মুসনাদে ইমাম আযম আবু হানীফা রহঃ
৪. নামায অধ্যায়
হাদীস নং: ৯৮
নামায শুরু করার বর্ণনা
৯৮। হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লাম বলেছেন, উযূ হলো নামাযের চাবি, তাকবীর হলো এর তাহরীয়া (তাকবীর নামায ব্যতীত সমস্ত কাজ হারাম করে দেয়), সালাম এর জন্য তাহলীল (অর্থাৎ সালাম হারাম হওয়া কাজকর্ম পুনরায় হালাল করে দেয়), প্রতি দু'রাকা'আতে সালাম ফিরাও অর্থাৎ তাশাহহুদ পাঠ কর এবং কোন নামায় সূরা ফাতিহা ও অন্য একটি সূরা মিলানো ব্যতীত পূর্ণ হয় না।
অন্য এক রিওয়ায়েতে মুকরী হযরত ইমাম আবু হানীফা (রাহঃ) থেকে একই ধরনের বাক্য বর্ণনা করেছেন। কিন্তু এতে এতটুকু অধিক রয়েছে যে, আমি আবু হানীফা (রাহঃ)-কে জিজ্ঞাসা করি, প্রতি দু'রাকাআতে সালাম করার কি অর্থ ? তিনি বলেনঃ এর অর্থ হলো তাশাহহুদ পড়া। মুকরী (রাহঃ) বলেনঃ সত্য বলেছেন।
অন্য রিওয়ায়েতের শেষদিকে এতটুকু অধিক রয়েছে যে, কোন নামায ফাতিহাতুল কিতাব (আলহামদু) এবং এর সাথে কোন সূরা মিলানো বাৰ্তীত পূর্ণ হয় না।
অন্য এক রিওয়ায়েতে মুকরী হযরত ইমাম আবু হানীফা (রাহঃ) থেকে একই ধরনের বাক্য বর্ণনা করেছেন। কিন্তু এতে এতটুকু অধিক রয়েছে যে, আমি আবু হানীফা (রাহঃ)-কে জিজ্ঞাসা করি, প্রতি দু'রাকাআতে সালাম করার কি অর্থ ? তিনি বলেনঃ এর অর্থ হলো তাশাহহুদ পড়া। মুকরী (রাহঃ) বলেনঃ সত্য বলেছেন।
অন্য রিওয়ায়েতের শেষদিকে এতটুকু অধিক রয়েছে যে, কোন নামায ফাতিহাতুল কিতাব (আলহামদু) এবং এর সাথে কোন সূরা মিলানো বাৰ্তীত পূর্ণ হয় না।
عَنْ طَرِيفٍ أَبِي سُفْيَانَ، عَنْ أَبِي نَضْرَةَ، عَنْ أَبِي سَعِيدٍ الْخُدْرِيِّ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ، أَنَّ رَسُولَ اللَّهَ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: «الْوُضُوءُ مِفْتَاحُ الصَّلَاةِ، وَالتَّكْبِيرُ تَحْرِيمُهَا، وَالتَّسْلِيمُ تَحْلِيلُهَا، وَفِي كُلِّ رَكْعَتَيْنِ، فَسَلِّمْ وَلَا تُجْزِي صَلَاةٌ إِلَّا بِفَاتِحَةِ الْكِتَابِ، وَمَعَهَا غَيْرُهَا» ، وَفِي رِوَايَةِ الْمُقْرِي، عَنْ أَبِي حَنِيفَةَ مِثْلُهُ، وَزَادَ فِي آخِرِهِ: قُلْتُ لِأَبِي حَنِيفَةَ: مَا يَعْنِي بِقَوْلِهِ: «فِي كُلِّ رَكْعَتَيْنِ فَسَلِّمْ» ؟ قَالَ: يَعْنِي: التَّشَهُّدَ.
قَالَ الْمُقْرِي: صَدَقَ.
وَفِي رِوَايَةٍ: نَحْوُهُ، وَزَادَ فِي آخِرِهِ: «وَلَا تُجْزِي صَلَاةٌ إِلَّا بِفَاتِحَةِ الْكِتَابِ، وَمَعَهَا شَيْءٌ»
قَالَ الْمُقْرِي: صَدَقَ.
وَفِي رِوَايَةٍ: نَحْوُهُ، وَزَادَ فِي آخِرِهِ: «وَلَا تُجْزِي صَلَاةٌ إِلَّا بِفَاتِحَةِ الْكِتَابِ، وَمَعَهَا شَيْءٌ»
হাদীসের ব্যাখ্যা:
এই হাদীসে কয়েকটি মাসয়ালা নিয়ে ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণের প্রয়োজন রয়েছে। যেমন হাদীসে বলা হয়েছে, الوضوء مفتاح الصلاة (উযূ নামাযের চাবি) এর দ্বারা অতি সুক্ষভাবে একটি মাসয়ালার দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, উযুর মধ্যে নিয়্যত ওয়াজিব নয়, বরং সুন্নত। কেননা নামাযের মধ্যে উত্তর গুরুত্ব হলো চাবির মত, এর দ্বারা নামায় খোলা অর্থাৎ শুরু করা হয়, নামাযের হাকীকত প্রতিষ্ঠা করা হয়, নামায বাস্তবে আদায়ের ব্যবস্থা করা হয়। সুতরাং নামায যেহেতু একটি ইবাদত, তাই উর্দূ ইবাদতের মধ্যে গণ্য নয়, বরং ইবাদতের বাহন হিসেবে গণ্য হয়েছে এবং ইবাদত সহীহ হওয়ার জন্য নিয়্যত শর্ত। কেননা নিয়্যত ব্যতীত ইবাদত সওয়াব থেকে শূন্য থাকে। যখন সওয়াব থেকে শূন্য থাকে, তখন এর শুদ্ধতা চলে যায়। এই অবস্থা ইবাদতের বাহন বা সরঞ্জামের সাথে যুক্ত নয়। আবূ দাউদ ও ইবনে মাজাহ-এ এর স্পষ্ট নলীল রয়েছে لا صلاة لمن لا وضوء له ولا وضوء لمن لم يذكر اسم الله عليه "যার উযূ নেই তার নামায নেই এবং এটা উযু নয় যার উপর আল্লাহর নাম উচ্চারণ করা হয় নি।"
অতঃপর হাদীসে বলা হয়েছেঃ والتكبير تحريمها এর মধ্যে মতানৈক্য রয়েছে যে, তাকবীরে তাহরীমা কোন বাক্যের দ্বারা বলতে হবে। ইমাম শাফিঈ (র) বলেন: আল্লাহু আকবার অথবা আল্লাহুল আকবার (الله الاكبر অথবা الله اكبر) ব্যতীত অন্য কোন বাক্য দ্বারা তাকবীরে তাহরীমা জায়েয নয়। অর্থাৎ اكبر -কে অনির্দিষ্ট অথবা নির্দিষ্ট (معرفة অথবা ناكرة) হিসেবে ব্যবহার করতে হবে। ইমাম মালিক এবং ইমাম আহমদ (র)-এর মতে আল্লাহ আকবর ব্যতীত অন্য কোন বাক্য দ্বারা জায়েয নয়। কাযী আবূ ইউসুফ (র) বলেন: আল্লাহুল (الله الاكبر) বলা জায়েয আছে। মোট কথা তাঁর মতে আল্লাহু আকবর, আল্লাহুল কবীর আকবর এবং আল্লাহুল কবীর এ তিন বাক্যের দ্বারা তাকবীরে তাহরীমা হবে। ইমাম আবূ হানীফা (র) এবং ইমাম মুহাম্মদ (র)-এর মতে ঐ সমস্ত বাক্যের দ্বারা তাকবীরে তাহরীমা জায়েয হবে যা আল্লাহর মর্যাদা ও মহত্ব প্রকাশ করে থাকে। তবে এটা শুধু ফরয আদায়ের জন্য। কিন্তু হাদীসের বাহ্যিক বর্ণনা অনুযায়ী 'আল্লাহু আকবর' বলা সুন্নত।
ইমাম আবূ হানীফা (র)-এর মতামত নিয়ে একটু বিশ্লেষণের প্রয়োজন রয়েছে। মূলত পবিত্র কুরআনের আয়াত وَرَبَّكَ فَكَبِّرْ -এর দ্বারা তাকবীরে তাহরীমা ফরয হয়েছে। অন্যান্য উলামায়ে কিরাম উপরোক্ত আয়াতের দৃষ্টিকোণ থেকে এটা 'আকবর' (اكبر) শব্দের মধ্যে সীমাবদ্ধ করেছেন। ইমাম আবূ হানীফা (র) অর্থের দিকে দৃষ্টি রেখে বলেনঃ তাকবীর অভিধানে তাযীমের অর্থে ব্যবহার হয়। সুতরাং যে বাক্য দ্বারা তাযীম প্রকাশ পাবে, এর দ্বারা তাকবীরে তাহরীমা বলা জায়েয হবে। তাই আল্লাহ আকবর, আল্লাহু আজানু (الله اجل) আল্লাহু আযামু (الله اعظم অথবা আর-রাহমানির রাহিম (الرحمن الرحيم) বলা জায়েয হবে। অন্য আয়াতে বলা হয়েছেঃ فلما راينه اكبرنه অর্থাৎ “অতঃপর যখন তারা এটা দেখল, তখন তারা এটা বিরাট মনে করল।" এখানে আকবার দ্বারা বুযর্গ বুঝানো হয়েছে। অন্য এক স্থানে নামায সম্পর্কে বলা হয়েছে। وذكر اسم ربه فصلى এখানে ذكر -এর দ্বারা তাকবীরে তাহরীমা বুঝানো হয়েছে, এখানে যে ذكر এর উপর তাকবীর আরোপ করা হয়েছে। সুতরাং এটা কিভাবে আকবর (اكبر) শব্দের দ্বারা নির্দিষ্ট করা যাবে? বরং اسم শব্দে দৃষ্টিকোণ থেকে فله الأسماء الحسنى অথবা হাদিসের বর্ণনা امرت ان اقاتل الناس حتى يقولوا لا اله الا الله অনুযায়ী যদি কেউ لا اله الا الرحمن বলে, তাহলে তাকে মুসলমান বলে গণ্য করা হবে, তার জীবন ও সম্পদ নিরাপদ হয়ে যাবে। যখন মূল্যের মধ্যে এই প্রশস্ততা বিদ্যমান, তখন নামাযে তা কেন গ্রহণযোগ্য হবে না?
অতঃপর হাদীসে বলা হয়েছে: والتسليم تحليلها সালাম নামাযের জন্য তাহলীল।" অর্থাৎ সালামের সাথে সাথে নামাযের যে সমস্ত কাজ হারাম হয়েছিল, তা হালাল হয়ে যায়। এই মাসয়ালায় অর্থাৎ সালাম শব্দের মাধ্যমে নামায সমাপ্ত করা ফরয অথবা ওয়াজিব এটা নিয়ে শাফিঈ ও হানাফী মাযহাবের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। ইমাম শাফিঈ (র) ও ইমাম আহমদ (র) এটা ফরয বলে মতামত পেশ করেছেন। ইমাম আবূ হানীফা (র) এটা ওয়াজিব বলেছেন। হযরত আলী (রা), হযরত ইবনে মুসাইয়্যেব (রা), হযরত ইবরাহীম নখঈ (র), ইমাম সুফিয়ান সওরী (র) এবং ইমাম আওযাঈ (র)-এর মাযহার এটাই ছিল। ইমাম শাফিঈ (র) বর্ণিত হাদীস والتسليم و تحليلها দলীল হিসেবে পেশ করে বলেনঃ এখানে বাহ্যিকভাবে তাহলীল (تحليل) অর্থৎ নামায থেকে অবসর হওয়াকে তাসলীম (تسليم) বলে, অর্থাৎ সালাম শব্দ আদায়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ করেছেন। অথবা হাদীস صلوا كما رايتموني اصلي অর্থাৎ যেভাবে আমাকে নামায পড়তে দেখ, তোমরাও সেভাবে নামার্থ আদায় কর। হুযূর (সা) অবশ্য سلام শব্দ ব্যবহার করতেন। এ ছাড়া তিনি তাকবীরে তাহরীমার উপর কিয়াস করে বলেন যে, নামায শুরু করার জন্য তাকবীর বলা যেমন সর্বসম্মতিক্রমে ফরয, ঠিক তেমনিভাবে নামায সমাপ্ত করার জন্য সালাম বলা ফরয।
ইমাম আবূ হানীফা (র) সুনানে আবূ দাউদে হযরত ইবনে মাসউদ (রা) থেকে বর্ণিত হাদীস اذا قلت هذا او قضيت هذا فقد قضيت صلاتك যখন তুমি এরূপ করবে অথবা এটা পূর্ণ করবে তখন তুমি তোমার নামায পূর্ণ করে নিলে", পেশ করে বলেনঃ এখানে বর্ণনা এবং আমলের মধ্যে অধিকার বা ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। যদি সালাম ফরয হতো তাহলে ফরযের মধ্যে অধিকার দেওয়া সঠিক হতো না। এছাড়া এক আরববাসীর হাদীস তিনি দলীল হিসেবে পেশ করেছেন যাতে দেখা যায় হুযূর (সা) তাকে নামায শিক্ষা দিয়েছেন কিন্তু সালামের কথা উল্লেখ করেননি । যদি ফরয হতো, তাহলে কিভাবে তা ছেড়ে দিলেন? হাঁ, দ্বিতীয় সালাম করা কারো মতেই ফরয নয়। সুতরাং এর উপর কিয়াস করে এটা বলা যায় যে, এটা কেন ফরয হবে?
এবার শাফিঈ মাযহাবের কিয়াসের জওয়াব হলো এই যে, তাকবীর ও সালামের মধ্যে বিরাট পার্থক্য রয়েছে। এ দুটোর হাকীকত, হালত এবং ক্রিয়ার মধ্যে পার্থক্য বিরাজমান। তাকবীর যেহেতু একমাত্র প্রশংসা এবং কিবলার দিকে মুখ করে আদায় করা হয়, তাই এটা ইবাদতের মধ্যে গণ্য। অধিকন্তু এর ক্রিয়া হলো এই যে, এই ইবাদত (তাকবীর) মানুষকে নামাজে প্রবেশ করিয়ে দেয়। সুতরাং নামাযের মত এটাও ফরয। পক্ষান্তরে সালাম কিন্তু এরূপ নয়। এটা আল্লাহ্ তা'আলার একটি প্রশংসামূলক নাম। অন্য কথায় এটা মানুষকে উদ্দেশ্য করে বলা হয় এবং এর দ্বারা মানুষের সাথে কথাবার্তা শুরু করা হয়। এই দৃষ্টিকোণ থেকে নামাযের মধ্যে সালাম করা নিষেধ এবং কিবলা থেকে গর্দান ফিরিয়ে তা আদায় করতে হয়। এমনিভাবে ক্রিয়ার দিক থেকেও সালাম তাকবীয় থেকে পৃথক। তাকবীর ইবাদতে প্রবেশ ও মগ্ন হওয়ার উপায়। পক্ষান্তরে সালাম ইরাদত থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার উপকরণ। এই পার্থক্যের কারণে তাকবীরের মত সালাম ফরয হয়নি। তবে সালামে যেহেতু আল্লাহর প্রশংসা নিহিত আছে, তাই ফরম ও নফলের মধ্যে একে ওয়াজিব হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। বর্ণিত হাদীস والتسليم و تحليلها এর দ্বারা সালামের মাধ্যমেই তাহলীল অর্থাৎ নামায শেষ করতে হবে, এতে সীমাবদ্ধ করার প্রমাণ বহন করে না। অতঃপর এটা খবরে ওয়াহিদ (خبر واحد) হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। কাজেই এর দ্বারা ফরয প্রমাণ করা কিভাবে সম্ভব? অবশ্য হুযূর (সা)-এর সর্বদা বলা বা নির্দেশ প্রদানের দ্বারা ওয়াজিব হওয়ার প্রমাণ রয়েছে। এটাই ইমাম আবু হানীফা (র)-এর মাযহাব।
হাদীসে বর্ণিত- وفي كل ركعتين فسلم (প্রতি দু'রাকাআতে সালাম ফিরাও) এই বাকা দু'টি অর্থে ব্যবহৃত হতে পারে। প্রথমতঃ বাহ্যিক অর্থে ব্যবহৃত হতে পারে এবং প্রতি দু'রাকাআএেরদ্বারা নফল বুঝানো হবে। এখানে হুকুম নুদুব (ندب) বা নফল হিসেবে গণ্য হবে। উদ্দেশ্য হলো এই যে, প্রতি মু'রাকাআতের পর সালাম ফিরাও। এরদ্বারা ইমাম আবূ ইউসুফ (র) ও মুহাম্মদ (র) বলেন : হাদীস, الصلاة مثنى مثنى অনুযায়ী নফল নামায দু-দু' রাকাআত করে পড়া উচিত। অথবা فسلم এর দ্বারা প্রকৃত সালাম উদ্দেশ্য নয়, বরং এর দ্বারা তাশাহহুদ বুঝানো হয়েছে। যেমন এই হাদীসের দ্বারা তা-ই বুঝা যাচ্ছে। ইমাম আবু হানীফা (র) হাদীসের এই ব্যাখ্যা করেছেন। এই অবস্থায় উপরোক্ত নির্দেশ (امر) নফলের মধ্যে। আর ওয়াজিব ফরয়ের জন্য হবে অর্থাৎ তাশাহহুদ পরিমাণ বসা ওয়াজিব হবে। অথবা তিন বা চার রাকাআত বিশিষ্ট ফরয নামাযে ওয়াজিব হবে।
