আশ-শামাঈলুল মুহাম্মাদিয়্যাহ- ইমাম তিরমিযী রহঃ

শামাইলে নববীর পরিচ্ছেদসমূহ

হাদীস নং: ৩৭৪
রাসূলুল্লাহ -এর জীবিকার বিবরণ
৩৭৪। মুহাম্মাদ ইবন বাশ্শার (রাহঃ)... খালিদ ইবন উমায়র ও শুওয়ালিসা আবুর-রিকাদ (রাহঃ) থেকে বর্ণনা করেন, তাঁরা বলেন, হযরত উমর ইবন খাত্তাব (রাযিঃ) উতবা ইবন গাযওয়ানকে অভিযানে প্রেরণ করলেন এবং বললেন : তুমি ও তোমার সঙ্গীরা আরব সীমান্ত পার হয়ে আজম সীমান্তবর্তী জনপদের দিকে অগ্রসর হবে। অতএব তাঁরা যখন জনপদের উটের চারণভূমি পার হয়ে নরম পাথুরে ভূমিতে অবতরণ করলেন তখন জিজ্ঞাসা করলেন, এটা কোন্ জায়গা? জনগণ বললো, এটা বসরা। এরপর তাঁরা আরো অগ্রসর হয়ে একটি সরু ছোট সাঁকোর নিকটবর্তী হয়ে বললেন, এ জায়গা সম্বন্ধে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সুতরাং এখানে অবতরণ কর। এরপর দীর্ঘ হাদীস বর্ণনা করলেন। অতঃপর উতবা ইবন গাযওয়ান (রাযিঃ) বললেনঃ তোমরা কি আমাকে দেখনি ঐ সময়ে যখন আমি রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) -এর সাত সঙ্গীর একজন ছিলাম, আর গাছের পাতা ভিন্ন আমাদের খাবার আর কিছুই ছিল না। গাছের পাতা খাওয়ার কারণে আমাদের মুখ গহবরে ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছিল। একটি চাদর পেয়ে সাদ এবং আমি ভাগ করে নিয়েছিলাম। আজ আমাদের ঐ সাতজনের প্রত্যেকেই কোনো না কোনো শহরের অধিকর্তা। অচিরেই তোমরা আমাদের পরবর্তী শাসকদের কার্যকলাপও পরখ করতে পারবে।
حَدَّثَنَا مُحَمَّدُ بْنُ بَشَّارٍ قَالَ : حَدَّثَنَا صَفْوَانُ بْنُ عِيسَى ، قَالَ : حَدَّثَنَا عَمْرُو بْنُ عِيسَى أَبُو نَعَامَةَ الْعَدَوِيُّ قَالَ : سَمِعْتُ خَالِدَ بْنَ عُمَيْرٍ ، وَشُوَيْسًا أَبَا الرَّقَادِ ، قَالاَ : بَعَثَ عُمَرُ بْنُ الْخَطَّابِ عُتْبَةَ بْنَ غَزْوَانَ وَقَالَ : انْطَلِقْ أَنْتَ وَمَنْ مَعَكَ ، حَتَّى إِذَا كُنْتُمْ فِي أَقْصَى بِلاَدِ الْعَرَبِ ، وَأَدْنَى بِلاَدِ الْعَجَمِ فَأَقْبِلُوا ، حَتَّى إِذَا كَانُوا بِالْمِرْبَدِ وَجَدُوا هَذَا الْكِذَّانَ ، فَقَالُوا : مَا هَذِهِ ؟ قَالُوا : هَذِهِ الْبَصْرَةُ فَسَارُوا حَتَّى إِذَا بَلَغُوا حِيَالَ الْجِسْرِ الصَّغِيرِ ، فَقَالُوا : هَهُنَا أُمِرْتُمْ ، فَنَزَلُوا - فَذَكَرُوا الْحَدِيثَ بِطُولِهِ - قَالَ : فَقَالَ عُتْبَةُ بْنُ غَزْوَانَ : لَقَدْ رَأَيْتُنِي وَإِنِّي لَسَابِعُ سَبْعَةٍ مَعَ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَا لَنَا طَعَامٌ إِلاَ وَرَقَ الشَّجَرِ حَتَّى تَقَرَّحَتْ أَشْدَاقُنَا ، فَالْتَقَطْتُ بُرْدَةً قَسَمْتُهَا بَيْنِي وَبَيْنَ سَعْدٍ ، فَمَا مِنَّا مِنْ أَولَئِكَ السَّبْعَةِ أَحَدٌ إِلَّا وَهُوَ أَمِيرُ مِصْرٍ مِنَ الأَمْصَارِ وَسَتُجَرِّبُونَ الْأُمَرَاءَ بَعْدَنَا.

হাদীসের ব্যাখ্যা:

এখানে হাদীসটি সংক্ষিপ্ত আকারে আনা হয়েছে। অন্যান্য বর্ণনার আলোকে নিম্নে পূর্ণাঙ্গ হাদীস ও তার ব্যাখ্যা পেশ করা হলো।

উতবা ইবন গাযওয়ান রাযি. বসরার গভর্নর থাকাকালে ভাষণ দেন। তিনি আল্লাহ তা'আলার হামদ ও ছানা পাঠ করলেন। তারপর বললেন, দুনিয়া তো বিচ্ছেদের ঘোষণা দিয়ে দিয়েছে। সে খুব দ্রুত ছুটে চলেছে। তার কেবল অতটুকুই বাকি আছে, যতটুকু পাত্র থেকে তার মালিক পান করার পর পাত্রের তলায় অবশিষ্ট থাকে। নিশ্চয়ই তোমরা এখান থেকে স্থানান্তরিত হবে এক স্থায়ী নিবাসের দিকে। সুতরাং তোমরা তোমাদের কাছে উৎকৃষ্ট যা–কিছু আছে তা নিয়ে স্থানান্তরিত হও। কেননা আমাদের কাছে বর্ণনা করা হয়েছে যে, জাহান্নামের তীর থেকে যদি পাথর নিক্ষেপ করা হয় আর তা সত্তর বছর নিচের দিকে গড়াতে থাকে, তারপরও তা তার তলদেশ স্পর্শ করতে পারে না। আল্লাহর কসম! অবশ্যই তা ভরে ফেলা হবে। তোমরা কি বিস্ময় বোধ করছ?
আমাদের কাছে বর্ণনা করা হয়েছে যে, জান্নাতের কপাটসমূহের মধ্য থেকে দুই কপাটের মধ্যবর্তী ব্যবধান চল্লিশ বছরের দূরত্বের সমান। নিশ্চয়ই এমন একদিন অবশ্যই আসবে, যখন তা ভাঁড়ে পরিপূর্ণ হয়ে যাবে।
(এমন একদিন গেছে, যখন) আমি নিজেকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে সাত ব্যক্তির মধ্যে সপ্তম জনরূপে দেখেছি। তখন আমাদের গাছের পাতা ছাড়া কোনও খাদ্য ছিল না। এমনকি (তা খেতে খেতে আমাদের চোয়াল ক্ষতবিক্ষত হয়ে গিয়েছিল। এ অবস্থায় আমি একটি চাদর পেয়েছিলাম। আমি সেটি ফেড়ে আমার ও সা'দ ইবন মালিকের মধ্যে ভাগ করে নিয়েছিলাম। আমি সেটির অর্ধেক দিয়ে লুঙ্গি বানাই এবং সা'দ ইবনে মালিকও অর্ধেক দিয়ে লুঙ্গি বানান। আর আজকে আমাদের প্রত্যেকেরই ভোর হয় এমন অবস্থায় যে, সে কোনও না কোনও শহরের শাসনকর্তা। আমি নিজের কাছে বড় হওয়া ও আল্লাহর কাছে ছোট হওয়া থেকে আল্লাহ তা'আলার আশ্রয় গ্রহণ করছি।

হাদীসের ব্যাখ্যাঃ
এ বর্ণনাটি বসরায় প্রদত্ত হযরত উতবা ইবন গাযওয়ান রাযি.-এর একটি ভাষণের অংশবিশেষ। তিনি আল্লাহ তা'আলার হামদ ও ছানা বর্ণনা করার পর প্রথমে কিয়ামতের নৈকট্য সম্পর্কে সতর্ক করলেন। দুনিয়ার যে আর বেশি দিন বাকি নেই, সময় দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে, কিয়ামতের কেবল অতটুকুই বাকি আছে, যতটুকু পানি পান করার পর পাত্রের তলায় অবশিষ্ট থাকে। পাত্রের তলায় কতটুকুই বা অবশিষ্ট থাকে? আর কিয়ামত সংঘটিত হওয়াই তো শেষ কথা নয়। তারপর ভিন্ন এক জগৎ আছে। সকলকে এই ক্ষণস্থায়ী জগৎ ছেড়ে ওই স্থায়ী জগতে পাড়ি জমাতে হবে। সেজন্য প্রিপারেশন দরকার। তিনি বললেন-
(সুতরাং তোমরা তোমাদের কাছে উৎকৃষ্ট যা-কিছু আছে তা নিয়ে স্থানান্তরিত হও)। অর্থাৎ আখিরাতের প্রস্তুতির জন্য সৎকর্মে নিয়োজিত থাকো। আল্লাহর কাছে যত পার পুণ্য জমা করে নাও। পুণ্য সঞ্চয়ের সামর্থ্যকেই তিনি 'উৎকৃষ্ট যা-কিছু আছে' বলে ব্যক্ত করেছেন। যেন বলতে চাচ্ছেন, এমনভাবে পুণ্য সঞ্চয়ে তৎপর থাকো, যেন তা সঞ্চিত হয়েই গেছে। আর সেই সঞ্চিত পুণ্য নিয়ে আখিরাতের পথে পাড়ি জমাও।

ছাওয়াব ও পূণ্য সঙ্গে নিয়ে কেন যেতে হবে? তা যেতে হবে এ কারণে যে, আখিরাতে কর্মের প্রতিদানস্বরূপ জান্নাতের নি'আমত ও জাহান্নামের শাস্তি উভয় ব্যবস্থাই আছে। যে ব্যক্তি সৎকর্মে নিয়োজিত থেকে ছাওয়াবের সঞ্চয় নিয়ে যাবে, সে অনন্তকাল জান্নাতের অফুরন্ত নি'আমত ভোগ করতে থাকবে। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি পাপাচারে লিপ্ত থাকবে, তাকে আখিরাতে অনন্তকাল জাহান্নামের দুর্বিষহ শাস্তি ভোগ করতে হবে।

জাহান্নামের গভীরতা
সে জাহান্নাম কেমন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীছ থেকে তার খানিকটা বর্ণনা তিনি তাঁর এ বক্তব্যে প্রদান করেছেন। তিনি বলেন-
(জাহান্নামের তীর থেকে পাথর নিক্ষেপ করা হয় আর তা সত্তর বছর নিচের দিকে গড়াতে থাকে, তারপরও তা তার তলদেশ স্পর্শ করতে পারে না)। এর দ্বারা জাহান্নামের গভীরতা সম্পর্কে একটা ধারণা দেওয়া হয়েছে। একটা পাথর সত্তর বছর কাল যদি নিচের দিকে নামতে থাকে, ভাবা যায় তা কতদূর পর্যন্ত নামতে পারে? কত লক্ষ মাইল পর্যন্ত? বলা হয়েছে, তারপরও তা জাহান্নামের তলদেশ স্পর্শ করতে পারবে না। মানে তার গভীরতা আরও অনেক বেশি। এ তো গেল জাহান্নামের গভীরতার কথা। তাহলে তার দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ হবে কতখানি? সে এক অকল্পনীয় বিশাল বিস্তৃত অগ্নিকৃত। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-
{كَلَّا لَيُنْبَذَنَّ فِي الْحُطَمَةِ (4) وَمَا أَدْرَاكَ مَا الْحُطَمَةُ (5) نَارُ اللَّهِ الْمُوقَدَةُ (6) الَّتِي تَطَّلِعُ عَلَى الْأَفْئِدَةِ (7) إِنَّهَا عَلَيْهِمْ مُؤْصَدَةٌ (8) فِي عَمَدٍ مُمَدَّدَةٍ} [الهمزة: 4 - 9]
কক্ষনও নয়। তাকে তো এমন স্থানে নিক্ষেপ করা হবে, যা চূর্ণ-বিচূর্ণ করে ফেলে। তুমি কি জান সেই চূর্ণ-বিচূর্ণকারী জিনিস কী? তা আল্লাহর প্রজ্বলিত আগুন, যা হৃদয় পর্যন্ত পৌঁছে যাবে। নিশ্চয়ই তা তাদের উপর আবদ্ধ করে রাখা হবে। যখন তারা (আগুনের) লম্বা-চওড়া স্তম্ভসমূহের মধ্যে (পরিবেষ্টিত) থাকবে।

এ বিশাল বিস্তৃত সুগভীর জাহান্নাম পাপীদের দ্বারা ভরে ফেলা হবে। হযরত উতবা রাযি. বলেন-(আল্লাহর কসম! অবশ্যই তা ভরে ফেলা হবে। তোমরা কি বিস্ময় বোধ করছ?)। এতবড় জাহান্নাম কিভাবে ভরে ফেলা হবে তা নিয়ে কারও খটকা লাগতে পারে। তাই তিনি কসম করে বলছেন যে, অবশ্যই তা ভরে ফেলা হবে। আর এতে আশ্চর্যের কিছু নেই। আল্লাহ তা'আলার কুদরত ও ক্ষমতার কোনও সীমা নেই। তাঁর ক্রোধ ও শাস্তিদানের শক্তিও অপরিসীম। সৃষ্টির শুরু থেকে এ পর্যন্ত কত জিন্ন ও মানব দুনিয়া এসেছে। কার পক্ষে তা গুনে বের করা সম্ভব?

জাহান্নামে জাহান্নামী ব্যক্তির শরীরের বিশালতা
এই অসংখ্য জিন্ন ও মানুষের মধ্যে মুমিন ও নেককারদের তুলনায় কাফের ও ফাসেকদের সংখ্যাই তো বেশি। তদুপরি এক একজন পাপীকে বিশাল দেহধারী বানিয়ে ফেলা হবে। এতবড় শরীর তাদের হবে যে, একেকটা দাঁত হবে পাহাড়ের মতো। এক হাদীছে আছে-
ضِرْسُ الْكَافِرِ، أَوْ نَابُ الْكَافِرِ، مِثل أحدٍ، وَغِلَظ جِلْدِهِ مَسِيرَةُ ثَلاث
কাফেরের মাড়ির দাঁত বা তার দুপাশের সরু দাঁত হবে উহুদ পাহাড়ের মতো। আর তার চামড়া মোটা হবে তিন দিনের পথের দূরত্ব সমান।

তার দুই কাঁধের মধ্যবর্তী প্রশস্ততা সম্পর্কে হাদীছে এসেছে-
ما بَيْنَ مَنكِبي الْكَافِرِ مَسِيرَةُ ثَلاثَةِ أَيَّام للرَّاكِبِ الْمُسْرع.
"কাফেরের দুই কাঁধের মধ্যবর্তী দূরত্ব হবে দ্রুতগামী আরোহীর তিন দিনের পথচলার দূরত্ব পরিমাণ।"

তার চামড়া ও তার বসার স্থান সম্পর্কে বলা হয়েছে-
“কিয়ামতের দিন কাফেরের মাড়ির দাঁত হবে উহুদ পাহাড়ের মতো। তার চামড়ার পুরুত্ব হবে সত্তর হাত। তার ঊরু হবে ওয়ারিকান পাহাড়ের মতো। তার বসার স্থান হবে এখান থেকে অর্থাৎ মসজিদে নববী থেকে রবযার মধ্যবর্তী পরিসর পর্যন্ত।

তার কানের লতি ও কাঁধের মধ্যবর্তী দূরত্ব সম্পর্কে বলা হয়েছে-
إِنَّ بَيْنَ شَحْمَةِ أَذْنِ أَحَدِهِمْ وَبَيْنَ عَاتِقِهِ مَسِيرَةَ سَبْعِينَ خَرِيفا، تَجْرِي فِيهَا أَوْدِيَة القيح والدم.
তাদের অর্থাৎ কাফেরদের কানের লতি ও কাঁধের মধ্যবর্তী দূরত্ব হবে সত্তর বছরের পথের দূরত্ব পরিমাণ। তাতে পুঁজ ও রক্তের নহর প্রবাহিত হবে।

এই যাদের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের বিস্তৃতি, তাদের গোটা শরীর কত বড় হবে তা কি ভাবা যায়? এরকম অসংখ্য জিন্ন ও মানুষ দ্বারা অতবড় বিশাল জাহান্নাম ভরে ফেলায় আশ্চর্যের কিছু নেই। তবে হাঁ, জাহান্নামের ক্ষুধা অনিঃশেষ। সমস্ত কাফের জিন্ন ও মানুষকে জাহান্নামে নিক্ষেপের পরও তার ক্ষুধা মিটবে না। ইরশাদ হয়েছে-
يَوْمَ نَقُولُ لِجَهَنَّمَ هَلِ امْتَلَاْتِ وَتَقُولُ هَلْ مِنْ مزيد
সেই সময় স্মরণ রাখ, যখন আমি জাহান্নামকে বলব, তুমি কি ভরে গেছ? সে বলবে, আরও কিছু আছে কি?

অতঃপর আল্লাহ তা'আলা নিজ কুদরত দ্বারা তার ক্ষুধা মেটানোর ব্যবস্থা করবেন।

জান্নাতের একেকটি দরজা কত বড়
জাহান্নামের এ বিবরণ শুনলে যে-কারওই ভয়ে কেঁপে ওঠার কথা। নিজের সম্পর্কেও আশঙ্কা জাগা স্বাভাবিক যে, না জানি আমার কী পরিস্থিতি হয়। মাত্রাতিরিক্ত ভয় মানুষের মনে হতাশা জন্মায়। তাই এ ভয়ের পাশাপাশি আশার বাণীও শোনানো দরকার। সুতরাং হযরত উতবা ইবন গাযওয়ান রাযি. জাহান্নামের এ বিভীষিকাময় পরিস্থিতির কথা শোনানোর পর শ্রোতাদেরকে জান্নাত সম্পর্কেও খানিকটা শুনিয়ে দেন। তিনি বলেন--
(আমাদের কাছে বর্ণনা করা হয়েছে যে, জান্নাতের কপাটসমূহের মধ্য থেকে দুই কপাটের মধ্যবর্তী ব্যবধান চল্লিশ বছরের দূরত্বের সমান)। কপাটসমূহ বলা হয়েছে এ কারণে যে, জান্নাতের দরজা ৮টি। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
في الْجَنَّةِ ثَمَانِيَةُ أَبْوَابٍ فِيهَا بَابٌ يُسَمَّى الرَّيَّانَ، لَا يَدْخُلُهُ إِلَّا الصَّائمُونَ
জান্নাতে আটটি দরজা আছে। তার একটি দরজার নাম রায়্যান। রোযাদারগণ সে দরজা দিয়ে প্রবেশ করবে।

সে আট দরজার প্রত্যেকটির দুই কপাটের মধ্যবর্তী দূরত্ব হল চল্লিশ বছরের পথের দূরত্ব সমান। তাহলে জান্নাত কত বড়? কুরআন মাজীদ জানাচ্ছে-
سَابِقُوا إِلى مَغْفِرَةٍ مِنْ رَبِّكُمْ وَجَنَّةٍ عَرْضُهَا كَعَرْض السَّمَاءِ وَالْأَرْضِ أُعِدَّتْ لِلَّذِينَ آمَنُوا بِاللهِ وَرُسُلِهِ
তোমরা একে অন্যের অগ্রণী হওয়ার চেষ্টা কর তোমাদের প্রতিপালকের ক্ষমা ও সেই জান্নাত লাভের জন্য, যার প্রশস্ততা আকাশ ও পৃথিবীর প্রশস্ততা তুল্য। তা প্রস্তুত করা হয়েছে এমনসব লোকের জন্য, যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলগণের প্রতি ঈমান এনেছে।

জান্নাতের প্রশস্ততাই যখন আকাশ ও পৃথিবীর প্রশস্ততার সমান, তখন এর দৈর্ঘ্য তো আরও অনেক বেশিই হবে। এই সুবিশাল জান্নাত আল্লাহ তা'আলা মুমিন- মুত্তাকীদের জন্য প্রস্তুত করে রেখেছেন। সেখানে কোনও সংকীর্ণতা নেই। প্রত্যেকের চাহিদা পূরণের সর্বপ্রকার আয়োজন সেখানে বিদ্যমান। এক একজনের জান্নাত সমগ্র পৃথিবীর চেয়েও অনেক বড়। অতবড় জান্নাতের জন্য সুবিশাল প্রবেশদ্বার তো থাকাই স্বাভাবিক। তবে হাঁ, জান্নাতের ভেতরে ভীড় ও ঠাসাঠাসি না থাকলেও প্রবেশদ্বারের কথা আলাদা। এ সম্পর্কে হযরত উতবা রাযি. বলেন-
(নিশ্চয়ই এমন একদিন অবশ্যই আসবে, যখন তা ভীড়ে পরিপূর্ণ হয়ে যাবে)। কেননা জাহান্নামবাসীদের তুলনায় জান্নাতবাসীদের সংখ্যা কম হলেও সে কমটাও তো অসংখ্য। তাছাড়া আনন্দ-প্রবেশে কিছুটা ভীড়ই আনন্দদায়ক। এমন ক্ষেত্রে একটু ঠেলাঠেলি ও ধাক্কাধাক্কিতেই যেন মন ভরে।এক্কা দোক্কা প্রবেশ কেমন জলো ও নিষ্প্রভ লাগবে।

হযরত উতবা রাযি. যে সময় এ ভাষণ দিচ্ছেন, তখন ইসলামের দুর্বার গতি। একের পর এক রণক্ষেত্রে জয়ের ডঙ্কা বাজছে। সঙ্গে আসছে ঐশ্বর্য ও প্রাচূর্যও। প্রাচুর্যের সে ডামাডোলে উম্মত তার আখিরাতমুখী চিন্তা-চেতনা হারিয়ে ফেলবে না তো! তা যাতে হারিয়ে না ফেলে, সেজন্য আখিরাতের আলোচনার পাশাপাশি নিজেদের অতীত দিনের স্মৃতিচারণাও জরুরি।

ইসলামের সূচনাকলীন অভাব-অনটনের অবস্থা
কেমন ছিল ইসলামের সূচনাকাল? কী কঠিন অর্থসংকট ও খাদ্যাভাবের ভেতর দিয়ে এ উম্মতের প্রথম অভিযাত্রীদের সামনে এগোতে হয়েছে। হযরত উতবা রাযি. সে দিনগুলোর কথা স্মরণ করে বলেন-
(এমন একদিন গেছে, যখন) আমি নিজেকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে সাত ব্যক্তির মধ্যে সপ্তম জনরূপে দেখেছি। অর্থাৎ আমি একদম শুরুদিকের মুসলিম। সে সময়কার অবস্থা আমার চোখের সামনে। যে কঠিন পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে তখন চলতে হয়েছিল, আমি নিজেও তার একজন ভুক্তভোগী।

তখন আমাদের গাছের পাতা ছাড়া কোনও খাদ্য ছিল না। এমনকি (তা খেতে খেতে) আমাদের চোয়াল ক্ষতবিক্ষত হয়ে গিয়েছিল'। অর্থাৎ রুটি তো না-ই, এমনকি একদম সাধারণ যে খাদ্য- খেজুর, তাও ছিল না। প্রাণ বাঁচানোর জন্য আমাদেরকে গাছের পাতা পর্যন্ত খেতে হয়েছিল। সে কি মানুষের পক্ষে খাওয়া সম্ভব? ক্ষুধা নিবারণের তাগিদে তা খেতে গিয়ে আমাদের মুখে ঘা হয়ে গিয়েছিল। এই ছিল খাদ্যের অবস্থা। পোশাকের অবস্থা কেমন ছিল? তিনি বলেন-
والتقطتُ برْدَةً فَشَقَقْتُها بَيني وَبَيْنَ سَعْدِ بن مَالِكِ، فَاتَّزَرْتُ بنصفِهَا، وَاتَّزَر سَعْدٌ بنصفها
(এ অবস্থায় আমি একটি চাদর পেয়েছিলাম। আমি সেটি ফেড়ে আমার ও সা'দ ইবন মালিকের মধ্যে ভাগ করে নিয়েছিলাম। আমি সেটির অর্ধেক দিয়ে লুঙ্গি বানাই এবং সা'দ ইবন মালিকও অর্ধেক দিয়ে লুঙ্গি বানান)। অর্থাৎ পড়ে থাকা একটি চাদর আমি তুলে নিই। চাদরটি কার তা হয়তো জানা যাচ্ছিল না। অথবা জানা থাকলেও সেইসঙ্গে এই ধারণাও ছিল যে, এটি ব্যবহার করলে মালিক নাখোশ হবে না। তাই আমি সেটি ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিয়ে নিই। কিন্তু অভাব তো আমার একার নয়। সা'দ ইবন মালিক অর্থাৎ সা'দ ইবনে আবী ওয়াক্কাসেরও আমার মতোই অবস্থা। তারও লজ্জা নিবারণের সংকট। কাজেই আমি কাপড়টি ছিড়ে দু টুকরো করলাম। এক টুকরো দিয়ে আমি লুঙ্গি বানালাম, অপর টুকরো দিয়ে তিনি। এই ছিল আমাদের ইসলামের গুরুজীবনের অবস্থা। খাদ্যসংকট ও বস্ত্রসংকট উভয়ের মধ্য দিয়েই আমাদের আসতে হয়েছে। সেদিন যারা গাছের পাতা খেয়ে ক্ষুধা নিবারণ করেছে, এক টুকরো কাপড় দিয়ে কোনওমতে লজ্জা নিবারণ করেছে, আজ তাদের কেমন দিন যাচ্ছে তোমরাই দেখতে পাচ্ছ। তিনি বলেন-
(আর আজকে আমাদের প্রত্যেকেরই ভোর হয় এমন অবস্থায় যে, সে কোনও না কোনও শহরের শাসনকর্তা)। শাসনকর্তা ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় পদের ক্ষেত্রে হযরত উমর রাযি.- এর নীতি ছিল কেবল সাহাবায়ে কেরামকেই সেসব পদে নিয়োগদান করা। তার মধ্যেও তিনি প্রথম দিকের সাহাবীদেরকে অগ্রাধিকার দিতেন। সে কারণেই ইসলামের শুরু যমানার কষ্ট-ক্লেশ যেসব সাহাবী ভোগ করেছিলেন, পরবর্তীকালে তাঁরা রাষ্ট্রীয় কোনও না কোনও গুরুত্বপূর্ণ পদে সমাসীন হয়েছিলেন।

গুরুত্বপূর্ণ পদ বাহ্যত মর্যাদাকর, কিন্তু নৈতিক দিক থেকে বিপজ্জনকও বটে। নফস ও শয়তান এর মধ্য দিয়ে মানুষের নৈতিক স্খলন ঘটানোর চেষ্টা করে। ফলে অনেকেরই আখলাক-চরিত্রের অবক্ষয় দেখা দেয়। রিয়াযাত-সাধনার মাধ্যমে আত্মিক পরিশুদ্ধি অর্জিত না হলে এসব পদে ঢোকার পর কেউ অহমিকার শিকার হয়, কেউ প্রলোভনে পড়ে যায়, কেউ নির্দয়-নিষ্ঠুর হয়ে ওঠে। সাহাবীগণ তো সাধনা-মুজাহাদার মধ্য দিয়েই এসেছেন। তাই তাঁদের ক্ষেত্রে এ ভয় তেমন ছিল না। তা সত্ত্বেও হযরত উতবা রাযি., বলছেন-
(আমি নিজের কাছে বড় হওয়া ও আল্লাহর কাছে ছোট হওয়া থেকে আল্লাহ তা'আলার আশ্রয় গ্রহণ করছি)। অর্থাৎ সেনাবাহিনীর আমীর ও শাসনকর্তা পদে নিযুক্ত হওয়ার কারণে আমি যেন অহংকার-অহমিকার শিকার না হয়ে পড়ি। কেননা যে ব্যক্তি অহমিকার শিকার হয় সে নিজের চোখে নিজে বড় হয় বটে, কিন্তু আল্লাহর কাছে ছোট হয়ে যায়। এক হাদীছে এসেছে
من تواضع لله رفعه الله، فهو في نفسه صغير، وفي أعين النَّاسِ عَظِيم، ومن تكثر وضَعَهُ الله، فهو في أعين الناس صغير، وفي نَفْسِهِ كَبِيرٌ، حَتَّى لَهُوَ أَهْوَنُ عَلَيْهِمْ مِنْ كَلْبِ أَو خنزير
"যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্য বিনয় অবলম্বন করে, আল্লাহ তার মর্যাদা উঁচু করেন। সে নিজের কাছে থাকে ছোট, কিন্তু মানুষের চোখে বড়। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি অহংকার করে, আল্লাহ তাকে নীচ করে দেন। সে মানুষের চোখে থাকে ছোট, নিজের কাছে বড়। এমনকি সে মানুষের কাছে কুকুর ও শূকরের চেয়েও হীন হয়ে যায়।”

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. বক্তব্যের শুরুতে খুতবা পাঠ করা সুন্নত। খুতবার শুরুতে হামদ ও ছানা এবং শেষে أما بعد বলা চাই।

খ. কিয়ামত অতি নিকটে। অর্থাৎ পৃথিবী সৃষ্টির সূচনাকাল হিসেবে অতীত অপেক্ষা পৃথিবীর অবশিষ্ট কাল নিতান্তই কম।

গ. অন্তরে কিয়ামতের ভয় থাকা প্রকৃত ঈমানদারের বৈশিষ্ট্য।

ঘ. ঈমানদার ব্যক্তির কর্তব্য আখিরাতের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করা। সে প্রস্তুতি হল যত বেশি সম্ভৰ পুণ্য সঞ্চয়ে তৎপর থাকা।

ঙ. জাহান্নাম পাপীদের ঠিকানা। তা অত্যন্ত বিভীষিকাময়। তা থেকে বাঁচার জন্য ঈমান ও সৎকর্ম আঁকড়ে ধরতে হবে।

চ. জান্নাত মুমিন ও সৎকর্মশীলদের ঠিকানা। তাকওয়া-পরহেযগারীর মাধ্যমে তা অর্জন করা যায়।

ছ. ইসলামের সূচনাকাল ছিল অতি অভাব-অনটনের। সে কথা স্মরণ রেখে অভাব-অনটনের ক্ষেত্রে আমাদেরকে সবরের পরিচয় দিতে হবে।

জ. অভাব-অনটন ভোগ করার পর ঐশ্বর্য লাভ হলে অতীত দিনের কথা ভুলে যাওয়া উচিত নয়।

ঝ. গরীব অবস্থায়ও অন্য গরীবের প্রতি সহমর্মী থাকা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরামের আদর্শ।

ঞ. আল্লাহপ্রদত্ত কোনও নি'আমতকে অহংকারের বিষয়ে পরিণত করা উচিত নয়। সর্বাবস্থায় বিনয়ই আল্লাহ তা'আলার পসন্দ।
ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
tahqiqতাহকীক:তাহকীক চলমান