আশ-শামাঈলুল মুহাম্মাদিয়্যাহ- ইমাম তিরমিযী রহঃ

শামাইলে নববীর পরিচ্ছেদসমূহ

হাদীস নং: ৩৮৭
রাসূলুল্লাহ্ -এর ওফাতের বিবরণ
৩৮৭। কুতায়বা (রাহঃ)... 'আয়িশা (রাযিঃ) থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেনঃ রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) -এর মৃত্যুর সময় দেখতে পেলাম, তাঁর কাছে একটি পানির পাত্র ছিল। তিনি বারবার সেই পাত্রে হাত রাখছিলেন এবং পানি দিয়ে চেহারা মাসেহ করছিলেন। অতঃপর দু'আ করছিলেন, হে প্রভু! মৃত্যু যন্ত্রণায় আমাকে সাহায্য কর।
حَدَّثَنَا قُتَيْبَةُ ، قَالَ : حَدَّثَنَا اللَّيْثُ ، عَنِ ابْنِ الْهَادِ ، عَنْ مُوسَى بْنِ سَرْجِسَ ، عَنِ الْقَاسِمِ بْنِ مُحَمَّدٍ ، عَنْ عَائِشَةَ ، أَنَّهَا قَالَتْ : رَأَيْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَهُوَ بِالْمَوْتِ وَعِنْدَهُ قَدَحٌ فِيهِ مَاءٌ ، وَهُوَ يُدْخِلُ يَدَهُ فِي الْقَدَحِ ثُمَّ يَمْسَحُ وَجْهَهُ بِالْمَاءِ ، ثُمَّ يَقُولُ : اللَّهُمَّ أَعِنِّي عَلَى مُنْكَرَاتِ - أَوْ قَالَ عَلَى سَكَرَاتِ - الْمَوْتِ.

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এ হাদীছটিতে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মৃত্যুকালীন অবস্থা বর্ণনা করা হয়েছে। মৃত্যুর প্রক্রিয়া শুরু হলে তিনি খুব কষ্ট পাচ্ছিলেন। সে কষ্ট যাতে কিছুটা লাঘব হয়, সেজন্য তিনি পেয়ালার পানিতে হাত ভিজিয়ে সে হাত চেহারায় বুলাচ্ছিলেন। বস্তুত মৃত্যু বড় কঠিন জিনিস। এর কষ্ট সকলকেই ভোগ করতে হয়। মৃত্যুযন্ত্রণার কথা কুরআন মাজীদেও আছে। ইরশাদ হয়েছে-
وَجَاءَتْ سَكْرَةُ الْمَوْتِ بِالْحَقِّ ذَلِكَ مَا كُنْتَ مِنْهُ تَحِيدُ
'মৃত্যুযন্ত্রণা সত্যিই আসবে। (হে মানুষ!) এটাই সে জিনিস যা থেকে তুমি পালাতে চাইতে’। (সূরা কাফ, আয়াত ১৯)

অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে-
كَلَّا إِذَا بَلَغَتِ التَّرَاقِيَ (26) وَقِيلَ مَنْ رَاقٍ (27) وَظَنَّ أَنَّهُ الْفِرَاقُ (28) وَالْتَفَّتِ السَّاقُ بِالسَّاقِ (29)
'সাবধান প্রাণ যখন কণ্ঠাগত হবে এবং (শুশ্রূষাকারীদেরকে) বলা হবে, আছে কোনও ঝাড়-ফুঁককারী? এবং মানুষ বুঝে ফেলবে যে, এটাই বিদায়ক্ষণ এবং পায়ের গোছার সাথে গোছা জড়িয়ে যাবে’। (সূরা কিয়ামা, আয়াত ২৬-২৯)

অন্যত্র ইরশাদ-
وَلَوْ تَرَى إِذِ الظَّالِمُونَ فِي غَمَرَاتِ الْمَوْتِ وَالْمَلَائِكَةُ بَاسِطُو أَيْدِيهِمْ أَخْرِجُوا أَنْفُسَكُمُ الْيَوْمَ تُجْزَوْنَ عَذَابَ الْهُونِ
'তুমি যদি সেই সময় দেখ (তবে বড় ভয়াল দৃশ্য দেখতে পাবে) যখন জালেমগণ মৃত্যুযন্ত্রণায় আক্রান্ত হবে এবং ফিরিশতাগণ তাদের হাত বাড়িয়ে (বলতে থাকবে), নিজেদের প্রাণ বের করো, আজ তোমাদেরকে লাঞ্ছনাকর শাস্তি দেওয়া হবে’। (সূরা আন'আম, আয়াত ৯৩)

আরও ইরশাদ-
فَلَوْلَا إِذَا بَلَغَتِ الْحُلْقُومَ (83) وَأَنْتُمْ حِينَئِذٍ تَنْظُرُونَ (84)
'অতঃপর যখন (কারও) প্রাণ কণ্ঠাগত হয়, এবং তোমরা (বিমর্ষ মনে তার দিকে) তাকিয়ে থাক, তখন এমন কেন হয় না যে.....?’ (সূরা ওয়াকি'আ, আয়াত ৮৩, ৮৪)
এসব আয়াতে মৃত্যুর অনিবার্যতা, মৃত্যুর কাছে মানুষের অসহায়ত্ব এবং মৃত্যুর কঠোর-কঠিন অবস্থার কথা তুলে ধরা হয়েছে।

سَكْرَة এর অর্থ মৃত্যুযন্ত্রণা। রূহ বের করে নেওয়ার সময় শরীরে প্রচণ্ড চাপ পড়ে। ভীষণ কষ্ট হয়। সে কষ্টে তার চোখ বিস্ফারিত হয়ে পড়ে। এক পর্যায়ে মৃত্যুপথযাত্রী সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলে। তার জ্ঞান ও চেতনা লোপ পেয়ে যায়। তখন কারও কিছু করার থাকে না। উপস্থিত লোকজন কেবল তাকিয়ে দেখতেই পারে, এর বেশি কিছু নয়।

মৃত্যুযন্ত্রণা মুমিন-কাফের সকলেরই হয়
মৃত্যুর এ যন্ত্রণা মুমিন-কাফের, পাপী-পুণ্যবান সকলেরই হয়। এ যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়েছিল সৃষ্টির সেরা ব্যক্তি এবং আল্লাহর হাবীব রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে পর্যন্ত, যেমনটা এ হাদীছসহ আরও বিভিন্ন হাদীছ দ্বারা জানা যায়। এর দ্বারা বোঝা যায় মৃত্যুকালে যন্ত্রণা ভোগ করাটা কারও মর্যাদার ঘাটতি প্রমাণ করে না। উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রাযি. বলেন-
مَا أَغْبِطُ أَحَدًا بِهَوْنِ مَوْتٍ بَعْدَ الَّذِي رَأَيْتُ مِنْ شِدَّةِ مَوْتِ رَسُولِ اللَّهِ ﷺ
'রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যে মৃত্যুকষ্ট দেখেছি, তারপর আমি কারও প্রতি তার সহজ মৃত্যুর কারণে ঈর্ষাবোধ করি না।’ (জামে' তিরমিযী: ৩০৯)
অর্থাৎ সর্বোত্তম মাখলুক ও সর্বাপেক্ষা মর্যাদাবান ব্যক্তি হওয়া সত্ত্বেও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে যখন মৃত্যুযন্ত্রণা ভোগ করতে হয়েছে, তখন আমি কারও জন্য যেমন মৃত্যুযন্ত্রণা অপসন্দ করি না, তেমনি আসানির সঙ্গে মৃত্যু হওয়ার কারণে কারও প্রতি আমি ঈর্ষাবোধ করি না (অর্থাৎ মনে করি না যে, সে খুব ভালো মানুষ হওয়ায় তার মৃত্যু এত সহজে হয়েছে। তাই আমার মৃত্যুও যদি তাঁর মতো হত, এমন কামনাও করি না)। বস্তুত মৃত্যুযন্ত্রণা মৃত্যুর সময়কার একটি স্বাভাবিক অবস্থা। কেবল মানুষ নয়; সকল প্রাণীকেই মৃত্যুকালে এ কষ্ট ভোগ করতে হয়।

মুমিন ব্যক্তির মৃত্যুযন্ত্রণা
উপরে বলা হয়েছে, মৃত্যুযন্ত্রণা মুমিন ও কাফের সকলেরই হয়। কোনও কোনও হাদীছের সঙ্গে এ কথাটি সাংঘর্ষিক মনে হয়। কেননা তা দ্বারা জানা যায়, মুমিনের মৃত্যু হায় আসানির সঙ্গে। কুরআন মাজীদের বিভিন্ন আয়াত দ্বারাও এর সমর্থন পাওয়া যায়। যেমন ইরশাদ হয়েছে-
الَّذِينَ تَتَوَفَّاهُمُ الْمَلَائِكَةُ طَيِّبِينَ يَقُولُونَ سَلَامٌ عَلَيْكُمُ ادْخُلُوا الْجَنَّةَ بِمَا كُنْتُمْ تَعْمَلُونَ
'তারা ওইসকল লোক, ফিরিশতাগণ যাদের রূহ কবজ করে তাদের পাক-পবিত্র থাকা অবস্থায়। তারা (তাদেরকে) বলে, তোমাদের প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক। তোমরা যে আমল করতে, তার ফলে জান্নাতে প্রবেশ করো।’ (সূরা নাহল, আয়াত ৩২)

অপর এক আয়াতে ইরশাদ-
إِنَّ الَّذِينَ قَالُوا رَبُّنَا اللَّهُ ثُمَّ اسْتَقَامُوا تَتَنَزَّلُ عَلَيْهِمُ الْمَلَائِكَةُ أَلَّا تَخَافُوا وَلَا تَحْزَنُوا وَأَبْشِرُوا بِالْجَنَّةِ الَّتِي كُنْتُمْ تُوعَدُونَ
'যারা বলেছে আমাদের রব আল্লাহ, তারপর তারা তাতে থাকে অবিচলিত, নিশ্চয়ই তাদের কাছে ফিরিশতা অবতীর্ণ হবে (এবং বলবে) যে, তোমরা কোনও ভয় করো না এবং কোনওকিছুর জন্য চিন্তিত হয়ো না আর আনন্দিত হয়ে যাও সেই জান্নাতের জন্য, যার ওয়াদা তোমাদেরকে দেওয়া হত’। (সূরা হা-মীম সাজদা, আয়াত ৩০)

মৃত্যুকালে ফিরিশতাগণ যাদের সালাম জানায় ও জান্নাতের সুসংবাদ দেয়, তাদের তো মৃত্যুকষ্ট ভোগ করার কথা নয়। নিরাপদে ও আরামের সঙ্গেই তাদের জান কবজ হওয়ার কথা। সুতরাং নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
فإن الرجل المؤمن إذا كان في انقطاع من الدنيا و إقبال من الآخرة نزل إليه ملائكة من السماء بيض الوجوه و كأن وجوههم الشمس معهم حنوط من حنوط الجنة و كفن من كفن الجنة حتى يجلسوا منه مد البصر ثم يجيء ملك الموت حتى يجلس عند رأسه فيقول : أيتها النفس الطيبة ! اخرجي إلى مغفرة من الله و رضوان قال فتخرج نفسه فتسيل كما تسيل القطرة من فم السقاء فيأخذها فإذا أخذها لم يدعها في يده طرفة عين حتى يأخذها فيجعلها في ذلك الكفن و في ذلك الحنوط و تخرج منها كأطيب نفحة ريح مسك......
'মুমিন ব্যক্তির যখন দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া ও আখিরাতের পথে যাত্রার সময় হয়, তখন আসমান থেকে তার কাছে একদল ফিরিশতা অবতীর্ণ হয়। তাদের চেহারা সূর্যের মতো উজ্জ্বল। তাদের কাছে থাকে জান্নাতের কর্পূর এবং জান্নাত থেকে নিয়ে আসা কাফন। তারা মুমূর্ষু ব্যক্তির দৃষ্টিসীমার শেষপ্রান্তে বসে পড়ে। তারপর মালাকুল মাওত তার কাছে আসেন এবং তার মাথার কাছে বসে বলেন, হে পবিত্র আত্মা। তুমি বের হয়ে এসো আল্লাহর পক্ষ থেকে মাগফিরাত ও তাঁর সন্তুষ্টির দিকে। তখন তার আত্মা নেমে আসে, যেমন মশকের মুখ থেকে পানির ফোঁটা নেমে আসে। মালাকুল মাওত সে আত্মা গ্রহণ করেন এবং চোখের পলকে তা ওই কাফন ও কর্পূরের ভেতর রেখে দেন। অমনি তা থেকে সর্বোৎকৃষ্ট মিশকের মতো সুগন্ধি বের হয়ে আসে...।’ (বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান: ৩৯০; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা: ১২০৫৯; আল-আজুররী, আশ-শারী'আহ: ৮৬৪; হাকিম, আল মুস্তাদরাক: ১০৭)

এর দ্বারা বোঝা যায় মুমিন ব্যক্তির মৃত্যুযন্ত্রণা ভোগ করতে হয় না। তার প্রাণ পানির ফোঁটার মতো সহজেই বের হয়ে যায়। অথচ আলোচ্য হাদীছসহ বিভিন্ন হাদীছ দ্বারা মুমিন-কাফের নির্বিশেষে সকলেরই মৃত্যুযন্ত্রণা ভোগ করতে হয় বলে জানা যায়। এর কী সমাধান?

আসলে মৃত্যুযন্ত্রণা দু'রকম। এক যন্ত্রণা কেবল শারীরিক। আরেক যন্ত্রণা হল শারীরিক ও আত্মিক উভয়রকম। মুমিন ব্যক্তির যে মৃত্যুযন্ত্রণা হয়, তা কেবল শারীরিক। রূহানী ও আত্মিকভাবে তার কোনও কষ্ট হয় না। যেসব আয়াত ও হাদীছ দ্বারা আসানির সঙ্গে তার মৃত্যু হয় বলে জানা যায়, তার সম্পর্ক রূহের সঙ্গে। আর যা দ্বারা সে কষ্ট পায় বলে বোঝা যায়, তার সম্পর্ক দেহের সঙ্গে। মৃত্যুকালে দৈহিক কষ্ট মুমিন ব্যক্তিরও হয় এবং কাফের ব্যক্তিরও। তবে উভয়ের কষ্টের মধ্যে পার্থক্য আছে। মুমিন ব্যক্তির যে কষ্ট হয়, তা তার জন্য রহমতস্বরূপ। কেননা তার জন্য এটা আল্লাহ তা'আলার কাছে মর্যাদা বৃদ্ধির অছিলা। কোনও কোনও বর্ণনায় আছে, যদি কোনও মুমিন ব্যক্তি নিজ আমল দ্বারা তার জন্য জান্নাতের নির্ধারিত মর্যাদায় উপনীত হতে না পারে, তবে তার মৃত্যু কঠিন করে দেওয়া হয়। তাকে তার মৃত্যুযন্ত্রণার বিনিময়ে সেই মর্যাদায় পৌঁছিয়ে দেওয়া হয়। তাছাড়া মৃত্যুযন্ত্রণা পাপী মুমিনদের জন্য গুনাহ মাফেরও একটা ব্যবস্থা।

কাফের ব্যক্তির মৃত্যুযন্ত্রণা
কাফের ও অবিশ্বাসী ব্যক্তির মৃত্যুযন্ত্রণা মুমিনের মৃত্যুযন্ত্রণার মতো নয়। কারণ তার মৃত্যুকালে দৈহিক ও আত্মিক উভয়রকম কষ্ট হয়। তা কেবল আযাবই আযাব। তার বিনিময়ে তার কিছু অর্জিত হয় না। কেবল শাস্তিভোগই হয়। মৃত্যুকালে তাকে তার জাহান্নামের ঠিকানা দেখিয়ে দেওয়া হয়। সে দেখতে পায় দুনিয়ার অর্থ-সম্পদ, আত্মীয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধব সব ছেড়ে এমন এক জায়গায় তাকে যেতে হচ্ছে, যেখানে তার জন্য রয়েছে কঠিন আযাবের ব্যবস্থা। এর ফলে দৈহিক ও মানসিক উভয়রকম কষ্ট তার রয়েছে একত্র হয়ে যায়। তদুপরি মুমিনদের ক্ষেত্রে জান কবজকারী ফিরিশতাদের দয়ামায়া থাকে, তাদের ক্ষেত্রে তা মোটেই থাকে না। তারা নির্মমভাবে তাদের প্রাণ সংহার করে। ইরশাদ হয়েছে-
وَلَوْ تَرَى إِذْ يَتَوَفَّى الَّذِينَ كَفَرُوا الْمَلَائِكَةُ يَضْرِبُونَ وُجُوهَهُمْ وَأَدْبَارَهُمْ
'তুমি যদি দেখতে, ফিরিশতাগণ কাফেরদের চেহারা ও পিঠে আঘাত করে করে তাদের প্রাণ হরণ করছিল’। (সূরা আনফাল, আয়াত ৫০)

হাদীছে ইরশাদ হয়েছে-
وَأَمَا الْعَبْدُ الْكَافِرُ إِذَا كَانَ فِي انْقِطَاعٍ مِنَ الدُّنْيَا، وَإِقْبَالٍ مِنَ الْآخِرَةِ نَزَلَ إِلَيْهِ مِنَ السَّمَاءِ مَلَائِكَةٌ سُودُ الْوُجُوهِ ومَعَهُمُ الْمُسُوحُ حَتَّى يَجْلِسُوا مِنْهُ مَدَّ الْبَصَرِ، ثُمَّ يَأْتِيَهِ مَلَكُ الْمَوْتِ فَيَجْلِسُ عِنْدَ رَأْسِهِ فَيَقُولُ: أَيَّتُهَا النَّفْسُ الْخَبِيثَةُ اخْرُجِي إِلَى سَخَطِ اللهِ وَغَضَبِهِ". قَالَ:" فَتَفَرَّقُ فِي جَسَدِهِ فَيَنْتَزِعُهَا، وَمَعَهَا الْعَصْبُ وَالْعُرُوقُ كَمَا يُنْتَزَعُ السَّفُّودُ مِنَ الصُّوفِ الْمَبْلُولِ فَيَأْخُذُونَهَا فَيَجْعَلُونَهَا فِي تِلْكَ الْمُسُوحِ". قَالَ:" وَيَخْرُجُ مِنْهَا أَنْتَنُ مِنْ جِيفَةٍ….
'আর কাফের ব্যক্তির যখন দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া ও আখিরাতের প্রতি যাত্রার সময় হয়, তখন আসমান থেকে কালো চেহারার ফিরিশতাগণ নেমে আসে। তাদের কাছে থাকে মোটা কাপড়। তারা মুমূর্ষু ব্যক্তির দৃষ্টিসীমার শেষপ্রান্তে বসে যায়। তারপর তার কাছে মালাকুল মাওত আসেন। তিনি তার মাথার কাছে বসে বলেন, হে নিকৃষ্ট আত্মা। বের হয়ে এসো আল্লাহর ক্রোধ ও গযবের দিকে। তখন সে আত্মা তার শরীরের ভেতর ছড়িয়ে পড়ে। তার সঙ্গে শিরা-উপশিরাসমূহ জড়িয়ে থাকে। মালাকুল মাওত তাকে টেনে-হেঁচড়ে বের করেন, যেমন ভেজা পশমের ভেতর থেকে লৌহশলাকা বের করা হয়। তারপর ফিরিশতাগণ ওই রূহ গ্রহণ করে এবং সেই মোটা কাপড়ের ভেতর রেখে দেয়। তখন তা থেকে মড়কের চেয়েও বেশি দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে’। (বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান ৩৯০; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা: ১২০৫৯; আল-আজুররী, আশ-শারী'আহ: ৮৬৪; হাকিম, আল মুস্তাদরাক: ১০৭)

মৃত্যুযন্ত্রণার ভয়াবহতা
মুমিন ও কাফেরের মৃত্যুকষ্টের মধ্যে পার্থক্য তো অবশ্যই আছে, যেমনটা উপরে বলা হল। তবে মৃত্যুকালে দৈহিক কষ্ট ভোগ করতে হয় সকলকেই। এ কষ্ট প্রাকৃতিক। কেবল মানুষ নয়, পশুপাখির বেলায়ও মৃত্যুকষ্ট এক কঠিন বাস্তবতা। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-
كُلُّ نَفْسٍ ذَائِقَةُ الْمَوْتِ
'প্রত্যেক প্রাণীর জন্য মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ অনিবার্য’। (সূরা আলে ইমরান, আয়াত ১৮৫)

মৃত্যুকষ্ট বড়ই কঠিন। রূহ মানুষের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, শিরা-উপশিরা ও প্রতিটি কোষ থেকে বের করে নেওয়া হয়। তখনকার বেদনা কাঁচি দিয়ে কাটা ও করাত দিয়ে চেরা অপেক্ষাও বেশি যাতনাময়। কিন্তু মুমূর্ষু ব্যক্তির শরীর ভেঙ্গে পড়ায় ও শক্তি নিঃশেষ হয়ে যাওয়ায় সে তখন না পারে ছটফট করতে, না পারে চিৎকার করতে। তা করতে না পারায় কষ্ট আরও বৃদ্ধি পায়।

শাদ্দাদ ইবন আওস রাযি. বলেন, মুমিন ব্যক্তির জন্য দুনিয়া ও আখিরাতে মৃত্যুই হল সর্বাপেক্ষা ভয়ংকর জিনিস। এটা ডেকচিতে পানি ফোটার চেয়েও প্রচণ্ড।

হযরত উমর ফারুক রাযি. কা'ব আল-আহবার রহ.-কে মৃত্যুযন্ত্রণা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেছিলেন, হে আমীরুল মুমিনীন! মৃত্যু হল কাঁটাভরা কোনও ডালের মতো। যে ডালটি কোনও ব্যক্তির পেটের ভেতর ঢুকিয়ে দেওয়া হল। তারপর তার কাটাগুলো ওই ব্যক্তির প্রত্যেক শিরা-উপশিরায় বিদ্ধ হল। এ অবস্থায় ওই ডালটি সজোরে টান দেওয়া হল। আর সেটি ওই শিরা-উপশিরাসমূহ ছিন্নভিন্ন করে বের হয়ে আসল। এ অবস্থায় ওই ব্যক্তির যন্ত্রণা কেমন হতে পারে?

মৃত্যুকালে হযরত আমর ইবনুল 'আস রাযি. তাঁর কষ্টের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলছিলেন, মনে হচ্ছে আমি যেন কোনও সুইয়ের ছিদ্র দিয়ে শ্বাস গ্রহণ করছি আর যেন কোনও কাঁটাযুক্ত ডাল আমার পায়ের ভেতর থেকে মাথার তালুর দিকে টেনে আনা হচ্ছে।

হযরত আনাস রাযি. বলেন, মানুষ তার জন্মের পর মৃত্যুযন্ত্রণার চেয়ে বেশি কষ্টকর কোনও অবস্থার সম্মুখীন কখনও হয় না।

সুফয়ান ছাওরী রহ. একবার অসুস্থ হয়ে পড়লে তিনি তার গাল মাটিতে লাগিয়ে দেন। তারপর বলতে থাকেন, মৃত্যু কতইনা কঠিন! সুফয়ান ছাওরী রহ. বলেন, আমার কাছে মৃত্যুযন্ত্রণার চেয়ে কঠিন আর কিছুই নেই। আমার ভয়, আমি তা সহজ করে দেওয়ার জন্য দু'আ করি আর সে দু'আ কবুল করা না হয়। ফলে মৃত্যুযন্ত্রণাকালে তখন আমি শয়তানের পরীক্ষার মধ্যে পড়ে যাই!

বলা হয়ে থাকে, কোনও মৃতব্যক্তি যদি কবর থেকে ফিরে আসত, তারপর দুনিয়াবাসীকে মৃত্যুযন্ত্রণার বর্ণনা দিত, তবে কারও পক্ষে ইহজীবন উপভোগ্য থাকত না। ঘুমের আরাম সকলের জন্য হারাম হয়ে যেত। আরও বলা হয়, মৃত্যুযন্ত্রণা যে কত কঠিন, দুর্বল মানুষ যদি তা আগে থেকে বুঝত, তবে এই এক চিন্তায়ই তার দুনিয়ার জীবন বিষাদময় হয়ে যেত। সে চিন্তা তার যাবতীয় সুখ-শান্তি মাটি করে দিত।

তবে যেহেতু আখিরাতের শস্যক্ষেত্র, তাই মৃত্যুর কঠিন যন্ত্রণা মানুষকে তার জীবদ্দশায় পুরোপুরি বুঝতে দেওয়া হয় না। কেননা তা বুঝতে পারলে তার দ্বারা জীবদ্দশায় কাজকর্ম করা সম্ভব হত না। সে দুনিয়া থেকে সম্পূর্ণরূপে বিমুখ হয়ে পড়ত। কাজকর্ম ছেড়ে দিয়ে বৈরাগী হয়ে যেত। কিন্তু তা ইসলামের শিক্ষা নয়। ইসলাম মানুষকে ইহজীবন সুন্দর ও সুষ্ঠুরূপে যাপন করতে বলে।

আখিরাতের জীবনই যেহেতু আসল জীবন, তাই ইসলাম মানুষকে সতর্ক করে দেয় যেন ইহজীবনের মোহে সে সম্পূর্ণরূপে মুগ্ধ হয়ে না পড়ে, যেন সে আখিরাতকে ভুলে না যায়। তা যাতে ভুলে না যায়, সেজন্য মৃত্যু দ্বারাও তাকে উপদেশ গ্রহণ করতে বলা হয়েছে। বলা হয়েছে-
كَفَى بِالْمَوْتِ وَاعِظًا
'উপদেশদাতারূপে মৃত্যুই যথেষ্ট’। (বায়হাকী, শু'আবুল ঈমান: ১০৭২; বাগাবী, শারহুস সুন্নাহ: ১৪৪৭)

নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
أَكْثِرُوا ذِكْرَ هَاذِمِ اللَّذَّاتِ يَعْنِي الْمَوْتَ
'তোমরা স্বাদ ও আনন্দ ধ্বংসকারী বিষয় অর্থাৎ মৃত্যুর কথা বেশি বেশি স্মরণ করো’।
( জামে' তিরমিযী: ২৩০৭; সুনানে নাসাঈ: ১৮২৪; মুসান্নাফে ইবন আবী শায়বা: ৩৪৩২৬; মুসনাদে আহমাদ: ৭৯১৩; মুসনাদুল বাযযার: ৬৯৮৭; সহীহ ইবনে হিব্বান: ২৯৯২; তাবারানী, আল মু'জামুল আওসাত: ৫৭৮০; হাকিম, আল মুস্তাদরাক: ৭৯০৯; বায়হাকী, শুআবুল ঈমান: ৮০২)

মৃত্যুকালে শয়তানের ওয়াসওয়াসা থেকে বাঁচা ও মৃত্যুকষ্ট লাঘবের দু'আ
মৃত্যুকালে শয়তান ঈমানদারের ঈমান হরণের জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করে। কারণ এটা শয়তানের জন্য সর্বশেষ সুযোগ। মৃত্যুর পর শয়তান আর তাকে পাবে না। তাই শেষবেলার এ সুযোগে ঈমানদার ব্যক্তির ঈমান নষ্ট করার জন্য সে নানা ফন্দি আঁটে। তার কথা শুনলে মৃত্যুযন্ত্রণা লাঘব হবে বলে মিথ্যা আশ্বাস দেয়। যার ঈমান নড়বড়ে, সে তার সেই ছলনায় পড়ে যায়। ফলে ঈমানহারা হয়ে কবরে যেতে হয়। তাই মুমিন ব্যক্তির উচিত মৃত্যুকালে যাতে সে শয়তানের ছলনা থেকে বাঁচতে পারে, সেজন্য আল্লাহ তাআলার কাছে দু'আ করা। হাদীছে এ বিষয়ে দু'আ শিক্ষা দেওয়া হয়েছে–
اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوْذُ بِكَ أَنْ يَتَخَبَّطَنِيَ الشَّيْطَانُ عِنْدَ الْمَوْتِ
'হে আল্লাহ! আমি আপনার আশ্রয় গ্রহণ করছি, যাতে মৃত্যুকালে শয়তান আমাকে বিপথগামী করতে না পারে’। (সুনানে নাসাঈ ৫৫৩১; মুসনাদে আহমাদ: ৮৬৫০; সুনানে আবূ দাউদ: ১৫৫২; তাবারানী, আল মু'জামুল কাবীর: ৩৮১; হাকিম, আল মুস্তাদরাক: ১৯৪৮)

আরেকটি দু'আ হল-
اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنْ عَذَابِ الْقَبْرِ وَمِنْ عَذَابِ النَّارِ وَمِنْ فِتْنَةِ الْمَحْيَا وَالْمَمَاتِ وَمِنْ فِتْنَةِ الْمَسِيحِ الدَّجَّالِ
'হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে আশ্রয় চাই কবরের আযাব থেকে, জাহান্নামের আযাব থেকে, জীবন ও মরণের পরীক্ষাসমূহ থেকে এবং কানা দাজ্জালের ফিতনা থেকে’।
(সহীহ বুখারী: ১৩৭৭; সহীহ মুসলিম: ৫৮৮; জামে তিরমিযী: ৩৪৯৫; সুনানে নাসাঈ: ৫৫০৯; সুনানে আবূ দাউদ: ১৫৪২; সুনানে ইবন মাজাহ ৯০৯; মুসনাদে আহমাদ: ২৩৪১)

দু'আ করা উচিত মৃত্যুযন্ত্রণা লাঘবের জন্যও। কেননা মৃত্যুকষ্টে ধৈর্যহারা হলে শয়তানের ফাঁদে পড়ার আশঙ্কা থাকে। তাছাড়া মানুষ এমনিতেও বড় দুর্বল। মৃত্যুর কঠিন যন্ত্রণা সহ্য করার মতো শক্তি তার নেই। তাই এ মুহূর্তে আল্লাহ তা'আলার সাহায্য বড় বেশি দরকার। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেও মৃত্যুযন্ত্রণায় আল্লাহ তা'আলার সাহায্য চেয়েছেন, যেমনটা আলোচ্য হাদীছে আছে। তিনি দু'আ করেছেন- اللَّهُمَّ أَعِنِّي عَلَى غَمَرَاتِ الْمَوْتِ أَوْ سَكَرَاتِ الْمَوْتِ (হে আল্লাহ! আপনি মৃত্যুকষ্ট ও মৃত্যুর যন্ত্রণায় আমাকে সাহায্য করুন)।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. মৃত্যু বড় যাতনাময়।

খ. মৃত্যুর কষ্ট সাধারণ মানুষ তো বটেই, নবীগণকেও ভোগ করতে হত।

গ. মৃত্যুকালে ভেজা হাত দিয়ে মুমূর্ষু ব্যক্তির চেহারা মুছে দেওয়া যেতে পারে।

ঘ. মৃত্যুযন্ত্রণায় আল্লাহ তা'আলার সাহায্য পাওয়ার জন্য হাদীছে বর্ণিত দু'আটি পড়া আমল করা উচিত।

ঙ. কারও মৃত্যুযন্ত্রণা দেখে তার সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করতে নেই।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
শামাঈলে তিরমিযী - হাদীস নং ৩৮৭ | মুসলিম বাংলা