মুসনাদে ইমাম আযম আবু হানীফা রহঃ

৮. বিবাহ-শাদীর অধ্যায়

হাদীস নং: ২৭৪
মুতআ বিবাহ হারাম
হাদীস নং- ২৭৪

হযরত সাবুরা জুহানী (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (ﷺ) মক্কা বিজয়ের দিন - নারীদের সাথে মুতাআ বিবাহ করতে নিষেধ করেছেন।
অন্য এক রেওয়ায়েতে আছে, হজ্জের বছর তিনি মু'আ বিবাহ নিষেধ করে দিয়েছেন। অপর এক বর্ণনায় আছে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মক্কা বিজয়ের দিন মুত'আ বিবাহ নিষেধ করেছেন।
عَنْ يُونُسَ بْنِ عَبْدِ اللَّهِ، عَنْ أَبِيهِ، عَنْ رَبِيعِ بْنِ سَبْرَةَ الْجُهَنِيِّ، عَنْ أَبِيهِ قَالَ: «نَهَى رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَنْ مُتْعَةِ النِّسَاءِ يَوْمَ فَتْحِ مَكَّةَ» ، وَفِي رِوَايَةٍ: «نَهَى عَنِ الْمُتْعَةِ عَامَ الْحَجِّ» ، وَفِي رِوَايَةٍ: نَهَى رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ «عَنْ مُتْعَةِ النِّسَاءِ يَوْمَ الْفَتْحِ»

হাদীসের ব্যাখ্যা:

