মুসনাদে ইমাম আযম আবু হানীফা রহঃ

৪. নামায অধ্যায়

হাদীস নং: ১০৪
ইমামের কিরাআতই মুকতাদীর কিরাআত
১০৪। হযরত জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ্ (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) বলেছেনঃ যার (নামাযে) ইমাম থাকবে, ইমামের কিরাআতই জন্য যথেষ্ট।
অপর এক রিওয়ায়েতে আছে, এক ব্যক্তি নবী (ﷺ)-এর পিছনে যোহর অথবা আসর নামাযে কিরাআত পাঠ করে, তখন এক ব্যক্তি ইঙ্গিতে তা থেকে নিষেধ করেন। যখন তিনি নামায থেকে অবসর হলেন তখন বললেন, তুমি কি আমাকে নবী করীম (ﷺ)-এর পিছনে পড়া থেকে বাধা প্রদান করছ? অতঃপর উভয়ে এটা নিয়ে তর্ক করতে লাগল। ফলে এটা নবী (ﷺ) শুনে ফেললেন। তখন তিনি বললেনঃ যে ব্যক্তি ইমামের পিছনে নামায পড়বে, এ অবস্থায় ইমামের কিরাআতই তার কিরআত হবে অর্থাৎ মুকতাদী হিসেবে তাকে কিরাআত পড়তে হবে না।
অন্য এক রিওয়ায়েতে আছে, হযরত জাবির (রাযিঃ) বলেনঃ এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)-এর পিছনে (কিরাআত) পাঠ করে। তখন তিনি তাকে কিরাআত পাঠ থেকে নিষেধ করেন।
অপর এক রিওয়ায়েতে আছে, হযরত জাবির (রাযিঃ) বলেনঃ একবার রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) (ইমাম হিসেবে) লোকদের নামায পড়ান। তখন তাঁর পিছনে এক ব্যক্তি কিরাআত পাঠ করেন। যখন তিনি নামায শেষ করেন, তখন তিনি বলেনঃ তোমাদের মধ্যে কে আমার পিছনে কিরাআত পাঠ করেছে? এটা তিনি তিনবার বললেন। তখন এক ব্যক্তি আরয করল, আমি, ইয়া রাসূলাল্লাহ । তখন তিনি বলেনঃ যে ব্যক্তি ইমামের পিছনে নামায পড়বে, এমতাবস্থায় ইমামের কিরাআত তার কিরাআত হিসেবে গণ্য হবে।
অন্য এক রিওয়ায়েতে আছে, নবী (ﷺ) একবার যোহর অথবা আসর নামায শেষ করার পর জিজ্ঞাসা করেন, তোমাদের মধ্যে কে سبح اسم ربك الاعلى পাঠ করেছে? (আদবের খাতিরে) সবাই চুপ থাকে। ফলে তিনি একই কথা তিনবার জিজ্ঞাসা করেন। তখন মুকতাদীদের মধ্য থেকে একজন আরয করলেন, আমি, ইয়া রাসূলাল্লাহ! তখন তিনি বললেনঃ নিশ্চয়ই আমি দেখছি যে, তোমরা আমার পবিত্র কুরআন নিয়ে ঝগড়া করছ, অথবা (এটা বর্ণনাকারীর পক্ষ থেকে সন্দেহ) কুরআন পড়ার মধ্যে তোমরা আমাকে চিন্তার মধ্যে ফেলে দিচ্ছ।
عَنْ مُوسَى، عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ شَدَّادٍ، عَنْ جَابِرِ بْنِ عَبْدِ اللَّهِ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ، أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: «مَنْ كَانَ لَهُ إِمَامٌ فَقِرَاءَةُ الْإِمَامِ لَهُ قِرَاءَةً» ، وَفِي رِوَايَةٍ: أَنَّ رَجُلًا قَرَأَ خَلْفَ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِي الظُّهْرِ وَالْعَصْرِ، وَأَوْمَأَ إِلَيْهِ رَجُلٌ، فَنَهَاهُ، فَلَمَّا انْصَرَفَ، قَالَ: أَتَنْهَانِي أَنْ أَقْرَأَ خَلْفَ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ؟ فَتَذَاكَرَا ذَلِكَ حَتَّى سَمِعَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «مَنْ صَلَّى خَلْفَ الْإِمَامِ، فَإِنَّ قِرَاءَةَ الْإِمَامِ لَهُ قِرَاءَةٌ» .
وَفِي رِوَايَةٍ، قَالَ: قَرَأَ رَجُلٌ خَلْفَ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، «فَنَهَاهُ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ» .
وَفِي رِوَايَةٍ، قَالَ: صَلَّى رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بِالنَّاسِ، فَقَرَأَ رَجُلٌ خَلْفَهُ، فَلَّمَا قَضَى الصَّلَاةَ، قَالَ: " أَيُّكُمْ قَرَأَ خَلْفِي؟ ثَلَاثَ مَرَّاتٍ، فَقَالَ رَجُلٌ: أَنَا يَا رَسُولَ اللَّهِ، قَالَ: «مَنْ صَلَّى خَلْفَ الْإِمَامِ، فَإِنَّ قِرَاءَةَ الْإِمَامِ لَهُ قِرَاءَةٌ» .
وَفِي رِوَايَةٍ، قَالَ: انْصَرَفَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مِنْ صَلَاةِ الظُّهْرِ وَالْعَصْرِ، فَقَالَ: " مَنْ قَرَأَ مِنْكُمْ: سَبِّحِ اسْمَ رَبِّكَ الْأَعْلَى؟ فَسَكَتَ الْقَوْمُ، حَتَّى سَأَلَ عَنْ ذَلِكَ، فَقَالَ رَجُلٌ مِنَ الْقَوْمِ: أَنَا يَا رَسُولَ اللَّهِ، فَقَالَ: لَقَدْ رَأَيْتُكَ تُنَازِعُنِي، أَوْ تُخَالِجُنِي الْقُرْآنَ

হাদীসের ব্যাখ্যা:

ইমামের পিছনে মুকতাদীর সূরা ফাতিহা পাঠ করা এবং না করা সম্পর্কে আইম্মায়ে কিরামের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। ইমাম আবূ হানীফা (র)-এর মতে উচ্চস্বরের নামায হোক যেমন ফজর, মাগরিব, ইশা ও জুমু'আ অথবা নিম্নস্বরের নামায, যেমন যোহর ও আসর, কোন অবস্থাতেই ইমামের পিছনে মুকতাদীর সূরা ফাতিহা পড়তে হবে না। একই মত পোষণ করেছেন হযরত জাবির ইবনে আবদুল্লাহ্ (রা), হযরত যায়দ ইবনে সাবিত (রা), হযরত আলী ইবনে আবী তালিব (রা), হযরত উমর ইবনে খাত্তাব (রা), হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রা), হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ (রা), হযরত সুফিয়ান সওরী (র), সুফিয়ান ইবনে উয়াইনা (র), ইবনে আবী লায়লা (র), হাসান ইবনে সালেহ্ ইবনে হাসান (র), ইবরাহিম নখঈ (র) ও অন্যান্য হাদীস বিশারদগণ মোট কথা প্রখ্যাত সাহাবা ও তাবেঈগণ এই মাযহাব অনুসরণ করতেন। আল্লামা আইনী (র) বলেন: প্রথম যুগের মর্যাদাসম্পন্ন সাহাবাদের মধ্যে আশিজন ইমামের পিছনে কিরাআত পাঠ না করার পক্ষ সমর্থন করেছেন। কারো কারো মতে এই সংখ্যা আরো বৃদ্ধি হয়ে প্রায় ইজমা হওয়ার স্তর পর্যন্ত পৌঁছেছে।
ইমাম শাফিঈ (র)-এর মাযহাব (যখন তিনি মিসরে ছিলেন) হলো এই যে, নামায উচুস্বরের হোক অথবা নিম্নস্বরের হোক, ইমামের পিছনে মুকতাদীর সূরা ফতিহা পাঠ করা ফরয। এই মত পোষণ করতেন হযরত উবাদাহ্ ইবনে সামিত (রা), হযরত উরওয়াহ ইবনে যুবায়র (রা), হযরত সাঈদ ইবনে যুবায়র (রা), ইমাম আওযাঈ (র), হযরত হাসান বসরী (র), হযরত লাইস ইবনে সা'দ (র), হযরত আবূ সওর (র) ও অন্যান্যগণ। ইমাম মালিক (র) উঁচু হরের নামাযে ইমাম আবু হানীফা (র)-এর পক্ষ এবং নিম্ন স্বরের নামাযে ইমাম শাফিঈ (র)-এর পক্ষ সমর্থন করেছেন। এই মত পোষণ করতেন হযরত সাঈদ ইবনে মুসায়্যেব (রা), হযরত উবায়দুল্লাহ ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে উতবা ইবনে মাসউদ (রা), হযরত সালিম ইবনে আবদুল্লাহ (রা), ইবনে উমর (রা), ইমাম যুহরী (র), ইমাম কাতাদাহ (র), হযরত ইবনুল মুবারক (র) এবং হযরত ইসহাক (র)। ইমাম আহমদ (র) ইমাম মালিক (র)-এর মত সমর্থন করেছেন। তবে উঁচু স্বরের নামাযে একটু মতপার্থক্য করে বলেছেন, যদি মুকতাদী এতটুকু দূরে থাকে যে, ইমামের কিরাআত শুনতে পায় না, তাহলে তাকে ফাতিহা পাঠ করতে হবে। ইমাম শাফিঈ (র) যখন ইরাকে ছিলেন, তখন তিনিও এই মত পোষণ করতেন। হযরত উবাই ইবনে কা'ব (রা) ও অন্যান্যদের এই মাযহাব ছিল।
ইমাম আবূ হানীফা (র)-এর মাযহাব অত্যন্ত শক্তিশালী দলীলের উপর প্রতিষ্ঠিত। কেননা পবিত্র কুরআন ও হাদীসে এর স্বপক্ষে দলীল ও প্রমাণ রয়েছে। কিয়াসও এর সমর্থন করে। অধিকাংশ সাহাবার ঐকমত্য বিষয়টিকে ইজমা'র নিকটবর্তী পৌঁছে দিয়েছে। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে واذا قرئ القران فاستمعوا له وأنصتوا , "যখন পবিত্র কুরআন পাঠ করা হয়, তখন তা শ্রবণ কর এবং চুপ থাক।" এ ব্যাপারে সবাই একমত যে, এই আয়াত ইমামের পিছনে ফাতিহা পাঠ সম্পর্কে নাযিল হয়েছে। হুযূর (সা)-এর পিছনে মুক্তাদী হিসেবে নামায পড়ার সময় এক ব্যক্তি যখন সূরা ফাতিহা পাঠ করেন, তখন এই আয়াত নাযিল হয়। ইমাম আহমদ (র) থেকে বায়হাকী রিওয়ায়েত করেন, اجمع الناس على ان هذه الآية في الصلاة "লোকজন এ ব্যাপারে ঐকমত্য পোষণ করেছে যে, এই আয়াত নামায সম্পর্কে নাযিল হয়েছে।"
মুজাহিদ থেকে বর্ণিত আছে যে, নবী (সা) নামাযে কিরাআত পাঠ করছিলেন, এ সময় তিনি পিছনে একজন আনসারীর কিরাআতের আওয়ায শুনতে পেলেন। তখন এই আয়াত অবতীর্ণ হয়। ইবনে মারদুয়া স্বীয় তাফসীরে বর্ণনা করেন যে, এই আয়াত ইমামের পিছনে কিরাআত পাঠ সম্পর্কে নাযিল হয়েছে। এখানে একটি বিষয় খেয়াল রাখা প্রয়োজন, তা হলো, উসূলে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হলো এই যে, কোন সাধারণ (مطلق) বিষয়কে এর প্রয়োগকৃত বস্তুর উপর স্থীর রাখতে হবে। সুতরাং এই নীতি অনুযায়ী উল্লিখিত আয়াতে إذا قرئ القرآن সাধারণ (مطلق) অর্থাৎ আয়াত উচুস্বরে বা নিম্নস্বরে পাঠ করা, উভয়কে অন্তর্ভুক্ত করেছে। এমনিভাবে انصتوا (চুপ থাকা) সাধারণ (مطلق وعام) অর্থাৎ উচুস্বরের অথবা নিম্নস্বরের কিরাআত হোক না কেন, উভয় অবস্থায় চুপ থাকার নির্দেশ রয়েছে। তবে আয়াত فاستمعوا -এর মধ্যে শ্রবণ করা উঁচু স্বরে নামাযের সাথে নির্দিষ্ট। কেননা উচুস্বরে পড়া না হলে শ্রবণ করা সম্ভব নয়। সুতরাং আয়াতের বিস্তারিত অর্থ হলো এই যে, যখন নামাযে কুরআন তিলাওয়াত করা হয়, তখন উঁচুস্বরের নামাযে কিরাআত শ্রবণ করা এবং উচুম্বর ও নিম্নস্বরের উভয় নামাযে চুপ থাকা। সুতরাং নামাযে, বিশেষ করে উচুস্বরের নামাযে ইমামের পিছনে কিরাআত পাঠ করা মাকরূহ তাহরীমি হবে।
খুলাসা (خلاصة) নামক গ্রন্থে বলা হয়েছে যে, যদি কোন ব্যক্তি উচ্চস্বরে পবিত্র কুরআন তিলাওয়াত করে এবং তার নিকট অন্য এক ব্যক্তি ইলমে ফিকহ লিখার কাজে এমনিভাবে মগ্ন থাকে যে, মনোযোগ সহকারে কুরআন শ্রবণ করা তার পক্ষে সম্ভব নয়, তা হলে কুরআন তিলাওয়াতকারী গুনাহগার হবে। কেননা লেখকের উপর শ্রবণ করা ওয়াজিব ছিল, কিন্তু যখন এটা সম্ভব হল না তখন এর গুনাহ তিলাওয়াতকারীর উপর পতিত হবে। এমনভাবে যদি কেউ রাতে ছাদের উপর উচ্চস্বরে কুরআন পাঠ করে এবং লোকজন শুয়ে থাকে, তা হলেও কুরআন তিলাওয়াতকারী গুনাহগার হবে। এরদ্বারা স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, নামাযে এবং নামাযের বাইরে কুরআন তিলাওয়াত শ্রবণ করা ওয়াজিব। যদিও বিধানের কারণ নির্ধারিত কিন্তু শব্দ সাধারণ
(عام) হওয়ার কারণে বিধানের কারণ ও সাধারণ থেকে যায়। কেউ কেউ فاستمعوا له وأنصتوا -এর মধ্যে একটি অপরটির সাথে সংযুক্ত (عطف) করেছেন। এর ফলে তাঁরা উভয়কে এক নির্দেশের মধ্যে গণ্য করে । أنصتوا কে উচুস্বরের নামাযের সাথে নির্দিষ্ট করে থাকেন। কিন্তু উভয়কে সংযুক্ত (عطف) করার কারণে এটা জরুরী নয় যে, উভয়ই উদ্দেশ্যের মধ্যে এক হতে হবে। যেমন পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে أقيموا الصلاة وآتوا الزكاة এখানে তার মালের উপর যাকাত ওয়াজিব। সুতরাং কুরআন শ্রবণ করা এবং চুপ থাকা পৃথক পৃথক নির্দেশ। একটি হলো নির্দিষ্ট (جاص), অপরটি সাধারণ (عام)। কিন্তু এখানে এটা সন্দেহ করা যাবে না যে, এই আয়াত যেহেতু উচুস্বরের নামায সম্পর্কে নাযিল হয়েছে, তাই উভয়ে এর সাথে নির্দিষ্ট হবে। এবার দ্বিতীয় সন্দেহ হলো এই যে, এই আয়াত (إذا قرئ القرآن) অপর এক আয়াত فاقرءوا ما تيسر من القرآن -এর বিরোধী যা সাধারণ (عام) হওয়ার কারণে ইমাম, মুকতাদী, একাকী নামায আদায়কারী, সবার উপর কিরাআত ওয়াজিব করে। এর একটি জওয়াব হলো এই যে, এই সমস্ত আয়াতের মধ্যে কোন বিরোধিতা নেই । কেননা সহীহ্ হাদীস قراءة الإمام له قراءة “ইমামের কিরাআত মুকতাদীর জন্য যথেষ্ঠ।” প্রকৃতপক্ষে শরীয়তের দৃষ্টিকোণ থেকে মুক্তাদীকেও কারী হিসেবে গণ্য করা হয়। শুধু পার্থক্য হলো এই যে, ইমামের কিরাআত হাকিকী (حقيقي) এবং মুকতাদীর কিরাআত হুকমী (حكمى)। অথবা তিলওয়াতের মাধ্যমে ইমামের কিরাআত আদায় এবং চুপ থাকার মাধ্যমে মুকতাদীর কিরাআত আদায় (فاقرءوا) হয়ে যায়। সুতরাং এর সাথে বিরোধিতা বাকী থাকে না।
দ্বিতীয় জওয়াব হলো এই যে, যদি কোন ব্যক্তি রুকু'র মধ্যে অংশগ্রহণ করে ঐ রাকাআত পেয়ে যান, তাহলে তিনি এই আয়াত থেকে মুক্ত। সুতরাং যদি উপরোক্ত হাদীসের দৃষ্টিকোণ থেকে মুক্তাদীকে মুক্ত রাখা হয়, তাহলে উভয় আয়াতের মধ্যে কোন বিরোধিতা থাকে না।
এবার হাদীস দ্বারা উপরোক্ত বিষয়টি আরো স্পষ্টভাবে আলোচনা করা প্রয়োজন। ইমামের পিছনে কিরাআত পাঠ করার নিষেধাজ্ঞা সম্পর্কে অনেক সাহাব্য থেকে বহু সহীহ্ মরফু', মওকুফ ও মুরসাল হাদীস বর্ণিত আছে। এঁদের মধ্যে হযরত জাবির ইবনে আবদুল্লাহ্ (রা), হযরত আবূ হুরায়রা (রা), হযরত আবুদ দারদা (রা) এবং ইমরান ইবনে হুসাইন (রা) উল্লেখযোগ্য। এর মধ্যে হযরত জাবির (রা) বর্ণিত হাদীস হানাফী মাযহাবের প্রধান দলীল। কিন্তু এই হাদীস অন্যান্য সাহাবায়ে কিরাম, যেমন হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে উমর (রা), হযরত আবূ সাঈদ খুদরী (রা), হযরত আনাস ইবনে মালিক (রা), হযরত আবূ হুরায়রা (রা) এবং হযরত ইবনে আব্বাস (রা) থেকে বর্ণিত আছে। হযরত জাবির (রা)-এর হাদীস মরফূ' হিসেবে বর্ণিত। বিরোধী পক্ষ এই হাদীসের সনদ দুর্বল (ضعيف) হিসেবে আখ্যায়িত করে বলে যে, মূসা ইবনে আবী আয়েশা থেকে কেউ এই হাদীস সহীহ পদ্ধতিতে বর্ণনা করেননি; বরং এই হাদীস মুরসাল। অর্থাৎ, আবদুল্লাহ্ ইবনে শাদ্দাদ (র) হযরত জাবির (রা)-এর মাধ্যমে ব্যতীত হুযূর (সা) থেকে এই হাদীস রিওয়ায়েত করেছেন। দারে কুতনীতে বলা হয়েছে, এই হাদীস মুরসাল সহীহ কিন্তু মুসনাদ সহীহ নয়। কেননা সুফিয়ান, আবুল আহওয়াস, শু’বা, ইসরাঈল, আবূ খালিদ, শুরাইক (র) ও অন্যান্য থেকে এই হাদীস মুরসাল হিসেবে বর্ণিত আছে।
এখন প্রশ্ন হলো আবূ হানীফা (র)-এর মত একজন প্রখ্যাত ইমাম থেকে এই হাদীস মরফূ' বর্ণিত হয়েছে, তা হলে এর জওয়াব কি ? দারে কুতনী বলেনঃ
هذا الحديث لم يسند عن جابر بن عبد الله غير أبي حنيفة والحسن ابن عمارة وهما ضعيفان
“এই হাদীস হযরত জাবির ইবনে আবদুল্লাহ্ (রা) থেকে ইমাম আবূ হানীফা (র) এবং হাসান ইবনে আম্মারা ব্যতীত কেউ রিওয়ায়েত করেনি। অথচ এই দু'জনই দুর্বল (ضعيف)। নাউযুবিল্লাহ! এমন একজন প্রখ্যাত ইমাম সম্পর্কে দারে কুতনীর এই মন্তব্য অত্যন্ত ন্যাক্কারজনক, তার একবার চিন্তা করা উচিত ছিল যে, আমি কার সম্পর্কে এই উক্তি করছি। অথচ তার নিজের মুসনাদে মা'লুল, মুনকার, গরীব ও মওযূ' হাদীসে ভর্তি। ইমাম আবূ হানীফা (র) সম্পর্কে তার এই দুঃসাহস খুবই দুঃখজনক। যাঁর ইলম ও ফযীলত সম্পর্কে ইমাম সুফিয়ান সওরী, ইবনুল মুবারক, হাম্মাদ ইবনে যায়দ, হুসায়ম, ওয়াকী' ইবনে জাররাহ্ ও অন্যান্য প্রখ্যাত উলামায়ে কিরাম (র) প্রশংসা করেছেন। যাঁর মতামতের উপর অনেক বিষয়ে ইমাম মালিক, ইমাম শাফিঈ ও ইমাম আহমদ (র) ঐকমত্য পোষণ করেছেন। তবুও এই কূটিলতাপূর্ণ সমালোচনার জওয়াব হলো এই যে, যদি তোমাদের মতে এই হাদীস মুসালসাল (مسلسل) সহীহ্ হয়ে থাকে, তা হলে হানাফীদের মতে মুরসাল (مرسل) হাদীস দলীল হওয়ার যোগ্যতা রাখে। এছাড়া এই অভিযোগ অত্যন্ত ভুল যে, ইমাম আবূ হানীফা (র) ব্যতীত মূসা থেকে অন্য কেউ এই হাদীস মুসনাদ বর্ণনা করেনি। কেননা আহমদ ইবনে মানী স্বীয় মুসনাদে এই হাদীস দু'টি সহীহ পদ্ধতিতে মরফূ' বর্ণনা করেছেন। প্রথমটি হলো সুফিয়ান ও শুরাইক (র) মূসা (র) থেকে রিওয়ায়েত করেছেন। দ্বিতীয়টির মধ্যে জারীর (র) ও অন্যান্যের রিওয়ায়েত। বুখারী ও মুসলিমের শর্ত অনুযায়ী প্রথম সনদ সহীহ এবং দ্বিতীয় সনদ মুসলিমের শর্ত অনুযায়ী সহীহ। সুতরাং এবার দারে কুতনীর দাবি যে, সুফিয়ান, শুরাইক, জারীর (র) ও অন্যান্যগণ মূসা (র)-এর সূত্রে এই হাদীস মরফূ' (مرفوع) নয়, এটা ভুল প্রমাণিত হলো।
এরপর বায়হাকী, দারে কুতনী, তাহাবী ও ইবনে আদী (র) অন্য এক পদ্ধতিতে এই হাদীস রিওয়ায়েত করেছেন। কিন্তু এখানে বায়হাকী আবূ যুবায়র (র) থেকে বর্ণনাকারী জাবির, লাইস, ইবনে আবী সুলায়ম (র) ও অন্যান্যদেরকে নিয়ে অভিযোগ উত্থাপন করে বলেছেন جابر و ليث لا يحتج بهما "জাবির ও লাইস (র) দলীল হিসেবে গ্রহণযোগ্য নন।" কেননা তাঁদের মতে বর্ণনাকারীর দুর্বল (৯) হওয়া তার অবস্থার উপর নির্ভর করে না; বরং একজন নির্ভরযোগ্য (ثقة) বর্ণনাকারী হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে অপর একজন বর্ণনাকারীর বিপক্ষে আসার উপর নির্ভর করে।
মোট কথা বিরোধী পক্ষের কথা হলো, হানাফীদের নিকট এ বিষয়ে কোন হাদীস নেই এবং আসমাউর রিজাল (اسماء الرجال) -এর জ্ঞান নেই, সব কিছু তাদের কাছেই রয়েছে। মোট কথা হানাফী মাযহাবের বিরোধিতা করাই হলো মূল উদ্দেশ্য। অথচ এই জাবির (রা)-এর হাদীস নির্ভরযোগ্য (توثيق) বলে ওয়াকী, শু’বা, সুফিয়ান সওরী (র) ও অন্যান্য আইম্মায়ে কিরাম মত প্রকাশ করেছেন। ইবনে আবদুল হাকিম (র) বলেনঃ ইমাম শাফিঈ (র) থেকেও আমি এই হাদীসের নির্ভরযোগ্যতা সম্পর্কে তাঁর মন্তব্য শুনেছি। লাইস (র) সম্পর্কে ইবনে মাঈন (র) বলেন; لا باس به আবদুল ওয়ারিস বলেন: اكان من أوعية العلم এরপর শু’বা তাঁর কাছ থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন। তাই এতে কিভাবে সন্দেহ করা যায় যে, এমনিভাবে ইবনে আবী শায়বা আনুষ-যুবায়রের সূত্রে হযরত জাবির (রা) থেকে এই মরফূ' হাদীস বর্ণনা করেছেন ? আল-জাওহারুন নকীতে বলা হয়েছে যে, এই হাদীসের রিজাল (رجال) সবাই নির্ভরযোগ্য (ثقة)। আবূ নুআইম (র) এই হাদীস মরফূ' হিসেবে বর্ণনা করেছেন। এবার কিছুক্ষণের জন্যও যদি ধরে নেয়া যায় যে, এই হাদীস অন্য কোন পদ্ধতিতে মরফূ' সহীহ্ নয়, তা হলেও ইমাম আবূ হানীফা (র)-এর এই হাদীসকে মরফূ' হিসেবে গ্রহণ করা নিশ্চিতভাবে এটা দলীলের উপযুক্ত হবে। অধিকন্তু তা মওকুফ ও সহীহ্ পদ্ধতিতেও বর্ণিত আছে। সুতরাং ইমাম মুহাম্মদ (র) মালিক (র)-এর সূত্রে ওহাব ইবনে কায়সান (র) থেকে হাদীস বর্ণনা করে বলেনঃ তিনি হযরত জাবির (রা)-কে বলতে শুনেছেনঃ
من صلى ركعة لم يقرأ فيها بأم القرآن فلم يصل إلا وراء الإمام
“যে ব্যক্তি এক রাকাআত নামায পড়লো এবং এতে সূরা ফাতিহা পড়ল না, তা হলে সে যেন নামাযই পড়লো না; ইমামের পিছনে ছাড়া।"
এবার হাদীসের বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেওয়া হলো। প্রকৃতপক্ষে প্রথম রিওয়ায়েত মূল হাদীসের একটি অংশ যা অন্য রিওয়ায়েতে বর্ণিত আছে। হযরত জাবির (রা) কখনো মূল বিষয় (محل حكم) বর্ণনা করেন। আবার কখনো এর সাথে বিস্তারিত ব্যাখ্যা বর্ণনা করেন। দ্বিতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম রিওয়ায়েতের দ্বারা দু'টি বিষয়ের ব্যাখ্যা হয়ে থাকে। একটি হলো এই যে, قرات خلف الإمام (ইমামের পিছনে কিরাআত) এই বাক্যের দ্বারা নিম্নস্বরের নামাযেও কিরাআতের নিষেধাজ্ঞা বুঝানো হয়েছে। কেননা যোহর ও আসর নামায় সম্পর্কে এই আলোচনা। এরদ্বারা ইমাম মালিক (র) ও অন্যান্যদের মাযহাবকে স্পষ্ট বাক্যের দ্বারা খন্ডন করা হয়েছে। দ্বিতীয়ত হুযূর (সা) বলেছেন : من صلى خلف الإمام এই হাদীসের বাক্য ياريتك تنازعني -এর দ্বারা ইমামের পিছনে কিরাআতের নিষেধ করা হয়েছে। কিন্তু কেউ কেউ এর দ্বারা নিজেদের উদ্দেশ্য সাধনের চেষ্টা করেছেন। তারা বলেনঃ হুযুর (সা) শুধু এটা বলেছেন যে, ইমামের কিরাআত মুকতাদীর জন্য যথেষ্ট। কিন্তু যদি মুকতাদী ইচ্ছা করে, তা হলে নিজেও পড়তে পারে। এই অর্থ নয় যে, মুকতাদী মোটেই পড়তে পারবে না।
এর জওয়াব হলো এই যে, যদি তা সঠিক হতো তা হলে যখন ইমামের পিছনে কিরাআত পাঠকারী এবং নিষেধকারীর ঘটনা হুযূর (সা)-এর নিকট পেশ করা হয়, তখন তিনি নিষেধকারীর পক্ষ সমর্থন করে কিরাআত পাঠকারীর মতামতকে খন্ডন করেন। কেননা তিনি সুস্পষ্টভাবে কিরাআত থেকে বাধা প্রদান করে বলেন: যখন ইমামের কিরাআত মুকতাদীর জন্য যথেষ্ট, এ অবস্থায় তোমরা কেন অযথা কিরাআত পাঠ কর ? অধিকন্তু যদি কিরাআতের আজ্ঞা ও নিষেধাজ্ঞা উভয়ই গ্রহণযোগ্য হতো, তা হলে পঞ্চম রিওয়ায়েতে তিনি যে জিজ্ঞাসা করেনঃ من قران منكم سبح اسم ربك الاعلى তখন সবাই আদব ও নবুওয়তের বিশেষ মর্যাদার কারণে জওয়াব দেননি; এর দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, হুযূর (সা)-এর পবিত্র চেহারায় অসন্তোষ ও ক্রোধের চিহ্ন ফুটে উঠেছিল। ফলে কারো জওয়াব দেওয়ার সাহস হয়নি। অবশেষে আঁ হযরত (সা) তিনবার একই কথা জিজ্ঞাসা করেন। যদি কিরাআত জায়েন হতো, তা হলে তিনি কেন প্রশ্ন করতেন? যদিও প্রশ্ন করতেন, তা হলে পাঠক তা প্রথমেই স্বীকার করতেন যে, আমি কিরাআত পাঠ করেছি।
যদি কিছু সময়ের জন্য এটা মেনে নেওয়া যায় যে, ইমামের কিরাআত মুকতাদীর জন্য যথেষ্ট হওয়ার অর্থ এই যে, ইচ্ছা করলে মুকতাদীও কিরাআত পাঠ করতে পারে। তা হলে এর স্পষ্ট অর্থ হলো এই যে, মুকতাদীর উপর কিরাআতের ফরয হওয়ার বিষয়টি ইমামের কিরাআতের মাধ্যমে পূর্ণ হয়েছে। সুতরাং ইমাম যখন মুকতাদীর পক্ষ থেকে কিরাআত পাঠ করে এবং সাথে সাথে মুকতাদীও কিরাআত পাঠ করে, তাহলে এ অবস্থায় মুকতাদীর উপর শরীয়ত যতটুকু কিরাআত নির্ধারণ করেেছ, এর চেয়ে তা অতিরিক্ত হবে। কিন্তু এ ধরনের অতিরিক্ত কাজ শরীয়তে জায়েয নেই। দ্বিতীয়তঃ মুকতাদীর কিরাআত যখন ইমামের যিম্মায় মেনে নেওয়া হয়েছে, এ অবস্থায় যদি মুকতাদীও কিরাআত পাঠ করে, তা হলে মুকতাদী যেন একই রাকাআতে দু'টি কিরাআত পাঠ করল, এটাও জায়েয নয়। এছাড়া হাদীসের দ্বারা এটা প্রতীয়মান হয় যে, মুকতাদীর কিরআতের বদল বা স্থলাভিষিক্ত হলো ইমামের কিরাআত। যদি মুকতাদীও কিরআত পাঠ করে মূল ও স্থলাভিষিক্ত ( اصل و نائب ও بدل و مبدل منه) একত্র জমা হয়ে যাবে। বস্তুত এটা জায়েয নয়। প্রকাশ থাকে যে, হাদীস صلى جاف الإمام الج একটু গভীর দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে, এতে একটি সূক্ষ্ম বিষয়ের দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, কিরআতের জন্য উচুস্বরে বা নিম্নস্বরের নামাযের শর্ত আরোপ করা হয়নি। কেননা ইমামের কিরাআত মুকতাদীর পক্ষ থেকে বদল হওয়ার জন্য ইমামের পিছনে ইকতিদা করা আবশ্যক করা হয়েছে এবং এর জন্য মুকতাদীর উপর কিরাআতের নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। “এখানে ইকতিদা হলো সাধারণ (مطلق বা عام) উচুম্বর ও নিম্নস্বর উভয়কে অন্তর্ভুক্ত করে। সুতরাং এখানে ইমাম মালিক (র) ও অন্যান্যদের মাযহাব অনুযায়ী উচুম্বরের (جهرى) শর্ত আরোপ (قيد) করা কিভাবে সম্ভব? যদি তা করা হয়, তা হলে এটা হাদীসের মূল উদ্দেশ্যের বিরোধী হবে।
তৃতীয় রিওয়ায়েতে فنهاه এই শব্দ দ্বারা সুস্পষ্টভাবে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। এতে ব্যাখ্যার কোন প্রয়োজন নেই। এবার প্রশ্ন হলো, যখন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হলো, তা হলে এরদ্বারা কিরাআত সাধারণভাবে হারাম হওয়া প্রয়োজন ছিল এবং নামায ফাসেদ হওয়া উচিত ছিল। এ ব্যাপারে একটি দুর্বল রিওয়ায়েত বর্ণিত আছে। কিন্তু অন্যান্য রিওয়ায়েতের সাথে যেহেতু । বিরোধ সংঘটিত হয়েছে, তাই হারাম থেকে নমনীয় করে মাকরূহ তাহরীমী স্থির করা হয়েছে। ইমাম বুখারী ও মুসলিম থেকে এই রিওয়ায়েত বর্ণিত আছে। ইবনে আদী (র) স্বীয় কামিল নামক গ্রন্থে হযরত আবূ সাঈদ খুদরী (রা) থেকে একই বাক্যের মাধ্যমে হাদীস বর্ণিত আছে। কিন্তু এতে অভিযোগ করা হয় যে, এই হাদীসে ইসমাঈল ইবনে উমর হাসান ইবনে সালেহ থেকে রিওয়ায়েত করেছেন, যিনি দুর্বল (ضعيف) এবং কেউ তাঁকে অনুসরণ করেনি। অথচ তিবরানী এই হাদীসও একই সনদ উল্লেখ করেছেন। এতে নযর ইবনে আবদুল্লাহও হাসান সালেহ থেকে রিওয়ায়েত করেছেন। হযরত ইবনে উমর (রা) ও হযরত আবূ হুরায়রা (রা) থেকে দারে কুতনী, হযরত আনাস (রা) থেকে ইবনে হাব্বান কিতাবুয যুআফা (كتاب الضعفاء) নামক গ্রন্থে মরফু' হাদীস বর্ণনা করেছেন। কোন কারণ ব্যতীত এই হাদীসসমূহকে দুর্বল (ضعيف) বলা হয়েছে। এরপর যদি মেনে নেওয়া হয় যে, কোন কোন রিওয়ায়েত দুর্বল, কিন্তু অধিক সংখ্যক বিওয়ায়েতের দ্বারা হাদীসের দুর্বলতা দূরীভূত হয়ে যায়। সুতরাং এবার কোন অভিযোগ অবশিষ্ট থাকল না।
এবার ঐ সাহাবাদের হাদীসের উপর দৃষ্টিদান করা যায়, যাঁরা ইমামের পিছনে কিরাআতের নিষেধাজ্ঞার সাথে ঐকমত্য পোষণ করেছেন। এঁদের মধ্যে হযরত আবূ হুরায়রা (রা) বর্ণিত হাদীসের উল্লেখ করা হয়েছেঃ
إنما جعل الإمام ليؤتم به فإذا كبر فكبروا وإذا قرأ فأنصتوا وإذا قال سمع الله لمن حمده قولوا ربنا لك الحمد
“ইমাম এইজন্য নিয়োজিত করা হয়েছে যে, তাঁকে অনুসরণ করতে হবে। সুতরাং যখন তিনি তাকবীর বলবেন, তখন তোমরাও তাকবীর বল, যখন তিনি কিরাআত পাঠ করবেন, তখন তোমরা চুপ থাক। যখন তিনি سمع الله لمن حمده বলবেন, তখন তোমরা ربنا لك الحمد বল।" এই হাদীস ইমাম মালিক, আবূ দাউদ ও নাসাঈ (র) এবং অন্যান্যরা গ্রহণ করেছেন। সবরাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে বলেনঃ وإذا قرأ فأنصتوا অতিরিক্ত এবং এটা মাহফ্য (محفوظ) নয়। আবূ দাউদ, আবূ হাতিম, ইবনে মুঈন, হাকিম ও দারে কুতনী (র) বলেনঃ ليس محفوظة ইবনে হাম্মাম জওয়াবে বলেনঃ যদি সনদের ধারা সহীহ্ হয় এবং বর্ণনাকারী নির্ভরযোগ্য (ثقة) হন, তাহলে এই شاذ ও গ্রহণযোগ্য (مقبول) হয়ে থাকে। কিন্তু মাযহাবী সম্পর্কের কারণে আবূ দাউদ (র) আবূ খালিদ (র) সম্পর্কে সমালোচনা ও সন্দেহ করেছেন। তবে আবূ দাউদের এই সন্দেহের জওয়াবে বলা হয়েছে যে, এই আবূ খালিদ সুলায়মান ইবনে হাইয়ান হলেন ঐ ব্যক্তি, যাঁর থেকে ইমাম বুখারী ও মুসলিম দলীল গ্রহণ করেছেন এবং তাঁর দলীল গ্রহণযোগ্য। এছাড়া ইমাম মুসলিম (র) স্বীয় সহীহ্ গ্রন্থে হযরত আবূ মূসা (রা) থেকে সুলায়মান তাইমীর সূত্রে এই হাদীস বর্ণনা করেছেন। এতে এই অতিরিক্ত (زيادت) বিদ্যমান রয়েছে।
স্বয়ং ইমাম মুসলিম (র) হযরত আবূ হুরায়রা (রা) বর্ণিত এই হাদীস সহীহ বলে মতামত প্রদান করেছেন। তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হয় যে, আপনি এই হাদীসকে সহীহ বলে থাকেন কিন্তু স্বীয় গ্রন্থে কেন অন্তর্ভুক্ত করেন নি? তিনি বলেনঃ প্রত্যেকটি হাদীস যা আমি সহীহ বলে জানি এবং এর উপর ইমামদের ইজমা রয়েছে, ঐ সকল এই গ্রন্থে সন্নিবেশিত করা হয়নি। এমনিভাবে হযরত আবু দারদা (রা), হযরত ইমরান ইবনে হুসায়ন (রা) এবং হযরত আবূ হুরায়রা (রা) থেকে সহীহ্ পদ্ধতিতে এই হাদীস বর্ণিত আছে যা কিরাআতের নিষেধাজ্ঞা প্রমাণ করে। এই বিষয়ে আসারে (اثار) সাহাবাও উত্তম সনদের দ্বারা বর্ণিত আছে। যেমন হযরত ইবনে উমর (রা) থেকে বর্ণিত আছে, তিনি ইমামের পিছনে কিরাআত পাঠ করতেন না। হযরত ইবনে মাসউদ (রা) থেকে বর্ণিত আছে যে, কোন এক ব্যক্তি তাঁর নিকট ইমামের পিছনে কিরাআত পাঠ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে, তখন তিনি বলেন, চুপ থাক। ইমামের কিরাআত তোমার জন্য যথেষ্ট। ইমাম মুহাম্মদ (র) স্বীয় মুয়াত্তা নামক হাদীস গ্রন্থে হযরত উমর (রা) সম্পর্কে বলেন যে, তিনি বলেছেন, যদি ইমামের পিছনে কিরাআত পাঠকারীর মুখে পাথর হতো! হযরত সা'দ ইবনে ওয়াক্কাস (রা) সম্পর্কে বলা হয়েছে, তিনি বলেছেন, আমি এটা পছন্দ করি যে, ইমামের পিছনে কিরাআত পাঠকারীর মুখে আগুনের স্ফুলিঙ্গ জ্বলে উঠুক। মোট কথা এমনি আরো অনেক আসার রয়েছে।
এবার ইজমা ও কিয়াসের মাধ্যমে বিষয়টি আলোচনা করা যেতে পারে। উপরের বর্ণনা অনুযায়ী আশি থেকে অধিক সাহাবা (রা) থেকে কিরাআতের নিষেধাজ্ঞা সম্পর্কে হাদীস বর্ণিত আছে। এটা প্রায় ইজমা'র নিকটবর্তী হয়েছে। কিয়াসও হানাফী মাযহাবের সমর্থন করে থাকে। কেননা হাদীস الإمام ضامن -এর দৃষ্টিকোণ থেকে ইমাম কিরাআতের যিম্মাদার হয়ে যান। সুতরাং নিষেধাজ্ঞার হাদীসেও এইদিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, ইমাম হলেন কিরাআতের যিম্মাদার। তাই ইমামের পিছনে কিরাআত পাঠ করা ইমামের যিম্মাদারী ভঙ্গ করারই নামান্তর এবং শরীয়তের বিধান লঙ্ঘন করার ফলে বিষয়টি হারাম না হলেও অবশ্যই মাকরূহ তাহরীমী হবে। সুতরাং পবিত্র কুরআন, হাদীস, ইজমা ও কিয়াসের দৃষ্টিকোণ থেকে হানাফী মাযহার সঠিক বলে প্রমাণিত হলো।
উপরে হানাফী মাযহাবের আলোকে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। তাই এখানে উঁচু ও নিম্নম্বরে নামাযের মধ্যে মুক্তফ্ফানীর উপর কিরাআত ফরয বলে মতামত প্রদানকারীদের মাযহাব সম্পর্কে আলোচনা করা হলো, তাঁদের মাযহারের স্বপক্ষে তাঁরা হাদীস ও কিয়াসের দৃষ্টিকোণ থেকে দলীল পেশ করে থাকেন। ফাতিহা ফরয হওয়ার স্বপক্ষে তাঁরা হাদীস لا صلاة لمن لم يقرأ بفاتحة الكتاب পেশ করেন। কিন্তু এই হাদীসে ইমাম, মুকতাদী, মুনফারিদ (একাকী নামায আদায়কারী) উঁচুম্বর ও নিম্নস্বরের শর্ত আরোপের কথা উল্লেখ নেই। সুতরাং এরদ্বারা ফরয প্রমাণিত হয় না। অতঃপর এটা সাধারণ (عام) নয়; বরং ইকতিদার অবস্থা এর থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। যদি মেনে নেয়া হয় যে, এটা সাধারণ (عام), তা হলে কিরাআতের নিষেধাজ্ঞা দ্বারা এর সাধারণ (عموم) হওয়া ঐ সময় লংঘিত হবে যখন মুকতাদীর চুপ থাকাকে শরীয়তের দৃষ্টিকোণ থেকে জরুরী মান্য করা