অতঃপর হাদীসে বলা হয়েছেঃ والتكبير تحريمها এর মধ্যে মতানৈক্য রয়েছে যে, তাকবীরে তাহরীমা কোন বাক্যের দ্বারা বলতে হবে। ইমাম শাফিঈ (র) বলেন: আল্লাহু আকবার অথবা আল্লাহুল আকবার (الله الاكبر অথবা الله اكبر) ব্যতীত অন্য কোন বাক্য দ্বারা তাকবীরে তাহরীমা জায়েয নয়। অর্থাৎ اكبر -কে অনির্দিষ্ট অথবা নির্দিষ্ট (معرفة অথবা ناكرة) হিসেবে ব্যবহার করতে হবে। ইমাম মালিক এবং ইমাম আহমদ (র)-এর মতে আল্লাহ আকবর ব্যতীত অন্য কোন বাক্য দ্বারা জায়েয নয়। কাযী আবূ ইউসুফ (র) বলেন: আল্লাহুল (الله الاكبر) বলা জায়েয আছে। মোট কথা তাঁর মতে আল্লাহু আকবর, আল্লাহুল কবীর আকবর এবং আল্লাহুল কবীর এ তিন বাক্যের দ্বারা তাকবীরে তাহরীমা হবে। ইমাম আবূ হানীফা (র) এবং ইমাম মুহাম্মদ (র)-এর মতে ঐ সমস্ত বাক্যের দ্বারা তাকবীরে তাহরীমা জায়েয হবে যা আল্লাহর মর্যাদা ও মহত্ব প্রকাশ করে থাকে। তবে এটা শুধু ফরয আদায়ের জন্য। কিন্তু হাদীসের বাহ্যিক বর্ণনা অনুযায়ী 'আল্লাহু আকবর' বলা সুন্নত।
ইমাম আবূ হানীফা (র)-এর মতামত নিয়ে একটু বিশ্লেষণের প্রয়োজন রয়েছে। মূলত পবিত্র কুরআনের আয়াত وَرَبَّكَ فَكَبِّرْ -এর দ্বারা তাকবীরে তাহরীমা ফরয হয়েছে। অন্যান্য উলামায়ে কিরাম উপরোক্ত আয়াতের দৃষ্টিকোণ থেকে এটা 'আকবর' (اكبر) শব্দের মধ্যে সীমাবদ্ধ করেছেন। ইমাম আবূ হানীফা (র) অর্থের দিকে দৃষ্টি রেখে বলেনঃ তাকবীর অভিধানে তাযীমের অর্থে ব্যবহার হয়। সুতরাং যে বাক্য দ্বারা তাযীম প্রকাশ পাবে, এর দ্বারা তাকবীরে তাহরীমা বলা জায়েয হবে। তাই আল্লাহ আকবর, আল্লাহু আজানু (الله اجل) আল্লাহু আযামু (الله اعظم অথবা আর-রাহমানির রাহিম (الرحمن الرحيم) বলা জায়েয হবে। অন্য আয়াতে বলা হয়েছেঃ فلما راينه اكبرنه অর্থাৎ “অতঃপর যখন তারা এটা দেখল, তখন তারা এটা বিরাট মনে করল।" এখানে আকবার দ্বারা বুযর্গ বুঝানো হয়েছে। অন্য এক স্থানে নামায সম্পর্কে বলা হয়েছে। وذكر اسم ربه فصلى এখানে ذكر -এর দ্বারা তাকবীরে তাহরীমা বুঝানো হয়েছে, এখানে যে ذكر এর উপর তাকবীর আরোপ করা হয়েছে। সুতরাং এটা কিভাবে আকবর (اكبر) শব্দের দ্বারা নির্দিষ্ট করা যাবে? বরং اسم শব্দে দৃষ্টিকোণ থেকে فله الأسماء الحسنى অথবা হাদিসের বর্ণনা امرت ان اقاتل الناس حتى يقولوا لا اله الا الله অনুযায়ী যদি কেউ لا اله الا الرحمن বলে, তাহলে তাকে মুসলমান বলে গণ্য করা হবে, তার জীবন ও সম্পদ নিরাপদ হয়ে যাবে। যখন মূল্যের মধ্যে এই প্রশস্ততা বিদ্যমান, তখন নামাযে তা কেন গ্রহণযোগ্য হবে না?
অতঃপর হাদীসে বলা হয়েছে: والتسليم تحليلها সালাম নামাযের জন্য তাহলীল।" অর্থাৎ সালামের সাথে সাথে নামাযের যে সমস্ত কাজ হারাম হয়েছিল, তা হালাল হয়ে যায়। এই মাসয়ালায় অর্থাৎ সালাম শব্দের মাধ্যমে নামায সমাপ্ত করা ফরয অথবা ওয়াজিব এটা নিয়ে শাফিঈ ও হানাফী মাযহাবের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। ইমাম শাফিঈ (র) ও ইমাম আহমদ (র) এটা ফরয বলে মতামত পেশ করেছেন। ইমাম আবূ হানীফা (র) এটা ওয়াজিব বলেছেন। হযরত আলী (রা), হযরত ইবনে মুসাইয়্যেব (রা), হযরত ইবরাহীম নখঈ (র), ইমাম সুফিয়ান সওরী (র) এবং ইমাম আওযাঈ (র)-এর মাযহার এটাই ছিল। ইমাম শাফিঈ (র) বর্ণিত হাদীস والتسليم و تحليلها দলীল হিসেবে পেশ করে বলেনঃ এখানে বাহ্যিকভাবে তাহলীল (تحليل) অর্থৎ নামায থেকে অবসর হওয়াকে তাসলীম (تسليم) বলে, অর্থাৎ সালাম শব্দ আদায়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ করেছেন। অথবা হাদীস صلوا كما رايتموني اصلي অর্থাৎ যেভাবে আমাকে নামায পড়তে দেখ, তোমরাও সেভাবে নামার্থ আদায় কর। হুযূর (সা) অবশ্য سلام শব্দ ব্যবহার করতেন। এ ছাড়া তিনি তাকবীরে তাহরীমার উপর কিয়াস করে বলেন যে, নামায শুরু করার জন্য তাকবীর বলা যেমন সর্বসম্মতিক্রমে ফরয, ঠিক তেমনিভাবে নামায সমাপ্ত করার জন্য সালাম বলা ফরয।
ইমাম আবূ হানীফা (র) সুনানে আবূ দাউদে হযরত ইবনে মাসউদ (রা) থেকে বর্ণিত হাদীস اذا قلت هذا او قضيت هذا فقد قضيت صلاتك যখন তুমি এরূপ করবে অথবা এটা পূর্ণ করবে তখন তুমি তোমার নামায পূর্ণ করে নিলে", পেশ করে বলেনঃ এখানে বর্ণনা এবং আমলের মধ্যে অধিকার বা ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। যদি সালাম ফরয হতো তাহলে ফরযের মধ্যে অধিকার দেওয়া সঠিক হতো না। এছাড়া এক আরববাসীর হাদীস তিনি দলীল হিসেবে পেশ করেছেন যাতে দেখা যায় হুযূর (সা) তাকে নামায শিক্ষা দিয়েছেন কিন্তু সালামের কথা উল্লেখ করেননি । যদি ফরয হতো, তাহলে কিভাবে তা ছেড়ে দিলেন? হাঁ, দ্বিতীয় সালাম করা কারো মতেই ফরয নয়। সুতরাং এর উপর কিয়াস করে এটা বলা যায় যে, এটা কেন ফরয হবে?
এবার শাফিঈ মাযহাবের কিয়াসের জওয়াব হলো এই যে, তাকবীর ও সালামের মধ্যে বিরাট পার্থক্য রয়েছে। এ দুটোর হাকীকত, হালত এবং ক্রিয়ার মধ্যে পার্থক্য বিরাজমান। তাকবীর যেহেতু একমাত্র প্রশংসা এবং কিবলার দিকে মুখ করে আদায় করা হয়, তাই এটা ইবাদতের মধ্যে গণ্য। অধিকন্তু এর ক্রিয়া হলো এই যে, এই ইবাদত (তাকবীর) মানুষকে নামাজে প্রবেশ করিয়ে দেয়। সুতরাং নামাযের মত এটাও ফরয। পক্ষান্তরে সালাম কিন্তু এরূপ নয়। এটা আল্লাহ্ তা'আলার একটি প্রশংসামূলক নাম। অন্য কথায় এটা মানুষকে উদ্দেশ্য করে বলা হয় এবং এর দ্বারা মানুষের সাথে কথাবার্তা শুরু করা হয়। এই দৃষ্টিকোণ থেকে নামাযের মধ্যে সালাম করা নিষেধ এবং কিবলা থেকে গর্দান ফিরিয়ে তা আদায় করতে হয়। এমনিভাবে ক্রিয়ার দিক থেকেও সালাম তাকবীয় থেকে পৃথক। তাকবীর ইবাদতে প্রবেশ ও মগ্ন হওয়ার উপায়। পক্ষান্তরে সালাম ইরাদত থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার উপকরণ। এই পার্থক্যের কারণে তাকবীরের মত সালাম ফরয হয়নি। তবে সালামে যেহেতু আল্লাহর প্রশংসা নিহিত আছে, তাই ফরম ও নফলের মধ্যে একে ওয়াজিব হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। বর্ণিত হাদীস والتسليم و تحليلها এর দ্বারা সালামের মাধ্যমেই তাহলীল অর্থাৎ নামায শেষ করতে হবে, এতে সীমাবদ্ধ করার প্রমাণ বহন করে না। অতঃপর এটা খবরে ওয়াহিদ (خبر واحد) হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। কাজেই এর দ্বারা ফরয প্রমাণ করা কিভাবে সম্ভব? অবশ্য হুযূর (সা)-এর সর্বদা বলা বা নির্দেশ প্রদানের দ্বারা ওয়াজিব হওয়ার প্রমাণ রয়েছে। এটাই ইমাম আবু হানীফা (র)-এর মাযহাব।
হাদীসে বর্ণিত- وفي كل ركعتين فسلم (প্রতি দু'রাকাআতে সালাম ফিরাও) এই বাকা দু'টি অর্থে ব্যবহৃত হতে পারে। প্রথমতঃ বাহ্যিক অর্থে ব্যবহৃত হতে পারে এবং প্রতি দু'রাকাআএেরদ্বারা নফল বুঝানো হবে। এখানে হুকুম নুদুব (ندب) বা নফল হিসেবে গণ্য হবে। উদ্দেশ্য হলো এই যে, প্রতি মু'রাকাআতের পর সালাম ফিরাও। এরদ্বারা ইমাম আবূ ইউসুফ (র) ও মুহাম্মদ (র) বলেন : হাদীস, الصلاة مثنى مثنى অনুযায়ী নফল নামায দু-দু' রাকাআত করে পড়া উচিত। অথবা فسلم এর দ্বারা প্রকৃত সালাম উদ্দেশ্য নয়, বরং এর দ্বারা তাশাহহুদ বুঝানো হয়েছে। যেমন এই হাদীসের দ্বারা তা-ই বুঝা যাচ্ছে। ইমাম আবু হানীফা (র) হাদীসের এই ব্যাখ্যা করেছেন। এই অবস্থায় উপরোক্ত নির্দেশ (امر) নফলের মধ্যে। আর ওয়াজিব ফরয়ের জন্য হবে অর্থাৎ তাশাহহুদ পরিমাণ বসা ওয়াজিব হবে। অথবা তিন বা চার রাকাআত বিশিষ্ট ফরয নামাযে ওয়াজিব হবে।


বর্ণনাকারী: