। কিন্তু বাস্তবে পরীক্ষা করে দেখা যায়, তাঁদের নিকট শুধু হযরত আয়েশা (রা)-এর বর্ণনাই বাকী থাকে। কেননা হযরত যায়দ ইব্ন সাবিত (রা) ও ইব্ন উমর (রা)-এর নিকট বিপরীত রিওয়ায়েতের প্রমাণ রয়েছে।
পক্ষান্তরে হানাফী মাযহাবের পক্ষে রয়েছে খুলাফায়ে আরবাআ উবাই ইব্ন কা'ব, মু’আয ইব্ন জাবাল, আবু দারদা, উবাদা ইব্ন সামিত, আবু মুসা আশআরী ও অন্যান্য সাহাবায়ে কিরাম (রা)। এ ছাড়া তাউস, আতা, ইবনুল মুসায়্যিব, সাঈদ ইব্ন যুবায়র, মুজাহিদ হাসান বসরী, ফয়ান আওযাঈ (র) ও অন্যান্যগণ একই মত পোষণ করেছেন। ইমাম আহমদ, (র)-ও একই মত পোষণ করেছেন। হানাফী মাযহাবের পক্ষে কুরআন ও হাদীসের প্রমাণ রয়েছে। যুক্তিও এ মতকেই সমর্থন করে। কুরআন মজীদে বলা হয়েছেঃوَاللَّائِي يَئِسْنَ مِنَ الْمَحِيضِ [যে (নারী) হায়য থেকে নিরাশ বা মুক্ত হয়ে যায়]। (৬৫ঃ৪) এতে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, قرؤ শব্দের অর্থ হলো হায়য। অতঃপর ইদ্দতের জন্য ثَلَاثَةَ قُرُوءٍ বাক্য ব্যবহার করা হয়েছে। বহুবচনের (جمع) অবস্থায়। অর্থাৎ কমপক্ষে পূর্ণাঙ্গ তিন তুহর এবং এর এ পদ্ধতি সম্ভব নয় যখন পবিত্র (طهر) অবস্থায় তালাক প্রদান করে এবং সেটা সুন্নতও বটে। কেননা অবশিষ্ট দুই তুহরে ইদ্দত শেষ হয়ে গিয়েছে। সুতরাং প্রথম طهر তো অসম্পূর্ণ রয়ে গেল, সম্পূর্ণ طهر কখন গণনা হবে? এবং বাস্তবে দু'টি পূর্ণাঙ্গ طهر গণনা করা হবে।قرؤ শব্দ দ্বারা হায়য অর্থ গ্রহণ করায় কোন বাধা নেই যে, এ অবস্থায় পূর্ণাঙ্গ তিনটি হায়য হবে। হাদীসসমূহের মধ্যে এ হাদীস হলো সবচেয়ে শক্তিশালী । যুক্তি ও জ্ঞান এটাই বলে যে, রেহেমের (رحم) পবিত্রতার লক্ষণ প্রকৃতপক্ষে হায়যের দ্বারা উপলব্ধি করা যায়, (তুহুর বা পবিত্রতা) দ্বারা নয়। সুতরাং ইদ্দতও এরদ্বারা নির্ধারিত হওয়া কিয়াসের কথা।
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান