মুসনাদে ইমাম আযম আবু হানীফা রহঃ

৩. পবিত্রতা অর্জনের অধ্যায়

হাদীস নং: ৪২
স্থির ও জমা পানিতে প্রস্রাব করা নিষেধ
৪২। হযরত জাবির (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। হযরত রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেনঃ তোমাদের মধ্যে কেউ যেন স্থির বা জমাকৃত পানির মধ্যে প্রস্রাব না করে এবং ঐ পানি দ্বারা উযূ না করে।
عَنْ أَبِي الزُّبَيْرِ، عَنْ جَابِرٍ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «لَا يَبُولَنَّ أَحَدُكُمْ فِي الْمَاءِ الدَّائِمِ، ثُمَّ يَتَوَضَّأُ مِنْهُ»

হাদীসের ব্যাখ্যা:

পানির পবিত্রতার শর্ত হিসেবে ফিকহবিদগণ পানিকে দু'ভাগে বিভক্ত করেছেন। প্রথমতঃ অল্প পানি, দ্বিতীয়ত অধিক পানি। অল্প পানিতে ময়লা ও অপবিত্র বস্তু পতিত হলে ঐ পানি অপবিত্র হয়ে যায়। স্থির পানিরও এটাই বিধান। প্রবাহিত ও অধিক পানির বিধান এর থেকে ভিন্ন। এর ব্যাখ্যা বুখারী ও মুসলিম শরীফে হযরত আবূ হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত মরফূ' হাদীসে পাওয়া যায়।

এই হাদীসে হুযূর (সা) বলেছেনঃ কেউ যেন স্থির পানিতে প্রস্রাব না করে, যে পানি প্রবাহিত নয়। এরপর ঐ পানিতে গোসল করে । এমনিভাবে ঐ পানিও এই বিধানের বাইরে যা প্রবাহিত নয়। কিন্তু অধিকাংশের মতে এটা প্রবাহিত পানির মধ্যে গণ্য। পানির পবিত্রতা ও অপবিত্রতা সম্পর্কে উলামায়ে কিরামের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। ইমাম শাফিঈ (র)-এর মতে ঐ পানি পবিত্র যা দুই কুল্লা বা এর চেয়ে অধিক। ইমাম মালিক (র)-এর মতে যতক্ষণ পর্যন্ত পানির তিনটি গুণ যথা : রং, গন্ধ ও স্বাদ পরিবর্তন না হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত পানির মধ্যে ময়লা ও অপবিত্র বস্তু পতিত হলেও পানি অপবিত্র হবে না। হযরত ইমাম আবূ হানীফা (র)-এর মতে স্থির পানি যদি এরূপ দীর্ঘ ও প্রশস্ত পুকুর বা কূপে থাকে যার এক কিনারে নাড়া দিলে অন্য কিনারে স্পন্দন সৃষ্টি না হয়, তবে এই পানি অধিক পানি বলে গণ্য হবে। হানাফী মাযহাবের পরবর্তী আলিমগণের মতে এর পরিমাণ ১০ x ১০ অর্থাৎ একশত বর্গফুট স্থানে ঐ পানি থাকতে হবে।

