মুসনাদে ইমাম আযম আবু হানীফা রহঃ
৪. নামায অধ্যায়
হাদীস নং: ৯৭
নামায শুরু করার বর্ণনা
৯৭। হযরত সুফিয়ান ইবনে উয়াইনা (রাহঃ) বলেনঃ একবার হযরত ইমাম আবু হানীফা (রাহঃ) ও ইমাম আওযাঈ (রাহঃ) পবিত্র মক্কায় গম বিক্রির বাজারে একত্রিত হলেন। ইমাম আওযাঈ হযরত ইমাম আবু হানীফা (রাহঃ)-কে বললেন ঃ তোমাদের কি হয়েছে যে, তোমরা নামাযে রুকূতে যাওয়ার সময় এবং রুক্ থেকে উঠার সময় হাত উঠাও না? হযরত আবু হানীফা (রাহঃ) বলেনঃ এর কারণ হলো এই যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে এই বিষয়ে কোন সহীহ হাদীস পাওয়া যায়নি। ইমাম আওযাঈ (রাহঃ) বলেনঃ কেন সহীহ হাদীস থাকবে না? আমার নিকট ইমাম যুহরী বর্ণনা করেছেন, তিনি হযরত সালিম থেকে, তিনি তাঁর পিতা হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রাযিঃ) থেকে, তিনি রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) থেকে রিওয়ায়েত করেন যে, তিনি যখন নামায শুরু করতেন এবং রুকূ করতেন ও রুকূ থেকে উঠতেন তখন হাত উঠাতেন।
তখন ইমাম আবু হানীফা (রাহঃ) তাঁকে বলেনঃ আমার নিকট হযরত হাম্মাদ রিওয়ায়েত করেন, তিনি হযরত ইবরাহীম নখঈ থেকে, তিনি হযরত আলকামা ও হযরত আসওয়াদ (রাহঃ) থেকে, তাঁরা হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাযিঃ) থেকে রিওয়ায়েত করেন যে, হুযুর (ﷺ) শুধু নামায শুরু করার সময় হাত উঠাতেন। এছাড়া দ্বিতীয়বার এরূপ কিছু করতেন না। তখন ইমাম আওযাঈ (রাহঃ) বলেনঃ আমি তোমার নিকট ইমাম যুহরী থেকে হাদীস বর্ণনা করছি, তিনি হযরত সালিম থেকে, তিনি তাঁর পিতা হযরত আব্দুল্লাহ্ (রাযিঃ) থেকে (অর্থাৎ উর্ধ্বতন ব্যক্তিগণের হাদীস অধিক গ্রহণযোগ্য) এবং তোমরা বলছ, আমার নিকট ইমাম হাম্মাদ হাদীস বর্ণনা করেছেন, তিনি ইবরাহীম থেকে, (অর্থাৎ তাঁরা পূর্বোক্তদের মত সৌভাগ্য লাভ করেননি)। তখন হযরত ইমাম আবু হানীফা (রাহঃ) এর (তাদের ধারণার) বিরোধিতা করে বলেন যে, হাদীসের প্রাধান্য বর্ণনাকারীর ইলমে ফিকহর দ্বারা হয়ে থাকে, উর্ধ্বতন হওয়া বা মর্যাদার দ্বারা নয়। হাম্মাদ (রাহঃ) যুহরী (রাহঃ) থেকে ইলমে ফিকহ সম্পর্কে অধিক জ্ঞানী, ইবরাহীম নখঈ (রাহঃ) হযরত সালিম থেকে ফিকহ সম্পর্কে অধিক জ্ঞানী এবং হযরত আলকামা (রাযিঃ) হযরত ইবনে উমর (রাযিঃ) থেকে ইলমে ফিকহ সম্পর্কে কম জ্ঞানী ছিলেন না [আদবের কারণে অধিক জ্ঞানী বলেন নি। যদি হযরত ইবনে উমর (রাযিঃ) রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সোহবত হাসিলের সৌভাগ্য লাভ করে থাকেন, তবে হযরত আলকামা (রাযিঃ) অন্য ফযীলত লাভে ধন্য হয়েছেন। অতঃপর হযরত আব্দুল্লাহ (রাযিঃ) (মর্যাদার দিক দিয়ে) হযরত আব্দুল্লাহই ছিলেন। তখন ইমাম আওযাঈ (রাহঃ) চুপ হয়ে গেলেন।
তখন ইমাম আবু হানীফা (রাহঃ) তাঁকে বলেনঃ আমার নিকট হযরত হাম্মাদ রিওয়ায়েত করেন, তিনি হযরত ইবরাহীম নখঈ থেকে, তিনি হযরত আলকামা ও হযরত আসওয়াদ (রাহঃ) থেকে, তাঁরা হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাযিঃ) থেকে রিওয়ায়েত করেন যে, হুযুর (ﷺ) শুধু নামায শুরু করার সময় হাত উঠাতেন। এছাড়া দ্বিতীয়বার এরূপ কিছু করতেন না। তখন ইমাম আওযাঈ (রাহঃ) বলেনঃ আমি তোমার নিকট ইমাম যুহরী থেকে হাদীস বর্ণনা করছি, তিনি হযরত সালিম থেকে, তিনি তাঁর পিতা হযরত আব্দুল্লাহ্ (রাযিঃ) থেকে (অর্থাৎ উর্ধ্বতন ব্যক্তিগণের হাদীস অধিক গ্রহণযোগ্য) এবং তোমরা বলছ, আমার নিকট ইমাম হাম্মাদ হাদীস বর্ণনা করেছেন, তিনি ইবরাহীম থেকে, (অর্থাৎ তাঁরা পূর্বোক্তদের মত সৌভাগ্য লাভ করেননি)। তখন হযরত ইমাম আবু হানীফা (রাহঃ) এর (তাদের ধারণার) বিরোধিতা করে বলেন যে, হাদীসের প্রাধান্য বর্ণনাকারীর ইলমে ফিকহর দ্বারা হয়ে থাকে, উর্ধ্বতন হওয়া বা মর্যাদার দ্বারা নয়। হাম্মাদ (রাহঃ) যুহরী (রাহঃ) থেকে ইলমে ফিকহ সম্পর্কে অধিক জ্ঞানী, ইবরাহীম নখঈ (রাহঃ) হযরত সালিম থেকে ফিকহ সম্পর্কে অধিক জ্ঞানী এবং হযরত আলকামা (রাযিঃ) হযরত ইবনে উমর (রাযিঃ) থেকে ইলমে ফিকহ সম্পর্কে কম জ্ঞানী ছিলেন না [আদবের কারণে অধিক জ্ঞানী বলেন নি। যদি হযরত ইবনে উমর (রাযিঃ) রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সোহবত হাসিলের সৌভাগ্য লাভ করে থাকেন, তবে হযরত আলকামা (রাযিঃ) অন্য ফযীলত লাভে ধন্য হয়েছেন। অতঃপর হযরত আব্দুল্লাহ (রাযিঃ) (মর্যাদার দিক দিয়ে) হযরত আব্দুল্লাহই ছিলেন। তখন ইমাম আওযাঈ (রাহঃ) চুপ হয়ে গেলেন।
قَالَ: اجْتَمَعَ أَبُو حَنِيفَةَ وَالْأَوْزَاعِيُّ فِي دَارِ الْحَنَّاطِينَ بِمَكَّةَ، فَقَالَ الْأَوْزَاعِيُّ لِأَبِي حَنِيفَةَ: مَا بَالُكُمْ لَا تَرْفَعُونَ أَيْدِيَكُمْ فِي الصَّلَاةِ عِنْدَ الرُّكُوعِ وَعِنْدَ الرَّفْعِ مِنْهُ؟ فَقَالَ أَبُو حَنِيفَةَ: لِأَجْلِ أَنَّهُ لَمْ يَصِحَّ عَنْ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِيهِ شَيْءٌ، قَالَ: كَيْفَ لَا يَصِحُّ، وَقَدْ حَدَّثَنِي الزُّهْرِيُّ، عَنْ سَالِمٍ، عَنْ أَبِيهِ، عَنْ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «أَنَّهُ كَانَ يَرْفَعُ يَدَيْهِ إِذَا افْتَتَحَ الصَّلَاةَ، وَعِنْدَ الرُّكُوعِ، وَعِنْدَ الرَّفْعِ مِنْهُ»
فَقَالَ لَهُ أَبُو حَنِيفَةَ: حَدَّثَنَا حَمَّادٌ، عَنْ إِبْرَاهِيمَ، عَنْ عَلْقَمَةَ وَالْأَسْوَدِ، عَنِ ابْنِ مَسْعُودٍ: «أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَانَ لَا يَرْفَعُ يَدَيْهِ إِلَّا عِنْدَ افْتِتَاحِ الصَّلَاةِ، وَلَا يَعُودُ شَيْءٌ مِنْ ذَلِكَ» ، فَقَالَ الْأَوْزَاعِيُّ: أُحَدِّثُكَ عَنِ الزُّهْرِيِّ، عَنْ سَالِمٍ، عَنْ أَبِيهِ، وَتَقُولُ: حَدَّثَنِي حَمَّادٌ، عَنْ إِبْرَاهِيمَ! فَقَالَ لَهُ أَبُو حَنِيفَةَ: كَانَ حَمَّادٌ أَفْقَهَ مِنَ الزُّهْرِيِّ، وَكَانَ إِبْرَاهِيمُ أَفْقَهُ مِنْ سَالِمٍ، وَعَلْقَمَةُ لَيْسَ بِدُونِ ابْنِ عُمَرَ فِي الْفِقْهِ، وَإِنْ كَانَتْ لِابْنِ عُمَرَ صُحْبَةٌ، أَوْ لَهُ فَضْلُ صُحْبَةٍ، فَالْأَسْوَدُ لَهُ فَضْلٌ كَثِيرٌ، وَعَبْدُ اللَّهِ هُوَ عَبْدُ اللَّهِ، فَسَكَتَ الْأَوْزَاعِيُّ
فَقَالَ لَهُ أَبُو حَنِيفَةَ: حَدَّثَنَا حَمَّادٌ، عَنْ إِبْرَاهِيمَ، عَنْ عَلْقَمَةَ وَالْأَسْوَدِ، عَنِ ابْنِ مَسْعُودٍ: «أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَانَ لَا يَرْفَعُ يَدَيْهِ إِلَّا عِنْدَ افْتِتَاحِ الصَّلَاةِ، وَلَا يَعُودُ شَيْءٌ مِنْ ذَلِكَ» ، فَقَالَ الْأَوْزَاعِيُّ: أُحَدِّثُكَ عَنِ الزُّهْرِيِّ، عَنْ سَالِمٍ، عَنْ أَبِيهِ، وَتَقُولُ: حَدَّثَنِي حَمَّادٌ، عَنْ إِبْرَاهِيمَ! فَقَالَ لَهُ أَبُو حَنِيفَةَ: كَانَ حَمَّادٌ أَفْقَهَ مِنَ الزُّهْرِيِّ، وَكَانَ إِبْرَاهِيمُ أَفْقَهُ مِنْ سَالِمٍ، وَعَلْقَمَةُ لَيْسَ بِدُونِ ابْنِ عُمَرَ فِي الْفِقْهِ، وَإِنْ كَانَتْ لِابْنِ عُمَرَ صُحْبَةٌ، أَوْ لَهُ فَضْلُ صُحْبَةٍ، فَالْأَسْوَدُ لَهُ فَضْلٌ كَثِيرٌ، وَعَبْدُ اللَّهِ هُوَ عَبْدُ اللَّهِ، فَسَكَتَ الْأَوْزَاعِيُّ
হাদীসের ব্যাখ্যা:
ইমাম আওযাঈ (র) এবং ইমাম আবু হানীফা (র)-এর এই বিতর্ক কয়েকটি বিষয়ের আলোচনাকে উন্মুক্ত করে দিয়েছে। এক দিক দিয়ে এটা খুবই উপকারী ও ফলদায়ক। এর দ্বারা ইমাম আবূ হানীফা (র)-এর জ্ঞানের গভীরতা ও উন্নত মেধাশক্তির পরিচয় পাওয়া যায়, যার আলোকে তিনি নবী করীম (সা)-এর হাদীসসমূহ পরীক্ষা-নীরিক্ষা করে এগুলো থেকে মাসয়ালাসমূহ বের করতেন। ফলে কোন প্রকার দুর্বল বর্ণনা তাঁর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি থেকে বাদ পড়েনি। সুতরাং এই বিতর্ক যদি একদিকে ইমাম সাহেবের এই গুণাবলীকে প্রকাশ করে, তা হলে অন্য দিকে ঐ সমস্ত মিথ্যা বর্ণনাকারীর দাঁতভাঙ্গা জওয়াব হয়েছে যারা তাঁকে ব্যক্তিগত মত পোষণকারী বা যুক্তিবাদী বলে আখ্যায়িত করে বলে যে, তাঁর মাযহাব যুক্তি ও কিয়াসের উপর নির্ভরশীল। বলা বাহুল্য, তিনি কি ইমাম আওযাঈ (র)-এর বিরুদ্ধে স্বীয় মত ব্যক্ত করেছেন, না হুযূর (সা)-এর হাদীস পেশ করেছেন? অতঃপর ঐ হাদীস সনদের দিক দিয়ে আওয়াঈ (র)-এর বর্ণিত হাদীসের মুকাবিলায় অধিক শক্তিশালী ও গ্রহণযোগ্য ছিল, না দুর্বল? এই বিতর্ক বর্ণনাকারীদের মর্যাদা ইলমে ফিকহের জ্ঞানের উপর নির্ভর করে উঁচুমানের সনদ বা ন্যায়-নিষ্ঠার উপর করে না। এই বিতর্কের মাধ্যমে এটাও প্রতীয়মান হয় যে, ইলমে ফিকহের জ্ঞান ও অন্যান্য জ্ঞানের গভীরতা সোহবত (সঙ্গ) লাভের ফযীলত থেকে উত্তম। তবে শর্ত হলো এই যে, উভয়ের নবী করীম (সা)-এর সোহবত সৌভাগ্য হতে হবে। তাই তিনি বলেছেন, হযরত আলকামা (রা) হযরত ইবনে উমর (রা) থেকে কোন অংশে কম নন। মোট কথা এর দ্বারা ইমাম আযম (র)-এর আদব ও হাদীসের জ্ঞানের শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশ পেয়েছে।
নামাযে رفع يدين বা হাত উঠানো সম্পর্কে আইম্মায়ে কিরামের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। ইমাম শাফিঈ (র) ও আহমদ (র)-এর মতে নামায আরম্ভের সময় ছাড়াও রুকূতে যাওয়ার সময় এবং রুকূ থেকে উঠার সময় হাত উঠানো সুন্নত। ইমাম আবূ হানীফা (র)-এর মতে নামায আরম্ভ করার সময় ব্যতীত অন্য কোথাও হাত উঠানোর প্রয়োজন নেই। ইমাম মালিক (র) থেকে দু'টি রিওয়ায়েত বর্ণিত আছে। একটিতে ইমাম শাফিঈ (র) এবং অপরটিতে ইমাম আবূ হানীফা (র)-এর মতের সাথে একাত্মতা রয়েছে। কিন্তু তাঁর অধিকাংশ অনুসারী প্রথম রিওয়ায়েতের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে তা অনুসরণ করে থাকেন।
ইমাম শাফিঈ (র) ও তাঁর অনুসারীগণ তাঁদের মাযহাবের স্বপক্ষে আশারায়ে মুবাশশারাসহ অনেক সাহাবায়ে কিরামের (রা) বর্ণিত হাদীস পেশ করেছেন। বিষয়বস্তুর দৃষ্টিকোণ থেকে তাঁদের হাদীস দু'প্রকার। প্রথমতঃ রুকূতে যাওয়ার সময় এবং রুকূ থেকে উঠার সময় অথবা তাকবীরের সময় অথবা প্রতিবার ঝুকার সময় এবং উঠার সময়। মোট কথা বাকী হাদীসের মধ্যে দুর্বোধ্যতা রয়েছে যার দ্বারা সহীহ আমলের দিক-নির্দেশনা পাওয়া যায় না; বরং এত বিরোধী মতামতের মিশ্রণ রয়েছে যা শাফিঈ মাযহাবের অনুসারিগণও মানেনি এবং হানাফী মাযহাবের অনুসারিগণও গ্রহণ করেনি।
সুতরাং তাদের সহীহ হাদীস ঐগুলো, যাতে রুকূ ছাড়া অন্য স্থানে হাত উঠানো থেকে অস্বীকার করা হয়েছে। অতঃপর এটাও উল্লেখযোগ্য যে, সাহাবাদের মধ্যে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) থেকে যে হাদীস বর্ণিত আছে এবং তা শাফিঈ বা হানাফী যে কেউ গ্রহণ করুক না কেন, এর দ্বারা হাত না উঠানোর প্রমাণ বহন করে। এ ছাড়া অনেক সাহাবা (রা) থেকে হাত উঠানো সম্পর্কে এবং হানাফী মাযহাব হাত না উঠানো সম্পর্কে হাদীস রিওয়ায়েত করে থাকে। এবং বলে থাকে আশারায়ে মুবাশশারা অথবা খলীফাগণ আমাদের সাথে আছেন। অথবা কেউ এমনি ত্রুটিপূর্ণ কথাও বলে থাকে যে, সমস্ত সাহাবায়ে কিরাম আমাদের সাথে রয়েছেন, এরূপ বলা সম্পূর্ণ নির্বুদ্ধিতার পরিচায়ক । পরবর্তী বর্ণনার দ্বারা এটা অনুমান করা যাবে যে, আহলে হাদীস দাবিকারিগণ হাত উঠানোর ব্যাপারে যেরূপ কঠোরতা অবলম্বন করে থাকেন, তা কতটুকু জায়েয। বুখারী শরীফে হযরত ইবনে উমর (রা) থেকে এ সম্পর্কে বর্ণিত আছে যে, হযরত (সা) নামাযের জন্য দাঁড়ানোর পর হাত উঠাতেন এবং তা কাঁধ রবাবর এসে যেত এবং রুকুর জন্য তাকবীর বলার সময় ও রুকূ থেকে উঠার সময়ও এরূপ করতেন কিন্তু সিজদার সময় এরূপ করতেন না। মুসলিম শরীফেও একই বিষয়ে হাদীস বর্ণিত রয়েছে। অথবা সাহাবী হযরত আলী (রা) থেকে বর্ণিত হাদীসের শেষ অংশে বর্ণিত আছে যে, যখন হুযূর (সা) সিজদা থেকে উঠতেন তখন এভাবে হাত উঠাতেন। হাত উঠানোর পক্ষ সমর্থনকারী দল এই হাদীসও দলীল হিসেবে পেশ করে থাকে।
এবার হানাফী মাযহাবের দলীল একটু বিস্তারীতভাবে পেশ করা হবে। কেননা এটা বলা হয়ে থাকে যে, এই বিষয়ে হানাফীদের নিকট কোন সহীহ হাদীস নেই।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) বর্ণিত হাদীসের শেষ অংশে রয়েছে। অর্থাৎ হুযুর (সা) নামায শুরু করার সময় হাত উঠাতেন কিন্তু দ্বিতীয়বার আর কখনো তিনি এরূপ করতেন না। ইমাম তাহাবী, হুসাইন ও ইবরাহীম নখঈ (র)-এর সূত্রে বর্ণনা করেন যে, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) নামায শুরু করার সময় ব্যতীত অন্য সময় হাত উঠাতেন না। ইমাম মুহাম্মদ (র) স্বীয় হাদীস গ্রন্থ মুয়াত্তায় একই অর্থবোধক বাক্য দ্বারা হাদীস বর্ণনা করেছেন। ইমাম আবূ দাউদ (র) স্বীয় হাদীস গ্রন্থ আবূ দাউদ শরীফে আসিম ইবনে কুলাইব (র) থেকে, তিনি আবদুর রহমান ইবনে আসওয়াদ (র) থেকে, তিনি আলকামা (র) থেকে এবং তিনি হযরত ইবনে মাসউদ (রা) থেকে বর্ণনা করেন: ألا أصلي لكم صلاة رسول الله صلى الله عليه وسلم قال فصلى فلم يرفع يديه إلا مرة "তিনি বলেছেন, আমি কি তোমাদেরকে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নামায কিরূপ ছিল, তা দেখাব? বর্ণনাকারী বলেনঃ অতঃপর আবদুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ (রা) নামায পড়েন এবং শুধু একবার হাত উত্তোলন করেন।" অন্য এক রিওয়ায়েতে আছে, “তিনি শুধু নামায শুরু করার সময় হাত উত্তেলন করেন।” কিন্তু বিরোধী পক্ষ উক্ত হাদীস বর্ণনাকারী আসিম ইবনে কুলাইব সম্পর্কে সমালোচনা করেছেন। কেউ বলেছেন, এই হাদীসের কোন প্রমাণ নেই। কেউ বলেছেন, এই হাদীস সনদের দিক দিয়ে দুর্বল (ضعيف) আবার কেউ বলেছেন, এই হাদীস সহীহ নয়। পক্ষান্তরে ইবনে হাজম, দারে কুতনী ও ইবনে কাতান (র) এই হাদীসকে সহীহ বলেছেন। ইমাম নাসাঈ (র) হাত না উঠানোর ব্যাপারে একটি পৃথক অধ্যায় রচনা করেছেন। ইমাম মুসলিম (র) তাঁর থেকে হাদীস বর্ণনা করেন। ইমাম বুখারী ও মুসলিম (র) আসিমকে নির্ভরযোগ্য (ثقة) বলে উল্লেখ করেছেন। যদি আবদুর রহমান (র)-এর মধ্যে কিছু সন্দেহ থাকে কিন্তু ইমাম মুসলিম (র) তাঁর নিকট থেকেও হাদীস বর্ণনা করেছেন। সুতরাং এ হাদীসের মধ্যে কি দুর্বলতা থাকতে পারে?
এই আসিম (র)-এর সূত্রে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) থেকে ইমাম তিরমিযী (র) ও হাদীস বর্ণনা করেছেন এবং বলেছেন এই হাদীস হাসান (حسن)। অনেক সাহাবায়ে কিরাম এবং তাবেঈন এই মত সমর্থন করেছেন। ইমাম সুফিয়ান সওরী (র) এবং কুফাবাসীদের মাযহাবও এটাই। সুতরাং আহলে হাদীস উলামায়ে কিরাম যখন এই হাদীসের বর্ণনাকারীদের মেনে নিয়ে এই হাদীসকে হাসান (حسن) বলেছেন, তাহলে অন্য দল এটাকে কিভাবে দুর্বল বলে থাকে! কেউ কেউ এই অভিযোগ করেছেন যে, আবদুর রহমান (র) হযরত আলকামা (র) থেকে হাদীস শ্রবণ করেননি। ৭৯ হিজরীতে যখন আবদুর রহমান (র) ইনতিকাল করেন তখন ইবরাহীম নখঈ জীবিত ছিলেন এবং সর্ব সম্মতিক্রমে তিনি হযরত আলকামা (র) থেকে হাদীস শ্রবণ করেছেন। অধিকন্তু খতীব বোগদাদী "কিতাবুল মুত্তাফিক ওয়াল মুতাফাররিক" নামক গ্রন্থে আবদুর রহমান (র) সম্পর্কে লিখেছেন যে, তিনি তাঁর পিতা থেকে এবং হযরত আলকামা (র) থেকে হাদীস শ্রবণ করেছেন। সুতরাং এরপর কোন দিক থেকেই এ হাদীসের উপর কোন প্রকার অভিযোগ বাকী থাকে না।
এবার খলীফার মধ্যে হযরত আবূ বকর (রা) ও হযরত উমর (রা)-এর মতামত ও মাযহাব কি ছিল, তা আলোচনা করা প্রয়োজন। দারে কুতনী এবং ইবনে আদী (র) মুহাম্মদ ইবনে জাবির থেকে, তিনি হাম্মাদ ইবনে আবি সুলায়মান থেকে, তিনি ইবরাহীম থেকে, তিনি হযরত আলকামা থেকে, তিনি হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ইবনে মাসউদ (রা) থেকে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেনঃ صليت مع رسول الله صلى الله عليه وسلم وأبو بكر وعمر فلم يرفعوا أيديهم إلا عند افتتاح الصلاة "আমি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সাথে এবং হযরত আবূ বকর (রা) ও হযরত উমর (রা)-এর সাথে নামায পড়েছি। তাঁদের মধ্যে কেউ নামায শুরু করার সময় ব্যতীত হাত উত্তোলন করেননি। এই রিওয়ায়েতের পর বিরোধী পক্ষ মুহাম্মদ ইবনে জাবির ইবনে ইয়াসারের রিওয়ায়েত উল্লেখ করে বলেনঃ মুহাম্মদ ইবনে জাবির (র) সম্পর্কে অভিযোগ রয়েছে। অথচ মুহাম্মদ ইবনে জাবির থেকে আইউব ইবনে আউফ, হিশাম ইবনে হাসান, ইমাম সুফিয়ান সওরী, ইমাম ওবা ও ইবনে উয়াইনার মত সম্মানিত ব্যক্তিবর্গ হাদীস রিওয়ায়েত করেছেন, তিনি কি কোন ইলম-এর অধিকারী ছিলেন না? এর মর্যাদা কিভাবে খাটো করে দেখা যায়?
পক্ষান্তরে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) একজন সম্মানিত সাহাবী ছিলেন। সাথে সাথে তিনি হাদীসের সত্যতা বর্ণনা করতে গিয়ে হুযূর (সা)-এর সাথে হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রা)-এর সত্যবাদিতা এবং হযরত উমর ফারুক (রা)-এর জ্ঞানকে একত্রিত করেছেন। বরং এটা হুযূর (সা)-এর আদর্শ পূর্ণাঙ্গভাবে অনুসরণকারী হযরত আবূ বকর (রা) এবং উমর (রা)-এর হাদীস হিসেবেই গণ্য। মোট কথা এই হাদীস হানাফী মাযহাবের একটি শক্তিশালী দলীল হযরত আলী (রা)-এর মাযহাব সম্পর্কে ইমাম তাহাবী ও ইমাম মুহাম্মদ (র) আবূ বকর নাহশালী (র) থেকে, তিনি আসিম (র) থেকে, তিনি তাঁর পিতা থেকে রিওয়ায়েত করেন যে, ان عليا كان يرفع في اول تكبيرة من الصلاة ثم لا يعود "হযরত আলী (রা) নামাযে প্রথম তাকবীরের সময় হাত উঠাতেন কিন্তু অতঃপর আর কখনো এরূপ করতেন না।"
দারে কুতনী নাহশালী (র) থেকে এই হাদীস রিওয়ায়েত করেছেন এবং বলেছেন, এই হাদীস মরফু" নয়, তবে মওকুফ সহীহ। মুহাম্মদ ইবনে আবানও আসিম (র) থেকে এ ধরনের হাদীস রিওয়ায়েত করেছেন। কিন্তু দারেমী এর উপর অভিযোগ উত্থাপন করেছেন। তিনি বলেছেন, হযরত আলী (রা) থেকে যে রিওয়ায়েতের উদ্ধৃতি দেয়া হয়েছে তা হলো, তিনি প্রথম তাকবীরে হাত উঠাতেন অতঃপর এরূপ করতেন না- এটা সম্পূর্ণ দূর্বল (ضعيف)। কেননা হযরত আলী (রা) সম্পর্কে এটা কিভাবে ধারণা করা যায় যে, তিনি হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আমলের বিরোধিতা করবেন অথচ হযরত সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি রুকূতে যাওয়ার সময় এবং রুকূ থেকে উঠার সময় হাত উঠাতেন। তাঁদের বক্তব্য হলো এই যে, হযরত আলী (রা)-এর এই আমল হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পরের এবং তা হাত উঠানো (رفع يدين) রহিত হওয়াকে প্রমাণ করে থাকে। কিন্তু বিরোধী পক্ষ তাঁদের মতামতের বিপক্ষে অন্য কোন মত বা যুক্তি মানতে রাজী নয়। ইবনে দাকীকুল ঈদ (র) একই বাক্যের দ্বারা দারিমীর সমালোচনা করেছেন।
আবু দাউদ, ইবনে মাজাহ এবং তিরমিয়ী হযরত আলী (রা) থেকে হাত উঠানোর (رفع يدين) স্বপক্ষে এক মরফূ' রিওয়ায়েত বর্ণনা করেছেন। কিন্তু এটা গ্রহণযোগ্য নয়। কেননা প্রথমতঃ আবূ দাউদের রিওয়ায়েতের আবদুর রহমান ইবনে যিনাদ (র)-কে '*তাকরীব' নামক গ্রন্থে সত্যবাদী বলা হয়েছে কিন্তু যখন বাগদাদ আগমণ করেন তখন তাঁর হিফয শক্তির মধ্যে ত্রুটি পরিলক্ষিত হয়। এ ছাড়া বর্ণিত হাদীসে اذا قام من السجدتين رفع يديه كذلك (যখন দু'সিজদা থেকে দাঁড়াতেন তখন দু'হাত উঠাতেন) খটকা রয়েছে যা সবার মতে রহিত অথবা যার কোন প্রমাণ নেই। এরপর আবূ দাউদের হাদীস মরফূ' যা হুযূর (সা)-এর আমলকে প্রকাশ করে থাকে। সুতরাং এটা সহজেই বুঝা যায় যে, তিনি প্রথমতঃ হযরত সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদীস বর্ণনা করেছেন। এরপর হাত উঠানো (رفع يدين) রহিত হয়ে যায়, তখন তিনি এর উপর আমল করতে থাকেন। এ সম্পর্কে ইতিপূর্বে ইমাম মুহাম্মদ থেকে সহীহ হাদীস বর্ণনা করা হয়েছে।
ইমাম তাহাবী এবং বায়হাকী হাসান ইবনে আব্বাস (র)-এর সূত্রে সহীহ্ সনদের সাথে আসওয়াদ থেকে বর্ণনা করেঃ قال رأيت عمر بن الخطاب رأيت إبراهيم والشعبة رفع يديه في أول تكبيرة ثم لا يعود قال يفعلان ذلك "হযরত আসওয়াদ (র) বলেছেন, আমি হযরত উমর (রা)-কে দেখেছি যে, তিনি নামাযে প্রথম তাকবীরের সময় হাত উঠাতেন। এরপর আর এরূপ করেন নি। তিনি বলেছেন, আমি ইবরাহীম নখঈ ও হযরত শাখী (র)-কে এরূপ করতে দেখেছি।” ইমাম তাহাবী (র) বলেনঃ এই হাদীসের বর্ণনাকারী হাসান ইবনে আব্বাস (র) নির্ভরযোগ্য। ইয়াহইয়া ইবনে মুঈন (র) ও অন্যান্যরা তাঁকে নির্ভরযোগ্য বলেছেন। এটা তাঁরা এজনা বলেছেন যে, তাঁরা জানেন যে, সমস্ত সনদের মধ্যে এই এক ব্যক্তিকে নিয়ে সমালোচনা হতে পারে। তাই তাঁরা পূর্বেই তাঁর নির্ভরযোগ্যতা সম্পর্কে দলীল পেশ করেছেন। ইমাম হাকিম (র) তাউস (র)-এর সূত্রে হযরত ইবনে উমর (রা) থেকে এর বিরোধী এক হাদীস বর্ণনা করেছেন। আমরা বলব, যখন এই হাদীস সনদের দিক দিয়ে সহীহ, তখন উপরে বর্ণিত হাদীসের সাথে এর বিরোধিতা হবে কিন্তু উভয়েই আহাদ এবং এর দ্বারা হযরত ইবনে মাসউদ (রা)-এর হাদীসকে আরো শক্তিশালী করে। পক্ষান্তরে হযরত ইবনে উমর (রা)-এর উপর হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা)-এর যে ফযীলত ও সম্মান রয়েছে, এ সম্পর্কে আইম্মায়ে কিরাম অবগত আছেন।
হাত উঠানোর পক্ষ সমর্থনকারীগণ এই বিষয়ের উপর গর্ব করে থাকে যে, হযরত ইবনে আব্বাস ও হযরত ইবনে উমর (রা)-এর মাযহাবের সাথে আমাদের মাযহাবের ঐকমত্য রয়েছে। সুতরাং এখানে ঐ হাদীসও বর্ণনা করা হলো যা হাত উঠানো সম্পর্কে বর্ণিত আছে। বুখারী শরীফে কিতাবুল মুফরাদে ওয়াকী' ইবনে আবী লায়লা (র) হাকাম (র)-এর সূত্রে ইবনে আব্বাস (রা) থেকে হাদীস বর্ণনা করেন যে, হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, শুধু সাত জায়গায় হাত উঠানো প্রয়োজন। নামাযের প্রারম্ভে, কিবলা দর্শনের সময়, সাফা-মারওয়া ও আরাফাতে একত্রিত হওয়ার সময়, মিনায় এবং দু’জামরায়। হযরত নাফে'(র)-এর সূত্রে বাযযায নামক গ্রন্থে হযরত ইবনে উমর (রা) থেকে একই হাদীস বর্ণনা করা হয়েছে। এই হাদীসে কোথাও রুকুর সময় হাত উঠানোর উল্লেখ নেই। কিন্তু বিরোধী পক্ষ এই হাদীসের রিওয়ায়েতের মধ্যে অভিযোগ উত্থাপন করে বলে যে, হাদীসের বর্ণনাকারী ইবনে আবী লায়লা (র) দলীল হিসেবে গ্রহণযোগ্য নন। অথচ তিনি এরূপ প্রখ্যাত তাবেঈ, যিনি একশ' বিশজন সাহাবার সাক্ষাত লাভ করেছেন। যদি তাঁর বর্ণিত মরফূ' হাদীস গ্রহণ করা না হয়, তাহলে কার হাদীস গ্রহণ করা হবে? দ্বিতীয়তঃ এটা বলা হয়েছে ওয়াকী' (র)-এর সূত্রে বর্ণিত হাদীস মওকুফ, সহীহ মরফূ' নয়; তাই এটা প্রতীয়মান হয় যে, ইমাম আবূ হানীফা (র)-এর মাযহাব সঠিক।
অধিকন্তু হানাফী মাযহাবের স্বপক্ষে হযরত বারা' ইবনে আযিব (রা), হযরত জাবির ইবনে সামুরা (রা) এবং হযরত আবূ সাঈদ খুদরী (রা) থেকে বর্ণিত সহীহ হাদীস বিদ্যমান রয়েছে। খবর দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, হানাফী মাযহাব এই মাসয়ালায় সহীহ্ হাদীসের উপর প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু এতদসত্ত্বেও বিরোধী পক্ষ প্রচার করে থাকে যে, হানাফী মাযহাবের স্বপক্ষে কোন সহীহ হাদীস নেই; তারা কিয়াসের উপর নির্ভরশীল। আমরা আহলে হাদীস। এখানে হানাফী মাযহাবের পক্ষ থেকে ন্যায়ভিত্তিক ফয়সালা হলো এই যে, হাত উঠানো ও না উঠানো উভয়ই সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত এবং উভয় হাদীসের মধ্যে বিরোধ রয়েছে। সুতরাং উভয় হাদীসের মধ্যে সমন্বয় সাধন করা একান্ত জরুরী। তাই এইভাবে সমন্বয় করা যায় যে, হাত উঠানো না উঠানো হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিভিন্ন সময়ের দু'প্রকারের দু'টি আমল। অতঃপর হাত উঠানোর নির্দেশ রহিত হয়ে যায় এবং হাত না উঠানোর বিষয়টি বাকী থাকে।
পক্ষান্তরে কোন কোন সাহাবা (রা), যেমন হযরত ইবনে উমর (রা) সহ যাঁরা হাত উঠানো সম্পর্কিত হাদীস বর্ণনা করেছেন, তাঁরা নিজেরাই হাত উঠানো পরিত্যাগ করেছেন। তাঁদের স্থাদীস বর্ণনা করার পর নিজেই এর বিপরীত আমল করেন, তখন এর দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, এই হাদীস রহিত হওয়া সম্পর্কে তিনি প্রমাণ পেয়েছেন। নতুবা হযরত ইবনে উমর (রা) এবং হযরত আলী (রা) সম্পর্কে এটা কিভাবে বলা যায় যে, তাঁরা উভয়ে হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীস বিরোধী আমল করেছেন। অন্যদিকে এই নীতি রয়েছে যে, যখন সহীহ হাদীস পরস্পর বিরোধী হয়, তখন কিয়াসের মাধ্যমে একটি হাদীসকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। কিয়াসও এটাই বলে যে, হাত না উঠানো হোক। কেননা হাত উঠানোর মাধ্যমে নামাযে একাগ্রতা, ভয় ও বিনয়ের মধ্যে ব্যাঘাত সৃষ্টি হয়।
নামাযে رفع يدين বা হাত উঠানো সম্পর্কে আইম্মায়ে কিরামের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। ইমাম শাফিঈ (র) ও আহমদ (র)-এর মতে নামায আরম্ভের সময় ছাড়াও রুকূতে যাওয়ার সময় এবং রুকূ থেকে উঠার সময় হাত উঠানো সুন্নত। ইমাম আবূ হানীফা (র)-এর মতে নামায আরম্ভ করার সময় ব্যতীত অন্য কোথাও হাত উঠানোর প্রয়োজন নেই। ইমাম মালিক (র) থেকে দু'টি রিওয়ায়েত বর্ণিত আছে। একটিতে ইমাম শাফিঈ (র) এবং অপরটিতে ইমাম আবূ হানীফা (র)-এর মতের সাথে একাত্মতা রয়েছে। কিন্তু তাঁর অধিকাংশ অনুসারী প্রথম রিওয়ায়েতের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে তা অনুসরণ করে থাকেন।
ইমাম শাফিঈ (র) ও তাঁর অনুসারীগণ তাঁদের মাযহাবের স্বপক্ষে আশারায়ে মুবাশশারাসহ অনেক সাহাবায়ে কিরামের (রা) বর্ণিত হাদীস পেশ করেছেন। বিষয়বস্তুর দৃষ্টিকোণ থেকে তাঁদের হাদীস দু'প্রকার। প্রথমতঃ রুকূতে যাওয়ার সময় এবং রুকূ থেকে উঠার সময় অথবা তাকবীরের সময় অথবা প্রতিবার ঝুকার সময় এবং উঠার সময়। মোট কথা বাকী হাদীসের মধ্যে দুর্বোধ্যতা রয়েছে যার দ্বারা সহীহ আমলের দিক-নির্দেশনা পাওয়া যায় না; বরং এত বিরোধী মতামতের মিশ্রণ রয়েছে যা শাফিঈ মাযহাবের অনুসারিগণও মানেনি এবং হানাফী মাযহাবের অনুসারিগণও গ্রহণ করেনি।
সুতরাং তাদের সহীহ হাদীস ঐগুলো, যাতে রুকূ ছাড়া অন্য স্থানে হাত উঠানো থেকে অস্বীকার করা হয়েছে। অতঃপর এটাও উল্লেখযোগ্য যে, সাহাবাদের মধ্যে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) থেকে যে হাদীস বর্ণিত আছে এবং তা শাফিঈ বা হানাফী যে কেউ গ্রহণ করুক না কেন, এর দ্বারা হাত না উঠানোর প্রমাণ বহন করে। এ ছাড়া অনেক সাহাবা (রা) থেকে হাত উঠানো সম্পর্কে এবং হানাফী মাযহাব হাত না উঠানো সম্পর্কে হাদীস রিওয়ায়েত করে থাকে। এবং বলে থাকে আশারায়ে মুবাশশারা অথবা খলীফাগণ আমাদের সাথে আছেন। অথবা কেউ এমনি ত্রুটিপূর্ণ কথাও বলে থাকে যে, সমস্ত সাহাবায়ে কিরাম আমাদের সাথে রয়েছেন, এরূপ বলা সম্পূর্ণ নির্বুদ্ধিতার পরিচায়ক । পরবর্তী বর্ণনার দ্বারা এটা অনুমান করা যাবে যে, আহলে হাদীস দাবিকারিগণ হাত উঠানোর ব্যাপারে যেরূপ কঠোরতা অবলম্বন করে থাকেন, তা কতটুকু জায়েয। বুখারী শরীফে হযরত ইবনে উমর (রা) থেকে এ সম্পর্কে বর্ণিত আছে যে, হযরত (সা) নামাযের জন্য দাঁড়ানোর পর হাত উঠাতেন এবং তা কাঁধ রবাবর এসে যেত এবং রুকুর জন্য তাকবীর বলার সময় ও রুকূ থেকে উঠার সময়ও এরূপ করতেন কিন্তু সিজদার সময় এরূপ করতেন না। মুসলিম শরীফেও একই বিষয়ে হাদীস বর্ণিত রয়েছে। অথবা সাহাবী হযরত আলী (রা) থেকে বর্ণিত হাদীসের শেষ অংশে বর্ণিত আছে যে, যখন হুযূর (সা) সিজদা থেকে উঠতেন তখন এভাবে হাত উঠাতেন। হাত উঠানোর পক্ষ সমর্থনকারী দল এই হাদীসও দলীল হিসেবে পেশ করে থাকে।
এবার হানাফী মাযহাবের দলীল একটু বিস্তারীতভাবে পেশ করা হবে। কেননা এটা বলা হয়ে থাকে যে, এই বিষয়ে হানাফীদের নিকট কোন সহীহ হাদীস নেই।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) বর্ণিত হাদীসের শেষ অংশে রয়েছে। অর্থাৎ হুযুর (সা) নামায শুরু করার সময় হাত উঠাতেন কিন্তু দ্বিতীয়বার আর কখনো তিনি এরূপ করতেন না। ইমাম তাহাবী, হুসাইন ও ইবরাহীম নখঈ (র)-এর সূত্রে বর্ণনা করেন যে, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) নামায শুরু করার সময় ব্যতীত অন্য সময় হাত উঠাতেন না। ইমাম মুহাম্মদ (র) স্বীয় হাদীস গ্রন্থ মুয়াত্তায় একই অর্থবোধক বাক্য দ্বারা হাদীস বর্ণনা করেছেন। ইমাম আবূ দাউদ (র) স্বীয় হাদীস গ্রন্থ আবূ দাউদ শরীফে আসিম ইবনে কুলাইব (র) থেকে, তিনি আবদুর রহমান ইবনে আসওয়াদ (র) থেকে, তিনি আলকামা (র) থেকে এবং তিনি হযরত ইবনে মাসউদ (রা) থেকে বর্ণনা করেন: ألا أصلي لكم صلاة رسول الله صلى الله عليه وسلم قال فصلى فلم يرفع يديه إلا مرة "তিনি বলেছেন, আমি কি তোমাদেরকে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নামায কিরূপ ছিল, তা দেখাব? বর্ণনাকারী বলেনঃ অতঃপর আবদুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ (রা) নামায পড়েন এবং শুধু একবার হাত উত্তোলন করেন।" অন্য এক রিওয়ায়েতে আছে, “তিনি শুধু নামায শুরু করার সময় হাত উত্তেলন করেন।” কিন্তু বিরোধী পক্ষ উক্ত হাদীস বর্ণনাকারী আসিম ইবনে কুলাইব সম্পর্কে সমালোচনা করেছেন। কেউ বলেছেন, এই হাদীসের কোন প্রমাণ নেই। কেউ বলেছেন, এই হাদীস সনদের দিক দিয়ে দুর্বল (ضعيف) আবার কেউ বলেছেন, এই হাদীস সহীহ নয়। পক্ষান্তরে ইবনে হাজম, দারে কুতনী ও ইবনে কাতান (র) এই হাদীসকে সহীহ বলেছেন। ইমাম নাসাঈ (র) হাত না উঠানোর ব্যাপারে একটি পৃথক অধ্যায় রচনা করেছেন। ইমাম মুসলিম (র) তাঁর থেকে হাদীস বর্ণনা করেন। ইমাম বুখারী ও মুসলিম (র) আসিমকে নির্ভরযোগ্য (ثقة) বলে উল্লেখ করেছেন। যদি আবদুর রহমান (র)-এর মধ্যে কিছু সন্দেহ থাকে কিন্তু ইমাম মুসলিম (র) তাঁর নিকট থেকেও হাদীস বর্ণনা করেছেন। সুতরাং এ হাদীসের মধ্যে কি দুর্বলতা থাকতে পারে?
এই আসিম (র)-এর সূত্রে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) থেকে ইমাম তিরমিযী (র) ও হাদীস বর্ণনা করেছেন এবং বলেছেন এই হাদীস হাসান (حسن)। অনেক সাহাবায়ে কিরাম এবং তাবেঈন এই মত সমর্থন করেছেন। ইমাম সুফিয়ান সওরী (র) এবং কুফাবাসীদের মাযহাবও এটাই। সুতরাং আহলে হাদীস উলামায়ে কিরাম যখন এই হাদীসের বর্ণনাকারীদের মেনে নিয়ে এই হাদীসকে হাসান (حسن) বলেছেন, তাহলে অন্য দল এটাকে কিভাবে দুর্বল বলে থাকে! কেউ কেউ এই অভিযোগ করেছেন যে, আবদুর রহমান (র) হযরত আলকামা (র) থেকে হাদীস শ্রবণ করেননি। ৭৯ হিজরীতে যখন আবদুর রহমান (র) ইনতিকাল করেন তখন ইবরাহীম নখঈ জীবিত ছিলেন এবং সর্ব সম্মতিক্রমে তিনি হযরত আলকামা (র) থেকে হাদীস শ্রবণ করেছেন। অধিকন্তু খতীব বোগদাদী "কিতাবুল মুত্তাফিক ওয়াল মুতাফাররিক" নামক গ্রন্থে আবদুর রহমান (র) সম্পর্কে লিখেছেন যে, তিনি তাঁর পিতা থেকে এবং হযরত আলকামা (র) থেকে হাদীস শ্রবণ করেছেন। সুতরাং এরপর কোন দিক থেকেই এ হাদীসের উপর কোন প্রকার অভিযোগ বাকী থাকে না।
এবার খলীফার মধ্যে হযরত আবূ বকর (রা) ও হযরত উমর (রা)-এর মতামত ও মাযহাব কি ছিল, তা আলোচনা করা প্রয়োজন। দারে কুতনী এবং ইবনে আদী (র) মুহাম্মদ ইবনে জাবির থেকে, তিনি হাম্মাদ ইবনে আবি সুলায়মান থেকে, তিনি ইবরাহীম থেকে, তিনি হযরত আলকামা থেকে, তিনি হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ইবনে মাসউদ (রা) থেকে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেনঃ صليت مع رسول الله صلى الله عليه وسلم وأبو بكر وعمر فلم يرفعوا أيديهم إلا عند افتتاح الصلاة "আমি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সাথে এবং হযরত আবূ বকর (রা) ও হযরত উমর (রা)-এর সাথে নামায পড়েছি। তাঁদের মধ্যে কেউ নামায শুরু করার সময় ব্যতীত হাত উত্তোলন করেননি। এই রিওয়ায়েতের পর বিরোধী পক্ষ মুহাম্মদ ইবনে জাবির ইবনে ইয়াসারের রিওয়ায়েত উল্লেখ করে বলেনঃ মুহাম্মদ ইবনে জাবির (র) সম্পর্কে অভিযোগ রয়েছে। অথচ মুহাম্মদ ইবনে জাবির থেকে আইউব ইবনে আউফ, হিশাম ইবনে হাসান, ইমাম সুফিয়ান সওরী, ইমাম ওবা ও ইবনে উয়াইনার মত সম্মানিত ব্যক্তিবর্গ হাদীস রিওয়ায়েত করেছেন, তিনি কি কোন ইলম-এর অধিকারী ছিলেন না? এর মর্যাদা কিভাবে খাটো করে দেখা যায়?
পক্ষান্তরে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) একজন সম্মানিত সাহাবী ছিলেন। সাথে সাথে তিনি হাদীসের সত্যতা বর্ণনা করতে গিয়ে হুযূর (সা)-এর সাথে হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রা)-এর সত্যবাদিতা এবং হযরত উমর ফারুক (রা)-এর জ্ঞানকে একত্রিত করেছেন। বরং এটা হুযূর (সা)-এর আদর্শ পূর্ণাঙ্গভাবে অনুসরণকারী হযরত আবূ বকর (রা) এবং উমর (রা)-এর হাদীস হিসেবেই গণ্য। মোট কথা এই হাদীস হানাফী মাযহাবের একটি শক্তিশালী দলীল হযরত আলী (রা)-এর মাযহাব সম্পর্কে ইমাম তাহাবী ও ইমাম মুহাম্মদ (র) আবূ বকর নাহশালী (র) থেকে, তিনি আসিম (র) থেকে, তিনি তাঁর পিতা থেকে রিওয়ায়েত করেন যে, ان عليا كان يرفع في اول تكبيرة من الصلاة ثم لا يعود "হযরত আলী (রা) নামাযে প্রথম তাকবীরের সময় হাত উঠাতেন কিন্তু অতঃপর আর কখনো এরূপ করতেন না।"
দারে কুতনী নাহশালী (র) থেকে এই হাদীস রিওয়ায়েত করেছেন এবং বলেছেন, এই হাদীস মরফু" নয়, তবে মওকুফ সহীহ। মুহাম্মদ ইবনে আবানও আসিম (র) থেকে এ ধরনের হাদীস রিওয়ায়েত করেছেন। কিন্তু দারেমী এর উপর অভিযোগ উত্থাপন করেছেন। তিনি বলেছেন, হযরত আলী (রা) থেকে যে রিওয়ায়েতের উদ্ধৃতি দেয়া হয়েছে তা হলো, তিনি প্রথম তাকবীরে হাত উঠাতেন অতঃপর এরূপ করতেন না- এটা সম্পূর্ণ দূর্বল (ضعيف)। কেননা হযরত আলী (রা) সম্পর্কে এটা কিভাবে ধারণা করা যায় যে, তিনি হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আমলের বিরোধিতা করবেন অথচ হযরত সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি রুকূতে যাওয়ার সময় এবং রুকূ থেকে উঠার সময় হাত উঠাতেন। তাঁদের বক্তব্য হলো এই যে, হযরত আলী (রা)-এর এই আমল হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পরের এবং তা হাত উঠানো (رفع يدين) রহিত হওয়াকে প্রমাণ করে থাকে। কিন্তু বিরোধী পক্ষ তাঁদের মতামতের বিপক্ষে অন্য কোন মত বা যুক্তি মানতে রাজী নয়। ইবনে দাকীকুল ঈদ (র) একই বাক্যের দ্বারা দারিমীর সমালোচনা করেছেন।
আবু দাউদ, ইবনে মাজাহ এবং তিরমিয়ী হযরত আলী (রা) থেকে হাত উঠানোর (رفع يدين) স্বপক্ষে এক মরফূ' রিওয়ায়েত বর্ণনা করেছেন। কিন্তু এটা গ্রহণযোগ্য নয়। কেননা প্রথমতঃ আবূ দাউদের রিওয়ায়েতের আবদুর রহমান ইবনে যিনাদ (র)-কে '*তাকরীব' নামক গ্রন্থে সত্যবাদী বলা হয়েছে কিন্তু যখন বাগদাদ আগমণ করেন তখন তাঁর হিফয শক্তির মধ্যে ত্রুটি পরিলক্ষিত হয়। এ ছাড়া বর্ণিত হাদীসে اذا قام من السجدتين رفع يديه كذلك (যখন দু'সিজদা থেকে দাঁড়াতেন তখন দু'হাত উঠাতেন) খটকা রয়েছে যা সবার মতে রহিত অথবা যার কোন প্রমাণ নেই। এরপর আবূ দাউদের হাদীস মরফূ' যা হুযূর (সা)-এর আমলকে প্রকাশ করে থাকে। সুতরাং এটা সহজেই বুঝা যায় যে, তিনি প্রথমতঃ হযরত সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদীস বর্ণনা করেছেন। এরপর হাত উঠানো (رفع يدين) রহিত হয়ে যায়, তখন তিনি এর উপর আমল করতে থাকেন। এ সম্পর্কে ইতিপূর্বে ইমাম মুহাম্মদ থেকে সহীহ হাদীস বর্ণনা করা হয়েছে।
ইমাম তাহাবী এবং বায়হাকী হাসান ইবনে আব্বাস (র)-এর সূত্রে সহীহ্ সনদের সাথে আসওয়াদ থেকে বর্ণনা করেঃ قال رأيت عمر بن الخطاب رأيت إبراهيم والشعبة رفع يديه في أول تكبيرة ثم لا يعود قال يفعلان ذلك "হযরত আসওয়াদ (র) বলেছেন, আমি হযরত উমর (রা)-কে দেখেছি যে, তিনি নামাযে প্রথম তাকবীরের সময় হাত উঠাতেন। এরপর আর এরূপ করেন নি। তিনি বলেছেন, আমি ইবরাহীম নখঈ ও হযরত শাখী (র)-কে এরূপ করতে দেখেছি।” ইমাম তাহাবী (র) বলেনঃ এই হাদীসের বর্ণনাকারী হাসান ইবনে আব্বাস (র) নির্ভরযোগ্য। ইয়াহইয়া ইবনে মুঈন (র) ও অন্যান্যরা তাঁকে নির্ভরযোগ্য বলেছেন। এটা তাঁরা এজনা বলেছেন যে, তাঁরা জানেন যে, সমস্ত সনদের মধ্যে এই এক ব্যক্তিকে নিয়ে সমালোচনা হতে পারে। তাই তাঁরা পূর্বেই তাঁর নির্ভরযোগ্যতা সম্পর্কে দলীল পেশ করেছেন। ইমাম হাকিম (র) তাউস (র)-এর সূত্রে হযরত ইবনে উমর (রা) থেকে এর বিরোধী এক হাদীস বর্ণনা করেছেন। আমরা বলব, যখন এই হাদীস সনদের দিক দিয়ে সহীহ, তখন উপরে বর্ণিত হাদীসের সাথে এর বিরোধিতা হবে কিন্তু উভয়েই আহাদ এবং এর দ্বারা হযরত ইবনে মাসউদ (রা)-এর হাদীসকে আরো শক্তিশালী করে। পক্ষান্তরে হযরত ইবনে উমর (রা)-এর উপর হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা)-এর যে ফযীলত ও সম্মান রয়েছে, এ সম্পর্কে আইম্মায়ে কিরাম অবগত আছেন।
হাত উঠানোর পক্ষ সমর্থনকারীগণ এই বিষয়ের উপর গর্ব করে থাকে যে, হযরত ইবনে আব্বাস ও হযরত ইবনে উমর (রা)-এর মাযহাবের সাথে আমাদের মাযহাবের ঐকমত্য রয়েছে। সুতরাং এখানে ঐ হাদীসও বর্ণনা করা হলো যা হাত উঠানো সম্পর্কে বর্ণিত আছে। বুখারী শরীফে কিতাবুল মুফরাদে ওয়াকী' ইবনে আবী লায়লা (র) হাকাম (র)-এর সূত্রে ইবনে আব্বাস (রা) থেকে হাদীস বর্ণনা করেন যে, হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, শুধু সাত জায়গায় হাত উঠানো প্রয়োজন। নামাযের প্রারম্ভে, কিবলা দর্শনের সময়, সাফা-মারওয়া ও আরাফাতে একত্রিত হওয়ার সময়, মিনায় এবং দু’জামরায়। হযরত নাফে'(র)-এর সূত্রে বাযযায নামক গ্রন্থে হযরত ইবনে উমর (রা) থেকে একই হাদীস বর্ণনা করা হয়েছে। এই হাদীসে কোথাও রুকুর সময় হাত উঠানোর উল্লেখ নেই। কিন্তু বিরোধী পক্ষ এই হাদীসের রিওয়ায়েতের মধ্যে অভিযোগ উত্থাপন করে বলে যে, হাদীসের বর্ণনাকারী ইবনে আবী লায়লা (র) দলীল হিসেবে গ্রহণযোগ্য নন। অথচ তিনি এরূপ প্রখ্যাত তাবেঈ, যিনি একশ' বিশজন সাহাবার সাক্ষাত লাভ করেছেন। যদি তাঁর বর্ণিত মরফূ' হাদীস গ্রহণ করা না হয়, তাহলে কার হাদীস গ্রহণ করা হবে? দ্বিতীয়তঃ এটা বলা হয়েছে ওয়াকী' (র)-এর সূত্রে বর্ণিত হাদীস মওকুফ, সহীহ মরফূ' নয়; তাই এটা প্রতীয়মান হয় যে, ইমাম আবূ হানীফা (র)-এর মাযহাব সঠিক।
অধিকন্তু হানাফী মাযহাবের স্বপক্ষে হযরত বারা' ইবনে আযিব (রা), হযরত জাবির ইবনে সামুরা (রা) এবং হযরত আবূ সাঈদ খুদরী (রা) থেকে বর্ণিত সহীহ হাদীস বিদ্যমান রয়েছে। খবর দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, হানাফী মাযহাব এই মাসয়ালায় সহীহ্ হাদীসের উপর প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু এতদসত্ত্বেও বিরোধী পক্ষ প্রচার করে থাকে যে, হানাফী মাযহাবের স্বপক্ষে কোন সহীহ হাদীস নেই; তারা কিয়াসের উপর নির্ভরশীল। আমরা আহলে হাদীস। এখানে হানাফী মাযহাবের পক্ষ থেকে ন্যায়ভিত্তিক ফয়সালা হলো এই যে, হাত উঠানো ও না উঠানো উভয়ই সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত এবং উভয় হাদীসের মধ্যে বিরোধ রয়েছে। সুতরাং উভয় হাদীসের মধ্যে সমন্বয় সাধন করা একান্ত জরুরী। তাই এইভাবে সমন্বয় করা যায় যে, হাত উঠানো না উঠানো হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিভিন্ন সময়ের দু'প্রকারের দু'টি আমল। অতঃপর হাত উঠানোর নির্দেশ রহিত হয়ে যায় এবং হাত না উঠানোর বিষয়টি বাকী থাকে।
পক্ষান্তরে কোন কোন সাহাবা (রা), যেমন হযরত ইবনে উমর (রা) সহ যাঁরা হাত উঠানো সম্পর্কিত হাদীস বর্ণনা করেছেন, তাঁরা নিজেরাই হাত উঠানো পরিত্যাগ করেছেন। তাঁদের স্থাদীস বর্ণনা করার পর নিজেই এর বিপরীত আমল করেন, তখন এর দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, এই হাদীস রহিত হওয়া সম্পর্কে তিনি প্রমাণ পেয়েছেন। নতুবা হযরত ইবনে উমর (রা) এবং হযরত আলী (রা) সম্পর্কে এটা কিভাবে বলা যায় যে, তাঁরা উভয়ে হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীস বিরোধী আমল করেছেন। অন্যদিকে এই নীতি রয়েছে যে, যখন সহীহ হাদীস পরস্পর বিরোধী হয়, তখন কিয়াসের মাধ্যমে একটি হাদীসকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। কিয়াসও এটাই বলে যে, হাত না উঠানো হোক। কেননা হাত উঠানোর মাধ্যমে নামাযে একাগ্রতা, ভয় ও বিনয়ের মধ্যে ব্যাঘাত সৃষ্টি হয়।