হবে। এছাড়া যখন অংশগ্রহণ করে ঐ রাকাআত পাওয়ার ফলে ঐ ব্যক্তিকে সর্ব সম্মতিক্রমে এই সমস্ত হাদীস থেকে বিচ্ছিন্ন (مستثنى) করা হয়েছে, তা হলে এই নিষেধাজ্ঞার হাদীসের দৃষ্টিকোণ থেকে মুকতাদীকে কেন বিচ্ছিন্ন করা হবে না? দ্বিতীয়তঃ ইমামের পিছনে কিরাআত ফরয হওয়া সম্পর্কে অপর দলীল হলো হযরত উবাদাহ (রা) বর্ণিত হাদীস, বুখারী ও মুসলিম শরীফের রিওয়ায়েত অনুযায়ী এই হাদীস (عام) সাধারণ لا صلاة لمن لم يقرأ بفاتحة الكتاب কিন্তু এর দ্বারা তাঁদের দাবি পূর্ণাঙ্গভাবে সফল হয় না। সুতরাং হানাফী মাযহাবের পক্ষ থেকে এর জওয়াব হলো এই যে, মুকতাদী প্রকৃতপক্ষে তিলাওয়াতকারী। নিজে না হলেও ইমানের যিম্মায়। ফজর নামাযের কিস্সা তিনটি পদ্ধতিতে আবূ দাউদ থেকে বর্ণিত আছে। কিন্তু এগুলোর নির্ভুল হওয়া সম্পর্কে অভিযোগ রয়েছে। প্রথমত মুহাম্মদ ইবনে ইসহাক ইবনে ইয়াসার হলো মুদাল্লিস (مدلس), মুহাদ্দিসগণের মধ্যে কারো নিকট তার রিওয়ায়েত দলীল হিসেবে গ্রহণযোগ্য নয়। দ্বিতীয়ত নাফে' ইবনে মাহমূদ, তাকে তাহযীবুত্-তাহযীব নামক গ্রন্থে অজ্ঞাত পরিচয় (مجهول) বলা হয়েছে। আল্লামা তাহাবী বলেছেনঃ لا يعرف (অপরিচিত)। তৃতীয়ত হযরত উবাদাহ (রা) থেকে মাজহুল ব্যক্তি হাদীস শ্রবণ করেননি। তাহযীবুত-তাহযীব গ্রন্থে এই হাদীস আবূ বকর রাযী (র) থেকে একইভাবে বর্ণিত আছে।
যুক্তি হিসেবে (عقلى دليل) তাঁরা এই বলে থাকেন যে, কিরাআত হলো নামাযের রুকন, যাতে ইমাম ও মুকতাদী উভয়কে অংশগ্রহণ করতে হয়। আমরা বলব এটা কুরআনের মুকাবিলায় কিয়াস, যা গ্রহণযোগ্য নয়। অতঃপর রুকনের মধ্যে অংশগ্রহণ যদি মেনে নেওয়া হয়, তাহলে এটা প্রকৃত কিরাআতের সাথে ইমামের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হয়ে থাকে এবং অপরটি إذا قرىء القرآن فاستمعوا له وأنصتوا -এর দৃষ্টিকোণ থেকে চুপ থাকা ও শ্রবণ করার সাথে মুক্তাদীর ইমামের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হয়ে থাকে। দ্বিতীয় যুক্তি হিসেবে তারা এটা বলে থাকে যে, নিম্নস্বরের নামাযে যখন মুকতাদী কোন কিরাআত শ্রবণ করবে না এবং নিজেও পড়বে না, তখন মুকতাদী কর্মহীন থাকবে, অথচ ইবাদত হলো কাজে নিবিষ্ট থাকা। আমরা বলব, শরীয়ত যখন মুকতাদীর চুপ থাকাকে কিরাআত হিসেবে মেনে নিয়েছে, তা হলে এটা কিভাবে বেকার হতে পারে? এছাড়া এটা তাদের মাযহাবেও বিদ্যমান। কেননা ফাতিহা পাঠ করার পরও নিম্নস্বরের নামাযে ইমামের অবসর না হওয়া পর্যন্ত মুকতাদীকে বেকার থাকতে হয়। না পড়তে পারে, না শুনতে পায়। এমনিভাবে তাশাহহুদে-মুকতাদীকেও তাশাহহুদ, সালাত ও দু’আ পাঠ করার পর কিছু সময় বেকার বসে থাকতে হয়। সবচেয়ে চমকপ্রদ বিষয় হলো এই যে, এই মাযহাবের সমর্থকদেরকে যদি জিজ্ঞাসা করা হয় যে, ফাতিহা কখন পড়তে হবে? তারা বলবে, সাকতার (سكته) সময়। যদি এরপর জিজ্ঞাসা করা হয় যে, শরীয়তে সাকতার প্রমাণ কোথায় আছে? এর জওয়াবে তাদের পক্ষ থেকে সম্পূর্ণ নিস্তব্ধতা বিরাজ করে। এই ধারণার মূল বিষয় হলো এই যে, ইমামের জন্য চারটি সাকতা রয়েছে। প্রথমত তাকবীরে তাহরীমার পর কিরাআত শুরু হওয়া পর্যন্ত। দ্বিতীয়ত ولا الضالين এর পর আমীন (امين) বলার পূর্বে। তৃতীয়ত আমীন (امين) বলার পর মুকতাদীকে ফাতিহা পাঠ করার সুযোগ দেওয়ার উদ্দেশ্যে। চতুর্থত কিরাআত শেষ করার পর রুকূতে যাওয়ার পূর্বে। হানাফী মাযহাবমতে শুধু প্রথম সাক্‌তা (سكته) ব্যতীত অন্য কোন সাকতা নেই। সুতরাং এতে নীতি ও যুক্তির যে জটিলতা রয়েছে, তা হলো এই যে, প্রথমত এই সাকতার মধ্যে এই পরিমাণ সময় পাওয়া অত্যন্ত কঠিন ব্যাপার। কেননা এতে ফাতিহা পাঠ করার সময় পাওয়া যায় না। এ ছাড়া এই সাকতার মধ্যে থামা ইমামের জন্য মুস্তাহাব। অর্থাৎ থামা বা না থামা ইমামের ইচ্ছা এবং না থামার ফলে ইমামের গুনাহ্ হবে না। পক্ষান্তরে ফাতিহা পাঠ করা মুকতাদীর জন্য ওয়াজিব, পাঠ না করলে গুনাহ হবে। যদি ইমাম না থামেন তা হলে মুকতাদী কোন কারণ ব্যতীত ফাতিহা পাঠ না করার ফলে গুনাহগার হবে। এর থেকে রক্ষা পাওয়ার কোন উপায় নেই।
মুসনাদে আবু হানীফা রহঃ - হাদীস নং ১০৪ | মুসলিম বাংলা