উপরোক্ত হাদীস এই দু' মাযহাবের বিপক্ষে দলীল হিসেবে পেশ করা হয়েছে। কেননা এতে পানির গুণাবলী বা দু'কুল্লার কোন শর্ত নেই; বরং এখানে হুযূর (সা) বলেছেনঃ স্থির পানি প্রস্রাবের দ্বারা অপবিত্র হয়ে যায়। এর দ্বারা উযূ করা জায়েয নয়। অতঃপর দু'কুল্লা বর্ণনাকারী হাদীসের মধ্যে কয়েকটি সন্দেহ রয়েছে। প্রথমতঃ একদল এটাকে দুর্বল বলেছেন। এদের মধ্যে আলী ইবনে মাদিনী শায়খে নাহারীও রয়েছেন। তিনি বলেছেনঃ এই হাদীসে দু'কুল্লার প্রমাণ হুযুর (সা) থেকে নেই, বুখারী ও মুসলিম শরীফে বর্ণিত হয়নি এবং ইজমায়ে সাহাবা (রা)-এর বিরুদ্ধে। কেননা যমযম কূপের মধ্যে হাবশী ব্যক্তি পতিত হওয়ার কারণে হযরত ইবনে আব্বাস (রা) এবং হযরত ইবনে যুবায়র (রা) সমস্ত কৃপ পরিষ্কার করেছেন। অথচ এই হাদীসের দৃষ্টিকোণ থেকে ঐ কূপ অপবিত্র হয়নি এবং উপরোক্ত সাহাবাদ্বয়ের আমলের উপর কেউ বিরোধিতাও করেননি। আল্লামা তাহাবী (র) বিষয়টির ব্যাখ্যা করে বলেছেন যে, এই হাদীস সহীহ হলেও এর উপর আমাদের আমল নেই। কেননা قلة শব্দটি মাটির কলস, মশক এবং পাহাড়ের চূড়া এই তিনটি অর্থে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু এখানে কোন অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে, তা আমাদের জানা নেই। তাই এই হাদীসের উপর আমল করা কষ্টকর। দ্বিতীয় হাদীসটি খুবই স্পষ্ট। তাই প্রথমটির উপর আমল করা জরুরী নয়।

ইমাম মালিক (রা) দলীল হিসেবে ঐ হাদীস পেশ করেন যেখানে হুযূর (সা) বলেছেনঃ পানি ঐ পর্যন্ত পবিত্র থাকবে যতক্ষণ পানির মধ্যে ময়লা ও অপবিত্র বস্তু পতিত হওয়া সত্ত্বেও পানির রং, গন্ধ ও স্বাদ পরিবর্তন না হয়। এই বর্ণনা অত্যন্ত দুর্বল, দলীল হিসেবে গ্রহণযোগ্য নয়। বায়হাকী এর বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছে। দ্বিতীয় দলীল হলো ঐ হাদীস, যাতে বুযাআ নামক কূপ সম্পর্কে আঁ হযরত (সা)-এর নিকট জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, “পানি পবিত্র, তাই কোন বস্তুই তা অপবিত্র করতে পারে না।" এই হাদীস উপরোক্ত কূপের সাথে নির্দিষ্ট এবং এর পানিও প্রবাহিত ছিল। সমাগ্রিকভাবে সমস্ত পানি বা কূপের উপর এ হাদীস কার্যকরী নয়। এর প্রয়োগও এই হাদীস বাতিল করে থাকে এবং এটা হুযুর (সা) বলেছেনঃ তোমাদের মধ্যে যখন কেউ নিদ্রা থেকে জাগ্রত হবে, তখন সে যেন স্বীয় হাত তিনবার ধৌত করার পূর্বে বরতনের মধ্যে হাত প্রবেশ না করায়। এখানে হাতে কোন ময়লা বা অপবিত্র বস্তু নেই, কিন্তু অপবিত্র বস্তুর সন্দেহ রয়েছে।

সুতরাং অপবিত্র বস্তু বা ময়লার সন্দেহের কারণে যদি পানি অপবিত্র হয়, তাহলে অপবিত্র বস্তুর কারণে তা কেন অপবিত্র হবে না ? কাজেই বর্ণিত হাদীসের দ্বারা যদি বর্ণিত পানি অপবিত্র হয়, তাহলে অপবিত্র বস্তুর কারণে তা কেন অপবিত্র হবে না ? বর্ণিত হাদীসের দ্বারা যখন পানির শরীয়তের পরিমাণ প্রতিষ্ঠিত হয়নি যা প্রবাহিত পানির বিধানের মধ্যে রয়েছে, তাই অক্ষমতার অবস্থায় বিষয়টি বেশির ভাগ ধারণার উপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে যে, পানির দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ এই পরিমাণ হতে হবে যাতে এক কিনারে ময়লা পতিত হলে মনে হয় যেন অন্য কিনারে এর প্রতিক্রিয়া পৌঁছে না, তাহলে ঐ পানি প্রবাহিত পানির বিধানের মধ্যে গণ্য হবে এবং এটাই ইমাম আবূ হানীফা (র)-এর মাযহাব।
মুসনাদে আবু হানীফা রহঃ - হাদীস নং ৪২ | মুসলিম বাংলা