কোন কোন যুদ্ধে মুজাহিদগণ (জৈবিক উত্তেজনা প্রশমনের জন্য) হুযূর (সা)-এর নিকট খাসী হয়ে যাওয়ার জন্য অনুমতি প্রার্থনা করেন। তখন তিনি তাদেরকে এ কাজ থেকে বাধা প্রদান করেন এবং মুতাআ বিবাহের জন্য অনুমতি প্রদান করেন। অবশ্য পরবর্তীতে চিরদিনের জন্য মুতাআ বিবাহ নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়। এখনও মুসলিম উম্মাহ এর উপর একমত রয়েছে। কিন্তু এতে শীআ সম্প্রদায়ের মতানৈক্য রয়েছে, তারা এখনো মু'আ বিবাহকে বৈধ মনে করে থাকে।
সাহাবাদের মধ্যে কিছুদিন এটা নিয়ে মতানৈক্য ছিল। তবে অধিকাংশই এটা হারাম হওয়ার পক্ষেই মত পোষণ করেন। অতঃপর হযরত উমর (রা)-এর খিলাফতকালে সমস্ত সাহাবায়ে কিরাম মুতআ বিবাহ হারাম হওয়ার ব্যাপারে ঐকমত্য পোষণ করেন। এরপর আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের কারো এ বিষয়ে কোন কথা বলার আর সুযোগ নেই। নবী করীম (সা)-এর যুগে মু'আ বিবাহ হালাল ও হারাম হওয়া সম্পর্কে বিভিন্ন হাদীস বর্ণিত আছে। কারো কারো মতে এটা দু'থেকে অধিকবার হালাল ও হারাম হয়েছিল। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে মাত্র দু'বার হালাল হয়েছিল এবং দু'বারই হারাম হয়েছে। অতঃপর যখন শেষবারে হারাম হয়, তখন অনন্তকালের জন্য হারাম হয়ে যায়। অর্থাৎ খায়বার যুদ্ধের পূর্বে এটা হালাল ছিল এবং খায়বারের দিনই এটা হারাম হয়। মক্কা বিজয়ের দিন হালাল হয় এবং এর তিন দিন পর চিরকালের জন্য হারাম হয়ে যায়। বিদায় হজ্জের দিন পূর্ববর্তী বিষয়টিই পুনরায় ঘোষণা করা হয়েছে। এটা নয় যে, সে দিন এ বিষয়টিকে নতুনভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বরং পূর্বের সাব্যস্তকৃত হারাম হওয়ার কথাটিকে সাধারণ জনতার সামনে চূড়ান্ত পর্যায় হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।
সাহাবায়ে কিরামের মধ্যে হযরত ইবন আব্বাস (রা), হযরত জাবির (রা) সহ আরো কয়জনের এ ব্যাপারে কিছুদিন মতানৈক্য ছিল। কিন্তু পরে হযরত ইবন আব্বাস (রা) তাঁর মত পরিবর্তন করেন। সুতরাং তিরমিযীর এক বর্ণনায় প্রতীয়মান হয় যে, তিনি নিজেই বলেছেন, ইসলামের প্রথমদিকে মানুষ এ ব্যবস্থা গ্রহণ করতো। কেউ হয়তো একটি নতুন শহরে আগমণ করতো। সেখানে তার কেউ পরিচিত থাকত না। তখন সে ঐ জায়গায় কিছুদিনের জন্য এক মহিলাকে বিবাহ করতো। অর্থাৎ যতদিন পর্যন্ত সেখানে অবস্থান করতো, ঐ মহিলা তার আসবাবপত্র সংরক্ষণ করতো। কিন্তু যখন পবিত্র কুরআনের আয়াত : إِلَّا عَلَى أَزْوَاجِهِمْ أَوْ مَا مَلَكَتْ أَيْمَانُهُمْ (তবে তাদের স্ত্রী ও দাসী ব্যতীত) (২৩ঃ৬) নাযিল হয়, তখন হযরত ইবন আব্বাস (রা) বলেন, এখন থেকে এদেরকে ব্যতীত অন্য সমস্ত মহিলা হারাম হয়ে যায়। জাবির ইবন যায়দ আবুশ শাসা (রা) বর্ণনা করেন, যে হযরত ইবন আব্বাস (রা) মৃত্যুর পূর্বে দুটি বিষয় থেকে স্বীয় মত পরিবর্তন করেন। এক হল بيع صرف বা মুদ্রার বিনিময় আর দ্বিতীয়টি হল نكاح متعة বা মুত'আ বিবাহ।
হযরত জাবির (রা)-এর ঘটনা হলো এই যে, ইবন আবদুল বার (রা) বর্ণনা করেন, হযরত জাবির (রা) বলেছেন, আমরা হযরত উমর (রা)-এর খিলাফতের মধ্যবর্তী সময় পর্যন্ত মুত'আ বিবাহ করেছি। অতঃপর তিনি লোকদেরকে এটা থেকে নিষেধ করেছেন। মনে হয়, কোন কোন সাহাবার কাছে হারাম হওয়ার হাদীস না পৌঁছার কারণে তখনো কিছু সন্দেহ বাকী থেকে যায়। কিন্তু হযরত উমর (রা)-এর ঘোষণার পর হারাম হওয়ার ব্যাপারে সন্দেহ আর বাকী থাকে নি। এটা নয় যে, হযরত উমর (রা) স্বীয় খিলাফতকালে এটা নিজের মত অনুযায়ী হারাম করেছেন। বস্তুত যে সমস্ত সহীহ হাদীস মুতাওয়াতির-এর সীমা পর্যন্ত পৌঁছেছে, এগুলো সবই মুত’আ হারাম হওয়ার দলীল ও প্রমাণ এবং এটা হালাল না হওয়াকেই প্রমাণ করে। যেমন নিম্নে বর্ণিত হাদীস বিভিন্ন সাহাবা থেকে বিভিন্ন সূত্রে বর্ণিত আছে অথবা সাবুরা ইবন মা'বাদুল জুহানী (রা) কর্তৃক বর্ণিত হাদীস যা মুসলিম শরীফ সহ অন্যান্য সুনান গ্রন্থে একই বাক্যে উল্লেখ করা হয়েছে তা হলো: نَهَى عَنِ الْمُتْعَةِ, وَقَالَ: أَلاَ إِنَّهَا حَرَامٌ مِنْ يَوْمِكُمْ هَذَا إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ “নবী করীম (সা) মুতাআ বিবাহ থেকে নিষেধ করেছেন এবং বলেছেন: সাবধান! এটা আজ থেকে কিয়ামত পর্যন্তের জন্য হারাম করা হয়েছে।"
এটা ছিল মক্কা বিজয়ের দিনের সর্বশেষ কোন বিষয়ের হারাম হওয়ার নির্দেশ। অথবা তিরমিযী শরীফে হযরত আলী (রা) বর্ণিত হাদীস, রাসূলুল্লাহ (সা) খায়বরের সময় নারীদের সাথে মুত'আ বিবাহ এবং গাধার গোশত খাওয়া থেকে নিষেধ করেছেন। সুতরাং এটা প্রমাণিত হলো যে, কিয়ামত পর্যন্ত মুতাআ বিবাহ হারাম হওয়ার নির্দেশ জারী থাকবে। এটা বিশেষ ওজর ও অবস্থার প্রেক্ষিতে হালাল করা হয়েছিল। যেমন একদিকে মুজাহিদগণের পরিবার থেকে নিঃসঙ্গতা ও বিচ্ছিন্নতা, প্রাকৃতিক চাহিদা, অন্যদিকে সফরের আসবাবপত্রবিহীন ও জিহাদের নিমগ্নতা ইত্যাদি কারণে এ সুযোগ দেয়া ছাড়া অন্য কোন উপায় ছিল না। সুতরাং হুযূর (সা) এ অবস্থার প্রেক্ষিতে একটি নির্ধারিত সময়ের জন্য এ সুযোগ প্রদান করেছেন। এটা নয় যে, এখনো স্বীয় দেশে বাস করে উক্ত নির্দেশের প্রেক্ষাপটে কামভাব চরিতার্থ করার জন্য একটি অবৈধ কাজের পথ উন্মুক্ত করা যাবে এবং শরীয়তের আড়ালে এর স্বাধীনতা দেয়া যাবে। সুতরাং হাযেমী একই বিষয় সম্পর্কে মত প্রকাশ করেছেন যে, নবী করীম (সা) সাহাবায়ে কিরামকে স্বীয় ঘর ও দেশে বসবাসের সময় এর অনুমতি দান করেননি, বরং অবস্থার প্রেক্ষিতে প্রয়োজনানুযায়ী অনুমতি দিয়েছিলেন। অতঃপর বিদায় হজ্জের সময় তা অনন্তকালের জন্য নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়। এখন শুধু শীআ সম্প্রদায় ব্যতীত অন্য কারো নিকট এটা হারাম হওয়া সম্পর্কে কোন সন্দেহ নেই। এখন মুত'আ সম্পূর্ণ হারাম এবং এটা যে হালাল মনে করবে, সে আল্লাহ তা'আলা ও তাঁর রাসুলের নাফরমান ও অবাধ্য বলে বিবেচিত হবে।
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান