মুসনাদে ইমাম আযম আবু হানীফা রহঃ

৪. নামায অধ্যায়

হাদীস নং: ১১৩
ফজর নামাযে দু'আয়ে কুনূত পাঠ করা সম্পর্কে
১১৩। হযরত ইবনে মাসউদ (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত আছে, এক মাস ব্যতীত নবী করীম (ﷺ) কখনো ফজর নামাযে দু'আয়ে কুনূত পাঠ করেননি। এর পূর্বে বা পরে কখনো তা পাঠ করতে দেখা যায়নি। তিনি (এই দু'আয়ে কুনূতে) কয়েকজন মুশরিকের বিরুদ্ধে বদদু'আ করেছেন।
عَنْ حَمَّادٍ، عَنْ عَلْقَمَةَ، عَنِ ابْنِ مَسْعُودٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ: «أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَمْ يَقْنُتْ فِي الْفَجْرِ إِلَّا شَهْرًا وَاحِدًا، لَمْ يُرَ قَبْلَ ذَلِكَ، وَلَا بَعْدَهُ يَدْعُو عَلَى أُنَاسٍ مِنَ الْمُشْرِكِينَ»

হাদীসের ব্যাখ্যা:

হাদীসে বর্ণিত আছে, যে সমস্ত কাফিরের বিরুদ্ধে হুযুর (সা) বদ দু'আ করেছেন, তারা হুযুর (সা)-এর সাথে চুক্তি করে তা ভঙ্গ করেছে এবং ধোকা দিয়ে কয়েকজন ক্বারী (সাহাবা)-কে নিয়ে অত্যন্ত নির্মমভাবে শহীদ করে। এর ফলে আঁ হযরত (সা) অন্তরে এত দুঃখ ও ব্যথা পেয়েছেন যে, তিনি এই অপকর্মকারীদের বিরুদ্ধে দু’আয়ে কুনুতের মাধ্যমে বদ দু'আ শুরু করেন এবং এক মাস পর্যন্ত মুশরিকদের বিরুদ্ধে কুনূতের মাধ্যমে এই বদ দু’আ অব্যাহত রাখেন।
এই হাদীসে বর্ণিত দু'আয়ে কুনূত সম্পর্কে ইমামদের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। ইমাম আবূ হানীফা (র) ও ইমাম আহমদ (র)-এর মতে বিতর নামাযে দু'আয়ে কুনূত পাঠ করা সুন্নাত। কেননা তাঁদের মতে ফজরে দু'আয়ে কুনূত একটি বিশেষ সময়ে এবং বিশেষ অবস্থার প্রেক্ষিতে শুরু হয়েছিল যা এক মাস অব্যাহত থাকার পর সমাপ্ত হয়ে যায়। এটা হুযূর (সা)-এর অব্যাহত আমল নয়। যার ফলে এটা স্থায়ী সুন্নাত হতে পারে না। ইমাম শাফিঈ (র) ও ইমাম মালিক (র)-এর মতে ফজর নামাযে দু'আয়ে কুনুত পাঠ করা সুন্নাত। তাঁরা আবূ জাফরের সূত্রে হযরত আনাস (রা) থেকে দারে কুতনী গ্রন্থে বর্ণিত এ হাদীস দলীল হিসেবে পেশ করেছেনঃ
مازال رسول الله صلی الله عليه وسلم يقنت في الصبح حتى فارق الدنيا "রাসূলুল্লাহ্ (সা) ইনতিকালের পূর্বে পর্যন্ত ফজর নামাযে সর্বদা দুআয়ে কুনূত পাঠ করেন। দ্বিতীয় দলীল হিসেবে বুখারী শরীফের হযরত আবূ হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত হাদীস পেশ করেছেন। হাদীসে হযরত আবূ হুরায়রা (রা) বলেনঃ “আমি নামাযে তোমাদের চেয়ে হুযূর (সা)-এর অতি নিকটবর্তী ছিলাম।” অর্থাৎ আমি হুযূর (সা)-এর সাথে তোমাদের চেয়ে অধিক নামায আদায় করেছি। হযরত আবু হুরায়রা (রা) ফজর নামাযের দ্বিতীয় রাকাআতে سمع الله لمن حمده পাঠ করার পর মুমিনদের জন্য দু'আ করতেন এবং কাফিরদের জন্য বদ দু'আ করতেন। আবদুল্লাহ ইবনে সাঈদ আল-মাকবিরী (র)-এর সূত্রে হযরত আবূ হুরায়রা (রা) থেকে অপর রিওয়ায়েতে বর্ণিত আছে যে, নবী করীম (সা) ফজর নামাযের দ্বিতীয় রাকাআতে রুকু থেকে মাথা উঠানোর পর দু'আয়ে কুনূত পাঠ করতেন।
হযরত ইমাম আবূ হানীফা (র)-এর প্রথম দলীল হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) বর্ণিত হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, ফজরের দু'আয়ে কুনূত নাযিলা আকারের ছিল। এই দু'আয়ে কুনূত নাযিলা এক মাস অব্যাহত ছিল। এরপর তা বন্ধ হয়ে যায়। এই হাদীস ইবনে আবী শায়বা, বাশশার ও তিবরানী (র) রিওয়ায়েত করেছেন। প্রথমত হযরত ইবনে মাসউদ (রা) এরূপ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন লোক, যাঁর উপর হানাফী মাযহাবের ফিকহ নির্ভরশীল। এ ছাড়া তিনি এমন একজন মর্যাদাসম্পন্ন সাহাবী যিনি হুযূর (সা)-এর খাদিম হিসেবে বিশেষ সম্মানের অধিকারী। তাঁর সব সময়ের সাথী হওয়ার গৌরব তিনি অর্জন করেছিলেন। আঁ হযরত (সা)-এর পারিবারিক ও বাইরের সমস্ত খবর সম্পর্কে তিনি অবগত ছিলেন। এরূপ ব্যক্তির সম্পর্কে কি এই ধারণা করা যায় যে, বাধ্যতামূলকভাবে ফজর নামাযে দু'আয়ে কুনূত পাঠ করা হয়েছে এবং তিনি এ সম্পর্কে অজ্ঞাত ছিলেন? এই আমল ধারাবাহিকভাবে অব্যাহত ছিল অথচ তিনি এটার খবর রাখেন নি? তা কখনো হতে পারে না।
দ্বিতীয় দলীল হলো বায়হাকী বর্ণিত হযরত ইবনে উমর (রা)-এর হাদীস। তিনি বলেন, আমি হযরত ইবনে উমর (রা)-এর সাথে ফজর নামায আদায় করি। তিনি এই নামাযে দু'আয়ে কুনুত পাঠ করেন নি। ইবনে আবী শায়বা ও হযরত সাঈদ ইবনে যুবায়র (রা) থেকে বর্ণিত আছে, হযরত উমর (রা) ফজর নামাযে দু'আয়ে কুনূত পাঠ করেন নি। ইমাম শা'বী (র) বলেন, হযরত আবদুল্লাহ (রা) পড়েননি। যদি হযরত উমর (রা) পাঠ করতেন তাহলে হযরত ইবনে উমর (রা)-ও তা পাঠ করতেন। হযরত ইবনে আবী শায়বা (র) বলেন, হযরত আবু বকর (রা), হযরত উমর (রা) এবং হযরত উসমান (রা) ফজর নামাযে দু'আ কুনূত পাঠ করতেন না। মুহাম্মদ ইবনে হাসান আসওয়াদ ইবনে ইয়াযীদ থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন যে, আমি দু'বৎসর সফরে ও বাড়িতে হযরত উমর (রা)-এর সাথে ছিলাম। কিন্তু আমি তাঁকে ফজর নামাযে দু'আয়ে কুনুত পাঠ করতে দেখিনি। ইবনে আবী শায়বা বলেন, একবার হযরত আলী (রা) শত্রুদের অনিষ্টতা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ফজর নামাযে দু'আয়ে কুনূত পাঠ করেন। এই নূতন ঘটনায় মুকতাদীগণ অবাক হলেন। ফলে হযরত আলী (রা) বলেন, এই দু'আ দ্বারা আমরা শত্রুদের উপর জয়ী হওয়ার জন্য আল্লাহর নিকট সাহায্য চেয়েছি। এতে প্রতীয়মান হয় যে, এটা কুনূতে নাযিলা ছিল। যদি সব সময় পাঠ করা হতো, তা হলে সাহাবায়ে কিরাম এতে অবাক হতেন না।
তৃতীয় দলীল হলো, আবূ মালিক সাআদ ইবন তারেক আশজাঈ তাঁর পিতা থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেছেন, আমি হুযূর (সা)-এর পিছনে ইকতিদা করে নামায আদায় করেছি, কিন্তু তিনি কুনূত পাঠ করেননি। এমনিভাবে হযরত আবূ বকর (রা), হযরত উমর (রা), হযরত উসমান (রা) এবং হযরত আলী (রা)-এর পিছনে নাময আদায় করেছি, কিন্তু তাঁরা নামাযে দু'আয়ে কুনূত পাঠ করেননি। অতঃপর তিনি বলেছেন হে পুত্র! এটা বিদআত। তিরমিযী, নাসাঈ ও ইবনে মাজাহ এই হাদীস রিওয়ায়েত করেছেন। তিরমিয়ী এই হাদীসকে হাসান (حسن) বলেছেন এবং এটাও বলেছেন যে, অধিকাংশ আলিম এই মত পোষণ করেছেন। সুতরাং উপরোক্ত দলীলের দ্বারা এটা প্রমাণিত হয় যে, ইমাম আবূ হানীফা (র)-এর মাযহাবই সঠিক।
এবার বিরোধী পক্ষের দলীল নিয়ে একটু আলোচনা প্রয়োজন। তাঁদের দলীল হলো হযরত আনাস (রা) বর্ণিত হাদীস। এই হাদীসের বর্ণনাকারীদের মধ্যে একজন হলেন আবূ জা'ফর (র)। তাঁর সম্পর্কে সমালোচকগণ বলেছেন, তিনি অন্য বর্ণনাকারীদের পরীক্ষা নীরিক্ষা করেছেন কিন্তু নিজের বর্ণনাকারীদের পরীক্ষা করেন নি। ইবনে মুঈন (র) বলেছেন, তিনি প্রায়ই ভুল করতেন। আহমদ (র) বলেছেন, বর্ণনায় তিনি শক্তিশালী নন। আবূ যারআ (র) বলেন, তিনি বর্ণনার মধ্যে সন্দেহ পোষণ করতেন। ইবনে হাব্বান (র) বলেছেন, তিনি মুনকার (منكر) হাদীস বর্ণনা করতেন। অতঃপর এই হাদীস খন্ডন করে তিবরানী গালিব ইবনে ফরকদ (র) থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেছেন, আমি দু'মাস হযরত আনাস (রা)-এর নিকট অবস্থান করেছি কিন্তু আমি তাঁকে ফজর নামাযে দু'আয়ে কুনূত পাঠ করতে দেখিনি। এছাড়া খতীব (র) হযরত আনাস (রা) থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন যে, নবী করীম (সা) ফজর নামাযে দু'আয়ে কুনূত পাঠ করতেন না। তবে যখন কোন জাতির (قوم) জন্য দু'আ করতেন অথবা বদ দু'আ করতেন, তখন দু'আয়ে কুনূত করতেন। সুতরাং এতে প্রতীয়মান হয় যে, তিনি যে দু'আ করতেন, তা ছিল কুনূতে নাযিলা।
এরপর হযরত আবু হুরায়রা (রা) বর্ণিত হাদীসের জওয়াব হলো এই যে, এ হাদীসের একজন বর্ণনাকারী হলেন আবদুল্লাহ ইবনে সাঈদ মাকরুরী যাঁর সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, অধিকাংশের মতে দলীল হিসেবে তিনি গ্রহণযোগ্য নন। ইবনে হাব্বানে হযরত আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত হাদীস দ্বারাও এর খন্ডন করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে كان رسول الله صلى الله عليه وسلم لا يقنت في صلوة الصبح الا ان يدعـو تـقـوم أو على قـوم “রাসূলুল্লাহ্ (সা) ফজর নামাযে দু'আয়ে কুনূত পাঠ করতেন না। তবে যখন কোন জাতির জন্য দু'আ করতেন অথবা বদ দু'আ করতেন” (তখন তিনি কুনূত পাঠ করতেন)। সুতরাং এই হাদীস দ্বারা স্পষ্ট প্রমাণিত হয় যে, এটা কুনূতে নাযিলা ছিল। বুখারী শরীফে বর্ণিত হাদীসের একই জওয়াব দেওয়া যায়। অধিকন্তু মুসলিম, তিরমিযী ও অন্যান্য হাদীস গ্রন্থে ফজর নামাযের সাথে মাগরিবের নামাযের কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু মাগরিবের বিরোধী পক্ষও সব সময়ের জন্য কুনুতের পক্ষে মত পোষণ করেন না। সুতরাং উভয় নামাযে ঐ দু’আ কুনূতে নাযিলা হিসেবে গণ্য করা ছাড়া কোন উপায় নেই। নতুবা মাগরিবের নামাযেও দু'আয়ে কুনূত এসে যায়। এখানে একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, হানাফী মাযহাবের দলীল তাদের মতামত সম্পর্কে খুবই স্পষ্ট। কিন্তু বিরোধী পক্ষের হাদীস কুনুতে নাযিলার উপর প্রতিষ্ঠিত হতে পারে, আবার কুনূত অর্থে দীর্ঘ কিয়ামের উপরও গণ্য হতে পারে। যেমন বলা হয়েছে: أفضل الصلوة طول القنوت “উত্তম নামায হলো দীর্ঘক্ষণ কুনূত ও কিয়াম করা” এবং ফজর নামাযে সাধারণত সমস্ত নামাযের চেয়ে বেশি দীর্ঘ কিয়াম হয়ে থাকে।
শরীয়তের দৃষ্টিতে কুনূতে নাযিলা এখনো জায়েয আছে, না রহিত (منسوخ) হয়েছে, এটা অবগত হওয়া প্রয়োজন। পরবর্তী উলামায়ে কিরামের বর্ণনায় প্রতীয়মান হয় যে, হুযূর (সা)-এর পরেও এই আমল অব্যাহত রয়েছে। হযরত আবূ বকর (রা) ও হযরত উমর (রা) যুদ্ধের সময় কুনূতে নাযিলা পাঠ করতেন। হযরত আলী (রা) হযরত মুআবিয়া (রা)-এর বিরুদ্ধে এবং হযরত মুআবিয়া (রা) হযরত আলী (রা)-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধের সময় কুনূতে নাযিলা পাঠ করেছেন।